ক্লাস ইলেভেন কিংবা টুয়েলভে পড়ার সময় “কবি” পড়ে কেঁদেছিলাম। এবারে ভালো লাগলো না ক্যানো? আমি কি সিনিক হয়ে গেছি?
বর্ধমান জেলার যে-গ্রামটিতে গল্পের সূচনা হয়— “অট্টহাস” — এই তো গত শীতে সেই গ্রামের মন্দিরে ঘুরে এলাম (মূলত দুপুরের অসাধারণ ভোগ প্রসাদ খাওয়ার লোভে)। ২০২১-এর শীতেও গেছিলাম। খুব মনোরম একটা গ্রাম। বললে বিশ্বাস হবে কিনা জানিনা, এই উপন্যাসটা লেখার পরে কতো বছর কেটে গেছে, গ্রামটা কিন্তু এখনও প্রায় চোদ্দো আনা একইরকম রয়ে গেছে। অন্তত কাহিনির স্থানিক বিবরণ পড়ে যতটুকু আন্দাজ করা যায়। আরো যে সমস্ত জায়গার বিবরণ আছে, কাটোয়া, অগ্রদ্বীপ— এই জায়গাগুলো আমার বাড়ি থেকে খুব কাছে। আমি এই জায়গাগুলোর বর্ণনা আরো একটু আন্তরিকভাবে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, প্রেক্ষাপট এবং পরিবেশ নির্মাণ বাদ দিয়ে সারাক্ষণ ইমোশনের জাল বুনতে ব্যস্ত রইলেন তারাশঙ্কর।
এবং এই ইমোশনও আমার কাছে পাকা ইমোশন বলে মনে হয়নি। একরকম হাসির গল্প আছে, সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানো হয়। এই উপন্যাসে চিমটি কেটে চোখ দিয়ে জল বের করার বন্দোবস্ত করেছেন লেখক। আমি কি এখনও ইলেভেনে পড়ি নাকি?
উপন্যাসের একটা চরিত্রকেও আমার স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হয়নি। সারাক্ষণ এই প্রেম প্রেম ভালোবাসা ভালোবাসা নিয়ে প্যানপ্যানানি আর ভালো লাগেনা। আবার পাশাপাশি বউকে ঠ্যাঙানোর বৃত্তান্ত এমনভাবে লেখা হয়েছে যেন ব্যাপারটা নেহাতই জলভাত। তারাশঙ্করকে এতোটা ইন্সেন্সিটিভ হতে আমি আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। উপন্যাসের শেষের দিকে জীবন এতো ছোট কেনে ছোট কেনে ছোট কেনে করে মাথা খেয়ে নিয়েছে! জীবন যখন এতোই ছোটো, তাহলে অকারণে ঢং দেখিয়ে সেই মেয়েটাকে ছেড়ে এলে ক্যানো বাপু, যে তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসে? এইরকম ন্যাকাচরণ পুরুষমানুষ আমার সহ্য হয়না। (তাই বলে আবার বাইনারি নিয়মে এই চিন্তা করে বসবেন না যে পুরুষ বলতে আমি শুধুই “দিওয়ার” সিনেমার অমিতাভ বচ্চনকে বুঝি!)
বাংলার লৌকিক সমাজ ও লৌকিক সংস্কৃতির অভিজ্ঞান তারাশঙ্করের অন্যান্য লেখায় যতটা বাস্তবসম্মতভাবে প্রকাশ পেয়েছে, এই উপন্যাসে সেটা পায়নি। বরং বলা যেতে পারে বিকৃতভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ঝুমুর-এর মতো প্রাচীন এবং ঐতিহ্যশালী একটা সংগীতশৈলীর চর্চাকারীদের এই উপন্যাসে ভ্রাম্যমাণ দেহপসারিনী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তারাশঙ্কর নিজে রাঢ় বাংলার মানুষ ছিলেন। তিনি কীভাবে ঝুমুর শিল্পীদের এভাবে অসম্মান করতে পারলেন তাঁর উপন্যাসে? পাঠককে রসগোল্লার চ্যাটচ্যাটে রসমাখানো অবাস্তব “লাভ স্টোরি” গেলানোর চক্করে এটা না করলেই হতো না?
সবমিলিয়ে হতাশ হয়েছি। ঔপন্যাসিকের হঠকারিতায় এবং চরিত্রদের আদিখ্যেতায়— দুইভাবেই হতাশ হয়েছি। আমি কি সিনিক হয়ে গেছি? ঝুমুর গায়িকা মদ খেয়ে একটার পর একটা কাস্টমারের কাছে নিজের দেহ বিক্রি করছে, আর ঠিক সেইসময় গায়িকার দরদিয়া প্রেমিকটি নির্বিকার চিত্তে গাছের তলায় বসে কবিগান বাঁধছে, এইসব দেখলে সিনিক হবো না তো কী হবো?