We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
2020-2021 সালের ELEVEN-এ বাঙলা বিষয়ের সিলেবাসভূক্ত আছে, এই উপন্যাস—সেজন্যই পড়া। শখের নয়, বাধ্য হয়ে। প্রথমে খানিকটা বিরক্তি লাগলেও পরে কাহিনিতে ঢুকে গেলে মোটামুটি লাগবে। প্রথম পড়াটাই মজা। উপন্যাস টাইপ লাগছিলো, পরে যেহেতু কিউরোসিটি নাই, এমসিকিউ মার্ক করতে পড়া। অসম্ভব বোরিং ছিলো, তখন।
বাংলাদেশের গ্রামান্চল, এবং তা হতে উদ্বুদ্ধ জনগণের মানসিকতা, উইকনেস, সাইকোলজি হালকা ধরতে পারবেন। সেইসাথে টিপিক্যাল পির কালচারের একটা নমুনা আপনার সামনে লেখক দেখিয়েছেন। ভাষা খুবই সাবলীল, বাক্যগুলোও। কাহিনী ও পটভূমি পুরোটাই জুড়ে এক গ্রাম, একজন পির, একটা ধর্ম আর গ্রামের কিছু অতিসাধারণ বোকা জনগন, যারা প্রতিনিয়ত নানাজন কতৃক ম্যানুপুলেট হচ্ছে, যা তারা বুঝে না। আরেকটা ব্যপার, নানারকম খারাপের মাঝেও সবশেষে শুভবোধ জাগ্রত হওয়ার ব্যপারটাও বেশ ভালো।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সবচেয়ে বেশি পঠিত এবং আলোচিত উপন্যাস হলো লালসালু। আমাদের উপমহাদেশীয় সমাজব্যবস্থায়, যেখানে রাজনীতি এবং ধর্ম— এই দুটি বিষয়কে অগ্রাহ্য করে জীবন কাটানো যায়না, সেখানে এইরকম একটি উপন্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই উপন্যাসের চরিত্ররা মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলেও, উপন্যাসটির মূল বক্তব্য কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে নিয়ে নয়। চরিত্ররা মুসলমান না-হয়ে হিন্দু হলেও কোনো অসুবিধে ছিলো না। ধর্মকে যারা অসৎ উপায়ে ব্যবহার করে, প্রকৃত “বিধর্মী” আসলে তারাই। আস্তিক-নাস্তিকরা খামোখাই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারপিট করে মরে।
ওয়ালীউল্লাহর লেখা প্রথম উপন্যাস এটি। পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে তাঁর যে বিশেষ গদ্যশৈলী প্রত্যক্ষ করি আমরা, এই উপন্যাসে সেটি নেই। খুব আটপৌরে এবং গতানুগতিক ভঙ্গিতে তিনি একজন ভন্ড মানুষের গল্প শুনিয়েছেন। ধর্মকে যারা “ধান্দা” হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের প্রত্যেকের চরিত্রে একটা বিশেষ লক্ষণ দেখা যায়। তারা নিজেরা খুব ভালো করেই জানে যে, তারা মিথ্যেবাদী। একজন হিন্দু বাবাজি খুব ভালো করেই বোঝেন : এই যে তিনি ভক্তদের হাতে মন্ত্রপূত মাদুলি বেঁধে দিচ্ছেন, সেই মাদুলি বস্তুটি একটি খাঁটি ভাঁওতাবাজি। তার মানে, মানুষ যাকে ভগবানের প্রতিনিধি হিসেবে মান্য করছে, সেই লোকটাই ভগবানের সঙ্গে (এবং ভগবানের নামে) সবচেয়ে বড়ো ঠাট্টা-মশকরা করছে। সবচেয়ে নির্ভেজাল খাঁটি নাস্তিক তো তারাই! “জাগো গ্রাহক জাগো!”
ধর্মবিশ্বাস জিনিসটা খারাপ নাকি ভালো সেই আলোচনায় আমি যাবো না। আলোচনাটা এতো সহজও নয়। আমি বরাবর মেনে এসেছি, ঈশ্বরবিশ্বাস একটি ব্যক্তিগত বিষয় (পাহাড় বেশি পছন্দ নাকি সমুদ্র নাকি অরণ্য? —এটা যেমন একটা ব্যক্তিগত বিষয়)। আমি দেখেছি, জাগতিক সিরিয়াস সমস্যাগুলোর প্র্যাক্টিক্যাল সমাধানের উপায় যারা মাথা থেকে বের করতে পারেনা, তারাই ঈশ্বরকে নিয়ে বেশি টানাটানি করে। দুই পক্ষের ক্ষেত্রেই দেখেছি। তুই নাস্তিক না মুই আস্তিক (or vice versa)— এইসব ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপারে তারা খুবই গর্বিত এবং নিজেদের বুক চাপড়ে চাপড়ে বুক ব্যথা করে ফ্যালে। খুব সহজেই তারা একে অপরকে নস্যাৎ করে দ্যায়। “ওহ, তুই ভগবান মানিস (কিংবা মানিস না)? ব্যাস ব্যাস আর কিছু বলতে হবে না, আমি যা বোঝার বুঝে গেছি।” এখন তো আবার ফেসবুক টুইটার আছে— বারোয়ারি মাছের বাজার। যেসব তর্কের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হলো কে কাকে কতো বেশি হেনস্থা করতে পারে, অপমান করতে পারে, ছোটো করতে পারে— সেগুলো তর্ক নয়, টাইমপাস। ক্ষতিকর টাইমপাস। কাজ নেই খেয়ে দেয়ে, স্ট্যাটাস ছাড়ি ধেয়ে ধেয়ে।
এই টাইমপাসের ফাঁকেই, ফায়দা যাদের লোটার, তারা লুটে নেয়। লালসালু উপন্যাসেও লুটেছে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো নিয়ে যখন সাধারণ মানুষরা ব্যতিব্যস্ত থাকে, সেই সুযোগে তারা চোরের মতো সিঁধ কেটে মানুষের মনের ভিতরে প্রবেশ করে। দেখে মনে হয় এদের অপকর্মের সবচেয়ে বড়ো সহায় হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। আসলে তা নয়। এদের সবচেয়ে বড়ো সহায় হলো মানুষের চেতনার মধ্যে ঢুকে থাকা ভয়, অসহায়তা, ভীরুতা, কাপুরুষতা, লজ্জা। লালসালু উপন্যাসে এই সবকিছুই খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমার আপত্তি শুধু একটা বিষয়ে।
এই উপন্যাসের চরিত্র এবং ঘটনানির্মাণ আমার কাছে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়নি। গ্রামের মানুষদের এতো বুদ্ধি-বিবেচনাহীন বলে মানতে রাজি নই আমি। গ্রামাঞ্চলের মানুষ শিক্ষায় দীক্ষায় পিছিয়ে আছে, ঠিক কথা। কিন্তু একজন মাত্র মানুষ একটি মাজারকে অবলম্বন করে গোটা গ্রামকে দীর্ঘকাল (১২ বছরেরও বেশি সময়) বোকা বানিয়ে রেখেছে, কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি, রুখে দাঁড়ায়নি, এমনকি তার ভন্ডামি ধরতেও পারেনি। এই বিষয়টা আমার কাছে বেশ আষাঢ়ে কল্পনা বলে মনে হয়েছে। মূল ভন্ড চরিত্রটির মধ্যে আমি এমন সাংঘাতিক কিছু খুঁজে পাইনি যার দ্বারা গোটা গাঁয়ের মানুষের এরকম দীর্ঘকালীন ল্যাজেগোবরে অবস্থা হবে। উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহকে কেমন যেন খাপছাড়া বলেও মনে হয়েছে। বিশেষ করে শেষের দিকের কাণ্ডকারখানার মর্ম আমার বোধগম্য হয়নি।
সুলিখিত এবং সুমার্জিত না হওয়া সত্ত্বেও উপন্যাসটি দীর্ঘকাল যাবৎ পাঠকদের ভাবিয়েছে। তার কারণ, উপন্যাসে বর্ণিত সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত তো হয়নি বটেই, বরং এখনও বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। আস্তিকরা নাস্তিকদের প্রতি এবং নাস্তিকরা আস্তিকদের প্রতি ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। হেনস্থা করে কাউকে নিজের দলে টানা যায়না। ভয় দেখিয়েও না। আমরা বোধহয় শত্রু নির্বাচনে ভুল করে ফেলছি। পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে সফল নাস্তিক যিনি ছিলেন, তিনি কিন্তু গরম-গরম বিপ্লবী ডায়লগ মেরে, প্রতিপক্ষকে অপমান করে, ফেসবুকে চালাক-চালাক স্ট্যাটাস পোস্ট করে, কিংবা হাতাহাতি করে নিজের কাজ হাসিল করেননি। তিনি নিজের কাজ হাসিল করেছিলেন করুণার দ্বারা, সহমর্মিতার দ্বারা, সমঝোতার দ্বারা, সহানুভূতির দ্বারা। তাঁর নাম সিদ্ধার্থ গৌতম। ওরফে বুদ্ধদেব। এইযুগের ফেসবুক-টুইটারের ভার্চুয়াল মাস্তানদের চেয়ে অনেক কঠিন মাস্তান ছিলেন তিনি।
লালসালু দিয়ে ঢাকা পীরের মাজার হোক কিংবা গেরুয়া নামাবলী দিয়ে ঢাকা “জাগ্রত” দেবতার থান। এইসব জায়গায় যারা ভন্ডামির রাজত্ব চালাচ্ছে, তাদের মুখোশ খুলতে হলে আগে আমাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক চুলোচুলি বন্ধ করতে হবে। পরস্পরকে বুঝতে হবে। “যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”