Reviews with the most likes.
বাঙলা ভাষার অতীত, বর্তমান, ও ভবিষ্যৎ নিয়ে লেখা ছোট-বড় নানান দৈর্ঘ্যের ১৭টি প্রবন্ধ নিয়ে সংকলিত বই বাংলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য। নিজস্ব বিভিন্ন এজেন্ডা বাঙলা ভাষার আগ্রহী পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য সময়ে সময়ে কলম ধরেছেন গোলাম মুরশিদ; সে কারণেই, বাঙলা ভাষার ইতিহাস, সাহিত্য, ও বাঙালির ধর্ম নিয়ে আলোচনা করা এ বই প্রায়শয়ই একটি ‘সোশ্যাল কমেন্টারি' হয়ে উঠেছে। বেশ কিছু আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার জানলাম বইটি পড়ে, সেগুলোর একাংশই এখানে টুকে রাখছি।
বাঙলা ভাষার উৎস প্রসঙ্গে জনপ্রিয় একটি ধারণা রয়েছে যে এ ভাষার শতকরা ৯০টি শব্দই এসেছে আর্যদের মৌখিক ভাষা-প্রাকৃত-এবং লিখিত ভাষা-সংস্কৃত থেকে। গোলাম মুরশিদ এ ধারণাটির কিছুটা বিরোধীতা করেই তাঁর বই শুরু করেছেন। এর ব্যখ্যায় তিনি দেখিয়েছেন আর্যরা কোন পথে কীভাবে এ বাঙলায় এলো, এবং কীভাবে মানুষের মুখে মুখে ভাষার পরিবর্তন ঘটে আজকের আধুনিক বাঙলায় পরিণত হলো। ধারণা করা হয় আজ থেকে প্রায় ২৮০০ বছর আগে আর্যরা উত্তর ভারত থেকে গঙ্গা নদীর তীর ধরে এসে আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের গৌড় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এরপর তাদের একটি অংশ দক্ষিণ দিকে, এবং অপর অংশ পুব দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ছবিঃ প্রাচীন বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের মানচিত্র
আর্যদের মুখের ভাষাকে ‘প্রাকৃত' বলা হয়, সে আমরা মাত্রই জেনেছি। পূর্ব ভারতে যে প্রাকৃত ভাষাটি ব্যবহৃত হতো, সেটির নাম ‘মাগধী প্রাকৃত'। এই প্রাকৃত ভাষাটি বঙ্গ, আসাম, এবং ওড়িষায় এসে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী পারস্পারিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে নতুন একটি ভাষায় পরিণত হয়, যাকে অপভ্রংশ বলা হয়। অপভ্রংশের পর নতুন যে ভাষা তৈরী হয়, তাকে বলা হয় ‘অবহট্ট'। এই অবহট্টের আধুনিক বিবর্তিত রূপই হলো বাঙলা, ওড়িয়া, এবং অহমিয়া।
আর্যরা তো ভারতবর্ষে এলো ২৮০০ বছর আগে, কিন্তু এর আগে তারা কোথায় থাকতো? আজ থেকে প্রায় ৬ হাজার বছর আগে আর্যরা সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব ইওরোপের তৃণভূমিতে বাস করতো। এদের একটি দল পরবর্তীতে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে, এবং অপর একটি দল কৃষ্ণ সাগর ও ক্যাস্পিয়ান সাগরের মাঝ দিয়ে ইরান, আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষে চলে আসে। এই সব ক'টা অঞ্চলে তারা নিয়ে যায় তাদের ভাষা, যেটিকে পণ্ডিতেরা আজ ‘ইন্দো-ইউরোপিয়ান' ভাষা বলে অভিহিত করেন। ল্যাটিন, গ্রীক, সংস্কৃত-এই ভাষাগুলোর উৎপত্তি এই ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা থেকেই।
ছবিঃ ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা ছড়িয়ে পড়ার মানচিত্র।
বাঙলা ভাষা যে স্রেফ সংস্কৃতের একটি বিবর্তিত রূপ নয়, এর যে নিজস্ব একটি কাঠামো আছে, তার চমৎকার একটি আলোচনা এ বইতে আছে, যার চুম্বক অংশ এখানে টুকে রাখার লোভ সামলাতে পারছি না! বাঙলা ভাষায় অতীত কাল বোঝাতে ক্রিয়াপদের শেষে আমরা কিছু অর্থবিহীন ধ্বনি যোগ করি (যেমনঃ লাম, লো, লে-ছিলাম, ছিলো, ছিলে ইত্যাদি অর্থে)। এই ধ্বনিসমষ্টিকে ব্যাকরণের ভাষায় ক্রিয়া বিভক্তি বা কৃৎ প্রত্যয় বলা হয়। হিন্দীতে অতীত কাল বোঝাতে ক্রিয়ার শেষে “থা” যোগ করতে হয় (পড়া থা), ওড়িয়াতে যোগ করতে হয় “থিলা” (খাইথিলা)। উত্তর ভারতের আর কোন ভাষায় এই লাম, লে, লো প্রত্যয় যোগ করা হয় না। এটি বাঙলার একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। একইভাবে, ভবিষ্যৎকাল বোঝাতেও বাঙলায় আমরা “বো”, “বে”-এই প্রত্যয়গুলো ক্রিয়াপদের শেষে যোগ করি (করবো, করবে-ইত্যাদি অর্থে)। এছাড়া, “পাগলে কী না বলে”, “ছাগলে কী না খায়”-এসব বাক্যে কর্তার সাথে “এ” ধ্বনিটি যোগ করাও বাঙলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আরো রয়েছে নির্দেশক প্রত্যয়, যেমন -টা, -টি, -খানা ইত্যাদি (চিঠিটি, বইটা, এক খান ইত্যাদি অর্থে)। হিন্দীতে “এক চিঠ্টি” বাঙলায় এসে “একটা চিঠি” হয়ে যায়। এই নির্দেশক প্রত্যয়ও বাঙলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য।
বাঙলায় শব্দের শেষে যেমন অর্থবিহীন প্রত্যয় যোগ করে নতুন শব্দ তৈরী করা হয়, তেমনি শব্দের শুরুতেও প্রত্যয় যোগ করার রীতি রয়েছে, যাদের উপসর্গ বলা হয়। “উপ” শব্দটি নিজেই একটি উপসর্গ, যার যোগে তৈরী হয়েছে “উপহার”, “উপদ্বীপ”, “উপগ্রহ”, “উপপরিচালক”, “উপভাষা” ইত্যাদি শব্দগুলো। সংস্কৃত ভাষায় -অপ, -অধি, -অপি,-প্র-ইত্যাদি একুশটি উপসর্গ রয়েছে সত্যিই, তবে বাঙলারও প্রচুর নিজস্ব উপসর্গ রয়েছে, যেমনঃ অ+বেলা, আ+ধোয়া, কু+কথা, নি+খোঁজ, হা+ভাতে ইত্যাদি। ধারণা করা হয় এই প্রত্যয়গুলো সবই স্থানীয় অনার্য আদিবাসীদের ভাষা থেকে বাঙলায় এসেছে। বাঙলা ভাষার আরো দুটি বৈশিষ্ট্য হলো ধ্বন্যাত্নক শব্দ এবং জোড়া শব্দ-ব্যাকরণের ভাষায় যাদের বলা হয় শব্দদ্বৈত। ধ্বন্যাত্নক শব্দ দিয়ে ধ্বনির অনুকরণ করা হয়, যেমনঃ ঢংঢং, কুলকুল, ঘ্যান ঘ্যান, চুক চুক, খচ খচ ইত্যাদি। অপরদিকে, জোড়াশব্দের উদাহরণ হিসেবে আমরা আঁকাবাঁকা, এলোমেলো, রাজাবাদশা, ছোটবড়-ইত্যাদি শব্দগুলোর দিকে তাকাতে পারি। বাঙলা শব্দদ্বৈতের সঙ্গে সংস্কৃতের কোন যোগাযোগ নেই। বাঙলার নিজস্ব এই বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা উল্লেখ করে গোলাম মুরশিদ দাবী করেছেন বাঙলাকে কেবল সংস্কৃতের সরাসরি দুহিতা বলা ঠিক নয়।
বাঙলা ভাষার আরেকটি অন্যতম বিশেষত্ব এর পদক্রম। কেউ যদি বলে, “north side-এর right corner-এর tube lightটা on করো”-তাহলে অতোগুলো ইংরেজি শব্দ থাকার পরও ভাষাটাকে বাঙলাই বলতে হয় “এর”, এবং “টা” প্রত্যয়গুলোর জন্য। এছাড়াও, “lightটা” এখানে কর্ম (object), আর on করো হলো ক্রিয়া, এদের পদক্রম বলে দেয় এই ভাষাটা বাঙলা। অপরদিকে, কেউ যদি বলে, “it was raining, তাই ঠিক করলাম, going out won't be right”, তাহলে ভাষাটা পদক্রমের জন্য ইংরেজিই হবে। বাঙলায় বলতে হলে বলতে হতো, “going outটা right হবে না”। কোন পদটা কখন কোথায় বসছে তা-ই মূলত নির্ধারণ করে দেয় ভাষাটা আসলে কী। এ প্রসঙ্গে আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ দেয়া যায়; সংস্কৃত ভাষার “নরো ব্যাঘ্রং হন্তি” বাক্যটির মানে দাঁড়ায় “মানুষ বাঘ মারে”। এই তিনটি শব্দকে আগে পরে যেভাবেই সাজানো হোক না কেন (নরো হন্তি ব্যাঘ্রং, হন্তি ব্যাঘ্রং নরো, ব্যাঘ্রং নরো হন্তি...ইত্যাদি), তাতে বাক্যের অর্থ পরিবর্তিত হয় না। কিন্তু বাঙলায় “মানুষ বাঘ মারে”, আর “বাঘ মানুষ মারে”-এই দুটি বাক্য সম্পূর্ণ উল্টো অর্থ প্রকাশ করে। বাঙলা ভাষা চেনার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এর এই পদক্রম (কর্তা+কর্ম+ক্রিয়া)। প্রায় হাজারখানেক বছর আগে লেখা চর্যাপদের ভাষা যে মূলত বাঙলা তা এই সকল সূত্র মিলিয়েই নির্ধারণ করা।
চর্যাপদ যে খাঁটি বাঙলা ভাষায় লেখা-এ দাবী করাটাও পুরোপুরি ঠিক নয় সত্যি বলতে, কারণ, চর্যায় প্রাচীন ওড়িয়া, ও প্রাচীন অহমিয়া ভাষার নিদর্শনও পাওয়া যায়। যে সময়ে চর্যা রচিত হয়, তখনও বাঙলা, অহমিয়া, ও ওড়িয়া নিজস্ব রূপ পুরোপুরি পায়নি। খাঁটি বাঙলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো নমুনা হিসেবে বর্তমানে বড়ু চণ্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”কে শনাক্ত করা হয়। এর রচনাকাল নিয়ে তর্ক রয়েছে; সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়-এর মতে এর রচনাকাল ১৪ শতকের শেষ দিকে, আর সুকুমার সেন রায় দিয়েছেন এই পুঁথির রচনাকাল কোনমতেই ১৭ শতকের আগে নয়। চর্যাপদের সাথে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষার বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে, সর্বনামের ভিন্নতা তার মাঝে অন্যতম। চর্যাপদ, ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ব্যবহৃত উত্তম পুরুষ, ও মধ্যম পুরুষের সর্বনামগুলোর তালিকা বানালে তা দেখতে কতকটা এমন হয়ঃ
এই সর্বনামগুলোর প্রায় সবই আজ বিলুপ্ত; আধুনিক বাঙলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সর্বনাম ‘আমি' তখনো জন্ম নেয়নি। এ সর্বনামটির প্রথম আবির্ভাব ১৫ শতকের শেষের দিকে, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়”-এ। এরপর ষোল শতকের মধ্যভাগ অব্দি আরো বেশ অনেকের লেখাতেই ‘আমি' এসেছে, তবে সে সময়ে ‘আমি', এবং ‘আমিসব' দিয়ে ‘আমরা' বোঝানো হতো। অহমিয়া ভাষায় এখনো ‘আমি' বহুবচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে ওড়িয়াতে বহুবচনে ব্যবহৃত হয় ‘আম্ভে', যার আদিরূপ ‘আহ্মে'।
মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বছর চল্লিশেক পর চৈতন্যদেব তাঁর বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার শুরু করেন আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায়। ১৫৩৩ সালে চৈতন্যদেব মারা যাবার পর তাঁর চ্যালাচামুণ্ডারা সম্ভবত বৈষ্ণবধর্মকে বিধিবিধানে পূর্ণ একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে পরিণত করেন (অরগ্যানাইজড রিলিজিয়ন)। মুরশিদের মতে এই চ্যালারা প্রায় সবাই-ই সংস্কৃত-পণ্ডিত ছিলেন, যাঁরা নাকি ফতোয়া জারি করেন, বাঙলায় লেখা পুরাণ (রামায়ন/ মহাভারত) চর্চা করলে রৌরব নরকবাস নিশ্চিত। এ ধরণের ফতোয়ার কারণে চর্যাপদ এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনকে ঘিরে যে লৌকিক বাঙলা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিলো তা বেশ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং অতি-সংস্কৃতায়ণের দরুন একধরণের কৃত্রিমতা গেঁড়ে বসে বলে গোলাম মুরশিদ মন্তব্য করেছেন।
বাঙলা গদ্যে পুরোদমে বই লেখা শুরু হয় ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর। এ কলেজের পণ্ডিতেরা প্রায় সবাই-ই ছিলেন সংস্কৃত বিশেষজ্ঞ। মুরশিদের মতে এঁরা দেশী, এবং আরবী-ফার্সি শব্দ যতখানি সম্ভব পরিহার করে সংস্কৃত শব্দের আধিক্যে বেশ কিছু বই লেখেন, এবং এই সংস্কৃতায়ণ করতে গিয়ে নিজেদের বানানো কিছু ছদ্ম-সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেন। এমনই একজন পণ্ডিত রামরাম বসুর বানোয়াট সংস্কৃত শব্দের একটি তালিকা মুরশিদ দিয়েছেনঃ
রামরাম বসুর অতি-সংস্কৃতায়ণের একটি উদাহরণ মুরশিদ দিয়েছেন; বসু ‘গাত্রমোচন' শব্দটি লিখেছেন তাঁর রচনায় ‘গা মোছা' অর্থে। মুরশিদের মতে গা না লিখে গাত্র লেখাটা সংস্কৃতের প্রভাব বটে, কিন্তু আসল মুশকিলটা হলো ‘মোচন' শব্দটির অর্থ ‘মোছা' নয়, বরং ‘মুক্তি দান'। এভাবে গা মোছাকে বসু জাতে তুলতে চেয়েছেন বলে মুরশিদ মন্তব্য করেছেন। রামরাম বসুর পাশাপাশি মুরশিদ উল্লেখ করেছেন গোলোকনাথ শর্ম্মার কথা; তিনি ‘অবিদ্বান' কে অবিদ্যান, ‘কর্ত্তব্য'কে কর্ত্তব্ব, ‘মিত্রতা'কে মৈত্রতা ইত্যাদি বানানে লিখে এমন সংস্কৃতায়ণের চেষ্টা করেছেন। মুরশিদের মতে সংস্কৃতায়ণের বিষয়ে এই পণ্ডিতদের পথপ্রদর্শক ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার।
১৮৫৪ সালে প্যারীচাঁদ মিত্র প্রথম বাঙলা উপন্যাস আলালের ঘরে দুলাল লেখা শুরু করেন। সমাজ-সংস্কারের উদ্দেশ্যে লেখা কিছুটা উপদেশমূলক এ উপন্যাসে দেখা যায় ধনী পরিবারের বড় ছেলেটি আদরে বখে গেছে, এবং ছোট ছেলেটি লেখাপড়া শিখে আদর্শ চরিত্রের এক তরুণে পরিণত হয়েছে। মুরশিদের মতে, এ উপন্যাসে লেখক ভাষা নিয়ে একটি সূক্ষ্ম খেলা খেলেছেন; যে চরিত্রগুলো অনুকরণযোগ্য, তাদের মুখে বসিয়েছেন সাধু ভাষা, কিন্তু আড়ষ্ট সে ভাষা সে চরিত্রগুলোকে বেশ অনেকটাই নাকি প্রাণহীণ করে তুলেছে। অপরদিকে উপন্যাসের মন্দ চরিত্রগুলো কথা বলে কথ্য অশিষ্ট ভাষায়, যাতে প্রচুর আরবী-ফার্সি শব্দের ব্যবহার রয়েছে। এ চরিত্রগুলো নাকি তুলনামূলক বেশ অনেকটাই জীবন্ত ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। কথ্য ভাষার প্রয়োগে কোন গল্প লেখার প্রথম প্রয়াসও বোধহয় এটিই। খাঁটি মৌখিক ভাষার প্রথম সত্যিকার প্রয়োগ লক্ষ করা যায় কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা (সম্ভবত) হুতোম প্যাঁচার নকশায় (১৮৬১-৬৩)। মুরশিদ উল্লেখ করেছেন এ বইতে বানানরীতি বেশ আধুনিক, অনেকটা যেন উচ্চারণকে অনুসরণ করেই লেখা (যেমনঃ গেলো থেকে গ্যালো)। শ্রেণীভেদে ভাষার এমন ভিন্নতা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতেও দেখা যায়। তাঁর উপন্যাসে সংলাপ সাধু ও চলিতের মিশ্রণে গঠিত; মুরশিদের মতে, বিশেষতঃ নিম্নশ্রেণীর এবং অশিক্ষিত নারী চরিত্ররা বেশীরভাগ সময়ে কথ্য ভাষায় কথা বলে। তিনি উল্লেখ করেছেন, বঙ্কিমের উপন্যাসে স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথনের দৃশ্যে দেখা যায় স্বামী কথা বলছেন সাধু ভাষায় আর স্ত্রী চলিত ভাষায়।
হিন্দু পুরোহিতরা যেমন বাঙলাকে ধর্মচর্চার অনুপযোগী মনে করেছেন, তেমনি মুসলমান মোল্লারাও বাঙলাকে ‘কুফরি জবান' বলে অভিহিত করে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিতে চেয়েছেন বারেবারে। মুরশিদ আলোচনা করেছেন বাঙালি মুসলমান আদৌ বাঙালি কি না, সে নিয়ে কীভাবে ১৯২০-এর দশক অব্দি পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। মুরশিদের আলোচনায় উঠে আসে কয়েকজন প্রগতিশীল মুসলমান চিন্তাবিদের নাম (হামেদ আলী, এবং সৈয়দ এমদাদ আলী), যাঁরা নূর-অল-ইমান, নবনূর, বাসনা ইত্যাদি পত্রিকায় কড়া ভাষায় প্রবন্ধ লিখে বাঙালি মুসলমানদের একটি দলকে বেশ কড়কে দিয়েছেন। তাঁদের মতে এই দলটির অন্তর্গত বাঙালি মুসলমানেরা সাতশ বছরের বেশি সময় ধরে এ বাঙলায় বাস করেও ইরাক-ইরান-কোহেকাফের স্বপ্নে বিভোর থাকেন।
মুরশিদ তাঁর বয়ানে প্রগতিশীল এই মুসলমান লেখকদের বিপরীত দাঁড় করিয়েছেন শেরে বাঙলা খ্যাত এ কে ফজলুল হককে। মুরশিদ উল্লেখ করেছেন হক বাঙলাভাষী হয়েও উর্দু শেখানোর পক্ষে ছিলেন, এবং বাঙলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়াও, '৭১ সালে স্বাধীন হবার আগ পর্যন্ত পূর্ব বাঙলায় যে সত্যিকার অর্থে স্থায়ী কোন সরকার আসেনি, এর জন্যও ফজলুল হককে বেশ অনেকটাই দায়ী করেছেন মুরশিদ। তাঁর মতে, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলীম লীগকে বিপুল ব্যবধানে হারাবার পর যুক্তফ্রন্ট (আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজাম-ই-ইসলামী, এবং গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে গঠিত মহাদল) যখন ফজলুল হককে মুখ্যমন্ত্রী বানাবার সিদ্ধান্ত নেয়, তিনি তখন সবচেয়ে বড় দল আওয়ামী লীগকে ন্যায্য আসন দিতে অসম্মতি দান করেন। পরে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতায় এলেও শপথ গ্রহণের মাত্র ২ সপ্তাহ পরেই ফজলুল হকের সে মন্ত্রীসভা বাতিল করতে হয়। মুরশিদ মন্তব্য করেছেন এর পর কৃষক-শ্রমিক পার্টি, আওয়ামী লীগ, ও ফজলুল হক শুধু প্রতিযোগীতা করে গেছেন কে পাকিস্তান-গভর্নরের মন বেশি যুগিয়ে চলতে পারেন। প্রথম ১১ বছরে পূর্ব পাকিস্তানে ৯টি মন্ত্রীসভা শপথ নিয়েছে; এই অস্থিরতার দায় মুরশিদ শেরে বাঙলাকেই দিয়েছেন।
দেশভাগের বেশ কয়েক দশক আগে থেকেই বাঙালি হিন্দু, এবং বাঙালি মুসলমান বারবার দাঙ্গায় জড়ালেও '৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ফলে হিন্দু-মুসলমান দলাদলিটা বেশ খানিকটা কমে আসে-এমন একটি ইঙ্গিত মুরশিদের এ বইতে পাওয়া যায়। মুরশিদের দাবী, সাহিত্য, এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আংশিকভাবে হলেও অসাম্প্রদায়িক মনোভাব গড়ে উঠতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করেছেন মৈত্রেয়ী দেবী এবং গৌরী আইয়ুবের মতো প্রগতিশীল মানুষদের কথা যাঁরা দাঙ্গা বিরোধী সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন; সাম্প্রদায়িক মৈত্রী বাড়াবার উদ্দেশ্যে এই সংস্থা থেকে তাঁরা নবজাতক, এবং ব্রাদার্স ফেইস নামে দুটি পত্রিকাও চালু করেছিলেন। দুই বাঙলার এই মৈত্রী '৭১-এ বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আরো সম্ভবত দৃঢ় হয়। মুরশিদ বলেছেন '৬৪-এর দাঙ্গার সময় আনন্দবাজার পত্রিকা-গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে হলুদ সাংবাদিকতা করেছে বটে, কিন্তু '৭১ সালে তার ভূমিকা আমূল বদলে যায়, বাঙলাদেশের আন্দোলনে নানাভাবে তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও বহু শরনার্থী অধ্যাপককে চাকরিতে নিয়োগ দেয় সে সময়। মুরশিদের বয়ানে জানতে পাই '৭১ সালে নাকি কলকাতার দূর্গাপূজার মণ্ডপে দেবদেবীর মূর্তির পাশে শেখ মুজিবের ছবিও টাঙানো হয়েছিলো!
এ বইয়ের একটি প্রবন্ধে '৫২'র ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকা, এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনাবলীর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী আছে। এ লেখাটি পড়লে দুটো ব্যাপার চোখে পড়ে। প্রথমত, ভাষা-আন্দোলনকারীদের দমাবার জন্য আইয়ুব খানের সরকার যে পন্থা অবলম্বন করে, তার সাথে '২৪-এর জুলাই-আন্দোলন দমাবার জন্য হাসিনা-সরকারের পন্থার আশ্চর্য মিল; অনেকটা যেন আইয়ুব খান এবং শেখ হাসিনা একই মায়ের সন্তান, একই তাদের জিনগত বৈশিষ্ট্য, একই তাঁদের চরিত্র, এবং একই তাঁদের শিক্ষার্থী খুন এবং লাশ গুম করবার তরিকা। মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটি '৫২, এবং '২৪-দুইয়েরই প্রেক্ষিতে ভীষণ প্রাসঙ্গিক। দ্বিতীয়ত, নিজের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের ব্যাপারে পূর্ববাঙলার মানুষের সচেতনতা। '৫২, এবং '২৪-এ ছাত্র-জনতার এক হবার patternটা একই রকম, আবেগটা একই জায়গায় গাঁথা। আমার ধারণা, পূর্ব বাঙলার বাঙলাভাষী এই মানুষদের ওপর জোর করে কোন সিদ্ধান্ত সহজে চাপিয়ে দেয়া যাবে না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা বারবারই রুখে দাঁড়াবে।
ঐতিহাসিক বিভিন্ন তথ্য বাদে এ বইতে গোলাম মুরশিদের নিজস্ব যে বিশ্লেষণ ও মতামত রয়েছে, তার বেশিরভাগের সাথেই আমি একমত নই। নতুন কোন পরিবর্তনকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করতে মুরশিদ সম্ভবত আগ্রহী নন। বাঙলাদেশের টিভি নাটকের সংলাপে, এবং রেডিওর বয়ানে আপাতঃ অশিষ্ট কথ্য ভাষার ব্যবহার নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন বারবার। অথচ নিজেই তিনি প্রচুর যুক্তি দেখিয়েছেন কীভাবে বিভিন্ন সময়ে মানুষের মুখে মুখেই ভাষার বড় পরিবর্তনগুলো এসেছে। আগের সময়ের পরিবর্তন ভালো, বর্তমানেরটা নয়-এমন একটি পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় তিনি দিয়ে গেছেন বইয়ের শেষার্ধ জুড়ে। বাঙলাদেশের মানুষ বিভিন্ন আঞ্চলিক টানে কথা বলে যাঁদের অনেকেই উন্নত জীবন যাত্রার উদ্দেশ্যে রাজধানীতে চলে যাবার পর ঢাকা শহরের চলিত কথ্যরীতিটি গ্রহণ করেন। বিশেষত তরুণসমাজের মুখে প্রচলিত এই কথ্য ভাষাটি মুরশিদ পছন্দ করেন না। মাত্র ২ সপ্তাহ আগেই মুরশিদ পরলোকগমন করেছেন; মৃত্যুর আগে তিনি বাঙলাদেশের জুলাই-আন্দোলন দেখে গেছেন। এ আন্দোলনে বারুদ যুগিয়েছে আওয়াজ উডা, কিংবা কথা ক গানগুলো। তরুণসমাজের অশিষ্ট এ ভাষাও কীভাবে প্রতিবাদের দুরন্ত হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে সেটি মুরশিদ দেখে গেছেন কি না জানি না। এ গান শোনার রূচি হয়তো তাঁর হতো না, কিন্তু কথ্য ভাষার শক্তির এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
এই প্রবন্ধগুলোর বেশিরভাগই আওয়ামীলীগের শাসনামলে লেখা (২০০৮-২০১৯), তাই শাসক গোষ্ঠীকে তুষ্ট করার একটা প্রচ্ছন্ন প্রবণতাও যেন লক্ষ করা যায়। জামাত সহ বাঙলাদেশের ইসলামী দলগুলো বাঙলা ভাষার মুসলমানী করাবার ষড়যন্ত্রে রত-এই অভিযোগ তুলে মুরশিদ অসংখ্যবার আওয়ামীলীগের শত্রু এই দলগুলোকে গালমন্দ করেছেন, কিন্তু স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থায় কেন এমন ইসলামী দলগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সে আলোচনায় কখনোই যাননি। গোটা বইতে প্রচুর স্ববিরোধও চোখে পড়ে; জীবন-সায়াহ্নে এসে লেখা এই প্রবন্ধগুলোতে মুরশিদকে প্রায়ই খেই হারাতে দেখা গেছে।
সবশেষে, বইটির সম্পাদনা অত্যন্ত নিচু মানের। একই ধাঁচের বক্তব্য সংবলিত একাধিক প্রবন্ধ বিনা সম্পাদনায় বইতে যোগ করা হয়েছে, তাতে বইটির ওজনই বেড়েছে অনর্থক। অন্তত ৫০-৬০ পাতা কমিয়ে আনা যেতো অনায়াসেই। গোলাম মুরশিদ প্রথম আলো'র ভাষাগত গুণ্ডামি নিয়ে কথা বলেছেন; প্রথম আলোতে লেখা ছাপাতে হলে তাদের নিজস্ব বানান-রীতি শিখে আসতে হয় এমন মন্তব্য করেছেন। বইটি প্রথম আলো'র মালিকানাধীন সংস্থা থেকেই বেরিয়েছে। গুণ্ডামির সীমারেখাটা আরেকটু বাড়িয়ে মুরশিদের পুণরাবৃত্তিমূলক লেখাগুলোর ওপর কলম চালালেই পারতেন তাঁরা। এছাড়া, প্রচুর মুদ্রণ-প্রমাদ ও ভুল বানানও রয়েছে। বইটির নামকরণ নিয়েও আমার আপত্তি আছে; বাঙলা ভাষার উদ্ভব ও অন্যান্য-নামটি আমার দৃষ্টিতে বেশ lazy। বিভিন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা বিভিন্ন রকম বক্তব্যের এই লেখাগুলোকে এক মলাটে ধরতে গিয়ে লেখক-প্রকাশকের কেউই নামকরণের ব্যাপারে সৃষ্টিশীলতা দেখাতে পারেননি। প্রকাশ প্রকাশক প্রথমা হার্ডকাভারে সজ্জিত চমৎকার বাঁধাইয়ের এ বইয়ের দাম হাঁকিয়েছে ৫০০ টাকা; রুচিশীল পাঠকের কাছে এর অর্ধেকটাই ফালতু খরচ হিসেবে ঠেকবে।