আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু

আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু

2009 • 64 pages

Ratings1

Average rating5

15

গদ্যশৈলীর মৌলিকতা, কাহিনির ভিতরে সম্পৃক্ত দ্বন্দ্ব, চরিত্র নির্মাণ, পাঠকালীন উপলব্ধি— সব দিক দিয়ে বিচার করে আমার মনে হয়েছে, এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ। এই উপন্যাসটির সঙ্গে লেখকের অন্যান্য জনপ্রিয় উপন্যাসের তুলনা এবং রেটিং-রেটিং খেলায় মত্ত হবো না আমি ; শুধু নিজের ভালোলাগার কারণগুলো খুব সংক্ষেপে লিখে রাখার চেষ্টা করবো এখানে।

উপন্যাসটির একটা মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর নির্লিপ্ততা। আমার কাছে আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম প্রকৃষ্ট লক্ষণ এটা। পাঠকের মতো লেখকও নিজেকে উপন্যাসের চরিত্রদের থেকে আলাদা করে রেখেছেন। নিজের মতামত/দর্শন আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেননি। তিনি স্রষ্টা হয়েও তাঁর হাবভাব স্রষ্টার মতো নয়, পাঠকের মতোই তিনি একজন দর্শক মাত্র। সেই কারণেই, আবু ইব্রাহিম যে মারা যেতে চলেছেন, এই স্পয়লারটা তিনি উপন্যাসের সর্বপ্রথম লাইনেই আমাদের জানিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। মুখ্য চরিত্রের অন্তিম পরিণতির ব্যাপারটা কাহিনির শুরুতেই বিবৃত করে দেওয়ার পরে, একটি নাতিদীর্ঘ এবং নির্লিপ্ত গল্পকথনের সূচনা করেন লেখক। প্রশ্ন হলো, ক্যানো মারা গেছিলেন আবু ইব্রাহিম?

আবু ইব্রাহিমের জীবনটা আমাদের নিজেদের জীবনের মতোই। তার মতো আমরাও “শর্টকাট” পদ্ধতিতে নিজেদের চারিত্রিক ভীরুতাকে জয় করতে চাই (এবং শেষ পর্যন্ত আরো বেশি ভীরু হয়ে যাই)। তার মতোই আমরা ঘুষ খাবো কি খাবোনা ভেবে রাতের ঘুম নষ্ট করি। খুব ইচ্ছে থাকলেও, স্রেফ সাহসের অভাবে আমরা অসৎ (কিংবা লম্পট) হতে পারিনা। সততার ফালতু মুখোশটা নিজেদের মুখের উপর লেপ্টে রেখে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াই। তার মতোই নিজেদের বউয়ের ব্যাপারে “পৃথুলা”, “স্থূলকায়া”, এইসব শব্দ চিন্তা করি, কিন্তু রাত্রিবেলায় বিছানায় বসে উপলব্ধি করি, এই মেদবহুল দেহটা থেকেই আনন্দ সংগ্রহ করে নিতে হবে, আপাতত হাতের কাছে দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই।

যখন “অপশন” এসে হাজির হয়? প্রাক্তন প্রেমিকা কিংবা অফিসের সহকর্মী। চান্স পেলে তখন সেই বিকল্প দেহটাকে আমরা উপভোগ করতে সচেষ্ট হই। ভুল বললাম। আমরা তো ভীরু এবং কাপুরুষ। সচেষ্ট হওয়ার বিষয়টা কেবল মনে মনেই কল্পনা করি। তাকে ডাকবো। বন্ধুর ফাঁকা ফ্ল্যাটে। দুপুরবেলা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি সেই নতুন দেহটাকে কব্জা করতে পারি আমরা? আবু ইব্রাহিম পেরেছিলেন তার “অপশন”কে কব্জা করতে?

জীবনের এইসব হাজাররকম “সম্ভাবনা”কে মগজের মাংসের খাঁজে প্রতিনিয়ত বহন করে চলি আমরা। সফল হওয়ার সম্ভাবনা। দৈহিক সুখলাভের সম্ভাবনা। শহরে নিজস্ব একটি বাড়ির মালিক হওয়ার সম্ভাবনা। পোষা কুকুরের মতো আজীবন পায়ের কাছে লুটোপুটি খাওয়া নিজেদের কাপুরুষতাকে, ভীরুতাকে, জয় করার সম্ভাবনা। বিভ্রান্তিতে ভরা বালের এই বোকাচোখা জীবনটার তেলতেলে ঘৃণ্য খোলস ত্যাগ করে ঝাঁ-চকচকে স্মার্ট জামাকাপড় পিন্দনের সম্ভাবনা। আবু ইব্রাহিম তো আসলে আমরাই। আবু ইব্রাহিমও সম্ভাবনার সুইমিংপুলের সাইডে দাঁড়িয়ে ভেবেছিলেন, জলের মধ্যে লাফ মারবো কি মারবো না? আবু ইব্রাহিম মারা গেছিলেন। তবে জলে ডুবে নয়।

শহীদুল জহিরের এই উপন্যাসটি তিনি বেঁচে থাকতে বই আকারে প্রকাশ করা হয়নি, যদিও পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল অনেক আগেই। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সরকারি উচ্চপদস্থ আমলা। এই উপন্যাসটিতে বেশ খোলামেলাভাবে তিনি আমলাতন্ত্রের ভন্ডামি, দুর্নীতি এবং দ্বিচারিতাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটি পড়লে আন্দাজ করা যায়, তাঁর পেশাগত অভিজ্ঞতার কিছু বাস্তব উপাদান তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন কাহিনিতে। এই কারণেই তাঁর জীবিতাবস্থায় বইটি ছাপা হয়নি। কাক যেমন কাকের মাংস খায়না, তেমনি নিজে আমলা হয়ে সহকর্মী-আমলাদের মাংস খাওয়া যায়না।

যাই হোক, আবু ইব্রাহিম ইজ আপাতত ডেড।

কিন্তু তবুও, লং লিভ আবু ইব্রাহিম। এই কথা তো বলাই বাহুল্য।

April 12, 2023Report this review