Ratings1
Average rating4
Reviews with the most likes.
“পাহাড়ের মানুষ মানেই সরল (পড়ুন : বুদ্ধিহীন), আবেগপ্রবণ (পড়ুন : রগচটা), সাধাসিধে (পড়ুন : অল্পে খুশি) ও অনুগত (পড়ুন : প্রশ্ন করে না, সহজে বশ্য, গৃহপালিত পশুর মতো) — সমতলের বাঙালির এই ধারণাগুলো শাসকের মতো, প্রতিবেশীর মতো নয়। এই ধারণার চাষ হতে দেখেছি প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে। এই চাষ থেকে উঠে এসেছে যে ফসল তার নাম : ক্ষোভ।”
আমার মতো সমতলের মানুষদের কাছে দার্জিলিং স্রেফ একটি শৈলশহরের নাম। দার্জিলিং তো যেকোনো হেঁজিপেজি শৈলশহর নয়, ইংরেজরা একে আদর করে ডাকতো “The Queen of Hill-stations” নামে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে আরো গর্বের ব্যাপার হলো দার্জিলিং আমাদেরই রাজ্যে অবস্থিত। হাতে যদি দিন-তিনেকের ছুটি পাওয়া যায়, ছাপোষা বাঙালি তিনটে জায়গায় দৌড়ে যায়। দীঘার সমুদ্রসৈকত, শান্তিনিকেতন, অথবা দার্জিলিং। কিন্তু একদা যে-শৈলশহরটি ছিল পাহাড়ের রানি, সেই রানি আজ কাঙাল হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক, যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখা হোক না ক্যানো, অধুনা একটি দীর্ঘশ্বাসের নাম দার্জিলিং।
লেখক প্রথম দার্জিলিঙে যান কর্মসূত্রে। নিবিড় কুয়াশাঘেরা এবং স্মৃতির মলিন জলরঙে আঁকা এই শহরটিকে আপন করে নেন ধীরে ধীরে। সাধারণ বাঙালি ট্যুরিস্টের আদিখ্যেতা-মার্কা নজরের বাইরে একটা আলাদা নজরে এই শহরকে দেখতে শুরু করেন। যে শহরকে আমরা ভালোবাসি সেই শহরের সমস্যাগুলো আমরা এড়িয়ে যাই না। সেই শহরের মানুষদের আমরা “ইউজ অ্যান্ড থ্রো” হিসেবে ব্যবহার করি না। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করি, তাদের সুখ-দুঃখ-স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গের দিনলিপির সঙ্গে পরিচিত হই। এক অনবদ্য মুনশিয়ানায়, আন্তরিকতায়, অভিনিবেশে, লেখক এই বিরল কাজটি করেছেন। শুধু নস্টালজিয়ার রঙিন চশমাটি নাকে ঝুলিয়ে রাখেননি, হাতে রেখেছেন আরো দুটো জিনিস। একটা আয়না আর একটা আতসকাচ।
কীভাবে একটি শহর হয়ে যায় মানুষের অন্ধ ফুর্তিবাজির শিকার। কীভাবে একটি শহর হয়ে যায় ভোট-রাজনীতির ক্রমিক ক্রীড়নক। কীভাবে একটি গোটা শহরের মানুষ হয়ে যান বহিরাগত ফুর্তিবাজদের একনিষ্ঠ চাকরবাকর। কীভাবে একটি শহরের রমণীয় সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আত্মপরিচয়হীন অস্তিত্বের তীব্র যন্ত্রণা। কীভাবে একটি প্রজাপতির অতীত ইতিহাসজুড়ে লেখা থাকে কেবল শুঁয়োপোকার কুৎসিত দংশন। আমরা যারা একবারের জন্যেও দার্জিলিঙে গেছি, পরিমল ভট্টাচার্যের এই হতশ্রী দার্জিলিংকে কিন্তু কমবেশি আমরা সবাই চিনি। কিন্তু ফুর্তির নেশায় অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে ছিলাম। সূর্যোদয়ের মনভোলানো কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখে হুল্লোড়ে মেতে ছিলাম, তাই আপামর শহরটার ক্ষীণ কান্নার শব্দ আমাদের কানে এসে পৌঁছায়নি। লেখক আমাদের চোখ আর কান দুটোই খুলে দিয়েছেন। কিছু কিছু বই অতর্কিতে হানা দ্যায় পাঠকের সুসজ্জিত চেতনায়। এটি তেমনই একটি বই।