Ratings1
Average rating4
Reviews with the most likes.
“যে জিনিসটা ছেলেবয়স থেকে বেশ ভালোই পারতাম সেটা হল ছবি আঁকা।”
ইন্টারনেটের গলিঘুজিতে মাঝে মাঝে একটা লিস্ট দেখা যায় : পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষ যাঁরা মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিলেন (‘ড্রপ-আউটস')। এইসব লিস্টে দুজনের নাম কখনই দেখা যায়না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়। প্রথমজন পড়াশুনা ছেড়েছিলেন বিরক্ত হয়ে। দ্বিতীয়জন বাধ্য হয়ে। সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের আত্মকথায় দেখতে পাই, জীবনে কখনও মায়ের কথা অমান্য করেননি তিনি। মায়ের প্রবল ইচ্ছেতেই শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হয়েছিলেন চিত্রশিল্প শেখার উদ্দেশ্যে (অথচ তার আগে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন ইকোনোমিক্সে অনার্স নিয়ে)।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুকুমার রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যদিও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের (পরবর্তীকালে বিনোদবিহারীকে নিয়ে বিখ্যাত ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন— “The Inner Eye”)। শান্তিনিকেতনের পাঠ কিন্তু শেষ করতে পারেননি তিনি। জীবিকার তাগিদে চার বছরের কোর্স আড়াই বছরে ছেড়ে দিয়ে, শান্তিনিকেতনের নিবিড় প্রকৃতি-সন্নিহিত স্তিমিত জীবন ত্যাগ করে, সারাজীবনের মতো প্রবেশ করলেন কলকাতার প্রবল নাগরিক জঙ্গলে। কিন্তু শান্তিনিকেতনের শিল্পশিক্ষার আঁচড়টি তাঁর মননে সযত্নে ধারণ করে রেখেছিলেন আমৃত্যু।
অতিরিক্ত প্রতিভাধর মানুষদের কিছু কিছু প্রতিভার কথা তুলনামূলক আড়ালে রয়ে যায়। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি দুর্দান্ত আতশবাজি বানাতে পারতেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দারুন বেহালা বাজাতে পারতেন। স্বামী বিবেকানন্দ অসাধারণ রান্না করতে পারতেন। রিচার্ড ফাইনম্যান খুব ভালো বোঙ্গো বাজাতে পারতেন। সত্যজিতের সিনেমা-নির্মাতা পরিচয়ের আড়ালে রয়ে গেছে তাঁর অলংকরণ পারদর্শিতার ব্যাপারটা। এমনকি লেখক সত্যজিৎও ইলাস্ট্রেটর সত্যজিতের চেয়ে অধিক আলোচিত। শিল্পী সত্যজিৎকে নিয়ে কিছু কিছু প্রবন্ধ লেখা হয়েছে বটে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বই একটাও ছিল না। দেবাশীষ দেব সেই অভাব পূরণ করেছেন।
দেবাশীষ দেব নিজে একজন স্বনামধন্য ইলাস্ট্রেটর। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ভীষণ জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলো দেবাশীষবাবুর অলংকরণ। দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করলেও তাঁর শিক্ষানবিশি শুরু হয়েছিল সত্যজিৎ-সম্পাদিত ‘সন্দেশ' পত্রিকায় ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে। সত্যজিৎ রায়কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি, এবং নিজে একজন অলংকরণশিল্পী হওয়ার সুবাদে সত্যজিতের চিত্রশিল্পী সত্তাটিকে তিনি বিশেষ নজরে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ এবং দীর্ঘকালীন চিন্তার ফসল হলো এই অসামান্য বইটি। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে : “যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এই বইটির জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন, তাঁদের জন্য”। আমি নিজে এই অপেক্ষাকারীদের একজন। প্রকাশ হওয়ার তিনদিনের মধ্যে হস্তগত করেছিলাম বইটিকে।
বাকি সবকিছুর কথা বাদ দিলাম। শুধু ‘সন্দেশ' পত্রিকার প্রচ্ছদগুলো দেখেই আমি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। তিন অক্ষরের ‘সন্দেশ' শব্দটিকে নিয়ে সত্যজিৎ যেন ছেলেখেলা করেছেন। কতো বিচিত্র টাইপোগ্রাফিতে ধরতে চেয়েছেন পত্রিকার এই অর্থবহুল নামটিকে। প্রচ্ছদগুলোর কতো বর্ণময় বৈচিত্র্য। কল্পনার কী অবাধ বিচরণ! (প্রায় একই কথা বলা যায় “এক্ষণ” পত্রিকার প্রচ্ছদগুলোর ব্যাপারেও)। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কমার্শিয়াল ডিজাইনার। সেই সংস্থার ম্যানেজার দিলীপকুমার গুপ্ত পরবর্তীকালে ‘সিগনেট প্রেস' নামের বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং সত্যজিতের সামনে খুলে যায় ইলাস্ট্রেশন এবং প্রচ্ছদ নির্মাণের অত্যাশ্চর্য দুনিয়া। সিগনেট প্রেস থেকেই বেরিয়েছিল ‘আম আঁটির ভেঁপু' (‘পথের পাঁচালী'-র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ)। এই বইটির প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ করার সময়ই সত্যজিতের মাথায় আসে একটি সিনেমার আইডিয়া, যা কিনা বদলে দেবে তাঁর নিজের জীবন এবং ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসকে।
জীবনে যে কাজেই হাত দিয়েছেন, ছকবাঁধা একঘেঁয়েমিকে অতিক্রম করে নিজস্ব অভিনব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সত্যজিৎ। ছবি আঁকাও ব্যতিক্রম নয়। কোনো একটি গল্প কিংবা উপন্যাসের সঙ্গে অলংকরণের ব্যাপারটি আগে ছিল নিছকই একটা ফাঁকা জায়গা ভরানোর অভিপ্রায়। বেশিরভাগ সময়ে অলংকরণশিল্পীর নামটুকুও উল্লেখ করা থাকতো না। প্রচ্ছদশিল্পীর নাম তো এখনও বহু সময় উল্লেখিত থাকেনা। এমন একটি পেশাদারী অবজ্ঞার পরিবেশে কাজ করতেন শিল্পীরা। নিজের অলংকরণ-কৌশলেই প্রচলিত প্রথাটিকে এক ধাক্কায় পাল্টে দিলেন সত্যজিৎ। প্রকাশকরা এই নবাগত শিল্পীর নামটিকে উপেক্ষা করতে পারলেন না। এমনকি অনেক সময় দেখা গেলো, বইয়ের চেয়েও বইটির প্রচ্ছদশিল্পীর খ্যাতি বেশি ছড়িয়ে পড়েছে! বইয়ের বিজ্ঞাপনে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা থাকতো প্রচ্ছদশিল্পীর নাম— এমন বিস্ময়কর কাণ্ড বাংলা প্রকাশনা জগতে কেউ কখনও দ্যাখেনি!
অলংকরণ তো শুধুমাত্র একটি বই কিংবা একটি রচনার সৌন্দর্যবৃদ্ধির উপায় নয়। একটি গল্পের সঙ্গে একই পৃষ্ঠায় মুদ্রিত একটি অলংকরণ যেন গল্পটির অন্যতম একটি চরিত্র। গল্পটির অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুকে আরো গভীরতা দ্যায় সেই অলংকরণ। কিন্তু তার জন্যে চিত্রশিল্পীর তরফে বুদ্ধিদীপ্ততার প্রয়োজন। খেয়াল গায়কের সঙ্গে যদি আনাড়ি তবলাবাদক সঙ্গত করে, তাহলে সেই গানের রসহানি ঘটে। কিন্তু যোগ্য সঙ্গতকারীর সহায়তা পেলে গায়কের পরিবেশনা অন্য মাত্রা পায়। সত্যজিৎ তাঁর অলংকরণের মাধ্যমে এই বুদ্ধিদীপ্ত সহায়তা করেছেন অগুনতি গল্প উপন্যাস কিংবা বইয়ের প্রচ্ছদে। তাঁর নিজের লেখাপত্রে তো বটেই, প্রচুর অখ্যাত লেখক আছেন যাঁদের রচনা উৎরে গেছে স্রেফ সত্যজিতের অলংকরণের অসামান্য শিল্পগুণে।
ছবি আঁকার এই তুলনামূলক অনালোচিত ক্ষেত্রটিতেও কী না করেছেন সত্যজিৎ! বিজ্ঞাপনের লে-আউট এঁকেছেন, বই এবং পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন, গল্প উপন্যাসের ইলাস্ট্রেশন করেছেন, ক্যালিগ্রাফি বা হরফ চর্চা করেছেন, নিজস্ব ইংরিজি ফন্ট তৈরি করেছেন, সিনেমার পোস্টার ডিজাইন করেছেন, সিনেমার সেট ডিজাইন করেছেন, এমনকি লোগো ডিজাইন করেছেন (কলকাতার বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহ ‘নন্দন' কিংবা ভারতের ‘সাহিত্য আকাদেমি' সংস্থার লোগো কিংবা বিখ্যাত ভারতীয় প্রকাশন সংস্থা ‘রূপা পাবলিকেশনস'-এর লোগো কিংবা ‘দেশ' পত্রিকার সুপরিচিত লোগোটিও তিনি তৈরি করেছেন)। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ' সিনেমাতে একটি বিখ্যাত দৃশ্য আছে। মগনলাল মেঘরাজের ডেরায় বেচারা লালমোহনবাবুর সঙ্গে ছুরি দিয়ে বিপজ্জনক খেলা দেখানোর দৃশ্যটি। এই দৃশ্যে লালমোহনবাবু একটি চিত্রপটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেই ভয়ানক চিত্রপটটিও সত্যজিতের স্বহস্ত-অঙ্কিত!
এই বিচিত্র মানুষটির কর্মকাণ্ড দুই মলাটে আঁটিয়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। তবু পরম অধ্যবসায়ের সঙ্গে, শ্রদ্ধার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে এবং তন্নিষ্ঠ গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সত্যজিতের শিল্পীসত্তার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন দেবাশীষ দেব। এমন একটি কাজের জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়! ঠিক যেমন সত্যজিৎ রায় মানুষটির প্রতি আমার অপার মুগ্ধতার পরিমাপের জন্য কোনো মাপকাঠির দৈর্ঘ্যই যথেষ্ট লম্বা নয়!
(‘সন্দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গল্পের হেডপিস)