নীল পাহাড়
নীল পাহাড়
শুধুমাত্র চেহারা এবং সংস্কৃতির ভিন্নতার জন্যে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত মানুষদের আমরা অন্যচোখে দেখি। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে হাসিতামাশা কিংবা বাঁকা কথা কিংবা তাঁদের প্রতি অপমানজনক আচরণ দেখা কিংবা শোনার অভিজ্ঞতা আমাদের, অর্থাৎ তথাকথিত ভূমিপুত্রকন্যাদের সবারই কমবেশি আছে। নিজদেশে তাঁরা পরদেশি হয়ে আছেন। বাংলাদেশের বান্দরবান অঞ্চলের নামডাক অনেক শুনেছি, মূলত বেড়াবার জায়গা হিসেবে। কিন্তু এই অঞ্চলের “পাহাড়ি” মানুষদের সঙ্গে বাঙালি “ভূমিসন্তান”দের সংঘর্ষের বিষয়টা আমি জানতাম না। এই বইটাকে দুই তারা দিলাম শুধু এই বিষয়টা এবং “মারমা” জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে আমাকে অবগত করবার জন্যে।
গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাসটির শুরু হয়েছিলো বেশ আশা জাগিয়ে। গদ্য বেশ ঝরঝরে লাগছিলো। লেখকের রসবোধটাও বেশ উপভোগ্য মনে হচ্ছিলো। তারপরেই শুরু হলো তামিল ব্লকবাস্টার সিনেমা। গল্পের স্বাদ আরো ঝাঁঝালো করতে অবধারিতভাবে ঢোকানো হয়েছে সকল মশলার শ্রেষ্ঠ মশলা— মুক্তিযুদ্ধের আবেগ। তাও আবার চড়া মাত্রায়। গল্পের যিনি নায়ক, তাঁর মধ্যে নায়কোচিত সমস্ত উত্তম গুণ প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন লেখক। ভাগ্যাহত অনাথ, কিন্তু লেখাপড়ায় মেধাবী। এমনিতে তাঁর কুসুমকোমল হৃদয়, কিন্তু যখন দরকার হয় তখন সংকল্পে ইস্পাতদৃঢ়। মারাত্মক সৎ। নিশ্চুপ প্রেমিক। পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থার সাহায্য ছাড়াই রাতারাতি তিনি সুস্থ করে তুলতে পারেন মৃতপ্রায় একজন সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ার রোগিকে। নায়কের অনাথ হওয়ার কাহিনিটিও (এবং সেই কাহিনির পরিণতি) এতোটাই নাটকীয় যে, এরকম কাহিনি আজকাল বাজারি বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্টলেখকরাও লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।
মেলোড্রামার রসে জবজবে করে চোবানো অবিশ্বাস্য ঘটনাসমৃদ্ধ এই উপন্যাসটা পড়তে পড়তে খুব আফসোস হচ্ছিলো আমার। শুধুমাত্র পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার লোভে এমন একটি সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কেমন ছেলেখেলা করলেন লেখক। উপন্যাসটা পড়া শেষ করে অনুভব করলাম, বান্দরবান পার্বত্য অঞ্চলের অশান্তির কার্যকারণ বিষয়ে খুব কম তথ্যই জানতে পেরেছি আমি। লাভের মধ্যে এটুকুই, মাথার মধ্যে ঢুকে রইলো একটা উদ্ভট আজগুবি আরব্যরজনীর গল্প।