Ratings1
Average rating4
মহিউদ্দিন আহমেদের অন্যান্য বেশকিছু বইয়ের মতোন, ক্রমানুসারে শুরু করবার জন্য জাসদ বিষয়কটার পর এটা অন্যতম সেরা বই, যা আমার ২০২২ সালে পড়া শেষ বই।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-এর বিশাল বৈচিত্রময় জার্নির সাবলীল পরিক্রমা— সংক্ষিপ্তসারে রিভিউ করতে চাইলে, এবং বই ও দল: উভয়ের বিষয়ে বলতে গেলে, বর্তমান রাজনৈতিক পর্যুদস্তবস্থায় বিএনপি বিগত যেকোনো সময়ের চাইতে এখন অধিকভাবে দেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করছে সন্দেহ নেই; ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের এই সময়েও সম্ভবত ইহা উপলব্ধি করা কষ্টকর, কেননা শহুরে মধ্যবিত্ত সার্কল পূর্বেকার ন্যায় চিরাচরিত বাঙালির রোল প্লে করে
একটি গণমানুষের আন্দোলনেও অংশ নেয়নি। বিশ-পঁচিশ বছর পরেও এটা, অর্থাৎ এখনকার জনসাধারণের পালস্ অনুধাবন করাটা টাফ হবে, কেননা মেইনস্ট্রিম কোনো গণমাধ্যমই এই সময়কে ধারণ করেনা পুরোটা, মনে হয় যেন সবাই এক আশ্চর্য দ্বৈত ভূখন্ডে বাস করছি যেখানের জনমানুষ আর ঐ জনমানুষের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, শিল্পি, মিডিয়া আর রাজনীতিবিদদের মুখের বয়ান আর চোখের ভাষা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী।
ঐতিহাসিকভাবেই স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙলাদেশে বিএনপি তুলনামূলক ইসলামপন্থী এবং ভারতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রধান আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করেছে; আর সাধারণভাবে পাকিস্তান বিভক্তি-উত্তর বাঙালিদের মনোজাগতিকভাবে পাকিস্তান সমর্থনকারী উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যাও (বাঙলাদেশের ন্যূনতম ২০ শতাংশ জনগণ) বিএনপির ভোটব্যাংক হিসেবে কাজ করেছে। অর্থাৎ বিএনপির রাজনীতি পুরোপুরি এন্টি-আওয়ামীলীগ কেন্দ্রিক নয়; যদি অদূর ভবিষ্যতে কখনো দলটির কাঠামো ভেঙ্গেও যায়, অনিবার্যভাবেই সম-আদর্শের সমমানের আরেকটি দল দাঁড়িয়ে যাবে; কেননা “এক-পাকিস্তান” আইডিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীলতা, বাঙলাদেশী জাতীয়তাবাদ, রাস্ট্রে ইসলাম-ধর্ম কেন্দ্রীকতা, ভারতবিরোধীতা—এই অাদর্শগুলোর বিলুপ্তি বাঙলাদেশে কখনো ঘটবে না; বরং ক্রমান্বয়ে বাড়বে এবং সম্ভবত আরোও উগ্রধর্মী নেতৃত্ব দাঁড়াবে যদিনা বর্তমান রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ফ্যাসিজম বন্ধ না হয়।
অতীতের ক্ষমতাসীন দল হিসেবে বিএনপির মারাত্মক কিছু কুলষতা, প্রতিহিংসাপরায়নতা ও দুর্নীতির ফলস্বরূপ এর ইমেজের অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে; সেইসাথে দেশের সংখ্যালঘু- নিরপেক্ষ জনগোষ্ঠীর বিরাট অংশকে তাঁদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে সব সময়ের জন্য।
তবু বিএনপি তুলনামূলক একটি লিবারাল প্ল্যাটফর্ম; ভারতবিদ্বেষী, পাকিস্তানপন্থী হতে শুরু করে সেক্যুলার, সংস্কারপন্থী শাহবাগী সবার জায়গার সংমিশ্রণ ঘটেছে এখানে; ফলে প্রায়শই পার্টির মূলধারায় কোনো অংশের মতামতের প্রতিনিধিত্ব ঘটেনি, আবার কোনো অংশকে করেছে বিপদের সম্মুখীন। সেইসাথে আদর্শগত মিত্রদের চিনতে ভুল করার পরিনামে এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবজনিত নিদর্শনের ফলস্বরূপ দলটিকে মাশুল দিতে হয়েছে অনেক বেশি; রক্ত আর গুমের হিসেবের মধ্য দিয়ে।
PS. বইয়ের প্রসঙ্গের বাইরে, দেশের এখনকার পরিস্থিতিতে, আমার মনেহয় বিএনপির এই দুর্দশার কারণ, প্রথমত: বিএনপির কৌশলগত অদূরদর্শীতা এবং রাজনৈতিক মিত্রদের প্রতি স্বার্থপরতা; সঙ্গে দ্বিতীয়ত: আদর্শগত শত্রু-মিত্র বিবেচনায় বিএনপি প্রকৃতপক্ষে এর রুট লেভেলের সমর্থকগোষ্ঠীকে ঔন করেনা; আসলে বিএনপির শক্তির জায়গা ইসলামপন্থী-তৃণমূল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী, শাহবাগ-কেন্দ্রীকতা নয়। বিএনপির চরিত্র শাপলা এবং জামায়াতের সদৃশ্য নয়, কিন্তু মিত্রতা বিবেচনায় বিএনপির পেছনে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে পারে কার্যত এই অংশই।
তৃতীয়ত: উপরোক্ত দুটি বিএনপির নীতিগত ভুল, এসব ভুল নিয়েও দলটির নিজস্ব সমর্থনেই আন্দোলন চালিয়ে কেয়ারটেকারের দাবি আদায় করতে পারার কথা; কিন্তু বিএনপির জন্য জার্নিটা কঠিন আর হতাশাব্যাঞ্জক। সত্যি বলতে আপনি কখনোই এমন শ্রেণীর মানুষদের সাথে ফাইট দিয়ে টিকে থাকতে পারবেন না, যারা আপনার বাজারের ব্যাগে কাঁচা মাংস দেখলেও খাবলে খেয়ে ফেলবে শুধু ক্ষুধা লাগছে বলে।
জানুয়ারি ১, ২০২৩।