Ratings1
Average rating4
এই দুনিয়ায় অনেক রকমের ভূতের হদিশ পাওয়া যায়। “একানড়ে” তেমনই একরকম ভূতের নাম। তালগাছের উপরে বাস করে এই ভূত। এই ভূতের একটা পা নেই। নিজের অবশিষ্ট একখানা পা ঝুলিয়ে সে বসে থাকে তালগাছের মগডালে। প্রচলিত গ্রাম্য শিশুতোষ ছড়া আছে :
যে ছেলেটা কাঁদে
তাকে ঝুলির ভেতর ভরে
গাছের উপর উঠে
তুলে আছাড় মারে।
অর্থাৎ যারা দুষ্টু ছেলেমেয়ে, এই ভূত তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দ্যায়। ছোটো ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়ানো খুব কঠিন একটা কাজ। আগেকার দিনে এইরকম ভয়ানক সব ছড়া শুনিয়ে তাদের ঘুম পাড়ানো হতো!
কিছুদিন আগেই এই লেখকের গোয়েন্দা উপন্যাস “শেষ মৃত পাখি” পড়েছিলাম। আজকে দুপুরে গুডরিডসের সূত্রেই এই উপন্যাসটার সন্ধান পেলাম। কী মনে হলো, ইন্টারনেটে খুঁজে দেখলাম এবং পেয়েও গেলাম। ছোটো সাইজের উপন্যাস, তাই পড়া শুরু করে দিলাম।
লেখকের মৌলিক গদ্যভাষার খানিকটা পরিচয় “শেষ মৃত পাখি”-তে পেয়েছিলাম। কিন্তু “একানড়ে” উপন্যাসটির অসামান্য গদ্যশৈলী ইদানিংকার বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের কারো কলম থেকে বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই। চিত্রকল্প এবং রূপকের অনবদ্য ব্যবহারে, শব্দচয়ন এবং বাক্যের সযত্ন নির্মাণে, কাহিনিতে যুক্ত করেছেন হিমশীতল হিংস্র অনুভূতির আলাদা একটা প্রান্তর।
এরপর আসি গল্পের কথায়। “একানড়ে” অলৌকিক গল্প হয়েও ঠিক অলৌকিক গল্প নয়, আবার বাস্তবতার গণ্ডিতেও পুরোপুরি আটকে থাকেনি এই গল্পের প্লট। রিভিউয়ের শুরুতেই “একানড়ে” নামক ভূতের যে রেফারেন্স দিলাম, সেগুলো চমৎকার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন লেখক। তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন শিশু-মনস্তত্ত্ব, অন্ধবিশ্বাস এবং ভুতুড়ে পরিবেশ-নির্মাণের মেধাবী কৌশল।
নয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলের দৈনন্দিন চিন্তাভাবনা, তার মানসিক স্ট্রাগল, বড়োদের জগতের সঙ্গে তার নিজের জগতের টানাপোড়েন— এই সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে লেখক এমন একটা কাহিনি ফেঁদেছেন, যেটা পড়তে গিয়ে আজকে এই উল্টোরথের দিনে, বৃষ্টি থৈ থৈ বিকেলবেলাটা, সন্ধেবেলাটা, রাত্রিবেলাটা— বেশ চমৎকার কাটলো।
বড়ো হয়ে যাওয়ার পরে আমরা এখন বেমালুম ভুলে গেছি : আমরা যখন বেশ ছোটো ছিলাম, আমাদের মনের ভিতরে লুকিয়ে ছিলো একটা সম্পূর্ণ গোপন রহস্যময় জগৎ। যে-জগৎটার হদিশ কেউ জানতো না। বড়োরা না, বন্ধুরা না, ভাইবোনেরা না, কেউ না। একটা রোমাঞ্চকর নিষিদ্ধ জগৎ।
জানতাম শুধু আমরা নিজেরা। আমাদের সেই জগৎটা কিন্তু মোটেও “ছোটোদের” জগৎ ছিলো না। “নিষ্পাপ” জগৎ ছিলো না। বিস্মৃত সেই রহস্যময় জগৎটার কথা আজকে খুব ক্ষীণভাবে আবার মনে পড়ে গ্যালো।
হাবিজাবি তন্ত্র মন্ত্র পিশাচ ভুজুংভাজুং থোড়-বড়ি-খাড়া আবর্জনায় ডুবে থাকা বাংলা সাহিত্যের আজকের এই মধ্যমেধাবী লেখকদের জমানায় এরকম বুদ্ধিদীপ্ত সুলিখিত অলৌকিক একখণ্ড আনন্দ দেওয়ার জন্যে— লেখককে কুর্নিশ!