Ratings1
Average rating4
জাপানি সংস্কৃতির মতো অভিনব সংস্কৃতি এই দুনিয়ায় আর একটা নেই। চারুশিল্প কিংবা সৃজনশিল্পের হরেক নমুনা তো পৃথিবীতে রয়েছে। অঙ্কন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, আরো কত কি। কিন্তু, ফুল সাজানোর শিল্প “ইকেবানা”, কিংবা বড় গাছকে উদ্ভিদবিদ্যাগত উপায়ে ছোট সাইজের বানিয়ে ফেলার শিল্প “বনসাই”, কিংবা ভাঁজ-করা পাতলা কাগজের হাতপাখার উপর সূক্ষ্ম উডব্লক-প্রিন্ট ও ক্যালিগ্রাফি করার শিল্প “সেনসু”, এসব জিনিস জাপানিরা ছাড়া আর কেউ ভাবতে পারেনি। সামান্য চা খাওয়াকেও তারা একটা সৃজনশিল্প বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে তাদের যে-শিল্পটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তার নাম “অরিগামি”।
ছোটবেলায় ইশকুলে পড়ার সময় কাগজের নৌকা কিংবা কাগজের এইরোপ্লেইন কে না বানিয়েছে? কিন্তু তবু, কাগজ ভাঁজ করে যে আরো কত কত জিনিস বানানো যায়, এই বিষয়টার ব্যাপ্তির আন্দাজ আজকের দিনেও খুব বেশি মানুষের নেই। ১৯৮০ সালে (বইটা যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল) তো আরো ছিলো না। নারায়ণ সান্যাল একজন আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। কতো ভিন্ন ভিন্ন বিচিত্র বিষয়ে যে তিনি কেতাব লিখেছেন! (আচ্ছা, তাঁর ব্যাপারে আরেকদিন বলা যাবে)। তাই বলে “অরিগামি” বিষয়েও বই লিখেছেন তিনি, ভাবা যায়? এলেবেলে বই নয়, রীতিমত বিস্তারিত গবেষণাসমৃদ্ধ বই। যেখানে নিজের হাতে ছবি এঁকে এঁকে তিনি শিখিয়েছেন অরিগামি মডেল বানাবার উপায়। আজকের দিনে ইউটিউবের কল্যাণে এই বইটির মূল্য হয়তো আর কিছুই নেই। কিন্তু আজ থেকে অনেক বছর আগে (ভুলে গেছি কত বছর আগে) আমি যখন প্রথম এই বইটির সংস্পর্শে এসেছিলাম, একটা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত আনন্দময় জগতের দরজা খুলে গেছিলো আমার সামনে!
শুধুমাত্র একটুকরো কাগজ দিয়ে কি কি জিনিস বানানো সম্ভব? মাছ, উড়ন্ত ঈগল, শুকরছানা, উড়ন্ত সারস পাখি, টিয়াপাখি, পেলিক্যান, রাজহংস, বাইসন, মোরগ, কুকুর, সিংহ, অক্টোপাস, ব্যাঙ (যেটা আবার নাচেও), ঘোড়ায় চড়া বেদুইন, ময়ূর (যার পুচ্ছটি গুটিয়েও রাখা যায়), দাড়িয়ালা রামছাগল, আরো অনেক অনেক অনেক কিছু। এমনকি, পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অরিগামি-মাস্টার বলা হয় যাঁকে, সেই আকিরা যোশিযাওয়া, কাগজ ভাঁজ করে নিজের সেল্ফ-পোর্ট্রেট বানিয়েছিলেন! এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা আবশ্যক। অরিগামি মানে কিন্তু শুধুই কাগজ-ভাঁজ-করা। কোনো আঠার ব্যবহার নয়, কাঁচির ব্যবহার নয়। শুধু একটুকরো কাগজ, দুটো হাত, আর উৎসাহ। এর বাইরে কিছু ব্যবহার করলে সেটাকে অরিগামি বলা যাবে না।
একসময় খুবই উৎসাহিত ছিলাম অরিগামি নিয়ে। ইশকুলের বার্ষিক প্রদর্শনীতে সবাই যখন সেই একঘেঁয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া সায়েন্স-মডেল, ইলেকট্রনিক্স মডেল, থার্মোকলের মডেল, কিংবা দেশলাই কাঠি দিয়ে আল্পনার মডেল বানাতো, তখন, বলতে একটু লজ্জাই লাগছে, রঙিন কাগজ দিয়ে বানানো আমার অরিগামি মডেলগুলো দেখতে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভিড় করতো। এখন আর ততটা উৎসাহ নেই। কিন্তু পুরোনো বই গোছাতে গিয়ে আজকে সকালে যখন এই বইটা হাতে পড়লো, দমকা হাওয়ার মতো চোখের সামনে ভেসে এলো : ঘরময় লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কাগজের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে, সারাটা দুপুরবেলা আমি মগ্ন হয়ে ভাঁজ করে বানাবার চেষ্টা করছি একটা কাগজের কাঠবেড়ালি। বিকেলবেলা মা আমার ঘরে ঢুকে কাঠবেড়ালিটা দেখে বেশি খুশি হলো নাকি আমার খুশিতে উজ্জ্বল মুখটা দেখে, বলা মুশকিল।