Ratings1
Average rating4
Reviews with the most likes.
আবুল হাসানের নামই জানতাম না আজ থেকে বছর চারেক আগেও। দোষ আমার নয়। কোনো এক বিচিত্র উন্নত-নাসিকা-syndrome-জনিত কারণে, বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের ব্যাপারে আমাদের এই বঙ্গভূমে আলাপ আলোচনা হয় না। তবে সুখের কথা, এই বদভ্যাস ক্রমশ কমছে। যদিও এখনও বাংলাদেশের বইপত্র আমাদের এখানে সহজলভ্য নয়। গোটা কলেজ স্ট্রিট তল্লাশি করে আবুল হাসানের কবিতার বইয়ের অন্তত একপিস কপিও খুঁজে পাইনি।
অথচ মনের মধ্যে নিত্য আসা যাওয়া করে, এখান থেকে ওখান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া, কয়েকটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পঙক্তি। জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা! মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা। আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই, স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে! ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও। এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া। অতটুকু চায়নি বালিকা!
মনের ভিতর আকুলিবিকুলি করে এই কবির কবিতা ছুঁয়ে দেখার জন্য। অবশেষে হারুন পাঠিয়েছিল আবুল হাসানের রচনা সমগ্র। সেই সমগ্র থেকে কবির প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইটি পড়েই ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে জলডাকাতের মতো উৎপাত শুরু হয়ে গেছে আমার চেতনা জুড়ে! “রাজা যায় রাজা আসে” কাব্যগ্রন্থের পয়লা লাইনটি :
সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ এটা সেই পাথরের নাম নাকি?
কী আশ্চর্য, কবিতাটির নাম “আবুল হাসান”! কবির মতো আমাদের প্রত্যেকের নিজের প্রস্তরীভূত আত্মনামটিও তো সময়ের ঘষা লেগে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। আমরাও তো সেই নামটির অনিচ্ছুক দাস। আমরাও কি ভালোবেসেছিলাম কোনো যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙুল?
তারপর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে বয়ে চলে স্মৃতি সত্তা ও ভবিষ্যতের অজস্র অনিকেত কোরাস। এক জায়গায় চোখে পড়ে আমার আরেকজন প্রিয় কবি শহীদ কাদরীকে উৎসর্গ করা একটি কবিতায় (“গাছগুলো”) যেন অতিপরিচিত এক ব্যক্তিগত দেয়াল লিখন :
আমরা যখোন শার্টের তলায়নিজস্ব গোপন ছুরি নিয়ে চলা ফেরা করিপ্রতিমুহূর্তের আয়নায় আত্মহত্যা করি আরপ্রতিমুহূর্তের অবিশ্বাসেএর ওর সাথে কথা বলি,সে মুহূর্তে ওরা বিলায় ওদের নিজস্ব সম্পদনির্বিশেষে চুপিচাপি
বিষাদের আমলকি-ছায়ায় বসে কবি আমাকে সরবরাহ করেছেন তাঁর গভীর গোপন দুঃখ। তাঁর বাবা, একজন ‘নিম্নমানের মানুষ', যাঁকে নাকি তাঁর মা বলতেন :
তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা?ঘুস খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,কত রকম ফন্দি আঁটছে কত রকম সুখে থাকছে,তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?
আমি যেন মানস কর্ণে শুনতে পাই কবির নিচু গলায় উচ্চারিত, চামেলী হাতে সেই ব্যর্থ মানুষটি, তাঁর বাবার কথা। আবার পরের পৃষ্ঠাতেই সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দৃপ্ত তিনি :
এই কবিতা তোমার মতো সমালোচকের ভুলশোষকের শাসনত্রাশন ভেঙে ফেলে, মুখের উপর থুথুড়ি দেয়ইচ্ছে হলেই শিল্প দেখায় রক্ত মাখায় এই কবিতা!
এমন অজস্র পঙক্তি নির্ভুল নিশানায় আমার চুলের কাছে ফেরার বাতাসের মতো স্পর্শ করে যায় আমাকে। আমিও সেদিনের ঝঞ্ঝাপীড়িত মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে বিড়বিড় করি :
মেঘেরও রয়েছে কাজওকে ছুটি দাওওকে দিয়ে দাও ওর কালো আমব্রেলাটি,ফিরে যাক ও তার তল্লাটে!
তারপর আমার কব্জির নীল ডায়ালের তারার থেকে মুখ তুলে দেখতে পাই যেন খুব পরিচিত একটি দৃশ্যকুসুম :
তোমার কথার মতো নরম সবুজকেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচেতোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ!তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়...
আবুল হাসানের এই নিবিড় এবং আত্মগত কবিতাগুলো পড়তে পড়তে, তাঁর শৈশব ও শিল্প, প্রেম ও প্রতিনির্জন, মেঘ ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মিসট্রেসের বৃত্তান্তগুলি পড়তে পড়তে, তাঁর মাতৃভূমির মতো অসহায় মা এবং বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসার ব্যক্তিগত পোশাকগুলির কথা পড়তে পড়তে, আমার দিকে জ্যোৎস্নাসিক্ত নির্জন সাইকেলের মৃদু ঘণ্টাধ্বনির মতো বারবার ফিরে ফিরে আসে একটি অনপেক্ষ দীর্ঘনিঃশ্বাস :
পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলী মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত!
আহা, কী অপূর্ব!!
.