Dead Reckoning
Dead Reckoning
১. ১৯৭১এ স্বাধীনতাকামী মজলুম বাঙালিদের উল্লেখ আমরা সর্বত্র পাই, স্কুলে পড়ানো বিশ্বপরিচয় বই হতে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া, সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত কনটেন্ট পর্যন্ত তাঁদের প্রতি হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ আর নির্যাতনের কথা ছড়িয়ে আছে; কিন্তু ওইসময় যারা আওয়ামীলীগের অপজিশন পার্টি করতেন, বিশেষত চীনপন্থী বাম আর ইসলামপন্থীরা; একাত্তর পূ্র্ব তেইশ বছরে যেসব অগনিত বিহারি আর মাগরেবে পাকিস্তানির আগমন ঘটেছিলো এই অঞ্চলে—বিভিন্নভাবে, অথবা নেহায়ত এখানে অবস্থানরত সিভিলিয়ান অবাঙালিগণ—এই নয়মাসে তাদের অবস্থা কেমন ছিলো? আমাদের সূর্যসন্তানেরা কি তাহাদের প্রতি যুদ্ধাপরাধের বদলা নিতে পাল্টা যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়েছিলো? নাকি পৌরানিক কাহিনির নিষ্পাপ দেবতাদের ন্যায় রোল প্লে করেছিলো?
গৃহযুদ্ধের মার্চের প্রথম আর শেষ ডিসেম্বরের কিছু ঘটনা, কিছু মাস কিলিং; যা আমাদের টেক্সটগুলোতে অবধারিতভাবে উহ্য থাকে, সেসব আমাদের জন্য কি খুব বেশি বিব্রতকর?
২. লেখিকার পলিটিক্যাল অবস্থান স্বভাবতই পাকিস্তানপন্থী; শর্মিলা বসু আমেরিকা হতে পাকিস্তানে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান বিক্রয়ের সমর্থকদের একজন ছিলেন। এই প্রজেক্টের ক্ষেত্রেও কিছু প্রশংসার পাশাপাশি ভারতীয়, বাংলাদেশি এবং একাত্তরে পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থানরত কতিপয় বিদেশি সাংবাদিকের সমালোচনা কুড়িয়েছেন তিনি।
বইয়ের বিবৃতিগুলোয় পাকিস্তানি মেজরদের বিবরনগুলোকে অধিকতর সত্যি এবং, কিছুক্ষেত্রে বাঙালি সাক্ষ্য/দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি অনাস্থা প্রকাশের প্রবনতা ছিলো। বইতে বিশেষত উনি ফোকাস করেছেন কয়েকটি পয়েন্টে:
ক. মুক্তিযুদ্ধের সহিংসতা মূলত দুইপক্ষ থেকেই হয়েছিলো, পাকিস্তানিদের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারাও প্রো-পাকিস্তানি এবং নিরস্ত্র সিভিলিয়ানদের রক্তে রঞ্জিত।
খ. পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক ধ্বংসযজ্ঞ ও নিহতদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক কম, যার ভারতীয় ও বাংলাদেশি মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত প্রচারণা ঘটেছে (দেশদ্বয়ের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য)
গ. লেখিকা পাকিস্তানের তৎকালীন পলিসি মেকারদের একটা জাষ্টিফিকেশন তৈরি করতে চেয়েছেন, বিশেষত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আর জেনারেল নিয়াজীর প্রতি।
ঘ. উগ্র জাতীয়তাবাদী মব, মুজিব-ভুট্টোর অসহিষ্ণুতা, এবং পঁচিশে মার্চ পরবর্তী সামরিক হস্তক্ষেপ : পাকিস্তান ভাঙনের মূল নিয়ামক।
৩. ইতিহাস মূলত অতীতে যা ঘটে সেটার বর্ণনা নয়, কজ সেটা আসলভাবে বর্ণনা করা সম্ভবও না, বরং কোনো ঘটনার একটি সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিকে আপনি যেভাবে, যত প্রভাবশালীভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রচার করতে পারছেন, সেটাই হবে মেইনস্ট্রিম ইতিহাস; একাত্তরের স্মৃতি আমাদের কাছে যেরকম আবেগমাখা, অামাদের চারপাশে যারা গনবিরোধী ভূমিকা নিয়েছিলো একসময়, তাঁদের স্টোরিগুলো ভিন্নরকম, হয়তো পুরো বিপরীত তাদের যুক্তির জায়গাগুলোও; সেগুলো কতোটুকুন সত্যি-মিথ্যা তা তো আরও পড়াশোনা আর আপনার ক্রমবর্ধমান রুচি আর চাহিদা মাফিক কৌতূহলের ওপর নির্ভরশীল, তবু চিরায়ত স্টোরির বাইরে শুরু করার জন্যে এটা মন্দের ভালো বই।
-ডিসেম্বর ১৫, ২০২২।