The Story of Hassan of Baghdad and How He Came to Make The Golden Journey to Samarkand
ব্রিটিশ কবি ও নাট্যকার জেইমস এলরয় ফ্লেকার-এর নাটক ‘হাসান'। ১৯২৫ সালে লেখা এ নাটক মূলত বাগদাদের হাসানের ঠিকানা কিভাবে শেষতক সামারকান্দে গিয়ে ঠেকলো তার-ই আখ্যান (এটিই নাটকের উপশিরোনাম)। ইসলামিক বিশ্বের আব্বাসীয় খিলাফতের পঞ্চম খলিফা হারুন-উর-রশীদ-এর শাসনকাল (৭৮৬-৮০৯) এ নাটকের পটভূমি। ‘আরব্য রজনী''র বদৌলতে খলিফা হারুনের এ সময়টির সত্যমিথ্যে অনেক গল্পই আমাদের জানা। ফ্লেকার যে সময়ের মানুষ, পশ্চিমা বিশ্বে তখন-মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত-গোটা পূর্বাঞ্চলটি নিয়েই ভীষণ আগ্রহ, যার বরাতে প্রচুর পশ্চিমা লেখকের বই আজ আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। তাঁদের গবেষণার ফল এই বইগুলো সবসময় যে প্রাচ্যের সত্যিকার চিত্রটি তুলে ধরে তেমন নয়। বহু পশ্চিমাই প্রাচ্যকে রহস্যে ঘেরা জাদুকরী এক জায়গা হিসেবে দেখেছেন, যেখানে কি না মানুষ রাস্তাঘাটে হাত সাফাই করার খেলা দেখায়, পশু পাখির সাথে কথা বলে, জাদুর কার্পেটে উড়ে বেড়ায়...
পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে প্রাচ্যকে এঁদের অনেকেই গেঁয়ো, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, পিছিয়ে পড়া এক জনপদ হিসেবে দেখেছেন, যেখানের মানুষের লোকাচার রীতিমতো বুনো ও আদিম। সত্তরের দশকে এডওয়ার্ড সাইদ পশ্চিমাদের এই মনোভাবটিকে টিটকারী মেরে ‘অরিয়েন্টালিজম' নাম দিয়েছিলেন। ফ্লেকারের এ নাটকটি লেখার সময়কাল, ও এর বিষয়বস্তু এমন যে আধুনিক অনেক পাঠক এতে সেই অরিয়েন্টালিজম-এর ভুত দেখতে পারেন। মূলত আপনার রুচিবোধই নির্ধারণ করে দেবে এ ভুতটি আপনি দেখতে পাবেন নাকি পাবেন না।
নাট্যকার নাটক লেখেন আসলে কোন একটি ‘বদ' উদ্দেশ্য নিয়ে। একটি পক্ষ অবলম্বন করে নানান ঘটনার ‘নাটক' সাজিয়ে নাট্যকার তাঁর নৈতিক অবস্থানের পক্ষে প্রপাগ্যান্ডা চালান মূলত। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে এথেন্স ও স্পার্টা'র মাঝে যখন পেলোপনেজিয়ান যুদ্ধ শুরু হয়, সে যুদ্ধ বন্ধে গ্রীক কমেডি নাটকের অন্যতম শীর্ষ গুরু অ্যারিস্টোফেনিস একটি অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন; ‘লিজিস্ট্রাটা' নাটকে তিনি দেখান যুদ্ধরত সৈনিকদের স্ত্রীরা একটি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে-তাদের স্বামীদের সাথে তারা আর যৌনমিলনে অংশ নেবেনা, হোক না তাতে তাদের যতই কষ্ট! কামনার শরে বিদ্ধ হতে হতে দুর্বল হয়ে যাওয়া সৈনিকেরা বাধ্য হয়ে যুদ্ধ বন্ধ করে দেবে এটাই লিজিস্ট্রাটার আশা ছিলো।
বাস্তবের পেলোপনেজিয়ান যুদ্ধে এমন কিছু ঘটেনি, ঘটার কথাও নয়, কিন্তু যে বার্তাটি অ্যারিস্টোফেনিস দিয়ে গেছেন, সেটিই এখানে মুখ্য। প্রাচীন গ্রেকো-রোমান বহু নাট্যকারকেই আমরা এ ধরণের প্রপাগ্যান্ডা চালাতে দেখি; মেনান্দার, প্লাউতাস, টেরেন্স-এঁরা সবাই-ই দু হাজার বছরেরও ওপরের আগের মানুষ হয়েও ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে সূক্ষ্মভাবে প্রচারণা চালিয়েছেন। দু'হাজার বছরের রুচির পার্থক্যে এঁদের কমেডি আজ আমাদের কাছে দিলদার কি হারুন কিসিঞ্জারের কমেডির মতোই সস্তা, গেঁয়ো ও খেলো ঠেকতে পারে, কিন্তু তাঁদের নাটকগুলো সাক্ষ্য দেয়, চিন্তায়-চেতনায় তাঁরা আমাদের অনেকের-প্রায় বেশীরভাগেরই বোধহয়-চেয়েই অনেক আধুনিক ছিলেন।
বিংশ শতকের ইংরেজ কবি হয়ে ফ্লেকার কেন অষ্টম শতকের ইসলামী খলিফাকে নিয়ে নাটক লিখতে গেলেন? এ নাটকের নাম হাসান, তবে কেন্দ্রীয় চরিত্রটি সে নয়; নাটকের ঘটনাপ্রবাহ যাকে ঘিরে তার নাম রাফি, ভিক্ষুকদের সর্দার সে। রাজ্যের ফকির মিসকীনদের নিয়ে খলিফা হারুন-উর-রশীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তুলেছে রাফি। কারণ? রাফি'র বাগদত্তা পারভীনকে ক্রীতদাস বেচাকেনার হাটে নিয়ে যাওয়া হয় জোর করে। বহু কষ্টকর যাত্রার পর যখন অবশেষে পারভীনকে হাটে খুঁজে পায় রাফি, তখনও তাকে টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে পারেনা সে, কারণ খলিফা হারুনের আদেশ-বাজারের সেরা সব ‘মাল' যাবে খলিফার হারেমে, তাঁর সওদা করা শেষ হলেই বাকী সব এঁটো ঝুটারা রাফিদের মতো ফকির ফাতরা গরীব গুর্বাদের ভাগে যাবে।
আব্বাসীয় খিলাফতকে ইসলামের ইতিহাসে সোনালী এক অধ্যায় হিসেবে দেখা হয়, যখন দিকে দিকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছে, খলিফাদের বীরত্বের নানান গল্প পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এসে পৌঁছাচ্ছে। ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা এই সময়টিকে নিয়ে ভীষণ গর্ব বোধ করেন, এবং পশ্চিমারা যে কেবলই ভোগ পান ও অবাধ যৌনতায় মেতে থাকে তা নিয়ে ছিছিকারে মাতেন। তবে এই আব্বাসীয় খলিফেরা “ভোগ পান ও অবাধ যৌনতায়” কারো চেয়েই যে কম কিছু ছিলেন না-এ ইতিহাসটি অনেকটা ইচ্ছেকৃতভাবেই ভুলে যান তাঁরা। বিশেষত হারেম শব্দটি আজ আব্বাসীয় খলিফাদের সমার্থক শব্দই হয়ে উঠেছে। আব্বাসীয় হারেম-এর ব্যাপকতার ধারণা দেয়ার জন্য একটি তথ্য দেয়া যেতে পারে। অষ্টাদশ আব্বাসীয় খলিফা আবুল ফজল জাফর ইবনে আহমেদ আল মুক্তাদির-এর হারেমে সব মিলিয়ে ১৫ হাজার বন্দিনী/ দাসী/ বাঁদি ছিলো।
আব্বাসীয় হারেমের বাসিন্দা এই নারীদের মাঝে একধরণের hierarchy বা শ্রেণিবিন্যাসও ছিলো; মোটা দাগে ৫ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে এই ছোট্ট রাজ্যের অধিবাসীদেরঃ স্ত্রী,উপস্ত্রী বা রক্ষিতা, খলিফার বিশেষ খেদমতে নিয়োজিত নর্তকী যাদের “জাওয়ারি” বলা হতো, বাচ্চাকাচ্চাদের দেখে রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত “কাহরামানা”, এবং সবশেষে এই নারীদের পাহারার দায়িত্বে থাকা খোজা পুরুষেরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রাক-ইসলামী আরবের সবকিছুকেই খারাপ ও বাতিল ঘোষণা করা এই খলিফারা প্রাক-ইসলামী যুগের গাইয়ে বন্দিনী “কিয়ান”দের ঠিকই সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন, এবং এদের অনেককেই “জাওয়ারি”'র পদে তাঁরা অধিষ্ঠিত করেন। রাজকার্য, যুদ্ধবিগ্রহ নিয়ে ব্যস্ত থাকা খলিফাদের সময় থাকতোনা হারেমের ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেবার, তাই বিশাল এই সংগঠনটির দায়িত্বে থাকতেন খলিফাদের মায়েরা। খলিফাদের যে ৪ বা এরও বহু সংখ্যক স্ত্রী থাকতো, তাদের কাউকে এ দায়িত্ব দেয়া হতোনা, কারণ, ইসলামে এক স্ত্রীকে অপর স্ত্রীদের চেয়ে বেশী ক্ষমতাবান না বানাবার নির্দেশ এসেছে।
ছবিঃ খাজারদের (তুর্কী বংশোদ্ভূত স্লাভিক মুসলমান) কাছে রাশানরা ক্রীতদাস বিক্রী করছে। সের্গেই ইভানভ (১৯১৩)। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া
ফ্লেকারের এ নাটকে ইসলামী আরব সংস্কৃতির টুকরো টুকরো অনেক ছবিই চমৎকারভাবে উঠে আসে। ইয়াসমিনের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকা হাসান যখন বারবার ‘ইয়াল্লাহ, ইয়াল্লাহ' জপতে থাকে, তার বন্ধু সেলিম তাকে “O father of repetition” বলে সম্বোধন করে মনে করিয়ে দেয় বিগত কয়েক মিনিটে হাসান ৩৭ বার ‘ইয়াল্লাহ' বলা ছাড়া আর কিছুই বলেনি। কমবয়েসী সুন্দরী ইয়াসমিনের এক টুকরো হাসির প্রত্যাশায় থাকা প্রৌঢ় হাসান হতাশ হয়ে শেষতক বলেই বসে অবিশ্বাসীদের জন্য বেহেশতের দরজা যেমন চিরতরে বন্ধ, হাসানের জন্যও ইয়াসমিনের হাসির দেখা পাওয়া বোধহয় তেমনি অসম্ভব। আরবীভাষীদের নিজেদের মাঝে একে অপরকে নিয়ে হাসি-তামাশা'র ব্যাপারটি আমরা অনেকেই জানি, সামান্য পরিসরে তার কিছুটা এ নাটকেও উঠে আসে; হাসানের প্রেমরোগ সারাবার জন্য বন্ধু সেলিম যখন বিখ্যাত এক ইহুদী জাদুকরের গুণের বর্ণনায় দাবী করে কায়রোর সুলতানের সামনে সে জাদুকর উপস্থিত দর্শকদের আধ ঘন্টার জন্য বাঁদর বানিয়ে রেখেছিলো, জবাবে হাসান বলে “মিশরীয়দের ভাল করে চিনলে সহজেই বুঝে নিতে পারতে এটা মোটেই কোন তাক লাগানো খেল নয়!”।
রেগে গেলে এ নাটকের চরিত্ররা একে অপরকে কাফির বা অবিশ্বাসী বলে গালাগাল করে, “নালায় মরা কুত্তা টেনে আনা ছোটলোক”-বলে অপমান করে, শূলে চড়িয়ে সে লাশ বিষ্ঠার স্তূপে ছুঁড়ে ফেলার হুমকি দেয়, অপেক্ষা করিয়ে রাখলে দেরী করিয়ে দেবার জন্য “আমারে কি ইহুদী নাইলে খ্রীষ্টান মনে অয় তর?” বলে চিৎকার চেঁচামেচি লাগিয়ে দেয়, সামান্য তুচ্ছ একটি মেয়েকে হারেমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে গোটা ইসলামের সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করে রাফি কি গর্হিত এক অপরাধ করেছে তা তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়...নাটকের পরতে পরতে নানান চোখা সংলাপ আর দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়ে ফ্লেকার তাঁর এজেন্ডা বাস্তবায়িত করেছেন, ব্যঙ্গের এক ‘নাটক' সাজিয়ে যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিয়েছেন। একটি বিষয় বারবারই চোখে পড়ে, সেটি হলো খলিফার স্নেহধন্য চাটুকার চরিত্রগুলো এখানে খলিফাকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করে সম্বোধন করে, কখনো খলিফা “আগ্নেয় থুতু নিক্ষেপক”, কখনো “অবিশ্বাসীদের হাড় ভঙ্গনকারী”, কখনো “ইসলামের বাগানের মালী”, কখনো “পৃথিবীর বুকে স্রষ্টার ছায়া”, আর কখনো তিনি স্রেফ “সর্বশক্তিমান”। একজন খেয়ালী খলিফাকে কেন্দ্রে রেখেই যে গোটা ইসলামিক বিশ্ব ঘোরে সেটি ঘুরেফিরে উঠে আসে এই খেতাবগুলোর ভেতর দিয়ে।
জেইমস ফ্লেকার আজ অনেকটাই বিস্মৃতপ্রায়, মাত্র ৩১ বছর বয়েসেই প্রাণ হারানো এ কবি খুব বেশী কাজ রেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু এই অতি ছোট জীবনেই তিনি তাঁর সময়ের বাঘা বাঘা সব লেখক সাহিত্যিকদের নজর কেড়েছেন। হোর্হে লুই বোর্হেস, আগাথা ক্রিস্টি, বিক্রম শেঠ, নেভিল শ্যুট, সাকি, অ্যান্থনি পাওয়েল থেকে শুরু করে হালের সময়ের নেইল গাইম্যান-এঁরা সবাই-ই নিজেদের কাজে ফ্লেকারকে উদ্ধৃত করেছেন। এতগুলো নেইম ড্রপিং-এর পর আমার একার মন্তব্যে আর কি এসে যায়?
এ বইতে পাওয়া ফ্লেকারের একটি চুটকি দিয়ে শেষ করছি, যেটি তিনি খলিফার মুখে আমাদের শুনিয়েছেন। খলিফার দরবারে ডলফিন ও নগ্নবালক-সংবলিত দারুণ সুন্দর একটি ফোয়ারা দেখে হাসান যখন মুগ্ধ হয়, তখন খলিফা হারুন গর্বভরে এ ফোয়ারার ইতিহাসটি ব্যক্ত করেন (সম্মানিত পাঠক, লক্ষ্য করুন, ইসলামী বিধিতে ভাস্কর্য তৈয়ার করা হারেমে রক্ষিতা পোষার মতোই নিষিদ্ধ)। হারুন-উর রশীদের বাবা খলিফা আল মাহদী'র দরবারে একদিন এক গ্রীক ভাস্কর অনিন্দ্যসুন্দর এই ফোয়ারাটি নিয়ে হাজির হন। আল মাহদী তাকে জিজ্ঞেস করেন এমন ফোয়ারা সে আরো বানিয়ে দিতে পারবে কি না। “সানন্দে! চাইলে এমন আরো ১০০টা বানিয়ে দিতে পারবো”-উত্তর দেয় গ্রীক ভাস্কর। “এই কে আছিস, এই বিধর্মী কাফির শুয়োরটাকে শূলে চড়া এক্ষুণি”-হাঁক দিয়ে ওঠেন আল মাহদী। এর পর থেকে গোটা পৃথিবীতে এই ফোয়ারা এই এক খানাই আছে।