R.U.R.
1920 • 116 pages

Ratings22

Average rating3.9

15

চেক লেখক কারেল চাপেক-এর বিজ্ঞান-কল্পকাহিনী নাটক রসাম'স ইউনিভার্সাল রোবট, বা সংক্ষেপে আর.ইউ.আর। বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও থিয়েটারকে এক বিন্দুতে মিলিয়েছেন এমন লেখক/ নাট্যকার পৃথিবীতে খুব বেশী নেই। অন্তর্জালে ঘাঁটাঘাঁটি করে জানলাম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ভিত্তিক থিয়েটার নাটক নিয়ে আদতে গবেষণাই হয়েছে ভীষণ কম। ১৯৯৩ সালে র‍্যালফ উইলিংহ্যাম বহু গবেষণার পর "সায়েন্স ফিকশন অ্যান্ড দ্যা থিয়েটার' নামে একটি বই বের করেছিলেন যাতে তিনি ৩২৮টি বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ভিত্তিক নাটক তালিকাবদ্ধ করেন। এর অনেকগুলোই মূলত "অ্যাডাপ্টেশন" বা রূপান্তর। সচরাচর মেরি শেলী'র ফ্র্যাংকেন্সটাইন বা রবার্ট লুই স্টিভেন্সনের ড. জেকিল অ্যান্ড মিস্টার হাইড-ই ঘুরেফিরে বিভিন্ন রুপে সায়েন্স ফিকশন নাটক হিসেবে মঞ্চে অভিনীত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এর বাইরে অ্যান্থনি বার্জেসের "আ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ"-এর নাট্যরূপও বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনীকে নাটক হিসেবেই লেখা-এমন কাজ সত্যিই বেশ দুর্লভ। চাপেকের আর.ইউ.আরকে এ ঘরানায় প্রথম বলা যাবে না, সে কৃতিত্বটির দাবীদার সার্বিয়ান নাট্যকার দ্রাগুতিন ইলিচ-এর ("অ্যাফটার মিলিয়ন অফ ইয়ারস", ১৮৮৯), তবে আর.ইউ.আর ভিন্ন একটি কারণে অনন্য। "রোবট" শব্দটি পৃথিবীতে প্রথম চাপেক-ই ব্যবহার করেন এই নাটকে। আজও রোবটিক্সের পাঠ্যবইয়ের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম লাইনটি শুরু হয় চাপেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে।

চেক ভাষায় "রোবোতা" শব্দের অর্থ (ক্রীতদাসদের দিয়ে করানো) জোরপূর্বক শ্রম। ১৯২০ সালে লেখা এই নাটকে চাপেক নিকটবর্তী এক ভবিষ্যতের ছবি দেখান, যখন জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রোবটের ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে; বিজ্ঞানী রসাম-এর কারখানায় বিরাট দক্ষযজ্ঞ চলছে, একদিনেই ১৫ হাজার রোবট সরবরাহের ফরমায়েশ হরদম আসছে। এই রোবটেরা দেখতে হুবহু মানুষের মতো; সাধারণের চোখে কোন পার্থক্যই ধরা পড়ে না। রোবট কারখানায় যে মানুষেরা কাজ করে, তারা অবশ্য জড়বুদ্ধির এই রোবটদের যন্ত্রের চেয়ে বেশী কিছু মনে করে না। এদিকে রোবটদের "মর্যাদার" এই অবনমনে কিছু কিছু মানুষের ঘোর আপত্তি, তারা রোবটের জন্য মানবাধিকার সংঘ খুলে রোবটদের বেতন-ভাতা এবং অন্যান্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন শুরু করেছে। নাটকের শুরু ঠিক এখানেই। রোবটের অধিকার নিয়ে কর্মরত হেলেনা রসাম-এর রোবট ফ্যাক্টরীতে এসে উচ্চকণ্ঠে তার দাবী জানায়ঃ রোবটদের সাথে সম্মানসূচক আচরণ করতে হবে, তাদের শ্রমের মূল্য দিতে হবে, রোবটেরও যে "আত্না" আছে, তার স্বীকৃতি দিতে হবে।

পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতিতে একটি শব্দ বিগত এক দশকে বেশ জনপ্রিয় হয়েছেঃ woke। ইংরেজী wake শব্দের past participle এই রুপটি ব্যবহৃত হয় মূলত রাজনীতি নিয়ে সচেতন তরুণ সমাজকে বোঝাতে, যাঁরা বিভিন্ন সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জাগ্রত ভূমিকা পালন করেন। এ শব্দটির প্রচলন যখন প্রথম শুরু হয়, তখন এটি প্রশংসাসূচক অর্থেই ব্যবহৃত হতো; বিশ্বব্যপী যখন নানা অবিচার, বৈষম্য, বিভেদ, বর্ণবাদ চলছে, তখন চারপাশে ঘুমিয়ে থাকা শত কোটি মানুষের মাঝে মুষ্টিমেয় "জাগ্রত" কয়েকজনই যে প্রকৃত বীর সে তো সন্দেহাতীত। তবে এক দশকের পার্থক্যে এই শব্দটির অর্থ অনেকটাই বদলে গেছে; সম্পূর্ণ বিপরীত একটি অর্থে শব্দটির প্রয়োগ চলছে বর্তমানে। হালের সময়ে টিটকারী মেরে তাঁদেরই "ওক" বলা হয়, যাঁরা ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে উচ্চকিত হন। একটি সামাজিক সমস্যার আগাগোড়া না জেনে, প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত যোগাড় না করে, সমস্যাটির ইতিহাস পর্যবেক্ষণ না করেই যাঁরা সমস্যাটি নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন, এবং সেটি সমাধানের বিভিন্ন (আধাখেঁচড়া) উপায় বাতলে দেন, তাঁদের আজ মোটা দাগে এই "ওক" বলা হচ্ছে। এই শব্দটি দিয়ে আজ বোঝানো হয় এঁরা অনেকটা যেন এতদিন ঘুমিয়েই ছিলেন, এবং হঠাৎ ধড়ফড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠে ঝাপসা চোখ এবং মস্তিষ্ক দিয়ে চারপাশটা বিচার করছেন।

মাত্র বছর দশেকের ব্যবধানে অমন প্রশংসাসূচক একটি শব্দ মশকরার বিষয়ে কেন পরিণত হলো? এর কারণ প্রগতির সঠিক সংজ্ঞা কী তা নিয়ে প্রগতিশীলদের ভেতরে থাকা অনৈক্য, এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতির আন্দোলনটির প্রতি তাঁদের নৈতিক অসততা। যে আন্দোলনের সাথে তাঁরা যুক্ত, সেটির কারণ, লক্ষ্য, ও উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁদের পড়াশোনার অভাবও অশ্লীলভাবে চোখে পড়ে সময়ে সময়ে। আহমদ ছফা প্রায় তিন দশক আগে এ বিষয়ে অমর একটি উক্তি রেখে গেছেন,

যারা মৌলবাদী তারা একশো ভাগ মৌলবাদী। কিন্তু যারা প্রগতিশীল বলে দাবী করে থাকেন তাদের কেউ কেউ দশ ভাগ প্রগতিশীল, পঞ্চাশ ভাগ সুবিধাবাদী, পনেরো ভাগ কাপুরুষ, পাঁচ ভাগ একেবারে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন।”

রসামের রোবট কারখানায় রোবটদের মুক্তির দাবী নিয়ে আসা হেলেনকে এ দলে ফেলা যায়। পৃথিবীতে রোবটের অত চাহিদার কারণ মূলত মুনাফা; রোবটের ব্যবহার কারখানার মালিকের খরচ কয়েকগুণ কমিয়ে দিয়েছে। চাপেক তাঁর নাটকে যে পৃথিবী দেখিয়েছেন তা খাদ্য সরবরাহে বেশ অনেকটাই স্বয়ংসম্পন্ন; এর কারণ খাদ্য উৎপাদন, প্রস্তুতি, বাজারজাতকরণ-ইত্যাদি নানান ধাপগুলো এখন রোবটদের দিয়ে করানো হচ্ছে, ফলে উৎপাদনের হার বহুগুণ বেড়ে গেছে। “এক টুকরো রুটির দাম কত?”-রোবট বিজ্ঞানীদের এই সামান্য প্রশ্নটির উত্তর হেলেন জানেনা। যে অভিজাত কাপড়টি পরে হেলেন কারখানা পরিদর্শনে এসেছে, সে কাপড়ের গজ প্রতি দাম কত তার ব্যাপারেও বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তার। উৎপাদন ব্যয় কমে যাওয়ায়, এবং উৎপাদনের হার বেড়ে যাওয়ায় পৃথিবীব্যাপী মানুষের যে খেতে পরতে সুবিধে হচ্ছে সে ব্যাপারেও হেলেন সম্পূর্ণই অজ্ঞ। আর্থিক বিষয়গুলোকে আমলে না নিয়ে, বৈশ্বিক একটি ছবি মনে ধারণ না করে কেবল আবেগের বশবর্তী হয়ে হেলেন তার দাবী নিয়ে এসেছে। আন্দোলনের নির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য না থাকায় হেলেন ও তার রোবটাধিকার সংঘের কার্যত কোন অবদানই থাকেনা, এবং হেলেন রোবট কারখানার বিজ্ঞানীদের ক্রীড়নকেই পরিণত হয় ধীরে ধীরে।

তবে চাপেকের এ নাটকের মূল গল্প হেলেনের "feel good" আন্দোলন নয়; রোবটেরা একসময় সত্যিই নিজেদের "আত্না" এবং অধিকার নিয়ে সচেতন হয়, এবং মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। রোবট কারখানার এক প্রকৌশলীকে শুধু বাঁচিয়ে রেখে গোটা পৃথিবীর সব মানুষকে নিকেশ করে দেয় তারা। “টার্মিনেটর” ঘরানার অসংখ্য চলচ্চিত্রে এ গল্প আমরা বহু বহুবার দেখেছি, কিন্তু চাপেকই সম্ভবত প্রথম আমাদের সতর্ক করে গেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিদ্রোহ প্রসঙ্গে। এ নাটকের প্রায় ১০০ বছর পর ইউভাল নোয়াহ হারারি আজ আশঙ্কা করছেন আগামী দিনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই হয়তো আমাদের বলে দেবে কাকে বিয়ে করতে হবে, কাকে ভোট দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে ভর্তি হতে হবে। ইতোমধ্যে অনেকেই অংকের হোমওয়ার্ক, বইয়ের রিভিউ ইত্যাদি চ্যাটজিপিটি'র মতো এআই দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। চাপেক বর্তমানে অন্য আর যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক।

তবে চাপেকের এ নাটকের মূল গল্প হেলেনের "feel good" আন্দোলন নয়; রোবটেরা একসময় সত্যিই নিজেদের "আত্না" এবং অধিকার নিয়ে সচেতন হয়, এবং মানুষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। রোবট কারখানার এক প্রকৌশলীকে শুধু বাঁচিয়ে রেখে গোটা পৃথিবীর সব মানুষকে নিকেশ করে দেয় তারা। “টার্মিনেটর” ঘরানার অসংখ্য চলচ্চিত্রে এ গল্প আমরা বহু বহুবার দেখেছি, কিন্তু চাপেকই সম্ভবত প্রথম আমাদের সতর্ক করে গেছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিদ্রোহ প্রসঙ্গে। এ নাটকের প্রায় ১০০ বছর পর ইউভাল নোয়াহ হারারি আজ আশঙ্কা করছেন আগামী দিনগুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই হয়তো আমাদের বলে দেবে কাকে বিয়ে করতে হবে, কাকে ভোট দিতে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে ভর্তি হতে হবে। ইতোমধ্যে অনেকেই অংকের হোমওয়ার্ক, বইয়ের রিভিউ ইত্যাদি চ্যাটজিপিটি'র মতো এআই দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। চাপেক বর্তমানে অন্য আর যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক।

ছবিঃ নাটকের ৩য় অঙ্কের দৃশ্য, বিদ্রোহী রোবটেরা কারখানার মানুষদের মেরে ফেলছে, ১৯২১। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া

কেউ কেউ চাপেকের এ নাটকটিকে প্রযুক্তি-বিরোধী হিসেবে দেখতে পারেন, কিন্তু আদতে চাপেক প্রচ্ছন্নভাবে সমালোচনা করেছেন আগ্রাসী পুঁজিবাদী মনোভাবকে। অতি মুনাফার লোভে মানুষ বুদ্ধিমান রোবট বানিয়ে জীবন-যাপন একেবারেই সহজ করে ফেলেছিলো। সে জীবন একদিকে যেমন সংগ্রামহীন, অপরদিকে তেমনি রাজনৈতিক সচেতনতাহীনও বটে। হেলনদের জন্ম এখান থেকেই। হেলেনের এই চরিত্রটি দিয়ে চাপেক স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছেন আধসেদ্ধ সচেতনতা, ও অন্ধ আবেগ দিয়ে সমাজ উদ্ধার করা যায় না। সমাজ উদ্ধারের জন্য যে গভীর চিন্তার প্রয়োজন, সেই চিন্তা করবার কষ্টটি স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাওয়া এক জীবনে কেউ আর করতে চায় না।

চাপেক যেভাবে তাঁর নাটক শেষ করেছেন, তাতে ধারণা হয় “শোষক শ্রেণীকে উচ্ছেদ করে শাসিত শ্রেণী নতুন এক পৃথিবীর জন্ম দেবে”-এমন একটি বিষয়েরও দিকেও তিনি ইঙ্গিত করেছেন। নাটকের শেষ দৃশ্যে “নারী” ও “পুরুষ” দুটি রোবট একে অপরের প্রেমে পড়ে, এবং পৃথিবীর শেষ মানুষ অ্যালকুইস্ট-এর আশীর্বাদ নিয়ে “অ্যাডাম” ও “ইভ” নাম ধারণ করে। একপক্ষীয় শোষণ যে চিরদিন চলতে পারেনা, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যে শোষিতেরাও মরণ কামড় দিতে জানে এই সত্যটি শোষক-শোষিতের সংগ্রামে বারবারই ফিরে ফিরে আসে; মানুষ-রোবট, সাদা-কালো, পাকিস্তানী-বাঙালি, বাঙালি-পাহাড়ি...যে রূপেই হোক না কেন।

তবে শোষকেরা বরাবরই কানে ঠসা হন।

February 3, 2023Report this review