Ratings6
Average rating4.2
মার্সেল প্রুস্ত বলেছিলেন, আমাদের অতীতকে আমরা যেভাবে মনে রাখি, অতীত আসলে তার চেয়ে অনেকটাই অন্যরকম ছিল। প্রুস্তের এই কথার সঙ্গে “বিস্মৃতি”র কোনো সম্পর্ক নেই। বিস্মৃতি মানে ভুলে যাওয়া। এখানে উনি স্মৃতির প্রতারণার কথা বলতে চেয়েছেন। অথবা স্মৃতির বিশ্বাসঘাতকতার কথা। আমরা কতটা ভরসা করতে পারি আমাদের স্মৃতির উপরে?
এই কাহিনিতে নির্দিষ্ট কোনো প্লট নেই। নির্দিষ্ট কোনো শুরু নেই। শেষ নেই। ঠিক যেমন আমাদের অবচেতন এবং অস্তিত্বের মধ্যে সারাক্ষণ নিচুস্বরে কথোপকথন চলতে থাকে, অনেকটা তেমনভাবে বলা হয়েছে এই গল্পটা। সিরিল র্যাডক্লিফ নামের একজন ব্রিটিশ আইনজীবী, যিনি আগে কোনোদিন ভারতবর্ষে পা রাখেননি, তাকে ভারতবর্ষ দেশটাকে ভেঙে দু-টুকরো করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। সময় দেওয়া হয়েছিল ৫ সপ্তাহ।
এই নামমাত্র সময়ের মধ্যে একটা কাল্পনিক সীমারেখা টেনে, পাশাপাশি বসবাস করা অসংখ্য মানুষকে তিনি পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। খণ্ডিত দুই ভূখণ্ড, একে অপরের কাছে পরিণত হয়েছিল স্রেফ স্মৃতিতে। নিমেষের মধ্যে বর্তমান রূপান্তরিত হয়েছিল অতীতে। অতীত মানেই স্মৃতি। কিংবা স্মৃতি এবং বিস্মৃতির মাঝামাঝি কয়েকটা ধূসর সীমারেখা। দ্য শ্যাডো লাইনস।
উপন্যাসটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যেন অনেকগুলো টুকরো টুকরো গল্পের মাধ্যমে একটা সম্পূর্ণ গল্পের অবয়ব ফুটে উঠেছে। এই টুকরো গল্পগুলোতে অতীত এবং বর্তমানের সীমারেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বর্তমানের পরের লাইনেই অতীত এবং অতীতের পরের পরিচ্ছেদেই বর্তমানের এই মিশেল পাঠকের মনে একটা ঘোরের সৃষ্টি করে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অমিতাভ ঘোষের চমৎকার মসৃণ গদ্য।
উপন্যাসটি যার জবানিতে লেখা হয়েছে সেই কথকের নামটা একবারও উল্লেখ করা হয়নি। এই নামহীন কথকের মুখে আমরা জানতে পারি তার প্রতিভাবান কাকা ত্রিদিবের কথা। যার ব্যাপারে কথকের ঠাকুমা বলেছিলেন, ত্রিদিব ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই হতে পারতো, কিন্তু ত্রিদিবের নিজের ইচ্ছে ছিলো “কিছুই-না-হওয়া”। জানতে পারি এই কথাটা যিনি বলেছিলেন সেই ঠাকুমার কথা, দেশভাগের অনেক পরে ঢাকায় ঘুরতে যাওয়ার সময় যাঁর মনে হয়েছিল, তিনি সেখানে যাচ্ছেন না, তিনি ঢাকায় “ফিরে আসছেন”। জানতে পারি ইলার কথা। কথক যাকে মনে মনে ভালোবাসতো। ইলা সেই ভালোবাসার কথা জানতো না।
জানতে পারি, আমাদের স্মৃতি প্রায় সবসময়ই অসম্পূর্ণ। Fragmented. Unreliable. কোন্ ঘটনাটা আমরা মনে রেখে দেবো, কোনটা ভুলে যাবো, একটা ঘটনাকে অনেক অনেক বছর পরে কীভাবে পুনর্নির্মাণ করবো, তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। ফুটবল লেগে আমার নাক ভেঙে গেছিলো। সেই দিনটার ব্যাপারে আর কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে নাক চেপে ধরে মাঠে শুয়ে হঠাৎ আমার চোখে পড়েছিল বিকেলবেলা ঘরে ফিরতে থাকা কয়েকশো পাখির একটা অপূর্ব ঝাঁককে (কয়েক হাজারও হতে পারে)। কুড়ি বছর আগেকার এক শীতের গোধূলিমুহূর্তের এই ঘটনাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে।
এক বন্ধুকে কথাপ্রসঙ্গে এই ঘটনাটা বলার পরে সে হাসতে হাসতে বললো, পাখির ঝাঁক তো সেদিন দেখিসনি তুই। তোর নাক ভেঙেছিল স্কুলের মাঠে দুপুরবেলা। দুপুরবেলায় পাখি কই? পাখির ঝাঁক দেখেছিলি গঙ্গার পাশের মাঠে, যেদিন তোর পা ভেঙেছিলো। মাঠে শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে আমাকেও সেই পাখির ঝাঁক দেখিয়েছিলি তুই। এইরকম আধমাতাল স্মৃতির উপর নির্ভর করেই আমরা সারাজীবন কাটিয়ে দিই! উপন্যাসে এরকম ভঙ্গুর স্মৃতিচারণায় আমরা দেখতে পাই দেশভাগের কথা, দাঙ্গার কথা, দেখতে পাই রাজনীতি কিভাবে প্রভাবিত করে একজন মানুষের জীবনকে, কয়েকজন মানুষের জীবনকে, একটা পরিবারকে, একটা শহরকে, কয়েকটা শহরকে, প্রেমকে, মৃত্যুকে।
“And then I think to myself why don't they draw thousands of little lines through the whole sub-continent and give every little place a new name? What would it change? It's a mirage. The whole thing is a mirage. How can anyone divide a memory?”