Ratings28
Average rating3.5
A millionairess returns to her home town to seek revenge on a man who wronged her in her youth.
Reviews with the most likes.
ধরুন, আপনি একজন লাইনম্যান, হাতের সামনে রাখা সুইচে টিপ দিয়ে ট্রেনের রাস্তা ঘুরিয়ে দিতে পারেন। রোজকার মতো অফিসে বসে সুইচ টিপে টিপে সময়মতো ট্রেনগুলোর রাস্তা বদলে যার যার গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন। এমন সময়ে দেখলেন ঢাকা-সিলেটগামী ট্রেনের লাইনের ওপর ৫ জন ঘুমিয়ে আছে, আর ট্রেন ছুটে আসছে দানবিক গতিতে। হাঁকডাক করে ঘুমিয়ে থাকা ৫ জনকে ওঠাবার কোন উপায় নেই, হাতে সময়ও নেই, একমাত্র উপায় হাতের সুইচটি টিপে সিলেটের ট্রেনকে রাজশাহীর লাইনে উঠিয়ে দেয়া, কিন্তু সে লাইনের ওপর কানে হেডফোন গুঁজে একজন আনমনে হেঁটে চলেছেন, চারপাশে কী হচ্ছে সেদিকে তাঁর কোন নজরই নেই। আপনি কী করবেন? নিশ্চেষ্ট হয়ে চোখের সামনে ৫ জন ঘুমন্ত মানুষের ওপর ট্রেন চলে যেতে দেবেন? নাকি সুইচ টিপে রাজশাহীর লাইনে উঠিয়ে সেই আনমনে হেঁটে চলা লোকটিকেই ট্রেনের চাকার তলে ঠেলে দেবেন? ১ জনের জীবন, নাকি ৫ জনের জীবন? কোনটি বেশী ভারী আপনার কাছে?
দর্শনের ক্লাসের ‘ট্রলি প্রবলেম'-এর এই জটিল ধাঁধাটি তো আমরা অনেকেই জানি। ষাটের দশকের শেষের দিকে একটি গবেষণাপত্রে প্রথমবারের মতো এ ধাঁধাঁটি উপস্থাপন করা হয়, এরপর থেকে ব্যবসা, দর্শন, আইন, নৈতিকতা-ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের ক্লাসে এ সমস্যাটি বিভিন্ন রূপে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়ে আসছে। হালের সময়ের দারুণ জনপ্রিয় সিটকম ‘দ্যা গুড প্লেইস'-এও ট্রলি সমস্যা নিয়ে দারুণ একটি এপিসোড হয়েছে। বলছি বটে মাত্রই ষাটের দশকে এ সমস্যাটি জনসমক্ষে এসেছে, কিন্তু এমন নৈতিক ডিলেমাতে পড়ে তো মানুষ সেই কত শত হাজার বছর ধরেই ঘোল খেয়ে আসছে। আমরা চলচ্চিত্রেই দেখেছি, পৃথিবীর শত কোটি মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা-ইত্যাদি মৌলিক চাহিদাগুলো মেটাতে হিমশিম খেতে দেখে দয়াপরবশ হয়ে থানোস তাঁর দস্তানা পরা হাতে তুড়ি মেরে পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নিকেশ করে সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত করতে চান। আমরা ওয়াচমেন-এ পড়েছি, একই যুক্তি দেখিয়ে অজিম্যান্ডিয়াস আজকের পৃথিবীর কয়েক মিলিয়ন মানুষকে মেরে ফেলতে চান, ভবিষ্যতের বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তর্কপ্রিয়রা বলবেন এরা তো সব কল্পনার মানুষ, এদের ট্রলি প্রবলেমের সেই ডিলেমা কই? তাহলে সত্যিকার মানুষের কল্পনার একটা উদাহরণই দেখা যাকঃ
চীনে ৫০-এর দশকে মাও সে তুং-এর সরকার যখন একের পর এক মুর্খতায় ভরা অবিমৃষ্যকারী সব সিদ্ধান্ত নিয়ে ৪ বছর মেয়াদী দীর্ঘ এক ক্ষরা ডেকে আনে, তাতে সাড়ে ৪ কোটি মানুষ না খেতে পেয়ে প্রাণ হারায় (সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তান, আজকের বাঙলাদেশের জনসংখ্যাই তখন ছিলো সাড়ে ৪ কোটির সামান্য নিচে)। মাও নিজে ঘোষণা দিয়ে দেশের মানুষকে উপোস করে মরে যাবার জন্য উৎসাহ যোগান। সাংহাইয়ে দেয়া তাঁর এক বক্তব্যের সারকথা ছিলো, “খাদ্য অপ্রতুল হলে মানুষ মরবে জানা কথা। তাই দেশের অর্ধেক মানুষ খাওয়া ছেড়ে দিলে বাকী অর্ধেক মানুষ বেঁচে যায়, বৃহত্তর স্বার্থে আপনারা সেটাই করুন। দেশ আপনাদের এই মহান ত্যাগের কথা আজীবন সোনার অক্ষরে লিখে রাখবে”। সঙ্গীতের মতোই রাজনীতি, ধর্ম-ইত্যাদিও গুরুমুখী বিদ্যা। গুরু যে সুরে গলা চড়ান, শিষ্য তার বাইরে বেশী একটা সুর ভাঁজেন না। মাও-এরও তেমনি গুরু ছিলো। দেশের মানুষদের না খেয়ে মরে যাবার আহবান জানাবার এ জাদুকরী সুর তিনি শিখেছেন লেনিন আর স্টালিনের কাছ থেকে। সত্যিকার এই মানুষদের মনের ফ্যান্টাসিগুলো বাস্তবায়িত করতে গিয়ে এঁদের ফ্যান্টাসির ট্রলির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে অর্বুদ কোটি মানুষ।
একটি মাত্র জীবনের চেয়ে পাঁচ পাঁচটি জীবন অনেক বেশী দামী এবং গুরুত্বপূর্ণ, এমন ভেবে অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন “সিলেটের ট্রেনটিকে ঘুরিয়ে রাজশাহীর লাইনেই উঠিয়ে দেই” । তাহলে পরিস্থিতিটা আরেকটু ঘোরালো করা যাক, কি বলেন? আচ্ছা, সিলেটের লাইনের ওপর ঘুমিয়ে থাকা ঐ ৫ জন যদি কারওয়ান বাজারের বস্তিতে বাস করা এক রিকশাওয়ালা আর তার পরিবারের লোকেরা হয়, আর রাজশাহীর লাইনে একাকী হেঁটে চলা ব্যক্তিটি যদি হন দেশের সেরা একজন বিজ্ঞানী, কিংবা সাহিত্যিক, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক? অথবা, সে ৫ জন যদি আপনার পরিবারের কেউ হন, আর একা হেঁটে যাওয়া মানুষটি যদি হন আপনার ধর্মের সবচেয়ে প্রভাবশালী ধর্মগুরুটি, যাঁর প্রতি অন্ধ আনুগত্যই আপনার ধর্মটি পালন করবার প্রধান শর্ত? চাইলে চরিত্রগুলোকে অদল-বদল করে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে এই থট এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যেতে পারেন, আমার আর মিছেমিছি নিজের মনের ওপর চাপ বাড়াতে ভালো লাগছে না...
সুইস নাট্যকার ফ্রিডরিখ ডুরেনমাট ট্রলি প্রবলেম গোছের এমন একটি গল্পই ধরেছেন তাঁর নাটক দ্যা ভিজিট-এ। ইওরোপের অখ্যাত, ভীষণ দারিদ্র্যের মধ্যে দিয়ে চলা এক গ্রামে অনেক বছর পর ঘুরতে আসেন এক প্রৌঢ়া নারী, যাঁর জন্ম এখানেই। আজ তিনি শত কোটিপতি। জন্মস্থান ঘুরে দেখার এ সফরে সাথে করে নিয়ে এসেছেন তাঁর বিরাট লটবহর; যে আরাম কেদারায় তিনি বসেন, সেটি কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটবার জন্য আছে দুই মুষকো জোয়ান, আছে খাঁচায় বন্দী তাঁর শখের পোষা চিতাবাঘ, আর আছে তাঁর সপ্তম স্বামী। গ্রামবাসীরা একাগ্র চিত্তে অপেক্ষা করে আছে, নিজ জন্মস্থানের এ গরিবী হাল দেখে ধনকুবের ক্লেয়ারের মন না কেঁদে পারবে না, তিনি নিশ্চয়ই বড় অঙ্কের টাকা দান করবেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া কল কারখানাগুলো তাঁর দানে আবার চালু হবে, মানুষের কর্মসংস্থান হবে...ক্লেয়ারের মন গলাবার জন্য তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্লেয়ারের ছোটবেলার প্রেমিক/ বন্ধু ইল। ইলের সাথে দেখা হলেই প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগের সেই প্রেমের ইতিহাস মনে করে ক্লেয়ার যে উদারহস্ত হবেন তাতে সন্দেহ কী? ক্লেয়ার সত্যিই কথা দেন, তিনি সাহায্য করবেন। টাকার যে অঙ্কটা তিনি উল্লেখ করেন, তা গ্রামবাসীদের সুদূর কল্পনার অতীত। সবার মুখ হাঁ হয়ে যায় এই বিপুল পরিমাণ অর্থসাহায্যের কথায়। কিন্তু ক্লেয়ার একটি শর্ত জুড়ে দেন; এ দশ লাখ টাকা পেতে হলে গ্রামবাসীদের ভেতর কাউকে এগিয়ে আসতে হবে ইলকে হত্যা করবার জন্য।
ইলের সাথে তরুণ বয়েসে যখন ক্লেয়ারের প্রেম হয়, তার অব্যবহিত পরেই তিনি সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়েন। পিতৃত্বের দায়িত্বের ঝামেলায় জড়াবার ইচ্ছে ইলের ছিলো না। তাই সে মিথ্যে সাক্ষ্য যোগাড় করে ক্লেয়ারের নামে অপবাদ দিয়ে তাঁকে গ্রামছাড়া করে। বিশ শতকের গোড়ার দিকের সে সমাজে অবিবাহিত কিন্তু সন্তানসম্ভবা ক্লেয়ারের ঠিকানা জোটে এক পতিতাপল্লীতে। সেখানেই বহু হাত বদল হয়ে শেষমেষ এক ধনী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে কোটি টাকার মালিক বনেন ক্লেয়ার। এরপর তিনি একের পর এক বিয়ে করে গেছেন। নাটকে ইল-হত্যার ঘোষণা দেবার কয়েক পাতা পরেই দেখা যায় ক্লেয়ার তাঁর সপ্তম স্বামীকে তালাক দিয়ে অষ্টম স্বামী গ্রহণ করেছেন। ক্লেয়ারের গ্রামের অধিবাসীরা শুরুতে বেশ গাঁইগুঁই করে, ক্লেয়ারকে তারা মনে করিয়ে দেয় শত হলেও সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ইওরোপে তাদের বাস, যতই গরীব হোক তারা, হাতে রক্ত মেখে বড়লোক হবার ইচ্ছে তাদের নেই, ক্লেয়ার তাঁর প্রস্তাবটি ফিরিয়ে নিতে পারেন। ক্লেয়ার অবশ্য তাঁর অফার বলবৎ রাখেন। দামী হোটেলের বারান্দায় নবম স্বামীর সাথে বসে হট চকলেটের কাপে সুরুৎ সুরুৎ চুমুক দিয়ে তামাশা দেখতে থাকেন...
ইল ওদিকে ক্রমেই প্যারানয়েড হয়ে ওঠে; গ্রামবাসীর আচরণ তার কাছে অন্যরকম ঠেকতে থাকে। পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ তাকে সাত পাঁচ তের বুঝিয়ে বিদেয় করে দেয়, মেয়রকেও আর আগের মতো বন্ধুভাবাপন্ন লাগে না ইলের কাছে। যে মুদি দোকানটি ইল চালায় সেখান থেকে সবাই (বাকীতে) দামী দামী সিগারেট, মদ কিনে নিয়ে যায়, ইলের স্ত্রী-সন্তানেরা (বাকীতে) অভিজাত কাপড় কিনে নতুন মডেলের গাড়ী হাঁকায় (কীভাবে কেনা? সেও বাকীতেই)। গ্রামের কারো কাছেই টাকা নেই, কিন্তু বাকীর হিসেবে সবাই ভোগবিলাস করে চলেছে, সবার মনেই ফূর্তি, সবাই যেন ধরেই নিয়েছে, টাকা আসছে। একসময় মেয়র নিজেই ইলের হাতে বন্দুক তুলে দেন, ইল যেন সসম্মানে নিজের হাতে প্রয়োজনীয় কাজটি করে গোটা গ্রামবাসীকে বাঁচিয়ে দেয়, ইল মরলেই অর্থনীতির চাকাটি সচল থাকে। তাছাড়াও, ইলের কৃতকর্মটিও তো কম গর্হিত নয়।
শেষতক কী হলো জানতে চাইছেন? এর উত্তর আপনি নিজেই দিতে পারবেন। ইলের জন্য কি আপনার মনে কোন দয়ার সঞ্চার হয়? মনের দাঁড়িপাল্লায় এক পাশে দায়িত্ব নিতে না চাওয়া, মিথ্যে সাক্ষ্য দিয়ে ক্লেয়ারের জীবন বরবাদ করে দেয়া ইল আর আরেকপাশে গোটা গ্রামবাসীকে উঠিয়ে হিসেব করতে থাকুন।
ফ্রিডরিখ ডুরেনমাট-এর এই দ্যা ভিজিট নাটকটিই তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হিসেবে স্বীকৃত। ডুরেনমার্ট বলেছেন তাঁর কাজকে বুঝতে হলে, সঠিকভাবে তারিফ করতে হলে আগে ‘গ্রটেস্কনেস' বুঝতে হবে। ট্র্যাজি-কমেডি ধাঁচের এ নাটকে মানব চরিত্রের কাটাছেঁড়ার কাজটিই তিনি আসলে করেছেন। আর কে না জানে, মানব চরিত্র মাত্রেই ‘গ্রটেস্ক'। চোখা চোখা দারুণ উইটি এবং সূক্ষ্ম সব সংলাপ ও ঘটনার অবতারণা করেছেন ডুরেনমাট, সব দেখেশুনে মনে হয় মানবজাতির ওপর বেশ অনেকটাই বীতশ্রদ্ধ ছিলেন তিনি, এবং তাঁর এই ঘেন্না পাঠক/ দর্শকদের মাঝেও সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন তিনি। বড় লেখকদের (বিশেষত নাট্যকারদের) প্রায় সবাইকেই আসলে এটাই কি করতে দেখি না আমরা?
ডুরেনমাট-এর একটি উপন্যাস অবলম্বনেই ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার বিজয় তেন্ডুলকার তাঁর বিখ্যাত নাটক শান্ত! কোর্ট চালু আহে লেখেন, দেশে বিদেশে এ নাটক বহু বহুবার প্রদর্শিত হয়েছে, আগ্রহী কেউ চাইলে এ নাটক ইউটিউবেও দেখে নিতে পারেন। নাট্যকার মাত্রেই বেয়াদব হন; কোন একটি এজেন্ডা ছাড়া, ওপর মহলের প্রতি মধ্যমা প্রদর্শন ব্যতিরেকে নাটক আসলে হয় না। বিজয় তেন্ডুলকারের নাটকের নাম থেকেই বুঝে নেয়া যায় তাঁর কোর্ট চালু আহে নাটকের উদ্দেশ্য এবং বিষয়বস্তু কী, এবং কতটা বেয়াদব তিনি হতে পারেন। আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নাটক পড়িয়ে সে বেয়াদবী সঞ্চারিত করেছেন তাঁর শিক্ষার্থীদের মাঝেও। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০২ সালে যখন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গুজারাত দাঙ্গায় মুসলমান হত্যায় সরাসরি মদদ দেন, সে সময় প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত তেন্ডুলকার বলেছিলেন, “আমার কাছে একটা পিস্তল থাকলে আমি এখনি মোদীকে গুলি করে দিতাম”। এমন চরিত্রের একটি মানুষ যখন ডুরেনমাটের কাছ থেকে ধার করেন, তখন সেই ডুরেনমার্টের বাকী সব বইকেও অবশ্যই তালিকায় রাখতে হয়। ডুরেনমাট তাই থাকছেন, থাকবেন।
বিজয় তেন্ডুলকারের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মহর্ষি শ্রী শ্রী ঠাকুর অরূপরতন। তাঁর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা।