Ratings1
Average rating5
“গোলকধাম রহস্য” গল্পের শুরুতে মহাভারত প্রসঙ্গে তপেশরঞ্জন মিত্তির বলেছিলো, “এ হলো একধার থেকে ননস্টপ ভূরিভোজ। গল্পের পর গল্পের পর গল্প।” তপেশরঞ্জন ওরফে তোপসের এই কথা শুনে তার কাজিন-ব্রাদার ফেলু মিত্তির উল্লসিত হয়ে এই বইকে “আনপুটডাউনেবল” আখ্যা দিয়েছিলেন। “যে বই একবার পড়ব বলে পিকআপ করলে আর পুট-ডাউন করবার জো নেই!” যদিও তিনি যেটা পড়ছিলেন, সেটা ছিলো থানইঁট সাইজের কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত। কালীসিঙ্গির মহাভারত আমি একবার ট্রাই করেছিলাম। সামলাতে তো পারিই নি, উল্টে ল্যাজে-গোবরে হয়ে গেসলুম।
কালীপ্রসন্ন সিংহের দুই-খণ্ডের মহাভারত এমনিতেই সেই ঊনবিংশ-শতক স্টাইলের তৎসমবহুল পুরোনো বাংলায় লেখা। রেলগাড়ির মতো ইয়া লম্বা লম্বা বাক্য। তার উপর মহাভারতের কিসসার তো কোনো অন্ত নেই। একই কাহিনি চোদ্দোবার বলা হয়েছে। বেশিরভাগ কাহিনির সঙ্গে মূল গল্পের কোনো সংস্পর্শ নেই। সংস্পর্শ থাকলেও সেই সংস্পর্শের বিষয়টা আবিষ্কৃত হয়েছে চারশো-বত্তিরিশ পৃষ্ঠা পরে গিয়ে। চরিত্রদের সংখ্যারও কোনো গোনাগুন্তি নেই। গল্প ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে। দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি, কূটনীতি, রাজনৈতিক তত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, আরো গুচ্ছের সব কঠিন কঠিন ব্যাপার-স্যাপার। প্রথমখণ্ডের ২৬.৩২% এগিয়েই মুন্ডু খামচে বসে থাকার মতো অবস্থা। সেল্ফ-কনফিডেন্সের সোয়া-বারোটা বেজে গেছিলো।
সেই কবে ছোটোবেলায় উপেন্দ্রকিশোরের মহাভারত পড়েছিলাম। রামায়ণ আর মহাভারত যদিও আলাদা করে পড়তে হয়না ভারতীয়দের। বিশেষ করে রামায়ণ। প্রি-ইনস্টলড সফটওয়ারের মতো, জন্মের সময় থেকেই এই গল্প আমাদের মগজের মাদারবোর্ডে চিপকানো থাকে। পৌনে-দুই বছরের পুঁচকে নাকেশিকনি ছোঁড়াকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, রামচন্দ্রের শত্তুর কে? সেও আধো উচ্চারণে ঠিক ঠিক জবাব দেবে : রাবণ। রামচন্দ্রের বউ? - হিহি, সীতা।
কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর তো অল্পবয়েসিদের কথা চিন্তা করে মহাভারত লিখেছিলেন। খোকাখুকুদের মন যাতে দূষিত না-হয় সেকথা ভেবে সমস্ত “অ্যাডাল” প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছেন। অনেক গুরুগম্ভীর বিষয় ছেঁটে দিয়েছেন। শরশয্যায় শুয়ে পিতামহ ভীষ্ম কাকে কাকে কী কী পরামর্শ দিয়েছেন সেই জটিল কথাবার্তা শুনলে শিশুরা তো মনে মনে বলবে, অ্যাম্মা ক্বী বোরিং গল্প মাইরি ধুস্ আমি খেলতে গেলাম ঝন্টু তোর ব্যাট বের কর। তাই ওই বইতে ওইসব কিছুই নেই। কিন্তু আমি তো এখন বড় হয়ে গেছি! কালীপ্রসন্নও মুখ বাঁকাচ্ছেন আমার বুদ্ধিশুদ্ধির অভাব দেখে। তাইলে কি মহাভারতটা ভালো করে পড়াই হবে না আমার?
ঠিক এমনি সময়ে, এন্টার দ্য রাজশেখর দ্য বসু! এর আগে তাঁর হাসির গপ্পো পড়ে আঁকুপাঁকু হেসেছি অনেক। হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ হাসতে হাসতে হঠাৎ চোখে পড়লো : আরে! ভদ্রলোক তো বিখ্যাত অভিধানও সংকলন করেছেন। “চলন্তিকা”। অলরাউন্ডার নাকি? তারও পরে একদা হাতে এলো তাঁর লেখা মহাভারত। আমার সব ছ্যাবলামি ফুলস্টপ হয়ে গ্যালো। আমি মহাভারত পড়লাম। কালীপ্রসন্নের দুইখণ্ডের দুটো থানইঁটকে উনি ওস্তাদের মতো পালিশ করে একখণ্ডের সুদৃশ্য শিল্পবস্তুতে পরিণত করেছেন। আমি তখনও বুদ্ধদেব বসু পড়িনি। মুজতবা আলি পড়িনি। শঙ্খ ঘোষ পড়িনি। বাংলা গদ্যের বলিষ্ঠ সৌকর্যে আমার প্রাণ যেন ভরে গ্যালো। প্রথমবারের জন্যে।
মহাভারতকে বলা হয় পৃথিবীর দীর্ঘতম মহাকাব্য। পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোর অন্যতমও বটে। হিন্দুধর্মের একটা প্রধান আকরগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হলেও আমি মহাভারতকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করিনা। একটা কথা সত্যি, মহাভারতের ভেতরেই আছে “শ্রীমদ্ভগবতগীতা”, যে-বইটি হিন্দু বেদান্ত-দর্শনের সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎস হিসেবে মান্যতা পেয়ে এসেছে বরাবর। কিন্তু মহাভারতের বিশালতাকে শুধুমাত্র একটি ধর্মের চৌহদ্দিতে আটকে রাখার চেষ্টা করা উচিত হবে না, চেষ্টা করে লাভও হবে না। মহাভারতের আবেদন সর্বজনীন। কোনো বিশেষ ধর্ম নয়, একটি বৃহৎ অঞ্চলের সম্মিলিত সংস্কৃতি ও সভ্যতার দীর্ঘকালীন লৌকিক ইতিহাস এটি। অধুনা-প্রচলিত আনুষ্ঠানিক পৌত্তলিক ধর্মের সংগঠন হয়েছে আরো অনেক পরে।
মূল মহাভারতের বিস্তারিত আলোচনা করার পরিসর এটা নয়। (আমার পক্ষে সম্ভবও নয়!) আমি বরং রাজশেখর বসুর ভার্শনটার ব্যাপারে আর মাত্তর চাট্টি কথা বলে আজকের বক্তিমে শেষ করবো আজ্ঞে। রাজশেখর বসুর মহাভারতের সবচেয়ে বড় প্লাসপয়েন্ট হলো, মূল মহাভারতের একটা উপাখ্যানও উনি বাদ দেননি। একটা প্রসঙ্গও হাপিস করেননি। এমনকি প্রচলিত দার্শনিক অংশগুলোও দিব্যি রেখে দিয়েছেন (যেমন “গীতা”)। উনি শুধু মূল সংস্কৃত মহাভারতের অতিরিক্ত কোলেস্টরল এবং ফ্যাটকে ট্রেডমিল-দ্বারা বর্জন করিয়ে সিক্স-প্যাক সারবস্তুটুকু পরিবেশন করেছেন। যাতে আমার মতো ধৈর্যহীন, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন ব্যক্তিরাও মহাভারত-পাঠের অভিজ্ঞতা এবং আনন্দ লাভ করতে পারে।
ভাগ্যিস রাজশেখর বসু ছিলেন। তাই আমিও এখন গুরুগম্ভীর আলোচনায়, বিজ্ঞবাগীশ কলার তুলে, স্লো-মোশনে জামার হাতা গোটাতে গোটাতে উদাস কিন্তু হেব্বিজ্ঞানী নয়ন মেলে বলতে পারি : তো ইয়ে যেটা বলছিলাম আরকি... গরুড় যদিও সেই বিশাল গাছটার মগডালে বসে আরাম করে গজকচ্ছপ ভোজন করছিলো, কিন্তু গাছের ডাল তো গ্যালো ভেঙে... শেষ পর্যন্ত গন্ধমাদন পর্বতের শৃঙ্গে বসেই ভোজন করতে হলো তাকে, আর কোনো উপায়ও তো ছিলো না বেচারার, তাইনা?
আপনারা যারা রাজশেখর পড়েননি তারা তো আমার কথা কিসুই বুঝবেন না। শুধু বলবেন, হেঁ হেঁ তা তো বটেই, তা তো বটেই...