বাংলাভাষায় লেখা নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠলে, “তিতাস একটি নদীর নাম” উপন্যাসের কথা সবার আগে মনে পড়ে। তিতাস নদীর চেয়ে খ্যাতনামা নদী বাংলাদেশে আরো অনেক আছে। তবু এই আপাত-অখ্যাত নদীটিকে, অদ্বৈত মল্লবর্মণ চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন আপামর বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে। প্রধানত দুটো কারণে।
এক। প্রান্তিক হতদরিদ্র মৎস্যজীবি সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়াশুনার রেওয়াজ, সেই আমলে প্রায় ছিলোনা বললেই চলে। এমন অবস্থায়, নিরক্ষর মালোজাতিদের ঘরের একজন মানুষ, দৈবক্রমে লেখাপড়া শিখে, নিজের জাতির মানুষদের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার বিবরণ এরকম দরদ দিয়ে লিখবেন, এটা একটা অভাবনীয় ঘটনা। সারা পৃথিবীতে এই বিরল ঘটনা ক'টা ঘটেছে তা আঙুল গুনে বলে দেওয়া যায়।
দুই। সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যাওয়া একটা সময়কাল, সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের মানুষজন, তাদের সমাজ, সামাজিক রীতিনীতি, তাদের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, বেঁচে থাকার অপরিসীম সংগ্রাম, তাদের অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা, একদরিয়া দুঃখের মাঝে ভাসমান একঘটি সুখ, জীবনের উত্থান-পতন, তাদের প্রেম-ভালোবাসা-বিরহযন্ত্রণা— এই সমস্তকিছু জানতে পেরে পাঠক হিসেবে আমার উপলব্ধি হয়েছে যে, এইসব বৃত্তান্ত যদি লিখে না-রাখা হতো, একটা অপূর্ব ঐশ্বর্য্য তলিয়ে যেতো কালের গর্ভে। এমনও ছিলো আকাশ বাতাস জল মাটি নৌকা বৃক্ষ নদী চোখের জল? আমরা কোনোদিন জানতেই পারতাম না! এখানেই তো সাহিত্যের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।
বইটা পড়ে যে-অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতিকে চিনলাম, সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান ছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। তাঁর লেখা এবং আব্বাসউদ্দীন আহমদের গাওয়া ভাওয়াইয়া আঙ্গিকের একটা লোকসংগীত আমার খুব প্রিয়। রিভিউ শেষ করার আগে সেই গানের অন্তিম কয়েকটা লাইন এখানে লিখে রাখি। গানের কথাগুলো শুনলে উপন্যাসের চরিত্রদের অভিব্যক্তি এবং সারল্যের কথা মনে পড়ে যায়।
শালিধানের শ্যামলা বনে হইলদা পঙ্খি ডাকেচিকমিকাইয়া হাসে রে চান্দ সৈর্ষা ক্ষেতের ফাঁকে-ফাঁকে সৈর্ষা ক্ষেতের ফাঁকেসোনালি রূপালি রঙে রাঙা হইলো নদীমিতালী পাতাইতাম মুই মনের মিতা পাইতাম যদি রেআরে ঝিলমিলাইয়া ঝালর পানি নাচে থৈইয়া দিয়া পানি নাচে থৈইয়া দিয়া ...