Ratings1
Average rating5
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের কতটুকু মিথ, আর কতটুকু সত্যি, কতটুকু কুয়াশা, আর কতটুকু দ্বিপ্রহরের প্রখর সূর্যালোক— এইসব জটিল ধাঁধার কিছুটা সমাধান হয়েছে, কিছুটা আজও হয়নি, কিছুটা হয়তো কোনোদিন হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর মতো বৈচিত্র্যময় এবং ঘটনাবহুল জীবনের উদাহরণ আর একটিও নেই।
সুভাষচন্দ্র ছিলেন আজন্ম-বিপ্লবী। পারিবারিক স্বচ্ছলতা এবং নিজস্ব প্রতিভার স্পর্ধায় তিনি অতি অনায়াসে একটি আরামের জীবন বেছে নিতে পারতেন। ইংরেজ রাজত্বের সবচেয়ে উঁচুপদের চাকরি পাওয়ার জন্যে যে ICS পরীক্ষা দিতে হতো, সেই পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন। অতি দুর্লভ এবং আপাত-লোভনীয় সেই চাকরিতে তিনি যোগদান করেননি, পরাধীন দেশের প্রতি কর্তব্যের আহ্বান তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে অন্য ভবিতব্যের দিকে।
কর্মজীবনের শুরুই হয়েছে যাঁর এরকম অবিশ্বাস্য ত্যাগের মধ্যে দিয়ে, সেই মানুষটার বাকি জীবনের রূপরেখা আমরা সহজেই আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে দুরন্ত কল্পনাও তাঁর জীবনের বাস্তব কাহিনিকে স্পর্শ করতে পারেনা। অতিমানবিক অকল্পনীয় এক নাটকীয় জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
যখন মূলধারার রাজনীতি করেছেন, তখন স্বয়ং গান্ধীজির নির্দেশ অমান্য করেছেন বারবার। কংগ্রেসের রাজনৈতিক দর্শন যখন ডুবে আছে অহিংসার কোমল নরম এঁটেল মাটির কাদার গভীরে, সেই সময় তিনি বারবার বলেছেন, হাত পেতে ভিক্ষা চাইলে স্বাধীনতা লাভ করা যাবেনা। প্রয়োজন সার্বিক সংগ্রামের। তাঁর নিজের কথায় : “No real change in history has ever been achieved by discussions.”
এই বিকল্প “উগ্র” মনোভাবের কারণে প্রায় প্রত্যেক প্রথমসারির কংগ্রেস নেতার বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। শুধু ব্রিটিশরাই তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেনি, নিজের দলেও তাঁকে ব্রাত্য করে রাখার, তাঁকে মাথা তুলতে না-দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিলো। ব্রাত্য হয়েছেন তিনি মৃত্যুর পরেও। রিচার্ড অ্যাটেনবরো পরিচালিত বিশ্ববিখ্যাত “গান্ধী” ছবির একটা ফ্রেমেও সুভাষচন্দ্রকে দেখা যায়নি। গান্ধীর জীবনে সুভাষচন্দ্র নেই, ভাবা যায়!
অজস্র বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও একটা অবিশ্বাস্য জীবন যাপন করেছিলেন তিনি, সেই জীবনের তুলনা সমগ্র পৃথিবীর মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাঁর জীবনের ভরকেন্দ্র ছিল নিজের দেশমাতৃকার প্রতি অকপট শ্রদ্ধা। আর কিচ্ছু না! আর কোনোকিছু কিংবা কোনো মানুষের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন না। কাউকে পরোয়া করেননি। কোনো বাধাবন্ধন সহ্য করেননি। ভেতো, ভীরু, ক্ষমতার-পদলেহনকারী বাঙালির ঘরে তাঁর মতো সিংহের জন্মগ্রহণ একটা অকল্পনীয় ঘটনা!
বাঙালি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে, মাথায় তুলে নেচেছে। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কাউকে বাঙালি এতটা উঁচু বেদীতে প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু তাঁর জীবন নিয়ে আজ পর্যন্ত একটাও পরিপূর্ণ উপন্যাস লেখা হয়নি বাংলাভাষায় (রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়েও নয়)। এই উপন্যাসটা মারাঠি ভাষায় রচিত। আমি পড়েছি বাংলা অনুবাদে। যেরকম নিষ্ঠার সঙ্গে, গবেষণার পরিশ্রমে, সাবলীল সজীব গদ্যে, এই উপন্যাসটা লেখা হয়েছে, তার জন্যে লেখকের প্রতি শুধু আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানানো যায়! বইয়ের শেষে “তথ্যসূত্র” ও “গ্রন্থপঞ্জী” অংশদুটিতে চোখ বোলালে তাজ্জব হতে হয়।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে কেউ কেউ উল্কার সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু তিনি উল্কা ছিলেন না মোটেও। একটি প্রজ্জ্বলন্ত মশাল ছিলেন। পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে মশালটা আজীবন দাউ দাউ করে জ্বলেছে। কেউ তাঁকে নেভাতে পারেনি! তাঁর জীবনের কথা জানতে পেরে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ হয়। আবার পাশাপাশি এটাও মনে হয় যে, সেই মশালের একটা ছোট্ট স্ফুলিঙ্গের অস্তিত্বও কি আজকের বৃহত্তর বাঙালি সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে?