Ratings1
Average rating4
ঔপনিবেশিক বঙ্গদেশে উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবারের সামাজিক লেক্সিকনে “পশ্চিম” নামে একটি শব্দ ছিল। এই পশ্চিম দিকনির্দেশক পশ্চিম নয়, স্থাননির্দেশক পশ্চিম। তৎকালীন রাজনৈতিক মানচিত্রে বৃহত্তর বাংলাপ্রদেশের সঙ্গে বিহার রাজ্যটি যুক্ত থাকলেও, বাঙালি নিজের জাতিগত সম্ভ্রান্ত-অবস্থানের সঙ্গে সেই রাজ্যের “লিট্টিখোর খোট্টা” বিহারি মানুষ এবং সংস্কৃতিকে একই আসনে স্থান দিতে ইচ্ছুক ছিল না। তাই “পূর্ববঙ্গ” নামের একটি আঞ্চলিক ধারণা প্রচলিত থাকলেও, স্বাধীনতাপূর্ব বাঙালির মননে “পশ্চিমবঙ্গ” বলে কিছু ছিল না। ছিল শুধু “পশ্চিম”। কেবলই পশ্চিম। এর চেয়ে বেশি সম্মান দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
এবং সেই অঞ্চলটি ছিল “ড্যাঞ্চি”। অর্থাৎ “damn cheap”। মানে, নেহাতই সস্তা। জলের দর। বাঙালি বাবুরা পশ্চিমে যেতেন ছুটি কাটাতে, কিংবা “হাওয়া বদল” করতে, কিংবা আমাশয়, অগ্নিমান্দ্য (বর্তমানে “অম্বল”), ক্ষুধামান্দ্য (বর্তমানে “একদম ক্ষিধে হচ্ছে না, ডাক্তারবাবু”), বদহজম-পীড়িত বাঙালির চিরাচরিত উদরসমস্যার উন্নতিকল্পে (কারণ সেই অঞ্চলের খনিজসমৃদ্ধ জল-হাওয়া ছিল ক্ষুধা এবং সুস্বাস্থ্য উদ্রেককারী)। এবং শহর কলকাতার বনেদি বাজারহাটের অগ্নিমূল্যের তুলনায় সেই পশ্চিমের দেহাতি বাজারের জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক সস্তা দর প্রত্যক্ষ করে বাবুদের মুখ থেকে ছিটকে বেরোতো এই কথাটি : Damn cheap! উচ্চারণের বিবর্তনে কথাটি রূপান্তরিত হয় “ড্যাঞ্চি”তে। পরিমল ভট্টাচার্যের বইটি বাঙালির সেই অতীত ড্যাঞ্চিভূমির একটি অভিনব আখ্যান।
শুধু জিনিসপত্র নয়, সেই অঞ্চলের মানুষও ছিল ড্যাঞ্চি। বিহারি বাদ দিলেও, ছোটনাগপুর মালভূমির বিস্তীর্ণ জঙ্গল-অধ্যুষিত অঞ্চলটির ভূমিসন্তান ছিলেন সাঁওতাল, হো, মুন্ডা, ওরাওঁ, কোল, ইত্যাদি অসংখ্য জনজাতিরা (যাঁরা ইদানিং মূলত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অধিবাসী)। কিন্তু সামাজিক অবস্থানের নিরিখে নিজেদের ভূমিতেই তাঁরা ছিলেন সবচেয়ে অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত। যে-অঞ্চলে খাদ্যবস্তুর অস্বাভাবিক সস্তা দর দেখে বাঙালি বাবুরা Damn cheap বলে উল্লসিত হয়ে উঠতেন, সেই একই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের কাঁধে নিয়মিত চেপে থাকতো খাদ্যের অনটন, দুর্ভিক্ষের জোয়াল। শোষণের এক বিচিত্র সহাবস্থানে বহিরাগত বাঙালিদের তৈরি করা সুদৃশ্য রুচিশীল বাগানবাড়িতে ভৃত্যের কাজ করতো সেই অঞ্চলের বুভুক্ষু মানুষরা।
পরিমল ভট্টাচার্যের এই ড্যাঞ্চি-আখ্যানে শুধু ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল নয়, ক্রমশ উঠে এসেছে ব্রিটিশ আমলের খাদ্যসংকটে জর্জরিত আরো অনেক মানুষের কথা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় আছে : “মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি”। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আছে : “বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী, যা হোক একটা দাও কিছু হাতে, একবার ম'রে বাঁচি!” কেমন ছিল সেই ঘর? কেমন ছিল সেই ম'রে বাঁচা? বাঙালিজাতির জাতিগত উৎকর্ষের সফেদ দেয়ালে কুৎসিত ঘুঁটের মতো লেপ্টে আছে মন্বন্তরের স্মৃতিদাগ। যে-দাগ জন্মদাগের মতোই চিরন্তন। ক্রনিক চুলকানির মতো নাছোড়বান্দা। কলকাতা শহরের সুরম্য পথঘাটের আনাচে কানাচে এখনও রয়ে গেছে গগনবিদারী “একটু ভাত দিন গো”... “একটু ফ্যান দিন গো” আর্তচিৎকারের যূথবদ্ধ প্রেতাত্মারা। শিল্পীর আঁকা উডকাট ছবিতে, ফটোগ্রাফারের তোলা সাদাকালো স্থিরচিত্রে, আজও রয়ে গেছে সেই কঙ্কালসদৃশ মানুষদের অশরীরী ছায়া, জ্বলজ্বলে ক্ষুধার্ত চোখের তীব্র চাহনি।
অর্থাৎ জিনিসপত্র নয়, আসলে মানুষই বড় সস্তা। সামাজিক পিরামিডের উঁচুনিচু সহাবস্থানের নকশায় একদল মানুষ আরেকদল মানুষকে বানিয়ে রেখেছে ড্যাঞ্চি। মানুষেরই তৈরি সভ্য সমাজে মানুষ পোকামাকড়ের মতো মারা যায়, কুকুরের মতো (এবং কুকুরেরই সঙ্গে) ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁটে খায়, গবাদি পশুর মতো নির্বিকারে ত্যাগ করতে বাধ্য হয় নিজের মানুষিক আত্মমর্যাদা। ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাসের পঙ্কিল ঘোলাজলে ডুবসাঁতার দিয়ে পরিমল ভট্টাচার্য তুলে এনেছেন অস্বাভাবিক সস্তা মানুষদের কতিপয় প্রত্নচিহ্ন। কখনও কলকাতা শহরের বেওয়ারিশ লাশে-ঢাকা রাজপথে, কখনও ছোটনাগপুরের রুক্ষ প্রকৃতির মাঝে, কখনও দেশভাগের অবাঞ্ছিত জারজ সন্তান উদ্বাস্তুদের কলোনিতে, কখনও ভোরবেলায় গড়ের মাঠে নকশাল বিপ্লবীর পলাতক উদ্বায়ী জীবনে, তিনি খুঁজে খুঁজে ফিরেছেন ড্যাঞ্চি মানুষদের, অবিশ্বাস্য সস্তা মানুষদের।
বিষয়বস্তুর মতোই বইটির রচনাশৈলীও অভিনব। একটি নির্দিষ্ট পথরেখা ধরে চলেনা লেখকের বর্ণনা। এমনকি ভাষাতেও যেন জড়িয়ে রয়েছে স্মৃতিচারণের উচ্ছৃঙ্খল ঘোরগ্রস্ততা। বর্তমান বাংলা নন-ফিকশন সাহিত্যে পরিমল ভট্টাচার্যের গদ্য সম্ভবত সবচেয়ে মৌলিক, সবচেয়ে সুখপাঠ্য। সেই সুখপাঠ্য গদ্যের খাঁজে লেখক অবলীলায় গুঁজে দিয়েছেন বিষাদের বেহালাকান্না। প্রকৃতির শিশিরনিবিড় বর্ণনার মাঝে হঠাৎ ছুঁড়ে দিয়েছেন আনরোমান্টিক অস্তিত্বের নিঃশব্দ হাহাকার। ছড়ানো ছেটানো এলেমেলো ইতস্তত খাপছাড়া এই রচনাশৈলী যেন মানুষেরই খাপছাড়া জীবনের দ্যোতক। যে-জীবন অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে। যে-জীবন সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের মতো খেলা করে। যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের। যে-জীবন চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে অশ্বত্থের কাছে এক গাছা দড়ি হাতে একা-একা হেঁটে যায়।
যে-জীবন ড্যাঞ্চি। হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
(কলকাতার রাজপথ, ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর।
শিল্পী: জয়নুল আবেদিন)