Ratings2
Average rating4.5
"Fate, it seems, is not without a sense of irony."
Morpheus, The Matrix (1999)
রাজা, নাকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-রাষ্ট্রের শাসনদণ্ডটি প্রকৃত অর্থে কার হাতে থাকে? আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে রাজাই দেশের সর্বেসর্বা নায়ক হিসেবে প্রতীয়মান হন, কিন্তু কার্যত কি তা-ই? পর্দা নামিয়ে, দরজা লাগিয়ে দেশ চালনার জটিল হিসেবগুলো রাজা কার সাথে বসে করেন? রাজার ট্যাঁকে অর্থ যোগান কে? কে রাজা হবেন, তা-ই বা কে নির্ধারণ করে দেয়?
এ প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হলে আমরা বাকস্বাধীনতা, নাগরিকের ভোটাধিকার, জনমত-ইত্যাদি গা-জোয়ারি উত্তরগুলো দাঁড় করাতে পারি, কিন্তু আদতে কি তা-ই হয়? ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ধর্মীয় সমাজকে পাশ কাটিয়ে রাজনীতিতে যে টিকে থাকা যায় না তার প্রমাণ তো আমরা সভ্যতার শুরু থেকে আজতক প্রতি মূহুর্তেই পেয়ে চলেছি। আমরা জানি, ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট পবিত্র কোন মানব রাজার আসনে আসলে আসতে পারেন না, বরঞ্চ সিংহাসনে যিনি বসেন, তাঁর জীবনাচার-বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই-রাষ্ট্রটিতে রাজা যে ধর্মমতটি চালু রেখেছেন, তার ভালো ভালো শিক্ষাগুলোর সাথে সম্পূর্ণ সাঙ্ঘর্ষিক। রাজা শোষণে শোষণে আমাদের পিঠ ভাঙেন, কিন্তু আমরা সাধারণেরা এই ভেবে কৃতজ্ঞ হই যে, ভাগ্যিস! ঈশ্বর এবং ধর্ম দুই-ই রাজার সহায় আছেন, ঈশ্বর নিজে ভালোবেসে রাজাকে আমাদের পিঠে ডান্ডা ভাঙতে পাঠিয়েছেন! আমাদের বিশ্বাসের শক্তির কাছে হাজার বছর ধরে চলে আসা বৈষম্য, অনাচার, শোষণ আর অবিচারের ইতিহাস নতজানু হয়ে পড়ে এক নিমিষে। আমরা ভুলে বসি, রাজা আর ধর্মযাজক এক বিছানায় ঘুমোন, গায়ে গা লেপ্টে একে অপরের আদর খান।
একবিংশ শতাব্দীর আমরা আজ গণতন্ত্র বা নাগরিকের অধিকার ইত্যাদি কাঠের তলোয়ার-স্বরূপ অস্ত্র নিয়ে রাজার মুখোমুখি হই; আমাদের আগের শতকগুলোর মানুষের হাতে এই খেলনা অস্ত্রগুলোও ছিলো না। তারা রাজা এবং ধর্মের হাতে যুগপৎভাবে নির্বিচারে মার খেয়ে গেছে। হাজার হাজার বছরের পরিক্রমায় নাগরিকের অধিকারের বলয় যতো বেড়েছে, রাজার ক্ষমতা ততো খর্ব হয়েছে, কিন্তু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিষদাঁত একইরকম তীক্ষ্ণ ও বিষাক্ত রয়ে গেছে। সমাজের বেশীর ভাগ, প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাস রাখেন বলে গণতন্ত্র একটা সময়ে কার্যত ধর্মতন্ত্রের হাতের পুতুল হয়ে পড়ে; ধর্মতন্ত্রের সিদ্ধান্তগুলোই বেশী মানুষের ভোট পেয়ে গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের মুখোশ পরে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকের যে আধুনিক গণতন্ত্র তা প্রতিষ্ঠা পাবার আগে যাজক ও রাজা ধর্মতন্ত্র দিয়ে দেশ চালাতেন; পালা করে করে তাঁরা কখনো জল্লাদ হতেন, কখনো হতেন জল্লাদের হাতের খাঁড়া।
তবে কিছু কিছু সময় তো জল্লাদের হাত থেকেও খাঁড়া পিছলে যায়, কিংবা অধিক ব্যবহারে হাতল ভেঙে আসে। সময়ে সময়ে রাজার সাথে যাজকের সম্পর্কও প্রায়ই এমন পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে; যে যাজক দীর্ঘকাল রাজার একান্ত বিশ্বস্ত খাঁড়া হয়ে জনগণের গলা কেটে এসেছেন, তিনি-ই শেষতক উল্টো ফিরে রাজার নাড়িভুঁড়ি বের করে আনতে চেয়েছেন। দ্বাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় হেনরি ও ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক চার্চের সর্বেসর্বা আর্চবিশপ থমাস বেকেটের মাঝে ঠিক এভাবেই সংঘাত বাধে। ৮০০ বছর পর ফরাসী নাট্যকার জাঁ আনুই ঐতিহাসিক এ ঘটনা অবলম্বনে তাঁর বেকেট নাটকটি লেখেন।
এ নাটকের পুরো নাম Becket or The Honor of God। থমাস বেকেট ইতিহাসের এক কৌতুহলোদ্দীপক চরিত্র। প্রথম জীবনে আপাদমস্তক ভোগী জীবন যাপন করা বেকেট মূলত ছিলেন রাজা দ্বিতীয় হেনরি'র ‘পার্টনার ইন ক্রাইম'; লাম্পট্য, ফুর্তি-ফার্তা, পান-ভোজন, বিলাস-ব্যাসনে একে অপরকে ছাড়া চলতোই না এঁদের। প্রাণের বন্ধু বেকেটকে হেনরি প্রথমে লর্ড চ্যান্সেলর বানান, যা ইংল্যান্ডের সরকারী কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ পদ। এর খুব অল্প পরেই হেনরি বেকেটকে ক্যাথলিক চার্চের শীর্ষ গুরু আর্চবিশপ অফ ক্যান্টরবিউরি'র পদে অধিষ্ঠিত করেন। পদাধিকারের দিক দিয়ে আর্চবিশপের অবস্থান রাজার ঠিক পরেই। বেকেটের আগে যিনি আর্চবিশপ ছিলেন, সেই থিওবাল্ড রাজা হেনরির চক্ষুশূল হয়ে পড়েন, কারণ থিওবাল্ড রাজাকে অর্থসাহায্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
রাজার আসনে বসলে অনেকরকম খরচের নেশায় পেয়ে বসে; এখানে যুদ্ধ করতে হয়, সেখানে বাইজি নাচাতে হয়, ওখান থেকে দামী অলঙ্কার আনাতে হয় রাণীর মন ভরাবার জন্য...এমন হাজারটা খরচের উৎস। কিন্তু গরীব চাষাভুষা প্রজাদের পিঠ ভেঙে আর কতই বা নেয়া যায়? এদিকে টাঁকশাল খালি। উপায়ন্তর না দেখে শেষমেষ হেনরি আর্চবিশপের কাছেই হাত পাতেন। অতীতে অনেকবার অর্থসাহায্য দিয়ে দিয়ে যাজক সম্প্রদায়েরও আর পোষাচ্ছে না, তাঁরা দেখে এসেছেন চার্চের টাকায় রাজা কিভাবে ফুর্তি করে চলেন। থিওবাল্ড তাই বেশ শক্তভাবে রাজাকে ‘না' বলে দেন।
থিওবাল্ডের হঠাৎ মৃত্যুতে হেনরির সামনে সুযোগ চলে আসে, তিনি বহু যোগ্য এবং অভিজ্ঞ প্রার্থীকে ডিঙ্গিয়ে বেকেটকে আর্চবিশপ বানান। জিগরী দোস্ত বেকেট আর্চবিশপ হয়ে এবার যে দু'হাতে হেনরিকে টাকা যোগাবেন সে বিষয়ে তাঁর কোন সন্দেহ থাকে না। কিন্তু আর্চবিশপ হবার পর সব হিসেব পাল্টে দিয়ে বেকেট বেঁকে বসেন, তিনিও হেনরিকে টাকা যোগাতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ? বেকেট এখন ঈশ্বরের সন্ধান পেয়েছেন! ঈশ্বরের ভাগের টাকায় বেশ্যা নিয়ে ফুর্তি করা কি মানায়? ঈশ্বরের সম্মান রক্ষায় দৃঢ়চিত্ত বেকেটের সাথে হেনরির দূরত্ব বাড়তে থাকে, যার শেষ হয় ১১৭০ সালে হেনরির একান্ত কাছের লোকেদের হাতে বেকেটের খুন হওয়া দিয়ে। বেকেটের মৃত্যুর পর পোপ ৩য় আলেক্সান্ডার তাঁকে সন্ত উপাধি দেন, এবং আজতক খৃষ্টান বিশ্ব থমাস বেকেটকে সেইন্ট বেকেট হিসেবেই জেনে আসছে। সংক্ষেপে এই হলো থমাস বেকেটের জীবনী ও আনুই-এর নাটকের মূল গল্প।
এই নাটকে আনুই-এর ভীষণ তীক্ষ্ণ উইট-এর পরিচয় পাওয়া যায়; দ্বাদশ শতকের রাজকীয় বর্বরতা, স্বার্থের দখল নিয়ে খেয়োখেয়ি, ক্ষমতাশীলদের হাতে বাক্সবন্দী হয়ে থাকা গরীব জনগণ-এই সব কিছুই টুকরো টুকরো ভাবে উঠে আসে আনুই-এর বিষাক্ত কমেডিতে। কিছুটা চ্যাপলিনীয় স্ল্যাপস্টিক কমেডি সংবলিত এ নাটকের শেষে দেখা যায় যে ব্যারনেরা বেকেটকে খুন করেছিলো রাজা হেনরি তাদের-ই পালের গোদাটিকে বেকেট-হত্যার তদন্তের দায়িত্ব দেন। বাস্তবে বেকেট হত্যার সাথে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিলো; বেকেটের হত্যাকারীদের কাউকে হেনরি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন কি না সেটি আমার জানা নেই, ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে সে তথ্যও হয়তো পেয়ে যাবো, তবে সে ইচ্ছে আমার নেই। বাঙলাদেশের নাগরিক হিসেবে যে অমোঘ সত্যটি আমি জানি, সেটি হলো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের অপরাধগুলো সচরাচর নৃপতির অঙ্গুলিহেলনেই হয়, এবং অপরাধকর্মটি যিনি নিজ হাতে করলেন, তাঁকেই এ অপরাধের তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
ছবি:থমাস বেকেট ও রাজা দ্বিতীয় হেনরি। ১৪ শতকে আঁকা।
কেউ প্রশ্ন করে বসতেই পারেন, আনুই ৮০০ বছর আগের এই ঘটনা নিয়ে কেন নাটক লিখতে গেলেন? শুধু কি ইতিহাস বলাই তাঁর উদ্দেশ্য? কিন্তু সে তো ইতিহাসের যেকোন বই পড়লেই জানা যায়। আনুই-এর নাটকে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ভুলও রয়েছে যা তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন (বেকেটকে আনুই তাঁর নাটকে স্যাক্সন হিসেবে দেখিয়েছেন, বাস্তবে বেকেট ছিলেন নরম্যান)। ঐতিহাসিক এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাটক লেখার পেছনে আনুই-এর ভিন্ন একটি উদ্দেশ্য রয়েছে, যেটি নিয়ে আলোচনা করবার জন্যই এত সময় লাগিয়ে ৮০০ শব্দের এই ফোরপ্লে।
জাঁ আনুই কামু এবং সার্ত্রে দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত ছিলেন। এঁরা দু'জনই দর্শনশাস্ত্রের অস্তিত্ববাদ শাখাটির অন্যতম মূল বিজ্ঞাপন। দর্শনের এ শাখাটি ব্যাক্তির অস্তিত্বকে (কিংবা স্বীয় অস্তিত্বের “শুদ্ধতা”কে) সব কিছুর ঊর্ধে রাখে; এখানে ভাগ্য বলে কিছু নেই, এখানে ঈশ্বর নেই, বিচারকর্তা নেই, স্বর্গ-নরক নেই; ভালো-মন্দ বিচার করবার দায় পুরোটাই আপনার নিজের। আপনি যদি এ পথের অনুসারী হন, তাহলে যেকোন ভালো কাজ করা এবং খারাপ কাজ এড়িয়ে চলার জন্য আপনার বিবেকই যথেষ্ঠ হওয়া উচিৎ; “ওপরওয়ালার কাছে কি জবাব দেবো?”-এই প্রশ্নটির ভীতি আপনাকে জোর করে কোন কাজ করিয়ে নেবে না। তৃষ্ণার্তকে পানি খাওয়ানো কিংবা অন্ধকে হাত ধরে রাস্তা পার করিয়ে দেয়া-ইত্যাদি কাজগুলো আপনি যদি নিজের ইচ্ছেতে না করে ঈশ্বরের শাস্তির ভয়ে করেন, তাহলে আপনার এই ভালো কাজগুলো কতটা আন্তরিক, এবং এ কাজগুলোর জন্য আপনার আদৌ পুরষ্কৃত হওয়া উচিৎ কি না-সে প্রশ্নটি নিজেকে করে দেখতে পারেন।
আনুই তাঁর অস্তিত্ববাদের প্রপাগ্যান্ডা দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, পূর্বলিখিত ভাগ্য বলে কিছু নেই, মানুষ কারো হাতের পুতুল নয়। কোন পথটি সঠিক এবং কোন পথটি বেঠিক, তা আপনি জীবনের যে কোন পর্যায়ে, যে কোন মুহুর্তে নির্ধারণ করতে পারেন, এবং সে অনুযায়ী দিক বদলাতে পারেন; আপনার গাড়ীটির চালক আপনি হবেন, নাকি চালকের হাতে নিজের ভাগ্য সঁপে দিয়ে গোটা সময়টা যাত্রীর আসনে বসে থাকবেন-এ সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণই আপনার। জীবনের বড় একটি অংশই ভোগী জীবন যাপন করেও শেষতক ঈশ্বরের সম্মান রক্ষার্থে বেকেট ত্যাগের জীবনকেই বেছে নিয়েছিলেন, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও। এ প্রসঙ্গে আব্রাহাম লিংকনের একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে,
আমি যখন কোন ভালো কাজ করি, আমার ভালো লাগে, যখন আমি কোন খারাপ কাজ করি, সেটির অপরাধবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এটাই আমার ধর্ম।
Tabula Rasa
সহজ রাস্তা
ঘৃণ্য
নীতির আলাপ ত ম্যালাই দিলেন, আপনেই এবার কনঃ
অহন-ই যদি এক বান্দীর পোলায়
আঁৎকা আয়া চাক্কু মারবার চায়
তারে কি বুকে টাইনা কইবেন,
“খাড়ান, বাপজান! আমি কি আপনের সন্তান?”
নিজে লগে যে চাক্কুডা রাহেন, ঐডা দিয়া কি কান চুলকান?
জানের মায়া ব্যাবাকের-ই আছে।
হাততালি পাইবো ভাইবা দয়ার শইল সাইজা বহে কেউ যদি
খোদার কসম কইলাম আইজ মামা, তার মায়েরে আমি__”
দ্যা ম্যাট্রিক্স
ম্যাট্রিক্স