29 Books
See all“মানুষ কোথা থেকে এলো”- এ প্রশ্নটি তো আমাদের সব্বাইকেই একবার না একবার বিব্রত করেছেই। ধর্মগ্রন্থের সরল ব্যখ্যা যাঁরা মেনে নিতে চান না, তাঁদের জন্য তো প্রশ্নটি আরো বেশী বিব্রতকর! বিজ্ঞানের ব্যখ্যা যাঁরা মানতে নারাজ, তাঁরা “বিজ্ঞান বলে মানুষ বাঁদর থেকে এসেছে” বলে একটি অপপ্রচার চালান। বিজ্ঞান যে দাবীটি মূলত করে সেটি হলো বাঁদর ও মানুষ একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে এসেছে। বাঁদর আমাদের মানুষদের “বাবা” নয়, “খালাতো”/ “চাচাতো”/ “মামাতো” ভাই-বোন। তাহলে এই সব cousin-গোত্রীয় প্রাণীদের common যে পূর্বপুরুষ, সেই “পরদাদা” প্রাণীটি কোনটি? এর উত্তর লুকিয়ে আছে ৩৭৫ মিলিয়ন বছর পুরনো ফসিলে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নেইল শ্যুবিন ডাঙায় চলাচলকারী সকল মেরুদণ্ডী প্রাণীদের “পরদাদা” যে প্রাণীটি, তার ফসিলের সন্ধান পেয়েছিলেন ২০০৪ সালে। সেই চমকপ্রদ আবিষ্কার নিয়েই তাঁর বই “ইওর ইনার ফিশ”, যা আপনাকে আপনার অভ্যন্তরীণ মাছটির সন্ধান দেবে!
ফসিল শিকারী বিজ্ঞানীরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের ফসিল কীভাবে খুঁজে বের করেন? তাঁরা কি চোখ বন্ধ করে ‘অপু দশ বিশ তিরিশ চল্লিশ' জপে আন্দাজে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে দেন? উত্তরটা অবশ্যই ‘না'। মাটির নিচে ফসিলকৃত শিলা আসলে সময়কাল অনুযায়ী স্তরে স্তরে সুবিন্যাস্ত থাকে; যে শিলা (বা ফসিল) পৃথিবীর যতো গভীরে, তা ততো প্রাচীন। ওপরের স্তরগুলোতে ওঠার সাথে সাথে নতুনতর শিলা এবং ফসিলের দেখা মিলতে থাকে। এ ব্যাপারটি যে সবসময়ের জন্যই অমোঘ সত্য তা ঠিক নয়; ভৌগোলিক অবস্থান ভেদে শিলার স্তরবিন্যাসে পার্থক্য থাকতেই পারে। বিশেষতঃ বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের চাপ ও তাপে আগের পরের অনেক শিলাস্তর মিশে একাকার হতেই পারে, তবে এর ভেতর থেকেও সঠিকভাবে সময়কাল অনুযায়ী স্তরগুলোকে আলাদা করা সম্ভব।
যে কোন শিলায়ই কি তবে ফসিল থাকে? এর উত্তরও ‘না'। ফসিল সংরক্ষণের জন্য আদর্শ শিলা মূলত চার রকমঃ চুনাপাথর (limestone), বেলেপাথর (sandstone), পাললিক শিলা (siltstone), এবং অপেক্ষাকৃত নরম শিলা যা শেইল (shale) নামে পরিচিত। এ ধরণের শিলা গঠিত হয় মূলত নদী, সমুদ্র, বা হ্রদের গতিপথের কারণে। প্রাণের বিকাশ ও বিস্তার এমন পরিবেশে হবে সেটিই স্বাভাবিক। পাললিক প্রক্রিয়ার কারণেও এ ধরণের শিলাতে ফসিল প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত থাকে শত শত মিলিয়ন বছর ধরে। বিপরীতে, আগ্নেয় শিলা (volcanic rock) এবং রুপান্তরিত শিলা (metamorphic rock) মূলত পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রচন্ড তাপ ও চাপে তৈরী হয়, এমন পরিবেশে প্রাণের বিকাশ না হবার সম্ভাবনাই বেশী, তাই ফসিল শিকারীরা সে পথ বেশী একটা মাড়াননা। মূলত জনপ্রাণহীন বিরান অঞ্চলগুলোতেই সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত ফসিলগুলো পাওয়া যায়; মরু বা মেরু অঞ্চলে যেহেতু গাছপালা নেই, মনুষ্য নির্মিত দালানকোঠা, গাড়ী-ঘোড়া নেই, মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে ফসিলগুলো তাই দিব্যি অবিকৃত থাকতে পারে। সাহারা, গোবি, ইউটাহ ইত্যাদি উষ্ণ মরু অঞ্চল তো বটেই, উত্তর গোলার্ধের তুষার মরুও (arctic desert) ফসিল শিকারের জন্য আদর্শ জায়গা।
শ্যুবিন এ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন আর্ক্টিকের প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কী অমানুষিক কষ্ট সহ্য করে তাঁরা শিলা সংগ্রহ করেছেন। পদে পদে মেরু ভালুকের আক্রমণের আশঙ্কা, রসদ ফুরিয়ে যাবার ভয়, তুষার ঝড়ে আটকা পড়ে হারিয়ে যাবার চিন্তা...এমন হাজারো বিপদ মাথায় নিয়ে মানুষের বিজ্ঞানযাত্রাকে ঋদ্ধ করার কাজটি এঁরা করে গেছেন নাক মুখ গুঁজে। গোটা বছরের হাতেগোণা অল্প ক'টা দিনেই শুধু আর্ক্টিকে কাজ করা সম্ভব। একদিন এদিক ওদিক হলেই খারাপ আবহাওয়ার খপ্পরে পড়তে হয়। যে ভয়ানক দুর্গম খাড়া পাহাড়ী অঞ্চলে শ্যুবিন ও তাঁর গবেষক দলকে হেলিকপ্টার নামিয়ে দিয়ে যায়, সেখান থেকে নিকটতম বেইস ২৫০ মাইল দূরে। হেলিকপ্টার কতখানি ওজন বইতে পারবে তারও ধরাবাঁধা সীমা আছে, চাইলেই বড় এক টুকরো শিলা ভেঙে নিয়ে চলে আসা যায় না। বরফশীতল পরিবেশে জীবন হাতের মুঠোয় ধরে ছোট একটি হাতুড়ি দিয়ে টুকটুক করে বাছাই করা শিলা কেটে চলা...এ মোটেই কোন সহজ কাজ নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শত শত মাইল জুড়ে শুধু বরফ দেখে যাওয়াটাও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য খুব সুখকর কিছু নয়। বিরান এই অঞ্চলে কোন গাছপালা বা বাড়ীঘর যেহেতু নেই, দূরত্বের ঠাহরও পাওয়া যায় না; চোখে ধাঁধা লাগে, ১ মাইল আর ৫ গজ দূরের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না মানব মস্তিষ্ক। এইসব প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে, ১৫০০ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে থাকা শিলা ঘেঁটে, ৩ বার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর শেষতক কাঙ্ক্ষিত সেই ফসিল উদ্ধার করে শ্যুবিনের দল; মানবজাতির উদ্ভব ও বিকাশের ব্যখ্যা অনেকটাই লুকিয়ে আছে যেখানে।
২০০৪ সালে শ্যুবিনরা ৩৭৫ মিলিয়ন বছর পুরনো যে ফসিলটি খুঁজে পান, সেটির নাম রাখা হয় টিকটালিক; ইনুকটিউট ভাষার এই শব্দটির অর্থ ‘মিঠাপানির বড় মাছ'। এই আবিষ্কারটি এত গুরুত্বপূর্ণ, এর কারণ, বেশ কিছু দিক থেকেই প্রাণীটি অনন্য। আমরা জানি, মাছের ঘাড় থাকে না; তাদের মাথা এবং কাঁধ একসাথে জোড়া লাগানো থাকে কয়েকটি হাড়ের সংযোগে। টিকটালিকের আগের সময়ের যতো মাছের ফসিল পাওয়া গেছে, সেগুলোর কোনটিতেই ঘাড় নেই; চলার পথে বাঁক নিতে গেলে গোটা শরীরের সাথে মাথাটাও এদের ঘোরাতে হতো। একমাত্র টিকটালিকেই ঘাড়ের সন্ধান পাওয়া যায়; এরা শরীর না বাঁকিয়েও মাথা ঘোরাতে পারতো (যেমনটা আমরা পারি)। আমাদের পাশাপাশি এই বিশেষত্বটি আছে উভচর, সরিসৃপ, পাখি, এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝেও।
মাথা এবং ঘাড়ের এই ‘নতুন' বিন্যাস আরো অনেকগুলো দরজা খুলে দেয়। ১৮০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিখ্যাত অ্যানাটমিস্ট স্যার রিচার্ড ওয়েন বিভিন্ন প্রাণীর শরীর ব্যবচ্ছেদ করে প্রানী জগতের একটি ‘নীলনকশা' আবিষ্কার করলেন। ‘হাত' এবং ‘পা' সংবলিত সকল প্রাণীরই এই প্রত্যঙ্গগুলো আসলে একই ছাঁচে গঠিত। আমাদের জন্য যা ‘হাত' এবং ‘পা', প্রাণীবিশেষে তা কখনো ডানা, কখনো হাত, কখনোবা সাঁতার কাটার ফ্লিপার। প্রত্যঙ্গগুলোর গঠনের দিকে তাকালে আমরা একটি সূত্রই দেখতে পাই সবার ক্ষেত্রেঃ প্রথমে একটি হাড় (হাতের ক্ষেত্রে হিউমেরাস, পায়ের ক্ষেত্রে ফিমার), এরপর দু'টি হাড় (হাতের ক্ষেত্রে রেডিয়াস এবং আলনা ও পায়ের ক্ষেত্রে টিবিয়া এবং ফিবুলা), আর সবশেষে একগোছা ছোট ছোট হাড় (আঙুল)। ওয়েনের এ আবিষ্কারের কিছুদিন পরই ডারউইন তাঁর বিবর্তনবাদের তত্ত্বটি সামনে আনেনঃ এই প্রাণীগুলোর গঠন-প্রকৃতি একরকম কারণ, এদের সবারই উৎপত্তি একই পূর্বপুরুষ থেকে। সোজা বাঙলায়, এই প্রাণীরা সবাই একে অপরের চাচাতো/ জ্যাঠাতো / ফুপাতো ভাই-বোন!
টিকটালিকের অন্যতম প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য হলো, মাছটির হাত-পায়ের মতো প্রত্যঙ্গ ছিলো, যেটি এর আগের কোন মাছে দেখা যায়নি। শুধু তাই-ই নয়, হাড়ের কাঠামো সাক্ষ্য দেয় মাছটি রীতিমতো বুকডনও দিতে পারতো! বুকডন দেবার সময় আমাদের কনুই ভাঁজ হয়ে আসে, বুকের পেশীগুলোর সংকোচন প্রসারণের মাধ্যমে আমরা নিজেদের ধাক্কা দিয়ে ওপরে নিচে ওঠানামা করাতে পারি; টিকটালিক এর সবই করতে পারতো। আমরা যে কনুই সোজা রেখেও ওপরে নিচে ইচ্ছেমতো বুড়ো আঙুলটা নাড়াতে পারি, এর কারণ, আমাদের হিউমেরাস ও রেডিয়াসের সংযোগস্থলে থাকা কোটরসন্ধিটি (ball-socket joint)। ভাত বা ডালের বাটি থেকে হাতা দিয়ে তুলে পাতে ঢালতে আমরা দু'টি বিপরীত ভঙ্গিতে হাত ঘোরাইঃ supination (বাটি থেকে ভাত তোলা) ও pronation (পাতে ভাত ঢালা)। হিউমেরাস ও রেডিয়াসের কোটরসন্ধির এ গঠনটি টিকটালিকের মাঝেই প্রথম দেখা যায়, এর আগের কোন প্রাণীতে এমন কোন বৈশিষ্ট্য ছিলো না।
টিকটালিকের সাথে আমাদের বাহ্যিক গঠনগত বৈশিষ্ট্যগুলোর পর এবার একটু অন্যদিকে চোখ ফেরানো যাকঃ জিনতত্ত্ব! ১৯৫০ এবং '৬০-এর দশকে বিজ্ঞানীরা মুরগীর ভ্রুণের ওপর গবেষণা চালানো শুরু করেন। তাঁরা মূলত ভ্রুণের এক অংশ থেকে টিস্যু অপসারণ করে অন্য অংশে প্রতিস্থাপন করলে এর ফলাফল কী দাঁড়ায় তা-ই দেখতে চাইছিলেন। আমাদের হাতে বা পায়ে যেমন বুড়ো আঙুল থেকে কনিষ্ঠা পর্যন্ত ৫টি হাড়ের ভাগ রয়েছে, পাখির ডানাতেও তেমনি অনেকগুলো ভাগ রয়েছে, বোঝার সুবিধের জন্য যেগুলোকে আমরা বৃদ্ধাঙুল, তর্জনি, মধ্যমা, অনামিকা, কনিষ্ঠা ইত্যাদি হিসেবে কল্পনা করে নিতে পারি। ভ্রুণের টিস্যু গ্র্যাফটিং-এর গবেষণায় দেখা গেলো, যে টিস্যুটি পাখির ডানার ‘কনিষ্ঠা' গঠন করে, সেটিকে যদি বিপরীত পাশের ডানার টিস্যুতে প্রতিস্থাপন করে হয়, তাহলে সেখানে স্বাভাবিক ডানাটির গঠন তো হয়ই, সাথে সাথে বিপরীত যে পাশের ডানা থেকে টিস্যু নিয়ে আসা হলো, সে অংশের পূর্ণ একটি ডানাও গজিয়ে যায়। এই টিস্যুটির নাম দেয়া হয় জোন অফ পোলারাইজেশন অ্যাকটিভিটি (জিপিএ)। ডানা বা হাতের বৃদ্ধাঙুলের গঠন যে কনিষ্ঠার চেয়ে ভিন্ন তার জন্য দায়ী এই জিপিএ। এই পরীক্ষাগুলো থেকে বিজ্ঞানীরা উপসংহার টানলেন, এই জিপিএ থেকে কিছু একটা নিশ্চয়ই নিঃসরিত হয়, যা আঙুলগুলোর গঠন কেমন হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে (স্পয়লারঃ জিন!)।
মুরগীর ভ্রুণের ওপর চালানো এ গবেষণা নতুন দুয়ার খুলে দেয়। বিজ্ঞানীরা শিগগীরই আবিষ্কার করলেন, মাছির একটি বিশেষ জিন রয়েছে, যা মাছির শরীরের বিভিন্ন অংশকে বিভিন্ন গঠন-রূপ দেয়; জিনটির নাম দেয়া হয় হেজহগ। মাছির পর এবার মুরগীর ওপর পরীক্ষা করেও হেজহগ জিনটির খোঁজ পাওয়া গেলো, তবে সেটি মুরগীর নিজস্ব সংস্করণ, যার নাম দেয়া হয় সনিক হেজহগ। গবেষণায় দেখা গেলো, হাত/ পা (limb) সংবলিত যেকোন প্রাণীরই যেখানেই জিপিএ টিস্যুটি রয়েছে, সেখানেই কেবল হেজহগ জিনটি কাজ করে। মাতৃগর্ভে থাকবার সময় অষ্টম সপ্তাহে যদি এই হেজহগ জিনটি তার কাজ করা শুরু না করতো, তাহলে হয়তো আপনার বাড়তি কিছু আঙুল থাকতো, কিংবা আপনার বৃদ্ধাঙুল আর তর্জনি হয়তো দেখতে একই রকম হতো। হাত/ পায়ের গঠন, প্রতিটি আঙুলের আকারের ভিন্নতা, ডান দিক-বাঁ দিকের প্রতিসমতা-এই সবকিছুই নিশ্চিত করে হেজহগ জিন। মুরগী, ব্যাঙ, ইঁদুর...হাত/ পা সংবলিত যে কোন প্রাণীর ডিএনএ রেসিপি আদতে আসলে একই।
সনিক হেজহগ জিনটি যেহেতু হাত/পা সংবলিত প্রাণীদের হাড়ের কাঠামো গঠন করে, তাহলে যেসব প্রাণীতে হাড়ের গঠন একেবারেই ভিন্ন, তাদের ক্ষেত্রে কী হয়? তখনও কি সনিক হেজহগ কাজ করে? ইঁদুর, মুরগী, ব্যাঙ, বাদুড়-“একইরকম” হাড়ের কাঠামোর এসব প্রাণীদের বেলায় সনিক হেজহগের একই ভূমিকা আবিষ্কার করবার পর বিজ্ঞানীরা এবার গবেষণা শুরু করলেন হাঙর নিয়ে। হাড়ের কাঠামোর দিক দিয়ে হাঙর এবং সমগোত্রীয় মাছেরা (যেমন স্কেইট) আমাদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। আমাদের কঙ্কালের কাঠামোটি যেমন বয়েস বাড়বার সাথে সাথে শক্ত হাড়ে পরিণত হয়, হাঙরদের ক্ষেত্রে তা ঘটেনা; তাদের কাঠামোটি আজীবন নরম কার্টিলেজের-ই রয়ে যায়, যে কারণে এদের কার্টিলেজিনাস মাছ বলা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেলো এই কার্টিলেজসর্বস্ব হাঙরদেরও (কিংবা স্কেইটদের) একটি ‘হাঙর সনিক হেজহেগ জিন' (স্কেইটদের বেলায় স্কেইট সনিক হেজহগ জিন) রয়েছে।
এর মানে কি হাঙর/ স্কেইট ইত্যাদি কার্টিলেজিনাস প্রানীদের চেয়ে আমরা একেবারেই ভিন্ন? স্কেইটের পাখনায় হাড়ের যে রডগুলো রয়েছে, তা সবই দেখতে একইরকম (আমাদের হাতের পাঁচটি আঙুলই যদি দেখতে একই রকম হতো, তেমন)। এমন কোন উপায় কি আছে যাতে ভিন্ন কোন সনিক হেজহগের মাধ্যমে এই রডগুলোর আকারে ভিন্নতা আনা যায়? স্কেইটের ভ্রুণে ইঁদুরের সনিক হেজহগ প্রবেশ করিয়ে একটি পরীক্ষা করা হলো। এই পরীক্ষার দু'টি ফল হতে পারেঃ এক. কিছুই হবে না, সেক্ষেত্রে বোঝা যাবে স্কেইট বা হাঙরেরা আমাদের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন প্রাণী, আমাদের মাঝে কোনই সম্পর্ক নেই, আর দুই. যদি স্কেইটের মতো একটি মাছের ভ্রুণে ইঁদুরের মতো একটি স্তন্যপায়ী প্রাণীর জিন কাজ করে, যদি স্কেইটের পাখনার রডগুলো ভিন্ন ভিন্ন আকারে গঠিত হয়, তাহলে বোঝা যাবে মাছ ও স্তন্যপায়ী প্রানী খুব আলাদা কিছু নয়, মাছের ডিএনএ নতুন কোন ডিএনএ নয়; আদিমতম ডিএনএ'র অভিযোজিত একটি সংস্করণ মাত্র। এবং, কার্যতই, সে পরীক্ষায় দেখা যায় ইঁদুরের হেজহগ জিন স্কেইটের রডগুলোকে হাতের পাঁচ আঙুলের মতো ভিন্ন ভিন্ন আকার দিয়েছে। হাঙরের সাথে আমাদের আত্নীয়তার একটি সংযোগ এবার প্রতিষ্ঠিত হলো!
হাড় নিয়ে হড়বড় করে এত্তগুলো কথা খর্চা করে ফেললাম, প্রাণীজগতে এই হাড়ের উৎপত্তিটা কোথায়? মেরুদণ্ডে? চোয়ালে? নাকি শরীরের বাহ্যিক আস্তরণে? অনেকের কাছেই আশ্চর্য ঠেকবে, কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে হাড়ের উৎপত্তি আসলে দাঁতে! ১৮৩০-এর দিকে ২৫০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন বছরের পুরনো কিছু প্রাচীন সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিলের খোঁজ পাওয়া যায়, এদের নাম দেয়া হয় কনোডন্টস। ছোট আকৃতির নরম শরীরের এই প্রাণীগুলোতে একধরণের শক্ত শক্ত কাঁটার দেখা মেলে যা বাইরের দিকে মেলে থাকে। এই কনোডোন্টসরা যে আসলে কী, সে নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেকদিন তর্ক করেছেন; কেউ বলেছেন এরা উদ্ভিদ, কেউ বলেছেন এরা আসলে প্রাকৃতিক মিনারেল, আর অল্প কেউই এরা যে প্রানী তার পক্ষে রায় দিয়েছেন। এই রহস্যের সমাধান হয় যখন ল্যাম্প্রে নামক এক ধরণের আদিম মাছের সন্ধান মেলে। চোয়াল বিহীন এই ল্যাম্প্রে মাছগুলো অন্য মাছের গায়ে আটকে থেকে সে মাছের তরল অংশটুকু চুষে খেয়ে নিতো। ল্যাম্প্রের ফসিলে কনোডোন্টস-এর সেই ধারালো কাঁটা দেখতে পাওয়া যায়।
ছবি সূত্রঃ উইকিপিডিয়া
যে উপাদানটির উপস্থিতি দাঁতকে অত শক্ত বানায় সেটিকে বলে হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট। হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট এতটাই শক্ত যে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পরেও তা ফসিলে অবিকৃত থাকে, এবং ফসিলের দাঁত থেকে বুঝে নেয়া যায় প্রাণীটি মাংসাশী ছিলো নাকি উদ্ভিদ্ভোজী (মাংসাশী প্রাণীর দাঁত সূক্ষ্ম, ধারালো ও সূঁচালো হয়, মাংস কেটে বসবার জন্য; উদ্ভীদ্ভোজীর দাঁত হয় সমান, যাতে তা সহজে বাদাম জাতীয় ফল ভেঙে ফেলতে পারে)। কনোডন্টস-এর দাঁতে পাওয়া হাইড্রক্সিঅ্যাপেটাইট ইঙ্গিত করে, প্রাণীজগতে হাড়ের উদ্ভব প্রতিরক্ষার জন্য নয়, খেয়ে পরে বেঁচে থাকবার জন্য! শ্যুবিন মন্তব্য করেছেন, প্লাস্টিক উদ্ভাবনের পর যেমন গাড়ীর কলকব্জা থেকে শুরু করে ইয়ো ইয়োতে তা ব্যবহৃত হয়েছে, দাঁতের ব্যাপারটাও ঠিক অমনি। যখনই খেয়ে বেঁচে থাকবার জন্য প্রাণীকুলে দাঁতের উৎপত্তি ঘটেছে, পরিপার্শ্ব এবং অবস্থানের প্রেক্ষিতে অভিযোজিত হয়ে হয়ে এ দাঁত আস্তে আস্তে অন্যান্য অঙ্গের জন্ম দিয়েছে; দাঁত না থাকলে শরীরে আঁশ, পালক, বা স্তন এসবের কিছুই নাকি হতো না!
হাঙরের সাথে আমাদের আত্নীয়তার কথা তো একটু আগেই জেনেছি। হাঙর ও মানুষের ভ্রুণের দিকে নজর ফেরালে বেশ কিছু মিল চোখে পড়ে। উভয় ক্ষেত্রেই চোয়াল গঠিত হয় ভ্রুণের ৪টি খাঁজের প্রথমটি থেকে (ছবির arch 1)
হাঙরের সাথে পার্থক্য হলো, মানুষের বেলায় প্রথম এ খাঁজটি থেকে চোয়ালের পাশাপাশি কানের কিছু হাড়ও গঠিত হয়, হাঙরের বেলায় তা হয় না। হাঙরের ভ্রুণে দ্বিতীয় খাঁজের কোষগুলো বিভাজিত হয়ে কার্টিলেজ ও পেশী গঠন করে, মানুষের বেলায় মধ্য কান ও গলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ তৈরী করে, যার মাঝে অন্যতম হাইওয়েড নামের ছোট হাড়টি। ঢোঁক গেলা, গান শোনা এই কাজগুলো আমরা করতে পারি এই হাইওয়েডের জন্যই। বস্তুতঃ মাছ, সরিসৃপ, ও স্তন্যপায়ী-সব্বার ক্ষেত্রেই ভ্রুণ গঠিত হয় তিনটি স্তর থেকে, যাদের জার্ম লেয়ারস বলা হয়। প্রতিটি মেরুদণ্ডী প্রাণীর ক্ষেত্রেই-যতই তারা ভিন্ন হোক-হৃৎপিণ্ড গঠিত হয় এই জার্ম লেয়ারের একই স্তর থেকে, মস্তিষ্ক গঠিত হয় আরেকটি ভিন্ন স্তর থেকে।
জার্ম লেয়ারের এই তিনটি স্তরের নাম যথাক্রমে এক্টোডার্ম, এন্ডোডার্ম, ও মেসোডার্ম। এক্টোডার্ম গঠন করে চামড়া ও স্নায়ুতন্ত্র। ভেতরের স্তর এন্ডোডার্ম গঠন করে পরিপাকতন্ত্র, আর মাঝের স্তর মেসোডার্মের কাজ আমাদের হাড় ও পেশী তৈরী করা। এই ব্যবস্থাটিকে অনেকটা একটি টিউবের ভেতর আরেকটি টিউব হিসেবে দেখা যায়। এ ব্যাপারটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? ১৯২০-এর দশকে হিল্ডে ম্যানগোল্ড একটি পরীক্ষা করেন; তিনি স্যালামান্ডারের একটি ভ্রুণে অন্য প্রজাতির একটি প্রাণীর জার্ম লেয়ারের একটি টিস্যু লাগিয়ে দেন। এ কাজটি করবার জন্য যে হাতের ওপর দুর্দান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন সে তো বলা বাহুল্য। স্যালামান্ডারের গোলাকার এই ভ্রুণের ব্যাস ছিলো ১ ইঞ্চির ১/১৬ ভাগ! হিল্ডের পরীক্ষায় দেখা গেলো অন্য প্রাণী থেকে এনে জোড়া লাগিয়ে দেয়া সেই টিস্যুর বরাতে যমজ স্যালামান্ডারের জন্ম হয়েছে! এই টিস্যুটিকে পরবর্তীতে অরগ্যানাইজার নাম দেয়া হয়। জিন প্রকৌশলে এটি সম্ভবত আজতক সবচেয়ে বড় আবিষ্কার; স্তন্যপায়ী, মাছ, পাখি, সরিসৃপ-সবারই অরগ্যানাইজার আছে। কাট, স্লাইস, অ্যান্ড ডাইস; মুরগীর অরগ্যানাইজার কেটে এনে স্যালাম্যান্ডারের ভ্রুণে লাগিয়ে দিন, ব্যাস, পেয়ে গেলেন যমজ স্যালাম্যান্ডার!
ছবিসূত্রঃ Know your meme
পৃথিবীর বয়েস সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছর। আধুনিক মানুষের আবির্ভাব মাত্রই লাখখানেক বছর আগে। এই গোটা সাড়ে ৪ বিলিয়ন বছরকে যদি এক বছরে প্রকাশ করতে হয়, ১ জানুয়ারী থেকে ৩১ ডিসেম্বর, তাহলে জুন মাসেই কেবল এককোষী প্রাণীরা এলো। মাথা ওয়ালা প্রাণীদের আবির্ভাব অক্টোবরে, আর মানুষের আবির্ভাব আজকের দিনে, ৩১ ডিসেম্বরে। অসম্ভব লম্বা একটি রাস্তা পেরিয়ে, বহু বহু পরিবর্তনের বাঁকে ঘুরে তবে মানুষ আজ আজকের এই অবস্থায় এলো। পানির মাছেদের বিবর্তন ঘটে ঘটে, তাদের বহু বৈশিষ্ট্য নিয়ে দিয়ে থুয়ে ডাঙার আমরা আজ মঙ্গলে উপগ্রহ পাঠাচ্ছি। এই বই লিখে নেইল শ্যুবিন মূলত দু'টি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। প্রথমত, আমরা সব প্রাণীরাই একে অপরের আত্নীয় কোন না কোনভাবে। কুমির, বাদুড়, বিড়াল, পাখি, মাছ, বাঁদর-এরা সবাই আসলে একটু একটু আমরা, আর আমরা একটু একটু ওরা। এ ব্যাপারটিকে অনুধাবন করতে না পারলে “মানবিকতা” আমাদের কাছে সবসময়ই অভিধানের একটি আলঙ্কারিক শব্দ হয়ে থাকবে। কোন আসমানী কিতাব দিয়েই আমরা নিজেদের মানবিক করে তুলতে পারবো না।
দ্বিতীয়ত, এই অসম্ভব বড় পরিবর্তনগুলোর হাত ধরে যে আজ আমরা মানুষ হলাম, সেই কনোডন্টস-এর প্রাথমিক দাঁত থেকে আজকের আমরা, এর পেছনের কারণটা হলো আমরা বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে ক্রমশঃ অবস্থা ও পরিপার্শ্বের সাপেক্ষে নিজেদের বদলেছি; আমাদের জন্মই হয়েছে গতিশীল থাকবার জন্য। আমরা যদি কোন শারীরিক পরিশ্রম না করি, নিজেদের জীবনকে ক্রমাগত পরিবর্তন করতে না থাকি, শুধুই সোফায় শুয়ে মুখে চিপস গুঁজে নেটফ্লিক্স-বিলাস করতে থাকি, বিবর্তনের উল্টো রাস্তায় হেঁটে আমরা ডোডো পাখির মতোই বিলীন হয়ে যাবো। দূর সম্পর্কের এক জ্যাঠাতো ভাইয়ের হঠাৎ অন্তর্ধানে প্রাণীজগতের কারোরই তাতে কিছুই এসে যাবে না।
বসনিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ক্রোয়েশিয়ান লেখক ইভো আন্দ্রিচ-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস দ্যা ব্রিজ অন দ্যা দ্রিনা। এই একটি বই দিয়েই জগৎজোড়া খ্যাতি পেয়ে যাওয়া আন্দ্রিচ ১৯৬১ সালে নোবেল পুরষ্কার জেতেন। ঐতিহাসিক উপন্যাস যেহেতু, তাই ইতিহাসের আলোচনা করতেই হচ্ছে কিছুটা। এই লেখাটির শেষ পর্যন্ত আপনি যাননি এখনো, আমি গিয়েছি; আমি জানি, কত দীর্ঘ একটি আলোচনা ফেঁদে বসেছি এখানে! তাই উপক্রমণিকায় আর বাজে কথা খরচ না করে মূল আলোচনায় চলে যাই, ওপরের ছবিটির apology তখনই দেয়া যাবে খন।
'৮০ এবং '৯০-এর দশকে যাঁদের বেড়ে ওঠা, তাঁরা প্রায় সবাই-ই সংবাদপত্র বা টিভিতে দিনের পর দিন একটি সংবাদ দেখে গেছেনঃ বসনিয়ায় প্রাণঘাতী যুদ্ধ চলছে, হাজার হাজার মানুষ নির্বিচারে মারা পড়ছে প্রতিদিন। ভারতবর্ষে যেখানে আমাদের নিবাস, সেখান থেকে বলকান ব্লকের এ অঞ্চলগুলো এত এত ভীষণ দূরে যে সেখানের এ সংঘর্ষের কারণ বা পরিস্থিতি আমরা কখনো আসলে বুঝে উঠতে পারি না; কে কাকে মারছে, কারা যুদ্ধ করছে-এ বিষয়গুলো আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে না। ইসলাম-প্রধান দেশ হবার কারণে শুক্রবারের জুমুয়া'র নামাজের সময় আমরা মসজিদে শুনতে পাই ইমাম সাহেব বসনিয়ার মুসলমানদের ওপর চলা এথনিক ক্লিনজিং-এর প্রতিকার চেয়ে দোয়া করছেন, ওপরওয়ালা যেন বসনিয়ায় আমাদের মুসলমান ভাইদের সব কষ্ট লাঘব করে দেন, সে প্রার্থনা করে আমরাও ‘আমিন আমিন' স্বরে ইমাম সাহেবের সাথে গলা মিলিয়ে বসনিয়ার মুসলমানদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করি। পরের শুক্রবারটি না আসা পর্যন্ত আমরা বসনিয়ার সংঘর্ষ নিয়ে আর বেশী একটা মাথা ঘামাই না। কেন বসনিয়ায় মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রচেষ্টা চলছে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের আসলে তাকাতে হবে প্রায় পৌনে এক হাজার বছর বয়েসী লম্বা এক ইতিহাসের দিকে। যে বাঙলাদেশী প্রতিবার রাজনৈতিক ক্ষমতার পালা পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজের দেশের ইতিহাস নতুন করে শেখে, তার কাছে বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাস জানতে চাওয়া বাতুলতা। আমরা তাই জানতে পাই না (বা চাই না) রাশিয়ার দোরগোড়ায় সেই সুদূর বলকানে স্লাভদের মাঝে মুসলমান মানুষ কোথা থেকে এলো, আর কেনই বা এতগুলো দশক কি শতক ধরে এত রক্ত ঝরে চলেছে।
১৩৮৯ সনে তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য ব্যাটল অফ কসোভো-তে জয়লাভ করে বলকান অঞ্চলের ওপর বিশাল আধিপত্য বিস্তার করে। ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু বিজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতন অবশ্য এর বেশ আগেই শুরু হয়ে গেছে, তখতের দখল নিয়ে নিজেদের মাঝে খেয়োখেয়ির দরুন। অটোমানরা এসে কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দেয়। একে একে বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া ইত্যাদি অঞ্চলগুলো চলে যায় অটোমান মুসলমান শাসকদের পুরোপুরি দখলে। বলকানে অটোমান সাম্রাজ্য গেঁড়ে বসবার পর শুরু হয় এক তুঘলকী কাণ্ড; খ্রীষ্টান পরিবারগুলোতে নিয়মিত অটোমান সৈনিকেরা হানা দিতে শুরু করে এবং ৮-১০ বছর বয়েসী বালকদের অপহরণ করে তারা ইস্তাম্বুলে নিয়ে যায়। এই বলকান খ্রীষ্টান বালকদের অটোমানরা প্রশিক্ষণ দিয়ে দিয়ে যোদ্ধা বানায়, যাদের অনেকেই পরবর্তীতে অটোমান সাম্রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব পদেও আসীন হয়। অপহরণ করে নিয়ে আসার পর প্রথম যে কাজটি করা হয়, তা অবশ্যই ধর্মান্তরকরণ। এ ধরণের জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমেই মূলত বলকানে ইসলামের প্রসার ঘটে। মেহমেত পাশা সকোলোভিচ এমনই একজন বাল্যে অপহৃত বলকান, যিনি পরবর্তীতে অটোমানদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা হন, এবং অটোমান সাম্রাজ্যের গ্র্যান্ড ভিজির-এর সিংহাসনে বসেন (ভিজির => উজির, বা সরকার প্রধান; অটোমান সুলতানের পরেই এই পদের অবস্থান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আজও উর্দুতে ‘উজির-এ-আজম' বলা হয়)।
বসনিয়ার দ্রিনা নদীটি বেশ অদ্ভুত; আর সব নদীর মতো এই নদীর পানি নীল নয়, সবুজ! সার্বিয়ান- বসনিয়ান শহর ভিজেগ্রাদে এ নদীর অবস্থান। এই ভিজেগ্রাদেই মেহমেত পাশার বাল্যকাল কেটেছে, এখান থেকেই ছেলেবেলায় অপহৃত হয়েছিলেন তিনি। সময়ের পরিক্রমায় অটোমান সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদে আসীন হবার পরেও মেহমেত পাশা খুব সম্ভব তাঁর সার্বিয়ান-অর্থোডক্স খ্রীষ্টান জন্মপরিচয়টি ভুলে যেতে পারেননি; শেকড়ের টানেই কী না কে জানে, ১৫৭৭ সালে তিনি দ্রিনা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ করেন। সাড়ে চারশ' বছরের ইতিহাসের সাক্ষী এই সেতু আজও দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে। মাঝে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে বলকান যুদ্ধে বেশ অনেকখানি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিলো, আবার তা পুণঃনির্মাণ করা হয়েছে। এই সেতুটি আজ জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় রয়েছে। ইভো আন্দ্রিচ-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস এই সেতু এবং এর ইতিহাস নিয়েই। এই সেতুটি আসলে শুধু একা মেহমেত পাশা বা ৬০০ বছরের অটোমান সাম্রাজ্যের শাসনকালের সাক্ষ্যই দেয় না; বলকান ব্লকে শত শত বছর ধরে যে হানাহানি হয়ে আসছে, সে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী এই সেতু। আন্দ্রিচের উপন্যাসে উঠে আসে বলকানের ঐ অঞ্চলে মানুষে মানুষে হানাহানি কিভাবে দ্রিনার সবুজ পানি বারবার রক্তে লাল করেছে। ১৯১৪ সালে ঘটে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট জানতে এবং বুঝতে হলেও আমাদের চোখ কিছুটা ফেরাতে হবে মেহমেত পাশার শখের এই সেতুর দিকেই।
ছবি-সূত্রঃ উইকিপিডিয়া
যে ব্যাপারটি আন্দ্রিচ-এর এ বইতে বারবার চোখে পড়ে তা হলো ভিনদেশী, ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন সংস্কৃতির শাসকদের যাঁতাকলে স্লাভিক জনগণের ক্রমাগত পিষ্ট হয়ে চলা। ২০ শতকের শুরুর দিকে অটোমানরা বলকানে তাদের ৬০০ বছরের শাসনে যতি টানে বটে, কিন্তু তাতে বলকান জনগণের পরাধীনতার পালা শেষ হয় না। এবার সেখানে হাত বাড়ায় অস্ট্রীয়-হাঙ্গেরীয় (বা হাবসবার্গ) সাম্রাজ্য । অটোমান এবং হাবসবার্গীয়-দুই সময়েই বলকানের জনগণ ভুগেছে, তবে আন্দ্রিচ তাঁর বইতে অটোমান শাসনামল নিয়ে সুক্ষ্ম এবং স্থুল-দু'ভাবেই বেশ অনেকটা খেদ ঝেড়েছেন। ইসলামিক শাসন-ব্যবস্থার সাথে ঐতিহাসিকভাবে অর্থোডক্স-খ্রীষ্টান বলকান এলাকাগুলো কখনো সেভাবে মানিয়ে নিতে পারেনি। শাসন-ব্যবস্থার বিরোধীদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শনের জন্য অটোমানদেরও ছিলো আকাশছোঁয়া খ্যাতি। পান থেকে চুন খসলেই ভয়ানক সব শাস্তির খড়্গ নামিয়ে আনতো তারা। আন্দ্রিচ টুকে রেখেছেন সেইসব বিদ্রোহী স্লাভদের কথা, অটোমান শাসকদের বিরোধীতার জন্য যাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। তাদের শিরোচ্ছেদ করে কাটা মুণ্ডুগুলো দ্রিনা নদীর সেই সেতুর ওপর দিনের পর দিন ঝুলিয়ে রাখা হতো প্রদর্শনীর জন্য। সেতুর প্রবেশমুখে, বা সেতুর ওপরেই এখানে সেখানে এত এত কাটা মাথা নিত্যনতুন শোভা পেতো যে অভ্যেসের দাস মানুষের সেদিকে আর চোখই পড়তো না। কয়েকশ বছর পর যখন এভাবে কাটা মাথা ঝুলিয়ে রাখা বন্ধ করা হয়, তখন নাকি অনেকে খেয়ালই করেনি দুই সময়ের পার্থক্যটা কী!
এছাড়াও, বিদ্রোহীদের পশ্চাৎদ্দেশ দিয়ে চোখা, ভীষণ মসৃণ বাঁশ ঢুকিয়ে পিঠ বা কাঁধ দিয়ে বের করে রোদ কি প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মাঝে ঘণ্টার পর ঘন্টা টাঙিয়ে রেখে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে ঘটিয়ে একটু একটু করে খুন করার কায়দাটিও অটোমান শাসকদের বেশ প্রিয় ছিলো। নারকীয় এইসব শাস্তির বিধান জারী রেখে যে ভয়ের সংস্কৃতিটি অটোমানরা আরোপ করে, তা বলকানের ওপর তাদের ৬শ বছরের প্রায় নিরুপদ্রব শাসনের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। শাসক শ্রেণীর সাথে জনগণের সাংস্কৃতিক পার্থক্যটা ৬শ বছরে এত বেড়ে যায় যে, ১৯০৮ সালে যখন অটোমানরা বলকানের পাট চুকায়, তখনও ক্যাথলিক ও অর্থোডক্স খ্রীষ্টান, এবং ইহুদীরা মুসলমানদের জুজুর ভয়ে থাকতো। হাবসবার্গ খ্রীষ্টান সাম্রাজ্য ক্ষমতায় আসার পর মুসলমানদের ওপর এবার পাল্টা ঝাল ঝাড়া শুরু করে খ্রীষ্টানরা। অবিশ্বাস ও প্যারানয়া-যেকোন যুদ্ধের এই-ই তো রেসিপি। দুই ধর্ম বিশ্বাসের এই প্যারানয়া আজও একই শক্তিতে দীপ্যমান, যার হাত ধরেই ১৯৯২ সালে ঘটে যায় বসনিয়ার যুদ্ধ। বলকানের বুক থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে দেবার হীন এক প্রতিজ্ঞায় নামে সার্ব ও ক্রোয়াটরা।
একটি দেশের মূল ভিত্তি কী হওয়া উচিৎ? ধর্ম, নাকি ভাষা? আমাদের উপমহাদেশের ভারত, পাকিস্তান, ও বাঙলাদেশ ভাগ হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে; এই ভাগাভাগির পেছনে বহু ধর্মীয় সংঘাত, হানাহানি, ধর্ষণ ও রক্ত জড়িয়ে আছে। যে দেশগুলোই ধর্মের ভিত্তিতে নিজেদের পরিচয় নির্ধারণ করেছে, বা সেদিকে যাবার পাঁয়তারা কষছে, তারা কেউই আজ ভালো নেই, থাকবার কথাও নয়। একই ধর্মের সব মানুষদের নিয়ে দেশ বানাবার মতো বর্বর, মধ্যযুগীয়, এবং বর্ণবিদ্বেষী আর কিছু আছে কি? এ ধরণের রাষ্ট্রব্যবস্থায় মানব চরিত্রের বৈচিত্র্যতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, এবং সৃষ্টিশীলতার স্থান থাকে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই পরোক্ষভাবে দেশগুলোর রাজনৈতিক আসনগুলো নিয়ন্ত্রণ করে, এবং দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নীতিগুলো ধর্মকে কেন্দ্র করেই গঠিত হয়। যেহেতু গোটা বিশ্বের সবাই একই ধর্মের অনুসারী নয়, একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে দেশ চালাতে গেলে তাই অন্য পদ্ধতিতে চালনাকৃত দেশগুলোর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সাহিত্য, বা যেকোন মানবিক যোগাযোগই কার্যত বাধাগ্রস্ত হয়। ধর্মীয় অনুশাসনে চলা দেশগুলো একদিকে যেমন নিজেদের জনগণকে ধর্মের কলা খাইয়ে প্রতারিত করে চলে, তেমনি বৈশ্বিক ধর্মীয় উন্মাদনাতেও ঘি ঢালে। ভাষার ভিত্তিতে দেশ বানাবার ধারণাটির শামিয়ানা ধর্মের শামিয়ানার চেয়ে ঢের, ঢের বড়-এটাই আমার ব্যক্তিগত মত। কিন্তু... কিন্তু, ভাষার ভিত্তিতে দেশ হলেই কি সব হানাহানি, মারামারি শেষ হয়ে যাবে? মানুষে মানুষে পার্থক্য ঘুচে যাবে?
স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, মন্টেনেগ্রো, সার্বিয়া, ও ম্যাসেডোনিয়া-এই ছ'টি অঞ্চলকে নিয়ে মার্শাল টিটো সমাজবাদী ইউগোস্লাভিয়া বানিয়েছিলেন; সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই অঞ্চলগুলোর প্রত্যেকটিই ইউগোস্লাভিয়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজ নিজ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সাবেক ইউগোস্লাভিয়ার এই ছ'টি দেশ জুড়ে যে আড়াই কোটি মানুষ আছে, তাদের মুখের ভাষা ‘দক্ষিণ স্লাভিক' পরিবারের অন্তর্গত (বলকানে আরো দু'রকম স্লাভিক ভাষার প্রচলন রয়েছে; পশ্চিমী স্লাভিকঃ রুশ ও ইউক্রেনীয়, এবং পূর্বীয় স্লাভিকঃ পোলিশ, চেক ইত্যাদি)। ইভো আন্দ্রিচ তাঁর তরুণ বয়েসে দক্ষিণ স্লাভিক ভাষাভাষীদের নিয়ে একটি দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন, বলকানের বাস্তবতায় ক্রমে সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসেছেন। বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, ও সার্বিয়াতে মানুষ ‘একই ভাষায়' কথা বলে, যাকে এখন বসনিয়ান-ক্রোয়েশিয়ান-সার্বিয়ান বা বিসিএস ভাষা বলা হয়। ক্যাথলিক ক্রোয়েশিয়ানরা এই ভাষা লেখেন ল্যাটিন হরফে, অর্থোডক্স সার্বরা লেখেন সিরিলিক হরফে, আর বসনিয়ার মুসলমানেরা এই একই ভাষায় কিছু তুর্কী শব্দ আমদানী করেছেন, ভাষাটিকে ইসলামিক একটি রুপ দেবার জন্য, অনেকটা আমাদের জল-পানি যেমন (অর্থাৎ, নিজেদের ভাষার পার্থক্যের ভিত্তিটি এঁরা আপন আপন ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই গড়েছেন)। যদিও এঁরা সবাই সবার কথা দিব্যি বুঝতে পারেন, তিনটি অঞ্চলের মানুষেরাই নিজ নিজ ভাষাটিকে একটি স্বকীয় ভাষা হিসেবে দাবী করে আসছেন। ১৯৯২-এর বসনিয়ার যুদ্ধে এই তিনটি দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে মেক্সিক্যান স্ট্যান্ডঅফে দাঁড়িয়ে যায়; লক্ষাধিক মানুষ অনর্থক প্রাণ হারায়, ধর্ষিত হয় অগুনতি নারী (বিশেষত বসনিয়ান মুসলমান নারী)। ভাষার একাত্নতা এঁদের একে অপরের কাছে নিজেদের পশু হিসেবে প্রতীয়মান করাবার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তবে এই সংঘাতের গোড়ায় কার্যত পানি ঢেলেছে সেই ধর্মবিশ্বাস-ই।
ভাষাবিদদের মাঝে একটি কৌতুক প্রচলিত রয়েছেঃ ভাষা (language) এবং আঞ্চলিক টান (dialect)-এর মাঝে পার্থক্য কোথায়? এর উত্তর হলোঃ ভাষা আসলে এমন একটি আঞ্চলিক টান যার সমরশক্তি রয়েছে। অর্থাৎ, নিজের ভাষাটির মর্যাদা স্থাপন করতে গেলে আপনাকে কিছুটা গায়ের জোর খাটাতেই হবে! বলকান অঞ্চলের জন্য এই কথাটি ভীষণভাবে খাটে। চট্টগ্রামে বহুল প্রচলিত স্থানীয় চাটগাঁইয়া ভাষাটি বাঙলাদেশের সিংহভাগ মানুষই বোঝেন না, এবং এটিকে বাঙলাদেশে প্রচলিত বাঙলা ভাষার একটি আঞ্চলিক রূপ হিসেবেই দেখেন। চাটগাঁইয়া ভাষাভাষীরা আবার চট্টগ্রামের বাইরের কাউকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ইতার তন ছিটাইঙ্গা ন আইশ্যে দ্দে, ইতা বৈঙ্গা (“এই ব্যক্তি চাটগাঁইয়া পারে না, সে বহিরাগত!”)। ওদিকে রোহিঙ্গারা প্রায় এই চাটগাঁইয়া ভাষাটিরই খুব কাছাকাছি একটি রূপ আরবী হরফে লিখে সেটিকে রোহিঙ্গা ভাষা হিসেবে স্বকীয়তা দান করেছেন। ধর্ম কিংবা ভাষা কিংবা জাতীয়তাবোধ-মানুষ আসলে কোন না কোন একটার ছুতোয় নিজেকে/ নিজের দলকে অপরের চেয়ে উঁচুতে দেখতে চায়। বসনিয়ায় যে খ্রীষ্টধর্মী সার্বরা রয়েছে, এবং সার্বিয়ায় যে মুসলমান বসনিয়ানরা রয়েছে, তারা তাদের শতাব্দী-প্রাচীন সংঘাতের ইতিহাসটি ভুলতেই পারছে না; অবিশ্বাস এবং সন্দেহের দুষ্ট চক্রে পাক খেতে খেতে বারবারই তারা জড়িয়ে পড়ছে নিত্যনতুন সংঘাতে। ১৯৯২-১৯৯৫, এই ৩ বছর ধরে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার দখল নিয়ে যুদ্ধ এবং গণহত্যার দুঃস্বপ্নের পর শেষমেষ বসনিয়া-হার্জেগোভিনাকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগে থাকে বসনিয়ান সার্বরা (রিপুবলিকা সেরপ্স্কা, মানচিত্রের লাল অংশ), আরেকভাগে বসনিয়ান মুসলমানরা (ফেডারেশন অফ বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা)।
ছবি-সূত্রঃ উইকিপিডিয়া
সার্বিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপতি রাদোভান কারাদচিচ বসনিয়ান মুসলমানদের ওপর গণহত্যা চালিয়ে এখন আজীবন জেলের সাজা খাটছেন, কিন্তু সার্বিয়ায় তাঁকে জাতীয় নায়ক হিসেবে দেখেন এমন মানুষের সংখ্যাও খুব কম নয়। জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম-এ দু'টি বিষাক্ত পিল একসাথে গলাধঃকরণ করে বর্ণবিদ্বেষী কুৎসিত একটি রূপ গ্রহণ করা (মূর্খ) মানুষের চিরাচরিত লক্ষণ। বসনিয়ার যুদ্ধের প্রায় ৩০ বছর পেরিয়ে যাবার পর জাতিগত বিদ্বেষ আজ আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সার্বিয়ান নেতা মিলোরাদ দোদিচ তাঁর পূর্বসুরী কারাদচিচের সিলসিলায় আবার যুদ্ধ লাগাতে চাইছেন, বসনিয়ান মুসলমানদের বের করে দিতে চাইছেন। সুদূর তুরস্ক থেকে আসা শাসকদের হাত ধরে মুসলমান হয়ে যাওয়া স্লাভ এখন বাকী সব স্লাভদের কাছে ‘বৈঙ্গা'।
ইভো আন্দ্রিচ তাঁর এ গোটা বইয়ে মুসলমানদের প্রায় পুরোটা সময় হয় ‘তুর্কী' নয় ‘আরব' বলে সম্বোধন করেছেন। বিদেশী একটি সংস্কৃতি যে ৬শ বছরেও তাঁর নিজের সংস্কৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়নি, এক হবার চেষ্টা করেনি, এমন একটি আক্ষেপই সম্ভবত মোটা দাগে উঠে আসে শেষ পর্যন্ত এ বইয়ে। বসনিয় সাহিত্য সমালোচকরা আন্দ্রিচের প্রতি মুসলিম-বিদ্বেষ-এর অভিযোগ টানেন, আন্দ্রিচ একেবারে দুধে ধোয়া তুলসী পাতাও হয়তো নন, কিন্তু আন্দ্রিচকে কৃতিত্ব দিতেই হয় একটি কারণে। এ বইটি লিখে বসনিয়ার জনগণের ৬শ বছরের সংঘাতের ইতিহাস জানিয়ে আন্দ্রিচ মূলত আমাদের মনে করিয়ে দেন, ধর্মের পার্থক্য এ অঞ্চলের ওপর যে গভীর ক্ষত তৈরী করে দিয়ে গেছে বিগত শতকগুলোতে, এর প্রভাব খুব সহজে চলে যাবে না, আরো বহু বহু দশক ধরেই সম্ভবত এই সংঘাত টেনে যেতে হবে। এ লেখা শুরু করেছিলাম টুইটার থেকে প্রাপ্ত একটি ছবি দিয়েঃ গত বছর নভেম্বরে বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাই ম্যাচে ইউক্রেনীয় দর্শকেরা রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিবাদ করতে রাশিয়ার পতাকাটি উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু সেটি তখন আবার দেখতে সার্বিয়ার পতাকার মতো দেখায়। খেলা দেখতে আসা বসনিয় দর্শকেরা ইউক্রেনীয়দের সার্ব ভেবে আক্রমণ করে বসে। বলকানের ইতিহাস যাঁর জানা আছে, তিনি কি এতে মোটেই অবাক হবেন?
আন্দ্রিচ যে এ বই লিখে আমাদের মনে করিয়ে দিলেন এই সংঘাত আরো বহুদিন চলবে, এর পেছনে একটি ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণকে দাঁড় করানো যায়ঃ সত্য স্বীকার করে নেবার ক্ষেত্রে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর ভীষণরকম কৃপণতা। ইসলামিক বিশ্বের প্রতিটি দেশেই গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, নাগরিকের ভোটাধিকার, রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার পৃথকীকরণ, ও শাসকদের জবাবদিহিতা-এ বিষয়গুলো চরমভাবে অপব্যবহৃত হয়; এই দেশগুলোর মাথা যাঁরা, নিজেদের গদি টিকিয়ে রাখতে মধ্যযুগীয় প্রথাতেই তাঁরা দেশ চালিয়ে থাকেন, ফলে তাঁদের দেশগুলোর জনগণেরা সত্য-সন্ধানী হতে পারে না, সত্যের চর্চা করতে শেখে না, এবং কার্যত সত্য কথাও বলতে তারা জানে না। যেখানে সত্যের চর্চা ছিনতাই হয়ে গেছে, সেখানে কোন বিশ্বাসযোগ্য গবেষণা হতে পারে না, কোন ঘটনার সঠিক কার্যকারণও সেখানে জানা যায় না। এইসব কারণে গোটা ইসলামিক বিশ্বই জ্ঞানচর্চার দিক থেকে, এবং পড়াশোনার ক্ষেত্রে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪ ভাগের ১ ভাগ ইসলামিক বিশ্বের; এঁরা যদি নিজেদের ধর্মবিশ্বাসটিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে শুধু সেটিকেই অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরে রেখে বাকী বিশ্বকে শত্রু ঠাউরে নিজেদের অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঠেলে যাবার চিরাচরিত ঐতিহ্যটি চালিয়ে যান, পৃথিবীর বাকী ৩ ভাগ মানুষের জনজীবনের ওপরও তা বিরূপ ভূমিকা রাখা শুরু করবে।
অটোমান বা যেকোন ইসলামিক শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচারের ইতিহাস ইসলামিক বিশ্বের কোথাওই স্বীকৃত নয়; নিজেদের ধর্মের ভাইরা কখনোই কোন খারাপ কাজ করতে পারেন না-এমন একটি আত্নসৃষ্ট প্রপঞ্চে গা ডোবাতে মুসলমান জনগণ ভালোবাসেন। তাঁদের এই ভ্রান্তিবিলাসের জন্যই আর্মেনিয়ার ওপর চালানো তুরস্কের বা ইয়েমেনের ওপর চালানো সৌদি আরবের, বা বাঙলাদেশের ওপর চালানো পাকিস্তানের গণহত্যার কোন বিচার আন্তর্জাতিক কোন আদালতে হয় না, যেমনটা হয়েছে রাদোভান কারাদচিচ বা তাঁর দোসর স্লোবোদান মিলোসেভিচের। তুরস্কে বা পাকিস্তানে বা সৌদিতে উপর্যুক্ত গণহত্যাগুলোর ব্যাপারে কথা বলা কার্যত রাষ্ট্রদ্রোহের সামিল। মুসলিম দেশগুলোর মাঝে যেহেতু কোন ঐক্য নেই, এরা একজোট হয়ে মুসলমানদের ওপর চলা কোন অবিচারের প্রতিবাদও তাই করতে পারে না, ফলে অত্যাচারিতের ওপর অত্যাচার বাড়তেই থাকে। বসনিয়ায় নতুন করে যে ধর্মীয় টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে ইসলামিক বিশ্ব আদৌ ভাবিত নয়, যেমনটি তারা নয় চীনের উইঘুরদের নিয়েও। ইরান, সৌদী-আরব, তুরস্ক, মিশর, পাকিস্তান, কাতার, সিরিয়া, কুয়েত, বাহরাইন, ওমান-ইসলামিক বিশ্বের চাঁই এই সবক'টি দেশ রায় দিয়েছে চীন উইঘুরদের মোটেই অত্যাচার করছে না। বসনিয়ার ক্ষেত্রেও ভিন্ন কিছু হবে না, কারণ ধর্মের ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে এরা কেউই রাশিয়ার (বা চীনের) অর্থনৈতিক আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না।
ইভো আন্দ্রিচ-এর এ বইটির প্রেক্ষাপট নিয়েই সব কথা খর্চা করে ফেললাম, বইটি কেমন সে আলোচনায় যাবার সুযোগ পাইনি। এক কথায় বলতে গেলে বইটি আসলে খুব সুখপাঠ্য কিছু নয়। উপন্যাসের যে চিরাচরিত ধারা, সেটির চেয়ে বেশ অনেকটাই ব্যতিক্রম এ বই, কারণ এটি লেখা হয়েছে বেশ অনেকটাই নন-ফিকশন বা প্রবন্ধের আকারে। স্থায়ী কোন চরিত্র নেই, ৩১৫ পাতার বইতে সংলাপও সাকুল্যে ১০ পাতার মতো। শিল্পমান বিবেচনায় বইটি আসলে বেশ কম নাম্বারই বোধহয় পাবে, অন্তত ইংরেজী অনুবাদে পড়ে আমার তাই মত! আগ্রহোদ্দীপক, বর্ণিল এক ঐতিহাসিক সময়ের গল্প ধরেছেন আন্দ্রিচ, সেই সময়ের মায়াতেই বইটি এগিয়ে যায়, আন্দ্রিচের লেখনশৈলীতে বেশী একটা নয়। মুসলমানদের কাছ থেকে নিন্দা কুড়নো, ‘মুসলিম-বিদ্বেষী' তকমা এঁটে যাওয়া, এবং নিজ বইতে স্লাভিক মুসলমানদের তুর্কী কিংবা আরব বলে যাওয়া আন্দ্রিচ নোবেল জেতার পর যা টাকা পেয়েছিলেন, তার সবটাই তিনি বসনিয়ার গ্রন্থালয়গুলোতে বই কেনার জন্য দান করে দেন, নিজের জন্য কিছুই রাখেননি। ঐতিহাসিকভাবেই মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ বসনিয়ার গ্রন্থাগারের প্রতি তাঁর এই মায়া সম্ভবত ইঙ্গিত দেয় দিনশেষে তিনি মুসলমান-ক্যাথলিক-অর্থোডক্স-ইহুদী ভেদে একটি দক্ষিণ-স্লাভিক ঐক্যই দেখতে চেয়েছেন, ফালতু ধর্মীয় দলাদলি নয়।
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচিত হয় এই বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভোতে। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর হাবসবার্গ সাম্রাজ্য যখন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনাকে এক করে ঘোষণা করে তারাই এই অঞ্চলের নতুন মালিক, বসনিয়ান সার্বদের মোটেই পছন্দ হয় না এই প্রস্তাবনা। ৬ শতকের পরাধীনতার শেকলে আবদ্ধ থাকা স্লাভরা নিজেদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থা দাবী করে। হাবসবার্গ সাম্রাজ্যের রাজপুত্র আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ তখন সশরীরে সারায়েভো গিয়ে হাজির হন তাঁর দাবীটি জোরালো করবার জন্য। সারায়েভো'র রাস্তা দিয়ে আর্চডিউক সার্বিয়ার জনগণের সামনে গাড়ীবহর হাঁকিয়ে শোডাউন করবেন-এমনটাই ছিলো পরিকল্পনা। নিরাপত্তাজনিত কারণে শেষ মূহুর্তে ভিন্ন এক রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কিন্তু গাড়ী বহরের দুই চালক ছিলো জাতে চেক, গাড়ী ডানে ঘোরাবার জার্মান ভাষার নির্দেশ তারা বোঝেনি। বামের রাস্তায় ১৯ বছরের সার্বিয়ান তরুণ গাভ্রিলো প্রিন্সিপে পিস্তল হাতে প্রস্তুত হয়েই ছিলো, আর্চডিউকের বুকে দু'টো গুলি সেঁধিয়ে দিতে বেশী কষ্ট করতে হয়নি।
শুরু হয়ে যায় ৪ বছর মেয়াদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যাতে প্রাণ হারায় ৪ কোটি মানুষ, চিরদিনের জন্য তছনছ হয়ে যায় অগুনতি মানুষের জীবন, আর ২ দশক পরেই ডেকে নিয়ে আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
স্প্যানিশ সাহিত্যিক ইলদেফন্সো ফ্যালকোনেস-এর ঐতিহাসিক উপন্যাস ক্যাথিড্রাল অফ দ্যা সি। ১৩২৯ থেকে ১৩৮৩-এই ৫৪ বছর ধরে বার্সেলোনায় নির্মিত হয় স্পেনের বিখ্যাত সান্তা মারিয়া দেল মার বা সাগর তীরের মাতা মেরির ক্যাথিড্রাল। যে সময়ে এই ক্যাথিড্রালটি'র নির্মাণকাজ শুরু হয়, কাছাকাছি সময়ে ইওরোপে এমন ক্যাথিড্রাল বানাবার ধুম চলছে তখন, সবারই লক্ষ্য সবচেয়ে দশাসই ও সবচেয়ে দেখনদারি ক্যাথিড্রালটি বানিয়ে বাকী সবাইকে হাঁ করিয়ে দেয়া। এই ক্যাথিড্রালগুলোর বেশ কয়েকটিই আজ আর টিকে নেই, তবে সান্তা মারিয়া আজও বার্সেলোনা আলো করে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে ৭০০ বছর ধরে। পাউন্ড দেড়েক ওজনের এ বইতে ফ্যালকোনেস সান্তা মারিয়া ক্যাথিড্রাল নির্মাণের প্রেক্ষাপটে ১৪ শতকের বার্সেলোনার এ গলি সে গলি ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন, ৬০০ পৃষ্ঠা ধরে শুনিয়েছেন মধ্যযুগের ইওরোপের প্রতিদিনের জীবনের গল্প।
উপন্যাসের শুরুতেই ফ্যালকোনেস ধর্ম আর স্বার্থের খেয়োখেয়ির সেই চিরন্তন ছবিটিই দেখিয়েছেন ঐতিহাসিক নানা সূত্র টেনে। ক্ষমতার পালাবদলে শত্রু-মিত্রের বহু হিসেব নিকেশই পাল্টে যায়, ধ্রুব সত্য থেকে যায় কেবল একটি বিষয়ইঃ গরীব আরো গরীব হয়, আর ধনী শাসকের পকেট ফুলে ফুলে ঢোল থেকে কোলবালিশে পরিণত হয়। গরীবের রক্ত চুষে খাবার অভিনব সব পন্থা জায়েজ করবার তরে নিত্য নতুন ঐশ্বরিক বিধান নিয়ে রক্তের গন্ধ পাওয়া হাঙরের মতো ছুটে আসে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের দাদার মুখে ফ্যালকোনেস শুনিয়েছেন হাজার হাজার বছর ধরে চর্চিত হয়ে আসা অমোঘ সেই সত্যঃ
“
বাপধন, যারাই কইবো উপরওয়ালার কাছ থিকা আদেশ পায়া তোমার উপকার করতে আসছে, তাগোরে কোনওদিন বিশ্বাস কইরোনা। অরা তোমারে ম্যালা মিঠা মিঠা কথা শুনাইবো, শুনতে তোমার ভালাও লাগবো অনেক, কিন্তু ঐ সব কথার আসলে কোন দাম নাই। অরা যেইভাবে কথা নিয়া খেলবার পারে, আমাগো ঐ জ্ঞান নাইরে বাপ। কিতাব খুইলা তারা তোমারে উপরওয়ালার অনেক বিধি বিধান দেখাইবো, কিন্তু আমরা তো চাষা, কাম করি ক্ষেতে, ঐ কিতাব তো আমরা পড়বার পারিনারে বাপ। ছোট বাল-বাচ্চারে আমরা যেইভাবে এইটা ওইটা বুঝায়া ঘুম পাড়াইতে নিয়া যাই, ঐভাবেই অরা তোমারে বুঝ দিয়া তোমার সব কব্জা কইরা নিতে চাইবো। খু-উ-ব সাবধান থাইকো...”
সান্তা মারিয়া দেল মার
সান্তা মারিয়া
সান্তা মারিয়া
সান্তা মারিয়া
ইনকুইজিশন
Chronica
সিহানো দে ব্যেহজেহাচ (Cyrano de Bergerac) একাধারসে ছিলেন কবি, বিজ্ঞান-কল্পকাহিনীকার, দার্শনিক, চিকিৎসক, নাট্যকার, চিঠি-লেখিয়ে, সৈনিক, এবং তলোয়ারবাজ। যে সময়টায় সিহানো'র জন্ম, সেই ১৬১৯ সালে ইওরোপের মধ্যভাগ জুড়ে চলছে থার্টি ইয়ারস' ওয়ার। ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, জার্মানীর জনসংখ্যা নেমে আসে অর্ধেকে। এ যুদ্ধের হাত ধরে ইওরোপ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই আরো বেশ কয়েকটি যুদ্ধ দেখে যার মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য নেদারল্যান্ড ও স্পেনের ৮০ বছরের যুদ্ধ, ফ্রান্স-স্পেনের মাঞ্চুয়ান যুদ্ধ, পর্তুগাল-স্পেনের যুদ্ধ, এবং সবশেষে ফ্রান্স-স্পেনের যুদ্ধ। শেষের এই যুদ্ধে ফরাসী সিহানো নিজেও লড়াই করেন এবং যুদ্ধে আহত হবার পর সৈনিকের দায়িত্ব ছেড়ে পুরোপুরি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
জনশ্রুতি আছে, সিহানো'র নাকটি নাকি (আক্ষরিক অর্থেই) ছিলো বিশাল বড়। টেনিদা'র বইয়ের প্রচ্ছদে যেমন সবার প্রথমে তাঁর নাকের দিকেই নজর যায়, সিহানো'র ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিলো না নাকি। সিহানো'র মৃত্যুর প্রায় আড়াইশ বছর পর ১৮৯৭ সালে ফরাসী নাট্যকার এদমোঁ হোস্তাঁ (Edmond Rostund) সিহানোকে নিয়ে নাম শিরোনামে একটি নাটক লেখেন, যা আজ অব্দি তাঁর শ্রেষ্ঠতম কাজ হিসেবে টিকে আছে; বস্তুতঃ হোস্তাঁ এবং ‘সিহানো দে ব্যেহজেহাচ' আজ সমার্থক শব্দই হয়ে গেছে প্রায়।
হোস্তাঁ তাঁর এ নাটকে সিহানোকে নিয়ে যে গল্পটি ফেঁদেছেন, সে ধরণের গল্প আমরা ৮০-৯০-এর দশকের বাঙলা সিনেমায় অনেকই হয়তো দেখেছি। ট্র্যাজি-কমেডি ঘরানার এ নাটকে আমরা দেখতে পাই সিহানো তাঁর বিসদৃশ নাকের কারণে ভীষণ হীনমন্যতায় ভোগেন, এবং লজ্জায় ও শঙ্কায় তিনি কখনোই তাঁর ভালোবাসার নারী হক্সেইন (Roxanne)কে মনের কথা জানাতে পারেন না। হক্সেইন এদিকে মন দিয়েছেন সিহানো'র কম্পানি'র আরেক সৈনিক খ্রিস্তীয়ঁকে (Christian)। হক্সেইন দুর্দান্ত বুদ্ধিমতী, শিল্প-সাহিত্যে দারুণ আগ্রহ তার; ওদিকে, জীবনভর শুধুই তলোয়ার চালাতে শেখা খ্রিস্তীয়ঁ'র একেবারেই কাব্য আসে না! হক্সেইন খ্রীস্তীয়ঁ'র রূপে মজেছে, কিন্তু খ্রিস্তীয়ঁ নিজের থেকে বুদ্ধি খাটিয়ে কথা বলতে গেলেই হক্সেইন-এর হাঁপ ধরে যায়। আদতে একইরকম বোকা বোকা কথার বিরক্তিকর পুণরাবৃত্তি ছাড়া খ্রিস্তীয়ঁ'র ঝুলিতে আর কিছুই নেই। পাছে ভুল মানুষকে ভালোবাসার যাতনায় হক্সেইন আত্নদহনে ভোগে, সে ভয়ে সিহানো হাতে কলম তুলে নেন, আর বুকে চেপে নেন পাথর; খ্রিস্তীয়ঁ'র নাম দিয়ে হক্সেইনকে একের পর এক চিঠি লিখে দিতে থাকেন। মাতাল করা ভাষায় লেখা সে চিঠির কাব্যসুধা আকণ্ঠ পান করে হক্সেইন খ্রিস্তীয়ঁর প্রেমে আরো, আরো ডুবে যেতে থাকে, আর ‘কুৎসিত-দর্শন' সিহানো দূর থেকে দেখে যান। হক্সেইন সিহানো'র হয়নি, কিন্তু তাতে কী? খ্রিস্তীয়ঁকে বিয়ে করে হক্সেইন তো সুখে আছে, হক্সেইনের সুখেই সিহানো'র সুখ।
খ্রিস্তীয়ঁর সাথে হক্সেইন-এর বিয়েটা শেষমেশ দীর্ঘস্থায়ী হয় না; ফ্রান্স-স্পেনের যুদ্ধে খ্রিস্তীয়ঁ প্রাণ হারায়, এরপর ১৪ বছর কেটে যায়, কিন্তু সিহানো একবারও মনের কথাটা জানান না। এই ১৪টা বছর হক্সেইন জেনে এসেছে তাকে লেখা চিঠিগুলো সবই খ্রিস্তীয়ঁ'র লেখা; এমনকি যুদ্ধের ময়দান থেকেও নিয়ম করে প্রতিদিন সিহানো খ্রিস্তীয়ঁ'র সই দিয়ে চিঠি লিখে গেছেন, প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে শত্রু শিবিরের চোখ এড়িয়ে সে চিঠি প্রতিদিন পাচার করেছেন, কারণ যুদ্ধে যাবার আগে হক্সেইনকে সিহানো কথা দিয়েছিলেন খ্রিস্তীয়ঁ যেন নিয়মিত চিঠি লেখে তা তিনি দেখবেন। প্রায় পুরোটা নাটকে সিহানো তাঁর দারুণ চোখা চোখা সব সংলাপে পাঠক/ দর্শককে হাসিয়ে মেরে শেষের দৃশ্যে উদাস ও স্তম্ভিত করে দেন। হক্সেইন-এর কোলে মাথা রেখে ৩৬ বছর বয়েসী সিহানো যখন মারা যাচ্ছেন, সেই মুহুর্তেই কেবল হক্সেইন বুঝতে পারে কী নিদারুণ এক মিথ্যের সাথে গত ১৪টা বছর সে বাস করে এসেছে। মৃত্যুপথযাত্রী সিহানো'র একটিই আবদার, সিহানো'র জন্য হক্সেইনকে আলাদা সময় ব্যয় করতে হবেনা, শুধু খ্রিস্তীয়ঁর জন্য যখন হক্সেইন-এর খুব মন খারাপ হবে, প্রাণ কাঁদবে, তখন যেন সিহানোকেও একটু সে মনে করে, তাঁর জন্য এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে...
১৮৯৭ সালে লেখার পর থেকে হস্তোঁ'র এ নাটকটি গত ১২৬ বছরে অসংখ্যবার মঞ্চে এবং পর্দায় অভিনীত হয়েছে। মার্কিন অভিনেতা হোসে ফেরার ১৯৪৭ সালে টনি ও ১৯৫০ সালে অস্কার জেতেন সিহানো'র চরিত্রে অভিনয় করে। এরপর থেকে সিহানো প্রায় প্রতি দশকেই ফিরে ফিরে এসেছে কোন না কোন রূপে। ২০২১-এই টিরিওন ল্যানিস্টার খ্যাত পিটার ডিংক্লেজ সিহানো হয়েছেন। একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিংক্লেজ বলেছিলেন কিভাবে সিহানো'র সাথে তিনি নিজে মিশে একাকার হয়ে গেছেন। সিহানো'র মতোই তাঁরও যে নিজের শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রবল আক্ষেপ, হতাশা, লজ্জা ও হীনমন্যতা ছিলো! গত বছর প্রফেসর এক্স-খ্যাত জেইমস ম্যাকঅ্যাভয়ও সিহানোর চরিত্রে মঞ্চে এসে ভীষণ প্রশংসা কুড়িয়েছেন, তবে এটি আধুনিক ‘অ্যাডাপ্টেশন', হস্তোঁর মূল নাটকটি নয়।
সিহানো আর হক্সেইনকে নিয়ে লেখা প্রেমের গপ্পোটি সম্পূর্ণ বানোয়াট, তবুও কেন সিহানোকে মানুষ অতো ভালোবাসে? কেন তাঁকে নিয়ে হস্তোঁ নাটক লিখতে গেলেন? এর কারণটি লুকিয়ে আছে সিহানো'র লেখালেখিতে এবং তাঁর ব্যক্তিত্বে। নাটকে যেমন দেখা যায়, সিহানো বাস্তব জীবনেও খুব সম্ভব তেমনি বাকচতুর ছিলেন, কথার ইয়র্কারে প্রতিপক্ষকে সম্ভবত একইভাবে তিনি ক্লিন বোল্ড করে দিতেন। ১৭ শতকের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টাতেই সিহানো হাসির বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখে ধর্মীয় কুসংস্কারে আক্রান্ত এক সমাজকে চাবকিয়েছেন, কর্তৃত্ববাদকে মুখ ভেঙিয়েছেন। যে ধরণের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিহানো'র আস্থা ছিলো সেটিকে আজ ‘এপিকিউরান অ্যাটোমিজম' বলে। গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ধারণা করেছিলেন সকল বস্তুই বিভাজনের অযোগ্য ভীষণ ছোট ছোট সব কণা দিয়ে গঠিত (স্পয়লারঃ অ্যাটম/ পরমাণু)। তাঁর শিষ্য এপিকিউরান এ ধারণাটিকে আরো পোক্ত এবং প্রসারিত করেন। ১৭ শতকের ক্যাথলিক ফরাসী সমাজ এ ধারণাটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। এর কারণঃ অ্যারিস্টটল!
ডেমোক্রিটাস পরমাণু'র যে ধারণা দিয়ে যান, তাতে দু'টি পরমাণু'র মাঝে একটি ফাঁকা জায়গা থাকে (void)। এই ভয়েড বা শূণ্যতা নিয়েই অ্যারিস্টটলের যতো আপত্তি ছিলো। “কোন একটি ঘুর্ণায়মান বস্তু যতোখানি জোরে ঘুরছে, এর চেয়েও বেশী জোরে কেন ঘুরতে পারছে না?”-এ প্রশ্নের উত্তর অ্যারিস্টটল ভেবে বের করেন, নিশ্চয়ই কোথাও কোন একটি প্রতিরোধী বল কাজ করছে যা এর ঘুর্ণনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পরমাণুগুলো'র মাঝে যদি নিঃসীম শূণ্যতাই থাকতো, তাহলে তো আর এ বল কাজ করতে পারতো না, কারণ, যেখানে কিছু নেই সেখানে তো কিছুই থাকতে পারে না! অতএব শূণ্যতার তত্ত্ব বাদ, পরমাণুর তত্ত্বটিকে গোল্লায় পাঠানো হোক। বাঙলাদেশের আজকের ধর্মীয় সমাজ যেভাবে শিশুদের পাঠ্যবইতে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়ে চলেছে, বিবর্তনবাদের অংশটুকু ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বাকী বইটুকু পড়তে আহ্বান জানাচ্ছে, ১৭ শতকের ফরাসী ক্যাথলিক সমাজের পরমাণুবাদের বিরোধীতা এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিলো না। ফ্রান্সের ধর্মবাদীরা তাঁদের ভীষণ ক্ষুদ্র জানাশোনার পরিধি, এবং তার চেয়েও ক্ষুদ্র মনকে সম্বল মেনে সিহানোকে ধর্মনিন্দা'র অভিযোগে ফাঁসিয়ে তাঁর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন।
দারুণ আধুনিকমনস্ক সিহানো তাঁর গল্পে মানুষকে রকেটে চাপিয়ে চাঁদ এবং সূর্যে পাঠিয়েছেন, সেখানের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীর অধিবাসীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, দুই ভুবনের সামাজিক আচার-রীতির পার্থক্যের হিসেবও কষে দেখিয়েছেন নানা ব্যঙ্গাত্নক গল্পের অবতারণা করে। আজ আমরা জোনাথন সুইফটের গালিভার'স ট্র্যাভেলসকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্গাত্নক কাজ বলেই জানি, সুইফট-এর অনুপ্রেরণা হিসেবে সিহানো কাজ করেছেন, এটি নিশ্চয়ই এখন আর অবাক করা কোন তথ্য নয়! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অন্যতম শীর্ষ গুরু আর্থার সি ক্লার্কও সিহানোকে ওস্তাদ মেনেছেন। শুধু সুইফট বা ক্লার্ক-ই নন, মলিয়ের, যাঁকে দিয়ে মানুষ ফরাসী ভাষাটিকে চিনেছে (“ফরাসী মলিয়েরের ভাষা”-লোকমুখে প্রচলিত ছিলো), পর্যন্ত তাঁর Scapin the Schemer নাটকের দু'টি দৃশ্য সিহানো'র Le Pédant joué থেকে সরাসরি ছেপে দিয়েছেন! পৌনে ৪শ বছর আগের মানুষ সিহানো আজও আমাদের চারপাশের বহু বহু মানুষের চেয়ে ঢের আধুনিক।
সিহানোকে অমরত্ব দান করা ছাড়াও বিশ্বসাহিত্যে হস্তোঁ'র আরেকটি বড় অবদান রয়েছে; তাঁর বরাতে প্রথমে ফরাসী এবং পরে ইংরেজী অভিধানে 'panache' শব্দটি যুক্ত হয়। প্যানাশ শব্দের অর্থ আমরা আড়ম্বরপূর্ণ আচরণ, নিজস্ব একটি স্টাইল ইত্যাদিকে বুঝি। বাঙলা একাডেমি'র অভিধানে এ শব্দটির অর্থ লেখা হয়েছে "বড়াই ভাব"। নাটকে মৃত্যুপথযাত্রী সিহানো তাঁর টুপির পালকে হাত বুলিয়ে অনেকটা দম্ভ নিয়েই বলেন, তিনি রিক্ত, শূণ্য হাতে পৃথিবী ছাড়ছেন বটে, কিন্তু সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সেই প্যানাশ। প্যানাশ বিষয়টি আদৌ কী, এবং সিহানো'র প্যানাশটি কেমন ছিলো তার উত্তরে আত্নবিশ্বাস, হামবড়া ভাব, দৃঢ় প্রত্যয়, আপুন কা ইশটাইল...ইত্যাদি নানা শব্দের তাত্ত্বিক প্রয়োগ ঘটানো যায়, কিন্তু তাতেও কি পরিষ্কার হয়? নাটকটি পড়ে সিহানো'র প্যানাশ কেমন হতে পারে তার যে একটি ধারণা পেয়েছি সেটির একটি approximation সম্ভবত একমাত্র শিবাজিই হতে পারেনঃ
ইউটিউবে খুঁজলে হস্তোঁ'র নাটকটির অনেকগুলো মঞ্চায়ন-ই চোখে পড়বে, আমার সবচেয়ে দুর্দান্ত লেগেছে ২০১৪ সালে বব জোন্স ইউনিভার্সিটির এই পার্ফর্ম্যান্সটি। কারো হাতে ঘন্টা দু'য়েক সময় থাকলে বসে যেতে পারেন কিন্তু!