Ratings61
Average rating4
সিহানো দে ব্যেহজেহাচ (Cyrano de Bergerac) একাধারসে ছিলেন কবি, বিজ্ঞান-কল্পকাহিনীকার, দার্শনিক, চিকিৎসক, নাট্যকার, চিঠি-লেখিয়ে, সৈনিক, এবং তলোয়ারবাজ। যে সময়টায় সিহানো'র জন্ম, সেই ১৬১৯ সালে ইওরোপের মধ্যভাগ জুড়ে চলছে থার্টি ইয়ারস' ওয়ার। ১৬১৮ থেকে ১৬৪৮ সাল পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়, জার্মানীর জনসংখ্যা নেমে আসে অর্ধেকে। এ যুদ্ধের হাত ধরে ইওরোপ খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই আরো বেশ কয়েকটি যুদ্ধ দেখে যার মাঝে উল্লেখ্যযোগ্য নেদারল্যান্ড ও স্পেনের ৮০ বছরের যুদ্ধ, ফ্রান্স-স্পেনের মাঞ্চুয়ান যুদ্ধ, পর্তুগাল-স্পেনের যুদ্ধ, এবং সবশেষে ফ্রান্স-স্পেনের যুদ্ধ। শেষের এই যুদ্ধে ফরাসী সিহানো নিজেও লড়াই করেন এবং যুদ্ধে আহত হবার পর সৈনিকের দায়িত্ব ছেড়ে পুরোপুরি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন।
জনশ্রুতি আছে, সিহানো'র নাকটি নাকি (আক্ষরিক অর্থেই) ছিলো বিশাল বড়। টেনিদা'র বইয়ের প্রচ্ছদে যেমন সবার প্রথমে তাঁর নাকের দিকেই নজর যায়, সিহানো'র ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কিছু ছিলো না নাকি। সিহানো'র মৃত্যুর প্রায় আড়াইশ বছর পর ১৮৯৭ সালে ফরাসী নাট্যকার এদমোঁ হোস্তাঁ (Edmond Rostund) সিহানোকে নিয়ে নাম শিরোনামে একটি নাটক লেখেন, যা আজ অব্দি তাঁর শ্রেষ্ঠতম কাজ হিসেবে টিকে আছে; বস্তুতঃ হোস্তাঁ এবং ‘সিহানো দে ব্যেহজেহাচ' আজ সমার্থক শব্দই হয়ে গেছে প্রায়।
হোস্তাঁ তাঁর এ নাটকে সিহানোকে নিয়ে যে গল্পটি ফেঁদেছেন, সে ধরণের গল্প আমরা ৮০-৯০-এর দশকের বাঙলা সিনেমায় অনেকই হয়তো দেখেছি। ট্র্যাজি-কমেডি ঘরানার এ নাটকে আমরা দেখতে পাই সিহানো তাঁর বিসদৃশ নাকের কারণে ভীষণ হীনমন্যতায় ভোগেন, এবং লজ্জায় ও শঙ্কায় তিনি কখনোই তাঁর ভালোবাসার নারী হক্সেইন (Roxanne)কে মনের কথা জানাতে পারেন না। হক্সেইন এদিকে মন দিয়েছেন সিহানো'র কম্পানি'র আরেক সৈনিক খ্রিস্তীয়ঁকে (Christian)। হক্সেইন দুর্দান্ত বুদ্ধিমতী, শিল্প-সাহিত্যে দারুণ আগ্রহ তার; ওদিকে, জীবনভর শুধুই তলোয়ার চালাতে শেখা খ্রিস্তীয়ঁ'র একেবারেই কাব্য আসে না! হক্সেইন খ্রীস্তীয়ঁ'র রূপে মজেছে, কিন্তু খ্রিস্তীয়ঁ নিজের থেকে বুদ্ধি খাটিয়ে কথা বলতে গেলেই হক্সেইন-এর হাঁপ ধরে যায়। আদতে একইরকম বোকা বোকা কথার বিরক্তিকর পুণরাবৃত্তি ছাড়া খ্রিস্তীয়ঁ'র ঝুলিতে আর কিছুই নেই। পাছে ভুল মানুষকে ভালোবাসার যাতনায় হক্সেইন আত্নদহনে ভোগে, সে ভয়ে সিহানো হাতে কলম তুলে নেন, আর বুকে চেপে নেন পাথর; খ্রিস্তীয়ঁ'র নাম দিয়ে হক্সেইনকে একের পর এক চিঠি লিখে দিতে থাকেন। মাতাল করা ভাষায় লেখা সে চিঠির কাব্যসুধা আকণ্ঠ পান করে হক্সেইন খ্রিস্তীয়ঁর প্রেমে আরো, আরো ডুবে যেতে থাকে, আর ‘কুৎসিত-দর্শন' সিহানো দূর থেকে দেখে যান। হক্সেইন সিহানো'র হয়নি, কিন্তু তাতে কী? খ্রিস্তীয়ঁকে বিয়ে করে হক্সেইন তো সুখে আছে, হক্সেইনের সুখেই সিহানো'র সুখ।
খ্রিস্তীয়ঁর সাথে হক্সেইন-এর বিয়েটা শেষমেশ দীর্ঘস্থায়ী হয় না; ফ্রান্স-স্পেনের যুদ্ধে খ্রিস্তীয়ঁ প্রাণ হারায়, এরপর ১৪ বছর কেটে যায়, কিন্তু সিহানো একবারও মনের কথাটা জানান না। এই ১৪টা বছর হক্সেইন জেনে এসেছে তাকে লেখা চিঠিগুলো সবই খ্রিস্তীয়ঁ'র লেখা; এমনকি যুদ্ধের ময়দান থেকেও নিয়ম করে প্রতিদিন সিহানো খ্রিস্তীয়ঁ'র সই দিয়ে চিঠি লিখে গেছেন, প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে শত্রু শিবিরের চোখ এড়িয়ে সে চিঠি প্রতিদিন পাচার করেছেন, কারণ যুদ্ধে যাবার আগে হক্সেইনকে সিহানো কথা দিয়েছিলেন খ্রিস্তীয়ঁ যেন নিয়মিত চিঠি লেখে তা তিনি দেখবেন। প্রায় পুরোটা নাটকে সিহানো তাঁর দারুণ চোখা চোখা সব সংলাপে পাঠক/ দর্শককে হাসিয়ে মেরে শেষের দৃশ্যে উদাস ও স্তম্ভিত করে দেন। হক্সেইন-এর কোলে মাথা রেখে ৩৬ বছর বয়েসী সিহানো যখন মারা যাচ্ছেন, সেই মুহুর্তেই কেবল হক্সেইন বুঝতে পারে কী নিদারুণ এক মিথ্যের সাথে গত ১৪টা বছর সে বাস করে এসেছে। মৃত্যুপথযাত্রী সিহানো'র একটিই আবদার, সিহানো'র জন্য হক্সেইনকে আলাদা সময় ব্যয় করতে হবেনা, শুধু খ্রিস্তীয়ঁর জন্য যখন হক্সেইন-এর খুব মন খারাপ হবে, প্রাণ কাঁদবে, তখন যেন সিহানোকেও একটু সে মনে করে, তাঁর জন্য এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে...
১৮৯৭ সালে লেখার পর থেকে হস্তোঁ'র এ নাটকটি গত ১২৬ বছরে অসংখ্যবার মঞ্চে এবং পর্দায় অভিনীত হয়েছে। মার্কিন অভিনেতা হোসে ফেরার ১৯৪৭ সালে টনি ও ১৯৫০ সালে অস্কার জেতেন সিহানো'র চরিত্রে অভিনয় করে। এরপর থেকে সিহানো প্রায় প্রতি দশকেই ফিরে ফিরে এসেছে কোন না কোন রূপে। ২০২১-এই টিরিওন ল্যানিস্টার খ্যাত পিটার ডিংক্লেজ সিহানো হয়েছেন। একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিংক্লেজ বলেছিলেন কিভাবে সিহানো'র সাথে তিনি নিজে মিশে একাকার হয়ে গেছেন। সিহানো'র মতোই তাঁরও যে নিজের শারীরিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রবল আক্ষেপ, হতাশা, লজ্জা ও হীনমন্যতা ছিলো! গত বছর প্রফেসর এক্স-খ্যাত জেইমস ম্যাকঅ্যাভয়ও সিহানোর চরিত্রে মঞ্চে এসে ভীষণ প্রশংসা কুড়িয়েছেন, তবে এটি আধুনিক ‘অ্যাডাপ্টেশন', হস্তোঁর মূল নাটকটি নয়।
সিহানো আর হক্সেইনকে নিয়ে লেখা প্রেমের গপ্পোটি সম্পূর্ণ বানোয়াট, তবুও কেন সিহানোকে মানুষ অতো ভালোবাসে? কেন তাঁকে নিয়ে হস্তোঁ নাটক লিখতে গেলেন? এর কারণটি লুকিয়ে আছে সিহানো'র লেখালেখিতে এবং তাঁর ব্যক্তিত্বে। নাটকে যেমন দেখা যায়, সিহানো বাস্তব জীবনেও খুব সম্ভব তেমনি বাকচতুর ছিলেন, কথার ইয়র্কারে প্রতিপক্ষকে সম্ভবত একইভাবে তিনি ক্লিন বোল্ড করে দিতেন। ১৭ শতকের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টাতেই সিহানো হাসির বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লিখে ধর্মীয় কুসংস্কারে আক্রান্ত এক সমাজকে চাবকিয়েছেন, কর্তৃত্ববাদকে মুখ ভেঙিয়েছেন। যে ধরণের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সিহানো'র আস্থা ছিলো সেটিকে আজ ‘এপিকিউরান অ্যাটোমিজম' বলে। গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ধারণা করেছিলেন সকল বস্তুই বিভাজনের অযোগ্য ভীষণ ছোট ছোট সব কণা দিয়ে গঠিত (স্পয়লারঃ অ্যাটম/ পরমাণু)। তাঁর শিষ্য এপিকিউরান এ ধারণাটিকে আরো পোক্ত এবং প্রসারিত করেন। ১৭ শতকের ক্যাথলিক ফরাসী সমাজ এ ধারণাটিকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। এর কারণঃ অ্যারিস্টটল!
ডেমোক্রিটাস পরমাণু'র যে ধারণা দিয়ে যান, তাতে দু'টি পরমাণু'র মাঝে একটি ফাঁকা জায়গা থাকে (void)। এই ভয়েড বা শূণ্যতা নিয়েই অ্যারিস্টটলের যতো আপত্তি ছিলো। “কোন একটি ঘুর্ণায়মান বস্তু যতোখানি জোরে ঘুরছে, এর চেয়েও বেশী জোরে কেন ঘুরতে পারছে না?”-এ প্রশ্নের উত্তর অ্যারিস্টটল ভেবে বের করেন, নিশ্চয়ই কোথাও কোন একটি প্রতিরোধী বল কাজ করছে যা এর ঘুর্ণনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। পরমাণুগুলো'র মাঝে যদি নিঃসীম শূণ্যতাই থাকতো, তাহলে তো আর এ বল কাজ করতে পারতো না, কারণ, যেখানে কিছু নেই সেখানে তো কিছুই থাকতে পারে না! অতএব শূণ্যতার তত্ত্ব বাদ, পরমাণুর তত্ত্বটিকে গোল্লায় পাঠানো হোক। বাঙলাদেশের আজকের ধর্মীয় সমাজ যেভাবে শিশুদের পাঠ্যবইতে বিবর্তনবাদ পড়ানো নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়ে চলেছে, বিবর্তনবাদের অংশটুকু ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বাকী বইটুকু পড়তে আহ্বান জানাচ্ছে, ১৭ শতকের ফরাসী ক্যাথলিক সমাজের পরমাণুবাদের বিরোধীতা এর চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিলো না। ফ্রান্সের ধর্মবাদীরা তাঁদের ভীষণ ক্ষুদ্র জানাশোনার পরিধি, এবং তার চেয়েও ক্ষুদ্র মনকে সম্বল মেনে সিহানোকে ধর্মনিন্দা'র অভিযোগে ফাঁসিয়ে তাঁর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিলেন।
দারুণ আধুনিকমনস্ক সিহানো তাঁর গল্পে মানুষকে রকেটে চাপিয়ে চাঁদ এবং সূর্যে পাঠিয়েছেন, সেখানের অধিবাসীদের সাথে পৃথিবীর অধিবাসীদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, দুই ভুবনের সামাজিক আচার-রীতির পার্থক্যের হিসেবও কষে দেখিয়েছেন নানা ব্যঙ্গাত্নক গল্পের অবতারণা করে। আজ আমরা জোনাথন সুইফটের গালিভার'স ট্র্যাভেলসকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্গাত্নক কাজ বলেই জানি, সুইফট-এর অনুপ্রেরণা হিসেবে সিহানো কাজ করেছেন, এটি নিশ্চয়ই এখন আর অবাক করা কোন তথ্য নয়! বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর অন্যতম শীর্ষ গুরু আর্থার সি ক্লার্কও সিহানোকে ওস্তাদ মেনেছেন। শুধু সুইফট বা ক্লার্ক-ই নন, মলিয়ের, যাঁকে দিয়ে মানুষ ফরাসী ভাষাটিকে চিনেছে (“ফরাসী মলিয়েরের ভাষা”-লোকমুখে প্রচলিত ছিলো), পর্যন্ত তাঁর Scapin the Schemer নাটকের দু'টি দৃশ্য সিহানো'র Le Pédant joué থেকে সরাসরি ছেপে দিয়েছেন! পৌনে ৪শ বছর আগের মানুষ সিহানো আজও আমাদের চারপাশের বহু বহু মানুষের চেয়ে ঢের আধুনিক।
সিহানোকে অমরত্ব দান করা ছাড়াও বিশ্বসাহিত্যে হস্তোঁ'র আরেকটি বড় অবদান রয়েছে; তাঁর বরাতে প্রথমে ফরাসী এবং পরে ইংরেজী অভিধানে 'panache' শব্দটি যুক্ত হয়। প্যানাশ শব্দের অর্থ আমরা আড়ম্বরপূর্ণ আচরণ, নিজস্ব একটি স্টাইল ইত্যাদিকে বুঝি। বাঙলা একাডেমি'র অভিধানে এ শব্দটির অর্থ লেখা হয়েছে "বড়াই ভাব"। নাটকে মৃত্যুপথযাত্রী সিহানো তাঁর টুপির পালকে হাত বুলিয়ে অনেকটা দম্ভ নিয়েই বলেন, তিনি রিক্ত, শূণ্য হাতে পৃথিবী ছাড়ছেন বটে, কিন্তু সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সেই প্যানাশ। প্যানাশ বিষয়টি আদৌ কী, এবং সিহানো'র প্যানাশটি কেমন ছিলো তার উত্তরে আত্নবিশ্বাস, হামবড়া ভাব, দৃঢ় প্রত্যয়, আপুন কা ইশটাইল...ইত্যাদি নানা শব্দের তাত্ত্বিক প্রয়োগ ঘটানো যায়, কিন্তু তাতেও কি পরিষ্কার হয়? নাটকটি পড়ে সিহানো'র প্যানাশ কেমন হতে পারে তার যে একটি ধারণা পেয়েছি সেটির একটি approximation সম্ভবত একমাত্র শিবাজিই হতে পারেনঃ
ইউটিউবে খুঁজলে হস্তোঁ'র নাটকটির অনেকগুলো মঞ্চায়ন-ই চোখে পড়বে, আমার সবচেয়ে দুর্দান্ত লেগেছে ২০১৪ সালে বব জোন্স ইউনিভার্সিটির এই পার্ফর্ম্যান্সটি। কারো হাতে ঘন্টা দু'য়েক সময় থাকলে বসে যেতে পারেন কিন্তু!