Hazaaron Khwahishein Aisi: The Wonderful World of Urdu Ghazals

Hazaaron Khwahishein Aisi

The Wonderful World of Urdu Ghazals

2019 • 456 pages


মোহব্বত করনে ওয়ালে কম না হোঙ্গে তেরি মেহ্ফিল মে লেকিন হম না হোঙ্গে

দক্ষিণ এশিয়ার একান্ত নিজস্ব সংগীতশৈলীগুলির মধ্যে মার্গসংগীতের ধারা বাদ দিলে গজল গানের ইতিহাসই বোধহয় সবচেয়ে প্রাচীন। ধ্রুপদী গজল লেখা হয় মূলত উর্দু ভাষায়। উর্দু একটি পাঁচমেশালি ভাষা। আরবি, ফারসি, তুর্কি, সংস্কৃত, ব্রজ, অওয়ধি, এরকম নানাবিধ ভাষার মিশ্রণে মধ্যযুগে তৈরি হয়েছিল এই চমৎকার ভাষাটি। যদিও “গজল” শব্দটি আরবি এবং শব্দটির আক্ষরিক অর্থ : “প্রেমিকার সঙ্গে সংলাপ”।

শুধুমাত্র প্রতিদানহীন ব্যর্থ প্রেম (unrequited love)-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি স্বতন্ত্র সংগীতশৈলী পৃথিবীতে বোধহয় আর একটাও নেই। এবং এই শৈলীটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, গানের লিরিকের সাহিত্যগুণ অতি উঁচুমানের। সুরবর্জিত লিরিকগুলি পড়লে খাঁটি কবিতাপাঠের আনন্দ পাওয়া যায়। এবং এই উঁচুদরের কবিতার অঙ্গে যখন সুরের পোশাক জড়ানো হয়, এবং সঙ্গে যুক্ত হয় উপযুক্ত কণ্ঠের মাধুর্য, তখন বাহারের (বাহার= বসন্তকাল) যেমন চমন (=ফুলের বাগান) ইয়াদ আতা হ্যায়, আমাদের সবারই যেন কোনো এক গুলবদনের কথা মনে পড়ে যায়... (গুলবদন= গোলাপের মতো সুন্দর মুখ যার। এখানে মনে রাখা দরকার, গুলবদন শব্দের প্রযুক্ত অর্থ তথাকথিত “সুন্দরী” নয়। সবার কাছেই তার প্রেমিকার মুখ গোলাপের মতো সুন্দর)।

এই গুলবদনের উদ্দেশ্যেই যুগের পর যুগ লেখা হয়ে এসেছে গজল গান। এই গুলবদন কখনও রক্তমাংসের, কখনও কল্পনার। কিন্তু একে কখনোই ধরা যায় না— আলেয়ার মতো। কাউকে পেতে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হৃদয়ে জাগেনি, এমন মানুষ পৃথিবীতে বোধহয় একজনও নেই। কাউকে স্পর্শ করতে চাই, কারো সঙ্গে নিজের জীবন মিশিয়ে দিতে চাই, নিজের মনের আর্তিগুলো কারো কানে পৌঁছে দিতে চাই, কিন্তু কিছুতেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। গজল সংগীতের মূল নির্যাস এটাই। এই জন্য গজলের কথায়-সুরে মিশে থাকে একটা অসহায়তার অনুষঙ্গ, অপ্রাপ্তির রিনরিনে যন্ত্রণা।

গজলের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীর বেশ সাদৃশ্য আছে। বৈষ্ণব পদাবলী মূলত নারীর (শ্রীরাধিকার) বয়ানে লেখা, আর গজল পুরুষের বয়ানে (যদিও পরবর্তীকালে নারীরাও গজল লিখেছেন)। সেই গুলবদন কি বুঝতে পারছে না আমি কতটা বেদনা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছি? আমার অস্তিত্ব যে তাকে ছাড়া শূন্য মনে হয়, এটা সে বুঝতে পারছে না? ভিড়ের মাঝেও আমরা যখন একলা হয়ে যাই, এইসব প্রশ্ন যখন আমাদের জর্জরিত করে, ঠিক তখনই জগজিৎ সিং তাঁর জমজমাট কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন : শাম সে আঁখ মে নমি সি হ্যায়/ আজ ফির আপ কি কমি সি হ্যায়... (সন্ধ্যে থেকে চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার/ তুমি যে নেই এই কথাটা ফের মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার)।

যদি আত্মগত ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বুঝতে না-পারি, তাহলে বাউল গান অর্থহীন মনে হয়। যদি সমাজের ভন্ডামি, নোংরামি আর দুনিয়াদারির ধান্দাবাজির প্রতি তীব্র ক্রোধ এবং প্রতিবাদের আগুন না-জ্বলে বুকের ভিতর, তাহলে দ্রুতলয়ে গাওয়া হিপ-হপ সংগীতের মর্ম বোঝা সম্ভব নয়। যদি চেতনার অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অবস্থাকে উপলব্ধি করতে না-পারি, তাহলে ধ্রুপদী সংগীতকে নেহাতই অপ্রয়োজনীয় মনে হবে। যা-কিছু আমরা নিজেরা বুঝতে পারি না, তাকেই খারিজ করে দিতে চাই, কিংবা তাচ্ছিল্য করতে চাই।

গজল গানকেও অনেকেই বুঝতে ভুল করেন। কিংবা বুঝতে পারেন না। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু যারা গজল গান শুনতে ভালোবাসে, “তুমি কি মরীচিকা না ধ্রুবতারা?”— এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর যারা এখনও খুঁজে পায়নি, তাদের আশ্বাস দেওয়ার জন্য গুলাম আলি গেয়েছিলেন : ইয়ে বাতেঁ ঝুটি বাতেঁ হ্যায়, ইয়ে লোগো নে ফ্যায়লায়ি হ্যায়/ তুম ইনশা জি কা নাম না লো, ক্যায়া ইনশা জি সৌদায়ি হ্যায়? (“অনেকে অনেকরকম হাবিজাবি কথা বাজারে ছড়িয়েছে, তুমি সেইসব কথায় কান দিও না/ তুমি ইনশা-কেও ভুল বুঝো না, ইনশার কথা কি অতই সস্তা নাকি?”— ইনশা হলো এই অসামান্য গানটির রচয়িতা, পুরো নাম ইবন-এ-ইনশা। গজল সংগীতের সামগ্রিক দর্শন এবং সংজ্ঞা নিরূপণের উদ্দেশ্যেই যেন আমার অত্যন্ত প্রিয় এই গানটি লিখেছিলেন ইনশা)।

কাওয়ালি, টপ্পা, ঠুমরি, খেয়াল, কীর্তন কিংবা ভজন— উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী সংগীতের এই চিরাচরিত শৈলীগুলির সঙ্গে গজলের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, গজল একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির গান। কোনো সমষ্টিগত কিংবা সামাজিক কিংবা ধর্মীয় কিংবা আনুষ্ঠানিক অনুষঙ্গ জড়িয়ে নেই এই গানের সঙ্গে। যদিও পেশাগত কারণে অনেকেই সমবেত শ্রোতাদের সামনে গজল পরিবেশন করেন, কিন্তু বৈশিষ্ট্যগতভাবে গজল বারোয়ারি গান নয়। একলা শ্রোতার গান। ফরিদা খানুম কিংবা ভূপিন্দার সিং কিংবা বেগম আখতার যখন গান করেন, শুধু আমারই জন্য করেন।

গজল গানের বিবিধ গোরখ্-ধান্দা (গোলমেলে ব্যাপার) নিয়ে অনেক তানাবানা (টালবাহানা) হলো, এবার তো বইটার ব্যাপারেও সামান্য কিছু গুফ্তাগু (কথাবার্তা) হওয়া দরকার। পঁয়ষট্টি জন গীতিকারের লেখা গজল গানের সংগ্রহ আছে এই বইতে। প্রত্যেকের দুটি করে প্রতিনিধিত্বমূলক গানকে চয়ন করা হয়েছে। পৃষ্ঠার বাঁ-দিকে আছে রোমান হরফে উর্দু ভাষায় লেখা গানটির লিরিক, এবং ডানদিকে সেই লিরিকের স্বচ্ছন্দ ইংরিজি অনুবাদ। প্রত্যেক গীতিকারের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও রয়েছে, যেটি অনেক অজ্ঞাত গীতিকারকে চিনতে সাহায্য করেছে। এছাড়াও লেখক বিশ্লেষণ করেছেন সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হওয়া গজল সংগীতের বিভিন্ন পর্যায় এবং আঙ্গিককে। মূল উর্দু থেকে গজলগুলি যিনি অনুবাদ করেছেন তাঁর একটি বিশেষ পরিচয় আছে। উর্দু সাহিত্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ওয়েবসাইটটির নাম rekhta.org, আনিসুর রহমান এই ওয়েবসাইটের একজন উপদেষ্টা।

সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ গজল লিখেছেন। রাজা মহারাজা থেকে শুরু করে পথের ভিখারি পর্যন্ত; পুরুষ এবং নারী উভয়েই। ষোড়শ শতাব্দী থেকে একেবারে আধুনিক যুগের গীতিকাররা রয়েছেন এই বইয়ের পৃষ্ঠায়। আমার মতো কোনো গজলপ্রেমী যদি এই বইটি হাতে নেয় তাহলে তার মনে হবে : “কোয়ি তাজা হাওয়া চলি হ্যায় কহি” (মনোরম একঝাঁক বাতাস যেন বয়ে গ্যালো কোথাও)। যদিও আমি বইটি কবিতার বইয়ের মতো পড়েছি, গান হিসেবে ততটা নয়। সাদা পৃষ্ঠায় সুরের পরশ নেই, শুধু খসখসে লিরিক আছে। তবু কখনও এমন মুহূর্ত আসে, পাকিস্তানের একজন নারী কবি আদা জাফারে-র লেখা একটি গজল যখন চোখে পড়ে। তখন সুর স্থির হয়ে যায়, ঠিক যেমন বৃষ্টি নামার আগে স্থির হয়ে যায় গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কদম গাছের ফুলগুলো। তারপর ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃষ্টি নামে। ভিজে যায় ফুলের রেণু। একসময় বৃষ্টি থামে। একটা অদৃশ্য সুরের তীব্র সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চরাচর জুড়ে।

না ঘুবার মে না গুলাব মে মুঝে দেখনামেরে দর্দ কে তব-ও তাব মে মুঝে দেখনা...ম্যায় না মিল সকু ভি তো ক্যায়া হুয়া কে ফাসানা হুঁন্যয়ি দাস্তান ন্যয়ে বাব মে মুঝে দেখনা... ওহি এক লমহা-ঈ দিড় থা কে রুকা রাহা মেরে রোজ-ও শব কে হিসাব মে মুঝে দেখনা...জো তড়প তুঝে কিসি আঈনে মে না মিল সকে তো ফির আঈনে কে জওয়াব মে মুঝে দেখনা...(ধুলোতেও না, গোলাপ ফুলেতেও না; আমাকে খুঁজো তুমি আমার এই জ্বলজ্যান্ত দুঃখগুলোর মাঝেআমাদের দুজনের গল্পটার মধ্যে তো আমি আর রইলাম না, তবু আমাকে খুঁজো তুমি নতুন কোনো গল্পের মাঝেসময় যেন থমকে গেছিল তোমাকে যেদিন দেখেছিলাম, কিন্তু আমাকে খুঁজো তুমি সদাচলমান দিন আর রাতের মাঝেআমার এই উদ্দীপ্ত যন্ত্রণাকে যদি দেখতে না পাও তোমার আয়নার প্রতিবিম্বে, তাহলে বরং আমাকেই খুঁজো তুমি সেই আয়নার মাঝে...)


বিষাদের বল্কলে লেখা আবছা অনুভূতিটির নামকরণ এখনও করেনি কেউ।