Ratings35
Average rating3.7
সফোক্লিস, অ্যাস্কাইলাস ও ইউরিপিদেস-শুধুমাত্র এই তিন প্রাচীন গ্রীক ট্র্যাজিক নাট্যকারেরই এক বা একাধিক নাটক প্রায় আড়াই হাজার বছরের ব্যবধানে সম্পূর্ণ অবস্থায় আজও টিকে রয়েছে। এঁরা তিনজনের প্রত্যেকেই গড়ে ৮০-৯০টি করে নাটক লিখে গেছেন; এগুলোর মাঝে সফোক্লিস ও অ্যাস্কাইলাসের ৭টি করে মোট ১৪টি, ও ইউরিপিদেস-এর ১৯টি-এই ৩৩টি নাটকই শুধু আজ আমরা পড়তে বা দেখতে পাই, বাকী সব সময়ের নির্বিকার থাবায় হারিয়ে গেছে। ইউরিপিদেস-এর টিকে যাওয়া ১৯টি নাটকের কালানুক্রমিক হিসেব করলে ‘মিদিয়া' ২য়; খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩১ সনে তিনি নাটকটি লেখেন।
বাবা-মা চেয়েছিলেন ইউরিপিদেস সেনাবাহিনীতে নাম লেখান, কিন্তু তাঁর মন ছিলো নাটক লেখায়। সমসাময়িক দুই পূর্বসুরী সফোক্লিস ও অ্যাস্কাইলাসের সাথে প্রায়ই তিনি প্রতিযোগীতায় নামতেন, যদিও ১ম, ২য় বা ৩য় স্থান অর্জন করে পুরষ্কৃত হয়েছেন মোটে ৭বার। মিদিয়া লিখে এমনই এক প্রতিযোগীতায় তিনি ৩য় হন। সেবারের প্রতিযোগীতা নাকি এতই তীব্র হয় যে ট্র্যাজেডি নাটকের সর্বেসর্বা গুরু যিনি, সেই সফোক্লিসও ২য় হন। ১ম স্থানটি জিতে নেন অ্যাস্কাইলাস-পুত্র ইউরিফোরিওন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অ্যাস্কাইলাসের যে ৭টি নাটক আজ আমাদের হাতে আছে, তাদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত প্রমিথিয়াস ব্যাউন্ড; আধুনিক গবেষণা বলছে এই নাটকটি খুব সম্ভব অ্যাস্কাইলাস আদৌ লেখেননি, লিখেছেন তাঁর পুত্র ইউরিফোরিওন। ইউরিপিডেস-এর একটি নাটক রেসাস-এর লেখকস্বত্ত্বা নিয়েও বিতর্ক আছে; যদি ইউরিপিদেস ও অ্যাস্কাইলাস সত্যিই রেসাস ও প্রমিথিয়াস ব্যাউন্ড না লিখে থাকেন, তাহলে আসলে ৩জন নয়, ৫ জন গ্রীক ট্র্যাজিক নাট্যকারের কাজ আমাদের হাতে আছে। যাকগে, এসব পণ্ডিতদের তর্ক-বিতর্কের বিষয়, এখানে আমাদের ভূমিকা শুধুই নির্বাক দর্শকের।
মিদিয়া মূলত প্রতিহিংসার নাটক। ইউরিপিদেস তাঁর অনেক নাটকই বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে লিখেছেন; মিদিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। পুরাণের মূল গল্পটি জানা না থাকলে আধুনিক পাঠক ইউরিপিদেস-এর নাটকটি পড়তে বা দেখতে গেলে কিছুটা হোঁচট খেতেই পারেন, তাই গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী মিদিয়ার আখ্যান সংক্ষিপ্ত পরিসরে এখানে আগে লিখে রাখছি, এরপর নাটকের ব্যখ্যা বিশ্লেষণ, কাটাছেঁড়া ইত্যাদির অভিনয় করা যাবেঃ
থেসালি'র রাজা এইসনকে (Aeson) তাঁর ক্ষমতালোভী সৎ ভাই (সৎ মা/বাবা/বোন/ভাই রা বরাবরই ‘অসৎ' হন, সন্দেহ কি?) পিলিয়াস সিংহাসন থেকে উৎখাত করেন এবং এইসনের সকল উত্তরসূরীদের তিনি নির্মমভাবে হত্যা করেন। এইসনের স্ত্রী আলসিমেদে গোপনে এক সন্তানের জন্ম দেন (জেসন) যাকে তিনি পিলিয়াসের চোখ এড়িয়ে কাইরন নামক এক সেন্টরের কাছে দীক্ষা নিতে পাচার করে দেন। পিলিয়াসের কাছে দৈববানী আসে, বাঁকা রাস্তায় ক্ষমতায় বসার জন্য একদিন তাঁর পতন হবে, আর সে পতন নিয়ে আসবে এমন এক লোক যার এক পায়ে জুতো নেই।
বহু বছর পর পিলিয়াস একদিন তাঁর রাজ্যে এক খেলার আয়োজন করেন যেখানে জেসন এসে হাজির হন। পিলিয়াসের টুর্নামেণ্টে আসার পথে আনাভারোস নদী পার হবার সময় জেসনের এক পায়ের জুতো হারিয়ে যায়; সে অবস্থাতেই জেসন বাকী রাস্তা পাড়ী দিয়ে পিলিয়াসের দুয়ারে আসেন। পিলিয়াস যখন বোঝেন এই জেসনই দৈববানীর সে লোক যে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করবে, তিনি জেসনকে এক কঠিন শর্ত দেনঃ জেসনকে কলকিস যেতে হবে এবং সেখান থেকে স্বর্ণালী মেষচর্ম (golden fleece) নিয়ে আসতে হবে। জেসন তাঁর দলবল (আর্গোনটস) নিয়ে এই অভিযানে বেরিয়ে পড়েন। মেষচর্মটি ছিলো কলকিসের রাজা এইতি (Aeetes)-এর দখলে, তিনি জেসনকে ফাঁদে ফেলার জন্য কঠিন এক ফন্দি আঁটেন, কিন্তু তাঁর এ প্রচেষ্টা মাঠে মারা যায়, কারণ এইতি'র কন্যা মিদিয়া জেসনের প্রেমে পড়েছেন।
মিদিয়া তন্ত্রমন্ত্রের সাধণা করতেন; তিনি জাদুবলে জেসনকে গোল্ডেন ফ্লিস পাইয়ে দেন এবং দু'জনে একসাথে কলকিস থেকে পালান। জেসনের জন্য গোল্ডেন ফ্লিস যোগাড় করার সময় মিদিয়া তাঁর আপন ভাইকে হত্যা করেন এবং সে মৃতদেহের বিভিন্ন টুকরো সমুদ্রপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেন যাতে সেগুলো এক এক করে কুড়িয়ে নিতে মিদিয়া ও জেসনের পেছন পেছন ধাওয়ারত এইতি'র দেরী হয়ে যায়। জেসন ও মিদিয়া জেসনের রাজ্য ইওলকাসে এসে পৌঁছান, কিন্তু রাজা পিলিয়াস সৎ-ভাতিজা জেসনকে আবারো ঠকান, তিনি সিংহাসন ছাড়বেন না বলে দেন। মিদিয়া তখন পিলিয়াসের তিন কন্যাকে ভুল বুঝিয়ে তাদের পিতৃহত্যায় প্ররোচনা দেন। পিলিয়াস মারা যান, কিন্তু জেসন-মিদিয়ার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে না। তাঁদের ইওলকাস থেকে বহিষ্কার করা হয়। জেসন, মিদিয়া এবং তাঁদের দুই পুত্র এবার এসে আশ্রয় নেন করিন্থে। এই করিন্থই হলো ইউরিপিদেস-এর মিদিয়ার অকুস্থল।
জেসন-মিদিয়ার আখ্যান থেকে আমরা দেখতে পাই, জেসনের জন্য মিদিয়ার ভালোবাসার কোন কমতি ছিলোনা; প্রেমের জন্য খুনাখুনিতে জড়াতে মিদিয়া মোটেই পিছপা হননি। এহেন মিদিয়ার বুকে শেল বিঁধে জেসন হঠাৎ না বলে কয়ে করিন্থের রাজা ক্রেওনের মেয়েকে বিয়ে করে বসেন। ক্ষোভে দুঃখে মিদিয়া যখন এ নিয়ে জেসনকে প্রশ্ন করেন এবং জেসনের প্রান বাঁচানোর জন্য কত বড় ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তা মনে করিয়ে দেন, জেসন পাল্টা খোঁটা দিয়ে মিদিয়াকে বলেনঃ
“
স্বীকার করি, তুই আমার জান বাঁচাইছস
মাগার লাভ কিন্তু তুই-ই বেশী পাইছস।
আবে, তুই তো হালায় আছিলি বস্তির মাইয়া
কই থিকা কই তরে আনছি, দ্যাখ একবার চায়া।
তর তো আছিলো না হালায় জন্মেরও ঠিক
বাপ-কাকার নাম জিগাইলে হেঁচকি তুলতি “হিঁক, হিঁক”।
বান্দীর থিকা রানী বানাইছি, ভুইলা য্যান না যাস
হিসাব রাখছস বে, কয় ট্যাকার খাওন তুই ডেইলী হান্দাস?
জেসনের এমন আচরণ মিদিয়া মেনে নিতে পারেননি। তিনি জাদুবলে প্রথমে জেসনের নববিবাহিত স্ত্রীকে হত্যা করেন, এরপর তাঁর নিজের দুই ছেলেকেও হত্যা করেন। এর সবই তাঁর ভালোবাসার জেসনকে শাস্তি দেবার জন্য। করিন্থবাসীকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে মিদিয়া এরপর তাঁর ড্রাগন-চালিত রথে চড়ে রাজা এইগাস (Aegus)এর রাজ্যে চলে যান। ইউরিপিদেস এখানেই তাঁর নাটকের যবনিকা টেনেছেন।
জনশ্রুতি আছে, মিদিয়ার ছেলেদের আসলে হত্যা করেছে করিন্থবাসী, কিন্তু ইউরিপিদেস করিন্থিয়ানদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে নাকি মিদিয়াকে আপন সন্তান হত্যার দোষে দোষী করেছেন। ইউরিপিদেস টাকা খেয়েছেন কি না, তার সত্য-মিথ্যা আড়াই হাজার বছর পর আজ আর নিরুপণ করা সম্ভব নয়, তবে দু'চারটি কথা এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। ইউরিপিদেস-এর নাটকে দেখা যায় জেসন মিদিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, নতুন বিয়েটি তিনি করছেন বাধ্য হয়ে, অর্থনৈতিক লাভের আশায়। করিন্থের রাজার মেয়েকে বিয়ে করে তাঁদের নিজেদের সংসারের যদি চাকা ঘোরানো যায়, মন্দ কী?
কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন, জেসন আসলে তাঁর ভয়াল চরিত্রের এই বিদেশী বউকে নিয়ে হাঁসফাঁস করছিলেন। ভালোবাসার জন্য কথায় কথায় যে বিনা প্রশ্নে রক্ত ঝরাতে পারে, তার প্রেমময় বন্ধন নাগপাশের মতনই লাগবার কথা। যে প্রেম লাগামহীন, যে প্রেম অতি অন্ধ, বোধবুদ্ধি ভুলিয়ে দেয় যে প্রেম, ইউরিপিদেস কি সে প্রেমের ব্যাপারেই সতর্ক করে দিলেন? সংসার জীবনে দু'বার দাগা খেয়েছিলেন ইউরিপিদেস; শেষমেষ নাকি তিনি সব ছেড়েছুড়ে এক গুহায় গিয়ে বসবাস করতেন, সেখানেই বিশাল এক গ্রন্থাগারও নাকি বানিয়েছিলেন। যা দেখতে হাঁসের মতো, ডাকে হাঁসের মতো... এই যুক্তিতে এগিয়ে কেউ যদি ইউরিপিদেসকে Loveguru মেনে মিদিয়া থেকে প্রেমের শিক্ষা নেন, মন্দ কী তাতে?
অনেকটা মিদিয়ার আদলেই সম্ভবত, হেনরিক ইবসেন ১৮৯১ সালে লিখেছিলেন তাঁর নাটক হেডা গ্যাবলার। ইবসেনের হেডা মিদিয়ার মতোই ‘নিউরোটিক' ও প্রতিহিংসাপরায়ণ; নিজের বা পরের ধ্বংস ডেকে আনতে এঁদের দু'জনের হাত কাঁপে না। মিদিয়া'র মতো মায়েদের সাথে আমাদের বেশ ভালোভাবেই পরিচয় আছে; এঁরা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য মিদিয়ার মতোই প্রচণ্ড আবেগে নিজেদের কোটি কোটি মানুষের মা বানিয়ে নেন, এরপর প্রয়োজন মতো মিদিয়ার মতোই এই সন্তানদের গলায় ছুরি চালিয়ে দেন। সবচেয়ে বড় মিলটা অন্য জায়গায়। খুন করবার পর আমাদের এই মা'রাও মিদিয়ার মতোই তাঁদের ড্রাগন-চালিত রথে চড়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান (গাজিয়াবাদ কি?)। তাঁরা তখন শুধুই এক একটি কিংবদন্তি।
ছবিঃ জারমান হার্নান্দেজ আমোরেস। সূত্রঃ উইকিপিডিয়া