The Postman Always Rings Twice

The Postman Always Rings Twice

1934 • 128 pages

Ratings35

Average rating3.7

15

নাভুক্তং ক্ষীয়তে কর্ম কল্প কোটি শতৈরপি।
অবশ্যমেব ভোক্তব্যং কৃতংকর্ম শুভাশুভম্‌”।।



হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত এই শ্লোকটির অর্থ হলো, কর্মফল ভোগ না করে মানুষের উপায় নেই, এমনকি যদি সে কর্মফল ভোগ করতে শতকোটি বারও জন্মাতে হয়। যত দিন/মাস/বছর/শতাব্দী/ সহস্রাব্দ অব্দি কর্মফল ভোগ শেষ না হচ্ছে, মোক্ষ বা মুক্তি কিছুতেই আসবে না। পুরাতন পাপ নাকি ব্লাড হাউন্ডের মতোই গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিকই খুঁজে বের করে ঘ্যাঁক করে কামড় বসিয়ে দেয়। যে নমস্য মুনি ঋষিরা বেদ রচনা করে গেছেন, তাঁদের মতে কর্মফল নাকি তিন প্রকারঃ সঞ্চিতা, প্রবর্ধ, আর ক্রীয়ামান (বা আগামী)। তাঁরা যা জানাচ্ছেন তা হলো, আমাদের সবার (আগের জন্মগুলোর) সামষ্টিক কর্মফল টিনের কৌটায় থরে থরে সঞ্চিত রাখা আছে দোকানের তাকে (তাকগুলো আমাদের যার যার নিজেদের নামে আলাদা করে রাখা আছে), কৌটোর মুখ যেহেতু সিলগালা, তাই ভেতরের মালমশলার এদিক ওদিক করা আর আমাদের হাতে নেই। আমরা যখন নতুন কোন মানবদেহে নতুন রূপে জন্মগ্রহণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসি, তখন তাকের ওপর সঞ্চিত কৌটোগুলোর একটি নিয়ে আসি। কৌটোর ভেতরে থাকা কর্মফলের যতটুকু আমরা আমাদের জীবদ্দশায় ভোগ করি, তা হলো প্রবর্ধ,আর বর্তমানের আমাদের যে কাজগুলোর ফল ভবিষ্যতে পাবো, সেগুলো ক্রীয়ামান বা আগামী। অর্থাৎ, আপনার অতীত (জন্মের) কাজগুলো নির্ধারণ করে দিচ্ছে কেমন হবে আপনার বর্তমান (জন্ম), আর আপনার বর্তমান (জন্মের) কাজ নির্ধারণ করে দিচ্ছে আপনার ভবিষ্যৎ (জন্ম)।

বেদের বয়ানকে বেদবাক্য মানলে আপনার যে কোন দূর্ঘটনা বা ব্যর্থতার দায় গত জন্মে আপনার খারাপ স্বত্ত্বাটির ওপর চাপাতে পারেন; তখন আপনি খারাপ ছিলেন বলে সে জন্মের কর্মফল এ জন্মে আপনার ব্যর্থতার মাধ্যমে পাচ্ছেন-এ ভেবে আপনার ক্ষতে অয়েন্টমেন্ট লাগাতে পারেন। মানুষ নিজেই যে তার “ভাগ্য” গড়ে নেয়, জন্মের বহু আগেই ঈশ্বরের সই করে দেওয়া চিত্রনাট্য অনুযায়ীই যে কেবল আমরা অভিনয় করে যাই না এমন একটি (নাস্তিক্যবাদী) প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত কেউ কেউ এই দর্শনটিতে খুঁজে পেতে পারেন। হিন্দু দর্শনের বৃহৎ ছাতাটির নিচে ঈশ্বরবাদীরা যেমন আছেন, তেমনি নাস্তিকেরাও আছেন, যাঁরা মনে করেন বেদ আদৌ ঈশ্বর লেখেননি, কারণ, লিখতে হলে হাত চাই, আর হাত থাকলেই সেখানে ঘা হবে, বাত হবে, হাড় ক্ষয় হবে, আর্থ্রাইটিস হয়ে আঙুল বেঁকে যাবে...ঈশ্বর সর্বশক্তিমান হলে তো এমন হবার কথা নয়! এখানে বলে রাখা ভালো, হিন্দু দর্শনের নাস্তিক্যবাদী এই শাখাটির জন্ম ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, বেদের ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতে। নাস্তিকেরা আবহমান কাল থেকেই সমাজের ব্রাত্য অংশ, অচ্ছুৎ এঁদের তাই যেকোন আলোচনাতেই পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায়। এ আলোচনাও তার খুব ব্যক্তিক্রম নয়! তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সবার কর্মফল যে কৌটায় কৌটায় তাকে সাজানো থাকে, সেই তাকগুলোর রক্ষণাবেক্ষণকারী ‘ম্যানেজার'টি কে? নাম অনুযায়ী কর্মফলের কৌটা লেবেলিং করেন কে? তিনিই কি ঈশ্বর? আমাদের গল্প যেহেতু আগাগোড়া পুরোটাই তিনি জানেন, তিনি কি আমাদের কোন বিপদের আগে ‘স্পয়লার অ্যালার্ট' কিংবা কোন সতর্কতাবাণী পাঠিয়ে সাবধান করে দেন?

মার্কিন থ্রিলার লেখক জেইমস এম কেইন ১৯৩৪ সালে তাঁর ক্রাইম নভেল দ্যা পোস্টম্যান অলওয়েজ রিংস টোয়াইস লিখে বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। মাত্র শ'দেড়েক পাতার দুরন্ত গতির এ থ্রিলারে রগরগে যৌন দৃশ্য আছে, পরকীয়া আছে, খুনের প্রচেষ্টা আছে, খুন আছে, আইনকে ফাঁকি দেবার ঘোরালো রাস্তা নেবার উদাহরণ আছে...অপরাধমূলক গল্পের প্রতিটি উপকরণ থাকা স্বত্ত্বেও একে আর দশটা সাধারণ থ্রিলার গল্পের কাতারে ফেলা যায় না। প্রায় ৯০ বছর আগে লেখা এ বই আজও সবুজ, আর সম্ভবত অন্য আর যেকোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে আরো বেশী মহান!

উপন্যাসের প্রথম পাতায়, প্রথম লাইনেই আমাদের পরিচয় ঘটে যায় গল্পের নায়ক (কিংবা খলনায়ক) ফ্র্যাঙ্কের সাথে। ভবঘুরে ফ্র্যাঙ্ক চেম্বার্সের বয়ানেই গোটা উপন্যাসটি লেখা। অজানা অচেনা নতুন এক শহরে বিনি পয়সার এক ট্রিপে চলে আসে ফ্র্যাঙ্ক। তার বয়ানে ক্রমশ পষ্ট হয়,আগে সে বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন অপকর্ম ঘটিয়ে অনেক জিলিপীর প্যাঁচ খেলিয়ে কোত্থাও সুস্থির না হয়ে উপন্যাসের অকুস্থল ক্যালিফোর্নিয়ার এই নতুন শহরে এসে পড়েছে। নতুন অ্যাডভেঞ্চারের সন্ধানে সদা তৎপর তার অভিজ্ঞ ইন্দ্রিয়গুলো। আবির্ভাবের সাথে সাথেই ফ্র্যাঙ্ক এই শহরের এক সরাইখানার মালিকের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলে। ফ্র্যাঙ্ক হয়তো কুশলাদি সেরে ফের বেরিয়েই পড়তো তার ভবঘুরে জীবন যাত্রায়, কিন্তু তার সাথে দেখা হয়ে যায় সরাইখানার মালিকের কমবয়েসী বউ কোরার। ফ্র্যাঙ্ক চোখ সরাতে পারেনা, সাথে সাথে শিশ্নটাও অবাধ্য হয়ে ওঠে। কোরার স্বামীর অধীনে সেই সরাইখানাতেই চাকরী নিয়ে থাকা শুরু করে দেয় ফ্র্যাঙ্ক। ওদিকে তেল চিটচিটে আধবুড়ো গ্রীক স্বামী নিক পাপাডাকিসের একঘেয়ে সংসার করে করে উদ্ধতযৌবনা কোরাও হাঁপিয়ে উঠেছে। ব্যাস...যজ্ঞাগ্নিতে ঘি ঢালা হয়ে গেলো!

ফ্র্যাঙ্ক আর কোরা খুব শিগগীরই প্রেমে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ছুতোয় নিককে বাইরে পাঠিয়ে প্রায়ই তারা উদ্দাম যৌনতায় মত্ত হয়। এভাবে চলতে চলতে একসময় তারা পরিকল্পনা করে নিককে খুন করে দূর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে পাকাপাকিভাবে দু'জন দু'জনার হবার। সাথে নিকের সম্পদ প্রাপ্তি তো আছেই। ঘটনাক্রমে তাদের পরিকল্পনা কেবল অর্ধেক বাস্তবায়িত হয়, অর্থাৎ, নিককে তারা ঘায়েল করতে পারে বটে, তবে জানে মেরে ফেলতে পারে না। জীবনের ওপর দিয়ে চলা এ আক্রমণে নিকের কিছুটা স্মৃতিভ্রংশ হয়। কোরা আর ফ্র্যাঙ্ক আবার নবোদ্যমে পরিকল্পনায় নামে। নিক কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর আবার হামলা চালায় তারা। এবার সফলতা আসে বটে, কিন্তু তারা জড়িয়ে যায় জটিল এক আইনী মারপ্যাঁচে। সেখান থেকেও অনেক ঝামেলা করে মুক্তি মেলে, কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক বা কোরা-কারোরই শেষরক্ষা আর হয় না। এতদিনের সকল অপকর্মের শাস্তি বুঝি এবার একবারে আষাঢ় মাসের বৃষ্টির মতই ঝপ করে নেমে আসে ওদের ওপর। শেষের অধ্যায়ে এসে বোঝা যায় পুরোটা গল্প ফ্র্যাঙ্ক জেলে বসে বলছে; কোরাকে হত্যার দায়ে সেখানে বন্দী সে। নিক পাপাডাকিসের হত্যা মামলায় প্রমাণের অভাবে পুলিশ ফ্র্যাঙ্ককে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো, অথচ কোরাকে খুন না করলেও ঘটনার প্রেক্ষিতে ফ্র্যাঙ্ককে খুনের আসামী বনে যেতে হয়। কর্মফলের সেই ঘেয়ো কুকুর অন্ধ হলেও গন্ধ শুঁকে ঠিকই কামড় দিয়ে বসে ফ্র্যাঙ্ককে।

পরিণতির ব্যাপারে উদাসীন, আপাতঃদৃষ্টিতে আগাগোড়া অসচ্চরিত্র, ভোগবাদী, কামুক, খুনী, জেলে বসে ফাঁসির আদেশের অপেক্ষায় থাকবার সময় পাঠককে উত্তম পুরুষে নিজের গল্প বলে যাওয়া-সচেতন পাঠক মাত্রেই মিলটা টের পাবেন। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, জেইমস এম কেইনের এই উপন্যাসটি পড়েই আলব্যার কাম্যু তাঁর দ্যা আউটসাইডার লেখেন, হুবহু একই ছকে। কাম্যু আর আউটসাইডার শব্দ দু'টি আজ সমার্থক হয়ে গেছে; এ বইটি তাঁকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম গুরুস্থানীয় ওস্তাদের আসনে বসিয়েছে। ওস্তাদেরও যে ওস্তাদ থাকে পোস্টম্যান আবারো তা মনে করিয়ে দিলো।

এ উপন্যাসে কোন পত্রবাহক নেই, দরজার বেলেও কেউ এখানে দু'বার করে আঙুল চাপে না। তাহলে কেন এমন নাম? উপন্যাসটি বের হবার পর কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন কেইন এ নাম রেখেছেন রুথ স্নাইডার নাম্নী এক আমেরিকান মহিলার ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ১৯২৭ সালে স্নাইডার (কোরার মতই) তাঁর প্রেমিককে নিয়ে স্বামীকে খুন করার ফন্দি আঁটেন। খুন করবার আগে স্নাইডার তাঁদের যৌথ জীবন বীমায় কিছু পরিবর্তন আনেন। এই পরিবর্তনগুলো যাতে স্বামী ধরতে না পারেন সেজন্য স্নাইডার তাঁদের ডাকপিয়নকে বলে রেখেছিলেন জীবন বীমা সংক্রান্ত কোন চিঠি এলে যেন দু'বার করে বেল চাপে, তাহলেই স্নাইডার বুঝে যাবেন, আর স্বামীর চোখ এড়িয়ে আড়ালে পরে সে চিঠি পিয়নের কাছ থেকে নিয়ে নেবেন।

এ ব্যখ্যাটি অনেকদিন জনপ্রিয় ছিলো, তবে উপন্যাসের নামকরণের মূল ব্যখ্যাটি কেইন স্বয়ং নিজেই দিয়েছেন যেটি আরো চমকপ্রদ। কেইনের “পোস্টম্যান” আসলে “ঈশ্বর” কিংবা নিয়তি। নিককে খুন করবার পরও প্রমাণের অভাবে ফ্র্যাঙ্ক যখন বেকসুর খালাশ পেয়ে যায়, তখনি ঈশ্বর “সতর্কতাবাণীস্বরূপ” পয়লাবার বেলটা চাপেন। বেপরোয়া ফ্র্যাঙ্কের মাঝে যখন কোন পরিবর্তন আসে না, তখনি বিরক্ত হয়ে ঈশ্বর “ধু-উ-রো শালা” বলে দুসরাবার বেলে আঙুল বসিয়ে দেন। একইভাবে, নিক যখন বলা নেই কওয়া নেই নিজের বাড়ীতেই গুরুতর আহত হয়, তখনও তিনি নিকের জন্য প্রথম বেলটা বাজান, কিন্তু বোকা নিকের মাথাতেই আসেনি তার আদরের বউ ফ্র্যাঙ্কের সাথে একাট্টা হয়ে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে। ফলাফল, আবারো “ধু-উ-রো শা-আ-লা”...

কাম্যু যে তাঁর আউটসাইডার সরাসরি পোস্টম্যান থেকেই বেশ অনেকখানি ছেপে দিয়েছেন সে তো জানতেই পেলাম। তবে প্লট, উপন্যাসের বয়ানভঙ্গি ইত্যাদি বাহ্যিক সব মিলের ব্যাপারটা নিতান্তই গৌণ। কাম্যু'র ম্যার্সো (Mersault), কেইনের ফ্র্যাঙ্ক, ইভান তুর্গেনেভের বাজারভ (ফাদারস অ্যান্ড সান্স), এবং মিখাইল লেরমন্তভের পেচোরিন (আ হিরো অফ আওয়ার টাইম)- এই ৪ জন নায়কই একে অপরের প্রতিভূ। চরম অস্তিত্ববাদী এই ৪ নায়ককে এক শব্দে বর্ণনা করতে গেলে বেশীরভাগ মানুষই হয়তো asshole-শব্দটি ব্যবহার করবেন। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, এই ৪ মহা মস্তান লেখক তাঁদের এই বইগুলো আমাদের জন্য সতর্কতাবাণী হিসেবে লিখে গেছেন, যেগুলোর সারকথাঃ সব যুগের, সব পরিস্থিতিরই একটি সীমারেখা থাকে, আপনি যতই দুর্বিনীত হন, যত বড় বেয়াদবই হন না কেন, আপনাকে আপনার সময়ের/ ভূখণ্ডের/ জাতির বেয়াদবীর সর্বোচ্চ সীমাটির মাপ জানতে হবে, তা নইলে কর্কশ কলিং বেলের বিচ্ছিরি ঘ্যাড়াং ঘ্যাড়াং আওয়াজটি দ্বিতীয়বার শোনা অনিবার্য

কর্মফলে যাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা হয়তো বলবেন, কৌটোয় যতখানি বেয়াদবী সঞ্চিত আছে, তার এদিক ওদিক করবার উপায় নেই, তাই এইসব সতর্কতাবাণী আমাদের কোন কাজে আসবে না। তাঁদের যাঁরা বিরোধী শিবির, সেই ইসলামিক বিশ্বাসের অনুসারীরা এক হাসিতেই বেদ-বেদান্ত আর কাম্যু-কেইন-লেরমন্তভদের উড়িয়ে দেবেন। তাঁরা বলবেন, ওপরওয়ালা যে দু'বার করে বেল চাপেন তা জানতে কি আর এত রকম বই পড়তে হয় নাকি? আমাদের এক বইতেই সব বলা আছেঃ

আর তিনি যদি মানুষকে তাঁদের সীমালঙ্ঘনের জন্য শাস্তি দিতেন তবে ভূপৃষ্ঠে কোন জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন তাঁদের সময় আসে তখন তাঁরা মুহুর্তকাল আগাতে বা পিছাতে পারেনা”, সূরা নাহল, ৬১
December 9, 2022Report this review