সমর সেনের কবিতা
সমর সেনের কবিতা
Ratings1
Average rating4
Reviews with the most likes.
১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত, মাত্র বারোবছর-ব্যাপী লেখা সমর সেনের কবিতার পরিচয় দেওয়ার জন্যে খুউব পুরাতন ক্লিশে হয়ে পচে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে এমন একটা শব্দ ব্যবহার করতে ইচ্ছে করছে : “আধুনিক”!
আরো একটা বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে ইচ্ছা করছে, যেটা খুব বেশিদিন হয়নি বাংলা শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করেছে, কিন্তু এখনই বুড়ো হয়ে গেছে : “স্মার্ট”।
সমর সেনের কবিতা শুরু হয়েছে বিষণ্ণ প্রেমিকের ইউনিফর্ম শরীরে চাপিয়ে। তাঁর প্রেম কখনোই বর্তমানের জ্যান্ত নরম স্পর্শে (এমনকি সেই স্পর্শের স্বপ্নেও) পুলকিত নয়। অতীতের ধুলোধূসরিত দ্বিপ্রাহরিক সরু পথরেখার মতো ম্লান।
অন্ধকারের মতো ভারি তোমার দুঃস্বপ্ন,তোমার দুঃস্বপ্ন অন্ধকারের মতো ভারি।
ভুলে-যাওয়া গন্ধের মতোকখনো তোমাকে মনে পড়ে।হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাসআর মেঘের কঠিন রেখায়আকাশের দীর্ঘশ্বাস লাগে।“নগরজীবনের ক্লান্তি”। এই কথাটা বারবার বলা হয়েছে সমর সেনের কবিতার পরিচয় দিতে গিয়ে। এই ক্লান্তি জীবনানন্দের ম্লান-চোখ-তুলে-তাকানো অসহায়তার ক্লান্তি নয়। এই ক্লান্তি আক্রোশে হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যুবক-কবির নতুন নতুন উপলব্ধিজাত নাগরিক ক্লান্তি।বর্তমানে মুক্তকচ্ছ, ভবিষ্যৎ হোঁচটে ভরা,মাঝে মাঝে মনে হয়,দুর্মুখ পৃথিবীকে পিছনে রেখেতোমাকে নিয়ে কোথাও সরে পড়ি।
মৃত্যু শুনেছি শেষ কথা নয়,কালস্রোতে ভেসে আসে নবীন জঞ্জাল,আবার সঙ্গোপনে ঘরে রহস্যভরে বিড়ি ধরেবালক বংশধর,তারো পরে টেরি কেটে কাব্য পড়েজানায় অমর প্রেম বখাটে যুবক।
সংসার খালি;দূর ছাই, কিছু ভালো লাগে না,সঙ্গীহীন বুড়ো ভাবে সন্ধ্যায় :সমাজ বদলেছে অনেক, নিরুপায়,নইলে হে হরি,এ বয়সে মন্দ লাগত না আর একটি কিশোরী।পরবর্তীকালে বামপন্থী “ফ্রন্টিয়ার” ম্যাগাজিনের কিংবদন্তিসম দাপুটে সম্পাদক হতে চলেছেন যিনি, সেই সমর সেনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটি কিভাবে ধীরে ধীরে রূপধারণ করছে, তার পরিচয়ও পাওয়া যায় এই বইয়ের অনেক কবিতায়। দেশ তখনও পরাধীন। পতপত করে উড়ছে দুর্ভিক্ষের কালো পতাকা। ক্রোধ নয়, প্রতিবাদ নয়, নিপাট তাচ্ছিল্য এসে জমাট বেঁধেছে কবির কলমে।দুকোটি ক্ষুধার অভিশাপসংহত বাঙলা দেশে।চোরে চোরে মাসতুতো ভাই,নিবিড় মিতালি মহাজন ও শকুনে।দুর্দিন রপ্তানি কিছুদিন বন্ধ করএদেশে, হে দেব ! ক্ষান্ত কর দাক্ষিণ্য দারুন।
ভবলীলা সাঙ্গ হলে সবাই সমান—বিহারের হিন্দু আর নোয়াখালির মুসলমাননোয়াখালির হিন্দু আর বিহারের মুসলমান।
বইয়ের একদম অন্তিম কবিতাটি সমর সেনের কাব্যদর্শনের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে। (কবিতার বইয়ের স্পয়লার হয়? হলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।)
শুনি না আর সমুদ্রের গান থেমেছে রক্তে ট্রামবাসের বেতাল স্পন্দন। ভুলে গেছি সাঁওতাল পরগনার লাল মাটি একদা দিগন্তে দেখা উদ্যত পাহাড়, বাইজীর আসরে শোনা বসন্তবাহার। ভুলে গেছি বাগবাজারী রকে আড্ডার মৌতাত, বালিগঞ্জের লপেটা চাল, আর ডালহাউসীর আর ক্লাইভ স্ট্রিটের হীরক প্রলাপ,ডকে জাহাজের বিদেশী ডাক। রোমান্টিক ব্যাধি আর রূপান্তরিত হয় না কবিতায়।যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে । বছর দশেক পরে যাব কাশীধামে ।।
এর পরে আর কোনোদিন কবিতা লেখেন নি তিনি।