Reviews with the most likes.
একরকম বিশ্লেষণ আছে যাকে বলা হয় কাটাছেঁড়া করা। আরেক রকম আছে যাকে বলা যায় : কোনো সুখাদ্যকে তারিয়ে তারিয়ে আস্বাদন করা। আলোচ্য বিষয় যেটাই হোক— মহাভারত কিংবা বরিস পাস্টেরনাক— বুদ্ধদেব বসুর বিশ্লেষণী প্রবন্ধগুলো পড়লে আমার মনে হয়, তিনি যেন আস্বাদনের তৃপ্তিকে অক্ষরের উপচারে পাঠকের হৃদয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন (খাদ্যের উপমা দিলাম কারণ আমি খেতে ভালোবাসি; নইলে অন্য যেকোনো উপমা ব্যবহার করা যেতে পারে— ফুলের সুগন্ধ কিংবা পাহাড়ি বাতাস!)
আর বিষয় যদি হয় “রবীন্দ্রনাথ”? তাহলে তো কথাই নেই! বুদ্ধদেবের প্রায় সমস্ত রচনাতে (তাঁর মৌলিক গল্প-উপন্যাসেও) রবীন্দ্রনাথের প্রগাঢ় উপস্থিতি। অথচ তাঁর এই রবীন্দ্রভক্তি অন্ধ নয়। রবীন্দ্রনাথকে তিনি আত্মস্থ করেছেন গবেষকের নির্মোহ দৃষ্টিতে। তাই বুদ্ধদেবের বিশ্লেষণকে আমি বিশেষ মূল্য দিই। বর্তমান বইটিতে তিনি রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক কাব্যদর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবং সেই আলোচনা, আহা, অতীব সুস্বাদু!
আমার ব্যক্তিগত জীবন, যাপিত যুগ এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে রবীন্দ্রকবিতা এবং তাঁর কাব্যশৈলীর যোজন-যোজন দূরত্ব। আমি কবিতা পড়া শিখেছি আধুনিক কবিতা পড়ে। তাই বুদ্ধদেবের মতো দিকনির্দেশকের সাহচর্য পাই বলেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রাসঙ্গিকতাকে উপলব্ধি করতে পারি। চিত্রকলায় পিকাসোর যেমন ছিল অপরিমেয় বৈচিত্র্য, রবীন্দ্রনাথ যেন কবিতার পিকাসো। কত যে ভিন্ন-ভিন্ন রীতি, কত যে বিচিত্র ছন্দশৈলী, কত যে বিবিধ পর্যায়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ— ভাবতে গেলে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে হয়।
যদিও এই আপাত-বিভিন্নতার মধ্যেও ছিল একটি অপ্রতিহত ধারাবাহিকতা। কোথায় যেন পড়েছিলাম : একজন কবি সারাজীবনব্যাপী প্রকৃত প্রস্তাবে একটিই কবিতা লেখেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এই কথাটি সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। কী ছিল তাঁর কাব্যসাধনার মূল অন্বিষ্ট? কে ছিল তাঁর সৃষ্টির উদ্দীপক (muse), তাঁর “বন্ধু”, জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে দাঁড়ায়ে থাকা তাঁর “পরান সখা”? কয়েকটি নির্বাচিত কবিতার নিবিষ্ট পাঠপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধদেব অন্বেষণ করেছেন রবীন্দ্রকবিতার সেই অবিচ্ছেদ্য ধ্রুবপদটি। এবং পাঠক হিসেবে আমাকে করেছেন সবিশেষ ঋদ্ধ।
এর বাইরেও বইটিতে রয়েছে আরো দুটি প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের “গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত আমার পড়া সবচেয়ে মনোজ্ঞ প্রবন্ধটির দেখা পেলাম এই বইতে, প্রবন্ধটির নাম “এপার-ওপার”। যারা এখনও গীতাঞ্জলি পড়েননি, কিংবা গীতাঞ্জলি পড়তে ভালোবাসেন, উভয়ের জন্যই প্রবন্ধটি অবশ্যপাঠ্য। দ্বিতীয় প্রসঙ্গটির বিষয়বস্তুও গীতাঞ্জলির সঙ্গে খানিকটা সম্পৃক্ত।
রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার জ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নোবেল কমিটির সম্পাদক তাঁর সরকারি মন্তব্যে লিখেছিলেন : “গ্যেটের পরবর্তী ইয়োরোপীয় কবিদের মধ্যে টেগোরের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এবং এই কবিকে কোনো আর্থিক পুরস্কার অর্পণ করাটাকে বলা যায় প্রায় অধর্মাচরণ, যেন আমরা দায়ুদের স্তোত্র বা সন্ত ফ্রান্সিসের গীতিকার জন্য অর্থমূল্য দিচ্ছি।” অথচ রবীন্দ্রনাথের সেই শিখরস্পর্শী কবিপ্রসিদ্ধি আজকের দিনে পশ্চিমি বিশ্বে প্রায় শূন্য। এই বিস্মৃতির কারণ কী?
কারণ খুঁজতে গিয়ে বুদ্ধদেব খতিয়ে দেখেছেন গীতাঞ্জলি অনুবাদের পিছনে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণাকে। বিচার করেছেন বাংলা থেকে ইংরিজিভাষায় তাঁর সেই অনুবাদকর্মের পদ্ধতিকে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি পশ্চিমি বিশ্বের তৎকালীন এবং সমকালীন মনোভাবের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন। এবং সবশেষে মন্তব্য করেছেন : “রবীন্দ্রনাথ জগতে অজ্ঞাত থাকার জন্য যে ক্ষতিটা হচ্ছে, সেটা জগতেরই, আমাদের নয়।”
একদম খাঁটি কথা! আর তাই তো বাঙালি হিসেবে, জীবনের শত দুর্ভোগ, অপমান, আনন্দ এবং শূন্যতার মাঝে আমি রবীন্দ্রনাথে খুঁজে পাই আমার একান্ত ব্যক্তিগত সংবেদকে। এবং তাঁরই লেখা ধার করে তাঁর প্রতি উচ্চারণ করতে পারি :
আমারে তুমি অশেষ করেছএমনি লীলা তব—ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।কত-যে গিরি কত-যে নদীতীরেবেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরেকাহারে তাহা কব?