Ratings10
Average rating4
জর্জ অরওয়েলের লেখা উপন্যাস পড়লে তাঁকে রূপক কিংবা প্রতীকী-ধাঁচের রচনার একজন ম্যাজিশিয়ান বলে মনে হয়। অ্যানিমেল ফার্মের চরিত্ররা যদি সত্যিকারের মানুষ হতো তাহলে গল্পটা এতটা জমতো না, এটা সব পাঠকই স্বীকার করবেন। অথচ তাঁর প্রবন্ধগুলোতে তিনি একদম উল্টো কায়দা অবলম্বন করেছেন। সেখানে তিনি নিপাট সোজাসাপ্টা। কোনোরকম ধানাইপানাই করেননি। লম্বা কাঠের হাতলওয়ালা একধরণের tool, যার একপ্রান্তে লোহার তৈরি চৌকো চ্যাপ্টা ব্লেড লাগানো থাকে— এরকম ত্যানা না-পেঁচিয়ে সরাসরি যন্ত্রটাকে “কোদাল” নামে ডেকেছেন।
এই ছোট্ট বইটির তিনটি প্রবন্ধেই তিনি “জাতীয়তাবাদ” (nationalism) নামক ধারণাকে অসম্ভব স্পষ্ট ভাষায় বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথম প্রবন্ধটি, “Notes on Nationalism”, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক মাসখানেক পরে প্রকাশিত হয়েছিলো। এর আগে দুবার পড়েছিলাম এই নাতিদীর্ঘ লেখাটি। প্রতিবারই চমৎকৃত হয়েছি অরওয়েলের পর্যবেক্ষণশক্তি এবং সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা দেখে। প্রতিবারই নিজের দেশ-কালের সঙ্গে মেলাতে পেরেছি তাঁর ৭৭ বছর “পুরোনো” চিন্তাকে। যুদ্ধের সময়ে জাতীয়তাবাদ প্রবল থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার দেশে যুদ্ধ কোথায়? তবু প্রায় হুবহু মিলে যায় অরওয়েলের বিশ্লেষণ!
প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি পাঠককে সাবধান করে দিয়েছেন যে, অনেকসময় সমার্থক অর্থে ব্যবহৃত হলেও, “জাতীয়তাবাদ” এবং “দেশভক্তি” (patriotism)— দুটো আলাদা বস্তু। দেশভক্তি একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস, যা কেউ কারো ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিতে পারেনা। নারী-পুরুষের পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার মতো। থাকলে থাকবে, না-থাকলে নেই। জাতীয়তাবাদ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জোর করে (কিংবা চালাকি করে) চাপিয়ে দেওয়া হয়, অথবা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আর, কে না জানে, একমাত্র ভুয়ো মালপত্রই গায়ের জোরে বিক্রি করা হয়। মাল যদি খাঁটি হয়, মানুষ নিজের গরজেই সেটা কিনবে। আমার দেশ যদি সত্যিকারের “মহান” হয়, সেই খবরটা সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানোর প্রয়োজন হবে না!
তারপর অসাধারণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে অরওয়েল যেন আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে দিয়েছেন। একদম চাঁচাছোলা ভঙ্গিতে জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের উপর তাঁর পর্যবেক্ষণের ঝকঝকে আলো ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, একজন জাতীয়তাবাদী কখনই নিজের বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত হওয়া সহ্য করতে পারেনা। তার বিশ্বাসকে “সর্বশ্রেষ্ঠ” ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেনা। এর স্বপক্ষে যদি যথেষ্ট প্রমাণ না-থাকে, তাহলেও কুছ পরোয়া নেহি। এমনকি যদি তার বিশ্বাসের বস্তুটি খেলায় হেরে যায়, তাহলেও সে সেই ফলাফল মেনে নিতে পারেনা। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে ভাবে : “আচ্ছা বেশ, পরের বার দেখে নেবো তোদের!”
কিন্তু জাতীয়তাবাদের ফলাফল কখনই শুভ হয়না। আজ পর্যন্ত কখনও হয়নি। জাতীয়তাবাদ মানে শুধুই যে একটি দেশের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করা, এমনটা নয়। একজন জাতীয়তাবাদী একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি (ধরা যাক হিন্দু ধর্ম) কিংবা একটি রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি (ধরা যাক সেকিউলারিজম) কিংবা সামাজিক অবস্থানের প্রতি (ধরা যাক “শহুরে-শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত”) নিজের চেতনাকে সমর্পণ করতে পারেন। এমনকি তথাকথিত শান্তিবাদী (pacifist) কিংবা নাস্তিক্যবাদীরাও বেশিরভাগ সময়েই খাঁটি জাতীয়তাবাদীদের মতো আচরণ করে। অনেকসময় দেখা যায়, বাংলাভাষাকে “সম্মান” দেখাতে গিয়ে কতিপয় ভাষাপ্রেমিক ইংরিজি ভাষার প্রতি অহেতুক জাতীয়তাবাদী মুখ-ভ্যাংচানি প্রদর্শন করে ফেলছেন।
কিন্তু যেহেতু “জাতীয়তাবাদ” সবসময়ই আমাদের নিজেদের বিশ্বাসের দোষত্রুটিকে উপেক্ষা করতে পরামর্শ দ্যায়, এমনকি অস্বীকার করতে, এমনকি চেপে যেতে পরামর্শ দ্যায়, এমনকি প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে বিকৃত করতে পরামর্শ দ্যায়, মতের অমিল হলে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার পরামর্শ দ্যায়— তাই একজন জাতীয়তাবাদী সারাক্ষণ নেচে নেচে গাইতে থাকে : “আমরা ভাল লক্ষ্মী সবাই, তোমরা ভারি বিশ্রী/ তোমরা খাবে নিমের পাঁচন, আমরা খাব মিশ্রী। আমরা পাব খেলনা পুতুল, আমরা পাব চম্চম্/ তোমরা তো তা পাচ্ছ না কেউ, পেলেও পাবে কম কম।”
তিনটি প্রবন্ধই পাঠকের মনোযোগ এবং কিছুটা পূর্ব-ধারণা দাবি করে। দ্বিতীয় প্রবন্ধটি, “Anti-Semitism in Britain”— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইংল্যান্ডের সামাজিক/ রাজনৈতিক পরিবেশের কথা মাথায় রেখে লেখা হয়েছে, কিন্তু প্রবন্ধটি পড়লেই বোঝা যাবে, ব্রিটেনের জায়গায় আমার নিজের দেশের নাম এবং ইহুদিদের জায়গায় মুসলমান শব্দটি বসিয়ে নিলে পড়তে খুব বেশি অসুবিধে হয় না। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায়, ঠিক অরওয়েল যেমন অনেক “ভদ্রলোক”-এর মুখে গোটা ইহুদিজাতির প্রতি অহেতুক গালমন্দ শুনেছেন, আমিও তো এই কয়েকদিন আগেই বাজার করতে গিয়ে শুনেছি, পরিচিত সহ-বাজারকারী একজন কলেজ প্রফেসর (বিষয় অর্থনীতি), যিনি একজন শখের নাট্যকর্মীও বটে, সালমান রুশদির উপর আক্রমণের প্রতিবাদ জানিয়ে আমাকে অবলীলায় বললেন : “শালার মোল্লার জাত!”
“The Sporting Spirit” নামক তৃতীয় প্রবন্ধটিতে তিনি দেখিয়েছেন খেলার মাঠেও কিভাবে জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়ে। আমরা যারা ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ কিংবা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ফুটবল ম্যাচের উত্তেজনার আগুনে নিজেদের সেঁকতে সেঁকতে বড় হয়েছি, তাদের কাছে এই বিষয়টি নিয়ে আলাদা করে কথা বলার প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি প্রবন্ধেই অরওয়েল পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেছেন। নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছেন। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই, অন্ধ এবং অযৌক্তিক জাতীয়তাবাদের কিছু না কিছু বীজ লুকিয়ে আছে। কিংবা লুকোনো নেই, প্রকট হয়ে আছে! এর হাত থেকে নিস্তার নেই। কিন্তু অরওয়েল আমাদের বলেছেন, আমরা যেন নিজেদের কাছেই নিজেরা হার স্বীকার না-করি। নিজের ত্রুটিগুলোকে অন্তত নিজের কাছে যেন ধামাচাপা না-দিই। হাতের ময়লা পুরোপুরি পরিষ্কার করতে না পারলেও, হাতটা যে ময়লা হয়ে আছে, এটুকু দেখতে পারার দৃষ্টি যেন আমাদের থাকে। এই দুঃসময়ে, অন্তত এটুকু যেন থাকে।
It can be argued that no unbiased outlook is possible, that all creeds and causes involve the lies, follies and barbarities. I do not accept this argument.