The Origins of Power, Prosperity, and Poverty
Ratings51
Average rating3.7
নোবেল পুরস্কারের যে-দুটো ক্যাটেগরির দিকে প্রতিবছর আমার বেশি নজর থাকে তা হলো সাহিত্য এবং অর্থনীতি। এই বছর দুটো বিভাগের পুরস্কারই আমাকে হতাশ করেছে (যদিও, সাহিত্য বিভাগে হতাশার ব্যাপারটা আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে)। সাহিত্যে যিনি পুরস্কার পেয়েছেন, সেই হান কাং-এর মাত্র একটাই বই পড়েছি (“The Vegetarian”) এবং সেই বইটি ছিল গতবছর আমার পড়া সবচেয়ে ফালতু বই। কিন্তু অর্থনীতির পুরস্কারের খবরটা শুনে ঠিক হতাশ নই, হতভম্ব হয়েছি। মূলত দুটো কারণে।
প্রথম কারণটা সংক্ষেপে বলে দেওয়া যাবে। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় নতুন আবিষ্কৃত কিংবা আলোচিত কিংবা দিকনির্দেশিত কোনো তত্ত্বের জন্য। এই বছরের পুরস্কৃত তত্ত্বটির মূল বিষয়বস্তুকে বাংলায় একটা লাইনে লিখে ফেলা যায় : একটা দেশ কতটা উন্নতি করবে সেটা নির্ভর করে সেই দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি কতোটা স্বাধীনভাবে, সক্রিয়ভাবে ও মানবকল্যাণমূলকভাবে কাজ করতে সমর্থ হয়, তার উপরে। খুবই অভিনব এবং এক্কেবারে নতুন আবিষ্কৃত একটি তত্ত্ব, তাই না?
বইটা যখন পড়েছিলাম তখন এই তত্ত্বটিকে শুধু বস্তাপচা বলেই মনে হয়নি, মনে হয়েছিল তত্ত্বটি পুরোপুরি ঠিকও নয়। রাষ্ট্রের উন্নয়নের কারণ খোঁজার কাজটা বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। আধুনিক অর্থনীতি বলবে, এই অনুসন্ধানের সূচনা হয়েছিল অ্যাডাম স্মিথের জমানা থেকে। কিন্তু কারো যদি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ব্যাপারে মোটামুটি ধারণা থাকে, তিনি সময়টা আরো এক-হাজার বছর পিছিয়ে দিতে দ্বিধা করবেন না। একটু কমন সেন্স থাকলেই বোঝা যায়, রাষ্ট্রের উন্নয়নের পিছনে একটা-দুটো নয়, অনেকগুলো কারণ কাজ করে। এবং সবকটা কারণকেই যে অর্থনৈতিক হতে হবে এমনটা মোটেই নয়।
এই বইটিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটার নাম extractive, যারা রাষ্ট্রের অল্পকিছু ধান্দাবাজ মানুষের জন্য কাজ করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে শোষণ করে। আরেকটার নাম inclusive, যারা গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করে এবং হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থের উদ্দেশ্যে নয়, বরং আমজনতার কথা ভেবে কাজ করে। এই একটিমাত্র অতিসরলীকৃত তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বইয়ের লেখকরা সাড়ে-চারশো-পৃষ্ঠাব্যাপী ক্রমাগত বকবক করে গেছেন (এবং অজস্র তথ্যকে “চেরি-পিকিং” করে গেছেন)। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য থেকে আধুনিক উত্তর-আমেরিকার অর্থনৈতিক উন্নতির অজস্র উদাহরণ দেখিয়েছেন। এবং বলতে চেয়েছেন, নৃতাত্ত্বিক কিংবা ভৌগোলিক কিংবা ঐতিহাসিক কোনো কারণ নয়, একটি দেশের উন্নতির পিছনে তাঁদের এই extractive-inclusive তত্ত্বটিই প্রকৃত চালিকাশক্তি।
এই তত্ত্বের অন্যতম বড় ত্রুটি হিসেবে যেটা আমার মনে হয়েছে তা হলো, তত্ত্বটি আধুনিক “গ্লোবালাইজেশন” ধারণাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। এই তত্ত্বটি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকারিতার কথাই শুধু বলেছে। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে কোনো দেশের অস্তিত্ব কি স্বতন্ত্র থাকতে পারে? পৃথিবীকে এখন বলা হয় “গ্লোবাল ভিলেজ”। রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি, টেকনোলজি— এরকম বেশ কিছু জাল দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি কয়েকটি জনগোষ্ঠীর উন্নতি কিংবা অবনতির পিছনে কিছু ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টরটির নাম— “ইতিহাস” (কাশ্মীর কিংবা প্যালেস্টাইন কিংবা বসনিয়ার জনগণের কথা চিন্তা করুন)।
এবার এই বইটি থেকে একটি হাস্যকর উদ্ধৃতির উল্লেখ করি (যেরকম হাস্যকর উদ্ধৃতির অভাব নেই এই বইতে)। আমেরিকা ক্যানো মেক্সিকোর চেয়ে বড়লোক তার কারণ দর্শাতে গিয়ে লেখা হয়েছে :
“Unlike in Mexico, in the United States the citizens could keep politicians in check and get rid of ones who would use their offices to enrich themselves or create monopolies for their cronies.”
লেখকরা সম্ভবত হিরোশিমা-নাগাসাকি, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইরাক, লেবানন, আফগানিস্তান, গুয়ান্তানামো বে, গাজা-ওয়েস্ট ব্যাংক— এই অঞ্চলগুলির নাম শোনেননি। আমেরিকার ডিফেন্স মিনিস্ট্রি, ওয়েপন অ্যান্ড অ্যামিউনিশন ইন্ডাস্ট্রি কিংবা মর্গেজ ইন্ডাস্ট্রির কর্মপদ্ধতির ব্যাপারেও বোধহয় তাঁরা একেবারেই অজ্ঞ। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশের আভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে যে অনেক গরীব দেশের মানুষ পরোক্ষভাবে অত্যাচারিত এবং বঞ্চিত হয় (ঊনবিংশ শতকের ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আখ চাষী কিংবা বর্তমান শতকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কর্মীদের কথা চিন্তা করুন)— এই বহুল-আলোচিত বিষয়টিও তাঁরা বেমালুম চেপে গেছেন। তাঁরা উন্নত দেশগুলির উন্নয়নকামী বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেছেন, কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকার অঞ্চলগুলিকে মনে রাখেননি (অথবা রাখতে চাননি, নিজেদের “অভিনব” তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে)।
সবচেয়ে আশ্চর্য কথা হলো, তাঁরা ভারত এবং চিন নামক দুটি বৃহৎ দেশের জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নিজেদের তত্ত্বের ভিতর ঢোকাতে ভুলে গেছেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি মানেই যে মানবিক সমৃদ্ধি নয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকতে পারে, এমনকি একটি তথাকথিত উন্নত দেশের অগণিত মানুষ যে অভুক্ত কিংবা বাসস্থানহীন থাকতে পারে (ভারত কিংবা চিনের মতো উন্নয়নশীল দেশের কথা বাদ দিই, জার্মানির মতো উন্নত রাষ্ট্রেও ২০২৪ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রায় বাইশ হাজার শিশু সরাসরি রাস্তায় বসবাস করে), এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে এবারের নোবেল লরিয়েটরা আলোচনার উপযুক্ত বলেই মনে করেননি! বর্তমান পৃথিবীতে ভারতীয় কিংবা চৈনিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে অর্থনীতির কোনো আলোচনা কি চলতে পারে? এরকম সুবৃহৎ অর্থনীতি যে extractive-inclusive তত্ত্বের সরল রাস্তায় চলতে পারে না (উদাহরণ : ভারত), কিংবা এই রাস্তায় না-চলেও হাতেকলমে প্রভূত রাষ্ট্রীয় সম্পদ সৃষ্টি হতে পারে (উদাহরণ : চিন কিংবা সৌদি আরব), কিংবা একটি রাষ্ট্রের inclusive-পৌষমাস যে অন্য রাষ্ট্রের extractive-সর্বনাশের কারণ হতে পারে (উদাহরণ : আমেরিকা-আফগানিস্তান), এইসব আলোচনা এই বইতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এই তো গ্যালো অর্থনীতির দিক দিয়ে এই তত্ত্বের কয়েকটি খামতি (আরো আছে, কিন্তু এখানে লেখার জায়গা নেই)। কিন্তু এই তত্ত্বের সবচেয়ে উন্নাসিক ত্রুটিটি কিন্তু অর্থনীতি-সম্পর্কিত নয়। একটি রাষ্ট্রের উন্নতির পিছনে রাষ্ট্রটির ভৌগোলিক অবস্থান, পররাষ্ট্রগত জটিলতা, ঐতিহাসিক বাধা-বিপত্তি, কিংবা পরিবেশ/জলবায়ুগত ভূমিকা থাকতে পারে— এই বিষয়গুলো সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। ১৪৯৮ সালে মশলার লোভে ভারতে এসেছিল ইয়োরোপীয় লুটেরা বণিকরা, তাদের সঙ্গে প্রবেশ করেছিল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ। দুশো বছর ধরে সেই ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্পদকে যথেচ্ছ লুণ্ঠন করেছিল। বিদায় নেওয়ার আগে সেই সাম্রাজ্যবাদীদের দুষ্টচক্রান্তে ভেঙে দুই টুকরো (পরবর্তীকালে তিন টুকরো) হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশ। টুকরো হওয়া তিনটে দেশের অর্থনীতি আজও বহন করছে সাম্রাজ্যবাদী অভিঘাতের ক্ষতচিহ্ন (২০২৩ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা বাবদ খরচ হয়েছিল প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা, অথচ স্বাস্থ্য বাবদ খরচ করা হয়েছিল মাত্র ৯০ হাজার কোটি টাকা— ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কোনটা বেশি প্রয়োজন? দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নাকি গোলাবারুদ?) বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের পিছনে রয়েছে ভারতের বেশ কিছু পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ। আবার ভারতের হস্তক্ষেপের পিছনে খুঁজলে পাওয়া যাবে পাকিস্তানের সঙ্গে (সুতরাং চিনের সঙ্গেও) তাদের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের যোগসূত্র।
উপরে উল্লিখিত উপমহাদেশীয় ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের নোবেল লরিয়েটদের কাছে এবারে কয়েকটা প্রশ্ন করি : সাম্প্রতিক জুলাই আন্দোলনে শারীরিক আঘাতজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত একজন বাংলাদেশি ছাত্রের অন্ধকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতকে তাঁরা নিজেদের extractive-inclusive তত্ত্ব দিয়ে কীভাবে বিশ্লেষণ এবং সমাধান করবেন? প্যালেস্টাইনের মতো একটি অত্যাচারিত রাষ্ট্র আপনাদের এই তত্ত্বটি প্রয়োগ করে কীভাবে সুষমভাবে পরিচালনা করবে তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে? ভারতের মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানা রাজ্যের দুজন ছাত্রী— যাদের একজন ব্রাহ্মণ (যিনি মহারাষ্ট্রের) এবং আরেকজন দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত (যিনি হরিয়ানার)— বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দুজনের অ্যাকাডেমিক রেকর্ড যদি হুবহু একই হয়, ওহে নোবেল লরিয়েটগণ, আপনারা কি জানেন, তবুও তাদের একজনের ভবিষ্যত হতে পারে উজ্জ্বল এবং আরেকজনের নিকষ অন্ধকার? (যদি ভারতীয় উদাহরণ পছন্দ না হয় তাহলে আপনাদের উন্নত দেশ আমেরিকা থেকেও উদাহরণ দিতে পারি)। এবং এই অন্ধকার কিংবা উজ্জ্বল হওয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই!
রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন নামক মারাত্মক জটিল সমীকরণটির একটি জলমেশানো ইউটোপিয়ান বিশ্লেষণকে এবারের নোবেল পদক দ্বারা পুরস্কৃত করা হয়েছে। ব্রাভো!