We don't have a description for this book yet. You can help out the author by adding a description.
Reviews with the most likes.
“সৎ-সাহিত্য” বলে একটা কথা আছে। যে সাহিত্য সৎ। যে সাহিত্যে ভান নেই। ভণিতা নেই। লোক-দেখানো ঢং নেই। যে সাহিত্যের চরিত্ররা জ্যান্ত। এই চরিত্ররা আমাদের পরিচিত হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। পরিচিত হোক বা অপরিচিত, কিন্তু একবারের জন্যেও লেখকের মনগড়া কৃত্রিম সৃষ্টি বলে ভ্রম হয়না। মাটির পৃথিবীতে শক্তপায়ে দাঁড়িয়ে আছে এরা। জীবন্ত। যে সাহিত্যের চরিত্ররা স্টেজে উঠে নাটকের ভাষায় কথা বলেনা। ভাষাও এদের জ্যান্ত। বাস্তব। দুপুর বারোটার রোদের মতো গায়ের চামড়ায় এদের মুখের ভাষার তাপস্পর্শ টের পাওয়া যায়। অথচ কেমন অবাক কান্ড, এই ভাষাটা আমার নিত্যদিনের ব্যবহার্য পরিচিত ভাষা নয়। গ্রাম্য আঞ্চলিক দুর্গম ভাষা। তবু এই ভাষা খাঁটি। খাঁটি এবং টগবগে। সদ্য হাঁড়িতে ধরা জিয়োল মাছের মতো টগবগে। এই হলো “সৎ-সাহিত্য”। আবু ইসহাকের লেখা “সূর্য-দীঘল বাড়ি” নিটোল নিখুঁত সৎ-সাহিত্যের একটি অনুপম নিদর্শন। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর অন্যতম। এই ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিধা নেই।
এই উপন্যাসে নায়ক নেই। নায়িকা আছে। জয়গুন নামের একজন অসামান্য নারী এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি একজন অশিক্ষিত কুসংস্কারতাড়িত দারিদ্র্যপীড়িত ধর্মভীরু গ্রাম্য মহিলা ; কিন্তু শহুরে শিক্ষিত আলোকিত আধুনিক মানুষদের চেয়ে তাঁর শিরদাঁড়া অনেক বেশি সপাট সোজা। দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী বাংলাদেশের হতকুচ্ছিত সমাজে জয়গুনের মতো নারীরা তাঁদের অমসৃণ লালিত্যহীন হাতে লক্ষ্মীর প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই পোড়ামুখো কীটদষ্ট সমাজটাকে উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন। আহা রে, সেই নারীর না ছিলো উদরে আহার, না ছিলো শরীরে একটা গোটা কাপড়, না ছিলো সামাজিক সম্মান, না ছিলো পারিবারিক সিকিউরিটি, না ছিলো ভবিষ্যতের আশা, না ছিলো মাথা গোঁজার ভদ্রস্থ একটা ঠাঁই। এমনকি যে-প্রদীপটা জ্বালিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, সে প্রদীপে ছিলো না একফোঁটা তেল। তবু তিনি নিভতে দেননি তাঁর প্রদীপের শিখা। তবু কতো উঁচু ছিল তাঁর শির! তাঁর বাড়ির পাশের বুড়ো তালগাছটার চেয়েও উঁচু। করুণায়, কাঠিন্যে, কর্তব্যনিষ্ঠায়, আত্মসম্মানবোধে, দীপ্ত এবং দৃপ্ত এই মানুষটি— অতল গহ্বরের মতো নিরুপায় দারিদ্র্য তাঁকে ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারেনি! তাঁর মাথা নিচু করাতে পারেনি।
সূর্য-দীঘল বাড়ির অপয়া অভিশপ্ত ছায়ায় ঢেকে যাক এই বাংলার পূত-পবিত্র সমাজের জীবাণুমুক্ত বিবেকপ্রতিমা। যে-প্রতিমার বহিরঙ্গ সুসংস্কৃত, সুসজ্জিত এবং সুষমামণ্ডিত, কিন্তু ভিতরটা খড়ের গাদা দিয়ে ঠাসা! জয়গুন, আপনাকে লাল নীল সবুজ গেরুয়া রঙের স্যালুট নয়। আমার তরফ থেকে আপনার জন্যে রইলো একটা মানুষ-রঙের স্যালুট!