শুরুতেই আপনি আমাকে পাগল ভাববেন না।শুরুতে পাগল ভাবলে আমার গল্পটা আপনি মন দিয়ে শুনবেন না।
একজন স্কিৎজোফ্রেনিক সাইকোপ্যাথের মনোলগের ভঙ্গিতে এমন একটা উপন্যাস যে লিখেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, অবশেষে এটা জেনে বেশ আশ্চর্য হয়েছি।
এই জটিল মানসিক ব্যাধির প্রায় নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। গল্পে কিছু নাটকীয়তা আছে; তবে এটাও ঠিক যে সাইকোপ্যাথদের মনের ভিতরে নাটকের তো সত্যিই অভাব নেই!
স্বভাবসিদ্ধ গতিময় ভাষায় এমন অভিনব একটি বিষয় নিয়ে লেখা চমৎকার উপন্যাসটি হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম স্মরণীয় সৃষ্টি হয়ে থাকবে আমার কাছে। খুবই চমকপ্রদ!
এখন যে দেশটির নাম জিম্বাবুয়ে, ১৯৮০ সালের আগে পর্যন্ত দেশটি “দক্ষিণ রোডেশিয়া” নামে পরিচিত ছিল (বিভূতিভূষণের “চাঁদের পাহাড়” উপন্যাসে এই নামটির উল্লেখ আছে)। এক দীর্ঘ অমানবিক অত্যাচারের অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে দুর্ভাগা এই দেশটির ইতিহাসের সঙ্গে (অতীত এবং সমসাময়িক— দুটোই)। স্থানীয় আফ্রিকান মানুষদের প্রতি ইয়োরোপীয় আগন্তুকদের অকথ্য শোষণের সেই কটু ইতিবৃত্তান্ত জীবন্ত হয়ে উঠেছে ডোরিস লেসিংয়ের এই অসামান্য উপন্যাসে।
What is madness, but a refuge, a retreating from the world?
শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক অপশাসনের বিশ্বস্ত বিবরণ নয়, উপন্যাসটি একই সঙ্গে মানুষের সঙ্গে মানুষের, মানুষের সঙ্গে সমাজের, এবং মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্কেরও একটি দুর্দান্ত খতিয়ান। সময়: গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক। কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন একজন ইয়োরোপীয় নারী, যিনি নিজের অভ্যস্ত নাগরিক জীবন ত্যাগ করে বিয়ে করেছিলেন একজন গ্রাম্য দরিদ্র কৃষককে।
এই নারীচরিত্রটির বিচিত্র জটিল অন্তর্দ্বন্দ্বের সামনে আমাকে দাঁড়াতে বাধ্য করেছেন ডোরিস লেসিং। উপন্যাসটি পড়ার সময় আগাগোড়া অস্বস্তির মুখোমুখি হয়েছি আমি, উশখুশ করেছি, কিন্তু লেখক আমাকে রেহাই দেননি। মানুষ কিংবা প্রকৃতির ব্যাপারে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণসম্পন্ন এই উপন্যাসটির অভিঘাত আমি সহজে মুছে ফেলতে পারবো না।
বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে ঢাকা এবং তীব্র দাবদাহে পুড়তে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকার এই অঞ্চলটিকে আমি চিনতাম না। এখানকার কৃষ্ণ-গাত্রবর্ণের মানুষদের চিনতাম না আমি। এই মানুষগুলোর সার্বক্ষণিক প্রভু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত শ্বেত-গাত্রবর্ণের ইয়োরোপীয় মানুষদের ব্যাপারে যদিও কিছুটা চেনাজানা ছিল (উপমহাদেশের কারই বা নেই?)। প্রকৃতি, মানুষ, সময় এবং সমাজের বহুমাত্রিক সম্পর্কের আয়তনকে পাঠকের অনুভূতির আয়নায় নিখুঁত স্পষ্টতায় প্রতিবিম্বিত করা— এর চেয়ে খুব বেশি দাবি সাহিত্যের প্রতি নেই আমার। উপন্যাসটি এই দাবি সর্বাংশে পূরণ করেছে।
‘Until one has some kind of professional relationship with books one does not discover how bad the majority of them are. In much more than nine cases out of ten the only objectively truthful criticism would be, “This book is worthless”...The best practice, it has always seemed to me, would be simply to ignore the great majority of books and to give very long reviews... to the few that seem to matter.'
Amen.
.
বই নিয়ে আমাদের প্রায় সবারই কমবেশি রোমান্টিকতা আছে। কেউ হয়তো কাগুজে বই পড়তে পছন্দ করেন, কেউ ইবুক, কেউ বা কাজের ফাঁকে অডিওবুক। একটা বই পড়ার পরে আমরা সেই বইটির বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিক নিয়ে চিন্তাভাবনা করি। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করি। গুডরিডসে/ফেসবুকে রিভিউ লিখে আমাদের ভালোলাগা/মন্দলাগার কথা আরো পাঁচজনকে জানাই। কেউ কেউ ইউটিউবে ভিডিও বানিয়ে বইটির ব্যাপারে কথা বলি। কিন্তু সবকিছুর বাইরে গিয়ে, শুধুমাত্র “বই” নামক বস্তুটিকে নিয়ে কতোটা চিন্তা করি? বইয়ের প্রচ্ছদ, কাগজ, হরফের রকমসকম, বাঁধাই, অলংকরণ— পাঠক হিসেবে আমাদের অবচেতনে এই বিষয়গুলো ঘোরাফেরা করে হয়তো, কিন্তু বইয়ের নির্মাণগত দিকটি নিয়ে আমরা প্রায় কেউই সচেতনভাবে চিন্তা করিনা।
কীভাবে তৈরি হয় একটা বই? একটা বইয়ের “বই” হয়ে ওঠার পিছনে সবটুকু দায় কি লেখকের? নাকি প্রকাশকও সেই দায়ের ভাগীদার? বইটি যিনি মুদ্রণ এবং বাঁধাই করলেন, তিনি ভাগীদার নন? বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো যিনি ডিজাইন করলেন? যিনি অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে প্রুফ সংশোধন করলেন? এমনকি, বইটি যিনি বিক্রি করলেন, তিনি?
একজন খ্যাতনামা প্রকাশক গ্রন্থনির্মাণকে বলেছিলেন “অদৃশ্য শিল্প”। বইতে ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলে সেগুলো আমাদের চোখে পড়ে এবং আমরা বিরক্ত হই (বেশি বিরক্ত হলে সোচ্চার হই)। কিন্তু ত্রুটির পরিমাণ যখন কম থাকে কিংবা বইটির পরিবেশনগত গুণমান যখন আমাদের পছন্দসই হয়, আমরা কিন্তু প্রায় কখনোই বলিনা, আহ, বইয়ের হরফগুলো দেখতে কী সুন্দর! বইয়ের কাগজের রংটা চোখের পক্ষে কী আরামদায়ক! পৃষ্ঠার লে-আউটটা কী চমৎকার! অথচ কেউ-না-কেউ যত্ন নিয়ে এইসব ভেবেছেন এবং তাঁর ভাবনাকে গ্রন্থটি নির্মাণের কাজে প্রয়োগ করেছেন। এটা জেনেও যে, তিনি তাঁর পরিশ্রমের কাঙ্ক্ষিত মর্যাদা পাবেন না। সেই জন্যই, গ্রন্থনির্মাণ একটি “অদৃশ্য শিল্প”।
যদিও অনেকেই কিন্তু “বই” নিয়ে ভাবছেন। মুদ্রণসৌষ্ঠবকে আরও পাঠকবান্ধব করার জন্য মাথা ঘামাচ্ছেন। নতুন নতুন টাইপফেস (আমরা যাকে খানিকটা ভুল করে “ফন্ট” নামে ডাকি) ডিজাইন করছেন। বইনির্মাণের সঙ্গে যুক্ত হাজারো খুঁটিনাটি বিষয়ে প্র্যাকটিকাল উদ্যম ব্যয় করছেন। এই বইটির লেখক তেমনই একজন মানুষ। বইয়ের ৩৮টি ছোট ছোট প্রবন্ধে তিনি পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন একটি অদৃশ্য দিগন্ত। যে-দিগন্তে আমরা প্রতিনিয়ত ঘুরেফিরে বেড়াই, অথচ চোখ মেলে তাকাই না।
বইটা পড়ে আমি প্রভূত আনন্দলাভ করেছি। এতোটাই যে, ইচ্ছে করেই একটানা পড়িনি, যাতে শেষ না হয়ে যায়। কত যে আকর্ষণীয় এবং অভিনব তথ্যে ভরপুর এই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো! একটা উদাহরণ দিই। “প্যানগ্রাম” কাকে বলে আমরা অনেকেই জানি। কোনো ভাষায় লেখা সাধারণত অর্থবহ এমন একটি বাক্য, যাতে সেই ভাষার বর্ণমালার যাবতীয় অক্ষরসমূহ স্থান পায়। ইংরিজি ভাষার সবচেয়ে পরিচিত প্যানগ্রামটি আমরা সবাই জানি :
The quick brown fox jumps over a lazy dog.
এই বাক্যটিতে A থেকে Z সবকটা অক্ষর আছে। কিন্তু বাংলা ভাষারও যে প্যানগ্রাম আছে তার ব্যাপারে আমি অন্তত এতোদিন কিছুই জানতাম না। এই বইতে উল্লেখিত দুটো বাংলা প্যানগ্রামের একটা :
বিষন্ন ঔদাসীন্যে ঊষাবৌদি বাংলা ভাষায় প্রচলিত ঈশপের নিখুঁত গল্পটির অর্ধেক বলতেই ঋতু ভুঁইঞা আর ঐন্দ্রিলা দারুণ হৈ হৈ করে উঠল— ওঃ, ব্যাস্, এবার থামো! বুঝেছি, বড্ডো পুরানো ঢঙের কেমন এক গল্প যার নীতিবাক্য হল— ‘মূঢ় আড়ম্বর ও আত্মশ্লাঘার ফল জীবনে বিঘ্ন ও বৃহৎ ক্ষতি'— তাই না, অ্যাঁ?
(প্যানগ্রামটি তৈরি করেছেন মনোজকুমার মিত্র)
“বই” নামক অতিপ্রিয় বস্তুটির হালহদিশ জানবার এমন বই বাংলা ভাষায় এখনও পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি। ইংরিজিতেও আছে কি? বাংলা হোক বা ইংরিজি, কারো জানা থাকলে দয়া করে আমাকে জানাবেন।
পুনশ্চ : প্রতিক্ষণ প্রকাশনীর বইয়ের গুণমান এমনিতেই সুরুচিসম্পন্ন হয়; কিন্তু বিষয়বস্তু এবং সৃজনশীল নির্মাণ— দু'দিক দিয়েই বইটি এত দুর্দান্ত, হাতে নিলে আর নামিয়ে রাখতে ইচ্ছে করেনা!
আবুল হাসানের নামই জানতাম না আজ থেকে বছর চারেক আগেও। দোষ আমার নয়। কোনো এক বিচিত্র উন্নত-নাসিকা-syndrome-জনিত কারণে, বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের ব্যাপারে আমাদের এই বঙ্গভূমে আলাপ আলোচনা হয় না। তবে সুখের কথা, এই বদভ্যাস ক্রমশ কমছে। যদিও এখনও বাংলাদেশের বইপত্র আমাদের এখানে সহজলভ্য নয়। গোটা কলেজ স্ট্রিট তল্লাশি করে আবুল হাসানের কবিতার বইয়ের অন্তত একপিস কপিও খুঁজে পাইনি।
অথচ মনের মধ্যে নিত্য আসা যাওয়া করে, এখান থেকে ওখান থেকে কুড়িয়ে পাওয়া, কয়েকটা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পঙক্তি। জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা! মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ আমাকে নেবেনা। আমি আমার ভালোবাসার স্বীকৃতি চাই, স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে স্বীকৃতি দে! ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও। এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া। অতটুকু চায়নি বালিকা!
মনের ভিতর আকুলিবিকুলি করে এই কবির কবিতা ছুঁয়ে দেখার জন্য। অবশেষে হারুন পাঠিয়েছিল আবুল হাসানের রচনা সমগ্র। সেই সমগ্র থেকে কবির প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইটি পড়েই ডাউন ট্রেনের মতো বৃষ্টি এসে জলডাকাতের মতো উৎপাত শুরু হয়ে গেছে আমার চেতনা জুড়ে! “রাজা যায় রাজা আসে” কাব্যগ্রন্থের পয়লা লাইনটি :
সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে, উজ্জ্বলতা ধরে আর্দ্র, মায়াবী করুণ এটা সেই পাথরের নাম নাকি?
কী আশ্চর্য, কবিতাটির নাম “আবুল হাসান”! কবির মতো আমাদের প্রত্যেকের নিজের প্রস্তরীভূত আত্মনামটিও তো সময়ের ঘষা লেগে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। আমরাও তো সেই নামটির অনিচ্ছুক দাস। আমরাও কি ভালোবেসেছিলাম কোনো যুবতীর বামহাতে পাঁচটি আঙুল?
তারপর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে বয়ে চলে স্মৃতি সত্তা ও ভবিষ্যতের অজস্র অনিকেত কোরাস। এক জায়গায় চোখে পড়ে আমার আরেকজন প্রিয় কবি শহীদ কাদরীকে উৎসর্গ করা একটি কবিতায় (“গাছগুলো”) যেন অতিপরিচিত এক ব্যক্তিগত দেয়াল লিখন :
আমরা যখোন শার্টের তলায়নিজস্ব গোপন ছুরি নিয়ে চলা ফেরা করিপ্রতিমুহূর্তের আয়নায় আত্মহত্যা করি আরপ্রতিমুহূর্তের অবিশ্বাসেএর ওর সাথে কথা বলি,সে মুহূর্তে ওরা বিলায় ওদের নিজস্ব সম্পদনির্বিশেষে চুপিচাপি
বিষাদের আমলকি-ছায়ায় বসে কবি আমাকে সরবরাহ করেছেন তাঁর গভীর গোপন দুঃখ। তাঁর বাবা, একজন ‘নিম্নমানের মানুষ', যাঁকে নাকি তাঁর মা বলতেন :
তুমি এই সমস্ত লোক দ্যাখোনা?ঘুস খাচ্ছে, জমি কিনছে, শনৈঃ শনৈঃ উপরে উঠছে,কত রকম ফন্দি আঁটছে কত রকম সুখে থাকছে,তুমি এসব লোক দ্যাখোনা?
আমি যেন মানস কর্ণে শুনতে পাই কবির নিচু গলায় উচ্চারিত, চামেলী হাতে সেই ব্যর্থ মানুষটি, তাঁর বাবার কথা। আবার পরের পৃষ্ঠাতেই সংকোচ ঝেড়ে ফেলে দৃপ্ত তিনি :
এই কবিতা তোমার মতো সমালোচকের ভুলশোষকের শাসনত্রাশন ভেঙে ফেলে, মুখের উপর থুথুড়ি দেয়ইচ্ছে হলেই শিল্প দেখায় রক্ত মাখায় এই কবিতা!
এমন অজস্র পঙক্তি নির্ভুল নিশানায় আমার চুলের কাছে ফেরার বাতাসের মতো স্পর্শ করে যায় আমাকে। আমিও সেদিনের ঝঞ্ঝাপীড়িত মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে কবির সঙ্গে গলা মিলিয়ে বিড়বিড় করি :
মেঘেরও রয়েছে কাজওকে ছুটি দাওওকে দিয়ে দাও ওর কালো আমব্রেলাটি,ফিরে যাক ও তার তল্লাটে!
তারপর আমার কব্জির নীল ডায়ালের তারার থেকে মুখ তুলে দেখতে পাই যেন খুব পরিচিত একটি দৃশ্যকুসুম :
তোমার কথার মতো নরম সবুজকেকগুলি পড়ে আছে একটি পিরিচেতোমার চোখের মতো কয়েকটি চামচ!তোমার হাসির মতো উড়ছে চাইনিজ পর্দা রেস্তোরাঁয়...
আবুল হাসানের এই নিবিড় এবং আত্মগত কবিতাগুলো পড়তে পড়তে, তাঁর শৈশব ও শিল্প, প্রেম ও প্রতিনির্জন, মেঘ ও ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মিসট্রেসের বৃত্তান্তগুলি পড়তে পড়তে, তাঁর মাতৃভূমির মতো অসহায় মা এবং বৃষ্টি চিহ্নিত ভালোবাসার ব্যক্তিগত পোশাকগুলির কথা পড়তে পড়তে, আমার দিকে জ্যোৎস্নাসিক্ত নির্জন সাইকেলের মৃদু ঘণ্টাধ্বনির মতো বারবার ফিরে ফিরে আসে একটি অনপেক্ষ দীর্ঘনিঃশ্বাস :
পাখি হয়ে যায় এ প্রাণ ঐ কুহেলী মাঠের প্রান্তরে হে দেবদূত!
আহা, কী অপূর্ব!!
.
রবীন্দ্রনাথ সবচেয়ে বেশি ‘এক্সপেরিমেন্ট' করেছিলেন বোধহয় তাঁর লেখা নাটকগুলি নিয়ে। প্রায় প্রতিটি নাটকের গঠনশৈলী গতানুগতিক নাট্যরীতির চেয়ে অন্যরকম। এর মধ্যে ‘রক্তকরবী' এবং ‘মুক্তধারা'-র নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হতে শোনা যায় প্রায়ই। দুটোই রূপক-আশ্রিত নাটক। যদিও ‘রক্তকরবী'-র ব্যঞ্জনা এবং ব্যাপ্তি অনেক বেশি গভীর।
‘মুক্তধারা' নাটকটিতে কোনো দৃশ্যবিভাগ নেই। হরেকরকম চরিত্ররা ক্রমাগত আসা-যাওয়া করে মঞ্চে, দৃশ্যের মাঝে কোনো বিরতি থাকেনা। ফলে পুরো নাটকে একটা নিরবচ্ছিন্ন flow লক্ষ্য করা যায়। নাটকের বিষয়বস্তু হলো, আধুনিক সমাজব্যবস্থায় যন্ত্র এবং কারিগরিবিদ্যার সাহায্যে মানুষের দ্বারা প্রকৃতিকে পোষ মানানোর (অপ)চেষ্টা এবং তার পরিণতি।
১৯২২ সালে রচিত এই নাটকটি আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। একটু বেশিই প্রাসঙ্গিক। নাটকের আখ্যানটি এরকম: একটি প্রাকৃতিক জলস্রোতের উপর বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাঁধটির কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, তবু কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। মানবিক চেতনার চেয়ে অর্থনৈতিক এবং ক্ষমতার স্বার্থই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কেউ কি এগিয়ে আসবেন সেই বন্দী জলধারাকে মুক্ত করে দিতে?
নাটকটি পড়ে বেশ ভালোই লেগেছে। নাটকের সংলাপ খুব জোরালো। তবে নাটকটিকে কেন জানি পূর্ণাঙ্গ বলে মনে হলো না। ক্লাইম্যাক্সও বড্ড তাড়াহুড়ো করে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। হয়তো মঞ্চায়িতরূপে দেখলে নাটকের বার্তাটি আরো বেশি অর্থবহ মনে হবে। কারণ অভিনয়েই তো নাটকের সার্থকতা। তবু বলবো, একশো বছর আগে লেখা নাটকে একেবারে সমসাময়িক ইস্যুর প্রতিফলন দেখে অবাক হয়েছি। দূরদর্শিতা বটে!
২৪ বছর বয়সী যে ছেলেটি সালমান রুশদিকে ছুরির আঘাতে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, সে নিশ্চয়ই রুশদিকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতো। কীভাবে গড়ে উঠেছিল এই ঘৃণা? ‘সেটানিক ভার্সেস' বইটির মাত্র ২টো পৃষ্ঠা পড়েছিল সে (হ্যাঁ দুটো, দুই, two— অধ্যায় নয়, পৃষ্ঠা)। এবং কিছু রুশদি-বিরোধী ইউটিউব ভিডিও দেখেছিল। ব্যাস, এই ছিল তার সম্বল।
এই জাতীয় দুর্বোধ্য ঘৃণা আজকের দুনিয়ায় খুবই সুলভ ঘটনা। যৎসামান্য তথ্যকে সম্বল করে এরকম অর্থহীন ঘৃণা কীভাবে গ্রাস করে একজন মানুষকে? আমি ভেবেছিলাম মূলত এই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার জন্য বইটি লেখা হয়েছে (বইটির সম্পূর্ণ শিরোনাম পড়েও তেমন ধারণা হয়েছিল)। কিন্তু রুশদি এই বিষয়ে নতুন কোনো চিন্তার দিগন্ত সংযোজন করতে পারেননি। উল্টে আমাকে চূড়ান্ত বিরক্তিকর কিছু সময় উপহার দিয়েছেন।
বইটির দুই-তৃতীয়াংশ জুড়ে রয়েছে ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহত হওয়ার পরে লেখকের বেঁচে ওঠার বৃত্তান্ত। অধ্যায়ের পর অধ্যায়, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা তিনি অতি গভীর মনোযোগ এবং উৎসাহের সঙ্গে লিখে রেখেছেন সেই জীবনদায়ী চিকিৎসাকাণ্ডের খুঁটিনাটি বিবরণ। সেই অসম্ভব বোরিং এবং অনিঃশেষ বর্ণনা পড়তে পড়তে, খুব অনুতাপের সঙ্গে স্বীকার করছি, মাঝে একবার আমার মনে হয়েছিল : এই বুড়ো মরলো না ক্যানো!
তবু সবকিছুই বৃথা যায়নি। ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবনা রয়েছে বইটিতে। এমনিতে রুশদির ননফিকশন গদ্য তো খুবই উপভোগ্য। জীবনে এত বিপর্যয় সত্ত্বেও তাঁর স্বকীয় সরসতা এখনও বজায় আছে। স্ট্রেস তাঁর সেন্স অব হিউমরকে পুরোপুরি গিলে খেতে পারেনি। জীবন, সমাজ, ঈশ্বর, ধর্ম, শিল্প, প্রেম, ব্যক্তিস্বাধীনতা, মৃত্যু, হিংসা, ক্ষমা, নিয়তি, আনন্দ— এইসব বিষয়ে তাঁর মতামত খুবই স্পষ্ট এবং বুদ্ধিদীপ্ত।
মুশকিলটা হল, সম্ভবত মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসার পরে স্বাভাবিক মানসিক স্থৈর্যের অভাবে, বইটি তিনি গুছিয়ে লিখে উঠতে পারেননি। (অন্তত আরো বছর-তিনেক পরে বইটি লেখা উচিত ছিল কি? ফতোয়া-পরবর্তী তাঁর নির্বাসিত গোপন জীবনের ব্যাপারে স্মৃতিচারণমূলক বইটি— “জোসেফ আন্তন”— তিনি লিখেছিলেন ঘটনার প্রায় ২২ বছর পরে)। তবু যাই হোক, খাপছাড়াভাবে হলেও, কিছু জরুরি কথা তিনি লিখেছেন, নিচে তেমন একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করলাম। আমার মনে হয়েছে, দৈর্ঘ্যে একটু বড়ো হলেও উদ্ধৃতিটি পুরোটা তুলে দেওয়া উচিত।
“The most important thing is that art challenges orthodoxy.“To reject or vilify art because it does that is to fail to understand its nature. Art sets the artist's passionate personal vision against the received ideas of its time. Art knows that received ideas are the enemies of art. Clichés are received ideas and so are ideologies, both those which depend on the sanction of invisible sky gods and those which do not. Without art, our ability to think, to see freshly, and to renew our world would wither and die.“Art is not a luxury. It stands at the essence of our humanity, and it asks for no special protection except the right to exist. “It accepts argument, criticism, even rejection. It does not accept violence. “And in the end, it outlasts those who oppress it. The poet Ovid was exiled by Augustus Caesar, but the poetry of Ovid has outlasted the Roman Empire. The poet Mandelstam's life was ruined by Joseph Stalin, but his poetry has outlasted the Soviet Union. The poet Lorca was murdered by the thugs of General Franco, but his art has outlasted the fascism of the Falange.”
উপন্যাসের ছদ্মবেশে যেন একটি থিসিস লিখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন চরিত্রকে যেন নিরীক্ষার উপাদান (‘study participant') হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিষয়বস্তু নির্মাণে কখনও প্রহসনের আশ্রয় নিয়েছেন, কখনও সেন্টিমেন্টের, কখনও নিজের সিদ্ধান্তে নিজেই যেন দ্বিধায় পড়ে গেছেন লেখক। মূল চরিত্র রাজকুমার আদৌ কোনো একক চরিত্র নয়, বরং মানুষের অনেকরকম চিন্তাভাবনা, চালচলন, বিকৃতি এবং বিপন্নতা নিয়ে গড়া একটি কম্পোজিট চরিত্র। আমাদের নিজেদের অনেক আচরণ এবং ব্যক্তিগত মতামতের মতোই রাজকুমারকে কখনও মনে হয় দুর্বোধ্য, কখনও কলুষিত, কখনও আপত্তিকর, কখনও আত্মবিশ্বাসী, আবার কখনও আত্মগ্লানিতে মুহ্যমান। রাজকুমার কাল্পনিক হয়েও জীবন্ত। দুর্বোধ্য হয়েও চাক্ষুষ। আমাদের সবার মতো। মানুষের মতো। দোষেগুণে দ্বিমাত্রিক নজরে তাকে বিচার করতে গেলে মস্ত ভুল হবে।
এই অদ্ভুত জটিল অথচ ভাবনার তীব্র খোরাক জোগানদায়ী উপন্যাসটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। চেতনা এবং বুদ্ধিবৃত্তির খুব গভীরে প্রবেশ করার সামর্থ্য না-থাকলে যার-তার দ্বারা এমন উপন্যাস লেখা কখনও সম্ভব নয়।
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ক্লান্তিহীন ছদ্ম-দার্শনিক বকবক, নাকি অপদার্থ নায়কের হাবভাব আর চালচলন— কোনটা বেশি বিরক্তিকর লাগলো জানি না। “শেষের কবিতা”-র কথা মনে পড়ে গেলো। সেই একইরকম অকর্মণ্য বুকনিবাজ “লাভার বয়” পুরুষ চরিত্র। সেই একইরকম প্রেমের মহিমা কীর্তন (সরি, কীর্তন নয়, হরিবোল সংকীর্তন!)। সেই একইরকম অসহ্য ন্যাকামি।
পড়া শেষ হয়েছে, বাঁচা গেছে!
মানিক বন্দোপাধ্যায়ের একদম শুরুর দিকের উপন্যাস এটি। পরের দিকে মানিক তাঁর উদ্ভাবিত নিজস্ব স্টাইলে মানুষের মনের দূরতম অন্দরমহলে গভীর সার্চলাইট ফেলে পর্যবেক্ষণ করতেন, কিংবা প্রচলিত বাংলা উপন্যাসের গঠন থেকে সরে এসে নিজের লেখাতে নিরীক্ষা আর নতুনত্ব নিয়ে আসতেন ; কিন্তু এই উপন্যাসে সেই ট্রেডমার্ক মানিক কিছুটা অনুপস্থিত। তবু একটা দিক দিয়ে এই উপন্যাস আমাকে ভাবিয়েছে, তা হলো মানিকের তীব্র তীক্ষ্ণ রিয়েলিজম।
জননী মানেই তো নিঃস্বার্থ, দরদী, ভালোবাসার অপার আশ্রয়— পৃথিবীর সব মা যেমন হয়ে থাকেন— সাহিত্যে! মানিক এইসব চিরাচরিত রোমান্টিসিজমকে নিজের সাহিত্যজীবনের শুরু থেকেই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। ‘জননী' উপন্যাসের শ্যামা নামের মুখ্য চরিত্রটি দোষে-গুণে, ক্রোধে-কান্নায়, লাজে-ভয়ে, স্বার্থপরতায়-স্বার্থহীনতায়, আহ্লাদে এবং অভিসম্পাতে, বুদ্ধি এবং নির্বুদ্ধিতায়, চালাকি এবং চতুরতায়, শোকে এবং সাবধানতায়— সব দিক দিয়ে একজন রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষ। নিছক সস্তা বাঙালি সেন্টিমেন্টের ধার ধারেননি মানিক। জীবনের শুরুতেই ঘোষণা করেছেন : আমি এসে গেছি পাঠক, আপনি মানসিকভাবে প্রস্তুত তো?
আধুনিক “ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যাওয়া” পাঠকদের কাছে ত্রিশের দশকে রচিত এই উপন্যাসের অনেক কিছুই আপত্তিকর মনে হবে। রমণীর অচ্ছেদ্য পতিপ্রেম (তা হোক-না সেই পতিদেব একজন মার্কামারা অপদার্থ এবং শারীরিক অত্যাচারকারী), কিংবা ভাগ্যের হাতে মেয়েদের অসহায় আত্মসমর্পণ, কিংবা সংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষের হৃদয়— এইসব দেখে অনেকে ভয়ানক অপমানিত বোধ করতে পারেন। কিন্তু সমাজ তো তখন এমনই ছিল (এখনও যেন কতো শুধরেছে!)। লেখকের কাজ “আদর্শ সমাজ”-এর রূপরেখা ফুটিয়ে তোলা নয়, সমাজে ঠিক যেমনটা দেখা যায় তেমনটা পাঠকের সামনে তুলে ধরা— উপন্যাসটি পড়ার সময় এটা ভুলে গেলে চলবে না। আমি মাঝেমাঝে ভুলে গিয়ে ভীষণ অপমানিত বোধ করছিলুম, তারপর আবার নিজেকে বোঝাচ্ছিলুম, চিল ব্রো, এটাই তো স্বাভাবিক চিত্র।
বহু বছর আগে পড়েছিলাম এই উপন্যাসটা। সেই অল্প বয়েসে কী যে বুঝেছিলাম কিছুই মনে নেই। এবার আবার পড়তে গিয়ে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অসামান্য চরিত্র-বিশ্লেষণ দেখে অবাক হলাম। কেমন অন্ধকার গোপন গহীন ফাঁকফোকরে পোকামাকড়ের সূক্ষ্ম নড়াচড়াও খুঁটিয়ে দেখবার নজর ছিল তাঁর! মানুষের মনের পোকামাকড়।
স্বতই বিমর্ষ হয়ে ভদ্রসাধারণচেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়েআরও বেশি কালো-কালো ছায়ালঙ্গরখানার অন্ন খেয়েমধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসাব ডিঙিয়েনর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠেনর্দমায় নেমে—ফুটপাথ থেকে দূর নিরুত্তর ফুটপাথে গিয়েনক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা মরে যেতে জানে।এরা সব এই পথে ওরা সব ওই পথে— তবুমধ্যবিত্তমদির জগতে আমরা বেদনাহীন— অন্তহীন বেদনার পথে।
“To wait. In our lives we know joy, anger, sorrow, and a hundred other emotions, but these emotions all together occupy a bare one per cent of our time. The remaining ninety-nine per cent is just living in waiting. I wait in momentary expectation, feeling as though my breasts are being crushed, for the sound in the corridor of the footsteps of happiness. Empty. Oh, life is too painful, the reality that confirms the universal belief that it is best not to be born.”
ঔপনিবেশিক ইয়োরোপের সবজান্তা ঐতিহাসিকরা দীর্ঘদিন যাবৎ একচক্ষু হরিণের মতো প্রাচীন গ্রিক সভ্যতাকে চিহ্নিত করতো সভ্য মানবসমাজের সূচনাবিন্দু হিসেবে। সেই হরিণদের আরেকটি চোখের ঠুলির নিচে চাপা দেওয়া ছিল চৈনিক সভ্যতা, আরব্য সভ্যতা এবং উপমহাদেশীয় সভ্যতার উৎকর্ষের কথা (পৃথিবীর আরো নানাবিধ প্রাচীন “ইন্ডিজেনাস” এবং প্রান্তিক অতি উন্নত সভ্যতাগুলোর কথা না হয় আপাতত বাদই দিলাম)। গ্রিক সভ্যতার পরে আরো প্রবল বেগে এলো রোমান সভ্যতা। প্রাচীন গ্রিক আর রোমান— এই দুটি সভ্যতা গোটা ইয়োরোপ মহাদেশের শৌর্য, বীর্য, চিন্তা, দর্শন, বিজ্ঞান এবং শিল্প-সাহিত্যের মাপকাঠি বেঁধে দিয়েছিল।
মহাপরাক্রমশালী সেই রোমান সভ্যতার পতন ঘটেছিল বড় মর্মান্তিকভাবে। এবং সেই পতনের পরে সমগ্র ইয়োরোপব্যাপী যে-অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল, টানা ১০টি শতাব্দী জুড়ে সেই মহাদেশ ডুবে ছিল এক অতল অনড় কুম্ভীপাকের গহ্বরে। ১০ শতাব্দী, মানে এক হাজার বছর (পঞ্চম থেকে পঞ্চদশ শতক)— বড় কম কথা নয়। মনুষ্যত্বহীনতার সেই থিকথিকে কাদা ঠেলে, পুনরায় জেগে উঠেছিল যে দেশটি তার নাম ইতালি। সেই দেশের তাসকেনি নামের একটি ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর প্রদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহরের নাম ফ্লোরেন্স। পৃথিবীর অল্প যে কয়েকটি শহরের নাম মানুষের পক্ষে কোনোদিন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়, ফ্লোরেন্স তার একটি। শুরু হলো ইয়োরোপীয় ইতিহাসের রেনেসাঁস পর্ব।
সেই রেনেসাঁস যুগকে বাংলা ভাষায় কাহিনি-আকারে পড়বো বলেই সদ্য প্রকাশিত এই বইটা কিনে ফেলেছিলাম। সদ্য প্রকাশ হওয়া ফিকশন বই আমি সচরাচর পড়ি না। কিন্তু এই বইটির ক্ষেত্রে নিয়মভঙ্গ করেছিলাম দুটো কারণে। একটি কারণের নাম লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। আরেকটি কারণের নাম মিকেলঅ্যাঞ্জেলো। ফরাসি “রেনেসাঁস” শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো পুনর্জাগরণ। মানে, হারিয়ে যাওয়া কোনো গৌরবকে পুনরায় জাগরিত করা। মানুষ নতুন কীর্তি গড়তে পারে, কিন্তু মাটির অনেক নিচে চাপা পড়ে যাওয়া গৌরবকে উদ্ধার করতে এমন মানুষের দরকার হয়, যাঁদের কাঁধ সাধারণের চেয়ে বেশি চওড়া। লিওনার্দো এবং মিকেলঅ্যাঞ্জেলো ছিলেন সেই গোত্রের মানুষ। এরকম দুজন অতিমানবকে ৪৩০ পৃষ্ঠায় মোটামুটি ঠিকঠাক ধরে ফেলা খুব কঠিন কাজ। আমাদের লেখক সেই কঠিন কাজটি করতে পারেননি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “সেই সময়” উপন্যাসের ব্লার্বে একটা কথা লেখা আছে, বইটির নায়ক কোনো মানুষ নয়, নায়ক হলো সময়। “সময়কে নায়ক” বানানোর এই ব্যাপারটা তারপর বাংলা সাহিত্যে একটা ক্লিশে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বহু চরিত্রের সমাবেশ ঘটলেই, কিংবা একাধিক শক্তিশালী চরিত্রের উপস্থিতি থাকলেই, লেখক “সময়” নামক বস্তুকে নায়ক বানিয়ে ফেলেন। এই বইয়ের মলাটের পিছনেও লেখা আছে, বইটি “খুঁজতে চেয়েছে সেই সময়কে”। কিন্তু সময় তো চলিষ্ণু একটি বস্তু, তাই তাকে খুঁজতে হলে সময়ের অগ্রপশ্চাৎকেও খুঁজতে হয়। ব্যাকগ্রাউন্ডকে যথার্থভাবে প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে চরিত্ররা অসহায় হয়ে উপন্যাসের পৃষ্ঠায় থমকে থমকে চলাফেরা করতে বাধ্য হয়। রেনেসাঁসের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা অধ্যায়কে ধরার জন্যে যে গভীরতার প্রয়োজন আছে, উপন্যাসটিতে সেই গভীরতার অভাব রয়েছে।
এই উপন্যাসে রেনেসাঁসের পশ্চাদপট হিসেবে প্রায় কিছুই দেখানো হয়নি। অন্ধকারময় মধ্যযুগের আঁধার কাটিয়ে ক্যানো ঘটেছিল এই নবজাগরণ? রেনেসাঁসের কুশীলব ছিলেন যাঁরা, কীসের তাড়নায় বিচ্ছুরিত হয়েছিল তাঁদের চোখধাঁধানো প্রতিভা? খামচা খামচাভাবে দুই-তিন জায়গায় উল্লেখ আছে বটে যে, এই সময়ে শিল্পের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয় ঘটেছিল— ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবার। কিন্তু এই পয়েন্টটা ইতালিয়ান রেনেসাঁসের ক্ষেত্রে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আরো বিশদে সম্পৃক্ত হওয়া উচিত ছিল। খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, অমিতপ্রতিভাধর লিওনার্দোকে একেবারেই যথাযথভাবে আঁকতে পারেননি লেখক (মিকেলঅ্যাঞ্জেলোকে তবু কিছুটা পেরেছেন)।
উল্টে অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, লিওনার্দোকে “রক্তমাংসের” দেখাতে গিয়ে, মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর সঙ্গে তাঁর দ্বৈরথ দেখাতে গিয়ে, কেমন ভিলেন বানিয়ে ফেলা হয়েছে তাঁকে! তাঁর রত্নখনির মতো নোটবইগুলো, সময়ের থেকে অনেক অগ্রগামী তাঁর বিস্ময়কর চিন্তাভাবনা— এইসব নিয়ে প্রায় কিছুই বলা হয়নি। এবং সবচেয়ে আফসোসের কথা, লিওনার্দো এবং মিকেলঅ্যাঞ্জেলো— দুজনেরই শিল্পকর্মগুলো নিয়ে ব্যাখ্যামূলক আলোচনা থেকে বিরত থেকেছেন লেখক (কেবল আহা, বাহা, কী-অপূর্ব, কী-চমৎকার, এই জাতীয় জেনেরিক বিশেষণ ছাড়া)। শিল্প ছাড়া শিল্পীর কোনো অস্তিত্ব আছে? শিল্পটাই যদি ভালো করে না চিনলাম তাহলে শিল্পীর জীবন জেনে কী লাভ আমার? কী এমন শৈল্পিক বিশেষত্ব আছে মিকেলঅ্যাঞ্জেলোর তৈরি “ডেভিড” নামের ভাস্কর্যে যে এখনও সেটিকে সর্বকালের সবচেয়ে সেরা মার্বেল ভাস্কর্য হিসেবে গণ্য করা হয়?
তাহলে উৎসাহী আধুনিক পাঠক, যাঁরা বিভিন্ন ডকুমেন্টারি দেখে, কিংবা বই পড়ে, কিংবা ইন্টারনেট ঘেঁটে ইতিমধ্যেই জেনে ফেলেছেন রেনেসাঁসের ব্যাপারে অনেক তথ্য, তাঁরা এই বইটি ক্যানো পড়বেন? চেনা চরিত্রগুলোকে স্রেফ ফিকশনাল ভার্শন হিসেবে দেখবার প্রয়োজনে? অনেক সম্ভাবনা থাকলেও উপন্যাসটি একটি গড়পড়তা ঐতিহাসিক উপন্যাস হয়ে থাকবে আমার কাছে। আচ্ছা বেশ, তাহলে ভালো কিছুই নেই এই বইতে? আছে। দুটো খুব ভালো দিক আছে। এক, আজকালকার “গবেষণাধর্মী” (মানে খান-পঞ্চাশেক বইপত্র পড়ে প্লটের মালমশলা জোগাড় করা আরকি) উপন্যাসের মতো রাশি রাশি ইনফর্মেশনের আবর্জনা পাঠকের মাথায় উপুড় করে ঢেলে দেওয়া হয়নি এই বইটিতে। লেখক পড়াশুনা করেছেন বিস্তর, কিন্তু তাঁর সেই অধীত জ্ঞান জামার কলার তুলে সোল্লাসে প্রদর্শন করার চেষ্টা করেননি। দ্বিতীয় ভালো দিক, লেখকের চমৎকার মসৃণ গদ্য। বিষয়বস্তু মোটেও সহজ ছিল না, তবুও ৪৩০ পৃষ্ঠার বইটি অনায়াসে পড়ে ফেলতে পেরেছি। প্লটের গঠন খাপছাড়া মনে হলেও একটি বিষয়ে লেখক লেটার মার্কস পেয়ে উৎরে গেছেন, সেটি হলো তৎকালীন সমাজজীবনের পরিবেশ বর্ণনা। বইটি পড়ার সময় মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল, নিশ্চিত আমি সশরীরে পৌঁছে গেছি সেই যুগে।
আক্ষেপ সত্ত্বেও লেখককে আমি সাধুবাদ জানাবো এই বিষয়টি বেছে নেওয়া এবং নিজের সাধ্যমতো পরিবেশনের চেষ্টা করার জন্যে। হাবিজাবি বিষয়বস্তু অধ্যুষিত বর্তমান বাংলা সাহিত্যে এমন একটি অফবিট বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখার সাহস দেখিয়েছেন লেখক, এটা অনেক বড় কথা। উপন্যাসটির কাহিনি এখনও সমাপ্ত হয়নি। বইয়ের অন্যতম মুখ্য চরিত্র, মোনা লিসা, প্রায় নাগালের বাইরে রয়ে গেছেন বলা যায়। উপন্যাসের অন্তিমে লেখক পরবর্তী আরেকটি খণ্ড লেখার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। বর্তমান খণ্ডটি পড়ে পুরোপুরি তৃপ্তি পাইনি ঠিকই, তবুও পরের খণ্ডের জন্যে সাগ্রহে অপেক্ষা করবো আমি। শেষ একটি কথা না বললেই নয়। সুবিনয় দাস পরিকল্পিত প্রচ্ছদটি দারুন। তীব্র লাল বর্ণের জমিতে অধরা মাধুরীর মতো ফুটে উঠেছে দুটি বিশ্ববিখ্যাত শিল্পকর্ম। আবেদনে রহস্যময় অথচ অনুভবে প্রগাঢ়। এবং হৃদয়ের গভীরে রক্তাক্ত। বইটির প্রধান দুই চরিত্রের অন্তর্জগৎ ঠিক যেমনটা ছিল।
it's not
the
history
of countries
but the lives of men.
fables are dreams
not lies,
and
truth changes
as
men change,
and when
truth becomes stable
men
will
become dead.
(Charles Bukowski, “It's Not Who Lived Here”)
গুলজার আগে কবি, পরে গীতিকার। উপমা এবং রূপকের যে নিবিড় সৌকর্য তাঁর লেখা গানে পাওয়া যায়, তা শুধু একজন কবির পক্ষেই সম্ভব। আমাদের সবার জীবনের সঙ্গে খুব সম্পৃক্ত কোনো ঘটনাকে, যেমন ধরা যাক প্রেমে বিচ্ছেদ, তাকেও তিনি বাকি সব বিচ্ছেদের গানের চেয়ে অভিনব পঙক্তিতে লিখে ফেলতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে সবার আগে মাথায় আসে আমার ভীষণ প্রিয় একটা গান : “মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস পড়া হ্যায়”। আর ডি বর্মন-এর সুরে এবং আশা ভোঁসলের গাওয়া এই গানটির শুধু লিরিক পড়লে মনে হবে যেন লয়হীন সাদামাটা একটা বিবৃতি পড়ছি। কোনো ছন্দমিল নেই, বিচ্ছেদের গানসুলভ কোনো তীব্র আবেগ নেই। অথচ গানটি যখন আমরা শুনি, মনে হয় এই কথাগুলি আমার নিজের কথা, গুলজার জানলেন কীভাবে? হিন্দি সিনেমার গানে আধুনিক গদ্যকবিতা ব্যবহারের এরকম উৎকৃষ্ট উদাহরণ বিরল।
গুলজারের গানের আরেকটি উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গানের মধ্যে একটি লক্ষণীয় ক্যাচলাইন বা ক্যাচফ্রেজ ব্যবহার করা, যেটি গোটা গানজুড়ে ধুয়োর মতো ঘুরেফিরে আসে এবং এই লাইনটি দিয়েই শ্রোতা গানটিকে চিহ্নিত করেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উদাহরণ : ছাঁইয়া ছাঁইয়া, বিড়ি জ্বালাই লে, কাজরা রে, ধান তে নান (“কামিনে” সিনেমার গান), ইত্যাদি। যদিও যে-গানটি লেখার জন্যে তাঁকে অস্কার দেওয়া হয়েছে (“স্লামডগ মিলিয়নেয়ার” সিনেমার “জয় হো”), সেটা আমার একেবারেই পছন্দ নয়। গুলজারের এই ক্যাচলাইন বৈশিষ্ট্যটি যদিও তাঁর আগেকার গানে দেখা যায় না, এটি তাঁর নতুন উদ্ভাবন। যে বইটি নিয়ে আলোচনা করছি সেটা গুলজার এবং প্রখ্যাত হিন্দি সিনেমা অনুরাগী নাসরিন মুন্নি কবির-এর পারস্পরিক আলাপচারিতার লিখিত রূপ। আলাপের বিষয়বস্তু : গুলজারের লেখা গান এবং তাঁর কয়েকটি গানকে ইংরিজি ভাষায় রূপান্তরের প্রয়াস।
বইটি যতটা আশা নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম তা পুরোপুরি মেটেনি। মূলত তিনটে কারণে। প্রথম কারণটি নিতান্ত ব্যক্তিগত। আমি যেহেতু হিন্দি এবং উর্দু ভাষা বেশ ভালো বুঝতে পারি, তাই গানগুলোর ভাষান্তরিত রূপ আমার বিশেষ কাজে লাগেনি। মূল ভাষাতেই আমি গানগুলোর রসগ্রহণে সক্ষম। তাই এই ভাষান্তরের প্রক্রিয়াটি আমার কাছে প্রচণ্ড বিরক্তিকর লেগেছে। দ্বিতীয় কারণ, আলোচনা করার জন্যে গুলজারের অনেক মাঝারি এবং নিচুমানের গান বেছে নেওয়া হয়েছে (বিশেষ করে বইয়ের শেষ অর্ধে)। বেশ কয়েকটা গানের আমি নামই জানতাম না, শুনেও একেবারে পছন্দ হয়নি (যেমন রূপকুমার রাঠোরের গাওয়া “রোজ-এ-আওভল” নামের একটা গান। কী বুঝে এটাকে নেওয়া হয়েছে কে জানে। এরকম হাবিজাবি আরো আছে)। এগুলোর চেয়ে গুলজারের আলোচনাযোগ্য গানের সংখ্যা প্রচুর, সেগুলোকে বাদ দিয়ে অহেতুক এই পচা গানগুলো নিয়ে অনেক পৃষ্ঠা বরবাদ করা হলো ক্যানো বুঝলাম না।
তৃতীয় কারণটি হলো গুলজারের আদর্শবাদী কথাবার্তা। গুলজারকে আমি মুখ্যত কবি হিসেবেই মান্য করি, এবং কবিদের মুখে দেশদুনিয়ার ভালোমন্দ, দোষত্রুটি, কোনটা উচিত কাজ, কোনটা অনুচিত কাজ, এইসব নিয়ে ঘ্যানঘ্যান শুনলে ভালো লাগেনা। খবরের কাগজ খুললেও তো এই একই কথা পড়ি, হোয়াটসঅ্যাপের ফরোয়ার্ডেড মেসেজেও একই বক্তব্য, টিভির আলোচনাসভাতেও একই বকবক। গুলজারের মুখেও সেই ভাষণবাজি ভালো লাগেনি আমার। আমার কাছে কবিরা এসবের ঊর্ধ্বে। কবিরা কিছু বলতে চাইলেও আকারে-ইঙ্গিতে বলবেন, সরাসরি নয়। যেকোনো ভাষার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পরিবেশক হলেন কবিরা। এক জায়গায় দেখলাম গুলজার রীতিমত রেগে ফায়ার হয়ে গেছেন কারণ, ইন্টারনেটে প্রচুর নকল কবিতা তাঁর নাম লাগিয়ে সার্কুলেট করা হয় নিয়মিত। আমার মতো হরিদাস পাল যদি এইসব ফালতু বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতো তাহলে একটা কথা ছিল। কিন্তু গুলজার?
বইটার ভালো দিকই বেশি যদিও। পুরোনো দিনের হিন্দি গানের জগৎ নিয়ে প্রচুর প্রচুর কৌতূহলকর তথ্য জানতে পেরেছি। সংগীতরচনার কলাকৌশলের খুঁটিনাটি স্বয়ং অশ্বের গুলজারের মুখ থেকে শুনতে পারা তো কম সৌভাগ্যের কথা নয়! তাঁর মতো একজন সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ এখনও গান লিখে চলেছেন, এটা আমাদের প্রজন্মের জন্যে একটা আশীর্বাদ। আরো একটি কারণে গুলজারকে আমি পছন্দ করি। আমিও তাঁর মতো উর্দু ভাষাটিকে খুব ভালোবাসি। “দিল সে” সিনেমার “দিল সে রে” গানটিতে একটা লাইন আছে : উও ইয়ার হ্যায় জো খুশবু কি তারাহ্ উও জিসকি জুবাঁ উর্দু কি তারাহ্ (সেই বন্ধু আমার, যেন এক সুগন্ধের মতো যার উপস্থিতি, যেন উর্দু ভাষার মতো সুন্দর যার কথা বলার ভঙ্গি...)। আহা কী উপমা! তিনি আরো অনেক বছর এরকম গান লিখুন, এটাই কামনা! রিভিউয়ের শেষে আমার প্রিয় দশটা গুলজারি গানের একটা তালিকা দিলে কি খুব বেমানান লাগবে? :p :p
- আপ কি আঁখো মে কুছ (সিনেমার নাম “ঘর”)
- দিল ঢুন্ডতা হ্যায় (ধীর লয়ের ভার্শনটা, সিনেমার নাম “মৌসম”)
- না জিয়া লাগে না (“আনন্দ”)
- সিলি হাওয়া ছু গয়ি (“লিবাস”)
- এক আকেলা ইস শহর মে (“ঘরাওন্দা”)
- তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোয়ি (“আঁধি”)
- শাম সে আঁখ মে নমি সি হ্যায় (জগজিৎ সিংয়ের গাওয়া গজল, অ্যালবামের নাম “মারাসিম”)
- চুপকে সে (“সাথিয়া”)
- দিল তো বাচ্চা হ্যায় জি (“ইশকিয়া”)
- পেহলি বার মহব্বত (“কামিনে”)
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নন-ফিকশন গদ্য বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। এমন চমৎকার সুস্বাদু প্রবন্ধ লিখতেন তিনি, মনে হয় প্রবন্ধ পড়ছি না, জয়নগরের মোয়া খাচ্ছি। সংবাদ-প্রতিবেদনের মতো তাৎক্ষণিকতার দোষে দুষ্ট নয়, আবার কবিরা সচরাচর যেমন গদ্য লেখেন, সেই ললিত-লবঙ্গ-লতার প্রাদুর্ভাব নেই তাঁর গদ্যভাষায়। টানটান, ছিমছাম, নির্মেদ। শুনলে বিশ্বাসই হয় না, সুনীল নাকি গদ্যরচনা শুরু করেছিলেন নেহাতই বাধ্য হয়ে, গ্রাসাচ্ছাদনের উদ্দেশ্যে দুটো পয়সা অতিরিক্ত রোজগারের আশায়।
তিন চারটে ছদ্মনাম পকেটে ঢুকিয়ে এই মর্ত্যধাম ভ্রমণ করেছিলেন তিনি। বিখ্যাত সেই ছদ্মনামগুলির মধ্যে “সনাতন পাঠক” সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন কবি, কিন্তু স্রেফ কবিতা লিখে সংসার চালানো যায় না। তার জন্যে প্রচুর গদ্য লিখতে হয়। দু-হাত খুলে লেখালেখি করার উদ্দেশ্যে, পিতৃদত্ত নামের পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় গদ্য লেখার জন্যে আরেকটি অতিরিক্ত নাম সৃষ্টি করে নিতে হয়েছিল তাঁকে। সনাতন পাঠক ছদ্মনামে তিনি দেশ বিদেশের সাহিত্য-সংক্রান্ত খবরাখবর সরবরাহ করতেন পাঠকদের। বলতে দ্বিধা নেই— পঞ্চাশ, ষাট কিংবা সত্তরের দশকে কলকাতা শহরে বসে সমসাময়িক বিশ্বসাহিত্যের যে-বিপুল তথ্য তিনি বাঙালি পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছেন, আজকের এই “ইনফরমেশন ওভারলোড”-আক্রান্ত সাইবার-যুগেও, অন্তত বাংলা সাহিত্য-অঙ্গনে, ধারাবাহিকভাবে এই কাজ করতে আমি কাউকে দেখিনি, দেখছি না। সবাই কেবল সুললিত “ব্যক্তিগত গদ্য” লেখায় ব্যস্ত আজকাল। আর নয়তো দেশ-দুনিয়া-সমাজ-সময়-ধর্ম-অধর্মের মুণ্ডপাত!
অথচ সনাতন পাঠকের লেখা এই প্রবন্ধগুলি সুদীর্ঘকাল অপ্রকাশিত অবস্থায় আজকের অর্বাচীন পাঠকের চোখের আড়ালে পড়ে ��িল। ভাবতে অবাক লাগে! কতো হাবিজাবি সংকলন, সংগ্রহ, অমনিবাস কিংবা রচনাসমগ্র বেরোচ্ছে প্রায় প্রত্যেকদিন, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্বের সামগ্রিক একটি প্রবন্ধ-সংকলন আজও বেরোয়নি, তিনি লোকান্তরিত হওয়ার এক যুগ পরেও! এই কাজ কেবল বাঙালির মতো কর্মনিষ্ঠ তৎপর জাতির পক্ষেই সম্ভব।
তবুও ভাগ্যের কথা, এবারের কলকাতা বইমেলায় অবশেষে পুনরাবির্ভাব ঘটেছে সনাতন পাঠকের। আমার বহুদিনের একটা আশা পূরণ হয়েছে। যে-সুনীলের গদ্যের এত ভক্ত আমি, তাঁর শুরুর দিকের গদ্যের স্বাদ বহু চেষ্টাতেও নিতে পারিনি এতদিন। কেমন ছিল সেই সুনীলের লেখা, যখন তিনি কবিতার গণ্ডি পেরিয়ে সদ্য পা ফেলছেন গদ্যের নিঃসীম জগতে? শুরুর দিকের একটি রচনায় তিনি লিখেছেন : “আমি জীবনে কখনো গল্প লিখিনি, কখনো লেখার ক্ষীণতম ইচ্ছা বা দুঃসাহসও আমার নেই।” কী আশ্চর্য কথা! গল্প রচনায় নিতান্ত অনিচ্ছুক সেই যুবকের বিপুল পরিমাণ গদ্যের প্রতি কটাক্ষ করে পরবর্তীকালে কবীর সুমন গান লিখেছেন : “সুনীল গাঙ্গুলীর দিস্তে দিস্তে লেখা...” (গানের নাম “আমাদের জন্য”)। বাকি গদ্যের কথা বাদ দিলাম, তাঁর শুধু উপন্যাস-সমগ্রই এখনও পর্যন্ত বেরিয়েছে ১৫টা খণ্ড (এবং এখনও শেষ হয়নি, আরো বেরোবে)!
এই সংকলনে রয়েছে মোট ১২৪টি রচনা। বেশিরভাগই আকারে ছোট। যেগুলোর আকার বড়, সেগুলোও আড়াই পৃষ্ঠায় এঁটে গেছে। সাময়িক পত্রিকায় এর চেয়ে বেশি জায়গা পাওয়া মুশকিল। মূলত সমসাময়িক সাহিত্য জগৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে মাঝে মাঝে চলে এসেছে সমাজের কথা, রাজনীতির কথা, ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। পঞ্চাশের দশকে তিনি আমাদের জানাচ্ছেন এস্কিমোদের সাহিত্যের ব্যাপারে। ওড়িয়া সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। জেমস জয়েসের স্ত্রী কিংবা ফ্রাঞ্জ কাফকার প্রেমিকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিচ্ছেন। সদ্য প্রয়াত জীবনানন্দের মৃত্যুর “প্রকৃত” কারণ খোঁজার চেষ্টা করছেন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পরে নোবেল সংগঠনের সভাপতির ভাষণের উল্লেখ করেছেন, যেখানে সভাপতি মহাশয় লিখেছেন : “প্রফেট রবীন্দ্রনাথ কিছুদিনের জন্যে লেখা-টেখা ছেড়ে প্রাচীন ভারতীয় পদ্ধতিতে পবিত্র গঙ্গা নদীর বুকে একটা নৌকায় ধ্যানী তপস্বীর জীবন কাটিয়েছেন” (আসলে, পদ্মা নদীতে বজরা-ভ্রমণের ব্যাপারে লিখতে চেয়েছিলেন উনি। সভাপতি মশাই যদি জানতেন, সবচে সেরা প্রেমের গানগুলো নদীতে ভাসতে ভাসতেই লিখেছিলেন সেই ধ্যানী তপস্বী!)
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে অতি কষ্টে জোগাড় করা “কালবেলা” নামক সাহিত্যপত্রিকায় (যেখানে “একটিও ছাপার ভুল নেই, ভাষার ভুল নেই”) শামসুর রাহমান নামের একজন অপরিচিত কবির কবিতা পাঠ করে মুগ্ধ হচ্ছেন। হাসান আজিজুল হক নামের একজন নবাগত গল্পকারের “আত্মজা ও একটি করবী গাছ” গল্পটির “ডায়ালেক্ট ও তেজী সাহিত্যের ভাষার” নিপুণতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে মন্তব্য করছেন: “কালবেলা নয়, ওঁদের সাহিত্য এখন সন্ধিক্ষণের”। থিয়েটার প্রসঙ্গে জাঁ পল সার্ত্রে-র জরুরি মতামত অনুবাদ করছেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আপামর বাংলাভাষী মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি মর্মন্তুদ ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে একটি রচনায় সুনীল লিখছেন, “সাধু ভাষা থেকে চলতি ভাষায় উত্তরণ যেমন একটি বিরাট ঘটনা— তেমনভাবেই সৈয়দ মুজতবা আলী ভাষাকে আর এক ধাপ এগিয়ে দিলেন। তিনি দেখালেন যে, বিশ্বের যে-কোনো ভাষা থেকেই শব্দ নিয়ে আসায় কোনো ক্ষতি নেই— যদি ঠিক মতন ব্যবহার করা যায়”। আজকের ভাষা-নাৎসি এবং “কেবলমাত্র খাঁটি বাংলা ভাষা”-প্রেমী এবং অহেতুক উৎকট বাংলা প্রতিশব্দ/ পরিভাষা/ বিকল্প উদ্ভট বঙ্গশব্দ উৎপাদনকারীদের শ্রীচরণে এই উদ্ধৃতিটি বিনীত নিবেদন করলাম আমি। এরকম আরো কতো যে বিচিত্র ও কৌতূহলোদ্দীপক সাহিত্য-বিষয়ক সংবাদের রামধনু ছড়িয়ে আছে এই বইটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়!
বইটির শুরুর দিকে গদ্যের বাঁধুনি ছিল কিছুটা যেন আলগা। বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণে আবেগের পরিমাণ কিছুটা যেন অতিরিক্ত। ধীরে ধীরে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন লেখক। ধীরে ধীরে চোখের সামনে নির্মিত হচ্ছে একজন অসামান্য গদ্যকারের শক্তিশালী কলম। যে-কলম পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় মাতিয়ে রাখবে বাঙালি পাঠকের রসনাকে। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, বৈচিত্র্যে বিচ্ছুরিত, অথচ বৈদগ্ধ্যের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশে পারদর্শী— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নামক একজন অনবদ্য গদ্যশিল্পীর প্রারম্ভিক সাহিত্যভাবনার উপভোগ্য দলিল হয়ে থাকবে এই চমৎকার সংকলনটি। সুবিনয় দাস-এর আঁকা প্রচ্ছদটি বেশ সুচারু।
“পাকে-চক্রে লেখক হয়ে যাওয়ার পর এখন একটা অন্য স্বপ্ন প্রায়ই দেখি। আমরা ভাবি যে এই সময় বা এই যুগকে বদলে দেবার ক্ষমতা আছে আমাদেরই হাতে। এটা যে একেবারেই ভুল স্বপ্ন, তা মনেই পড়ে না!”
“কিছু কিছু বইকে চিরশান্তির বিশ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।”
স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আগেই মার্কেজ এই উপন্যাসটির বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছিলেন। কিছুটা অংশ লিখেছিলেন। প্রকাশ করেছিলেন এখানে সেখানে। কিন্তু তারপর তিনি ভুলে গেলেন উপন্যাসের পূর্ব-পরিকল্পিত সামগ্রিক প্লট। বারবার চেষ্টা করেও শেষ করতে পারলেন না লেখাটা। অবশেষে হাল ছেড়ে দিলেন। চেয়েছিলেন বইয়ের পাণ্ডুলিপিটা ধ্বংস করে ফেলা হোক। কিন্তু তাঁর সন্তানরা বাপের অন্তিম ইচ্ছের মর্যাদা রাখলে না। উল্টে বড়ো গলায় বললে, “ছেলেপিলের কাজই হলো বাপের কথা অগ্রাহ্য করা” (মন্তব্যটা বানিয়ে বলছি না, সূত্র: বইটির উইকিপিডিয়া এন্ট্রি)।
সদ্য প্রকাশিত হয়েছে অসম্পূর্ণ এই উপন্যাসটি। উপন্যাসের দৈর্ঘ্য নিতান্তই ছোটো। অসম্পূর্ণ হলেও গল্পের শেষ অংশে পরিপূর্ণতার একটা আভাস খুঁজে পেয়েছি। এভাবেও সমাপ্তি ভেবে নেওয়া যেতেই পারে। একজন মধ্যবয়সি নারীর গল্প, যিনি নিজের বহুগামী জীবনকে যাপন করতে গিয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলেন একটি চমকপ্রদ গোপন তথ্য। কাহিনির পটভূমি খুবই সাধারণ। অল্প কয়েকটি চরিত্র। মার্কেজের ম্যাজিকের চিহ্ন থাকলেও থাকতে পারে লেখাতে, তবে তা যৎসামান্য। তবু কী যেন একটা অনাস্বাদিত পিছুটান রয়েছে। অবশ্য, মার্কেজের লেখা পছন্দ করি বলে এটা আমার মনের ভুলও হতে পারে।
পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত একদম সাধারণ মানুষের প্রাণের গান হয়ে উঠতে পারেনি। পপ রক জ্যাজ ব্লুজ র্যাপ কান্ট্রি মেটাল (এবং আরো অনেককিছু) সমন্বিত পাশ্চাত্য সংগীতের যে আধুনিক ধারাটি এখন বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের কাছে পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, খুব টেনেটুনেও তার ইতিহাস দেড়শো বছরের বেশি পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এবং খাঁটি পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীতের সঙ্গে এইসব আধুনিক সংগীতধারাগুলির আত্মীয়তা খুঁজতে হলে খুব সরু স্রোত হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু সেই অন্বেষণ হবে খড়ের গাদায় আলপিন খোঁজার শামিল। পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত আজও তার স্বকীয় বনেদিয়ানা ধরে রাখতে পেরেছে। হাওয়াই চপ্পল, হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট পরে কেউ যদি বেঠোভেনের পিয়ানো কনচার্টোর অনুষ্ঠান শুনতে যায়, আজকের দিনেও তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে।
ভারতীয় উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী সংগীত কিন্তু এই বনেদিয়ানার তোয়াক্কা করেনি। উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী সংগীতবিশ্বের সমৃদ্ধির পিছনে সমাজের “এলিট” সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতার ভূমিকা আছে ঠিকই, কিন্তু তবুও আমাদের ধ্রুপদী সংগীতকারেরা কেবল এলিট শ্রোতাদের গান শুনিয়েই পরিতৃপ্ত হননি। রাগ সংগীতের কাঠামোকে আশ্রয় করেই তাঁরা নিজেদের সংগীতকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের গৃহ এবং মনের অন্দরমহলে। তাঁরা বাইজিনাচের সঙ্গে ঠুমরি গেয়েছেন, ফসলের ক্ষেতে কাজ করতে করতে কাজরি গেয়েছেন, আড্ডার বৈঠকে টপ্পা গেয়েছেন, ঘরোয়া আসরে গজল গেয়েছেন কিংবা ধর্মীয় জলসায় কাওয়ালি গেয়েছেন। একটা উদাহরণ দেখা যাক।
রাগসংগীতের “খামাজ” (বা খাম্বাজ) নামক একটি ঠাটের (ঠাট মানে প্রকরণ) কাঠামোতে তৈরি বিখ্যাত ঠুমরি গেয়েছেন বেগম আখতার (“অ্যায় মহব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া”)। সেই একই ঠাটের তিলক কামোদ রাগে বিখ্যাত ভজন গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর (“বৈষ্ণব জন তো”— মহাত্মা গান্ধীর প্রিয় গান))। খামাজের একতালে গান লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ (“আমি চিনি গো চিনি তোমারে”)। একই রাগকে আশ্রয় করে অসামান্য কাওয়ালি লিখেছেন নবাব সাদিক জং বাহাদুর (“কানহাইয়া, ইয়াদ হ্যায় কুছ ভি হামারি?”— ধর্মীয় সম্প্রীতির চমৎকার একটি উদাহরণ এই গানটি কেউ না শুনে থাকলে প্লিজ শুনুন!)। “অভিমান” সিনেমায় শচীন দেব বর্মনের সুরে ডুয়েট গেয়েছেন লতা-কিশোর (“তেরে মেরে মিলন কি ইয়ে র্যায়না”)। আবার এই তিলক কামোদ রাগেই উস্তাদ রশিদ খাঁ “জব উই মেট” সিনেমায় গান গেয়েছেন (“আওগে জব তুম মেরে সাজনা”)। স্মরণাতীত কাল আগে সৃষ্টি হওয়া একটি ধ্রুপদী রাগের প্রত্যক্ষ ব্যবহার, জনপ্রিয় সংগীত মাধ্যমে আজও হয়ে চলেছে অবিরাম! তলিয়ে ভেবে দেখতে গেলে এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটি অহরহ ঘটে চলেছে হিন্দি সিনেমায়। হিন্দি চলচ্চিত্র নিয়ে বেশ কিছুদিন যাবত গবেষণাধর্মী কাজ করে চলেছেন নাসরিন মুন্নি কবির। এই বইটি কবি, গীতিকার এবং চিত্রনাট্য লেখক জাভেদ আখতারের সঙ্গে মুন্নি কবিরের সুদীর্ঘ কথোপকথনের মুদ্রিত রূপ। হিন্দি সিনেমা এবং ফিল্মি গানের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য নিয়ে দুজনের এই আলোচনাটি পড়ে অত্যন্ত ঋদ্ধ হলাম। উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী ও লোকজ নাট্যকলা এবং সংগীতের উত্তরাধিকারের সর্বশেষ নমুনা হলো হিন্দি সিনেমা। জাভেদ আখতার বলেছেন, হিন্দি সিনেমার সত্তাটি “সর্বভারতীয়”, অথচ সমগ্র ভারতের কোনো অংশের সঙ্গে এর মিল নেই। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মতো “হিন্দি সিনেমা” হলো একটি আলাদা রাজ্য। জাভেদ আখতার খুব চমৎকার কথা বলতে পারেন। আমি হিন্দি সিনেমা খুব বেশি দেখিনা, কিন্তু হিন্দি ফিল্মের গানের ভীষণ বড় ভক্ত। আমার কাছে এই বইটি একটা আনন্দময় উপহারের মতো উপভোগ্য মনে হয়েছে।
জাভেদ আখতারের বাগ্মীতার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন নাসরিন মুন্নি কবির। সত্তরের দশকে মেইনস্ট্রিম হিন্দি সিনেমাজগতে একটা বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন সেলিম খান (সালমান খানের বাবা) এবং জাভেদ আখতার চিত্রনাট্যকার জুটি (“সেলিম-জাভেদ” নামে পরিচিত)। দুজনের লেখা চিত্রনাট্য থেকে তৈরি হয়েছে একের পর এক ছাঁচভাঙা সিনেমা (জঞ্জির, দিওয়ার, শোলে, ত্রিশূল, ডন, ইত্যাদি)। সুতরাং হিন্দি সিনেমা জগতের “ইউনিক” বৈশিষ্ট্য এবং হিন্দি সিনেমার উপযোগী চিত্রনাট্য লেখার কায়দা— এই দুই বিষয়েই কথা বলার উপযুক্ত মানুষ হলেন জাভেদ আখতার। পরবর্তীকালে চিত্রনাট্য লেখার কাজে ইস্তফা দিয়ে তিনি পুরোপুরি গান লেখার কাজ শুরু করেন। আমার ব্যক্তিগত মতে, হিন্দি ফিল্মের উর্দুভাষা-আশ্রিত গানের লিরিক লেখার মুনশিয়ানা এবং সত্তর দশক পরবর্তী আধুনিকতা— দুটো বিষয়কে সবচেয়ে সফলভাবে যদি কেউ মিশিয়ে দিতে পেরেছেন, তিনি হলেন জাভেদ আখতার।
বইতে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করেছি হিন্দি ফিল্মের গান নিয়ে তাঁর কথাবার্তা। কথায় কথায় তিনি বিশ্লেষণ করেছেন শাহির লুধিয়ানভি, শৈলেন্দ্র, শাকিল বদাউঁনি, মজরুহ সুলতানপুরি, কৈফি আজমির মতো নিজের পূর্বসূরিদের লেখা গান নিয়ে। একই সঙ্গে এমন কিছু কথা বলেছেন যা কিনা আমারও মনের কথা। যেমন, হিন্দি ফিল্মের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড সংগীত রচয়িতার নাম আনন্দ বকশি। কিংবা, ‘Cool' isn't the opposite of poetic. Somehow people have come to believe that one can either be modern or literary. ভিতরে ভিতরে জাভেদ আখতার আসলে একজন কবি। তবু তিনি বলেছেন, যে-কথা কোনোভাবে বলা যায় না, এমনকি কবিতাতেও বলা যায়না, সেই কথা গানের মাধ্যমে বলে ফেলা যায়। উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী রাগসংগীত এবং উর্দু ভাষার সাংস্কৃতিক বনেদিয়ানা— এই দুটো উৎকৃষ্ট জিনিসকে আমি একত্রে খুঁজে পাই হিন্দি ফিল্মের গানে। জাভেদ আখতারের প্রাণবন্ত আলাপচারিতায় ফিল্মের গানের প্রতি আমার চিরকালীন ভালোবাসা আরো একটু বেড়ে গেলো।
“Then I think of you in bed,
your tongue half chocolate, half ocean,
of the houses that you swing into,
of the steel wool hair on your head,
of your persistent hands and then
how we gnaw at the barrier because we are two.
How you come and take my blood cup
and link me together and take my brine.
We are bare. We are stripped to the bone
and we swim in tandem and go up and up
the river, the identical river called Mine
and we enter together. No one's alone.”
(EIGHTEEN DAYS WITHOUT YOU)
কবিতা বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্যের সত্যিকারের গর্ব করার মতো জিনিস যদি কিছু থাকে তা হল ছোটগল্প। সেই রবীন্দ্রনাথ আর প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু। তারপর বিভূতিভূষণ পরশুরাম সতীনাথ তারাশঙ্কর মানিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র প্রেমেন্দ্র মিত্র জগদীশ গুপ্ত গৌরকিশোর ঘোষ মতি নন্দী কমলকুমার হাসান আজিজুল হক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী আশাপূর্ণা মহাশ্বেতা সত্যজিৎ রায় রমাপদ চৌধুরী বিমল কর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হুমায়ূন আহমেদ শ্যামল গাঙ্গুলি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ইত্যাদি দিকপালদের (দিকপাল আরো অনেক আছেন অবশ্যই, এখানে শুধু আমার প্রিয়দের নামোল্লেখ করলাম) সৃষ্ট অজস্র মণিমুক্তো পেরিয়ে এসে আজকে বেশ জোরগলাতেই বলা যায় : ছোটগল্পের মতো এরকম বহুমুখী সমৃদ্ধ শাখা কি বাংলা সাহিত্যে আর কিছু আছে?
কিন্তু গত শতকের নব্বই দশকের পরে কী যে হলো, যেমনটা বোধহয় হলো বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই, বাংলার আঞ্চলিক নিজস্বতা এবং স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে আন্তর্জাতিকতার গড্ডলিকা-স্রোতে ভেসে গেলেন বেশিরভাগ সাহিত্যিক (“গড্ডল” শব্দের অর্থ ভেড়া। ভেড়ারা তাদের দলের একজন যেদিকে যায়, পিছে পিছে বাকি সবাই সেদিকেই যায়)। শীর্ষেন্দু সুচিত্রা দেবেশ স্বপ্নময়দের মতো কয়েকজন টিমটিম করে জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলেন খাঁটি বাংলা ছোটগল্পের চিরাচরিত ধারাটি ; কিন্তু নতুন শতাব্দীতে প্রবেশ করে “চিরাচরিত” কিংবা “ধ্রুপদী” শব্দগুলো গালিগালাজে পরিণত হল। আরো আরো আরো বেশি আধুনিকতার খোঁজে নেমে পড়লাম আমরা সবাই। লেখক পাঠক প্রকাশক সম্পাদক সমালোচক— সব্বাই! সরলরৈখিক ছাপোষা প্লটের দিন ফুরাইলো। বাংলা ভাষার দিশি আম্রবৃক্ষশাখে ঝুলতে লাগলো লাতিন আমেরিকার “পোস্ট-মডার্ন” ফল কিংবা পূর্ব ইয়োরোপের বিপ্লবী সুগন্ধে ভরপুর exotic ফল কিংবা জাপানি “বিজার” ফল কিংবা...
বিপদে পড়লো আমার মতো নির্বোধ নিপাট নিরীহ পাঠকরা। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত গল্পে আমরা নিরিবিলি প্লট খুঁজতে লাগলাম। একটা সোজাসাপটা এবং সাদামাটা (এই শব্দ দুটোও বর্তমানে গালিগালাজে পরিণত হয়েছে) গল্প খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু চারিদিকে দেখি শুধু ফর্মের নতুন নতুন কায়দা নিয়ে কচলাকচলি। ভাষার প্রচলিত আদবকে হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে নতুন রূপের সন্ধান চলছে। হৃদয় নয়, লেখকরা চাইলেন পাঠকের মস্তিষ্ককে উজ্জীবিত করতে। যে লেখা সহজেই পড়ে ফেলা যায়, যে লেখা পড়তে হলে মগজের কোষকে যোগব্যায়াম করতে হয়না, সেগুলো এলেবেলে সাহিত্য। হুমায়ূন আহমেদ কিংবা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মতো সাবলীল (এটাও গালিগালাজ) গদ্যকাররা “বাজারি লেখক” খেতাব অর্জন করলেন।
এরই মধ্যে দেখতে দেখতে চোখের সামনে উপস্থিত হলো নতুন উপদ্রব। বাংলা সাহিত্যের দুকূল ছাপিয়ে বইতে লাগলো ভূত-প্রেত তন্ত্র-মন্ত্র সাই-ফাই স্পেকুলেটিভ-ডিস্টোপিয়ান— আরো কীসব অত নামও জানিনা ছাই! অগত্যা, আমি “আধুনিক” লেখাপত্তর পড়া বন্ধ করলাম। ফিরে গেলাম আমার চিরপরিচিত আটপৌরে (গালিগালাজ) বাংলা সাহিত্যের পুরোনো জগতে। যেখানে চরিত্ররা সবাই মানুষ, প্রেক্ষাপট আমাদের পরিচিত বাস্তব (গালিগালাজ) পৃথিবী, বিষয়বস্তু প্রাসঙ্গিক। চারিপাশে সবাই যখন আধুনিক (এবং আন্তর্জাতিক) হয়ে উঠতে লাগলো, আমি একটা আশাপূর্ণা দেবীর ঘরোয়া (গালিগালাজ) গল্প, কিংবা একটা গজেন্দ্র মিত্রের গ্রাম্য (গালিগালাজ) গল্প, কিংবা বিমল করের নাগরিক (এই শব্দটা এখনও গালিগালাজ হয়নি) গল্প পড়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে লাগলাম। অনেক চেষ্টা করেও বন্ধুরা আমাকে “আজকালকার সাহিত্য” পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে পারলো না। কেউ ভাবলো আমার নাক উঁচু, কেউ ভাবলো পাঠক হিসেবে আমার “কোয়ালিটি” নিচু। আসল ব্যাপারটা খুব কম মানুষই বুঝলো।
যে-বইটি নিয়ে আলোচনা করবো বলে এই বিস্তারিত শিবের গাজনটি গেয়ে শোনালাম, সেই বইয়ের শিরোনামটি নেওয়া হয়েছে একটি বিখ্যাত বাংলা কবিতা থেকে। এই কবিতাটির রচয়িতা আমাদের দেখিয়েছিলেন, আঞ্চলিকতার লক্ষণ এবং স্থানিক বিষয়বস্তুকে পরিত্যাগ না করেও কীভাবে আধুনিকতার চূড়ান্ত চর্চা করা সম্ভব। কবিতাটির নাম “বনলতা সেন”। কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। আলোচ্য বইটির ব্লার্বে কিছু ভুল কথা লেখা রয়েছে। গল্পগুলোকে বলা হয়েছে “নতুন যুগের গল্প”, “একবিংশ শতকের গল্প”। বলা হয়েছে গল্পগুলো “পুরুষের চোখে” নয়, “নারীর চোখে” দেখা হয়েছে। ইত্যাদি।
কিন্তু বইটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, আসলে তো গল্পগুলো চিরায়ত! ধ্রুপদী বাংলা ছোটগল্পের সুগন্ধে ভরপুর! আসলে তো গল্পগুলো আলাদাভাবে নারীর কিংবা পুরুষের নয়। এগুলো মানুষের গল্প! নারীচরিত্রগুলোকে পাল্টে দিয়ে পুরুষচরিত্র হিসেবে দেখালেও হিসেবের বিশেষ হেরফের হতো না। এমন সহজিয়া সাবলীল গদ্যভাষা, প্লটের এমন সুবিন্যস্ত গঠন, আটপৌরে ঘরোয়া প্রেক্ষাপটের ছায়ায় ঢাকা, বাস্তব মানুষের বাস্তব ঘরদুয়ার, অন্দর বাহির, মনের গহীন জটিলতা, মানুষের দৈনন্দিন মাপা-হাসি এবং চাপা-কান্নার এরকম সাবেকি প্রকাশ— বহু বহুদিন পরে আমার দৃষ্টিগোচর হলো! মুগ্ধ হয়েছি রিফাত আনজুম পিয়া-র ছোটগল্পগুলি পড়ে। বোদ্ধা পাঠকদের মগজের পুষ্টিসাধন হবে কিনা জানিনা, তবে লেখকের গল্পবলার মুন্সিয়ানা যে আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে, এ কথা আমি হলপ করে বলতে পারি।
এই বই আমার কিছুতেই পড়া হতোনা, বন্ধু আঞ্জুমান লায়লা নওশিনকে যদি জিজ্ঞেস না করতাম যে, ২০২২ সালে তার পড়া সবচেয়ে প্রিয় বই কোনটা। সে আমাকে বইয়ের নাম বলেই চুপ থাকেনি, বইটা কিনে সটান পাঠিয়ে দিয়েছে আমার বাড়িতে। তখন ভেবেছিলাম এ হয়তো নেহাতই তার সহৃদয় বন্ধুকৃত্য। বইটা পড়ার পরে এখন বুঝতে পারি, আমিও হয়তো এই একই কাজ করতাম। পরিচিত পাঠক, যাঁরা আমার মতো “সরল সোজা” গল্প পড়তে পছন্দ করেন, তাদের হাতে বইটা তুলে দিয়ে বলতাম, বইটা প্লিজ পড়ুন। লেখকের প্রথম বই, এখনও তেমন পরিচিতি অর্জন করেননি, কিন্তু তবুও পড়ুন। নওশিনের মতোই বইয়ের ভিতরে দৃঢ় অক্ষরে লিখে দিতাম : “পৃথিবীটা বইপড়ুয়াদের হোক!” এবং তার মতোই বারবার তাড়া দিতাম : বইটা পড়েছেন? পড়েছেন বইটা? এখনও পড়া শুরু করেননি? শুরু করেননি এখনও? সেকি!
শেষ হয়েও রয়ে যায় গল্পগুলোর শীতাতপ রেশ, চরিত্রদের উপস্থিতি ঘুরতে থাকে মাথার ভেতর। মনে পড়ে যায় “বনলতা সেন” কবিতাটির অন্তিম কয়েকটা লাইন :
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতনসন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজনতখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ;সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন ;থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার...
আরো অনেক পাঠকের হাতে উঠে আসুক এই দারুন গল্পগুলো।
নিখাদ বিনোদনের উদ্দেশ্যে হোক কিংবা প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে, উজ্জীবিত করার উদ্দেশ্যে হোক কিংবা প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে, শিল্প হিসেবে নাটক পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন একটি মাধ্যম। কিন্তু নাটকের একটা মৌল প্রতিবন্ধকতা আছে। পৃথিবীর সর্বত্র থিয়েটারের ঐতিহ্য মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত। লোকনাট্য (বা গ্রামীণ থিয়েটার) আঙ্গিক হিসেবে খুবই আকর্ষণীয়। এতে গ্রামের মানুষের সুখ-দুঃখের বর্ণনা কিছু-কিছু থাকে বটে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রাধান্য পায় রাজা-রানি, দেব-দেবী কিংবা পৌরাণিক বৃত্তান্ত। এসবের সঙ্গে গ্রামের সাধারণ মানুষের ব্যক্তিজীবনের খুব বেশি সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে শহুরে থিয়েটার অনেক বেশি সফিস্টিকেটেড এবং কৃত্রিম।
ধরা যাক শহরের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে চমৎকার একটি নাটক যার বিষয়বস্তু হলো : রাজনৈতিক পেশীশক্তির বিরুদ্ধে সর্বহারা কৃষকদের জাগরণ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে... বুঝতেই পারছেন প্রশ্নটা কী। যারা নাটকটি দেখছেন তাদের মধ্যে “সর্বহারা কৃষক” আছেন কয়জন? গণজাগরণের নাটকের দর্শকাসনে “গণ”-দের বদলে বসে থাকেন শৌখিন মজদুরেরা। সুতরাং লোকনাট্য হোক কিংবা শহুরে থিয়েটার, যবনিকা নেমে যাওয়ার পরে আদপে বেশিরভাগ নাটকই, শুনতে খারাপ লাগলেও বলতে হয়, অশ্বডিম্ব প্রসব করে। আর নাটকের ক্ষেত্রে “art for art's sake” বাহানাটা খাটেনা। কারণ অ্যাজেন্ডা-বিহীন নাটক আর গুলিবিহীন বন্দুক একই জিনিস।
গ্রামের নাটক এবং শহরের নাটক ছাড়া তৃতীয় কোনো বিকল্প নাটক কি নির্মাণ করা সম্ভব? যার মধ্যে একইসঙ্গে থাকবে লোকনাট্যের মেঠো আবেদন এবং শহুরে থিয়েটারের কারিগরি সফিস্টিকেশন? যেখানে গণদের নাটক দেখার সুযোগ পাবে স্বয়ং গণরাই? সারা পৃথিবীর নাট্যকর্মীরা নাটকের এই সমস্যা সমাধানের কথা ভেবেছেন। ভারতীয় নাট্যকারদের মধ্যে বাদল সরকার শুধু চিন্তাভাবনার মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তৃতীয় বিকল্পটিকে সফলভাবে প্রয়োগ করে দেখিয়েছিলেন। বিকল্প নাট্যধারাটির নাম দিয়েছিলেন— কোনো ধানাইপানাই ছাড়াই—“থার্ড থিয়েটার”। যেখানে মঞ্চ নেই, প্রপস্ নেই, পশ্চাৎপট নেই, স্পটলাইট নেই, সাজ-সরঞ্জাম নেই, মেকআপ নেই। আছে শুধু অভিনেতারা, আর আছে দর্শকরা (সেই প্রকৃত “গণ” দর্শকরা যাদের জন্য নাটকটি লেখা হয়েছে)। যেখানে দর্শককে টিকিট কেটে নাটকের কাছে যেতে হয় না, নাটকই পৌঁছে যায় দর্শকের দোরগোড়ায়। তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই “পুরোনো কাসুন্দি”তেও বারবার দেখতে পাই তাঁর এই সোজাসাপ্টা ভঙ্গিটি। বাদল সরকারের নাম শুনলে যে-তিনটি শব্দ সবার আগে মাথায় আসে : অকপট, জেদি এবং সুরসিক!
বইটি একটানা লেখেননি তিনি। পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত এই বইটির প্রতিটি পর্যায় লেখার মাঝে ছিল অনেকদিনের বিরতি। ফলে কিছু পুনরাবৃত্তি আছে। কিন্তু লেখকের অসামান্য রসবোধ এবং চাঁছাছোলা এক্সপ্রেশনের কারণে কখনোই লেখাটা ঝুলে যায়নি। উত্তর কলকাতার বনেদি পরিবারের সন্তান ছিলেন, কিন্তু তাঁদের পরিবার যে খ্রিস্টান ছিল এটা আমি আগে জানতাম না! প্রকৃত নাম সুধীন্দ্র, কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন সাদামাটা ডাকনাম “বাদল”। শিবপুর কলেজের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন, পেশায় ছিলেন টাউন প্ল্যানার, কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা করবেন বলে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা থেকে উপাদান নিয়ে তৈরি হয়েছিল একটি খিচুড়ি ভাষা, নাম “এসপেরান্তো” (Esperanto)। এই অভিনব ভাষাটির বিশেষজ্ঞ ছিলেন তিনি। সুতরাং দেখতে পাচ্ছি, শুধু থিয়েটারি ক্ষেত্রে নয়, গোটা জীবনটাই যেন ব্যয় করেছিলেন বিকল্প পথের সন্ধানে।
আত্মজীবনীতে একই সঙ্গে পাই চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কলকাতার সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক পরিমন্ডলের এক বিচিত্র বর্ণনা। একদিকে সুকুমারী ভট্টাচার্যকে নিজের লেখা নাটক পড়তে দিচ্ছেন, আরেকদিকে জুতোর সুকতলা খুইয়ে কমিউনিস্ট পার্টির ট্রেড ইউনিয়ন শাখায় কাজ করছেন। পরবর্তীকালে স্রেফ জেদের বশে লন্ডনে গেলেন টাউন প্ল্যানিং নিয়ে ডিগ্রি অর্জনের জন্য। পাশ করার পরে চাকরি করতে গেলেন নাইজেরিয়াতে! সরাসরি স্বীকার করেছেন, জাঁ পল সার্ত্র-এর প্রবন্ধ পড়ে অস্তিত্ববাদের কিছুই বোঝেননি, যা বোঝার বুঝেছেন সার্ত্রের নাটক পড়ে। কিংবা “মিথ অভ সিসিফাস পড়তে শুরু করেছিলাম, কিন্তু শেষ করতে পারিনি। পরে প্লেগ উপন্যাসটা পড়ে মনে হয় আর সিসিফাস পড়ার প্রয়োজন নেই”। সার্ত্রের মতোই তাঁরও অভিমত : কমিউনিস্ট পার্টিই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সবচেয়ে বড়ো শত্রু।
আত্মজীবনীর শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ ভ্রমণের বৃত্তান্ত আছে। ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিং, খুলনায় নাটকের ওয়ার্কশপ করিয়েছেন। বাংলাদেশ ঘুরে তাঁর মনে হয়েছিল সারা দেশের মধ্যে রাজশাহী ইউনিভার্সিটির ছাত্র-অধ্যাপকরা সবচেয়ে প্রগতিশীল। এত যে নির্ভিক মানুষ, সেই তিনিই ঢাকা শহরে পরিচিত এক মহিলার সঙ্গে রিকশায় বসে যেতে অস্বস্তি বোধ করেছেন (কারণ তিনি শুনে এসেছেন ঢাকায় নাকি নারী-পুরুষ একসঙ্গে রিকশায় বসেনা)। পরে সেই মহিলার ধমক খেয়েছেন : “কেউ কিছু মনে করবে না!” যাই হোক, সবশেষে বলতে হয়, বাদল সরকারের কোনো সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারী নেই। বিংশ শতাব্দীর বহুমুখী-প্রতিভাসম্পন্ন ক্ষণজন্মা বাঙালি প্রজন্মের অন্যতম শেষ উদাহরণ তিনি। প্রসেনিয়াম থিয়েটারের পোক্ত দেওয়াল ভেঙে থিয়েটারকে নিয়ে যাবেন মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে হাটে বাজারে চৌরাস্তার মোড়ে (কেবল কথার কথা নয়, একদম আক্ষরিক অর্থে)— এমন বুকের পাটা এখন আর কার আছে? নাট্যমঞ্চের শীতল অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বের করে এনে নাটককে তিনি ঝলমলে দিনের আলোর মাঝে মুক্ত করে দিয়েছিলেন! প্রকৃত “পাগলা ঘোড়া” তো আসলে তিনি নিজেই!
“পরে যখন একটু নামডাক হয়েছে, অনেকে প্রশ্ন করেছেন— সিনেমায় কিছু করবার ইচ্ছে বা চেষ্টা আছে কি না। সোজা বলে দিয়েছি— না, নেই। আরো কথা বাড়ালে বলেছি, কিছু লোকের তো থিয়েটারে থাকা দরকার!”
ভালো সাহিত্যের একটি লক্ষণ হলো, তা একই সঙ্গে সমকালীন এবং চিরন্তন। ১৯৫২ সালে লেখা এই বিখ্যাত হিন্দি উপন্যাসটির দেশকাল এবং প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আজকের দিনদুনিয়ার ভিনগ্রহসম পার্থক্য। তবু মানুষ যেহেতু আজও মানুষ রয়ে গেছে, তাই উপন্যাসের মূল বার্তাটি আজকের দিনেও আমার কাছে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থায়, একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে তার নিজের পরিবারের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। ছোট থেকে আমরা বড় হই আমাদের পরিবারের প্রত্যক্ষ নজরদারিতে। বড় হওয়ার পরে সেই পরিবারের প্রতি ঋণ শোধ করি আমরা। ধর্ম ত্যাগ করলেও করা যেতে পারে, কিন্তু পরিবারকে ত্যাগ করা (কিংবা দূরত্ব তৈরি করা) তো মহাপাতকের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়!
উপন্যাসের স্থান এবং কাল : স্বাধীনতার ঠিক পরের ভারতবর্ষের একটি মফস্বল শহর (সম্ভবত আগ্রা)। মুখ্য চরিত্র অপ্রাপ্তবয়স্ক একটি দম্পতি। মনের দিক দিয়ে পরিণত হয়ে ওঠার আগেই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, কারণ তাদের পরিবার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পৃথিবীটা ভালো করে চিনে ওঠার আগেই জীবনের অন্যতম গুরুতর দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের উপর। এর ফলাফল হয়েছে মর্মান্তিক।
নিজের আজন্মপরিচিত পরিবেশ ছেড়ে একজন নারী যখন সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হয় (বিয়ের পরে), তখন তার মনের আদল কেমন থাকে? আর যদি নতুন পরিবেশটি হয় সেই নারীর প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ? এমনকি যার ভরসায় মেয়েটি নিজের আত্মপরিচয় পাল্টে ফেলেছে, সেই স্বামীটিও যদি পছন্দ না করে তাকে? কিংবা স্বামীটি যদি হয় অস্থিরমতি, দুর্বলচিত্ত, অমানবিক?
নারী পুরুষের সম্পর্কের রসায়ন, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত সমাজে পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তিমানুষের সম্পর্ক, সমাজের দ্বারা অন্ধভাবে চাপিয়ে দেওয়া প্রথার পরিণতি, আধুনিকতার সঙ্গে গতানুগতিকতার দ্বন্দ্ব— এরকম বেশ কিছু গুরুতর বিষয়কে খুব মুনশিয়ানার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন রাজেন্দ্র যাদব। ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লেখা এরকম কতো মণিমুক্তোর সঙ্গে আচমকা দেখা হয়ে যায়! উৎকৃষ্টতম ভারতীয় সাহিত্য আসলে লেখা হয়েছে আঞ্চলিক ভাষাতেই।
যদি প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিই (অন্যকে না হলেও, অন্তত নিজেকে); প্রচলিত সমস্ত রীতি-রেওয়াজকে যদি চোখ বন্ধ করে মেনে নিই; বেশিরভাগ মানুষ যা বিশ্বাস করে, তাকেই যদি অভ্রান্ত ভেবে নিই; নিজের বিচারবুদ্ধিকে যদি সংস্কারের পায়ে সমর্পণ করি; যদি সোজা পায়ে না হেঁটে পিছন দিকে হাঁটতে থাকি, তাহলে কি আমি জীবিত মানুষ? ভূতের পা পিছন দিকে ঘোরানো থাকে।