দুদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপে ফরোয়ার্ড করা একটি ছোটো ভিডিও ক্লিপ দেখে, অনেকদিন পরে, হুমায়ূন আহমেদের কিছু বইপত্র পড়ার ইচ্ছে হয়েছে। ভিডিওটি হুমায়ূনের কনিষ্ঠ পুত্রের (দেখে মনে হলো টিনএইজ পার করেনি এখনও)। ক্যামেরার সামনে অবিকল বাবার কায়দায় কাকে যেন দার্শনিক জ্ঞান বিতরণ করছে। তার এই অ-বয়সোচিত ডেঁপোমি দেখে খুবই বিরক্তি লাগলো (অন্য কারো পোলা হলে বিরক্তি লাগার প্রশ্নই ছিল না ; হুমায়ূন আমার ভীষণ প্রিয় লেখক বলেই হয়তো বিরক্তি লেগেছে)। নিতান্ত অল্পবয়সেই এই ছেলে এমন নিখুঁত পোঁদপাকামি আয়ত্ত করলো কীভাবে, এটা ভেবেও বেশ অবাক হয়েছি। “অনন্ত অম্বরে” বইটি হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতিচারণমূলক কিছু রচনার সংকলন। নিজের জীবনের সম্ভব-অসম্ভব অনেকরকম ঘটনার কৌতূহলকর বর্ণনা দিয়েছেন। কিছু ঘটনা খুবই উপভোগ করেছি। কিছু ঘটনার সত্যতার প্রতি সন্দেহ জেগেছে মনে (যদিও পরিবেশনার চমৎকারিত্বে সেগুলো যেন আরো বেশি উপভোগ করেছি)। বইয়ের একজায়গায় তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন—
“আমি খুব গুছিয়ে সত্যের মতো করে মিথ্যা বলতে পারি।”
“I came not to send peace, but a sword.”
(শান্তি নয়, আমি এনেছি একখানি তরবারি।)
~যিশু খ্রিস্ট
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আনা কারেনিনা যতটা না প্রেমের উপন্যাস, তার চেয়ে বেশি দার্শনিক উপন্যাস। দ্বিতীয় কথা, মোরালিটি দিয়ে যে আর্টের বিচার চলে না, টলস্টয় এই কাজটা খুব পরিপাটিভাবে এই উপন্যাসে করে দেখিয়েছেন। উপন্যাসের একটি চরিত্রও নৈতিকভাবে “ভালো মানুষ” নয়। তারা যে-সব কাজকর্ম এবং চিন্তাভাবনা করে সেগুলোর বেশিরভাগই আপত্তিজনক/বিরক্তিকর। কিন্তু আমরা অনেক সময়ই গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের কাজকর্মের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাহিত্যের ভালোমন্দ বিচার করি। আমরা বলি, “অমুক চরিত্রটিকে আমার পছন্দ হয়নি, তাই উপন্যাসটা বাজে”। এই লজিক অনুযায়ী আনা কারেনিনা একটি যাচ্ছেতাই উপন্যাস।
কিন্তু আনা কারেনিনাকে যাচ্ছেতাই উপন্যাস বলার উপায় নেই। বরং আমরা ক্রমশ উপলব্ধি করি, নীতিশিক্ষা দেওয়া নয়, সাহিত্যের কাজ হলো সমাজ এবং মানুষের জীবনের প্রতিবিম্বকে বিশ্বস্তভাবে পাঠকের সামনে হাজির করা। ঠিক এই কারণেই অনেক পাঠক টলস্টয়কে ভুল বুঝে এসেছেন। আনা কারেনিনা পড়ে কেউ তাঁকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিভূ বলেছেন, কেউ নারীবিদ্বেষী বলেছেন, কেউ বলেছেন জমিদারতন্ত্রের সমর্থক, কেউ বলেছেন প্রাচীনপন্থী। আবার উল্টো দিকে, এই উপন্যাসের একটি প্রধান নারীচরিত্রকে বেশ্যা বলে গালি দিয়ে তৃপ্তি পেয়েছেন কেউ। কিংবা, নারীর আদর্শ স্থান যে পতির পদতলে ছাড়া আর কোত্থাও নয়— এই কথা ভেবে কেউ আহ্লাদিত হয়েছেন। টলস্টয় যদিও মুচকি হেসে একবারও বলেননি, তোমরা দুই পক্ষই ভুল ভেবেছো। কীভাবে বলবেন? তিনি নিজেই যে এই উপন্যাসের একটি অন্যতম প্রধান চরিত্র। তাঁর তো কিছু বলা সাজে না!
এবং এই সরাসরি আত্মিক সংযোগের জন্যই হয়তো টলস্টয় এই উপন্যাসকে তাঁর লেখা “প্রথম প্রকৃত উপন্যাস” বলে সার্টিফিকেট দিয়েছেন (অথচ এর আগেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ— “ওয়র অ্যান্ড পিস”)। আনা কারেনিনা লেখার পরে তাঁর মনে হয়েছিল আর কোনো উপন্যাস লেখার প্রয়োজন নেই। সাহিত্যিক তাঁর নিজের লেখা উপন্যাসকে কখন নিজেই সার্টিফিকেট দেন? (আত্মবিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে)। যখন তিনি “লোকে কী ভাববে” এই চিন্তাকে প্রাধান্য দেন না। কেউ যদি আপত্তি জানায় যে, ব্যভিচারের শাস্তি কি কেবল মেয়েরাই পাবে? পুরুষরা ক্যানো পাবে না? পুরুষকে ক্যানো বেশ্যা বলা হবে না? টলস্টয় এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ সমাজে এটাই ঘটে থাকে (সেই টলস্টয়ের যুগেও ঘটতো, এখনও ঘটে)। ব্যভিচারের দোষ সাধারণত নারীরাই বহন করে। যতদিন না সমাজ নিজে থেকে এই ব্যবস্থার পরিবর্তনে রাজি না-হয়, সাহিত্যিকের দায় নেই নিজেকে জোর করে “সংশোধনবাদী” দেখানোর! যারা দেখায় তারা হিপোক্রিট। অথবা কল্পনাবিলাসী। অথবা দুটোই।
টলস্টয়ের সব উপন্যাসের মতো এই উপন্যাসেও একটি কিংবা দুটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে কাহিনি গড়ে ওঠেনি। অনেকগুলো চরিত্রকে প্রায় সমান সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। চরিত্ররা ঘটনাচক্রে একে-অপরের সঙ্গে মেলামেশা করে বটে, কিন্তু প্রত্যেকের জীবনের গতিপথ আলাদা আলাদা। তাদের চিন্তাভাবনার গতিপথও আলাদা। মানে এতটাই আলাদা যে, প্রায় প্রতিটি চরিত্রকে নিয়ে, ইচ্ছে করলেই, টলস্টয় একটা করে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতেন। উপন্যাসের ভিতরে মোটিফও আছে অনেকগুলো, তার মধ্যে একটি হলো রেলগাড়ি। সাহিত্যের ইতিহাসে বোধহয় টলস্টয়ই প্রথম রেলগাড়িকে আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। এই উপন্যাসে রেলগাড়ির উল্লেখ এসেছে বারবার। এবং প্রতিবারই ঘটনার বাঁক বদলে গেছে।
উপন্যাসের সবচেয়ে বড়ো দুটো ঘটনার সঙ্গেও রেলগাড়ির উপস্থিতি সরাসরি জড়িয়ে আছে। একটি ঘটনা ঘটে গল্পের শুরুর দিকে। আরেকটা শেষের দিকে। প্রথমটা যেন বন্দুকের ট্রিগার। শেষটা যেন মৃতদেহ। এর মাঝের পৃষ্ঠাগুলোয় গুলিটা বয়ে চলে প্রশান্তি থেকে ঝড়ে। ঝড় থেকে আশ্রয়ে। আশ্রয় থেকে নিরাশ্রয়ে। নিরাশ্রয় থেকে উপলব্ধিতে। উপন্যাসটির আরেকটি বড়ো মোটিফ হলো : মানুষের দ্বিচারিতা। যে-কাজগুলো আমরা অপরকে না-করার পরামর্শ দিই, সেই কাজগুলোই আমরা নিজেরা পরম উৎসাহে করে থাকি। মানুষ মূলত ভণ্ড পলিটিশিয়ান। যারা ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দ্যায় দুর্নীতিমুক্ত সমাজের, কিন্তু ভোটের পরে নিজেরাই চুরি কোরে জনতার তহবিল ফাঁক করে! উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রের ভিতরে এই দ্বিচারিতা ঢোকানো আছে। তারা শক্ত হলেও নরম। নরম হলেও গরম। গরম হলেও বাসী। বাসী হলেও জানেমন, আমি তো শুধু তোমাকেই ভালোবাসি! (হ্যাঁ হ্যাঁ, “বিধিসম্মত সতর্কীকরণ” পড়ে নিয়েছি আমি— Having an affair is injurious to health! Affair kills!)
ব্যক্তিগত জীবনে লেভ টলস্টয় ছিলেন মনে-প্রাণে খ্রিস্টীয় আদর্শে বিশ্বাসী। সেই জন্যই এই উপন্যাসে ব্যভিচারীরা “উচিত শাস্তি” পেয়েছে। কিন্তু টলস্টয় তো দুনিয়ার সেরা একজন মানবিক আর্টিস্টও বটে। তাই ব্যভিচারীকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়নি, করুণার দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে। শুধু তো পেম-বালুবাসাই নয়, জীবনে আরো অনেক কর্তব্য আছে। সমাজ আছে। প্রকৃতি আছে। রাজনীতি আছে। সংসার আছে। যুদ্ধ আছে। ধর্ম আছে। অধর্ম আছে। আর আছে একটা খুব বড় প্রশ্ন : এই যে এত কাজ, এত কষ্ট, এত পরিশ্রম, এত ভাবনা, এত উদ্যোগ, এত আকাঙ্ক্ষা, এত যন্ত্রণা আর এত আনন্দ— সব তো একদিন ধুলোয় মিশে যাবে— মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নেবে আমাদের সব অর্জন, সব অধিকার— তাহলে ক্যানো পেয়েছি এই জীবন? কী উদ্দেশ্য জীবনের? ঢেউ এসে হেলায় ভেঙে দেবে যে বালির দুর্গ, ক্যানো তাকে গড়ে তুলছি এত যত্নে, এত মমতায়?
উপন্যাসজুড়ে নানাভাবে নানারূপে ছড়িয়ে আছে এই প্রশ্নগুলির টুকরো (উত্তর দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে)। প্রেম হোক কিংবা সামাজিক সমস্যা, বাস্তবের গদ্যময়তাকে ছাড়িয়ে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন টলস্টয় (উপন্যাসটি বস্তুত তৎকালীন রাশিয়ার সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের বিশ্বস্ত প্রতিচ্ছবিও বটে)। আজকের দিনে যদি লেখা হতো আনা কারেনিনা, তাহলে অবশ্যই পাল্টে যেত উপন্যাসের গঠন এবং মনস্তত্ত্ব। যে-কাজকে সেইসময় গণ্য করা হতো ক্ষমাহীন পাপ হিসেবে, আজকের দিনে সেই কাজ একেবারে স্বাভাবিক (আইনি এবং নীতিগত— দুই দিক দিয়েই)। কিন্তু সময়ের সঙ্গে মোরালিটির পরিবর্তন হলেও পরিবর্তন হয় না সম্পর্কের, সন্দেহের, ঈর্ষার, আত্মপ্রবঞ্চনার। আজও মানুষ যাকে ভালোবাসে, ভবিষ্যতে তার ক্ষতি করতে সচেষ্ট হয় (দরকার হলে নিজের নাক কেটে ফ্যালে)। আজও all is fair in love and war. আজও নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়, নক্ষত্রের মতন হৃদয় পড়িতেছে ঝরে— ক্লান্ত হয়ে— শিশিরের মতো শব্দ করে! আজও, মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান।
উপন্যাসের একদম শুরুতে উল্লেখ করা নিয়তির সেই অমোঘ সাবধানবাণীটি আজও প্রভাব বিস্তার কোরে চলেছে মানুষের জীবনে, মানুষীর জীবনে :
“Vengeance is mine; I will repay.”
(প্রতিহিংসা নেওয়ার দায়িত্ব আমার, যা করার তা আমিই করবো।)
কারণ— “শান্তি নয়, আমি এনেছি একখানি তরবারি।”
একটি স্বপ্নের নিদারুণ অপমৃত্যুর গল্প শোনানো হয়েছে এই ছোট্ট উপন্যাসটিতে। স্বপ্নটির নাম সাম্যবাদ। খেটে-খাওয়া, নিরন্ন, নিরস্ত্র, অসহায়, বঞ্চিত, বিপন্ন, শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে নিয়ে একটি সমাজ গড়ার স্বপ্ন। যেখানে কেউ কাউকে হীন চোখে দেখবে না, কেউ কারো মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেবে না। সবাই হবে সমান।
পৃথিবীর নানা দেশে বহুবার এই সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করেছে কমিউনিস্ট পার্টি। কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তাদের হাতে এই সুযোগ তুলে দ্যায়নি, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দ্বারা নিজেরাই ছিনিয়ে এনেছে সুযোগ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, প্রতিটা ক্ষেত্রে নিজেদেরই হাতে তারা ধ্বংস করেছে সেই সুযোগকে, সেই স্বপ্নকে। কলঙ্কিত করেছে সহযোদ্ধাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে।
দীর্ঘ ৩৪ বছরব্যাপী (১৯৭৭-২০১১) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান, বিবর্তন এবং পতনের গল্পটি সমগ্র পৃথিবীর সাম্যবাদী রাজনীতির নিরিখে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ এই রাজ্যে তারা ছিল : “the longest serving democratically elected communist-led government in the world”. কিন্তু আজকের দিনে এই রাজ্যে তাদের প্রাসঙ্গিকতা প্রায় নেই বললেই চলে। এবং তাদের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ দেখে মনে হয় না খুব শিগগির সেই প্রাসঙ্গিকতা আবার পুনরুদ্ধার করতে পারবে তারা।
কিন্তু স্বপ্ন অবিনাশী। বিপ্লব মরতে মরতেও বেঁচে থাকে। আমরা যারা নিজেদের জীবনের একটা বড়ো অংশ পার করেছি পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট আমলে, দেখেছি তাদের নিরঙ্কুশ রমরমা, উন্নাসিক দ্বিচারিতা এবং আদর্শের ক্রমিক অধঃপতন, আমাদের কাছে এই উপন্যাসের কাহিনিটি ভীষণ পরিচিত। তাদের পতনের প্রায় এক যুগ পরেও আমরা দেখতে পাই, সেই হারিয়ে যাওয়া সাম্যবাদী স্বপ্নটি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে দিগন্তের কাছাকছি— বহু দূরে— হাতের নাগালের অনেক বাইরে।
সমসাময়িক ইস্যু নিয়ে বাংলা ভাষায় এখন আর রাজনৈতিক উপন্যাস লেখা হয় না (কিছু লেখা হলেও সেগুলো নিরীক্ষার ভারে জর্জরিত)। এই উপন্যাসটি ব্যতিক্রম। আটপৌরে গদ্যে লেখা উপন্যাসটিতে খানিকটা নাটকীয় উপাদান রয়েছে বটে, তবু ২০১১ সালের পালাবদলের মুহূর্তকে যথেষ্ট বিশ্বস্ততার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন সৌরভ মুখোপাধ্যায়। তাঁর রচনার এই অনায়াস অথচ প্রগাঢ় ভঙ্গিটি আমার বরাবর ভালো লাগে।
শ্রেণিবৈষম্যহীন একটি সমাজ গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব কিনা আমি জানি না। মার্ক্সবাদী অর্থনৈতিক এবং সামাজিক তত্ত্বগুলি নিছক অবাস্তব দিবাস্বপ্ন কিনা আমি জানি না। “সর্বহারার একনায়কত্ব” ব্যাপারটি একটি সোনার পাথরবাটি কিনা আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি, এই তত্ত্বটি বাস্তবে প্রয়োগ করার সুযোগ যারাই পেয়েছে, তারাই অপব্যবহার করেছে। কমিউনিজমের উচিত/অনুচিতের তর্ক নয়, একটি জনপদের অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত আশাভঙ্গের একটি সাহিত্যিক দলিল হয়ে থাকবে এই উপন্যাসটি।
আমি ক্লান্ত যে, তবু হাল ধরো
আমি রিক্ত যে, সেই সান্ত্বনা
তব ছিন্ন পালে জয়পতাকা তুলে
সূর্যতোরণ দাও হানা
ও আলোর পথযাত্রী
এ যে রাত্রি, এখানে থেমো না
এ বালুর চরে আশার তরণী তোমার যেন বেঁধো না
ও আলোর পথযাত্রী...
সেই যখন আমেরিকা মত্ত হয়ে আছে ভিয়েতনাম-ধর্ষণে, সেই যখন খুন হলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, সেই যখন হরেকরকম প্রথাবিরোধী আন্দোলনে মুখর আমেরিকার যুবক-যুবতীরা, গত শতাব্দীর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সেই ষাটের দশকের কয়েকটা মাস যুক্তরাষ্ট্রের আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর বয়স তখন মাত্রই ৩৫ বছর। আয়ওয়ার সেই বিখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল রাইটার্স ওয়ার্কশপের অভিজ্ঞতার ব্যাপারে বহু রচনায় বিস্তারিত লিখেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। শঙ্খ ঘোষের এই ডায়েরিতে ধরা আছে তাঁর নিজের আমেরিকা-যাপনের দৈনিক ইতিবৃত্ত।
একই অভিজ্ঞতা নিয়ে, অনেক সাজিয়ে-গুছিয়ে, পরবর্তীকালে অন্য একটি বই লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ : “ঘুমিয়েপড়া অ্যালবাম”। ডায়েরিটিকে বলা যায় সেই বইটিরই uncut version— অপরিমার্জিত এবং স্পন্টেনিয়াস। ডায়েরির ভাষাও, সঙ্গত কারণেই, অনেক বেশি চাঁছাছোলা, অ-শঙ্খসুলভ। যাঁকে চিনি প্রায় নির্বাণপ্রাপ্ত একজন মানুষ হিসেবে, আমাদের সেই শঙ্খ ঘোষ এখানে এলোমেলো, প্রবল আত্মসচেতন, তিতিবিরক্ত এবং গসিপপ্রবণ।
এইসব দেখেশুনে সেই-সময়কার শঙ্খের প্রায় সমবয়েসি এখনকার আমি বেশ উৎফুল্ল (এবং নিশ্চিন্ত) হলাম!
নাহ, সব মিলিয়ে ভালো লাগলো না। ইয়াং-অ্যাডাল্ট ঘরানার সাহিত্যের সঙ্গে আমি খুব বেশি পরিচিত নই। স্যালি রুনির নাম শুনতে পাই অনেক, তাই নেহাত কৌতূহলের বশে বইটা পড়া শুরু করেছিলাম। লেখিকার গদ্যশৈলী মন্দ নয়, গল্পটাও মোটামুটি চলনসই, কিন্তু তবু... শেষ পর্যন্ত underwhelming মনে হলো।
সংস্কৃতির (এবং হয়তো জেনারেশনেরও) ভিন্নতার কারণে কিনা জানি না, এই কাহিনির চরিত্রদের সঙ্গে আমি একাত্মবোধ করতে পারিনি। বড্ডো নকল লেগেছে পুরো ব্যাপারটা। ইশকুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, হাবভাব, যেমনটা দেখানো হয়েছে, আয়ারল্যান্ডে কি মাত্র ১৮/১৯/২০-বছর বয়সেই সবাই এরকম বুড়োমার্কা হয়ে যায়? আর যদ্দুর বুঝলাম, সেই দেশে কোনো কুসুমেরই মন নাই, শুধু শরীর, শরীর।
গল্পের কিছু বিষয় কিন্তু সামাজিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। অল্পবয়েসি সিঙ্গল-মাদার, টক্সিক/অ্যাবিউজিভ/ম্যানিপুলেটিভ সম্পর্ক (রোমান্টিক কিংবা ডোমেস্টিক— দু রকমই), কিশোর বয়সের যৌনতা, একাকীত্ব, alienation, সেলফ-ডাউট, এরকম বেশ কিছু দরকারি জিনিস উঠে এসেছে। কিন্তু খিচুড়িতে কিছু-কিছু সবজি ভালো করে সেদ্ধ হয়নি। আবার কিছু-কিছু সবজি বেশি সেদ্ধ হয়ে গেছে।
উপন্যাসটির উত্তরকথনে লেখক মন্তব্য করেছেন : “এই উপন্যাস আসলে বাঙালির বিবেকের প্রায়শ্চিত্ত”। উপন্যাসের কাহিনিসূত্রের পশ্চাতে রয়েছে একটি দুঃখজনক সত্যি ঘটনা। আর জি কর হাসপাতাল নিয়ে আজকে যে তুলকালাম কাণ্ড চলছে, সেই হাসপাতালেই ফিজিওলজি বিভাগের গবেষক ও অধ্যাপক ছিলেন ডাক্তার সুভাষ মুখার্জি। সময় : গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুর দিক। ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণাকর্ম চালিয়ে সেই দুর্ভাগা গবেষক “ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন” (IVF) পদ্ধতি ব্যবহার করে ভারতের প্রথম (বিশ্বের দ্বিতীয়) টেস্টটিউব বেবির জন্মদান সম্ভব করেছিলেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন কমিউনিস্ট বামফ্রন্ট সরকার তাঁর এই আবিষ্কারকে নস্যাৎ করে দ্যায় এবং তাঁকে পেশাগতভাবে অপমান করে। সাফল্যের ন্যায্য স্বীকৃতি না দিয়ে উল্টে ঠগবাজ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। সরকারি উদ্যোগে সংঘটিত সেই অন্যায় অপমানের দায় মাথায় নিয়ে, পেশাজীবনে একঘরে হয়ে যাওয়া সেই প্রতিভাবান মানুষটি আত্মহত্যা করেন। (আরো বিস্তারিত জানতে হলে উইকিপিডিয়ায় “Subhash Mukhopadhyay (physician)” দেখতে পারেন।)
রমাপদ চৌধুরী তাঁর উপন্যাসে এই ঘটনাটিকে হুবহু ব্যবহার করেননি। এমনকি বিষয়বস্তুও বেশ খানিকটা পরিবর্তন করেছেন। যদিও নিজের স্বভাবসিদ্ধ অনুসন্ধানী রচনাশৈলীর দ্বারা রমাপদবাবু মর্মান্তিকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বাঙালির জাতিগত চরিত্রের একটি ডেফিনিটিভ বৈশিষ্ট্যকে, যার নাম “কাঁকড়াবৃত্তি”। একটা কাঁকড়া যখন নিজের প্রচেষ্টায় উপরে ওঠার চেষ্টা করে, আশেপাশের বাকি কাঁকড়ারা তাকে টেনে নিচে নামিয়ে দ্যায়। অন্যের সাফল্য কিংবা অগ্রগতিকে ঈর্ষা করার স্বভাব সব মানুষেরই কমবেশি থাকে, কিন্তু বাঙালি একে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। মহাভারতের অভিমন্যুর মতো চক্রব্যূহ পার করতে হলে (অর্থাৎ কোনো দুরূহ কাজ করতে হলে) বাঙালিকে একাকী উদ্যোগে করতে হয়। এবং সেই কাজটি যদি সফল হয়, সাফল্যের উপহারস্বরূপ অনেকসময়ই সেই একাকী যোদ্ধার কপালে জোটে ঈর্ষাসঞ্জাত অপমান কিংবা অপদস্থ হওয়ার কাঁটার মুকুট।
মজার কথা হলো, আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেকার সেই প্রবল প্রতাপশালী কমিউনিস্ট পার্টি আজকে এই রাজ্যে হাসির খোরাকে পরিণত হয়েছে (যদিও বরাবরের মতোই তারা এখনও নিজেদের সবজান্তা মনে করে এবং তাদের বিরুদ্ধমতের মানুষকে মনে করে “অশিক্ষিত” কিংবা “নির্বোধ” কিংবা... আর কী?— “পেটি বুর্জোয়া!”) ইতিহাসের চক্রাকার বিবর্তনের কী অদ্ভুত পরিহাস! সেই আর জি কর হাসপাতালেই ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনাকে হাতিয়ার করে পার্টির বর্তমান কমরেডরা আজকে ঘোলা জলে মাছ ধরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যের ধুতির কাছা আঁকড়ে ধরে সেটাকে নিজেদের ধুতি হিসেবে চালাতে চাইছে। কিন্তু সারা বিশ্বের সর্বত্র কমিউনিস্ট অপশাসনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও দীর্ঘ ৩৪-বছরব্যাপী বামফ্রন্ট সরকারের উন্নাসিক অপশাসনকে মনে হয়না এই রাজ্যের ভুক্তভোগী জনগণ অ্যাতোই সহজে ভুলে যাবে। রমাপদ চৌধুরীর এই সুলিখিত উপন্যাসটি আরো একবার স্মরণ করিয়ে দিলো ডাক্তার সুভাষ মুখার্জির সেই যন্ত্রণাক্লিষ্ট পরিণতির কথা। এই উপন্যাস সত্যিই বাঙালির বিবেকের প্রায়শ্চিত্ত।
(উপন্যাসটি আলাদা করে এখন আর পাওয়া যায় কিনা জানি না। আমি পড়েছি রমাপদ চৌধুরীর “উপন্যাস সমগ্র” তৃতীয় খণ্ড থেকে। উপন্যাসের কাহিনি-অবলম্বনে পরিচালক তপন সিংহ একটি বিখ্যাত সিনেমা বানিয়েছিলেন— “এক ডক্টর কি মওত”।)
সময়ের তুলনায় বেশ সাহসী উপন্যাস। মেয়েদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে একটা থিয়োরি উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। মেয়েরা নাকি মোটাদাগে দুই রকম। একরকম হলো যারা মায়ের মতো পুরুষকে যত্নআত্তি করে, আগলে রাখে, পুরুষের আনন্দেই তাদের আনন্দ। আরেকরকম— যারা হলেন স্বাধীনচেতা। পুরুষের প্রতি যাদের ভালোবাসা সমানে-সমানে। ন্যাকাবোকা এবং খামখেয়ালি টাইপের পুরুষদের তারা পছন্দ করে না। তাদের পছন্দ স্বাবলম্বী পুরুষ। মুশকিলটা বাধে, রাউন্ড হোলে যখন স্কয়ার পেগ ঢুকতে চায়।
উপন্যাসে এই থিয়োরিটার প্রয়োগ করেছেন, সেই জন্যই কি একে সময়ের তুলনায় সাহসী বললাম? নাহ, সাহসী অন্য জায়গায়। জানতে হলে উপন্যাসটা পড়তে হবে।
এবং এই থিয়োরিটা আদৌ সত্যি কিনা এই ব্যাপারেও আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই! কারণ, স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম্ দেবা ন জানন্তি কুতো রবীন্দ্রনাথ?
উনিশ শতকের প্রথমার্ধের গল্প। সেই ডিরোজিও, ইয়াং বেঙ্গল, বাংলার রেনেসাঁসের সময়কাল। স্থান : শহর কলকাতা এবং কলকাতার উপকণ্ঠে গঙ্গাতীরবর্তী কয়েকটি জনপদ। উপন্যাসের মূল চরিত্ররা এবং মোদ্দা ঘটনাবলী সম্পূর্ণ কাল্পনিক হলেও, তৎকালীন পরিবেশচিত্রণে—পুরোপুরি না হলেও—লেখককে মোটামুটি সফল বলা যায় (এটুকুই যা প্রাপ্তি এই উপন্যাস থেকে)। এখনও পর্যন্ত রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের যে-কটা বই পড়েছি, প্লটের অভিনবত্ব এবং মৌলিক অথচ সাবলীল গদ্যশৈলীর কারণে, ইদানিংকার লেখকদের মধ্যে তাঁর লেখা আমি বিশেষ পছন্দ করি। কিন্তু এই উপন্যাসটা পড়ে নিদারুণ বিরক্ত হলাম। কী যে আগডুম-বাগডুম একটা গল্প ফেঁদেছেন! বুঝলাম যে প্লটের দিন গিয়াছে, ফর্মই হইলো আজকালকার লেখকদের মূল মাথাব্যথার বস্তু। কিন্তু তাই বলে কমন সেন্সকে জলাঞ্জলি দিয়ে, হাবিজাবি কিছু একটা লিখে, সেটাতে “পরাবাস্তব” কিংবা “পোস্টমডার্ন” কিংবা “নিরীক্ষামূলক” স্টিকার লাগিয়ে বাজারে নামিয়ে দিলেই চলবে রে বাবা? পূর্ববঙ্গের “বাঙাল” মানুষদের নিয়ে যে-একটা অবিশ্বাস্য কাণ্ড করেছেন এই উপন্যাসে—সেটা পড়ে হাসবো নাকি মুখ গোমড়া রাখবো, বুঝতে পারছিলাম না। আর হ্যাঁ, ভাই লেখক, আপনার প্রতিটি উপন্যাসের ভিতরে লালবাজারের কচকচানি আর ভাল্লাগচে না মাইরি!
এই বই যে-বছর প্রথম বেরোলো, ১৯৯৭ সালে, সেই বছর আমি প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হই। মানে, হ্যারি পটার পড়ার একেবারে উপযুক্ত বয়স! কিন্তু দুটো কারণে পড়া সম্ভব হয়নি। প্রথমত, আপাদমস্তক বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছাত্র হওয়ায়, ইংরিজি গল্পের বই পড়ার সময় হাঁটুতে জোর পেতাম না (তাছাড়া, আমরা ছিলাম পশ্চিমবঙ্গের পোগোতিসিল কমিউনিস্ট বামফ্রন্ট আমলের সরকারি প্রাইমারি ইশকুলের “ইংরিজিবিহীন” ছাত্তর— এই ব্যাপারটা যারা জানে, তারা জানে)।
দ্বিতীয় কারণ, আমাদের টিমটিমে মফস্বল শহরে টেক্সটবুক বাদ দিলে ইংরিজি হরফওয়ালা যে-বইগুলো পাওয়া যেত তার নাম ডিকশনারি। তাই কোথায় পাবো হ্যারি পটারের বিলিতি গল্পের বই? জোগাড় করা সম্ভব হলেও দাম পড়বে আকাশছোঁয়া। সুতরাং, আমার গোটা কিশোরবেলা কেটেছে হ্যারি পটারহীন। যদিও খবরের কাগজে দেখতাম এই বই নিয়ে বিশ্বব্যাপী উন্মাদনা। একেকটা বই বেরোচ্ছে, আর জগৎজুড়ে পটারহেডরা হামলে পড়ছে বইয়ের দোকানে। আনন্দবাজারের প্রথম পৃষ্ঠায় ছবি ছাপা হতো : রাত জেগে লাইনে দাঁড়িয়ে হ্যারি পটার সিরিজের নতুন বই বগলদাবা করে হাসিতে উদ্ভাসিত পটারপ্রেমীর মুখ। সব মিলিয়ে সে এক অশৈলী কাণ্ডকারখানা!
অবশেষে ঠিক ২৭ বছর বাদে মোলাকাত হলো হ্যারি পটারের সঙ্গে। এমন নয় যে ইতিপূর্বে পড়ার সুযোগ পাইনি। সুযোগ পেলেও ইচ্ছে হয়নি। কারণ ফ্যান্টাসি জঁরের বই পড়তে আমার ভালো লাগে না। বেশ কয়েক বছর ধরে বহু muggle-রা আমাকে হ্যারি পটার সিরিজটা পড়ার জন্য প্ররোচনা এবং উৎসাহ দিয়ে আসছিলেন, তবুও পড়িনি। কিন্তু এই বছর কী যে হলো, ঠিক দুর্গাপূজার আগে মা দুর্গার নাম স্মরণ করে গোটা সিরিজটাই কিনে ফেললাম! মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। আপাতত সিরিজের প্রথম বইটা শেষ করলাম। তো, কেমন লাগলো হ্যারি পটারের কিসসা?
আমি বরং জে কে রওলিংয়ের ব্যাপারে দু-চারটে কথা বলি। শিশুসাহিত্য মানেই তাকে হতে হবে নিষ্কলঙ্ক। তার মধ্যে থাকবে না কোনো ভায়োলেন্স। শিশুদের গল্পের চরিত্ররা হবে শান্তিপ্রিয় আদর্শবান মানুষ। শিশুসাহিত্যের জগৎ মানেই তাকে হতে হবে গঙ্গার জলে ধোয়া একটা নিষ্পাপ পবিত্র জগৎ। শিশুদের মন যে বড্ডো কচি এবং কোমল। খুনখারাবি আর হিংসা-বিদ্বেষওয়ালা বইপত্তর পড়লে বড় হয়ে তারা নির্ঘাত সিরিয়াল কিলারে পরিণত হবে! হ্যারি পটারের স্রষ্টাকে একটা Hagrid-সাইজের কুর্নিশ জানাই, শিশুসাহিত্যের এইসব ন্যাকাচন্দর ফর্মুলার গালে সপাটে একটা থাবড়া মারার জন্য!
“The trouble is, humans do have a knack of choosing precisely those things which are worst for them.”
পৃথিবীটা যেমন, ঠিক তেমনটাই দেখিয়েছেন রওলিং। পৃথিবীতে ছোটদের অকারণে হেনস্তা হতে হয়। ছোট হওয়ার জন্য তারা প্রতিবাদ করতে পারে না। অনেক সময়েই, ছোটদের সঙ্গে বড়রা মোটেও আদর্শ আচরণ করে না (একেকজন বাপ মা-র কাজকর্ম দেখলে তো ডিক্টেটররাও লজ্জায় আঁচলে মুখ লুকাবে)। ইশকুলে পড়ার সময়েও বদমাইশ ছেলেপিলের অভাব থাকে না। সহপাঠীরা একে-অপরের পিছনে লাগে। মানসিক এবং শারীরিক— দুভাবেই ক্ষতি করার চেষ্টা করে। এমনকি শিক্ষকদের মধ্যেও বদমাইশির কমতি থাকে না। ক্লাসরুমের ভিতরে হোক কিংবা বাইরে, এই দুনিয়াটা মোটেও সুবিধের জায়গা নয়। এবং বিশ্বাস করুন ছাই না করুন, ছোটরা কিন্তু এইসব ব্যাপার-স্যাপার খুব ভালো করেই বোঝে! তবু দুনিয়ার এই কর্কশ পাথুরে মাটিতেই ক্যাকটাসের মতো ফুটে ওঠে বন্ধুত্বের রঙিন ফুল। দুনিয়াটা কর্কশ বলেই বোধহয় বন্ধুরা আমাদের কাছে এত দামি! বই পড়ে কিংবা সিনেমা দেখে হিংসা-বিদ্বেষ শেখার দরকার হয় না। ওসব জিনিস নিশ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে যাতায়াত করে ছোটদের মনোজগতে। তাদের থেকে এইসব জিনিস জোর করে লুকিয়ে রাখলে বরং উপকারের চেয়ে ক্ষতি করা হয় বেশি।
জে কে রওলিং তাঁর ক্ষুদে পাঠকদের সঙ্গে ভণ্ডামি করেননি। Hogwarts-এর জগৎটাকে তিনি দ্বিধাহীন স্পষ্টতার সঙ্গে নির্মাণ করেছেন। রওলিংয়ের লেখনীও চমৎকার— সরস এবং স্মার্ট। তাঁর জগতে ভালো-খারাপ পাশাপাশি অবস্থান করে। এই জগতে ছোটরা সবসময় বাই-ডিফল্ট ভালোমানুষ হয় না, আবার বড়রাও অনেকসময় ছেলেমানুষী কাজ করে। কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে উজ্জ্বল, আশ্চর্য এবং বুদ্ধিদীপ্ত কল্পনার শ'য়ে শ'য়ে ফুলঝুরিকে ডানা মেলে উড়তে দিয়েছেন বটে, কিন্তু কাহিনির চরিত্ররা কেউই কাল্পনিক নয়। তাদের সবাইকে আমরা কমবেশি চিনি। আর চিনি বলেই, ২৭ বছর দেরি করে পড়া শুরু করলেও জমজমাট এই কাহিনির সঙ্গে আমি দিব্যি একাত্মতা অনুভব করতে পারছি। সবেমাত্র প্রথম বইটা শেষ করলাম, তাই সামগ্রিকভাবে খুব বেশি মতামত জানানো উচিত হবে না। এখনও তো অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি আছে। জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা... ইয়াহাঁ কাল ক্যায়া হো কিসনে জানা?
একুশটা গল্প আছে বইতে। প্রথম দু-তিনটে গল্প মন্দ লাগছিল না। তারপর যত এগোতে থাকলাম, বুঝলাম একটাই আইডিয়াকে (কিংবা ফর্মুলাকে) ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একুশবার ব্যবহার করেছেন লেখক। গুরুতর কিছু সামাজিক এবং মানবিক ইস্যু নিয়ে ডার্ক-কমেডি ধাঁচের গল্প লিখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু গল্পগুলোর মধ্যে সার্থক ডার্ক-কমেডির সূক্ষ্মতা এবং গভীরতা নেই। বরং morbid অতিনাটকীয়তার উপর্যুপরি ব্যবহারে (অথবা হাতুড়ির প্রহারে) একটা সময় গল্পগুলোকে কৃত্রিম এবং predictable মনে হতে শুরু করে। মনে হয় যেন, পাঠকের মনে স্রেফ চমক সৃষ্টি করার জন্য প্লট নিয়ে এরকম আপ্রাণ কসরৎ করেছেন লেখক। গল্পগুলোর গদ্যের মানও কাজ-চালানো-গোছের। এই ধরণের গল্প লেখার জন্য ভাষানির্মাণের যে-পারদর্শিতা প্রয়োজন, লেখকের উপস্থাপনায় তা অনুপস্থিত। সবমিলিয়ে, মানুষের মাংস খেয়ে তৃপ্তি পেলাম না মোটেও!
সিনেমাটা দেখার আগে ভাবলাম বইটা পড়ে ফেলি। মিতকায় এই উপন্যাস থেকে এতটা গভীরতার সন্ধান পেয়ে যাবো আশা করিনি। আজকে এই বৃষ্টিঘেরা ঘষা কাচের মতো ভোরবেলায় রোগা বইটা শেষ করে মনে ভাসছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের সেই গানটা—
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে
মোবাইলে একটা ছবি এডিট করার ক্ষমতা নেই যার (করলেও সেই ছবির অবস্থা হয় একইসঙ্গে ভৌতিক এবং হাস্যকর), সেই আমি যদি AI-এর মতো আধুনিক সফিস্টিকেটেড তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে চিন্তাভাবনা করি, তাহলে কি মানায়? কিন্তু কী আর করা যাবে, জমানা যেদিকে এগোচ্ছে, একটু আধটু খবর না-রাখলে তো চলে না। ইউভাল নোয়াহ হারারির বইটা যদিও এতকিছু ভেবেচিন্তে কিনিনি। বরাবর এই লেখকের বই পড়তে ভালো লাগে, জানতে পারলাম তাঁর নতুন বই বেরিয়েছে, তাই কিনেছি। তো এই দফায় হারারির আলোচনার বিষয়বস্তু : A brief history of information networks from the stone age to AI.
উপরের ইংরিজি লাইনটা হলো বইয়ের উপ-শিরোনাম। প্রস্তর যুগ থেকে মানুষের দ্বারা উদ্ভাবিত এবং ব্যবহৃত বিভিন্ন information network (ভাষা, মিথোলজি, ব্যুরোক্রেসি, ধর্মগ্রন্থ, মুদ্রণযন্ত্র, বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র, সংবাদমাধ্যম, রেডিও, ইন্টারনেট, ইত্যাদি) নিয়ে আলোচনা করেছেন বটে, তবে শেষ অবধি এই বইয়ের মূল আলোচ্য বিষয় যে “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স”, সেটা বোধহয় ইতিমধ্যে প্রায় সবাই জেনে ফেলেছেন। হারারি প্রথমে খুব ধীরেসুস্থে এবং বেশ বিশদে একদম প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে হাল আমলের তথ্য-সম্প্রচার ব্যবস্থাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। সমাজের উপর, রাজনীতির উপর, অর্থনীতির উপর, ধর্মের উপর, সর্বোপরি ব্যক্তিমানুষের উপর ইনফরমেশনের প্রভাব নিয়েও বিশদ আলোচনা করেছেন (বইয়ের প্রায় অর্ধেক আলোচনা এইসব বিষয়ে)। কারণ পুরো ইতিবৃত্তটা খোলসা না-হলে বর্তমান সমাজ এবং সভ্যতায় AI-এর প্রভাব আমার মতো বিজ্ঞানচর্চাহীন সাদামাটা পাঠকের মস্তিষ্কে সহজে ঢুকতো না। যদিও এই বইয়ের আলোচনা যতটা না প্রযুক্তি-বিষয়ক, তার চেয়ে বেশি আর্থসামাজিক। রাজনৈতিক।
হারারির প্রতিটা বইয়ের বিশেষত্ব হলো তিনি প্রচলিত চিন্তাভাবনাকে ভেঙেচুরে একটা নতুন রূপে পাঠকের সামনে হাজির করেন। এছাড়াও, হারারির প্রথম বই (“সেপিয়েন্স”) থেকেই আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, তিনি তীব্রগতিসম্পন্ন অনুভূতিহীন অত্যাধুনিক যন্ত্রসভ্যতাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দ্যাখেন। তাই বলে পাঠককে পুনরায় সেই আদিম শিকারী জীবনে ফিরে যেতে উদ্বুদ্ধ করেন, এমনটা নয়। তিনি শুধু এইটা বোঝাতে চান : আধুনিক সভ্যতার ব্যাপক অগ্রগতি নিয়ে নাচন-কোদন করার আগে একটু স্থির হয়ে বসে চিন্তা করো, বৎস। যতটা আহ্লাদে ডগমগ হচ্ছ, আদৌ কি ততটাও “মানুষ” হয়ে উঠেছে হোমো সেপিয়েন্স নামক প্রজাতিটা? নাকি বহু ক্ষেত্রে নিজের পায়ে কুড়ুল মারছি আমরা? এই বইতে এমন একটি প্রযুক্তি নিয়ে আমাদের সাবধান করেছেন তিনি, যেটাকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে না-পারলে, সম্ভবত এটাই হবে শেষবারের মতো পায়ে কুড়ুল মারা। এরপর কুড়ুলও থাকবে না, পা-ও না, পায়ের মালিকও না। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বিষয়ে হারারি ২০১৬ সালে প্রকাশিত তাঁর Homo Deus বইটিতে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করেছিলেন বটে, কিন্তু গত আট বছরে তথ্যপ্রযুক্তির এই ক্ষেত্রটি বহু দিগন্ত অতিক্রম করে ফেলেছে।
২০২২ সালে চ্যাট-জিপিটি বাজারে আসার পর থেকে, দোকানে-বাজারে-মাঠে-ঘাটে-পথে-প্রান্তরে-ফেসবুকে-টুইটারে-ব্লগে-ভ্লগে-সংবাদপত্রের কলামে অসংখ্য মানুষ বাঁকা চোখে চাপা হেসে প্রতিনিয়ত মন্তব্য করে চলেছেন : আরে বাওয়া... মানুষের বুদ্ধি, মানুষের চেতনা, মানুষের অনুভূতি, মানুষের... ইয়ে কী যেন বলে... মৌলিক সৃজনশীলতা, এইসব আয়ত্ত করা কি অতোই সস্তা রে ভায়া? এই তো আজকে সকালেই চ্যাট-জিপিটি ব্যাটাকে দুটো সহজ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলাম। এমন হাস্যকর উত্তর দিলো, হাসতে হাসতে কাশি পেয়ে গ্যালো। এই এলেবেলে জিনিসটা নাকি মানুষকে টেক্কা দেবে, হাহাঃ!
হারারির বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় : এই বাঁকা-হাসিওয়ালা (এবং আমার মতো যারা বাঁকা হাসে না, কিন্তু এই বিষয়ে অজ্ঞ) মানুষদের প্রকৃত বিপদটা সম্পর্কে অবহিত করা। “আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স” প্রযুক্তিটি এখনও যে-পর্যায়ে রয়েছে, তাকে মানুষের জীবনচক্রের সঙ্গে তুলনা করলে বলতে হয়, এখনও সে হামাগুড়ি দিতেও শেখেনি। হাত পা ছুঁড়ে দোলনায় শুয়ে আঙুল চুষছে আর আবাবাবাবাবা গিগিগিগিগি এইসব দুর্বোধ্য কথা বলছে। কিন্তু এই দোলনা পর্যায়েই সে নিখুঁত ছন্দে কবিতা লিখছে (অসন্দিগ্ধ পাঠকের কাছে যেগুলোকে প্রতিষ্ঠিত কোনো কবির নামে সহজেই চালিয়ে দেওয়া যায়)। ওস্তাদের মতো ছবি আঁকছে (ধরিয়ে না দিলে অনেকসময় বোঝার উপায় থাকে না সেটা কোনো বিখ্যাত চিত্রকরের আঁকা নয়)। গানের সুর সৃষ্টি করছে (এটার ব্যাপারেও একই কথা)।
শেয়ার বাজার কিংবা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার বিপুল পরিমাণ জটিল হিসাবপত্র চোখের নিমেষে হজম করে ফেলছে। সুযোগ পেলে গোটা-গোটা প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখে ফেলছে। অসংখ্য ধারা-উপধারা-দফা-অনুচ্ছেদ-কার্যবিধি-সংশোধনী সম্বলিত দেশের সংবিধানের খোলনলচে মুখস্ত করে ফেলছে (যেটা কোনো একক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়)। এত বেশি পরিমাণে ফেক-টুইট কিংবা ফেসবুকে ফেক-স্ট্যাটাস পোস্ট করছে যে, ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী সেইসব নকল পোস্টের সংখ্যা— দুনিয়ার সমস্ত পোস্টের শতকরা ৩০ ভাগ! মানে প্রতি তিনটে পোস্টের মধ্যে অন্তত একটা পোস্ট কোনো মানুষ লিখছে না, লিখছে একটা AI chatbot. এমনকি এই রিভিউটা আমি নিজে লিখেছি নাকি কোনো AI ওয়েবসাইট থেকে জেনারেট করা হয়েছে (পুরোটা না হলেও কিছুটা অংশ), এই ব্যাপারে পাঠকদের ১০০% নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই!
সঙ্গত কারণেই এই উপন্যাসটি নিয়ে এপার বাংলায় কোনো আলোচনা নেই। বর্তমান জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক পরিবেশে তো আলোচনার পরিসর আরো সীমিত। বাঙালি এমনিতেই ইতিহাস লিখতে পারেনা, লিখলেও লেখে রাজারাজড়ার প্রশস্তি। সত্যি কথা বলতে, ১৯৪৯ সালে নীহাররঞ্জন রায় “বাঙ্গালীর ইতিহাস” বইটি লেখার আগে পর্যন্ত সাধারণ বাঙালি গণমানুষের ব্যাপারে কেউ কিছু লেখার চেষ্টা করেনি। সেই কবেকার চর্যাপদ কিংবা বৈষ্ণব সাহিত্য কিংবা মহাকাব্যের অনুবাদ কিংবা মঙ্গলকাব্যগুলোতে বাঙালি মানুষ এবং সমাজের ছবি ফুটে ওঠে বটে, কিন্তু এগুলোকে তো আর “ইতিহাস” বলা যায় না। বাঙালির ইতিহাস নেই।
তাই আজকের হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের মূল কারণ (এবং সমাধান) খোঁজার বদলে কেবল পারস্পরিক খিস্তি খেউড় চলে। এপার বাংলার হিন্দুয়ানি মস্তানরা “ঘর ওয়াপসি” নামক সামাজিক প্রকল্প চালু করে। ভারতে বসবাসকারী বাঙালি মুসলিমদের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার পরামর্শ দ্যায়। বাংলাদেশকে লুঙ্গিদেশ নামে ডেকে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে (অথচ নিজের পাছাতেও কাপড় নেই)। আর ওপার বাংলার মুসলমানি মস্তানরা ফেসবুকে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার বৃত্তান্ত বিষয়ে গবেষণাধর্মী থিসিস পাবলিশ করে (পিয়ার রিভিউড)। কিংবা সেভেন সিস্টার্সকে “জয় বাংলা” করার জন্য “লুকিং ফর শত্রুজ” স্লোগানকে তাক থেকে ধুলো ঝেড়ে নামিয়ে আনে। এবং আগামী দুর্গাপূজায় কী হবে সেটা এখনও বলতে পারছি না। এইসব ফুটোমস্তানি করেই দিন কাটে বাঙালি জাতির। ছোটবেলায় ইশকুলে পড়ার সময় বন্ধুরা একে অপরের প্যান্ট আচমকা পিছন থেকে টেনে নামিয়ে দিয়ে মস্করা করতাম, সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
বাংলার শেষ স্বাধীন হিন্দু রাজা লক্ষ্মণ সেনের শাসনকালের একদম অন্তিম পর্যায়ের একটি কালখণ্ড চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসে। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের বৃত্তান্ত। বুড়ো রাজা লক্ষ্মণ সেন রাজ্যশাসনের প্র্যাকটিকাল দায়দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন সামন্ত আর উচ্চবর্ণের গুন্ডাদের হাতে। শাসনের দায়ভার থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে শেষ জীবনটা অতিবাহিত করছেন তীর্থস্থান নবদ্বীপ শহরে। যোগ্য শাসকের অনুপস্থিতির সুযোগে ওই “তত্ত্বাবধায়ক” শাসকরা আক্ষরিক অর্থে যথেচ্ছ ধর্ষণ করছে গৌড়বঙ্গের আমজনতাকে। ঐতিহাসিক উপন্যাসে কল্পনার বিস্তার থাকে, তবু কল্পনার জন্যেও তো তথ্যের দরকার হয়। যৎসামান্য তথ্যকে আশ্রয় করে একটা বাস্তবসম্মত পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন শওকত আলী। তৎকালীন গৌড়বঙ্গের নিম্নবিত্ত জনসাধারণের যে অসহায় রূপটি দেখিয়েছেন, পড়তে পড়তে দমবন্ধ হয়ে আসে। চৈতন্য মহাপ্রভুর নেতৃত্বে সামাজিক গণজাগরণের প্রায় তিনশো বছর আগে, বঙ্গদেশের এত বিপুল সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল ক্যানো— এই কূটপ্রশ্নটির একটা লজিক্যাল উত্তরের আভাস আছে এই উপন্যাসে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে উপন্যাসটি অবশ্যই সার্থকতা অর্জন করেছে। কিন্তু আমার দুটো প্রশ্ন আছে।
প্রথম প্রশ্নটি উপন্যাসের নামকরণ নিয়ে। প্রদোষ মানে তো সন্ধ্যাবেলা। সন্ধ্যার পরে রাত্রি আসে। কিন্তু বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের পরে রাত্রি কি এসেছিল? লেখক কি পরবর্তী সাড়ে-পাঁচশো বছরব্যাপী ইসলামি শাসনকালকে রাত্রি হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন? দ্বিতীয় প্রশ্নটি উপন্যাসের তৎসমবহুল ভাষা নিয়ে। কয়েকটা উদাহরণ দিই। “তোমাদের খুরে দণ্ডবৎ একশতবার”, “শূকরপুত্র” (শুয়োরের বাচ্চা গালি বোঝাতে), “চুপ কর দগ্ধমুখী” (চুপ কর পোড়ামুখী বোঝাতে), “ললাটে সম্মার্জনী” (কপালে ঝাঁটা), “চক্ষুর মস্তকটি কি ভক্ষণ করে বসে আছিস?” (চোখের মাথাটা কি খেয়ে বসে আছিস?)— এরকম আরো অনেক। প্রশ্ন হলো, আটশো বছর আগেকার প্রাত্যহিক বাংলাভাষায় কি এইসব আপাত-আধুনিক বাগধারা ব্যবহার করা হতো?
এই দুটো খটকা বাদ দিলে উপন্যাসটিকে অবশ্যপাঠ্য বলে মনে হয়েছে আমার। বাংলা ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। ধর্মীয় রাজনীতির অচলায়তনে আটকে না-থেকে, বাঙালি এবার সত্যিকারের প্রশ্ন করতে শিখুক, তবেই তো সত্যিকারের উত্তর খুঁজে পাবে। উপন্যাসের “প্রদোষ” শব্দটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, কিন্তু ফুটোমস্তান বাঙালিজাতির সত্যিকারের প্রদোষকাল কি সমাসন্ন?
একরকম বিশ্লেষণ আছে যাকে বলা হয় কাটাছেঁড়া করা। আরেক রকম আছে যাকে বলা যায় : কোনো সুখাদ্যকে তারিয়ে তারিয়ে আস্বাদন করা। আলোচ্য বিষয় যেটাই হোক— মহাভারত কিংবা বরিস পাস্টেরনাক— বুদ্ধদেব বসুর বিশ্লেষণী প্রবন্ধগুলো পড়লে আমার মনে হয়, তিনি যেন আস্বাদনের তৃপ্তিকে অক্ষরের উপচারে পাঠকের হৃদয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছেন (খাদ্যের উপমা দিলাম কারণ আমি খেতে ভালোবাসি; নইলে অন্য যেকোনো উপমা ব্যবহার করা যেতে পারে— ফুলের সুগন্ধ কিংবা পাহাড়ি বাতাস!)
আর বিষয় যদি হয় “রবীন্দ্রনাথ”? তাহলে তো কথাই নেই! বুদ্ধদেবের প্রায় সমস্ত রচনাতে (তাঁর মৌলিক গল্প-উপন্যাসেও) রবীন্দ্রনাথের প্রগাঢ় উপস্থিতি। অথচ তাঁর এই রবীন্দ্রভক্তি অন্ধ নয়। রবীন্দ্রনাথকে তিনি আত্মস্থ করেছেন গবেষকের নির্মোহ দৃষ্টিতে। তাই বুদ্ধদেবের বিশ্লেষণকে আমি বিশেষ মূল্য দিই। বর্তমান বইটিতে তিনি রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক কাব্যদর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবং সেই আলোচনা, আহা, অতীব সুস্বাদু!
আমার ব্যক্তিগত জীবন, যাপিত যুগ এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে রবীন্দ্রকবিতা এবং তাঁর কাব্যশৈলীর যোজন-যোজন দূরত্ব। আমি কবিতা পড়া শিখেছি আধুনিক কবিতা পড়ে। তাই বুদ্ধদেবের মতো দিকনির্দেশকের সাহচর্য পাই বলেই রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রাসঙ্গিকতাকে উপলব্ধি করতে পারি। চিত্রকলায় পিকাসোর যেমন ছিল অপরিমেয় বৈচিত্র্য, রবীন্দ্রনাথ যেন কবিতার পিকাসো। কত যে ভিন্ন-ভিন্ন রীতি, কত যে বিচিত্র ছন্দশৈলী, কত যে বিবিধ পর্যায়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ— ভাবতে গেলে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে হয়।
যদিও এই আপাত-বিভিন্নতার মধ্যেও ছিল একটি অপ্রতিহত ধারাবাহিকতা। কোথায় যেন পড়েছিলাম : একজন কবি সারাজীবনব্যাপী প্রকৃত প্রস্তাবে একটিই কবিতা লেখেন। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এই কথাটি সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। কী ছিল তাঁর কাব্যসাধনার মূল অন্বিষ্ট? কে ছিল তাঁর সৃষ্টির উদ্দীপক (muse), তাঁর “বন্ধু”, জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে দাঁড়ায়ে থাকা তাঁর “পরান সখা”? কয়েকটি নির্বাচিত কবিতার নিবিষ্ট পাঠপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধদেব অন্বেষণ করেছেন রবীন্দ্রকবিতার সেই অবিচ্ছেদ্য ধ্রুবপদটি। এবং পাঠক হিসেবে আমাকে করেছেন সবিশেষ ঋদ্ধ।
এর বাইরেও বইটিতে রয়েছে আরো দুটি প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের “গীতাঞ্জলি” কাব্যগ্রন্থ বিষয়ে এখনও পর্যন্ত আমার পড়া সবচেয়ে মনোজ্ঞ প্রবন্ধটির দেখা পেলাম এই বইতে, প্রবন্ধটির নাম “এপার-ওপার”। যারা এখনও গীতাঞ্জলি পড়েননি, কিংবা গীতাঞ্জলি পড়তে ভালোবাসেন, উভয়ের জন্যই প্রবন্ধটি অবশ্যপাঠ্য। দ্বিতীয় প্রসঙ্গটির বিষয়বস্তুও গীতাঞ্জলির সঙ্গে খানিকটা সম্পৃক্ত।
রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার জ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নোবেল কমিটির সম্পাদক তাঁর সরকারি মন্তব্যে লিখেছিলেন : “গ্যেটের পরবর্তী ইয়োরোপীয় কবিদের মধ্যে টেগোরের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এবং এই কবিকে কোনো আর্থিক পুরস্কার অর্পণ করাটাকে বলা যায় প্রায় অধর্মাচরণ, যেন আমরা দায়ুদের স্তোত্র বা সন্ত ফ্রান্সিসের গীতিকার জন্য অর্থমূল্য দিচ্ছি।” অথচ রবীন্দ্রনাথের সেই শিখরস্পর্শী কবিপ্রসিদ্ধি আজকের দিনে পশ্চিমি বিশ্বে প্রায় শূন্য। এই বিস্মৃতির কারণ কী?
কারণ খুঁজতে গিয়ে বুদ্ধদেব খতিয়ে দেখেছেন গীতাঞ্জলি অনুবাদের পিছনে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণাকে। বিচার করেছেন বাংলা থেকে ইংরিজিভাষায় তাঁর সেই অনুবাদকর্মের পদ্ধতিকে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি পশ্চিমি বিশ্বের তৎকালীন এবং সমকালীন মনোভাবের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছেন। এবং সবশেষে মন্তব্য করেছেন : “রবীন্দ্রনাথ জগতে অজ্ঞাত থাকার জন্য যে ক্ষতিটা হচ্ছে, সেটা জগতেরই, আমাদের নয়।”
একদম খাঁটি কথা! আর তাই তো বাঙালি হিসেবে, জীবনের শত দুর্ভোগ, অপমান, আনন্দ এবং শূন্যতার মাঝে আমি রবীন্দ্রনাথে খুঁজে পাই আমার একান্ত ব্যক্তিগত সংবেদকে। এবং তাঁরই লেখা ধার করে তাঁর প্রতি উচ্চারণ করতে পারি :
আমারে তুমি অশেষ করেছএমনি লীলা তব—ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।কত-যে গিরি কত-যে নদীতীরেবেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে,কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরেকাহারে তাহা কব?
মাধব দত্ত : দ্যাখো, বড়ো বড়ো পণ্ডিতেরা সব তোমারই মতো— তারা ঘর থেকে তো বেরোয় না।
অমল : বেরোয় না?
মাধব দত্ত : না, কখন বেরোবে বলো। তারা বসে বসে কেবল পুঁথি পড়ে— আর কোনো দিকেই তাদের চোখ নেই। অমলবাবু, তুমিও বড়ো হলে পণ্ডিত হবে— বসে বসে এই এত বড়ো বড়ো সব পুঁথি পড়বে— সবাই দেখে আশ্চর্য হয়ে যাবে।
অমল : না না, পিসেমশাই, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমি পণ্ডিত হব না— পিসেমশাই, আমি পণ্ডিত হব না!
ক্ষুদ্রকায় উপন্যাস। গুটিকয় চরিত্র। সীমিত পটভূমি। এই স্বল্প আয়োজনেই বেশ জটিল একটি গল্প বুনেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিষয় : দাম্পত্য ঈর্ষা। আমার সবসময়ই মনে হয়েছে, ছোটগল্প রচনায় রবীন্দ্রনাথের যে প্রশ্নহীন সিদ্ধি, উপন্যাসের ক্ষেত্রে কী যেন এক অদ্ভুত কারণে সেই উচ্চতায় পৌঁছতে পারেননি তিনি। এমনকি তাঁর উপন্যাসের গদ্যভাষাও ছোটগল্পের তুলনায় কৃত্রিম। আজকেই বুদ্ধদেব বসুর একটি প্রবন্ধে পড়ছিলাম : রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের “পাত্রপাত্রীরা অবস্থা-নির্বিশেষে সাহিত্যিক ভাষায় কথা বলে”... তাদের “ভাবনার ভাষাও সুগন্ধি ও রাবীন্দ্রিক” (অথচ তাঁর ছোটগল্পের পাত্রপাত্রীদের কথাবার্তা মোটের উপর স্বাভাবিক)। এই উপন্যাসটি পড়েও মনে হয়েছে, মালমশলা সবকিছুই উপস্থিত ছিল, তবু রান্নায় কিছু খামতি রয়ে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে নীরজা চরিত্রটির অসহায় আত্মনিগ্রহের বর্ণনা অনেকদিন মনে থাকবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন, “ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে”। এই অসুখটির নাম ঈর্ষা।
পরিমল ভট্টাচার্যের কলম ইংরিজি ভাষাতেও সমান সরেস। ইদানিংকার লেখক-সাহিত্যিকদের মধ্যে আঙুলে-গোনা কয়েকজন আছেন যাঁরা বাংলা-ইংরিজি দুটো ভাষাতেই একইরকম উপভোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারেন। পরিমল ভট্টাচার্য সেই বিরল লেখকদের একজন।
লেখকের প্রতিটি বইতেই তাঁর একটা পরিব্রাজক সত্তা দেখতে পাই। শুধু বাড়িতে বসে বইপত্র ঘেঁটে গবেষণা নয়, উপজীব্য বিষয়বস্তুকে সরেজমিনে তদন্ত করতে তিনি দূরে দূরান্তরে চলে যান। এবারও গেছেন। শান্তিনিকেতনে, সুন্দরবনে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে, উড়িষ্যার সিমলিপাল অরণ্যে, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে, এমনকি আমার শহর নবদ্বীপেও এসেছেন।
এইসব জায়গায় গিয়েছেন বাঙালি ছোটলোকদের খোঁজে। মজা করছি না, সত্যিই। বইটির উপ-শিরোনাম হলো : Bengal Beyond the Bhadralok. ভারতবর্ষে বাঙালি বলতে গণ্য করা হয় শহুরে সংস্কৃতিপ্রেমী সফিস্টিকেটেড একটি “ভদ্রলোক” গোষ্ঠীকে। যাদের পূর্বপুরুষরা বিলেতি ঔপনিবেশিকতার সামনে প্রথম বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। প্রথম ইংরিজি শিখেছিলেন। এবং ইংরিজি শিক্ষার সমস্ত সুফল এবং কুফলগুলি প্রথম আত্তীকরণ করেছিলেন।
এদের বাইরেও রয়ে গেছে বাঙালিজাতির একটা বিরাট অংশ, যাঁরা তথাকথিত “ভদ্রলোক” নয়। শহুরে রীতি রিওয়াজ শিক্ষা দীক্ষা সংস্কৃতি সুশীলতার পালিশ লাগেনি যাদের শরীরে মনে— স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও। সেই “ছোটলোক” বাঙালিদের খোঁজে বেরিয়েছেন লেখক। খুঁজেছেন এই প্রান্তিক মানুষদের অস্তিত্ব, বুঝতে চেয়েছেন তাঁদের জীবনদর্শন, অনুভব করতে চেয়েছেন তাঁদের বেঁচে থাকার স্ট্রাগলকে। নিজে একজন ভদ্রলোক বাঙালির প্রতিভূ হয়ে অনুপ্রবেশ করেছেন ছোটলোক বাঙালির ভুবনে।
একশো বছরেরও আগে স্বামী বিবেকানন্দ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন : নীচ, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর, চণ্ডাল— সবাই তাঁর ভাই। এতদিন পরেও, আমরা সেই ছোটলোকদের ভাই বলে ভাবা তো দূরে থাক, তাঁদের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের ব্যাপারেই বা কতটুকু জানি? কতটুকু জানি অযোধ্যা পাহাড়ের সেই নারীটির ব্যাপারে, লেখাপড়া শেখার অপরাধে যাঁকে ডাইনি বলে চিহ্নিত করে গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। কিংবা উড়িষ্যার গহন জঙ্গলের ভিতরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রত্যহ চার কিলোমিটার হেঁটে পড়াশুনা করতে আসা সেই কোলহো জনজাতির বালকটিকে কি চিনি? “তোমার রাষ্ট্রের নাম কী?” — এই প্রশ্নের জবাবে যে বলেছিল : “আমার রাষ্ট্রের নাম শুখুয়াপাত্তা পাহাড়” (তার গ্রামের নাম)।
বইয়ের একদম শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি উদ্ধৃতির উল্লেখ রয়েছে : If we look into our hearts, we will have to admit that the India we know is actually the India of the bhadralok. অন্যের কথা জানিনা, আমার নিজের ক্ষেত্রে এই কথাটি সর্বাংশে সত্যি। পরিমল ভট্টাচার্যের এই পরিশ্রমী বইটির কল্যাণে যৎসামান্য হলেও সেই “অন্য” মানুষদের চিনেছি (আবারও বলছি : যৎসামান্য)। এবং মুখের বুলি, শরীরের পোশাক, কলেজের ডিগ্রি, এইসব বাহ্যিক জিনিস বাদ দিলে, ছোটলোক-ভদ্রলোকের মাঝে প্রকৃত বিভেদ আদৌ কতটুকু আছে সেই ব্যাপারেও সন্দেহ দেখা দিয়েছে মনে। লালন ফকিরের একটি বিখ্যাত গানের উল্লেখ আছে বইতে, সেটা দিয়েই আমার কথা শেষ করি।
পণ্ডিত কানা অহংকারেমাতবর কানা চুগলখোরে পণ্ডিত কানা অহংকারেসাধু কানা অনবিচারে...বেদ-বিধির পর শাস্ত্র কানাআরেক কানা মন আমারএসব দেখি কানার হাটবাজার!
ঔপনিবেশিক বঙ্গদেশে উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবারের সামাজিক লেক্সিকনে “পশ্চিম” নামে একটি শব্দ ছিল। এই পশ্চিম দিকনির্দেশক পশ্চিম নয়, স্থাননির্দেশক পশ্চিম। তৎকালীন রাজনৈতিক মানচিত্রে বৃহত্তর বাংলাপ্রদেশের সঙ্গে বিহার রাজ্যটি যুক্ত থাকলেও, বাঙালি নিজের জাতিগত সম্ভ্রান্ত-অবস্থানের সঙ্গে সেই রাজ্যের “লিট্টিখোর খোট্টা” বিহারি মানুষ এবং সংস্কৃতিকে একই আসনে স্থান দিতে ইচ্ছুক ছিল না। তাই “পূর্ববঙ্গ” নামের একটি আঞ্চলিক ধারণা প্রচলিত থাকলেও, স্বাধীনতাপূর্ব বাঙালির মননে “পশ্চিমবঙ্গ” বলে কিছু ছিল না। ছিল শুধু “পশ্চিম”। কেবলই পশ্চিম। এর চেয়ে বেশি সম্মান দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।
এবং সেই অঞ্চলটি ছিল “ড্যাঞ্চি”। অর্থাৎ “damn cheap”। মানে, নেহাতই সস্তা। জলের দর। বাঙালি বাবুরা পশ্চিমে যেতেন ছুটি কাটাতে, কিংবা “হাওয়া বদল” করতে, কিংবা আমাশয়, অগ্নিমান্দ্য (বর্তমানে “অম্বল”), ক্ষুধামান্দ্য (বর্তমানে “একদম ক্ষিধে হচ্ছে না, ডাক্তারবাবু”), বদহজম-পীড়িত বাঙালির চিরাচরিত উদরসমস্যার উন্নতিকল্পে (কারণ সেই অঞ্চলের খনিজসমৃদ্ধ জল-হাওয়া ছিল ক্ষুধা এবং সুস্বাস্থ্য উদ্রেককারী)। এবং শহর কলকাতার বনেদি বাজারহাটের অগ্নিমূল্যের তুলনায় সেই পশ্চিমের দেহাতি বাজারের জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক সস্তা দর প্রত্যক্ষ করে বাবুদের মুখ থেকে ছিটকে বেরোতো এই কথাটি : Damn cheap! উচ্চারণের বিবর্তনে কথাটি রূপান্তরিত হয় “ড্যাঞ্চি”তে। পরিমল ভট্টাচার্যের বইটি বাঙালির সেই অতীত ড্যাঞ্চিভূমির একটি অভিনব আখ্যান।
শুধু জিনিসপত্র নয়, সেই অঞ্চলের মানুষও ছিল ড্যাঞ্চি। বিহারি বাদ দিলেও, ছোটনাগপুর মালভূমির বিস্তীর্ণ জঙ্গল-অধ্যুষিত অঞ্চলটির ভূমিসন্তান ছিলেন সাঁওতাল, হো, মুন্ডা, ওরাওঁ, কোল, ইত্যাদি অসংখ্য জনজাতিরা (যাঁরা ইদানিং মূলত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অধিবাসী)। কিন্তু সামাজিক অবস্থানের নিরিখে নিজেদের ভূমিতেই তাঁরা ছিলেন সবচেয়ে অবহেলিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত। যে-অঞ্চলে খাদ্যবস্তুর অস্বাভাবিক সস্তা দর দেখে বাঙালি বাবুরা Damn cheap বলে উল্লসিত হয়ে উঠতেন, সেই একই অঞ্চলের স্থানীয় মানুষদের কাঁধে নিয়মিত চেপে থাকতো খাদ্যের অনটন, দুর্ভিক্ষের জোয়াল। শোষণের এক বিচিত্র সহাবস্থানে বহিরাগত বাঙালিদের তৈরি করা সুদৃশ্য রুচিশীল বাগানবাড়িতে ভৃত্যের কাজ করতো সেই অঞ্চলের বুভুক্ষু মানুষরা।
পরিমল ভট্টাচার্যের এই ড্যাঞ্চি-আখ্যানে শুধু ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল নয়, ক্রমশ উঠে এসেছে ব্রিটিশ আমলের খাদ্যসংকটে জর্জরিত আরো অনেক মানুষের কথা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতায় আছে : “মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি”। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আছে : “বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী, যা হোক একটা দাও কিছু হাতে, একবার ম'রে বাঁচি!” কেমন ছিল সেই ঘর? কেমন ছিল সেই ম'রে বাঁচা? বাঙালিজাতির জাতিগত উৎকর্ষের সফেদ দেয়ালে কুৎসিত ঘুঁটের মতো লেপ্টে আছে মন্বন্তরের স্মৃতিদাগ। যে-দাগ জন্মদাগের মতোই চিরন্তন। ক্রনিক চুলকানির মতো নাছোড়বান্দা। কলকাতা শহরের সুরম্য পথঘাটের আনাচে কানাচে এখনও রয়ে গেছে গগনবিদারী “একটু ভাত দিন গো”... “একটু ফ্যান দিন গো” আর্তচিৎকারের যূথবদ্ধ প্রেতাত্মারা। শিল্পীর আঁকা উডকাট ছবিতে, ফটোগ্রাফারের তোলা সাদাকালো স্থিরচিত্রে, আজও রয়ে গেছে সেই কঙ্কালসদৃশ মানুষদের অশরীরী ছায়া, জ্বলজ্বলে ক্ষুধার্ত চোখের তীব্র চাহনি।
অর্থাৎ জিনিসপত্র নয়, আসলে মানুষই বড় সস্তা। সামাজিক পিরামিডের উঁচুনিচু সহাবস্থানের নকশায় একদল মানুষ আরেকদল মানুষকে বানিয়ে রেখেছে ড্যাঞ্চি। মানুষেরই তৈরি সভ্য সমাজে মানুষ পোকামাকড়ের মতো মারা যায়, কুকুরের মতো (এবং কুকুরেরই সঙ্গে) ডাস্টবিন থেকে খাবার খুঁটে খায়, গবাদি পশুর মতো নির্বিকারে ত্যাগ করতে বাধ্য হয় নিজের মানুষিক আত্মমর্যাদা। ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাসের পঙ্কিল ঘোলাজলে ডুবসাঁতার দিয়ে পরিমল ভট্টাচার্য তুলে এনেছেন অস্বাভাবিক সস্তা মানুষদের কতিপয় প্রত্নচিহ্ন। কখনও কলকাতা শহরের বেওয়ারিশ লাশে-ঢাকা রাজপথে, কখনও ছোটনাগপুরের রুক্ষ প্রকৃতির মাঝে, কখনও দেশভাগের অবাঞ্ছিত জারজ সন্তান উদ্বাস্তুদের কলোনিতে, কখনও ভোরবেলায় গড়ের মাঠে নকশাল বিপ্লবীর পলাতক উদ্বায়ী জীবনে, তিনি খুঁজে খুঁজে ফিরেছেন ড্যাঞ্চি মানুষদের, অবিশ্বাস্য সস্তা মানুষদের।
বিষয়বস্তুর মতোই বইটির রচনাশৈলীও অভিনব। একটি নির্দিষ্ট পথরেখা ধরে চলেনা লেখকের বর্ণনা। এমনকি ভাষাতেও যেন জড়িয়ে রয়েছে স্মৃতিচারণের উচ্ছৃঙ্খল ঘোরগ্রস্ততা। বর্তমান বাংলা নন-ফিকশন সাহিত্যে পরিমল ভট্টাচার্যের গদ্য সম্ভবত সবচেয়ে মৌলিক, সবচেয়ে সুখপাঠ্য। সেই সুখপাঠ্য গদ্যের খাঁজে লেখক অবলীলায় গুঁজে দিয়েছেন বিষাদের বেহালাকান্না। প্রকৃতির শিশিরনিবিড় বর্ণনার মাঝে হঠাৎ ছুঁড়ে দিয়েছেন আনরোমান্টিক অস্তিত্বের নিঃশব্দ হাহাকার। ছড়ানো ছেটানো এলেমেলো ইতস্তত খাপছাড়া এই রচনাশৈলী যেন মানুষেরই খাপছাড়া জীবনের দ্যোতক। যে-জীবন অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোত ভালোবাসে। যে-জীবন সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের মতো খেলা করে। যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের। যে-জীবন চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে অশ্বত্থের কাছে এক গাছা দড়ি হাতে একা-একা হেঁটে যায়।
যে-জীবন ড্যাঞ্চি। হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
(কলকাতার রাজপথ, ১৯৪৩ সালের মন্বন্তর।
শিল্পী: জয়নুল আবেদিন)
খুবই ফালতু লেগেছে পড়ে। যেমন ফালতু গদ্যের স্টাইল, তেমনি ফালতু গল্পের বিষয়বস্তুর উপস্থাপন। তার উপরে ন্যাকামির চোটে মাথা ধরে গেসলো। বইটা শেষ করে রিভিউ হিসেবে একটা লাইনও লিখতে ইচ্ছে করছিল না! তবু কয়েকটা বিষয় উল্লেখ করি: এই বইতে খুব অন্যায় একটা কাজ করেছেন লেখিকা, ডোমেস্টিক অ্যাবিউজকে গ্লোরিফাই করেছেন। শারীরিক অত্যাচার সত্ত্বেও কোনো কোনো নারী ক্যানো নিজের পার্টনারকে ত্যাগ করতে পারেনা, এটার একটা প্রচণ্ড অপমানজনক যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেছেন উনি। এই গল্পের প্রধান নারীচরিত্রকে দিয়ে এমন কিছু কাজ করিয়েছেন, নিজের আত্মসম্মানের ব্যাপারে সচেতন কোনো স্বাধীনচেতা মানুষ এইসব কাজ করতে পারেনা। কিভাবে এই বই এত জনপ্রিয় হলো ভেবে আশ্চর্য হচ্ছি। অবশ্য Animal কিংবা Kabir Singh-এর মতো সিনেমা যদি সুপারহিট হয় তাহলে এই বই কী দোষ করেছে!
“পাহাড়ের মানুষ মানেই সরল (পড়ুন : বুদ্ধিহীন), আবেগপ্রবণ (পড়ুন : রগচটা), সাধাসিধে (পড়ুন : অল্পে খুশি) ও অনুগত (পড়ুন : প্রশ্ন করে না, সহজে বশ্য, গৃহপালিত পশুর মতো) — সমতলের বাঙালির এই ধারণাগুলো শাসকের মতো, প্রতিবেশীর মতো নয়। এই ধারণার চাষ হতে দেখেছি প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে। এই চাষ থেকে উঠে এসেছে যে ফসল তার নাম : ক্ষোভ।”
আমার মতো সমতলের মানুষদের কাছে দার্জিলিং স্রেফ একটি শৈলশহরের নাম। দার্জিলিং তো যেকোনো হেঁজিপেজি শৈলশহর নয়, ইংরেজরা একে আদর করে ডাকতো “The Queen of Hill-stations” নামে। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের কাছে আরো গর্বের ব্যাপার হলো দার্জিলিং আমাদেরই রাজ্যে অবস্থিত। হাতে যদি দিন-তিনেকের ছুটি পাওয়া যায়, ছাপোষা বাঙালি তিনটে জায়গায় দৌড়ে যায়। দীঘার সমুদ্রসৈকত, শান্তিনিকেতন, অথবা দার্জিলিং। কিন্তু একদা যে-শৈলশহরটি ছিল পাহাড়ের রানি, সেই রানি আজ কাঙাল হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কিংবা আর্থ-সামাজিক, যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখা হোক না ক্যানো, অধুনা একটি দীর্ঘশ্বাসের নাম দার্জিলিং।
লেখক প্রথম দার্জিলিঙে যান কর্মসূত্রে। নিবিড় কুয়াশাঘেরা এবং স্মৃতির মলিন জলরঙে আঁকা এই শহরটিকে আপন করে নেন ধীরে ধীরে। সাধারণ বাঙালি ট্যুরিস্টের আদিখ্যেতা-মার্কা নজরের বাইরে একটা আলাদা নজরে এই শহরকে দেখতে শুরু করেন। যে শহরকে আমরা ভালোবাসি সেই শহরের সমস্যাগুলো আমরা এড়িয়ে যাই না। সেই শহরের মানুষদের আমরা “ইউজ অ্যান্ড থ্রো” হিসেবে ব্যবহার করি না। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করি, তাদের সুখ-দুঃখ-স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গের দিনলিপির সঙ্গে পরিচিত হই। এক অনবদ্য মুনশিয়ানায়, আন্তরিকতায়, অভিনিবেশে, লেখক এই বিরল কাজটি করেছেন। শুধু নস্টালজিয়ার রঙিন চশমাটি নাকে ঝুলিয়ে রাখেননি, হাতে রেখেছেন আরো দুটো জিনিস। একটা আয়না আর একটা আতসকাচ।
কীভাবে একটি শহর হয়ে যায় মানুষের অন্ধ ফুর্তিবাজির শিকার। কীভাবে একটি শহর হয়ে যায় ভোট-রাজনীতির ক্রমিক ক্রীড়নক। কীভাবে একটি গোটা শহরের মানুষ হয়ে যান বহিরাগত ফুর্তিবাজদের একনিষ্ঠ চাকরবাকর। কীভাবে একটি শহরের রমণীয় সৌন্দর্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকে আত্মপরিচয়হীন অস্তিত্বের তীব্র যন্ত্রণা। কীভাবে একটি প্রজাপতির অতীত ইতিহাসজুড়ে লেখা থাকে কেবল শুঁয়োপোকার কুৎসিত দংশন। আমরা যারা একবারের জন্যেও দার্জিলিঙে গেছি, পরিমল ভট্টাচার্যের এই হতশ্রী দার্জিলিংকে কিন্তু কমবেশি আমরা সবাই চিনি। কিন্তু ফুর্তির নেশায় অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে ছিলাম। সূর্যোদয়ের মনভোলানো কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখে হুল্লোড়ে মেতে ছিলাম, তাই আপামর শহরটার ক্ষীণ কান্নার শব্দ আমাদের কানে এসে পৌঁছায়নি। লেখক আমাদের চোখ আর কান দুটোই খুলে দিয়েছেন। কিছু কিছু বই অতর্কিতে হানা দ্যায় পাঠকের সুসজ্জিত চেতনায়। এটি তেমনই একটি বই।
মধ্যযুগে রাজস্থানের রাজপুতদের ইতিহাস এমন কিছু গৌরবের ছিল না। ভারতীয়রা মোটের উপর যুদ্ধপ্রবণ মানুষ নয়, কিন্তু রাজপুতরা ছিলেন ব্যতিক্রম। যোদ্ধা বলেই হয়তো সাধারণ ছাপোষা ভীরু ভারতীয়দের মনে তারা রেখাপাত করতে পেরেছিলেন। যদিও তাদের প্রতিশোধস্পৃহা, নৃশংসতা, উগ্র জাত্যভিমান—এইসব গুণকে কিছুতেই প্রশংসার যোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।
অবনীন্দ্রনাথের এই বইটিকে ক্যানো যে “কিশোরপাঠ্য” হিসেবে গণ্য করা হয় সেটা ভেবে অবাক লাগে। অবনীন্দ্রনাথের ভাষায় এবং গল্প বলার কায়দায় কিছু সহজিয়া বিশেষত্ব আছে ঠিকই; কিন্তু এইরকম হিংসা, হানাহানি, নরহত্যার গ্র্যাফিক বর্ণনা পড়ে কিশোর-কিশোরীরা কীভাবে উপকৃত হতে পারে তা আমি বুঝিনা। তাছাড়া, রাজস্থানের ‘ভিল' কিংবা ‘মিনা' জনজাতিদের উপরে অত্যাচারের ঘটনাকে যেরকম “স্বাভাবিক” হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেটাও কাঙ্ক্ষিত নয়।
সহিংসতাকে শৌর্য হিসেবে কিংবা প্রতিশোধ নেওয়াকে আত্মমর্যাদা হিসেবে বিবেচনা করা, স্বার্থসিদ্ধির কারণে যেনতেন উপায়ে শত্রুর নিধন (এমনকি নিজের ভাইকেও), প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ‘জংলী' হিসেবে চিহ্নিত করা—নিজের ছেলেমেয়েদের যারা এইসব জরুরি বিষয়ে শিক্ষা দিতে আগ্রহী, তাদের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য। বুড়োরাও যদি এইসব “বীরত্বব্যঞ্জক উপাখ্যান” উপভোগ করেন, তারাও মিস করবেন না।
তাঁর লেখা চিঠিপত্র পড়লে আমার সামনে একটা ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ। চিঠি তিনি লিখেছেন বিস্তর। নিজের গহন আন্তরিক সত্তাকে চিঠির পৃষ্ঠায় যতটা উন্মোচিত করেছেন, অন্য কোথাও এতটা করেননি মনে হয় (গান বাদ দিয়ে)। মনের মতো পত্রসঙ্গী পেলে তাঁর যেন আলাদা একটা দেখার চোখ খুলে যেত, একটা আলাদা ভাবার মন আবিষ্কৃত হতো, কলমের কালির রং পাল্টে যেত।
তাঁর লেখা চিঠিপত্রগুলো খণ্ডে খণ্ডে সংকলিত হয়েছে। প্রথম এই খণ্ডটিতে রয়েছে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লেখা চিঠির সম্ভার। জীবনে অনেক নারীর সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রায় ঘনিষ্ঠতা হয়েছে তাঁর, কিন্তু যাকে বলে ‘জীবনসঙ্গিনী', তা একমাত্র মৃণালিনী ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।
সাধারণ আলাপ-আলোচনা-আড্ডা-বিতর্কে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরী দেবী, লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়, ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, নির্মলকুমারী মহলানবীশ, এমনকি বিদেশিনী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর নাম উঠে আসে অহরহ। কিন্তু এই চিঠিগুলো পড়লে বোঝা যায়, স্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর মানসিক যোগাযোগ ছিল যথেষ্ট অন্তরঙ্গ। স্ত্রীর কাছেও মনের কথা, প্রাণের কথা, হাসি ঠাট্টার কথা, নিতান্ত ঘরোয়া কথা, কিংবা গভীর জীবনদর্শনের কথা আদানপ্রদান করেছেন তিনি।
“ভাই ছুটি” সম্বোধন করে মৃণালিনীকে লেখা চিঠিগুলোতে রবীন্দ্রনাথের একটি দাম্পত্য প্রেমিক-রূপ দেখতে পাই। স্ত্রীর জীবনাবসানের পরে স্বাভাবিকভাবেই যেটা আর কখনও কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না। অনেক নারীর কাছে অনেকরকম ভাষায়, অনেকরকম গভীরতায়, নিজেকে প্রকাশ করেছেন বটে, কিন্তু ইংল্যান্ড যাওয়ার পথে জাহাজ থেকে কল্পনায় জোড়াসাঁকোয় গিয়ে ঘুমন্ত স্ত্রীকে “একটু আধটু আদর” করার ইচ্ছের কথা, কিংবা “অনেক হামি” খাওয়ার কথা, আর কোনো নারীকে বলেছেন বলে জানা নেই আমার (রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় জানতে পারেন)।
ব্যক্তিগত কথাবার্তা ছাড়াও এই চিঠিগুলোতে রয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশের (মূলত পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলের) সেই অলৌকিক বর্ণনা, যা কিনা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের অন্যতম ট্রেডমার্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
“চারিদিকের সবুজ ক্ষেতের উপরে স্নিগ্ধ তিমিরাচ্ছন্ন নবীন বর্ষা ভারী সুন্দর লাগচে। বসে বসে মেঘদূতের উপর একটা প্রবন্ধ লিখচি। এই প্রবন্ধের উপর আজকের এই নিবিড় বর্ষার দিনের বর্ষণমুখর ঘনান্ধকারটুকু যদি এঁকে রাখতে পারতুম, যদি আমার শিলাইদহের সবুজ ক্ষেতের উপরকার এই শ্যামল আবির্ভাবটিকে পাঠকদের কাছে চিরকালের জিনিস করে রাখতে পারতুম, তাহলে কেমন হত!”
.