অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের ব্যাপারে অনেক শুনেছি, তাই তাঁকে জানতে আগ্রহী হয়েছিলাম। আহমদ ছফার বিখ্যাত বইটি পড়ে তাঁকে কতটুকু জানতে পেরেছি জানিনা, কিন্তু বেশ আশাহত হয়েছি। বইয়ের শুরু হয়েছে একটি প্রবচনকে (যেটি থেকে বইয়ের শিরোনামটি গ্রহণ করা হয়েছে) ভুল ভাবে উদ্ধৃত করে। সূচনাতেই সেই যে আমার ভ্রু কুঁচকে গেছিল, গোটা বইটি পাঠের সময় সেই ভ্রু স্বাভাবিক হয়নি। ভূমিকাতে লেখক অনুযোগ করেছেন যে, অনেকেই সন্দেহ করেছেন তিনি নিজের বক্তব্য অধ্যাপক রাজ্জাকের জবানিতে প্রকাশ করেছেন। সত্যি কথা বলতে, বইটি পড়ার পরে আমিও এই সন্দেহে ভুগছি।
অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে চেনার উদ্দেশ্যে এই বইটি হাতে তুলে নিয়েছিলাম। তিনি যেহেতু জ্ঞানচর্চা জগতের মানুষ, তাই তাঁর চিন্তাধারা, কাজের প্রেরণা, কাজ করার পদ্ধতি, মূলত এইসব বিষয় নিয়ে আগ্রহী ছিলাম। তিনি নিজে বিশেষ কিছু লেখেননি, কিন্তু তবু তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। এই বই থেকে তাঁর সেই কিংবদন্তিসম পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেয়েছি? নাহ, প্রায় গোটা বই জুড়ে তিনি বিদ্যাচর্চা এবং রাজনীতিজগতের বিখ্যাত মানুষদের নিয়ে গসিপ করে গেছেন। নজরুল ইসলামের সঙ্গে দিলীপ রায়ের রেষারেষি ছিল। ফজলুল হক মিথ্যে অভিনয় করতে পারদর্শী ছিলেন। সোহরাওয়ার্দির নামের টাইটেলটা নকল, জীবনধারণের জন্যে তাঁকে “চাঁদার টাকার উপর ডিপেন্ড করতে অইত”। “রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা আছিল ঠিকই” কিন্তু তাঁর মধ্যে বড় মানুষের ছায়া নাই। ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী নাকি তাঁর বইতে “এক্কেরে মনগড়া সব কথা লেইখ্যা থুইছে”। দীনেশচন্দ্র সেন “ওয়াজ রিয়্যালি এ গ্রেট ম্যান, এদিক সেদিক কিছু ব্যাপার আছে, তার পরেও”। কিন্তু ডাক্তার বিধান রায় খারাপ, কারণ দীনেশ সেন যখন অসুস্থ হয়েছিলেন, বিধান রায় দুই হাজার টাকা ফিস দাবি করেছিলেন। নীলরতন সরকার ভালো, কারণ তিনি ফিস মকুব করে দিয়েছিলেন। একই কারণে চিত্তরঞ্জন দাশ খারাপ, কারণ তিনি আলিপুর বোমা মামলায় ফিস নিয়েছিলেন। কিন্তু ভালো কে? ভালো হলেন মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ, কারণ তিনি “একমাস ধরে তিলকের একটা মামলা করছেন, কিন্তু ফিস নেন নাই”। বঙ্কিমচন্দ্র মুহসিন স্কলারশিপের টাকায় পড়াশোনা করেছিলেন, তারপর “মুসলমানের বিরুদ্ধে কলম ধইর্যা সেই ঋণ শোধ করছিলেন”। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় বিদ্যাসাগর কঠিন প্রশ্ন করেছিলেন, বঙ্কিমকে গ্রেস মার্কস দিয়ে বিএ পাশ করতে হয়েছিল, তাই তিনি বিদ্যাসাগরের উপর খাপ্পা ছিলেন। অধ্যাপক রাজ্জাকের পিএইচডি গাইড হ্যারল্ড ল্যাস্কিও নাকি স্কলার হিসেবে অত উচ্চশ্রেণীর ছিলেন না। ক্ষীতিমোহন সেন (গোটা বইতে ক্ষিতিমোহন সেনের নামের বানান এটাই লেখা হয়েছে) নাকি “রাইগ্যা গেলে প্রচণ্ড অইয়া উঠতেন। আশু সেন (অমর্ত্য সেনের বাবা) আছিলেন ক্ষীতিমোহনবাবুর জামাই। যখন জানতে পারলেন, আগে আশুবাবু আরেকটা মেমসাহেব বিয়া করছিলেন, ক্ষীতিমোহনবাবু জামাইরে খুন করবার লইছিল”। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যে-বিষয়ে পিএইচডি করেছিলেন, “সে বিষয়ে কাজ করার যোগ্যতা আছিল না”। মাওলানা আবুল কালাম আজাদের “সত্য কথা বলার অভ্যাস আছিল খুব কম, অ্যান্ড হি ওয়াজ এ কনজেনিটাল লায়ার”।
এইরকম ভিত্তিহীন, মনগড়া এবং কিছু কিছু রীতিমত আপত্তিজনক গসিপকে আমি “পাণ্ডিত্য” মানতে রাজি নই। এইসব হাবিজাবি মন্তব্য পড়ার জন্যে আমি এই বইটা হাতে নিইনি।
শুধু ভিত্তিহীন নয়, কিছু মন্তব্য পুরোপুরি অসত্যও বটে। দুটো উদাহরণ দিই।
(এক) বইতে আছে “রামমোহনরে বিলাত পাঠানোর সময় রাজা টাইটেল দিলেন বাহাদুর শাহ”। ভুল তথ্য। রামমোহনকে রাজা টাইটেল দিয়েছিলেন মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর। এই ফাঁকে অবশ্য রামমোহনের ব্যাপারেও গসিপ করে নিয়েছেন : “ঘুষ খাওন থেইক্যা শুরু কইর্যা তার গুণের অন্ত আছিল না”। রামমোহন রায় তাঁর প্রথম বইটি লিখেছিলেন ফারসি ভাষায় : “তুহফাত-উল-মুহাহহিদিন”, কিন্তু অধ্যাপক রাজ্জাকের মন্তব্য : “ইচ্ছা করলেই আরবি উর্দু ফারসি সংস্কৃত ইংরিজি সব ভাষাতেই লিখতে পারতেন। এক্কেরে ডাইনে বামে না তাকাইয়া হি চুজ টু রাইট ইন বেঙ্গলি, এইডাই তার বড় কাজ”।
(দুই) “লাইফ ম্যাগাজিন ইন্ডিয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্সের ওপর একটা কভার স্টোরি করছিলো। অগ্নিহোত্র অনুষ্ঠানে নেহরু খালি গায়ে বইস্যা মন্ত্র পড়ছেন”। স্বঘোষিত নাস্তিক জওহরলাল নেহরুর ব্যাপারে এই বর্ণনা শুনে হতভম্ব হয়ে গেছি! কোথা থেকে পেলেন এইসব জিনিস? স্বপ্নে?
তারপর আছে অধ্যাপক রাজ্জাকের “নিজস্ব মতামত”। এই মতামতগুলো দেখে আজকালকার সবজান্তা ফেসবুক পণ্ডিতদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। যেসব মতামতের পিছনে কোনো লজিক নেই, আছে কেবল গায়ের জোর। তিনটে উদাহরণ :
১) “গান্ধি ছাড়া ইংরেজ আমলের আর কারো ইংরিজি লেখাই টিকব না”। জওহরলাল নেহরুর লেখা? “উঁহু টিকব না”।
২) কবি সমর সেন যদি বাংলায় লিখতেন তাহলে তিনি রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে যেতেন।
৩) ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পঞ্চাশ বছর পরেও ভারতীয়রা একটা লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তৈরি করতে পারেনি, তাই “তারা একলগে থাকব কী কইর্যা আমি ত চিন্তা করবার পারি না”। [ভারতীয় সমাজের বৈচিত্র্যময় এবং বহুধাবিস্তৃত জাতীয় চরিত্রটির ব্যাপারে সামান্যতম ধারণা যদি কারো থাকে, তাহলে তিনি এই মন্তব্য করতে পারেন না!]
এরকম আরো বিবিধ অদ্ভুত মন্তব্য, মতামত এবং “বিশ্লেষণে” ভর্তি হয়ে আছে এই বইটির পৃষ্ঠা। কিছু কিছু কথাবার্তাকে তো সোজাসুজি মনগড়া ছাড়া অন্য কিছু বলার উপায় নেই। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নাকি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যাপারে বলেছিলেন, “যে মানুষ চৌদ্দটা পোলা মাইয়ার জন্ম দিছেন, হে সাধনা করবার সময় পাইল কখন!” কোথায় পেলেন তিনি এইসব গাঁজাখুরি কথা?! সমগ্র বই জুড়ে আছে অধ্যাপক রাজ্জাকের সরল জীবনযাপন এবং ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলার জন্যে গুণগান। পাণ্ডিত্যের সঙ্গে এই দুটোর সম্পর্ক কোথায়? তাঁর সরল জীবন এবং ঢাকাইয়া জবানের পরিচয় দিতে গিয়ে পাণ্ডিত্যের বিষয়টাই অগ্রাহ্য করা হয়েছে অত্যন্ত খাপছাড়া এবং অপরিকল্পিতভাবে রচিত এই বইতে। খুব খুব অবাক হয়েছি এইসব পড়ে। মাঝে মাঝে শুধু অবাক নয়, হতবাক হয়েছি। হতবাক হওয়া একটি অংশের উদ্ধৃতি দিয়েই শেষ করবো এই রিভিউ।
আমি বললাম, বাংলার ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু বলেন।স্যার বললেন, বাংলার ভবিষ্যত সম্পর্কে আমি আর কী কমু। সে ত আপনেগো উপর। মিঃ জিন্নাহ ত বেঙ্গল আপনেদেরে দিয়া দিছিলেন, আপনেগো চিত্তে সুখ অইল না, বেঙ্গল পার্টিশন করলেন।
এইসব পড়ার পরে, সত্যিই আমার মনে সন্দেহ জেগেছে, সত্যিই কি অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মতো একজন বিদগ্ধ মানুষ এইসব কথা বলতে পারেন? নাকি অন্য কোনো রহস্য আছে যা আমি ধরতে পারিনি?
সিনেমাটা অনেকেই দেখেছেন। আমি এখনও দেখিনি, বইটাও পড়া ছিল না। মাত্র ১৭১ পৃষ্ঠার একটি নভেলা। বিষয়বস্তু : প্রেম।
প্রেমের উপন্যাস পড়তে কেমন যেন লাগে। গুরুত্বপূর্ণ কতো উপন্যাস পড়া বাকি এখনও, যেসব উপন্যাসে সামাজিক কিংবা মানবিক জটিলতাকে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে। সেইসব “দরকারি” লেখা ছেড়ে প্রেমের উপন্যাস পড়ে সময় নষ্ট করবো?
তবু পড়লাম। পড়ে কিন্তু ভালো লাগলো। গল্পের প্রধান চরিত্ররা অল্পবয়েসি প্রেমিক-প্রেমিকা নয়। সংসারী এবং মধ্যবয়স্ক। প্রেমের মাঝে বিপত্তি তাই বেশি। দ্বন্দ্ব বেশি। গভীরতাও বেশি।
কাহিনির সারবস্তু দুই পৃষ্ঠাতেই লিখে ফেলা যেত। কিন্তু লেখকের রচনাশৈলী বেশ উপভোগ্য। তিনি ধীরে সুস্থে গল্পটা বলেছেন আমাদের। প্রেমের মতো জরুরি এবং অনিবার্য বিষয়ও আজকের দিনে “বাবু, খাইছো?” ঠাট্টায় পরিণত হয়েছে। ইট-চাপা ঘাসের মতো তবুও কয়েকদিন সূর্যালোকের স্পর্শ পেলেই, প্রেম এখনও, এত ঠাট্টা সত্ত্বেও, গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে।
বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একাদৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখাহয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলেআজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলেকিন্তু তুমি নেই বাহিরে, অন্তরে মেঘ করেভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!
(শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই গোটা রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপ জুড়ে চালু হয়েছিল রাষ্ট্রের দ্বারা সার্বিক পুলিশি নজরদারির ব্যবস্থা। দেশের জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনকে যেমন কড়া পাহারায় রাখা হয়েছিল, বাইরের দুনিয়ার থেকেও নিজেদের আড়াল করে রেখেছিল রাশিয়া এবং রাশিয়াসংলগ্ন দেশগুলো। মূলত মহামানব জোসেফ স্ট্যালিনের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ঘোমটার তলায় এই খ্যামটা নৃত্য। আরেকজন মহামানব উইনস্টন চার্চিল (জোসেফের পুরাতন বন্ধু) রাশিয়ার এই ঢাক ঢাক গুড় গুড় স্বভাবের নামকরণ করেছিলেন : “আয়রন কার্টেন”, অর্থাৎ লোহার তৈরি যবনিকা। রতনে রতন চেনে, শুয়োরে চেনে কচু।
এই বিশাল অঞ্চলের মানুষ এবং সমাজব্যবস্থার ব্যাপারে সারা বিশ্বের মানুষ প্রায় কিছুই জানতে পারছিল না। সত্যি কথার পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়েছিল হরেক রকম গুজব। বইয়ের শুরুতেই জন স্টাইনবেক শপথ করে নিয়েছিলেন, তিনি সোভিয়েত দেশে যেতে চান প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। তিনি লিখেছেন, নিজের চোখে যা দেখবো তাই লিখবো। কিন্তু কথা দিয়ে তিনি কথা রাখতে পারেননি। শুরুর দিকে বিনয়ী হওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বই যত এগিয়েছে ধীরে ধীরে খসে পড়েছে বিনয়ের মুখোশ। সূক্ষ্ম তাচ্ছিল্যের সুর ঢুকে পড়েছে বর্ণনায়। সরাসরি প্রকাশ করা দম্ভের চেয়ে ছদ্ম-বিনয় বেশি অস্বস্তিকর। “সকল দেশের রানি সে যে মোদের আমেরিকা” গানটির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি জন স্টাইনবেকের মতো মানবতাবাদী সাহিত্যিকও!
অনেক কিছু জানতে পেরেছি যদিও। মস্কো-লেলিনগ্রাদ কেন্দ্রিক প্রচলিত ভ্রমণরীতির বাইরে বেরিয়ে তিনি ঘুরতে গেছেন ইউক্রেন এবং জর্জিয়াতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরেই এইসব দেশের পরিস্থিতির বিবরণ কোনো বইতে পাইনি আগে। স্টাইনবেকের বর্ণনার চেয়েও আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে বইয়ের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত বিখ্যাত ফটোগ্রাফার রবার্ট কাপা-র তোলা অজস্র সাদাকালো ছবি। প্রসঙ্গত, রাশিয়া ভ্রমণে স্টাইনবেকের সঙ্গী ছিলেন স্বয়ং কাপা।
শব্দের চেয়ে ছবির শক্তি বেশি— এই কথাটায়, পুরোপুরি না হলেও, কিছুটা সত্যতা আছে! স্টাইনবেকের খোঁচা-দেওয়া গদ্যের চেয়ে কাপা-র ছবি দেখে রাশিয়াকে বেশি ভালো চিনতে পেরেছি আমি। বইটি লেখা হয়েছে ১৯৪৭ সালে। রাশিয়ার মানুষের সর্বনাশের সাতকাহন তখন সবে শুরু হয়েছে, যা শেষ হতে বাকি আরো পাঁচ দশক! এবং ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হতে হতে, দেশের জনগণের উপর রাশিয়ার এই নজরদারির স্বভাব আয়ত্ব করে ফেলবে আমেরিকা নিজেও— নজরদারিকে নিয়ে যাবে শিল্পের উচ্চতায়!
(জর্জিয়ার চা বাগান, আলোকচিত্রী - রবার্ট কাপা)
ব্যাস, পরপর দুটো বই হিট করেছে, এবার শুরু হয়ে গেছে আলতুফালতু লেখা।
ভাবলাম, অনেক দিন পরে নতুন একজন ভালো গোয়েন্দা চরিত্রের আগমন ঘটেছে বাংলা সাহিত্যে। ও বাবা, এই বইতে দেখি কাহিনিটাও পুরোপুরি গুছিয়ে শেষ করবার গরজ দেখাননি লেখকমশাই, রহস্যের অর্ধেক সমাধান করেই বই খতম! এরকম কাণ্ড জীবনে এই প্রথমবার দেখছি।
আশাহত!
(আরও কিছু কথা। “নোয়াপাতি ভুঁড়ি” কথাটা বেশ কয়েকবার ব্যবহার করা হয়েছে। নোয়াপাতি নয়, “নেয়াপাতি”। হোটেলের রেজিস্টার খাতাকে একাধিকবার লেখা হয়েছে “রেজিস্ট্রার খাতা”। একই ভুল বারবার হলে সেগুলো স্রেফ “ছাপার ভুল” বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং আয়ান রশীদ অনূদিত “গালিবের কবিতা” বইটির অনুবাদ করা হচ্ছে ১৯৮৩ সালে— এমনটা দেখানো হয়েছে। ১৯৮৯ সালের কলকাতার স্টোনম্যান হত্যার ঘটনাও চলে এসেছে ১৯৮৩ সালে। যদিও ক্রিকেটার কপিল দেব-এর নাম যথাযথ সময়েই উল্লেখ করা হয়েছে। সাল তারিখ সংক্রান্ত এই বিচ্যুতিগুলো কি সব “অ্যানাক্রনিজম”-এর কাঁধে চাপিয়ে দেবো?
কাহিনি নির্মাণ, ভাষার ব্যবহার, ডিটেইলিং— সবদিক দিয়েই অযত্নের ছাপ। কবীর সুমনের গানের লাইন আছে : “সাহিত্য মরে পুজো সংখ্যার চাপে”। এই উপন্যাস তো পুজো সংখ্যায় বেরোয়নি, তাহলে কীসের চাপে মরলো? প্রকাশকের চাপে? নাকি “ব্যাধ”-এর চাপে?)
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে শিশু এবং কিশোরদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে উপন্যাসটি। একইসঙ্গে একজন পিতার সঙ্গে তাঁর সন্তানের স্নেহার্দ্র সম্পর্কের কথাও ফুটে উঠেছে। গল্পের ঘটনাক্রম আমাদের প্রায় সবারই কমবেশি পরিচিত। তাই গল্পের বিষয়বস্তু নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু—
ওখানে একটা বড়ো বটগাছ ছিলো। এখন গাছটা নেই। মিলিটারিরা কেটে ফেলেছে। কেটে ফেলেছে গাছটা। এখানে একটা মন্দির ছিলো। মন্দির। ওখানে পুজো করতো হিন্দুরা। মিলিটারিরা তাদের মেরে ফেলেছে। মন্দিরটা ভেঙে ফেলেছে। এখানে বস্তি ছিলো। এখন নেই। গরিব মানুষরা এখানে থাকতো। মানুষগুলোকে মেরে ফেলেছে মিলিটারিরা। বস্তি নেই। মানুষ নেই। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে। আরেকটা মিলিটারির গাড়ি এলো। আমাদের রিকশা চলছে।...
গোটা উপন্যাসটা লেখা হয়েছে এরকম অদ্ভুত আধো আধো বাক্যে। একই কথা বারবার বারবার পুনরাবৃত্তি করে করে বড়ো বাক্যকে এরকম ছোটো ছোটো বাক্যাংশে ভেঙে ভেঙে লেখা হয়েছে। আমার কাছে চূড়ান্ত বিরক্তিকর লেগেছে হুমায়ুন আজাদের এই গদ্যশৈলী। তাই বিষয়বস্তু পছন্দ হওয়া সত্ত্বেও লেখার ভঙ্গির কারণে উপন্যাসটি পড়ার সময় সবমিলিয়ে খুব একটা সুখ অনুভব করিনি।
কলেজ স্কয়ারের “ধ্যানবিন্দু” দোকানে আমি যাই কবিতার বইয়ের খোঁজ করতে আর লিটিল ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা উল্টে দেখতে। সেখানেই পেয়ে গেলাম সালভাদোর দালি-র এই চমৎকার জীবনীটি। বিংশ শতাব্দীর চিত্রশিল্পীদের মধ্যে পাবলো পিকাসো এবং সালভাদোর দালি— এই দুজনের মধ্যে কে বেশি কিংবদন্তি ছিলেন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয় (দুজনেই স্প্যানিশ)। যদি চারিত্রিক বৈপরীত্যের তত্ত্বতালাশ করতে হয়, তাহলে দালি-র তুলনা শুধু চিত্রশিল্প জগতে নয়, পৃথিবীর যেকোনো সাংস্কৃতিক মাধ্যমেই পাওয়া দুষ্কর। অনতিদীর্ঘ এই বইটিতে একজন অবিস্মরণীয় শিল্পীর জীবন এবং কাজের খতিয়ান তুলে ধরা হয়েছে, যা আমার মতো সীমিত শিল্পবোধসম্পন্ন পাঠকের কাছে এক পরম পাওনা।
আমার দৃষ্টির ধার এত বেশি, এবং একাগ্রতা এত তীব্র, আর আমার সৃষ্টি প্রমাণ করছে যে এই শতাব্দীতে আমার চেয়ে বীরোচিত এবং বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব আর কেউ নেই। নিচাহ্ (Nietzsche) ছিলেন, কিন্তু উন্মাদ হয়ে জীবন শেষ করেছিলেন। আমি উন্মাদ নই আমি বিদূষকও নই। বাকি উন্মাদদের সঙ্গে আমার একটাই তফাৎ আছে— আমি উন্মাদ নই।
নিজের আত্মজীবনীতে এইভাবে নিজেই নিজের তারিফ করেছেন দালি। একবার দুবার নয়। সারাটা জীবন অক্লান্তভাবে নিজের গুণগান করে গেছেন। যখনই সুযোগ পেয়েছেন, নিজের ঢাক নিজে পিটিয়েছেন। নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন, তিনি একজন “নার্সিসিস্ট”। নিজের মুখেই ঘোষণা করেছেন, দিনের মধ্যে দুই ঘণ্টা যদি ছবি আঁকার কাজে ব্যস্ত থাকেন, বাকি বাইশ ঘণ্টা বরাদ্দ থাকে স্বপ্ন দেখার কাজে। “সুররিয়ালিজম” ধারাটিকে প্রায় তর্কাতীতভাবে গণ্য করা হয় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে। এবং এই আন্দোলনের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাটি সালভাদোর দালির হাতেই ধরা ছিল, এই ব্যাপারে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। অথচ সেই দালি-ই দম্ভ ভরে ঘোষণা করেছেন :
বাদবাকি সুররিয়ালিস্ট শিল্পীদের সঙ্গে আমার পার্থক্য হলো, আমিই হলাম একমাত্র সুররিয়ালিস্ট।
এমন বলেছেন ক্যানো? শুধুই দম্ভ? না বোধহয়। ঠিক যেমন কবিদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে কিছু ধারণা থাকে : কবিদের বড় বড় চুল হয়, সেই চুল তারা আঁচড়ায় না, জামার বোতাম ছেঁড়া থাকে, পকেট থাকে গড়ের মাঠ। সুররিয়ালিস্ট শিল্পীদের নিয়েও পূর্বধৃত কিছু ধারণা পোষণ করে থাকি আমরা। একটা মস্ত বড় ভুল তো আমরা প্রায় সবাই করি, সুররিয়ালিজম এবং অ্যাবস্ট্র্যাকশনিজম (বিমূর্ত শিল্পধারা)-কে অভিন্নরূপে গণ্য করি। “সালভাদোর” শব্দের অর্থ হলো Saviour বা ত্রাণকর্তা। নিজের নামের প্রসঙ্গ টেনে দালি নিজেই বলেছেন :
কিউবিজম, ডাডাইজম, অ্যাবস্ট্র্যাকশনিজম, ফভিজম, বাজারে ছেয়ে থাকা এইরকম গন্ডা গন্ডা “ইজম” থেকে চিত্রশিল্পকে বাঁচানোর জন্যেই আমার আবির্ভাব ঘটেছে।
কী দোষ করলো এইসব ইজম? দালি-র মতে, এইসব শিল্পীদের প্রায় কেউই ঠিকঠাক ড্রয়িং করতে পারেনা। মানবশরীর কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যকে দক্ষভাবে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা নেই এদের। এরা রঙের ব্যবহার জানেনা। পার্সপেক্টিভের জ্ঞান নেই এদের। আর নিজেদের অক্ষমতাকে ঢাকতেই এরা এইসব আজগুবি ইজমের ছাতার তলায় এসে জড়ো হয়েছে। দালি-র নিজের দৈনন্দিন জীবন ছিল অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নিজের কাজের ব্যাপারে ছিলেন প্রচণ্ড পরিশ্রমী (এই দিক দিয়ে পিকাসোর সঙ্গে মিল আছে তাঁর)। শিল্পে সিম্বলিজম বা প্রতীকের ব্যবহারকেও অশ্রদ্ধার চোখে দেখতেন তিনি। তাঁর মতে, যারা নিজেদের মনোভাবকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম, তারাই প্রতীকের উপর নির্ভরশীল হয়। যেকোনো শিল্প হলো প্রকৃতির সরাসরি উন্মোচন। প্রকৃতিতে “প্রতীক” বলে কিছু নেই, অ্যাবস্ট্রাক্ট বলে কিছু নেই, যা আছে সবকিছুই সরাসরি অর্থবোধক। ঠিক এই কারণেই “Art for art's sake” তত্ত্বকেও দুচ্ছাই করেছেন।
তাহলে কেমন ছিল সালভাদোর দালি-র নিজস্ব শৈল্পিক মনোজগৎ? গুগল থেকে দালি-র যেকোনো বিখ্যাত ছবি খুঁটিয়ে দেখলেই একটা ব্যাপার বোঝা যায় (এই বইয়ের ভেতরেও রয়েছে অসংখ্য সুমুদ্রিত ছবি)— একনজরে এই ছবিগুলোকে বিমূর্ত এবং আজগুবি বলে মনে হলেও আসলে তা শিল্পীর অবচেতন মন এবং অবিশ্বাস্য কল্পনাশক্তির মূর্ত প্রকাশ। এর মধ্যে প্রতীকী কিছু নেই, অকল্পনীয় কিছু নেই, উদ্ভট কিছু নেই (তাঁর নিজের ছবির ���ধ্যে প্রতীক খুঁজতে নিষেধ করেছেন)। দালি ছিলেন অস্ট্রিয়ান মনস্তত্ত্ববিদ সিগমান্ড ফ্রয়েডের ভক্ত। দালি-র ছবির এই আপাত উদ্ভটজগৎ আসলে ফ্রয়েডীয় অবচেতন মন এবং স্বপ্নসন্ধানের প্রতিফলন। ঘুমের মধ্যে আমাদের দেখা স্বপ্নগুলো যেমন অবাস্তব হয়েও বাস্তব, দালি-র ছবিও তেমনি। একইসঙ্গে দালি একে বলেছেন তাঁর অতীন্দ্রিয়সত্তার বহিঃপ্রকাশ। ভাবতে খুবই আশ্চর্য লাগে, সুররিয়ালিজম-এর সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী (এবং বামপন্থার বিরোধী)। আধুনিক চিত্রশিল্পের অন্যতম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বটি মধ্যযুগের রেনেসাঁস খ্রিস্টান ভক্তিবাদী চিত্রকলা থেকে নিজের বেশিরভাগ আইডিয়া আহরণ করেছিলেন!
একে যদি চারিত্রিক বৈপরীত্য না বলা হয় তাহলে আর কাকে বলা হবে? দালি-র অভিনব ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে আরও অনেক কিছু বলে ফেলা যায়। স্বঘোষিত নার্সিসিজমের ব্যাপারে তো আগেই বলেছি। তিরিশের দশকের স্পেনের মানুষ হয়ে (স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ) এবং চল্লিশের দশকের ইয়োরোপের মানুষ হয়ে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ), তিনি ছিলেন ঘোরতরভাবে অরাজনৈতিক। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় পালিয়েছিলেন রোমে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাতে। কিন্তু এই ব্যাপারে কোনও লুকোছাপা ছিল না তাঁর। সরাসরি বলেছেন :
আমি ইতিহাসপ্রবণ মানুষ নই, আমি যেমন অরাজনৈতিক, তেমনি আমার ইতিহাস প্রবণতাও কম। হয়তো আমি আমার সময় থেকে এগিয়ে রয়েছি অনেক গুণ, কিংবা সময় থেকে পিছিয়ে আছি অনেকটা। কিন্তু তাই বলে সমসাময়িক এই পিংপং খেলায় আমি নেই!
আত্মপ্রচারে ছিলেন দ্বিধাহীন। পয়সা রোজগারের ব্যাপারে ছিলেন নির্লজ্জ (“টাকাপয়সা ভীষণ ভালোবাসি আমি”)। বিখ্যাত ফরাসি কবি পল এলুয়ার-এর স্ত্রী, দালি-র চেয়ে দশ বছরের বড় গালা-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল শিল্পের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পৃথিবীতে আর কোনও শিল্পী নিজের প্রেরণাদাত্রী (muse)-কে নিয়ে এত বেশি মাতামাতি করেননি। নিজের অসংখ্য ছবিতে গালা-কে এঁকেছেন। মুক্তকন্ঠে স্বীকার করেছেন, গালা-র সঙ্গে জীবন না কাটালে তিনি দালি হয়ে উঠতে পারতেন না।
বিয়ে করেছিলেন এই নারীকে এবং পাঁচ দশকব্যাপী ঝড়ের মতো উদগ্র দাম্পত্য জীবন কাটিয়েছেন। একদিকে গালা ছিলেন তাঁর বিবিধ এবং উন্মত্ত যৌননিরীক্ষার সঙ্গী, আরেকদিকে দালি-র টাকাপয়সা ও বিপুল সম্পদের হিসেবরক্ষক। একটা সময় নিজে অমর হতে চেয়েছিলেন (তাত্ত্বিকভাবে অমর নয়, আক্ষরিক “অমর”)। মৃত্যুকে ভীষণ ভয় পেতেন। কিন্তু বৃদ্ধ বয়েসে জীবনসঙ্গিনীর মৃত্যুর পরে ঠিক করেন নিজেও মৃত্যুবরণ করবেন। জল খাওয়া ত্যাগ করেন। পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। চুরাশি বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে একবার ফিসফিস করে বললেন, “যবনিকা পতন”, তারপর বললেন :
আমার ঘড়িটা কোথায়?
বন্ধুত্বের এই গল্পগুলো আমার খুব ভালো লাগে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা কিশোর উপন্যাস এই প্রথম পড়লাম। প্রথমবারেই তাঁর সরস সাবলীল রচনাশৈলী ভীষণ পছন্দ করে ফেললাম। একটা কথা আছে, উৎকৃষ্ট শিশু-কিশোর সাহিত্য বড়ো হয়ে পড়লে নাকি আরো বেশি ভালো লাগে (উদাহরণ - সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আশাপূর্ণা দেবী)। “হাত কাটা রবিন” পড়ে আমি উৎকৃষ্ট কিশোর সাহিত্যের স্বাদ পেলাম।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল খুব পারদর্শিতার সঙ্গে কিশোর মনস্তত্ত্বকে এই উপন্যাসে প্রয়োগ করেছেন। কিশোর বয়সের সবচেয়ে বড়ো দুঃখ হলো, বড়োরা তাদের বুঝতে পারে না। কীভাবে বুঝবে? এই বয়সের জীবন্ত স্বপ্ন এবং বাঁধভাঙা কল্পনার ভান্ডার বড়ো হতে হতে যে ফুরিয়ে যায়!
চাঁদা তুলে ফুটবল কেনার পরে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। সবাই চাঁদার পয়সা ফেরত চাইলো। কিন্তু পয়সা তো নেই। তাই বলটাকে কেটে টুকরো টুকরো করা হলো এবং প্রত্যেকে নিজের ভাগের একটা টুকরো বুঝে নিলো (ঝগড়া যদিও কিছুদিন পরেই মিটে যায়)। এই ঘটনাটির গুরুত্ব বড়োরা কখনও বুঝতে পারবে? তারা তো এই “বোকামি”র কথা শুনে খ্যাক খ্যাক করে হাসবে। আমাদের ভেতরে আস্ত যে কৈশোরকালটা ধীরে ধীরে বিস্মৃতির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়, এইসব “আজগুবি” উপাখ্যান পড়লে সেই ঢাকনা খুলে ম্যাজিকের মতো কতো কথা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে!
শুধু একটা ব্যাপার একটু খারাপ লেগেছে। যেকোনো কাপুরুষতা কিংবা ভীরুতার দৃষ্টান্ত দেওয়ার সময় “তুই কি মেয়ে নাকি? তাহলে যা, স্কার্ট পরে মেয়েদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে যা!”— সংবেদনশীল লেখকের কলমে এই ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার দেখতে পেয়ে একটু অবাক হয়েছি। নইলে এই উপন্যাসের কপালে আমার তরফ থেকে পুরোপুরি পাঁচ তারা রেটিং বরাদ্দ ছিল!
ছোকরাবয়েসি রোমান সম্রাট ক্যালিগুলার বোন মারা গেছিলো। বোন ছিল তার প্রেমিকা। প্রেমিকা মারা যাওয়ায় তার মাথা খারাপ হয়ে গ্যালো। সে বুঝতে পারলো, মানুষ একদিন মারা যায় এবং যতদিন বেঁচে থাকে তখনও মানুষের জীবনে সুখ থাকেনা। ক্যালিগুলা জানতো, সম্রাট হিসেবে তার হাতে রয়েছে একচ্ছত্র ক্ষমতা, যা ইচ্ছে তাই করার লাইসেন্স। সে ঠিক করলো, “মানুষ একদিন মারা যায় এবং...“— এই যে তার উপলব্ধি, নিজের ক্ষমতার প্রয়োগ করে বাস্তব জীবনে সেই উপলব্ধিকে সে প্রতিষ্ঠা/প্রমাণ করে দেখাবে।
শুরু হলো নির্মম হত্যাযজ্ঞ। নির্বিচারে সে মানুষ মারতে লাগলো। বন্ধু, শত্রু, বৃদ্ধ, যুবক, ধনী, দরিদ্র, পুরুষ, মহিলা, কাউকে ছাড়লো না। কারো ছেলেকে মারলো, কারো বাবাকে মারলো, কারো স্ত্রীকে কেড়ে নিলো (সবই অকারণে)। উন্মাদ+শয়তান সম্রাট তার প্রজাদের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা শুরু করলো। সম্রাটের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে কিছু মানুষ তাকে গুপ্তহত্যা করার ষড়যন্ত্র করলো। শেষ পর্যন্ত কি তারা এই পাগল বর্বর সম্রাটকে খুন করতে সফল হলো?
মোটামুটি এই হলো নাটকের গল্প। নাট্যকার আলবের কামু সম্ভবত এই নাটকে নিজের প্রচারিত দর্শন— Absurdism (দুনিয়াতে কখন কী ঘটবে, ক্যানোই বা ঘটবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই) এবং Existentialism (পূর্বনির্ধারিত বিশেষ কোনও আদর্শের প্রভাবে নয়, মানুষ নিজেই নিজের বেঁচে থাকার কারণ/উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে)— মূলত এই দুটি দার্শনিক তত্ত্বকে রোমান সম্রাট ক্যালিগুলার উন্মত্ত এবং অযৌক্তিক কার্যকলাপের মধ্যে দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। মানুষের নিয়তি যেমন কোনও বিধিবদ্ধ নিয়মকানুন মেনে চলেনা, ক্যালিগুলার পাগলামি যেন সেই নিয়তিরই মানুষরূপী প্রতিফলন। নিয়তির মতোই সে তার প্রজাদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।
নাটকটি পড়ে আমার মোটামুটি লেগেছে, যতটা আশা করেছিলাম ততটা নয়। দার্শনিক বিষয়টা হয়তো খানিকটা ফুটিয়ে তুলতে সমর্থ হয়েছেন নাট্যকার, কিন্তু তবু নাটকটির ঘটনাক্রম এবং চরিত্রনির্মাণ আমার কাছে সুসংবদ্ধ বলে মনে হয়নি। অনেক পাঠক এই নাটকটির মধ্যে আধুনিক যুগের অত্যধিক ক্ষমতাশালী শাসকদের খেয়ালখুশি মাফিক আচরণের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু আমার কাছে এই সাদৃশ্য কষ্টকল্পনা বলে মনে হয়েছে। ক্যালিগুলার কাজকর্ম ছিল পুরোপুরি পাগলামির দ্বারা চালিত। আধুনিক যুগের স্বৈরাচারী শাসকরা মোটেও ক্যালিগুলার মতো পাগল এবং হঠকারী নয়।
বেশ কিছু আকর্ষণীয় “কোটেশন” আছে এই নাটকে। একটা উদাহরণ - “Power can never be complete without a total self-surrender to the dark impulse of one's destiny.” কিন্তু এই ধরনের কথাগুলো স্রেফ সুন্দর সুন্দর কথা হয়েই রয়ে গেছে, দেওয়ালে টাঙানো ছবির মতো খানিকটা অভিনবত্ব সৃষ্টি করেছে এগুলো, ব্যাস। সবমিলিয়ে কামু-র এই নাটকটা একটা মাঝারি মানের পাঠঅভিজ্ঞতা হয়ে রইলো আমার কাছে। কিছু কিছু বিষয় মস্তিষ্কে খানিকটা চিন্তার ঢেউ তুলেছে, কিন্তু মোটের উপর চলনসই। কামুর উপন্যাসের মতো দুর্দান্ত কিছু নয়।
এই বইটিকে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী বলা যাবে না। আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে হিন্দুধর্মের অবস্থা কেমন ছিল? ব্রাহ্মণরা ভাবতো তারা জাতপাতের অবস্থানগত পিরামিডের একদম চূড়ায় বসে ঠ্যাং দোলাচ্ছে (যদিও, পিরামিডের একদম উপরের ছুঁচলো অংশটিতে বসে থাকা শারীরিকভাবে একটু অস্বস্তিকর)। আর সমাজের অন্ত্যজ মানুষরা, যারা বেদ বেদান্ত শাস্ত্র ফাস্ত্র এইসব বুঝতেন না, তারা নিজেদের সুবিধে মতো ধর্মপালনের উপায় খুঁজে বের করে নিয়েছিলেন।
হিন্দু ধর্মের মূল শাস্ত্রগ্রন্থগুলো পৌত্তলিকতাকে সমর্থন করে না। “অদ্বৈতবাদ” নামের একটি দার্শনিক চিন্তার লাইন ধরে সুদীর্ঘকাল মেইনস্ট্রিম হিন্দু দর্শনের বিশ্লেষণ এবং চর্চা হয়ে আসছিল। মোটামুটিভাবে “অদ্বৈতবাদ” = ঈশ্বর কোনও মানুষের মতো দেখতে থ্রি-ডাইমেনশনাল জিনিস নয়। রক্তমাংসের মনুষ্যের দ্বারা তাঁকে বোঝা, কল্পনা করা, অনুভব করা, বিশ্লেষণ করা, স্পর্শ করা, দর্শন করা— এইসব পার্থিব কোনোকিছুই করা সম্ভব নয়। তিনি “অবাঙ্মনসগোচর”। সাধারণ বোধবুদ্ধি দিয়ে তাঁকে বোঝা যায় না।
ঈশ্বরের এই যে দুর্বোধ্য অদ্বৈত রূপটির ধারণা, একজন সাধারণ অশিক্ষিত দিন-আনি-দিন-খাই মানুষের মাথার দুই কিলোমিটার উপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। রুজি রোজগারের ধান্দায় সারাদিন পরিশ্রম করার পরে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এইসব ভজকট চিন্তাভাবনা করতে কার ভালো লাগে? ক্লাসের হিংসুটে ফার্স্ট বয় (কিংবা গার্লরা) যেমন নিজেদের “স্পেশ্যাল নোটস” অন্যদের থেকে লুকিয়ে রাখে, শাস্ত্রজ্ঞানী ব্রাহ্মণরাও তেমনি এইসব টেকনিক্যাল দার্শনিক ব্যাপার সাধারণ মানুষের থেকে লুকিয়ে রাখতো। সাধারণ মানুষ তখন ধুরশ্লা বলে নিজেরাই নিজেদের মতো ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করে নিতে বাধ্য হলো।
কিন্তু এত সহজে সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষ ঈশ্বরকে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে, ঈশ্বরের মূর্তি তৈরি করে, পূজা করতে লাগলো। আর ওই হিংসুটে ফার্স্ট বয়রা (এই ক্ষেত্রে শুধু বয়, কারণ গার্লদের ক্ষেত্রে শাস্ত্রপাঠ নিষিদ্ধ ছিল) বললো, মাটি কিংবা ধাতু কিংবা পাথর দিয়ে তৈরি মূর্তি নিয়ে তোমরা যতোই লাফালাফি করো, ধর্মের আচার বিচার সংস্কার নিয়ম কানুনের ব্যাপারে জানতে হলে আমাদের কাছেই আসতে হবে। ঈশ্বরকে নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এই টানাপোড়েন বহু যুগ ধরেই চলছিল। ঠিক এই পরিস্থিতিতে চৈতন্যদেব এমন একটি উপায় বললেন, যাতে এক ঝটকায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে গ্যালো।
তিনি বললেন, ধর্মপালন করার জন্যে আচার বিচার নিয়ম নিষ্ঠা মন্ত্র তন্ত্র হাবিজাবি কিচ্ছু দরকার নেই। প্রাণের আনন্দে ভক্তিসহকারে উচ্চকণ্ঠে স্রেফ হরিনাম সংকীর্তন করলেই ঈশ্বরকে ডাকা হবে, ঈশ্বরকে পাওয়া হবে। সঙ্গে যদি খোল কর্তাল শঙ্খ মাদল জোগাড় করতে পারো তাহলে তো কথাই নেই। এইসব বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে গলা ছেড়ে (ইচ্ছে হলে দুই হাত তুলে একটু নেচেও নিতে পারো, নো প্রবলেম) হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করলে আর কিছুর প্রয়োজন নেই। ব্যাস, মহাপ্রভুর এই আশ্বাস পেয়ে সাধারণ মানুষ উল্লাসে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো। প্রথমে নবদ্বীপ শহর, তারপর গোটা গৌড়বঙ্গ, তারপর ভারতের আরও নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো ঈশ্বর ভজনার এই অভিনব সহজিয়া পন্থা। প্রতিষ্ঠিত হলো “গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন”। (এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানানো যেতে পারে। হরিনাম সংকীর্তনের বার্তাটি চৈতন্যদেব সর্বপ্রথম, নবদ্বীপেরও আগে, প্রচার করেছিলেন পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টে— বর্তমান সিলেট)।
আজকের দিনের বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার করলে এই পুরো বৃত্তান্তকে “আরো একটি নতুন কিসিমের কুসংস্কারগ্রস্ত ধর্মীয় পাগলামি” বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চিরাচরিত সামাজিক কাঠামোর সীমা লঙ্ঘন না করেও, তৎকালীন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে, ধর্মকে সংস্কার করার এই সাহস দেখাতে চৈতন্যদেবের আগেও কেউ পারেননি, পরেও কেউ পারেননি। এমনকি আজকের দিনের মুক্তচিন্তার ফুরফুরে মলয় বাতাসেও ধর্মকে নিয়ে বেশি খোঁচাখুঁচি করার পরিণাম কেমন হতে পারে তা আমরা সবাই জানি।
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর নিজস্ব বিশ্লেষণের আলোকে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক চিন্তার জগৎকে পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এই বিষয়ে অনেক নতুন কিছু জানতে পেরেছি বইটা পড়ে, অনেক অন্ধকার দূর হয়েছে। রিভিউর সীমিত পরিসরে মহাপ্রভু প্রবর্তিত বৈষ্ণব দর্শনের ব্যাপারে প্রায় কোনোকিছুই আমি লিখতে পারলাম না। তাঁর মতো যুগন্ধর মানুষকে “ঈশ্বরের অবতার” হিসেবে গণ্য করা হবে, এটা তো স্বাভাবিক। কিন্তু আদপে তো তিনি ছিলেন আপনার আমার মতোই রক্তমাংসের মানুষ। কেউ বলে তিনি শ্রীকৃষ্ণের অবতার, কেউ বলে তিনি প্রথম বাঙালি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী (তথা “প্রলেতারিয়েতদের মসিহা”), কেউ বলে তিনি হিন্দুধর্মের একজন সংস্কারক, কেউ বলে তিনি কিসুই না, স্রেফ একজন বায়ুরোগগ্রস্ত প্রায়োন্মাদ।
কিন্তু সব মসিহার যেরকম অবস্থা হয় মহাপ্রভুরও একই অবস্থা হয়েছে। যিনি কিনা মানুষের উচ্চনিচ ভেদাভেদ দূর করে সবাইকে একই পঙ্ক্তিতে দাঁড় করাবার জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করলেন, তাঁর নিজের শহর নবদ্বীপে গেলে আজকে দেখা যাবে, তাঁর নামাঙ্কিত “মহাপ্রভু মন্দিরে” অব্রাহ্মণদের প্রবেশ করতে হলে কাঠের বাক্সের ভিতরে ভেট গুঁজে দিয়ে তবে ঢুকতে হয় (ভেট = entry fee)। তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পার্ষদ, মুসলমান ধর্মাবলম্বী হরিদাসকে মিছিলের মধ্যিখানে রেখে যিনি অত্যাচারী কাজির মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেই মহাপ্রভুর ভক্তরা তাদের মন্দিরে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাপারে আপত্তি না জানালেও নজরুলগীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যিনি সবাইকে হতে বলেছেন “তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা” (তৃণের মতো সামান্য, বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু), তাঁরই নামে কপালে তিলক কেটে ISKCON-এর ছোকরা সন্ন্যাসীমহারাজ ইউটিউবের ভিডিওতে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দকে বাঁদরের মতো মুখ ভ্যাংচায়। চেষ্টাচরিত্র করে দেখলে কুকুরের ল্যাজ সোজা হলেও হতে পারে, কিন্তু মানুষের ল্যাজ সোজা করা মহাপ্রভুরও কম্মো নয়।
আমেরিকার নাম “আমেরিকা” না হয়ে “কলম্বিয়া” হতে পারতো। কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ক্রিস্টোফার কলম্বাস জেদ ধরে বসেছিলেন যে তিনি এশিয়া মহাদেশ খুঁজে বের করেছেন, সম্পূর্ণ নতুন একটি মহাদেশ নয়। কলম্বাসের কপাল মন্দ, তাঁকে উপেক্ষা করে আমেরিকা মহাদেশের নামকরণ করা হয়েছে ইতালিয়ান অভিযাত্রী আমেরিগো ভেসপুচি-র নামে। উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা মিলিয়ে গোটা মহাদেশকে সেই সময় “নিউ ওয়ার্ল্ড” নামে ডাকা হতো, অর্থাৎ কিনা পূর্বে অজ্ঞাত সম্পূর্ণ নতুন একটি জগৎ। নতুন জগৎ মানে নতুন সম্ভাবনা। নতুন ধরনের মানুষ। নতুন ধরনের সভ্যতা। নতুন ঐশ্বর্য। নতুন লোভ। নতুন রক্তপাত।
ইয়োরোপীয় ঐতিহাসিকরা ঘটা করে সেই যুগটার নাম রেখেছেন “এইজ অভ ডিসকভারি”— “আবিষ্কারের যুগ”। আবিষ্কারের যুগ ঠিকই, কিন্তু নতুন মহাদেশ কিংবা নতুন সম্ভাবনার আবিষ্কার নয়। সত্যি কথা যদি মানতে হয়, মানুষ নামক একটি প্রাণীর রক্তপিপাসা (অন্য কোনও প্রাণীর নয়, মানুষেরই রক্ত), সম্পদের লালসা, অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা, অবিশ্বাস্য বর্বরতা, এইসব গুণগুলো নতুনভাবে আবিষ্কৃত হয়েছিল সেই সময়। নানারকম বৈজ্ঞানিক উন্নতির হাত ধরে মানুষ যত বেশি “সভ্য” হয়েছে, মানুষের জান্তব নগ্ন রূপটা তত বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের দুঃখ করার কারণ নেই। “মৃত্যুর পরপার” বলে যদি কিছু থাকে, সেখানে বসে তিনি নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছেন, তাঁর খুঁজে বের করা সামুদ্রিক রাস্তা দিয়ে ধেয়ে গেছে একের পর এক পৈশাচিক অভিযাত্রীদের দল, এবং লুটেপুটে তছনছ করেছে “নিউ ওয়ার্ল্ড” নামের সম্পদভাণ্ডারকে।
১৫২১ সালে এর্নান কর্তেস নামের একজন স্প্যানিশ অভিযাত্রী দক্ষিণ আমেরিকার মেহিকো অঞ্চলের “অ্যাজটেক” নামের একটি আঞ্চলিক সভ্যতাকে জয় করেছিলেন। তখনকার এই স্প্যানিশ অভিযাত্রীদের “কনকিস্তাদর” (conquistador) নামে ডাকা হতো। অ্যাজটেক ছিল একটি সুসংবদ্ধ এবং সম্পদশালী সভ্যতা। পরাজিত এই সভ্যতাকে ধর্ষণ করে, তার সম্পদ লুণ্ঠন করে, পাঠানো হলো স্পেনের রাজার দরবারে। সেই সম্পদের পরিমাণ দেখে রাজাগজা থেকে শুরু করে স্পেনের সাধারণ মানুষ, সবার চক্ষু চড়কগাছ। শোনা গ্যালো এই নাকি শেষ নয়, নিউ ওয়ার্ল্ডে আছে এরকম আরও অনেক সভ্যতা। সেখানে আছে আরও অনেক সম্পদ। অফুরন্ত সম্পদ! ব্যাস, আর কী, কনকিস্তাদর নামের অভিযাত্রীরা দলে দলে পাড়ি জমাতে থাকলো অ্যাটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে সেই নতুন পৃথিবীতে।
ফ্রান্সিস্কো পিজারো নামের একজন কনকিস্তাদর শুনেছিলেন এমনই একটি নতুন সভ্যতার কথা। সূর্য থেকে যেমন অঝোরধারায় রশ্মি ঝরে পড়ে, সেই দেশে নাকি স্বর্ণের সেরকমই অকল্পনীয় প্রাচুর্য। কিন্তু কোথায় সেই সভ্যতা? কীভাবে যাওয়া যায় সেখানে? দুবার চেষ্টা করেও বিফল হলেন পিজারো। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। তৃতীয়বারের চেষ্টায় খুঁজে পেলেন, দক্ষিণ আমেরিকারই নতুন আরেকটি সভ্যতা, আয়তনে এবং প্রাচুর্যে যারা মেহিকোর অ্যাজটেকদের চেয়েও বৃহৎ। সেই সভ্যতার নাম “ইনকা” (বর্তমানে পেরু এবং চিলে নামের দেশ যেখানে আছে, সেখানেই ছিল এই সভ্যতা)। সেইসময় ইনকাদের জনসংখ্যা ছিল এক কোটিরও বেশি। সেখানকার সম্রাট ছিলেন অতুল প্রতাপশালী। বিপুল শক্তিসম্পন্ন তাঁর সৈন্যবাহিনী। এই ভয়ংকর ইনকাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে পিজারোর অধীনে রয়েছে মাত্র... শুনলে হাসি পাবে... মাত্র ১৬৮ জন স্প্যানিশ সৈন্য!
শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কিন্তু আর হাস্যকর রইলো না। মুষ্টিমেয় ওই কয়েকজন সৈন্য নিয়েই, স্রেফ নৃশংস চতুরতা এবং অবিশ্বাস্য কপালজোরে, ইনকাদের প্রবল পরাক্রমশালী সম্রাট অ্যাতাহুয়ালপা-কে বন্দী করে ফেলেছিলেন ফ্রান্সিস্কো পিজারো! কীভাবে সম্ভব?! হ্যাঁ সম্ভব তো হয়েছিল বটেই, পরবর্তী ঘটনাক্রম ছিল আরো মর্মান্তিক। সুগঠিত একটি প্রাচীন সভ্যতাকে প্রায় চোখের নিমেষে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল আগন্তুক স্প্যানিশ নেকড়ের দল। প্রেমেন্দ্র মিত্রের “সূর্য কাঁদলে সোনা” উপন্যাসটি ইনকা-বিজয়ের সেই চমকপ্রদ (এবং দুঃখজনক) কাহিনিকে ভিত্তি করে লেখা হয়েছে। প্রায় চারশো পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি শুধু ঘনাদা সিরিজের নয়, প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা সবচেয়ে বড় উপন্যাস। এই উপন্যাসটিকে বাংলায় লেখা সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে চিহ্নিত করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছি না। যারা ইতিমধ্যে পড়েছেন (কিংবা ভবিষ্যতে পড়বেন) তারাও দ্বিধা করবেন না এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
বাংলা কিশোর সাহিত্যে অনেক দাদা আছেন। এঁদের মাঝে ঘনাদা (ভালো নাম ঘনশ্যাম দাস) একটু অন্যরকম দাদা। যদিও তিনি একজন প্রতিভাবান গুলবাজ, কিন্তু তার গুলমার্কা গল্পগুলোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে বিজ্ঞান কিংবা ভূগোল কিংবা ইতিহাসের কোনও চিত্তাকর্ষক বৃত্তান্ত। সত্যি কথা বলতে, পাঠক হিসেবে বয়স যখন অল্প ছিল, ঘনাদাকে আমি পছন্দ করতাম না। ইশকুলের বইপত্রে বিজ্ঞান ইতিহাস ভূগোলের গুঁতোয় এমনিতেই জর্জরিত হয়ে ছিলাম। গল্পের বইতেও এইসব পড়ে (তা যতোই চিত্তাকর্ষক হোক না ক্যানো) উপভোগ করার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্তর আমি ছিলাম না। তাই ঘনাদা-গল্পের মজা পেয়েছি অনেক পরে (ইশকুলের বইপত্রের গুঁতো যখন একটু স্তিমিত হয়ে এসেছে)। অনেক পরে বুঝেছি, প্রেমেন্দ্র মিত্র একজন জিনিয়াস। অনেক পরে বুঝেছি, ঘনাদাকে নিয়ে আরও অনেক বেশি মাতামাতি হওয়া উচিৎ!
“তথাকথিত বাংলা কিশোর উপন্যাস”-এর চাইতে “সূর্য কাঁদলে সোনা” একটু আলাদা। বাংলা কিশোর সাহিত্যে নারী চরিত্রদের সচরাচর দূরে সরিয়ে রাখা হয় (খুকুদের সংস্পর্শে এলেই নির্বোধ খোকারা যদি দুষ্টু হয়ে যায়!) কিন্তু এই কাহিনিতে বেশ গুরুতর দুজন নারী চরিত্র আছেন। তাদের মধ্যে একজন তো আবার গল্পের নায়ককে সিডিউস করতে উঠে পড়ে লেগেছেন! কিন্তু নারীঘটিত ব্যাপারটা বাদ দিলেও আরেকটা বড় রহস্য আছে। এমন দুর্ধর্ষ ঐতিহাসিক প্লট, রচনার এমন চমৎকার শৈলী, গল্পের এতরকম রুদ্ধশ্বাস বাঁকবদল, দুর্দান্ত উপস্থাপনা, আকর্ষণীয় সব চরিত্র (বাস্তব এবং কাল্পনিক, দুরকমই), সবমিলিয়ে এমন জমজমাট এবং রোমাঞ্চে ভরপুর একটি উপন্যাস, যা কিনা অন্য যেকোনো কিশোর উপন্যাসকে দশ গোলে ধরাশায়ী করতে পারে (হ্যাঁ, “চাঁদের পাহাড়”কে ধরে নিয়েই বলছি)— তবু এই উপন্যাসটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই নেই। কোনো মাতামাতি নেই। কোনো লাফালাফি নেই। ক্যানো?!
ক্যানো?! ক্যানো?!! ক্যানো?!!!
অনেকদিন পরে আর. কে. নারায়ণের উপন্যাস পড়লাম। এই উপন্যাসটা প্রথম পড়েছিলাম আজ থেকে প্রায়... পনেরো বছর আগে!! তখন কেমন লেগেছিলো সেসব আর কিছুই মনে নেই এখন। নারায়ণের সবকটা উপন্যাস সেইসময় একটানা পড়ে শেষ করেছিলাম। এবারও তাঁর সবকটা উপন্যাস একটানা পড়ে ফেলবো ঠিক করেছি। দেখা যাক কদ্দুর এগোনো যায়।
“স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস”কে যদি কিশোর-উপন্যাস হিসেবে গণ্য করি, তাহলে প্রাপ্তবয়স্ক বিষয় নিয়ে এটিই নারায়ণের প্রথম উপন্যাস। গত শতকের তিরিশের দশকে দক্ষিণ ভারতের একটি ছোটো মফস্বল শহরের গল্প (কাল্পনিক এই শহরের নামটি আমরা সবাই জানি— “মালগুড়ি”)। সেই শহরের চন্দ্রন নামের একজন যুবকের গল্প। একটি সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যাওয়া সময় এবং পরিবেশের গল্প। উপন্যাসটিতে লেখকের আত্মজৈবনিক কিছু উপাদান আছে।
কাহিনির চরিত্রদের কিছু কিছু চিন্তাভাবনা, আচার-আচরণ, আজকের দিনে আমাদের কাছে আপত্তিকর বলে মনে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, লেখক যদি উপন্যাসের চরিত্রদের “আদর্শ চরিত্র” হিসেবে দেখাতেন, তাহলে তখনকার মানুষের চিন্তাভাবনার ব্যাপারে আমরা কীভাবে জানতে পারতাম? সাহিত্যের থেকে আমরা কী প্রত্যাশা করি? বাস্তবধর্মিতা? নাকি স্যানিটাইজার দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা— “সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা”— একটি কাল্পনিক আদর্শ জগত? কথাসাহিত্য পড়ার সময় আমি সময়ের থেকে এগিয়ে থাকতে চাইনা। সময়টাকে চিনতে চাই।
নারায়ণের গদ্যশৈলী আমার ভীষণ প্রিয়। কী সুন্দর ফুরফুরে লেখা। কোনো চালাকি নেই। বাচালতা নেই। বাক্যগঠনে এবং শব্দচয়নে জটিলতা নেই। উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা নেই। “দার্শনিক বার্তা” দেওয়ার চেষ্টা নেই। পরিমিত ছিমছাম কয়েকটি রেখার টানে ফুটিয়ে তুলেছেন একটি অল্পবয়েসি ছেলের জীবনে প্রথমবার প্রেমে পড়ার ইতিবৃত্ত। প্রথমবার কষ্ট পাওয়ার ইতিবৃত্ত। কষ্টের মাঝেও কয়েক টুকরো মুচকি হাসি গুঁজে রাখতে ভুলে যাননি নারায়ণ। জীবন তো এরকমই...
পেশায় সাংবাদিক ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। সংবাদ-প্রতিবেদনে বাড়তি কথা ফেনিয়ে লেখার সুযোগ থাকেনা সাংবাদিকদের। পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে খুব তাড়াতাড়ি এবং স্পষ্টভাবে মূল বক্তব্যকে প্রকাশ করার তাগিদ থাকে। গৌরকিশোর ঘোষের উপন্যাসে সাংবাদিকসুলভ এই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রত্যক্ষভাবে খুঁজে পেয়েছি। যদিও দৈনিক-পত্রিকায় খবর ছাপানোর তাড়াহুড়ো এবং সেইসব মুদ্রিত খবরের তাৎক্ষণিক সমসাময়িকতার বাইরে বেরিয়ে এই উপন্যাসগুলো হয়ে উঠেছে প্রকৃত অর্থে “সাহিত্য”। উঁচুদরের সাহিত্য। পাঠককে ভাবিয়ে তোলার মতো সাহিত্য। একবার পড়া হয়ে গেলে ঝালমুড়ির ঠোঙা তৈরি করা যাবেনা এই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো দিয়ে।
মোট ছয়টি উপন্যাস রয়েছে এই সংগ্রহে। সবকটাই সীমিত দৈর্ঘ্যের এবং প্রতিটির বিষয়বস্তু ও প্রকাশভঙ্গি চমকপ্রদ। দুটো বিশেষ লক্ষণ গৌরকিশোরের উপন্যাসে দেখতে পেয়েছি। এক, তাঁর প্রধান চরিত্ররা প্রখরভাবে রাজনীতি এবং সময়-সচেতন। দুই, তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ছক ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্যে উদগ্রীব। গৌরকিশোরের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনের ব্যাপারে খোঁজখবর করলে বোঝা যায়, এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল। তাঁর উপন্যাসের চরিত্ররা সবাই অস্তিত্বের সংকটে ভুক্তভোগী। সমাজের সার্কাসে অদক্ষ জোকারের মতো তারা বিপজ্জনকভাবে ট্র্যাপিজের দড়ি ধরে ঝুলছে। কিন্তু প্রত্যেকেই নিজের অবস্থার ব্যাপারে তলিয়ে ভাবছে। বিশ্লেষণ করছে। শুধুই দিনগত পাপক্ষয় করতে শশব্যস্ত নয় তারা।
সবকটা উপন্যাস ধরে ধরে আলোচনা করার সুযোগ নেই। দরকারও নেই। গৌরকিশোর ঘোষের গদ্যভাষা তাঁর বক্তব্যের মতোই টানটান, ন্যাকামিবর্জিত, বলিষ্ঠ। যদিও তাঁর উপন্যাসের ন্যারেটিভ-গঠন গতানুগতিক নয়, বরং ভাষা এবং সংলাপ নিয়ে ক্রমাগত নিরীক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন তিনি। এবং প্রায় প্রতিটি নিরীক্ষাই আমার কাছে মৌলিক ও সার্থক বলে মনে হয়েছে। উপন্যাসগুলো ষাট, সত্তর এবং আশির দশকে লেখা। আমরা সবাই জানি, এই সময়কালে বাংলা সাহিত্যে জাঁকিয়ে বসেছিলো আরো বেশকিছু বিকল্প সাহিত্যস্বর। কিন্তু গৌরকিশোরের মতো ভানহীন, ভন্ডামিহীন, কৃত্রিমতাহীন উৎকর্ষ আমি আর কারো মধ্যে দেখতে পাইনি। আর সেই জন্যেই, পাঠক হিসেবে আমি বারবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি।
সামাজিক অব্যবস্থাগুলো নিয়ে, মানুষের মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে, এরকম অদ্ভুত আতসকাচের ব্যবহার আমি আর কখনও দেখিনি যে! একবারের জন্যেও গৌরকিশোর সরাসরি আঙুল তুলে, মুখ থেকে থুতু ছিটিয়ে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আকাশে ছুঁড়ে, কিংবা বাঁকা হেসে, সবজান্তা ভাব দেখিয়ে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গালিগালাজ করেননি (যেমন করাটাই “প্রতিবাদ” করার প্রতিষ্ঠিত রীতি— তখনও, এখনও)। তাঁর সমালোচনা করার পদ্ধতিটা নিস্পৃহ, মোহশূন্য, কিন্তু সত্যনিষ্ঠ। হাসপাতালের লাশকাটা ঘরের দরজা খুললে যেমন একইসঙ্গে ভেসে আসে হিমশীতল বাতাসের ঝাপটা এবং মৃতদেহের পচা দুর্গন্ধ (ডিসিনফেকট্যান্টের আপাতসুগন্ধ ছাপিয়ে)। গৌরকিশোর ঘোষের প্রতিটি উপন্যাস আমাকে উপলব্ধির সেই মৃতকল্প করিডোরে একলা ছেড়ে দিয়ে এসেছিল। সেই করিডোরে দাঁড়িয়ে, আমাদের সমাজব্যবস্থার হাস্যকর অথচ নিদারুণ পরিস্থিতির নিখুঁত ভাষ্য হিসেবে আমি ফিরে ফিরে শুনতে পেয়েছি গৌরকিশোরের উপন্যাসের একটা সংলাপ :
ওরে, লাশটার পকেটগুলো ভালো করে দ্যাখ। যা পাস নিয়ে আয় এখানে। লিস্টি করে রেখে দিই। তারপর ওটাকে নিয়ে যা। গাদায় রেখে দে।
এই লাশটা কে? আমাদের জীবন্মৃত সমাজ? নাকি সমাজের সদস্য হিসেবে আলাদাভাবে আমরা সবাই?
পল গগ্যাঁ-র জীবন যেন একটা ধূমকেতু। উনিশ শতকের প্যারিস-কেন্দ্রিক ইম্প্রেশনিস্ট/ পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের,— রেনোয়া, দেগা, মানে, সেজান, কামিল পিসাহো, মোনে, তুলুঝ লোত্রেক, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ— প্রায় প্রত্যেকের জীবন ছিলো ছন্নছাড়া, এলোমেলো, হিবিজিবি। এই ছন্নছাড়াদের দলের মধ্যমণি ছিলেন গগ্যাঁ। আবার এই ছন্নছাড়াদের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত চরিত্রও ছিলেন তিনি। জন্ম থেকেই শুধু ছুটছেন। এদিক থেকে সেদিক, এধার থেকে ওধার। সারাজীবন ফরাসি শৌখিনতার ধার ধারেননি। পরিশীলিত ফরাসি বিলাসিতার মুখে ঝাঁটা মেরেছেন। নিশ্চিন্ত স্বচ্ছল গৃহস্থ জীবন ত্যাগ করেছেন। কী যে একটা কাণ্ড করেছেন— স্রেফ ছবি আঁকবেন বলে! শুনলে মনে হয় রূপকথা শুনছি।
এই বইয়ের লেখক অহিভূষণ মালিক (মল্লিক নয়) নিজেই ছিলেন একজন স্বনামধন্য ইলাস্ট্রেটর। মূলত ব্যঙ্গচিত্রশিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। লীলা মজুমদারের “পদীপিসির বর্মীবাক্স” উপন্যাসের অবিস্মরণীয় ইলাস্ট্রেশনগুলো তাঁরই আঁকা। “রূপদর্শীর নকশা” নামে গৌরকিশোর ঘোষের লেখা বিখ্যাত সংবাদ-ফিচারের সঙ্গে দীর্ঘকাল শিল্পসঙ্গত করেছিলেন তিনি (“দেশ” পত্রিকায় প্রকাশিত হতো)। তুলির মতো তাঁর কলমও যে কতোটা চমৎকার, এই বইটা না-পড়লে পেত্যয় হবে না! মাত্র ৯৮ পৃষ্ঠার মধ্যে গগ্যাঁ-র মতো ফুটন্ত আগ্নেয়গিরিকে দিব্যি আঁটিয়ে ফেলেছেন। ছোটো ছোটো অধ্যায়ে, সরস সাবলীল গদ্যে লেখা, পল গগ্যাঁ-র এই জীবনীটি পড়লে বড্ডো আফসোস হয়। হায়, অন্য শিল্পীদের নিয়েও ক্যানো যে লিখলেন না!
পড়ছিলাম সমারসেট মম্-এর উপন্যাস “দা মুন অ্যান্ড সিক্সপেন্স”। শুনেছিলাম এই উপন্যাসটা নাকি গগ্যাঁ-র জীবনকাহিনি অবলম্বনে রচিত। পড়তে পড়তে মনে হলো : আরেহ, ডাল মে তো কুছ কালা হ্যায়! গগ্যাঁ-র জীবনের খুব সামান্য একটা আভাস আছে ঠিকই, কিন্তু সবমিলিয়ে শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়ে ফেলেছেন লেখক। মনের মধ্যে ভেসে উঠলো অনেকদিন আগে পড়া অহিভূষণ মালিকের লেখা পল গগ্যাঁ নামক বজ্রবিদ্যুৎসহ এক অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের বৃত্তান্ত। শেলফ থেকে খুঁজে বের করে আরেকবার বইটা পড়া ছাড়া তখন আর কোনো উপায় রইলো না!
Life is hardly more than a fraction of a second. Such a little time to prepare oneself for eternity! (পল গগ্যাঁ)
এই দুনিয়ায় অনেক রকমের ভূতের হদিশ পাওয়া যায়। “একানড়ে” তেমনই একরকম ভূতের নাম। তালগাছের উপরে বাস করে এই ভূত। এই ভূতের একটা পা নেই। নিজের অবশিষ্ট একখানা পা ঝুলিয়ে সে বসে থাকে তালগাছের মগডালে। প্রচলিত গ্রাম্য শিশুতোষ ছড়া আছে :
যে ছেলেটা কাঁদে
তাকে ঝুলির ভেতর ভরে
গাছের উপর উঠে
তুলে আছাড় মারে।
অর্থাৎ যারা দুষ্টু ছেলেমেয়ে, এই ভূত তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে শাস্তি দ্যায়। ছোটো ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়ানো খুব কঠিন একটা কাজ। আগেকার দিনে এইরকম ভয়ানক সব ছড়া শুনিয়ে তাদের ঘুম পাড়ানো হতো!
কিছুদিন আগেই এই লেখকের গোয়েন্দা উপন্যাস “শেষ মৃত পাখি” পড়েছিলাম। আজকে দুপুরে গুডরিডসের সূত্রেই এই উপন্যাসটার সন্ধান পেলাম। কী মনে হলো, ইন্টারনেটে খুঁজে দেখলাম এবং পেয়েও গেলাম। ছোটো সাইজের উপন্যাস, তাই পড়া শুরু করে দিলাম।
লেখকের মৌলিক গদ্যভাষার খানিকটা পরিচয় “শেষ মৃত পাখি”-তে পেয়েছিলাম। কিন্তু “একানড়ে” উপন্যাসটির অসামান্য গদ্যশৈলী ইদানিংকার বাঙালি কথাসাহিত্যিকদের কারো কলম থেকে বেরিয়েছে বলে আমার জানা নেই। চিত্রকল্প এবং রূপকের অনবদ্য ব্যবহারে, শব্দচয়ন এবং বাক্যের সযত্ন নির্মাণে, কাহিনিতে যুক্ত করেছেন হিমশীতল হিংস্র অনুভূতির আলাদা একটা প্রান্তর।
এরপর আসি গল্পের কথায়। “একানড়ে” অলৌকিক গল্প হয়েও ঠিক অলৌকিক গল্প নয়, আবার বাস্তবতার গণ্ডিতেও পুরোপুরি আটকে থাকেনি এই গল্পের প্লট। রিভিউয়ের শুরুতেই “একানড়ে” নামক ভূতের যে রেফারেন্স দিলাম, সেগুলো চমৎকার বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন লেখক। তার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন শিশু-মনস্তত্ত্ব, অন্ধবিশ্বাস এবং ভুতুড়ে পরিবেশ-নির্মাণের মেধাবী কৌশল।
নয় বছরের একটা বাচ্চা ছেলের দৈনন্দিন চিন্তাভাবনা, তার মানসিক স্ট্রাগল, বড়োদের জগতের সঙ্গে তার নিজের জগতের টানাপোড়েন— এই সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে লেখক এমন একটা কাহিনি ফেঁদেছেন, যেটা পড়তে গিয়ে আজকে এই উল্টোরথের দিনে, বৃষ্টি থৈ থৈ বিকেলবেলাটা, সন্ধেবেলাটা, রাত্রিবেলাটা— বেশ চমৎকার কাটলো।
বড়ো হয়ে যাওয়ার পরে আমরা এখন বেমালুম ভুলে গেছি : আমরা যখন বেশ ছোটো ছিলাম, আমাদের মনের ভিতরে লুকিয়ে ছিলো একটা সম্পূর্ণ গোপন রহস্যময় জগৎ। যে-জগৎটার হদিশ কেউ জানতো না। বড়োরা না, বন্ধুরা না, ভাইবোনেরা না, কেউ না। একটা রোমাঞ্চকর নিষিদ্ধ জগৎ।
জানতাম শুধু আমরা নিজেরা। আমাদের সেই জগৎটা কিন্তু মোটেও “ছোটোদের” জগৎ ছিলো না। “নিষ্পাপ” জগৎ ছিলো না। বিস্মৃত সেই রহস্যময় জগৎটার কথা আজকে খুব ক্ষীণভাবে আবার মনে পড়ে গ্যালো।
হাবিজাবি তন্ত্র মন্ত্র পিশাচ ভুজুংভাজুং থোড়-বড়ি-খাড়া আবর্জনায় ডুবে থাকা বাংলা সাহিত্যের আজকের এই মধ্যমেধাবী লেখকদের জমানায় এরকম বুদ্ধিদীপ্ত সুলিখিত অলৌকিক একখণ্ড আনন্দ দেওয়ার জন্যে— লেখককে কুর্নিশ!
দেশের মাহাত্ম্যের কথা জানিনা, ধর্মের মাহাত্ম্যের কথা জানিনা। কিন্তু দেশ এবং ধর্মের নামে মানুষের উপর মানুষের অত্যাচারকে, অপমানকে, খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারি।
দেশ আর ধর্ম বায়বীয় বিষয়, কিন্তু মানুষ তৈরি হয় রক্ত-মাংস-হাড়-স্নায়ু-চেতনা দিয়ে। দেশকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দিলে দেশ ভেউ ভেউ করে কাঁদতে বসে না (উপন্যাসের একটি চরিত্র নিজের দেশকে এই গালিটি দিয়েছেন)। কিন্তু ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিলে মানুষের কেমন লাগে? নিজেদের পবিত্র উপাসনাস্থল ভেঙে দিলে মানুষের কেমন লাগে? জাত তুলে গালি দিলে মানুষের কেমন লাগে? নিজের মা-বোনের গণধর্ষণ হলে মানুষের কেমন লাগে?
উপমহাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্য, রাজনীতি আর ক্ষমতা নিয়ে ব্যবসা করা কতিপয় হারামজাদার হাতবাক্স সেই ইংরেজ আমল থেকে সাধারণ মানুষকে দোহন করে আসছে— দেশ এবং ধর্মের সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার কোরে। “দেশভক্তি” টপিক নিয়ে নানান কিসিমের নাটক চলছে ভারতে। ভালোই বুঝি বাংলাদেশেও চলছে। একই গুয়ের গন্ধ ডানদিক থেকে শোঁকা আর বাঁ দিক থেকে শোঁকা। গু তো গু-ই।
মসজিদ ভাঙে এই দেশে, মাজা ভাঙে বাংলাদেশের হিন্দুদের। সেই মসজিদভাঙা পার্টির লোক এখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি আজকে একুশ কোটি মুসলিম জনসংখ্যার দেশের নির্বাচিত সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধি। কিন্তু একদা প্রকাশ্য জনসভায় মুসলিম সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে টিটকিরি মেরেছিলেন : “হাম পাঁচ, হামারা পচ্চিশ” (মুসলমানরা চারটে শাদি করে, তাই “আমরা পাঁচজন”, আর মুসলমানরা অনেক বাচ্চা পয়দা করে তাই “আমাদের সন্তান পঁচিশটা”)।
বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার পরে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপরে সংঘটিত অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লিখতে গিয়ে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তসলিমা নাসরিন। সাম্প্রতিক ভারতে কোনো হিন্দু নারী-সাহিত্যিক মুসলমানদের দুঃখ কষ্ট দুর্ভাবনাকে নিয়ে উপন্যাস লেখার সাহস দেখিয়েছেন কি?
যদিও এভাবে তুলনা করা উচিত নয়। সাহস কোনো তুল্যমূল্য বিচার করার বস্তু নয়। তাছাড়া ভারতবর্ষ বোধহয় আরও অনেক জটিল দেশ। এই দেশে অন্য ধর্মের মানুষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না। উঁচু জাতির হিন্দুরাই নিচু জাতির হিন্দুদের বাঁশ দ্যায় নিয়মিত। সেই নিচু জাতির হিন্দুরা আবার তাদের চেয়ে যারা আরেকটু নিচু, তাদের দ্যায়। এইভাবে ক্রমশ নিম্নতর পর্যায়ে দেওয়াদেয়ি চলতে থাকে। জারা হাটকে, জারা বাঁচকে, ইয়ে হ্যায় ইন্ডিয়া মেরি জান!
কিন্তু আলোচ্য এই উপন্যাসটা গুছিয়ে লিখতে পারেননি তসলিমা। একটা জরুরি বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে বড্ডো বেশি মোটাদাগের অভিব্যক্তি দেখিয়ে ফেলেছেন। চরিত্রগুলো খাপছাড়া, লক্ষ্যহীন। কাহিনিটা এলোমেলো। সম্ভবত উপন্যাসটা লেখার সময় তিনি নিজেই খুব “হাইপার” হয়ে ছিলেন। পারিপার্শ্বিক উত্তপ্ত ঘটনা চাক্ষুষ করলে যেকোনো সংবেদনশীল মানুষই হাইপার হয়ে যাবেন, এটা ঠিক কথা।
কিন্তু সাহিত্যিকরা তো সাধারণ মানুষ নন। উপন্যাস লেখার সময় তারা এরকম ল্যাজেগোবরে হয়ে গেলে উপন্যাসের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়না। একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে একটা নিম্নমানের উপন্যাস লিখেছেন তসলিমা নাসরিন। তবু তাঁর সাহসের কথা চিন্তা করে তাঁকে ধন্যবাদ জানাই।
ক্লাস ইলেভেন কিংবা টুয়েলভে পড়ার সময় “কবি” পড়ে কেঁদেছিলাম। এবারে ভালো লাগলো না ক্যানো? আমি কি সিনিক হয়ে গেছি?
বর্ধমান জেলার যে-গ্রামটিতে গল্পের সূচনা হয়— “অট্টহাস” — এই তো গত শীতে সেই গ্রামের মন্দিরে ঘুরে এলাম (মূলত দুপুরের অসাধারণ ভোগ প্রসাদ খাওয়ার লোভে)। ২০২১-এর শীতেও গেছিলাম। খুব মনোরম একটা গ্রাম। বললে বিশ্বাস হবে কিনা জানিনা, এই উপন্যাসটা লেখার পরে কতো বছর কেটে গেছে, গ্রামটা কিন্তু এখনও প্রায় চোদ্দো আনা একইরকম রয়ে গেছে। অন্তত কাহিনির স্থানিক বিবরণ পড়ে যতটুকু আন্দাজ করা যায়। আরো যে সমস্ত জায়গার বিবরণ আছে, কাটোয়া, অগ্রদ্বীপ— এই জায়গাগুলো আমার বাড়ি থেকে খুব কাছে। আমি এই জায়গাগুলোর বর্ণনা আরো একটু আন্তরিকভাবে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, প্রেক্ষাপট এবং পরিবেশ নির্মাণ বাদ দিয়ে সারাক্ষণ ইমোশনের জাল বুনতে ব্যস্ত রইলেন তারাশঙ্কর।
এবং এই ইমোশনও আমার কাছে পাকা ইমোশন বলে মনে হয়নি। একরকম হাসির গল্প আছে, সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানো হয়। এই উপন্যাসে চিমটি কেটে চোখ দিয়ে জল বের করার বন্দোবস্ত করেছেন লেখক। আমি কি এখনও ইলেভেনে পড়ি নাকি?
উপন্যাসের একটা চরিত্রকেও আমার স্বাভাবিক মানুষ বলে মনে হয়নি। সারাক্ষণ এই প্রেম প্রেম ভালোবাসা ভালোবাসা নিয়ে প্যানপ্যানানি আর ভালো লাগেনা। আবার পাশাপাশি বউকে ঠ্যাঙানোর বৃত্তান্ত এমনভাবে লেখা হয়েছে যেন ব্যাপারটা নেহাতই জলভাত। তারাশঙ্করকে এতোটা ইন্সেন্সিটিভ হতে আমি আর কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। উপন্যাসের শেষের দিকে জীবন এতো ছোট কেনে ছোট কেনে ছোট কেনে করে মাথা খেয়ে নিয়েছে! জীবন যখন এতোই ছোটো, তাহলে অকারণে ঢং দেখিয়ে সেই মেয়েটাকে ছেড়ে এলে ক্যানো বাপু, যে তোমাকে সত্যিকারের ভালোবাসে? এইরকম ন্যাকাচরণ পুরুষমানুষ আমার সহ্য হয়না। (তাই বলে আবার বাইনারি নিয়মে এই চিন্তা করে বসবেন না যে পুরুষ বলতে আমি শুধুই “দিওয়ার” সিনেমার অমিতাভ বচ্চনকে বুঝি!)
বাংলার লৌকিক সমাজ ও লৌকিক সংস্কৃতির অভিজ্ঞান তারাশঙ্করের অন্যান্য লেখায় যতটা বাস্তবসম্মতভাবে প্রকাশ পেয়েছে, এই উপন্যাসে সেটা পায়নি। বরং বলা যেতে পারে বিকৃতভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ঝুমুর-এর মতো প্রাচীন এবং ঐতিহ্যশালী একটা সংগীতশৈলীর চর্চাকারীদের এই উপন্যাসে ভ্রাম্যমাণ দেহপসারিনী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তারাশঙ্কর নিজে রাঢ় বাংলার মানুষ ছিলেন। তিনি কীভাবে ঝুমুর শিল্পীদের এভাবে অসম্মান করতে পারলেন তাঁর উপন্যাসে? পাঠককে রসগোল্লার চ্যাটচ্যাটে রসমাখানো অবাস্তব “লাভ স্টোরি” গেলানোর চক্করে এটা না করলেই হতো না?
সবমিলিয়ে হতাশ হয়েছি। ঔপন্যাসিকের হঠকারিতায় এবং চরিত্রদের আদিখ্যেতায়— দুইভাবেই হতাশ হয়েছি। আমি কি সিনিক হয়ে গেছি? ঝুমুর গায়িকা মদ খেয়ে একটার পর একটা কাস্টমারের কাছে নিজের দেহ বিক্রি করছে, আর ঠিক সেইসময় গায়িকার দরদিয়া প্রেমিকটি নির্বিকার চিত্তে গাছের তলায় বসে কবিগান বাঁধছে, এইসব দেখলে সিনিক হবো না তো কী হবো?
বার্টোল্ট ব্রেখ্ট্-এর সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং অভিনীত নাটকের নাম “লাইফ অফ গালিলেও”। নাটকটিকে শুধুই একটি “ঐতিহাসিক নাটক” হিসেবে গণ্য করলে ভুল হবে যদিও। ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী গালিলেও গালিলেই একজন ইতিহাসবিখ্যাত মানুষ ছিলেন বটে, কিন্তু গালিলেও'র জীবনকে এখানে নাট্যকারের নিজস্ব বক্তব্যপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। নাটকটিকে তাই “ঘটনাপ্রধান” নাটক হিসেবে না পড়ে “বিষয়প্রধান” নাটক হিসেবে বিবেচনা করাটাই কাজের কাজ হবে।
সুতরাং প্রশ্ন আসে, এই নাটকের বিষয়বস্তু কী? নাট্যকারের বক্তব্যই বা কী? নাটকের কাহিনির ব্যাপারটা খুব সংক্ষেপে আগে জেনে নেওয়া যাক। যুগের বিচারে গালিলেও দীর্ঘজীবী মানুষ ছিলেন। সাতাত্তর বছর বেঁচেছিলেন (১৫৬৪-১৬৪২)। ষোলো শতকের বেশ খানিকটা এবং সতেরো শতকের বেশ খানিকটা সময় জুড়ে তিনি পৃথিবীর হালচাল দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। ইতালির জনজীবনে সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক, চারিত্রিক এবং বৌদ্ধিক বিষয়গুলো তখন “দেখভাল” করতো রোমের খ্রিশ্চান ক্যাথোলিক চার্চ (ভ্যাটিকান)। এই চার্চের বড়োকর্তারা তখনও এমন একটা জগতে বাস করতেন, যেখানে সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে এবং পৃথিবী স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
গালিলেও'র জন্মের ঠিক কুড়ি বছর আগে পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস কোপার্নিকাস চার্চের এই চিরাচরিত বিশ্বাসকে ধাক্কা দিয়ে বলেছিলেন, সূর্য নয় বরং পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। বাইবেলবিরোধী এই “অদ্ভুত” দাবি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চার্চের তরফে বেশ জলঘোলা করা হয়। নতুন এই তত্ত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি করার অপরাধে জর্ডানো ব্রুনো নামের একজন ইতালীয় দার্শনিককে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। কিন্তু কোপার্নিকাস হোক কিংবা ব্রুনো, এঁরা কেউই পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে এই নতুন তত্ত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি। কোপার্নিকাসের তত্ত্ব তখনও গাণিতিক বিশ্লেষণের গণ্ডিতেই আবদ্ধ রয়েছে। কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে প্রথম হাতেকলমে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন গালিলেও। নাটকের কাহিনির কাঠামো মোটামুটি এটুকুই।
The evidence of your own eyes is a very seductive thing.
কোনো কিছু লোকের মুখে শোনা আর নিজের চোখে দেখার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। গালিলেও নিজে টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেননি, কিন্তু টেলিস্কোপের ভিতর দিয়ে দেখলেন, সূর্যকে পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরাবার গল্পটা আসলেই ভুয়ো। তিনি এই বিষয়টা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা শুরু করলেন। চার্চের বড়োকর্তারা বললেন, “দেখুন, আপনাকে আমরা বিজ্ঞানী হিসেবে সম্মান করি। ফালতু একটা বিষয় নিয়ে টানাটানি করে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারবেন না”।
গালিলেও ভীতু কাপুরুষ ছিলেন না। ফ্লোরেন্সে বসবাস করার সময়ে শহরে যখন প্লেগ রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দিলো, তখন তিনি অন্যদের মতো মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে শহর ত্যাগ করেননি, গবেষণার কাজ চালিয়ে গেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানকে এবং নতুন চিন্তাভাবনাকে যিনি প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন, সেই তিনিই পরবর্তীকালে চার্চের সামনে মাথা নত করেছিলেন ক্যানো? পূর্বসূরিদের মতো তাঁকেও চার্চ সাবধান করেছিল : খবরদার, পৃথিবীকে যেন সূর্যের চারিদিকে ঘোরাবার চেষ্টা না করা হয়।
A man who doesn't know the truth is just an idiot, but a man who knows the truth and calls it a lie is a crook.
পুরোনো বস্তাপচা অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসকে ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয় বিভিন্ন কারণে। সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো, ধর্মগুরুরা নিজেদের কর্তৃত্ব হারাতে ভয় পান। বাইবেল (কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মগ্রন্থ) তাদের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করে। তাদের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা তুলে দ্যায়। সেই বাইবেলের কথা যদি সাধারণ মানুষ অবিশ্বাস করতে শুরু করে তাহলে তো খুব মুশকিলের ব্যাপার হবে। কিন্তু গালিলেও আরেকজন জর্ডানো ব্রুনো হয়ে পুড়ে মরতে চাননি।
ব্রেখ্ট্-এর এই নাটকের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি তাঁর নাটকের নায়ককে দিয়ে হিরোগিরি করানোর চেষ্টা করেননি। তাঁর নাটকের নায়ক একজন রক্তমাংসের মানুষ। তিনি মরতে ভয় পান না যদিও, কিন্তু এটুকু বোঝেন, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সামনে অতিরিক্ত বীরত্ব দেখিয়ে বেঘোরে প্রাণ খোয়ানোর কোনও মানে হয় না। যদি নিজের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করতেই হয়, বেঁচে থেকেই করতে হবে। আর বেঁচে থাকার জন্যে মাঝেমাঝে মাথা নোয়াতে হয়। গাধাদের সামনেও মাথা নোয়াতে হয়। কারণ নিজের ইগোর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্যে “সত্যিকথা”র প্রদীপটাকে যেভাবে হোক প্রজ্জ্বলিত রেখে যাওয়া। যদি তিনি মারা যান, তাঁর সঙ্গে সত্যিটাও মারা যাবে। অতএব তাঁকে বেঁচে থাকতে হবে।
চার্চের সামনে মাথা নিচু করেও তিনি মিথ্যার সামনে মাথা নিচু করেননি। গৃহবন্দী অবস্থায় গোপনে নিজের বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম চালিয়ে গেছিলেন। নাটকের একদম শেষের দিকে নিজের পাণ্ডুলিপি ইতালির বাইরে পাচার করতে সফল হয়েছিলেন তিনি। তাঁর জীবনের তিরিশ বছরের গবেষণাসমৃদ্ধ সেই পাণ্ডুলিপি। নাটকের একজায়গায় গালিলেও বলেন, “Unhappy the land that is in need of heroes.” যে-দেশে হিরোর দরকার পড়ে, সেই দেশের কপাল খারাপ।
অথচ আজকের দিনের পৃথিবীর দিকে যদি তাকাই, চারিদিকে হিরোদের ছড়াছড়ি। নায়ক ভজনার ধুম লেগে আছে দুনিয়াতে। নাটকটি লেখা হয়েছিলো ১৯৩৮ সালে। ইয়োরোপের রাজনৈতিক গগনে তখন উত্থান ঘটেছে অ্যাডল্ফ হিটলার নামক এক মহানায়কের। গালিলেও'র জমানাতেও নায়কের সংখ্যা কিছু কম ছিল না (সবচেয়ে বড়ো নায়ক ছিলেন ভ্যাটিকানের পোপ)। কিন্তু গালিলেও প্রকৃত চালাক লোক ছিলেন বলেই মনে মনে ভেবেছিলেন : চার্চের সামনে মাথা যদি নেহাত নোয়াতেই হয়, তাহলে নুইয়ে নিই। আমার তো হিরোগিরি দেখিয়ে লাভ নেই। শহীদ হয়ে কাজ নেই বাপু, শহীদ হয়ে স্বর্গে গেলে দরকারি কাজগুলো কে করবে?
যে-বইটির পাণ্ডুলিপি ইতালির বাইরে পাচার করেছিলেন সেই বইটি বিজ্ঞানের দুনিয়ায় “Two New Sciences” নামে বিখ্যাত হয়ে আছে। বইটির ব্যাপারে বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং মন্তব্য করেছিলেন :
So great a contribution to physics was “Two New Sciences” that scholars have long maintained that the book anticipated Isaac Newton's laws of motion.
যদিও অনেক সময় আমরা উল্টোটা মনে করি, কিন্তু বিচক্ষণতা (prudency), বাস্তববুদ্ধি (pragmatism), সততা (integrity) এবং নৈতিকতা (morality) — এই শব্দগুলো একে অপরের শত্রু নয়।
বিলের ভিত্রে ভাট্টি মানে হিলের উপ্রে মিল কইরা ঝিলপাড়ের জঙ্গলে মর্ডান কবি লেখে, আর ছাইড়া দিলে যেমনে পুরা দেশবাসী দ্যাখে, জ-জ-জয় ভান্ডারী চিটাগাইংগা ব্যাকে, ধুঁয়ার চোটে কানা যেমনে নারিকেলের ধূপ মাইরা সেট!!!
হ্যাঁ হ্যাঁ আমি জানি, পাগল ছাড়া দুনিয়া চলেনা। কিন্তু ৪০৩ পৃষ্ঠার এই রহস্য উপন্যাস পড়ে ধুঁয়ার চোটে কানা যেমনে নারিকেলের ধূপ মাইরা সেট হয়ে থাকে, আমিও ঠিক তেমনি সেট হয়ে চেয়ারে বসে আছি আপাতত।
বেশ আশা জাগিয়ে শুরু হয়েছিল গল্পটা। আমার খুব প্রিয় একজন কবি প্রসূন বন্দোপাধ্যায়ের কবিতার চমৎকার একটা পঙ্ক্তি দিয়ে গল্পের সূচনা করেছেন লেখক। প্রতিটা অধ্যায়ের শুরুতেই সত্তরের দশকের বিভিন্ন কবিদের কবিতার পঙ্ক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। গোটা উপন্যাসটা পড়লে খুব স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে, লেখক একজন মরমিয়া কবিতাপ্রেমী। রহস্যগল্পের মধ্যে কবিতার অনুষঙ্গ। বাহ, কী দারুণ ব্যাপার!
বিদেশি রহস্য-সাহিত্যে বহুবার দেখেছি কাহিনির ভেতরে আরেকটা কাহিনি, উপন্যাসের ভেতরে আরেকটা কাল্পনিক উপন্যাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে (“embedded narrative”)। বাংলা সাহিত্যে এমন বস্তু এখনও আমার চোখে পড়েনি। এই উপন্যাসে সেই অভিনব শৈলীটিকে, সম্ভবত প্রথমবার ব্যবহার করা হয়েছে। বাহ, আরো দারুণ ব্যাপার!
গল্প এগোতে থাকে। দেখতে পেলাম, পাঠকের সস্তা মনোরঞ্জনের জন্যে রহস্যকাহিনির চিরাচরিত “escapist” ফর্মুলাগুলোর বাইরেও গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইস্যুকে টেনে আনা হয়েছে। সত্তরের দশককে বলা হয় “মুক্তির দশক”। শুধু তো মুক্তির দশক নয়, তোলপাড় করা ঘটনার দশকও বটে। নকশালবাড়ি আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, প্রতিষ্ঠানবিরোধী লিটিল ম্যাগাজিন আন্দোলন, ভারতীয় গণতন্ত্রে “ইমার্জেন্সি”র অনুপ্রবেশ, আরো কতো কিছু। এইসব সমকালীনতাকে কাহিনির ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে দিয়েছেন লেখক। বাহ, আনন্দে আমার প্রাণ আত্মহারা!
কিন্তু শ'খানেক পৃষ্ঠা এগোতেই মনটা খচখচ করতে লাগলো। একটু বেশি বকরবকর করছেন না লেখক? একই কথার, একই ঘটনার, একই জটিলতার বারবার পুনরাবৃত্তি করছেন না? গল্পের গতিও অত্যন্ত মন্থর। ছোটোবেলায় শীতকালের ভোরবেলায় টিউশানিতে যাওয়ার জন্যে যখন জোর করে ঘুম থেকে তুলে দেওয়া হতো, তখন যেভাবে চোখ অর্ধেক বন্ধ করে ভ্যাবলার মতো দাঁত মাজতাম, সেইরকম মন্থর। ভাবলাম, কী জানি বাবা, এটা তো আর-পাঁচটা বাজারি রহস্য উপন্যাসের মতো ফালতু জিনিস নয়। এর মধ্যে পোস্টমডার্ন কবিতা, নকশাল আন্দোলন, লিটিল ম্যাগাজিন, এই সব বড়ো বড়ো সব ব্যাপার আছে, হুঁ হুঁ বাওয়া।
মাঝের দুশো পৃষ্ঠায় পৃথিবীর সর্বকালের জটিলতম জিলিপির প্যাঁচ তৈরি করেছেন লেখক। খুব ভালো কথা। জিলিপির প্যাঁচেও আমার কোনও আপত্তি নেই (আই ♥️ আগাথা ক্রিস্টি)। আমি তো রেডি হচ্ছি রহস্যের দুর্দান্ত উন্মোচনের জন্যে। ওহ হরিবোল, কোতায় গ্যালো তোমার নকশাল, কোতায় গ্যালো তোমার লিটিল ম্যাগাজিন, আর কোতায়ই বা গ্যালো মুহুর্মুহু কবিতার ব্যবহার। রহস্য উন্মোচনের বাহানায় একটা গোদা সাইজের রামধনু রঙের গরুকে ঠেলে ঠেলে গাছে তুলে দিয়েছেন লেখক। শেষমেশ যদি সেই গাঁজার চাষই করবে, তাহলে অ্যাতো সোশিও-কালচারাল কেরামতির কী দরকার ছিলো মশাই?
যিনি গোয়েন্দা, তিনি রহস্যের সমাধান কীভাবে করেছেন? উপন্যাসের একদম শেষের দিকে, যিনি অপরাধী, তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গোয়েন্দাকে একটা প্রশ্ন করেছিলেন :
“আপনার এই সমস্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তি কোথায়?”
গোয়েন্দাকে তো আর পাচ্ছি না, তাই লেখকের প্রতি আমারও একই প্রশ্ন। এই জটিল রহস্যের যেরকম হাস্যকর (এবং অবিশ্বাস্য) সমাধানটা আপনি পেশ করলেন, তার ভিত্তি কোথায়? নেই! কোনও ভিত্তি নেই! যেন স্বপ্নের ভিতরে রাতারাতি সমাধান খুঁজে পেয়েছেন গোয়েন্দা। শুধু খুঁজে পাননি, সিনেমার মতো চোখের সামনে পুরো ঘটনাটা পষ্ট দেখতে পেয়েছেন।
স্রেফ আন্দাজে! স্রেফ “ইনটুইশন” নামক ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে! বেশি কিছু বলতে পারছি না স্পয়লার দিয়ে দেওয়ার আশঙ্কায়, কিন্তু একটা যৎসামান্য ক্লুয়ের দড়ির উপর দাঁড়িয়ে যে অসামান্য মাদারির খেলা দেখিয়েছেন, স্বয়ং শার্লক হোমস থাকলে গোয়েন্দাকে বলতেন, “মা গো, মা জননী, আপনার এট্টুসখানি পায়ের ধুলো আমার মাথায় মাখিয়ে দিন, প্লিজ? ব্রো ওয়াটসন, ওরকম ফ্যালফ্যাল কোরে তাকিয়ে কী দেকচো? তুমিও মা জননীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করো! হ্যাঁ, শুয়ে পড়ো। একদম টানটান হয়ে মাটিতে শুয়ে প্রণাম করো!”
আমার প্রিয় গদ্যশিল্পীদের তালিকায় ট্রুম্যান কাপোটি'র নাম উপরের দিকে থাকবে। এমন ঝকঝকে গদ্য লেখার হাত তাঁর, পড়লে মনে হয় বৃষ্টিঝরা বিকেলে বারান্দায় বসে গরম চায়ে রাস্ক বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছি। তাঁর “ইন কোল্ড ব্লাড” বইটা পড়ার অভিজ্ঞতার কথা এখনও বেশ মনে আছে। ক্রাইম জার্নালিজমকে সাহিত্যের পর্যায়ে তুলে ফেলেছিলেন সেই বইতে। তারপর “ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফ্যানিজ” সহ দু-তিনটে ছোটগল্প পড়েছিলাম। গল্প যেমনই লাগুক, তাঁর গদ্য পড়লে একটা আলাদা আরাম পাওয়া যায়। “মিউজিক ফর ক্যামিলিয়ন্স” বইটা বোধহয় স্টাইলিশ এবং উদ্ভাবনী গদ্যকার হিসেবে কাপোটি'র সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাজ (যদিও তাঁর সব ছোটগল্প এখনও পড়িনি আমি)।
তিনটে আলাদা অংশে বইটাকে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশে কয়েকটা ছোটগল্প রয়েছে। নাহ, ছোটগল্প বললে বোধহয় ভুল হবে। ওগুলোকে “ক্যারেকটার-স্কেচ” বলা উচিত। কাপোটির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা নিয়ে তো আলাদা করে কিছু আর বলার নেই। তাঁর চমৎকার সেন্স-অফ-হিউমর নিয়েও কিছু বলার নেই। এই বইয়ের মুখবন্ধে লেখক নতুন একটা সাহিত্য-ফর্মের উল্লেখ করেছেন : “নন-ফিকশন নভেল” (আশা করি নামটা শুনেই আমরা খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি ব্যাপারটা আসলে কী জিনিস)। তো, সেই হিসেবে এই গল্পগুলোকেও “নন-ফিকশন শর্টস্টোরিজ” বলা যেতে পারে।
তার পরের অংশটা, মানে বইয়ের দ্বিতীয় অংশটাকেই আসলে তিনি “নন-ফিকশন নভেল” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমেরিকার মিডওয়েস্ট অঞ্চলের (সম্ভবত ক্যানসাস স্টেটের) একটা স্মলটাউনে ঘটে যাওয়া সিরিয়াল কিলিংয়ের সত্যি ঘটনাকে উপজীব্য করে লেখা কাহিনিটা পড়ে ভীষণ আনন্দ পেয়েছি। আনন্দ পাওয়ার কথাটা স্বীকার করতে একটু লজ্জা লাগছে যদিও। একটার পর একটা মানুষ খুন হয়ে যাচ্ছে (তাও আবার হতভম্বকর উপায়ে), আর আমি ভাবছি : আহা, এভাবেও লেখা যায়! কেয়া বাত, কেয়া বাত!
তৃতীয় অংশটা বইয়ের সবচেয়ে দুর্দান্ত অংশ। অংশটার নাম : “কনভার্সেশনাল পোর্ট্রেটস্”। মানে, পারস্পরিক কথোপকথনের মাধ্যমে মানুষের চারিত্রিক রূপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সাতজন আলাদা আলাদা মানুষকে নিয়ে লিখেছেন। সাতজনের সামাজিক স্ট্যাটাস সাতরকম। কেউ লোকের বাড়িতে ঘরদোর পরিষ্কার করার কাজ করেন। কেউ ওয়াল স্ট্রিটের নামজাদা (কিন্তু ঘনঘন মদ্যপায়ী) ব্যক্তিত্ব। কেউ আবার কুখ্যাত সাইকোপ্যাথ চার্লস ম্যানসনের ঘনিষ্ঠ সহকারী (ইদানিং যিনি, বলাই বাহুল্য, শ্রীঘরে বিরাজ করছেন)। সাতজন মানুষের মধ্যে অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো-ও আছেন (যিনি নাট্যকার আর্থার মিলার-এর প্রেমে পড়েছেন সদ্য)। সাতজনের শেষ ব্যক্তিটি হলেন লেখক নিজেই। তিনি নিজেই নিজের ইন্টারভিউ নিয়েছেন। প্রত্যেকটা লেখাই উপভোগ্য এবং চিন্তার খোরাক জোগানদায়ী। কাপোটি'র রসবোধের ব্যাপারটা বারবার বলতে ইচ্ছে করে। মোটাদাগের নয়, খুব সূক্ষ্ম এবং তৃপ্তিদায়ক। কেবল রসবোধ আর স্টাইল নয়, প্রতিটা লেখার মধ্যে লেখকের একটা গভীর মানবিক সত্ত্বা টের পাওয়া যায়। একটা ছায়াচ্ছন্ন “হিউম্যান” দিক। নিজের সঙ্গে নিজের কথোপকথনের যে-লেখাটা, সেখান থেকে ছোটো একটা টুকরো তুলে এনে এই রিভিউটা সমাপ্ত করা যাক।
Q : If you could be granted one wish, what would it be?A : To wake up one morning and feel that I was at last a grown-up person, emptied of resentment, vengeful thoughts, and other wasteful, childish emotions. To find myself, in other words, an adult.
এমন একটা সকালের কথা আমিও প্রায়শই চিন্তা করি। কিন্তু হে মা জগদম্বা, এখনও সেই সকালটার দেখা পেলাম না।
কথায় বলে, brevity is the soul of wit. এই ক্ষুদ্র বইটা আমি বেশ কয়েকবার পড়েছি। প্রতিবার পড়ার সময়ই এই কথাটা আমার মাথায় আসে। নাটকের মতো একটি বিচিত্রমুখী এবং যৌগিক শিল্পমাধ্যমকে একটা ছোট্ট সাইজের বইয়ের মাত্র ৫৭ পৃষ্ঠার মধ্যে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা— এটা একটা অভাবনীয় কাজ।
নাটক একটা মিশ্র-শিল্প। মানে এতে অন্য নানারকম শিল্পের মিশেল ঘটেছে। কেউ নাটক লেখে। সেই লেখাটা কেউ পড়ে। তারপর তাকে মঞ্চায়িত করার ভাবনা আসে। লোক জোগাড় করা হয়। মঞ্চ সাজানো হয়। আলো লাগানো হয়। শব্দের ব্যবস্থা করা হয়। মঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রেক্ষাপট আঁকা হয়। গানবাজনার আয়োজন করা হয়। এরপর আছেন অভিনেতারা। তাঁরা কেউ কেবল সংলাপ বলেন। কেউ নৃত্য করেন। কেউ বা গান করেন। কেউ আবৃত্তি করেন। কেউ মুখে একটা কথাও বলেন না, শুধুই অভিব্যক্তির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন। যিনি নিহত সৈন্যের ভূমিকায় অভিনয় করছেন, তিনি সারাক্ষণ মঞ্চের মেঝেতে চুপচাপ মটকা মেরে শুয়ে থাকেন। অভিনেতারা কেমন পোশাক পরবেন, এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করারও লোক আছে। এরকম ছোটো বড়ো আরো অনেক কিছু। তারপর আমরা দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে নাটকটা দেখতে যাই। এই বিস্তারিত এবং বিপুল একটা আয়োজনকে তখন যেন সামগ্রিকভাবে আমাদের দিকে সজোরে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। মঞ্চের উপরের কয়েকজন মানুষের সঙ্গে মঞ্চের সামনে বসে থাকা কয়েকজন মানুষের মধ্যে এই যে একটা তাৎক্ষণিক এবং স্বতস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরি হয়, এটাই নাট্যশিল্পের মূল আবেদন।
এই পুরো আয়োজনটা কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে মূলত দুটো ভরকেন্দ্রকে আশ্রয় করে। একটা হলো, লিখিত নাটক। আরেকটা হলো, সেই লিখিত নাটকের অভিনয়। রচনা এবং অভিনয়। দুয়ে মিলে “নাট্যকলা”।
বাদল সরকারের “থার্ড থিয়েটার” মুভমেন্টের মতো ঘটনায় নাটকের দ্বৈত ভরকেন্দ্রের এই বিষয়টা আরো স্পষ্ট বোঝা যায়। থার্ড থিয়েটারের প্রযোজনাগুলোতে আনুষঙ্গিক আয়োজন বলতে কিচ্ছু থাকতো না। এমনকি মঞ্চও থাকতো না। সরাসরি ব্যস্ত রাস্তাঘাটের একপাশে নাটকের অভিনয় হতো। একজন লেখক নাটকটা লিখতেন, আর সেই নাটকটা কয়েকজন মিলে অভিনয় করতেন। ব্যাস, আর কিছু না। দর্শকরা যে যার ইচ্ছে মতো দাঁড়িয়ে পড়তেন। তাঁরাও অবাক হয়ে যেতেন আচমকা এই কাণ্ড দেখে। কখনও কখনও তাঁরাও নাটকের অংশ হয়ে যেতেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, নাটকের মতো এই যে এত বিচিত্র এত বিবিধ একটা আয়োজন, এর স্রষ্টা হিসেবে আমরা কাকে চিহ্নিত করবো? যিনি নাটকটা লিখেছেন, তাঁকে? নাকি যিনি পরিচালনা করেছেন? নাকি যাঁরা অভিনয় করেছেন? আর যিনি আলোকসম্পাত করেছেন? যিনি শব্দ-সংযোজন করেছেন? নেপথ্যে যাঁরা বাজনা বাজিয়েছেন? যিনি পোশাক ডিজাইন করেছেন? উইংসের পিছনে অল্পবয়েসি যে-ছেলেটা দৌড়ে দৌড়ে সবাইকে সেই সকাল থেকে লাগাতার চা খাইয়ে গেলেন, তাঁর কিছু দায় নেই? পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনও শিল্পে দায়বদ্ধতার এই প্রশ্নটা এত জোরদারভাবে উঠে আসে না। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও না। চলচ্চিত্রে সত্যি করেই সিংহভাগ দায় থাকে পরিচালকের। চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নৌকার হাল এবং রশি নিজের হাতে ধরে থাকেন তিনি। নাটকের ক্ষেত্রে উল্টো। ঠিক যখন সবার সামনে নাটকটা মঞ্চস্থ হওয়ার মোক্ষম সময় এলো, তখন কোথায় নাট্যকার? কোথায় পরিচালক? তখন আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে! একবার তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে একটা সিনেমা হাজার বার দেখলেও সেটা একই জিনিস। একটা নাটক যতবার মঞ্চস্থ করা হয়, প্রতিবার সেটা বদলে বদলে যায়। বহিরঙ্গে। অন্তরঙ্গে।
শম্ভু মিত্র নিজে ছিলেন বাংলা আধুনিক নাট্যজগতের অবিসংবাদিত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন। এই ক্ষুদ্র বইটা পড়লে বোঝা যায়, নাটক নামের এই শিল্পমাধ্যমটিকে নিজের ভিতরে সম্পূর্ণভাবে আত্তীকরণ করে ফেলতে না-পারলে, এতটা প্রাঞ্জলভাবে এতটা স্পষ্টভাবে তাকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। নাট্যশিল্পের গোড়ার বিষয়গুলো সহজ উপায়ে বোঝার জন্যে এই বইটার বিকল্প নেই। ক্যানো আজও, অ্যাটেনশন স্প্যানের দুর্ভিক্ষ আর চটজলদি হল্লাবাজির রমরমার এই যুগেও— যখন কোনও সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করলে ফট্ করে ল্যাপটপ খুলে ফেলা যায়, গান শুনতে হলে ফট্ করে স্পটিফাই, গুগল ইমেজ-সার্চের ভার্চুয়াল গ্যালারিতে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে পৃথিবীর বিখ্যাত চিত্রশিল্পের নমুনাগুলো, ইচ্ছে হলেই ফট্ করে দেখে নেওয়া যায় মোনালিসার স্মিত হাসি কিংবা ভ্যান গঘের আলু চাষী। তবু নাটক দেখতে হলে কষ্ট করে আমাদের যেতে হয় থিয়েটারে। আগে থেকে নিতে হয় মানসিক প্রস্তুতি। সবচেয়ে বড় কথা, ঘণ্টা দুয়েকের জন্যে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে হয়। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন যখন সন্ধ্যা আসে— প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে থাকে শুধু অন্ধকার— তখন আলোকিত মঞ্চ থেকে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে, মুখোমুখি বসে থাকেন নাটোরের বনলতা সেন। কোন্ চিরন্তন আবেদনের জাদুতে?
সুতরাং, কাকে বলে নাট্যকলা?
“কথা ও কাহিনী” রবীন্দ্রনাথের একটি ব্যতিক্রমী কাব্যগ্রন্থ। এই বইটি লেখার ঠিক আগেই তিনি “কণিকা” নামের একটি কবিতার বই প্রকাশ করেছিলেন। কণিকা-র ছোটো ছোটো কবিতাগুলোর সঙ্গে বাঙালি ইশকুলপড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা, “ভাবসম্প্রসারণ” নামক একটি ঝামেলাবহুল কাজের সূত্রে, খুব ভালো ভাবে পরিচিত।
আম্র কহে— একদিন, হে মাকাল ভাই,আছিনু বনের মধ্যে সমান সবাই।মানুষ লইয়া এল আপনার রুচি,মূল্যভেদ শুরু হল সাম্য গেল ঘুচি।
খুব সরল ভাষায় লেখা, উপদেশ কিংবা নীতিকথামূলক এই কবিতাগুলো জ্ঞানের ভারে কিংবা দার্শনিক চিন্তার গভীরতায় জর্জরিত নয়, বরং বেশ উপভোগ্য। উপদেশ দিয়েছেন বটে, কিন্তু পরিহাসের ছলে। সমাজ-সংসারের নানাবিধ বৈসাদৃশ্যকে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু কাউকে আঘাত না-দিয়ে। এই যে সহজ সরল ভাষায়, নিপুণ ছন্দে গাঁথা, গল্প শোনানোর ছলে কবিতা লেখার নবলদ্ধ স্টাইলটি উদ্ভাবন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, “কথা ও কাহিনী” কাব্যগ্রন্থে সেই ন্যারেটিভ স্টাইলটিকে আরো বিস্তারিতভাবে, আরো মনোহর ভঙ্গিতে, প্রয়োগ করেছিলেন তিনি। যেসব পাঠক কবিতা উপভোগ করতে পারেন না, তারাও এই বইটি পছন্দ করে ফেলবেন। কারণ কবিতা লেখার ছলে আসলে তিনি আমাদের নির্ভেজাল গল্প শুনিয়েছেন।
বইটির দুটো ভাগ। “কথা” অংশে মোট চব্বিশটি নাতিদীর্ঘ কবিতা রয়েছে। এই কবিতাগুলোর কাহিনিবস্তু বিভিন্ন বৌদ্ধ শাস্ত্র, প্রাচীন মরাঠি-পাঞ্জাবি-রাজস্থানি ইতিহাস, বৈষ্ণব সাহিত্য— এইসব সূত্র থেকে সংগ্রহ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর পাঠ-পরিধি এবং উৎসাহের দিগন্ত যে কতোটা বিস্তৃত ছিল, এই বইয়ের কবিতাগুলো তার প্রমাণ। যদি বৌদ্ধ কাহিনি খুঁজতে হয়, তাহলে খুব সহজেই তিনি “জাতক” কাহিনির শরণাপন্ন হতে পারতেন। কিন্তু সহজ পথে না হেঁটে, আখ্যানের সন্ধানে “অবদানশতক” কিংবা “মহাবস্ত্ববদান”-এর মতো স্বল্পপরিচিত বৌদ্ধ গ্রন্থের পৃষ্ঠা উল্টিয়েছেন তিনি। কাহিনি, ছন্দ এবং বক্তব্যের ত্রিবেণীসংগমে “কথা” অংশের কবিতাগুলো ভীষণ উপভোগ্য। বারবার পড়া যায়। অনেকবার পড়া যায়। অনেককিছু উপলব্ধি করা যায়।
এই বইয়ের “কাহিনী” অংশের প্রায় প্রতিটি কবিতা বাঙালি পাঠকদের কাছে সুপরিচিত, বহুলপঠিত। যারা আবৃত্তিচর্চা করেন, তারা তো এই কবিতাগুলো নিজেদের হাতের তালুর মতো চেনেন। “কাহিনী”-তে মোট সাতটি কবিতা আছে। এগুলোকে সাধারণ কবিতা না-বলে “নাট্য-কবিতা” নামে ডাকা যেতে পারে। এই অংশের কবিতাতেও কবিতা লেখার ছলে আদপে গল্প শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ছন্দের অপরূপ অথচ বলিষ্ঠ মাধুর্যে এবং বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে, এই কবিতাগুলো বাংলা সাহিত্যের বিশেষ সম্পদ। “দেবতার গ্রাস” কিংবা “বিসর্জন” কিংবা “গান্ধারীর আবেদন” কিংবা “কর্ণকুন্তী-সংবাদ”— কতোবার যে পড়েছি, তবু আশ মেটেনা।
“কাহিনী” অংশের কয়েকটা কবিতার ব্যাপারে আলাদাভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। কিন্তু এইখানে সেই আলোচনা করার পরিসর নেই। মহাভারতের মনোযোগী পাঠক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। “গান্ধারীর আবেদন” এবং “কর্ণকুন্তী-সংবাদ”— এই বিখ্যাত দুটি কবিতার প্লট তিনি মহাভারত থেকে নিয়েছেন। মহাভারতের অন্যতম অবহেলিত চরিত্রের নাম গান্ধারী। গান্ধারী কৃষ্ণের মতো সেলিব্রিটি ছিলেন না, ভীষ্মের মতো “মহান” ছিলেন না, কুন্তীর মতো তাঁর জীবন “সেনসেশনাল” ছিল না, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একজন পরিপূর্ণ মানবীরূপে দেখিয়েছেন। এই কবিতায় ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনকেও একটা ভিন্ন আলোকে দেখতে পাই আমরা। পরিচিত ক্যানভাসে পরিচিত রং দিয়ে কেমন এক অপ্রত্যক্ষ ট্র্যাজেডির ছবি এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ!
“কর্ণকুন্তী-সংবাদ” পড়লে আমার মনে হয় এটা কবিতা নয়, একটা কাকচক্ষু সুগভীর দীঘি। এপিক সাহিত্যের সুপরিচিত চরিত্রদের এই যে একটা নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেছেন রবীন্দ্রনাথ, এটা আমাকে মুগ্ধ করে। গোটা কবিতাটি সংলাপে গাঁথা। আর ছন্দের কী অসাধারণ বিস্তার। প্রথম স্তবকটি যতবার পড়ি, একটা আসন্ন ঝড়ের সংকেত আমার মাথায় বেজে ওঠে। সন্ধেবেলার ঝড়। বিষন্ন, বিপর্যস্ত, অন্ধকার, একাকী, সুন্দর।
পুণ্য জাহ্নবীর তীরে সন্ধ্যা-সবিতারবন্দনায় আছি রত। কর্ণ নাম যার,অধিরথ সূতপুত্র, রাধাগর্ভজাত,সেই আমি— কহ মোরে তুমি কে গো মাতঃ!
কুন্তীর বুকে কেমন ধাক্কা লেগেছিল, নিজের পুত্রের মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনে?
“কথা ও কাহিনী” তাই রবীন্দ্রনাথের একটি অপরূপ সৃষ্টি। বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন : “একদিন এল যখন আর-একটা ধারা বন্যার মতো মনের মধ্যে নামল। কিছুদিন ধরে দিল তাকে প্লাবিত করে। এর আনন্দবেগ যেন থামতে চাইল না।”
আমিও প্লাবিত হয়েছি বারবার এই ধারাস্রোতে। আমার মনের আনন্দও একই বার্তা শুনিয়েছে বারে বারে, নিজেকেই নিজে।
কথা কও, কথা কও।স্তব্ধ অতীত, হে গোপনচারী,অচেতন তুমি নও—কথা কেন নাহি কও!তব সঞ্চার শুনেছি আমারমর্মের মাঝখানে,কত দিবসের কত সঞ্চয়রেখে যাও মোর প্রাণে!হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনেকাজ করে যাও গোপনে গোপনে,মুখর দিনের চপলতা-মাঝেস্থির হয়ে তুমি রও।হে অতীত, তুমি গোপনে হৃদয়েকথা কও, কথা কও!
“সৎ-সাহিত্য” বলে একটা কথা আছে। যে সাহিত্য সৎ। যে সাহিত্যে ভান নেই। ভণিতা নেই। লোক-দেখানো ঢং নেই। যে সাহিত্যের চরিত্ররা জ্যান্ত। এই চরিত্ররা আমাদের পরিচিত হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। পরিচিত হোক বা অপরিচিত, কিন্তু একবারের জন্যেও লেখকের মনগড়া কৃত্রিম সৃষ্টি বলে ভ্রম হয়না। মাটির পৃথিবীতে শক্তপায়ে দাঁড়িয়ে আছে এরা। জীবন্ত। যে সাহিত্যের চরিত্ররা স্টেজে উঠে নাটকের ভাষায় কথা বলেনা। ভাষাও এদের জ্যান্ত। বাস্তব। দুপুর বারোটার রোদের মতো গায়ের চামড়ায় এদের মুখের ভাষার তাপস্পর্শ টের পাওয়া যায়। অথচ কেমন অবাক কান্ড, এই ভাষাটা আমার নিত্যদিনের ব্যবহার্য পরিচিত ভাষা নয়। গ্রাম্য আঞ্চলিক দুর্গম ভাষা। তবু এই ভাষা খাঁটি। খাঁটি এবং টগবগে। সদ্য হাঁড়িতে ধরা জিয়োল মাছের মতো টগবগে। এই হলো “সৎ-সাহিত্য”। আবু ইসহাকের লেখা “সূর্য-দীঘল বাড়ি” নিটোল নিখুঁত সৎ-সাহিত্যের একটি অনুপম নিদর্শন। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর অন্যতম। এই ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিধা নেই।
এই উপন্যাসে নায়ক নেই। নায়িকা আছে। জয়গুন নামের একজন অসামান্য নারী এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তিনি একজন অশিক্ষিত কুসংস্কারতাড়িত দারিদ্র্যপীড়িত ধর্মভীরু গ্রাম্য মহিলা ; কিন্তু শহুরে শিক্ষিত আলোকিত আধুনিক মানুষদের চেয়ে তাঁর শিরদাঁড়া অনেক বেশি সপাট সোজা। দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী বাংলাদেশের হতকুচ্ছিত সমাজে জয়গুনের মতো নারীরা তাঁদের অমসৃণ লালিত্যহীন হাতে লক্ষ্মীর প্রদীপ জ্বালিয়ে সেই পোড়ামুখো কীটদষ্ট সমাজটাকে উজ্জ্বল করে রেখেছিলেন। আহা রে, সেই নারীর না ছিলো উদরে আহার, না ছিলো শরীরে একটা গোটা কাপড়, না ছিলো সামাজিক সম্মান, না ছিলো পারিবারিক সিকিউরিটি, না ছিলো ভবিষ্যতের আশা, না ছিলো মাথা গোঁজার ভদ্রস্থ একটা ঠাঁই। এমনকি যে-প্রদীপটা জ্বালিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, সে প্রদীপে ছিলো না একফোঁটা তেল। তবু তিনি নিভতে দেননি তাঁর প্রদীপের শিখা। তবু কতো উঁচু ছিল তাঁর শির! তাঁর বাড়ির পাশের বুড়ো তালগাছটার চেয়েও উঁচু। করুণায়, কাঠিন্যে, কর্তব্যনিষ্ঠায়, আত্মসম্মানবোধে, দীপ্ত এবং দৃপ্ত এই মানুষটি— অতল গহ্বরের মতো নিরুপায় দারিদ্র্য তাঁকে ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারেনি! তাঁর মাথা নিচু করাতে পারেনি।
সূর্য-দীঘল বাড়ির অপয়া অভিশপ্ত ছায়ায় ঢেকে যাক এই বাংলার পূত-পবিত্র সমাজের জীবাণুমুক্ত বিবেকপ্রতিমা। যে-প্রতিমার বহিরঙ্গ সুসংস্কৃত, সুসজ্জিত এবং সুষমামণ্ডিত, কিন্তু ভিতরটা খড়ের গাদা দিয়ে ঠাসা! জয়গুন, আপনাকে লাল নীল সবুজ গেরুয়া রঙের স্যালুট নয়। আমার তরফ থেকে আপনার জন্যে রইলো একটা মানুষ-রঙের স্যালুট!