“যে জিনিসটা ছেলেবয়স থেকে বেশ ভালোই পারতাম সেটা হল ছবি আঁকা।”
ইন্টারনেটের গলিঘুজিতে মাঝে মাঝে একটা লিস্ট দেখা যায় : পৃথিবীর বিখ্যাত মানুষ যাঁরা মাঝপথে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়েছিলেন (‘ড্রপ-আউটস')। এইসব লিস্টে দুজনের নাম কখনই দেখা যায়না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সত্যজিৎ রায়। প্রথমজন পড়াশুনা ছেড়েছিলেন বিরক্ত হয়ে। দ্বিতীয়জন বাধ্য হয়ে। সত্যজিতের স্ত্রী বিজয়া রায়ের আত্মকথায় দেখতে পাই, জীবনে কখনও মায়ের কথা অমান্য করেননি তিনি। মায়ের প্রবল ইচ্ছেতেই শান্তিনিকেতনের কলাভবনে ভর্তি হয়েছিলেন চিত্রশিল্প শেখার উদ্দেশ্যে (অথচ তার আগে গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন ইকোনোমিক্সে অনার্স নিয়ে)।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সুকুমার রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যদিও শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি সান্নিধ্যলাভ করেছিলেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের (পরবর্তীকালে বিনোদবিহারীকে নিয়ে বিখ্যাত ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন— “The Inner Eye”)। শান্তিনিকেতনের পাঠ কিন্তু শেষ করতে পারেননি তিনি। জীবিকার তাগিদে চার বছরের কোর্স আড়াই বছরে ছেড়ে দিয়ে, শান্তিনিকেতনের নিবিড় প্রকৃতি-সন্নিহিত স্তিমিত জীবন ত্যাগ করে, সারাজীবনের মতো প্রবেশ করলেন কলকাতার প্রবল নাগরিক জঙ্গলে। কিন্তু শান্তিনিকেতনের শিল্পশিক্ষার আঁচড়টি তাঁর মননে সযত্নে ধারণ করে রেখেছিলেন আমৃত্যু।
অতিরিক্ত প্রতিভাধর মানুষদের কিছু কিছু প্রতিভার কথা তুলনামূলক আড়ালে রয়ে যায়। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি দুর্দান্ত আতশবাজি বানাতে পারতেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী দারুন বেহালা বাজাতে পারতেন। স্বামী বিবেকানন্দ অসাধারণ রান্না করতে পারতেন। রিচার্ড ফাইনম্যান খুব ভালো বোঙ্গো বাজাতে পারতেন। সত্যজিতের সিনেমা-নির্মাতা পরিচয়ের আড়ালে রয়ে গেছে তাঁর অলংকরণ পারদর্শিতার ব্যাপারটা। এমনকি লেখক সত্যজিৎও ইলাস্ট্রেটর সত্যজিতের চেয়ে অধিক আলোচিত। শিল্পী সত্যজিৎকে নিয়ে কিছু কিছু প্রবন্ধ লেখা হয়েছে বটে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ বই একটাও ছিল না। দেবাশীষ দেব সেই অভাব পূরণ করেছেন।
দেবাশীষ দেব নিজে একজন স্বনামধন্য ইলাস্ট্রেটর। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের ভীষণ জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হলো দেবাশীষবাবুর অলংকরণ। দীর্ঘদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করলেও তাঁর শিক্ষানবিশি শুরু হয়েছিল সত্যজিৎ-সম্পাদিত ‘সন্দেশ' পত্রিকায় ছবি আঁকার মধ্যে দিয়ে। সত্যজিৎ রায়কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি, এবং নিজে একজন অলংকরণশিল্পী হওয়ার সুবাদে সত্যজিতের চিত্রশিল্পী সত্তাটিকে তিনি বিশেষ নজরে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেই পর্যবেক্ষণ এবং দীর্ঘকালীন চিন্তার ফসল হলো এই অসামান্য বইটি। বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে : “যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে এই বইটির জন্য অপেক্ষা করে রয়েছেন, তাঁদের জন্য”। আমি নিজে এই অপেক্ষাকারীদের একজন। প্রকাশ হওয়ার তিনদিনের মধ্যে হস্তগত করেছিলাম বইটিকে।
বাকি সবকিছুর কথা বাদ দিলাম। শুধু ‘সন্দেশ' পত্রিকার প্রচ্ছদগুলো দেখেই আমি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। তিন অক্ষরের ‘সন্দেশ' শব্দটিকে নিয়ে সত্যজিৎ যেন ছেলেখেলা করেছেন। কতো বিচিত্র টাইপোগ্রাফিতে ধরতে চেয়েছেন পত্রিকার এই অর্থবহুল নামটিকে। প্রচ্ছদগুলোর কতো বর্ণময় বৈচিত্র্য। কল্পনার কী অবাধ বিচরণ! (প্রায় একই কথা বলা যায় “এক্ষণ” পত্রিকার প্রচ্ছদগুলোর ব্যাপারেও)। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন কলকাতার বিখ্যাত একটি বিজ্ঞাপন সংস্থার কমার্শিয়াল ডিজাইনার। সেই সংস্থার ম্যানেজার দিলীপকুমার গুপ্ত পরবর্তীকালে ‘সিগনেট প্রেস' নামের বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং সত্যজিতের সামনে খুলে যায় ইলাস্ট্রেশন এবং প্রচ্ছদ নির্মাণের অত্যাশ্চর্য দুনিয়া। সিগনেট প্রেস থেকেই বেরিয়েছিল ‘আম আঁটির ভেঁপু' (‘পথের পাঁচালী'-র সংক্ষিপ্ত সংস্করণ)। এই বইটির প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ করার সময়ই সত্যজিতের মাথায় আসে একটি সিনেমার আইডিয়া, যা কিনা বদলে দেবে তাঁর নিজের জীবন এবং ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসকে।
জীবনে যে কাজেই হাত দিয়েছেন, ছকবাঁধা একঘেঁয়েমিকে অতিক্রম করে নিজস্ব অভিনব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন সত্যজিৎ। ছবি আঁকাও ব্যতিক্রম নয়। কোনো একটি গল্প কিংবা উপন্যাসের সঙ্গে অলংকরণের ব্যাপারটি আগে ছিল নিছকই একটা ফাঁকা জায়গা ভরানোর অভিপ্রায়। বেশিরভাগ সময়ে অলংকরণশিল্পীর নামটুকুও উল্লেখ করা থাকতো না। প্রচ্ছদশিল্পীর নাম তো এখনও বহু সময় উল্লেখিত থাকেনা। এমন একটি পেশাদারী অবজ্ঞার পরিবেশে কাজ করতেন শিল্পীরা। নিজের অলংকরণ-কৌশলেই প্রচলিত প্রথাটিকে এক ধাক্কায় পাল্টে দিলেন সত্যজিৎ। প্রকাশকরা এই নবাগত শিল্পীর নামটিকে উপেক্ষা করতে পারলেন না। এমনকি অনেক সময় দেখা গেলো, বইয়ের চেয়েও বইটির প্রচ্ছদশিল্পীর খ্যাতি বেশি ছড়িয়ে পড়েছে! বইয়ের বিজ্ঞাপনে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা থাকতো প্রচ্ছদশিল্পীর নাম— এমন বিস্ময়কর কাণ্ড বাংলা প্রকাশনা জগতে কেউ কখনও দ্যাখেনি!
অলংকরণ তো শুধুমাত্র একটি বই কিংবা একটি রচনার সৌন্দর্যবৃদ্ধির উপায় নয়। একটি গল্পের সঙ্গে একই পৃষ্ঠায় মুদ্রিত একটি অলংকরণ যেন গল্পটির অন্যতম একটি চরিত্র। গল্পটির অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুকে আরো গভীরতা দ্যায় সেই অলংকরণ। কিন্তু তার জন্যে চিত্রশিল্পীর তরফে বুদ্ধিদীপ্ততার প্রয়োজন। খেয়াল গায়কের সঙ্গে যদি আনাড়ি তবলাবাদক সঙ্গত করে, তাহলে সেই গানের রসহানি ঘটে। কিন্তু যোগ্য সঙ্গতকারীর সহায়তা পেলে গায়কের পরিবেশনা অন্য মাত্রা পায়। সত্যজিৎ তাঁর অলংকরণের মাধ্যমে এই বুদ্ধিদীপ্ত সহায়তা করেছেন অগুনতি গল্প উপন্যাস কিংবা বইয়ের প্রচ্ছদে। তাঁর নিজের লেখাপত্রে তো বটেই, প্রচুর অখ্যাত লেখক আছেন যাঁদের রচনা উৎরে গেছে স্রেফ সত্যজিতের অলংকরণের অসামান্য শিল্পগুণে।
ছবি আঁকার এই তুলনামূলক অনালোচিত ক্ষেত্রটিতেও কী না করেছেন সত্যজিৎ! বিজ্ঞাপনের লে-আউট এঁকেছেন, বই এবং পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন, গল্প উপন্যাসের ইলাস্ট্রেশন করেছেন, ক্যালিগ্রাফি বা হরফ চর্চা করেছেন, নিজস্ব ইংরিজি ফন্ট তৈরি করেছেন, সিনেমার পোস্টার ডিজাইন করেছেন, সিনেমার সেট ডিজাইন করেছেন, এমনকি লোগো ডিজাইন করেছেন (কলকাতার বিখ্যাত প্রেক্ষাগৃহ ‘নন্দন' কিংবা ভারতের ‘সাহিত্য আকাদেমি' সংস্থার লোগো কিংবা বিখ্যাত ভারতীয় প্রকাশন সংস্থা ‘রূপা পাবলিকেশনস'-এর লোগো কিংবা ‘দেশ' পত্রিকার সুপরিচিত লোগোটিও তিনি তৈরি করেছেন)। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ' সিনেমাতে একটি বিখ্যাত দৃশ্য আছে। মগনলাল মেঘরাজের ডেরায় বেচারা লালমোহনবাবুর সঙ্গে ছুরি দিয়ে বিপজ্জনক খেলা দেখানোর দৃশ্যটি। এই দৃশ্যে লালমোহনবাবু একটি চিত্রপটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেই ভয়ানক চিত্রপটটিও সত্যজিতের স্বহস্ত-অঙ্কিত!
এই বিচিত্র মানুষটির কর্মকাণ্ড দুই মলাটে আঁটিয়ে ফেলা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। তবু পরম অধ্যবসায়ের সঙ্গে, শ্রদ্ধার সঙ্গে, ভালোবাসার সঙ্গে এবং তন্নিষ্ঠ গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সত্যজিতের শিল্পীসত্তার বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন দেবাশীষ দেব। এমন একটি কাজের জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়! ঠিক যেমন সত্যজিৎ রায় মানুষটির প্রতি আমার অপার মুগ্ধতার পরিমাপের জন্য কোনো মাপকাঠির দৈর্ঘ্যই যথেষ্ট লম্বা নয়!
(‘সন্দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গল্পের হেডপিস)
একটা রেলস্টেশনের বইয়ের দোকান থেকে বইটা কিনেছি। আগে স্টেশনে কতোরকম বই পাওয়া যেত। সেদিন কেনার মতো এই একটাই বই পেলাম। বইটার নাম এবং চেহারা আগেও দেখেছি বহু জায়গায়। চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্যে খুবই আবশ্যিক একটা বই হিসেবে পরিচিতি আছে। কিন্তু যে কারণেই হোক, আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। এবার পড়লাম। কী অপূর্ব বই! কী চমৎকার ধাপে ধাপে, বেশ লজিক্যাল পদ্ধতিতে নতুন নতুন শব্দ চিনিয়েছেন লেখক! কী দারুন রসবোধ— একেবারেই টেক্সটবইসুলভ নয়। আমার এমনিতেই ইংরিজি শব্দের স্টক খুবই সীমিত। কিছু লিখতে গেলে শব্দ হাতড়াই। আর কথা বলতে গেলে তো... যাক গে সেসব কথা। কিন্তু এই বইতে এমন একটা চমৎকার পদ্ধতিতে বিভিন্ন শব্দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমার মতো শব্দ-হাতড়ানো লোকেরও বেশ কিছু শব্দ মনে থাকবে। অন্তত আশা করছি যে মনে থাকবে!
কোনও এক মাকোন্দো গ্রামের কোনও এক বুয়েন্দিয়া পরিবারের গল্প। ভিন্ন মহাদেশের ভিন্ন সমাজ, ভিন্নরকম মানুষের ভিন্ন ভিন্ন লোকাচার, স্বভাবচরিত্তির, পাগলামি। আমার কাছে এইসব অপরিচিত লাগে। তবু ভালো লাগে। আমি তো নিশ্চিন্দিপুরও চিনতাম না। দস্তইয়েভ্স্কির সেইন্ট পিটার্সবার্গও না। আর কে নারায়ণের মালগুড়িও না। তবু তো তারা অনুভূতির গভীরে অনুরণন তুলতে পেরেছিল। মাকোন্দোও পেরেছে ভীষণভাবে! শুধু তার অপার বিস্ময়ঘেরা পরিবেশ আর সময়ের সঙ্গে তার ঝিমধরা সম্পর্কের কারণেই নয়, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের অতুলনীয় গদ্যশৈলীর কারণেও। যে গদ্য কিনা, বাংলা অনুবাদ সংস্করণের ভূমিকায় সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের অবলোকনে : “বাস্তবকে গলিয়ে আলোময় প্রবাহে পরিণত করেছে”। কাহিনি নয়, চরিত্র নয়, এই অপ্রতিম গদ্যই উপন্যাসটির সবচেয়ে বড় সম্পদ।
অথচ এই গদ্য আমার কাছে এসেছে দুই দফা হাতফেরত হয়ে। স্প্যানিশ থেকে ইংরিজি, ইংরিজি থেকে বাংলা। গতবছর এই বইটি পড়েছিলাম গ্রিগোরি রাবাসার চমৎকার ইংরিজি তর্জমায়। কিন্তু বাংলা অনুবাদ পড়তে যেহেতু সবসময় আমি আগ্রহী হয়ে থাকি— ভালো বাংলা অনুবাদ হাতে পেলে কদাপি ইংরিজি অনুবাদ পড়িনা— তাই জি এইচ হাবীবের এই অনুবাদটি তো একদিন আমার পড়ার কথাই ছিল! ইংরিজি অনুবাদটি আগে পড়ার কারণে আরও ভালো বুঝতে পেরেছি, কী অসম্ভব মেধাবী একটা কাজ করেছেন অনুবাদক। মাকোন্দোর দুনিয়া শুধু আমার পরিচিত দুনিয়ার চেয়েই আলাদা নয়, এই দুনিয়ার যেকোনো দুনিয়ার চেয়ে আলাদা। রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শশুদ্ধু তাকে সার্থকভাবে বাংলায় উপস্থাপন করা যে কতটা গভীর অভিনিবেশের কাজ, প্রথম কয়েকটা পৃষ্ঠায় প্রবেশ করলেই পাঠক সেটা বুঝে ফেলবেন! এমন উৎকৃষ্ট বাংলা অনুবাদ থাকলে ইংরিজি অনুবাদ পড়ার আদৌ প্রয়োজন নেই বোধহয়।
লাতিন আমেরিকার ‘জাদুবাস্তব' ঘরানার ব্যাপারে অজস্রবার আলোচনা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে, তাই এই বিষয়ে নতুন করে আমার আর কিছু বলার নেই। আমি কিন্তু বইটিকে কোনও ঘরানার ছাঁচে ফেলে পড়িনি। এইভাবে সাহিত্য পড়তে পারিনা আমি। আমি তো সাহিত্যের তাত্ত্বিক পাঠক নই, সাধারণ ছাপোষা পাঠক। কেবল আনন্দের জন্য বই পড়ি। তাই এই উপন্যাস যদি আমাকে টেনে ধরে রাখতে না পারতো, স্রেফ “বিখ্যাত” কিংবা “অবশ্যপাঠ্য” কিংবা “অন্যরকম” হওয়ার কারণেই উপন্যাসটি আমি জোর করে গিলতাম না (তাও আবার দুবার)। উপন্যাসটির কাহিনিবিন্যাস আমার অভ্যস্ত রুচির বাইরে হওয়া সত্ত্বেও আমি অসম্ভব উপভোগ করেছি। ক্যানো? কারণ আমার মনে হয়েছে, উপন্যাসটি লেখার সময় লেখক “নতুন একখান ���াকলাগানো জিনিস লিখছি রে ভাই” জাতীয় কোনও ভণিতার আশ্রয় নেননি। জিনিস নতুন বটে, কিন্তু সৃজনশীল অনুপ্রেরণার খুব সৎ এবং অকৃত্রিম বহিঃপ্রকাশ ছাড়া এইরকম ঘোরগ্রস্ত রচনা সম্ভব নয়।
উপন্যাসের শিরোনামে “নিঃসঙ্গতা” শব্দটি রয়েছে। নিঃসঙ্গতা কি “বিষন্নতা” শব্দের সমার্থক? সবসময় নয়। “একাকিত্ব” শব্দটি যেমন সবসময়ই বিষন্নতার সহচর। একটি পরিবারের প্রায় ছয়/সাতটি প্রজন্মের সদস্যদের মোটামুটি জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি যাপনচিত্র বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসে। কিন্তু আবার স্মরণ করছি, গতানুগতিক রচনারীতির মতো সরলরৈখিক নয় এই বর্ণনা। তবে কি কাহিনির চলন বঙ্কিম? তাও নয়। তাহলে কাটাকুটি? এলোমেলো? এদিক সেদিক? এবড়ো খেবড়ো? তাও নয়। তাও নয়। তাও নয়। এই উপন্যাসের রচনারীতি নিঃসঙ্গতার মতোই অধরা রহস্যময়। কখনও এর রূপ বিষন্ন। কখনও বিরক্তি উদ্রেক করে। কখনও এর স্পর্শে পুলক জাগে। বারতিনেক পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। যেন স্বপ্নের ভেতর বৃষ্টি পড়ছিল। আমি বৃষ্টিপতনের সেই শীতল শব্দ পান করছিলাম। ঘুম ভেঙে আবার খুলেছি বইটির পৃষ্ঠা। তারপর ডুবতে গিয়েও ভেসেছি। আবার ভাসতে ভাসতে তলিয়ে গেছি কখন যেন। নিঃসঙ্গতার কুহেলি শিশিরে ভিজে গেছে আমার পাঠকহৃদয়, পাতার পোশাক...
যতই দিক না যুদ্ধ, খণ্ডকাল হবে পরাজিতএই তো জেনেছি শাস্ত্রে, যতোটুকু হয়েছে অধীত।অখণ্ড কালের পক্ষপাতধন্য আমি মহাশয়,আমাকে রাঙাবে চোখ, এতো শক্তি রাখে না সময়।
(নবনীতা দেব সেন)
উপন্যাসটিতে কয়েকজন অত্যাশ্চর্য নারীচরিত্রের দেখা পাই। এরকম চরিত্রবহুল একটি উপন্যাসে একটিমাত্র চরিত্রকে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ করানো যায় না। তবু উরসুলা ইগুয়ারান নামের একজন নারীকে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে আমার। ভেবে দেখলে, উপন্যাসের নামটি খুব সহজেই “উরসুলার নিঃসঙ্গতার একশ বছর” রাখা যেতেই পারতো। লক্ষ্য করলাম, উপন্যাসের পুরুষচরিত্রগুলি প্রত্যেকে কমবেশি প্রায় একইরকম (তাদের নামের মতোই)। কিন্তু নারীচরিত্রগুলি নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য নিয়ে জ্বলজ্বল করছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে পুরুষরা বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছেন, উদ্দাম জীবনযাপন করেছেন, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে অনুপ্রাণিত করেছেন বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম বিখ্যাত ‘ওপেনিং লাইন'-টি লেখার জন্য (“বহু বছর পর, ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে, কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়ে যাবে সেই দূর বিকেলের কথা...”)। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, প্রকৃত বৈপ্লবিক কাজগুলো, অচিন্তনীয় কাজগুলো, সবচেয়ে বেশি প্রভাববিস্তারী কাজগুলো, আদপে করেছেন এই উপন্যাসের নারীরা। আমার হৃদয়কে সবচেয়ে গভীরভাবে স্পর্শ করেছেন তারাই।
বিপ্লবের কথায় মনে পড়লো, লাতিন আমেরিকার বিপ্লবজারিত অস্থির সমাজের বয়ান এই উপন্যাসের পৃষ্ঠায় খুব সন্তর্পণে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন লেখক। এই মহাদেশটির রাজনৈতিক সচেতনতা পৃথিবীর বাকি অংশের চেয়ে আলাদা। একইসঙ্গে চরম প্রতিবাদমনস্কতা এবং প্রহসনসদৃশ অত্যাচারী ক্ষমতাসীন কতিপয় জন্তুর পেশীপ্রদর্শন— দক্ষিণ আমেরিকার এই রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে আমরা প্রত্যেকেই পরিচিত। কেমন সুকৌশলে সেই বিপ্লব-প্রতিবিপ্লবের আন্তঃসম্পর্কটি যেন মঞ্চনাটকের উইংসের পিছনে সবসময় প্রস্তুত রেখেছেন লেখক। যখন দরকার দর্শকের সামনে এনেছেন, আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন। আর এই উপন্যাসের কথন যেন একটা সুবিস্তৃত অর্কেস্ট্রার মতো। কতো অদ্ভুত যন্ত্র একসঙ্গে বাজছে। সুরের পর্দা উঠছে, নামছে। সিম্ফনি ছড়িয়ে পড়ছে অডিটোরিয়ামের আনাচে কানাচে। উপন্যাসটির মূল বক্তব্যটি কাহিনির একদম শেষের দিকে হঠাৎ আমার চোখে পড়ে গেছে। একইসঙ্গে অপরূপ এবং বিচিত্র এক ভাষায় লেখা দুর্গম এই উপন্যাসটির মর্মার্থ যেন খুব আবছাভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি সেই লাইনটি পড়ে :
“...ওরা যেখানেই থাকুক না কেন একথা যেন সবসময় মনে রাখে যে অতীত একটা মিথ্যে ছাড়া কিছু নয়, স্মৃতির দিকে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়, চলে যাওয়া বসন্তের দিন আর ফেরবার নয়, আর, সবচেয়ে উন্মত্ত, সবচেয়ে একনিষ্ঠ প্রেমও শেষঅব্দি একটা ক্ষণস্থায়ী সত্য ছাড়া কিছু নয়।”
আদৌ উপলব্ধি করতে পেরেছি কি? লেখকও মনে হয় চাননি আমি পুরোপুরি উপলব্ধি করি। মানুষের একটা গোটা জীবন কেটে যায় নিঃসঙ্গতাকে উপলব্ধি করতে করতে...
(আমার সঙ্গে একই সময়ে বইটি পাঠ করেছেন আমার বন্ধু আঞ্জুমান লায়লা নওশিন। উপন্যাসটি অবলম্বনে নেটফ্লিকস প্রযোজিত নতুন টিভি-সিরিজটির খবর এবং এই উপলক্ষ্যে বইটি আরেকবার পড়ে ফেলার পরামর্শ— দুটোই তিনি দিয়েছেন। মার্কেজ-অনুরাগী নওশিনকে কৃতজ্ঞতা!)
মাতৃভাষার প্রতি আমাদের ভালোবাসাও আছে আবার অবহেলাও আছে। ভালোবাসার মানুষকে অবহেলা করার মতো। যদিও এমনটা যে করা উচিত নয় তা আমরা সবাই জানি। আমরা সবাই ছোটবেলা থেকে বাংলা ভাষাতেই কথা বলি, চিন্তা করি, স্বপ্ন দেখি। কিন্তু মুখের ভাষা আর লেখার ভাষায় তো পার্থক্য আছে। মুখের ভাষার বাক্যগঠন আর লেখার ভাষার বাক্যগঠন অনেকটাই আলাদা। তাই ভাষাকে যদি ভালোবাসি, তাহলে লেখার সময় আমরা সবাই আরেকটু যত্নবান হলে আখেরে বাংলা ভাষারই উপকার হয়। অনেকে আছেন যারা নিয়ম ভাঙতে চান। কিন্তু নিয়ম ভাঙার আগে নিয়মগুলো না জানলে কেমনে কী?! একটা ভাষা গড়ে ওঠে শত শত বছরের পরিচর্যায়। তাকে নাড়াচাড়া করার সময় একটু যত্নবান হওয়া উচিত নয়, বলুন?
অভিধান থেকে সাধারণত আমরা শব্দের অর্থ খুঁজে বের করি। অনেকসময় কোনো একটি শব্দের সঠিক বানানের খোঁজ করতেও অভিধানের শরণাপন্ন হই। সাধারণ অভিধানের সঙ্গে ‘প্রয়োগ অভিধান'-এর পার্থক্য আছে। প্রয়োগ মানে বাংলা ভাষার বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার কিংবা ব্যাকরণসম্মত প্রয়োগ। ‘ওতপ্রোত' লিখবো নাকি ‘ওতঃপ্রোত'? যেটা লিখবো সেটা ক্যানোই বা লিখবো? ‘ছন্দপতন' লিখবো নাকি ‘ছন্দোপতন'? ‘ইতিমধ্যে' কিংবা ‘ইতিপূর্বে'— এই দুটো শব্দ নাকি ভুল। ক্যানো ভুল? তাহলে সঠিক বানান কোনটা? এমনিতে দেখতে গেলে ভাষা নিয়ে এত খুঁটিনাটি তলিয়ে ভাবার কি আদৌ কোনো দরকার আছে? ভাষাকে ভালোবাসলে অবশ্যই দরকার আছে। আর অবহেলা করলে দরকার নেই।
যে বইগুলো সবসময় আমার হাতের কাছাকাছি থাকে, তার মধ্যে এটি একটি। যেমন খানিকক্ষণ আগেই ভাবছিলাম, ‘কোনো' এবং ‘কোনও' শব্দদুটির পার্থক্য কী? জানিয়ে রাখি, এই দুটো শব্দের অর্থগত আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। দুটো বানানই লেখা যেতে পারে। কিন্তু একটি রচনায় যেকোনো একটি বিকল্প লেখা বাঞ্ছনীয়। প্রসঙ্গত, প্রায় একই ধাঁচের আরেকটি খুব কাজের বই আছে। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সম্পাদিত “বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন”। যারা শুদ্ধ বাংলা লিখতে আগ্রহী, এই বই দুটি তাদের পড়ার টেবিলে না থাকলেই নয়! ভাষাকে অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে এই দুটি বই রীতিমত অস্ত্রের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে! তাই বলে “self-appointed ভাষা-Nazi” হতে হবে না! অন্যের বানান ভুলও ধরতে হবে না (ধরলেও সবার সামনে নয়, আড়ালে জানাতে হবে
মোহব্বত করনে ওয়ালে কম না হোঙ্গে তেরি মেহ্ফিল মে লেকিন হম না হোঙ্গে
দক্ষিণ এশিয়ার একান্ত নিজস্ব সংগীতশৈলীগুলির মধ্যে মার্গসংগীতের ধারা বাদ দিলে গজল গানের ইতিহাসই বোধহয় সবচেয়ে প্রাচীন। ধ্রুপদী গজল লেখা হয় মূলত উর্দু ভাষায়। উর্দু একটি পাঁচমেশালি ভাষা। আরবি, ফারসি, তুর্কি, সংস্কৃত, ব্রজ, অওয়ধি, এরকম নানাবিধ ভাষার মিশ্রণে মধ্যযুগে তৈরি হয়েছিল এই চমৎকার ভাষাটি। যদিও “গজল” শব্দটি আরবি এবং শব্দটির আক্ষরিক অর্থ : “প্রেমিকার সঙ্গে সংলাপ”।
শুধুমাত্র প্রতিদানহীন ব্যর্থ প্রেম (unrequited love)-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি স্বতন্ত্র সংগীতশৈলী পৃথিবীতে বোধহয় আর একটাও নেই। এবং এই শৈলীটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, গানের লিরিকের সাহিত্যগুণ অতি উঁচুমানের। সুরবর্জিত লিরিকগুলি পড়লে খাঁটি কবিতাপাঠের আনন্দ পাওয়া যায়। এবং এই উঁচুদরের কবিতার অঙ্গে যখন সুরের পোশাক জড়ানো হয়, এবং সঙ্গে যুক্ত হয় উপযুক্ত কণ্ঠের মাধুর্য, তখন বাহারের (বাহার= বসন্তকাল) যেমন চমন (=ফুলের বাগান) ইয়াদ আতা হ্যায়, আমাদের সবারই যেন কোনো এক গুলবদনের কথা মনে পড়ে য���য়... (গুলবদন= গোলাপের মতো সুন্দর মুখ যার। এখানে মনে রাখা দরকার, গুলবদন শব্দের প্রযুক্ত অর্থ তথাকথিত “সুন্দরী” নয়। সবার কাছেই তার প্রেমিকার মুখ গোলাপের মতো সুন্দর)।
এই গুলবদনের উদ্দেশ্যেই যুগের পর যুগ লেখা হয়ে এসেছে গজল গান। এই গুলবদন কখনও রক্তমাংসের, কখনও কল্পনার। কিন্তু একে কখনোই ধরা যায় না— আলেয়ার মতো। কাউকে পেতে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছা হৃদয়ে জাগেনি, এমন মানুষ পৃথিবীতে বোধহয় একজনও নেই। কাউকে স্পর্শ করতে চাই, কারো সঙ্গে নিজের জীবন মিশিয়ে দিতে চাই, নিজের মনের আর্তিগুলো কারো কানে পৌঁছে দিতে চাই, কিন্তু কিছুতেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না। গজল সংগীতের মূল নির্যাস এটাই। এই জন্য গজলের কথায়-সুরে মিশে থাকে একটা অসহায়তার অনুষঙ্গ, অপ্রাপ্তির রিনরিনে যন্ত্রণা।
গজলের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীর বেশ সাদৃশ্য আছে। বৈষ্ণব পদাবলী মূলত নারীর (শ্রীরাধিকার) বয়ানে লেখা, আর গজল পুরুষের বয়ানে (যদিও পরবর্তীকালে নারীরাও গজল লিখেছেন)। সেই গুলবদন কি বুঝতে পারছে না আমি কতটা বেদনা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছি? আমার অস্তিত্ব যে তাকে ছাড়া শূন্য মনে হয়, এটা সে বুঝতে পারছে না? ভিড়ের মাঝেও আমরা যখন একলা হয়ে যাই, এইসব প্রশ্ন যখন আমাদের জর্জরিত করে, ঠিক তখনই জগজিৎ সিং তাঁর জমজমাট কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন : শাম সে আঁখ মে নমি সি হ্যায়/ আজ ফির আপ কি কমি সি হ্যায়... (সন্ধ্যে থেকে চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার/ তুমি যে নেই এই কথাটা ফের মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার)।
যদি আত্মগত ঈশ্বরের অস্তিত্বকে বুঝতে না-পারি, তাহলে বাউল গান অর্থহীন মনে হয়। যদি সমাজের ভন্ডামি, নোংরামি আর দুনিয়াদারির ধান্দাবাজির প্রতি তীব্র ক্রোধ এবং প্রতিবাদের আগুন না-জ্বলে বুকের ভিতর, তাহলে দ্রুতলয়ে গাওয়া হিপ-হপ সংগীতের মর্ম বোঝা সম্ভব নয়। যদি চেতনার অ্যাবস্ট্র্যাক্ট অবস্থাকে উপলব্ধি করতে না-পারি, তাহলে ধ্রুপদী সংগীতকে নেহাতই অপ্রয়োজনীয় মনে হবে। যা-কিছু আমরা নিজেরা বুঝতে পারি না, তাকেই খারিজ করে দিতে চাই, কিংবা তাচ্ছিল্য করতে চাই।
গজল গানকেও অনেকেই বুঝতে ভুল করেন। কিংবা বুঝতে পারেন না। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু যারা গজল গান শুনতে ভালোবাসে, “তুমি কি মরীচিকা না ধ্রুবতারা?”— এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর যারা এখনও খুঁজে পায়নি, তাদের আশ্বাস দেওয়ার জন্য গুলাম আলি গেয়েছিলেন : ইয়ে বাতেঁ ঝুটি বাতেঁ হ্যায়, ইয়ে লোগো নে ফ্যায়লায়ি হ্যায়/ তুম ইনশা জি কা নাম না লো, ক্যায়া ইনশা জি সৌদায়ি হ্যায়? (“অনেকে অনেকরকম হাবিজাবি কথা বাজারে ছড়িয়েছে, তুমি সেইসব কথায় কান দিও না/ তুমি ইনশা-কেও ভুল বুঝো না, ইনশার কথা কি অতই সস্তা নাকি?”— ইনশা হলো এই অসামান্য গানটির রচয়িতা, পুরো নাম ইবন-এ-ইনশা। গজল সংগীতের সামগ্রিক দর্শন এবং সংজ্ঞা নিরূপণের উদ্দেশ্যেই যেন আমার অত্যন্ত প্রিয় এই গানটি লিখেছিলেন ইনশা)।
কাওয়ালি, টপ্পা, ঠুমরি, খেয়াল, কীর্তন কিংবা ভজন— উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী সংগীতের এই চিরাচরিত শৈলীগুলির সঙ্গে গজলের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, গজল একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতির গান। কোনো সমষ্টিগত কিংবা সামাজিক কিংবা ধর্মীয় কিংবা আনুষ্ঠানিক অনুষঙ্গ জড়িয়ে নেই এই গানের সঙ্গে। যদিও পেশাগত কারণে অনেকেই সমবেত শ্রোতাদের সামনে গজল পরিবেশন করেন, কিন্তু বৈশিষ্ট্যগতভাবে গজল বারোয়ারি গান নয়। একলা শ্রোতার গান। ফরিদা খানুম কিংবা ভূপিন্দার সিং কিংবা বেগম আখতার যখন গান করেন, শুধু আমারই জন্য করেন।
গজল গানের বিবিধ গোরখ্-ধান্দা (গোলমেলে ব্যাপার) নিয়ে অনেক তানাবানা (টালবাহানা) হলো, এবার তো বইটার ব্যাপারেও সামান্য কিছু গুফ্তাগু (কথাবার্তা) হওয়া দরকার। পঁয়ষট্টি জন গীতিকারের লেখা গজল গানের সংগ্রহ আছে এই বইতে। প্রত্যেকের দুটি করে প্রতিনিধিত্বমূলক গানকে চয়ন করা হয়েছে। পৃষ্ঠার বাঁ-দিকে আছে রোমান হরফে উর্দু ভাষায় লেখা গানটির লিরিক, এবং ডানদিকে সেই লিরিকের স্বচ্ছন্দ ইংরিজি অনুবাদ। প্রত্যেক গীতিকারের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও রয়েছে, যেটি অনেক অজ্ঞাত গীতিকারকে চিনতে সাহায্য করেছে। এছাড়াও লেখক বিশ্লেষণ করেছেন সময়ের সঙ্গে বিবর্তিত হওয়া গজল সংগীতের বিভিন্ন পর্যায় এবং আঙ্গিককে। মূল উর্দু থেকে গজলগুলি যিনি অনুবাদ করেছেন তাঁর একটি বিশেষ পরিচয় আছে। উর্দু সাহিত্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ ওয়েবসাইটটির নাম rekhta.org, আনিসুর রহমান এই ওয়েবসাইটের একজন উপদেষ্টা।
সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ গজল লিখেছেন। রাজা মহারাজা থেকে শুরু করে পথের ভিখারি পর্যন্ত; পুরুষ এবং নারী উভয়েই। ষোড়শ শতাব্দী থেকে একেবারে আধুনিক যুগের গীতিকাররা রয়েছেন এই বইয়ের পৃষ্ঠায়। আমার মতো কোনো গজলপ্রেমী যদি এই বইটি হাতে নেয় তাহলে তার মনে হবে : “কোয়ি তাজা হাওয়া চলি হ্যায় কহি” (মনোরম একঝাঁক বাতাস যেন বয়ে গ্যালো কোথাও)। যদিও আমি বইটি কবিতার বইয়ের মতো পড়েছি, গান হিসেবে ততটা নয়। সাদা পৃষ্ঠায় সুরের পরশ নেই, শুধু খসখসে লিরিক আছে। তবু কখনও এমন মুহূর্ত আসে, পাকিস্তানের একজন নারী কবি আদা জাফারে-র লেখা একটি গজল যখন চোখে পড়ে। তখন সুর স্থির হয়ে যায়, ঠিক যেমন বৃষ্টি নামার আগে স্থির হয়ে যায় গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কদম গাছের ফুলগুলো। তারপর ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বৃষ্টি নামে। ভিজে যায় ফুলের রেণু। একসময় বৃষ্টি থামে। একটা অদৃশ্য সুরের তীব্র সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চরাচর জুড়ে।
না ঘুবার মে না গুলাব মে মুঝে দেখনামেরে দর্দ কে তব-ও তাব মে মুঝে দেখনা...ম্যায় না মিল সকু ভি তো ক্যায়া হুয়া কে ফাসানা হুঁন্যয়ি দাস্তান ন্যয়ে বাব মে মুঝে দেখনা... ওহি এক লমহা-ঈ দিড় থা কে রুকা রাহা মেরে রোজ-ও শব কে হিসাব মে মুঝে দেখনা...জো তড়প তুঝে কিসি আঈনে মে না মিল সকে তো ফির আঈনে কে জওয়াব মে মুঝে দেখনা...(ধুলোতেও না, গোলাপ ফুলেতেও না; আমাকে খুঁজো তুমি আমার এই জ্বলজ্যান্ত দুঃখগুলোর মাঝেআমাদের দুজনের গল্পটার মধ্যে তো আমি আর রইলাম না, তবু আমাকে খুঁজো তুমি নতুন কোনো গল্পের মাঝেসময় যেন থমকে গেছিল তোমাকে যেদিন দেখেছিলাম, কিন্তু আমাকে খুঁজো তুমি সদাচলমান দিন আর রাতের মাঝেআমার এই উদ্দীপ্ত যন্ত্রণাকে যদি দেখতে না পাও তোমার আয়নার প্রতিবিম্বে, তাহলে বরং আমাকেই খুঁজো তুমি সেই আয়নার মাঝে...)
বিষাদের বল্কলে লেখা আবছা অনুভূতিটির নামকরণ এখনও করেনি কেউ।
এই বইয়ের গল্পগুলো নিয়ে একবার লিখেছিলাম। সেই ভালোলাগা এখনও রয়ে গেছে শীতশেষের সন্ধেবেলার আনাচে কানাচে। গল্পগুলোর ন্যারেটিভ কাঠামোর স্পষ্টতা প্রায় নেই বললেই চলে। প্রায় প্রতিটি গল্পের সমাপ্তি খাপছাড়া। আশ্চর্য বিষয় হলো, এই দুটো বিষয়ই এমনিতে আমি অপছন্দ করি। গল্পে একটা স্পষ্ট প্লট এবং বোধগম্য সমাপ্তি না-থাকলে আমার অস্বস্তি হয়। তবু এই গল্পগুলো ভালো লাগলো ক্যানো?
আমি জানিনা ক্যানো। ইলিয়াসের ভবিষ্যৎ গল্পগুলোর উজ্জ্বলতার ইঙ্গিত আমাকে তাড়া করেছিল হয়তো। গদ্যভাষা আবিষ্ট করেছিল হয়তো। কিংবা চরিত্রায়নের রহস্যময়তা? সামাজিক পরিস্থিতির বেআব্রু বিনির্মাণ? ইলিয়াসের বাকি ছোটগল্পগুলো খুব শিগগির পড়তে চলেছি। তাঁর ছোটগল্পের সামগ্রিক বিবর্তনটা ভালো করে বুঝে নিতে চাই। তারপর কোনো একসময় হয়তো আলোকিত হবে এই বইয়ের গল্পগুলো ভালোলাগার কারণটা, বা কারণগুলো। দেখা যাক।
আমি তিনদিন আগেও তর্ক করেছি বন্ধুদের সঙ্গে। অমুক রাজনৈতিক নেত্রীকে যদি সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তমুক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়ে যাবে। অমুকের চেয়ে তমুক তো আরো বেশি ক্ষতিকর! রাত দখলের মিছিল করার কি আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল? বাজারে এতো গুজব ছড়াচ্ছে কারা? কী উদ্দেশ্যে? মেয়েটির হাত নাকি চেপে ধরে রেখেছিল আরেকটি মেয়ে (অর্থাৎ আরেকবার প্রমাণিত হলো যে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু)। তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কোনোকিছু মেনে নিতে রাজি নই আমি। আমি তো মূলত একটি অরাজনৈতিক প্রাণী, তাই আমার চিন্তাভাবনা নির্মোহ। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু এটা মেনে নিতে দ্বিধা নেই যে বুকের ভিতরে কেউ একজন হাতুড়ি পিটিয়ে যাচ্ছিল ক্রমাগত। সমস্ত রাজনৈতিক তরজা আর লাভ-ক্ষতির হিসেবের বাইরে সেই হাতুড়ির দুম দুম দুম শব্দ শয়নে স্বপনে জাগরণে শুনতে পারছিলাম আমি। ধর্ষণের যেটুকু বর্ণনা, অত্যাচারিতার প্রাণহীন শরীরের যেটুকু বিবরণ, পোস্ট-মর্টেম ঘরের পিচ্ছিল দেয়াল ভেদ করে বাইরে এসেছে, নীতি-আদর্শের ছাল-বাকলা ছাড়িয়ে আমার তর্ক আর যুক্তিগুলো ক্রমশ অর্থহীন হয়ে যাচ্ছিল। ঘরে বাইরে অফিসে বাজারে সদরে অন্দরে আমি শুধু কল্পনা করার চেষ্টা করে গেছি, ওই জায়গায় আমি নিজে থাকলে ঠিক কেমন লাগতো? তার জায়গায় আমি শুয়ে থাকলে? ধরা যাক আমার পা দুটোকে কেউ...
আমার পক্ষে সম্ভব নয় যদিও, এই চিন্তাকে পূর্ণতা দেওয়া। আমার পৌরাণিক যৌনাঙ্গটি বাধা সৃষ্টি করে নিজেকে একজন নারীরূপে কল্পনা করতে। আমি কিছুতেই নিজেকে নিচে-শুয়ে-থাকা-অবস্থায় কল্পনা করতে পারিনা। আমি তো পুরুষ। আমি ভালোবাসতে পারি, কিংবা ধর্ষণ করতে পারি, কিন্তু কখনোই নিচে শুয়ে থাকতে পারিনা। আমি তো পুরুষ। প্রেম কিংবা প্রয়োজন কিংবা পৌরুষপ্রদর্শন— আমি সবসময়ই উপরে থাকি।
তাই নিচে শুয়ে থাকার, শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে ছিন্নভিন্ন হওয়ার, বাসে ট্রেনে ভিড়ের মাঝে অশ্লীল স্পর্শলাভ করার, পথে ঘাটে ইভ-টিজড হওয়ার, কর্মক্ষেত্রে উপরওয়ালার অবাঞ্ছিত অস্বস্তিকর “অ্যাটেনশন” সামলানোর, নিজের স্বাভাবিক জৈবিক শরীরী আকাঙ্ক্ষার উন্মোচনে “বেশ্যা” খেতাব লাভ করার, স্বামীর দ্বারা যথেচ্ছ ব্যবহৃত হওয়ার জন্য “বিবাহ” নামক লাইসেন্স প্রদান করার, পারিবারিক সদস্যের দ্বারা যৌনলাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাকে লোকলজ্জার ভয়ে সারাজীবন গোপন রাখতে বাধ্য হওয়া, সমাজের তুলাদণ্ডে নিজেকে প্রতিনিয়ত পুরুষের বাটখারায় মাপতে বাধ্য হওয়া— এই সবকিছু সবকিছু সবকিছু জানতে হলে আমাকে তাকিয়ে থাকতে হয় একজন সুচিত্রা ভট্টাচার্যের দিকে, একজন আশাপূর্ণা দেবীর দিকে, একজন মহাশ্বেতা দেবীর দিকে, একজন ইসমাত চুঘতাইয়ের দিকে, একজন সিলভিয়া প্লাথের দিকে, একজন জেন অস্টেনের দিকে। কোনো পুরুষ লেখক (যতোই শক্তিশালী হোক না তাঁর কলম) নিজের পুরুষাঙ্গের বিপুল ওজন উপেক্ষা করে কিছুতেই বিশ্বাসযোগ্যভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন না মেয়েদের যাপনচিত্রের যাবতীয় বে-দাগ বে-রং বে-জুবান কালার-কম্বিনেশনগুলোকে। একজনও না!
তাহলে আমার মতো কল্পনাশক্তির অ্যানিমিয়ায় ভোগা মানুষের পক্ষে কীভাবে সম্ভব সেই মেয়েটির জায়গায় নিজেকে চিন্তা করা? কীভাবে চিন্তা করবো একজন মেয়েকে যখন টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের সামনে ভরসন্ধ্যেবেলায় শত শত মানুষের চলমান দৃষ্টির সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করা হয়? কী চলে তখন সেই নারীটির মনে? ঝড়? সাইক্লোন? বন্যা? নাকি ধ্বস? নাকি শূন্যতা? এই অপমানের সমতুল্য কিছুই তো খুঁজে পাইনা নিজের জীবনে। পাশাপাশি রেখে বিচার করার মতো কিছুই খুঁজে পাইনা! সুচিত্রা ভট্টাচার্য লিখে না গেলে এই পাহাড়প্রমাণ অপমানের অস্তিত্বই থাকতো না আমার চেতনায়।
আজ যখন ঘটে গেছে আরেকটা পাহাড়প্রমাণ অপমানের ঘটনা (যেটা আবারও আমার কাছে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে, কারণ আমি কিছুতেই নিজেকে তার জায়গায় কল্পনা করতে পারছি না), কলেজজীবনে হোস্টেলে বন্ধুদের সঙ্গে মধ্যরাত্রে বসে বিস্ফারিত চোখে দেখা পর্নোগ্রাফিগুলো আমাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। রাস্তা ঘাটে উপভোগের দৃষ্টিতে কতোই তো দেখেছি নারীশরীরের সৌন্দর্য, আজ তারা বুমেরাংয়ের মতো আমাকে প্রত্যাঘাত করে যাচ্ছে। কতোই তো নারীইঙ্গিতবাহী গালি দিয়েছি জীবনে (কারণ নারীর অনুষঙ্গ জড়িয়ে না-থাকলে খিস্তি মেরে সুখ পাওয়া যায় না)— মাদারচোদ, বাঞ্চোত, খানকিমাগী, চুতমারানি, গুদমারানি— কিংবা আরো “পরিশীলিত” (কারণ ভাষা ইংরিজি)— মাদারফাকার, সান অভ আ বিচ।
সেই যাবতীয় গালিগালাজ আজ আমার দিকে ধেয়ে আসছে দশগুণ তীব্রতায়। আমার যাবতীয় রাজনৈতিক আর সামাজিক তর্ক আর যুক্তি আর বিচার আর প্রজ্ঞাকে ন্যাতানো বিস্কুটের মতো মনে হচ্ছে। কারণ পুরুষ হিসেবে আমি নাকি অনেক কিছু করতে পারি, যেহেতু আমার আছে অসীম ক্ষমতাবান একটি পুংলিঙ্গ। এই পৃথিবী নাকি পুরুষের। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা! (“বসুন্ধরা” একটি স্ত্রীলিঙ্গবাচক শব্দ, সুতরাং বীর মানেই পুরুষ— “বীরপুরুষ”! আর ভীতুরা সবাই “pussy”!) আমি নাকি সব পারি কিন্তু কিছুতেই একটা নারীর জায়গায় রেখে নিজেকে কল্পনা করতে পারিনা। গত পাঁচ দিন ধরে চেষ্টা করেও পারছি না। কোনোদিন পারবো না। আজকে সকালে দৈনিক পত্রিকার পৃষ্ঠায় দেখলাম আমার এই আজন্মলালিত পৌরুষের প্রতি লিখেছেন গায়ক-সাংবাদিক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় : যদি একজন্ম-দুইজন্ম বলে কিছু থাকে, তবে যেন পরজন্মে কুকুর হয়ে জন্মাই। যেন চেরা কামুক জিভ হয় আমার, যেন নির্বীর্য, পঙ্গু হয় শিশ্নদণ্ডটি। নারীজন্মের অপমান যেন গিলে খায় পুরীষ পুরুষজন্মকে। যে-অহংকার পুরুষাঙ্গ দিয়েছে আমাকে, সে যেন মাথা তুলে আর দেখতে না পায় এই তপ্ত তমসার ভুবনকে।
যদি বলি পুরুষ হিসেবে আজকে আমার লজ্জা লাগছে— আমার এই ঢঙের লজ্জা ধুয়ে কি জল খাবে সেই মেয়েটি! সেই মেয়েরা! সব মেয়েরা!
ইদানিং সত্যিই মনে হয়, সেই যখন কম্পিউটার ছিলো না, সোশ্যাল মিডিয়া ছিলো না, তখন মানুষ কি একটু বেশি স্মার্ট ছিলো? সামান্য হলেও একটু বেশি ক্রিয়েটিভ ছিলো? মানে, কী খেলাম, কোথায় গেলাম, কার সঙ্গে গেলাম, কী সিনেমা দেখলাম, কী বই পড়লাম, কী গান শুনলাম, কার বাগানে লুকিয়ে হাগলাম, এগুলো যখন মানুষ ফলাও করে প্রদর্শন করতো না, তখন কি এইসব কাজ করে কম আনন্দ পাওয়া যেতো? এখন কি বেশি আনন্দ পাই আমরা? নদীর তীরে সূর্য অস্ত যাবার ৬৩৭৬৩৮৩১৪৭৫৫তম ছবিটা যদি পোস্ট না করা হতো, তাহলে সূয্যিমামা কিংবা নদীমাসী নিশ্চয়ই খুব বেশি দুঃখ পেতেন না?
কিংবা, অমুকে ওই কাজটা ভুল করেছে, তমুকে ওই কথাটা ভুল বলেছে, অমুক ব্যাটা কতো হাস্যকর, তমুক লোকটা কতো বোকা, এবং আমি কতো চালাক, আমি কতো স্মার্ট, আমি সবার চেয়ে কতো অন্যরকম, আমি কাউকে পাত্তা দিইনা, আমি একদম ডোন্ট কেয়ার ডোন্ট গিভ আ শিট টাইপের ড্যুড্, আমার সেন্স অফ হিউমার দেখে আমিই মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই— এই যে শুধু আমি আমি আমি আমি আমি আমি আমি! মানুষ যখন দিবারাত্র এইসব আমিমার্কা ঢ্যামনামি করতো না, তখনকার মানুষরা কি এখানকার মানুষদের চেয়ে নিজেদের বেশি ক্যাবলা ভাবতো?
দেশদুনিয়া থেকে শুরু করে পাড়ামহল্লার খুঁটিনাটি বিষয়, যুদ্ধ, মহামারী, বিশ্বকাপ, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, মেসি, মেসির বউয়ের মেজোপিসি, রোনাল্ডোর বাড়ির ঝাড়ুদার, বিরাট কোহলি, নুহাশ হুমায়ূন, চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা, অমুকের বিচি, তমুকের বাঁড়া, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স-ম-স্ত বিষয়ে “বিশিষ্ট মৌলিক মতামত” যখন দিতো না মানুষ (দিলেও নিজের প্রাইভেট স্পেসে দিতো), এবং সেই বিজ্ঞ মতামতপ্রদানকারী মহাশয়/ মহাশয়ার পাছাটা, চেনা-অচেনা-আধাচেনা যে-কেউ এসে চুলকে না দিতো (মানে লাইক-কমেন্ট-লাভ রিয়্যাক্ট-হাহা রিয়্যাক্ট এইসব দেওয়ার কথা বলছি), তখন কি মানুষ তার নিজের বুকের ভিতরে ফুঁসতে থাকা “মূল্যবান মতামত”গুলো বাইরে বের করতে না পেরে ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে বাথরুমে বসে ভেউ ভেউ করে কাঁদতো? আর তাদের সেইসব বালের মতামতের অভাবে মানবসভ্যতার গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে যেতো দিনে ছয়বার?
সোশ্যাল মিডিয়ায় এতো যে দুঃসাহসী নির্ভীক বিপ্লবীর ছড়াছড়ি, যারা একখান কিবোর্ড আর কয়েক GB সস্তা data আর হাতে কিছু ফাঁকা টাইম জোগাড় করতে পারলেই— ব্যাস, শুরু করে দ্যায় সংগ্রাম!! প্রতিবাদ!! প্রতিশোধ!! গণজাগরণের আহ্বান!! মহা-বিদ্রোহী রণক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না!!!!! সোশ্যাল মিডিয়ার এই চে গেভারা ফিদেল কাস্ত্রো মহাত্মা গান্ধী মাদার তেরেসা মার্টিন লুথার কিং ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলরা যখন ছিলো না, আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষের তখন কি ভয়ানক দুর্দশাই না ছিলো! কীভাবে চলতো এই দুনিয়া?? কীভাবে সমস্যার সমাধান হতো?? কতো অত্যাচারিত, বঞ্চিত, পীড়িত, অবহেলিতই না ছিলো আগেকার মানুষ, আহা রে। আজকের এই মহান কিবোর্ড-যোদ্ধাদের প্রতি রইলো আমার... একটা গোটা লাভ রিয়্যাক্ট! ♥️
আমি বোধহয় সেই শেষ প্রজন্মের মানুষ, যারা ইন্টারনেটের সামান্যতম চিহ্নও যখন ছিলো না, মোবাইল ফোনের ভ্রূণকেও চোখে দ্যাখেনি আপামর জনতা (অন্তত এই তৃতীয় বিশ্বে), সোশ্যাল মিডিয়ার ঠাকুর্দারও যখন জন্ম হয়নি, সেই জমানাকেও চাক্ষুষ করেছে ; আবার আজকের এই অন্তর্জালের ফাঁসে হাসফাঁস করতে থাকা বায়বীয় দুনিয়াতেও নিঃশ্বাস নিয়েছে। সবজান্তা বিজ্ঞ পণ্ডিতদের ভিড়ে মিশে নিজেও প্রায় সেরকম হয়ে গেছে। সিনেমার নায়িকার ব্রেকআপ হলে নিজের “বিশিষ্ট মতামত”টুকু সোশ্যাল মিডিয়ার মাছের বাজারে ছেড়ে আসতে হাত চুলকায়। আমার মতের সঙ্গে যাদের মেলেনা, আমার পছন্দের সিনেমা যারা দ্যাখে না, আমার পছন্দের গান শোনেনা, বই পড়েনা, যাদের “ক্লাস” আমার থেকে নিচু, তাদের তাচ্ছিল্য করতে না পারলে ভাত হজম হয়না। আস্তিক হলে নাস্তিকদের, নাস্তিক হলে আস্তিকদের চোদ্দোগুষ্টিকে ভার্চুয়াল ডান্ডাপেটা না করলে সকালে হাগু পরিষ্কার হয়না। আর আছে স্বঘোষিত সমালোচকদের দল। সিনেমা থেকে শুরু করে বাতের ঔষধ, কবিতা থেকে শুরু করে কন্ডোমের স্থিতিস্থাপকতা— বিনিপয়সার এই ওস্তাদ সমালোচকদের হাবভাব দেখলে অঞ্জন দত্তের গান মনে পড়ে যায়।
তুমি না থাকলে দেবদাস কবে হয়ে যেত ক্ষুদিরাম
তুমি না থাকলে শুধু ডানদিক থাকত না কোনো বাম,
ধর্মতলায় লেগে যেত রোজ ধর্মের যুদ্ধ
তুমি না থাকলে বেচত বিড়ি গৌতম বুদ্ধ,
তুমি না থাকলে রবীন্দ্রনাথ
কালির দোয়াত মাথায় ঠুকে হত কুপোকাত!
সত্যি, আপনারা না থাকলে আমাদের মতো অসহায়দের কী যে মুশকিল হতো। আপনাদের জন্যেও রইলো আমার তরফ থেকে একপিস সশ্রদ্ধ লাভ রিয়্যাক্ট। ♥️
যখন মানুষের হাতে হাতে কম্পিউটার (এবং তার মেজোবোন স্মার্টফোন) ছিলো না, তখন কি মানুষ সত্যিই এখনকার মানুষদের চেয়ে বেশি স্মার্ট ছিলো? বেশি ক্রিয়েটিভ ছিলো? (বালের ওই meme তৈরির ক্রিয়েটিভিটির কথা বলছি না।) বেশি চিন্তাশীল ছিলো? ধৈর্যশীল ছিলো? বেশি সহনশীল ছিলো?
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা!
একটা লেখার সবচেয়ে বড় গুণ কী? স্পষ্টতা। সাহিত্যের ভাষা অবশ্যই স্বতন্ত্র হবে। তাতে বিভিন্নরকম নিজস্বতা গুঁজে দিতে হবে। লেখক চাইবেন দশটা লেখার মাঝে নিজের সৃষ্টিটা অনন্য হোক। কিন্তু সাহিত্য লিখি কয়জন? গল্প উপন্যাস কবিতা লিখি কয়জন? আমরা বেশিরভাগ মানুষ বিবৃতি লিখি। কেউ ব্যক্তিগত বিবৃতি। কেউ উদ্দেশ্যমূলক বিবৃতি। ইন্টারনেট এসে আমাদের বিবৃতি লেখার এই ইচ্ছেটাকে দশদিকে প্রসারিত করে দিয়েছে। এই যে আমি এই লেখাটা লিখছি, এটাও তো একটা বিবৃতি। এটা সাহিত্য নয়। আজ থেকে মাত্র বছর-কুড়ি আগেও এমন সুযোগ ছিল না।
আমার পড়শী দেশ বাংলাদেশে এই মুহূর্তে একটা অভূতপূর্ব আন্দোলন চলছে। আমার বাপের জন্মে আমি এরকম তীব্র আন্দোলন দেখিনি। দেশের ক্ষমতাসীন সরকার নিজের দেশের অল্পবয়েসি ছাত্রদের, সাধারণ মানুষদের, নির্দ্বিধায় গুলি করে মারছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর সঙ্গে ফাজলামি করছেন। একটা ক্রূর ফাজলামি। উপমহাদেশের এই অঞ্চলের মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকে অত্যাচারিত হয়ে এসেছেন। ইংরেজ আমলে জমিদারদের হাতে কৃষক প্রজারা অকথ্য অপদস্থ হয়েছেন। তারপর ইংরেজ গিয়ে এলো পাকিস্তান আমল। তখনও এই অঞ্চলের মানুষ লাঞ্ছনার মুখোমুখি হয়েছেন। তারপর দেশ স্বাধীন হয়েও শান্তি নেই। এই দেশটা কোনোদিন দীর্ঘমেয়াদীভাবে শান্তিতে থাকতে পারলো না।
আজ একবিংশ শতকের প্রায় সিকিভাগ পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশের মানুষ রাষ্ট্রের তরফ থেকে ন্যূনতম মানবাধিকার পেলো না। এতদিন একটা নাম-কা-ওয়াস্তে গণতন্ত্রের “ম্যানেকিন” দাঁড় করানো ছিল। এবারের আন্দোলনের চোদনে ধাক্কায় সেই খেলনা পুতুলের কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছে। দুঃখের কথা হলো, এই পুতুলটাকে দাঁড় করিয়ে রাখতে আমার নিজের দেশের প্রচুর অবদান আছে। আমি জানি এর পিছনে কিছু কূটনৈতিক কারণ রয়েছে, আমার দেশের স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু একজন সাধারণ বাঙালি হিসেবে আরেকটা দেশের সাধারণ বাঙালি মানুষের এই দুরবস্থা দেখতে ভালো লাগেনা আমার। কূটনীতির পাছায় ঝাঁটা মারতে ইচ্ছে করে।
এই গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ইশকুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির পড়ুয়ারা। এই অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েরা কয়েকদিন আগেও জীবনের প্রায় কিছুই দ্যাখেনি। কিন্তু এখন অনেক কিছু দেখে ফেলেছে! কতজন খুন হয়েছে এখনও পর্যন্ত? মিডিয়ার হিসেব যা-ই হোক, আমার সন্দেহ হয় সংখ্যাটা ৫০০ ছাড়িয়ে গেছে। শেখ হাসিনার এই সরকারকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক সরকার বলার উপায় নেই আর। এই সরকার খুনি সরকার। এরা ফ্যাসিস্টও নয়। ফ্যাসিজমেরও একটা রাজনৈতিক দর্শন থাকে। এদের সেটাও নেই। সাদা বাংলায় বলতে হলে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই আওয়ামি লিগ সরকার একটা গণহত্যাকারী, হিংস্র, নির্দয়, ধান্দাবাজ, ক্ষমতার অহংকারে অন্ধ হয়ে যাওয়া সরকার। এমনকি গণতান্ত্রিক ব্যঞ্জনায় এদের “সরকার” বলতেও দ্বিধা হয়। এরা স্রেফ খুনি। প্যাথোলজিক্যাল মৃত্যুবিলাসী খুনি।
এই উন্মাদ খুনিদের হাত থেকে দেশটাকে বাঁচাতে হবে। শয়ে শয়ে ছাত্র, শয়ে শয়ে সাধারণ নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ, বেঘোরে প্রাণ দিয়েছেন। রোজ মারা যাচ্ছেন তারা! গুলি খেয়ে মরছেন, অস্ত্রের আঘাতে মরছেন, চিকিৎসার অভাবে মরছেন, পুলিশ কাস্টডিতে মরছেন। কতো মানুষ মারাত্মক আহত হচ্ছেন। কেউ হয়তো সারাজীবনের মতো অন্ধ হয়ে যাবেন। কেউ পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকবেন। কারো ভাই মারা গেছে, কারো বোন, কারো সন্তান, কারো অভিভাবক, কারো প্রেমিক, কারো প্রেমিকা, কারো প্রিয় বন্ধু। এই মানুষগুলোর মৃত্যু কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যদি কিছুই করার মতো না খুঁজে পাই, তাহলে কিছু বিবৃতি তো লিখতে পারি। বিবৃতি সাহিত্য নয়, জানি। কিন্তু অক্ষরের শক্তি অসীম। নির্জলা স্পষ্ট ভাষায় লেখা, কয়েকটি সোজাসাপ্টা বাক্য দিয়ে গঠিত, একটা বিবৃতির শক্তি অনেক! আর অনেকগুলো বিবৃতির শক্তি—সীমাহীন!
গুডরিডস ছাড়া আমার আর লেখার জায়গা নেই। তাই আমার বিবৃতিটা আমি এখানে লিখলাম। যদিও একটা বইয়ের রিভিউ লেখার ভান করে এই বিবৃতিটা লিখছি, কিন্তু রিভিউটা পুরোটা ভান নয়। কীভাবে নিজের মনের কথা স্পষ্ট লিখিত ভাষায় প্রকাশ করা যেতে পারে, সেটা শেখার জন্য এই বইটার দ্বারা আমি বহুভাবে উপকৃত হয়েছি। বইটার উদ্দেশ্য যদিও ইংরিজি ভাষায় লেখালিখির নিয়মকানুন শেখানো, কিন্তু এই বইটার অনেক নিয়ম যেকোনো ভাষাতে লেখার কাজে প্রয়োগ করা যেতে পারে। সামান্য কিছু নমুনা দিই।
প্রথমেই সবচেয়ে মূল্যবান নিয়মটা বলি। বিবৃতি লেখার সময় জটিল বাক্য লিখবেন না। বাক্যের দৈর্ঘ্য বড় করবেন না। ছোটো ছোটো সরল বাক্যে লিখবেন। যেমন : দেশের প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে থাকার যোগ্যতা নেই শেখ হাসিনার।
পরিচিত শব্দ ব্যবহার করবেন। নিজেকে পণ্ডিত প্রমাণ করার জন্য অহেতুক কঠিন শব্দ ব্যবহার করবেন না। যেমন : আমি জানি আমারও প্রাণের ভয় আছে, কিন্তু আজ যদি আমি ভয় পেয়ে চুপ করে বসে থাকি, তাহলে সারাটা জীবন ভীতু হয়ে বেঁচে থাকতে হবে (দেখুন এই বাক্যে একটাও কঠিন শব্দ নেই, অথচ আপনার মতামত স্পষ্টভাবে জানানো হলো)।
সাহিত্য রচনার জন্য নানারকম পরিশীলিত প্রক্রিয়া আছে। সাহিত্যে উপমা ব্যবহার করা হয়। রূপক ব্যবহার করা হয়। অলংকার ব্যবহার করা হয়। বিরোধাভাস ব্যবহার করা হয়। এরকম আরো গাদা গাদা পদ্ধতি আছে রচনাকে সাহিত্যগুণসম্পন্ন করার জন্য। কিন্তু এই দুঃসময়ে নিজের বিবৃতি থেকে এইসব পদ্ধতি বাদ দিলেই ভালো হয়। তার চেয়ে বরং একেবারে সহজ ভাষায়, সাদামাটা ভঙ্গিতে লিখলে বিবৃতি অনেক বেশি জোরদার হবে। যেমন : আমি অনেক সহ্য করেছি। এই অপদার্থ সরকারের পতন এবার ভীষণ জরুরি। এরা নির্বিচারে মানুষ খুন করছে। তারপরেও এরা অনুতপ্ত হচ্ছে না। এদের কথায় আমি আর কীভাবে বিশ্বাস করবো? অসম্ভব!
কোনো বিখ্যাত লেখক কিংবা কবি কিংবা সাহিত্যিকের থেকে পঙক্তি ধার করার চেয়ে নিজের মনের কথা নিজস্ব ভাষায় লেখা ভালো। নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার লাইনকে বারবার ব্যবহার করলে সেই লাইনের তীক্ষ্ণতা এবং মৃত্যু উপত্যকার উচ্চতা—দুটোই কমে যায়। এই দুঃসময়ে অন্যের লেখা কবিতার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়ালে এটা প্রমাণ হয় যে আপনার নিজের ভাষায় লেখার সাহস নেই। কিংবা আপনি ঘুরিয়ে নাক দেখাচ্ছেন। আপনার সাহিত্যরুচি প্রদর্শন করার সুযোগ, বেঁচে থাকলে পরবর্তী সময়ে অনেক পাবেন। এমনও হতে পারে কালকে আপনার নিজের ভাই গুলি খেলো। কিংবা আপনার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। কিংবা আপনার বাবা? মা? স্ত্রী? সন্তান? যার সঙ্গে একবেলা কথা না বললে আপনার ভালো লাগে না, সে? যে আপনার দিকে তাকিয়ে হাসলে আপনার সারাটা দিন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে? এমনকি কালকে স্বয়ং আপনি নিজেই চন্দ্রবিন্দু হয়ে যেতে পারেন, হঠাৎ-ছিটকে-আসা একটা গুলির আঘাতে। মরে গেলে তো এমনিতেও লিখতে পারবেন না। কোনো জনপ্রিয় সেলিব্রিটি কিংবা বেস্টসেলার সাহিত্যিকের বিবৃতির অপেক্ষায় থাকবেন না। প্রত্যেকেরই নিজস্ব ধান্দা আছে, যাকে যার ইচ্ছেমতো থাকতে দিন। এই দুর্দিনে নিজের মনের কথা নিজেই লিখুন। যেমন:
তুমি আর কতো গুলি করবে শেখ হাসিনা? পাকিস্তান যেমন তোমার বাবাকে দাবায়ে রাখতে পারেনি, তুমিও আমাকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। এবার হয় তুমি থাকবে, নয় আমি। তোমার এবং তোমার সাঙ্গপাঙ্গদের এই নৃশংস নাটক আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার সহ্যের সব সীমা এখন পেরিয়ে গেছে। বুঝলে না ব্যাপারটা?
কিভাবে সহজ ভাষায় স্পষ্ট ভঙ্গিতে নিজের মনের ভাব লিখিত বাক্যে প্রকাশ করা যায়, সেটা বোঝার জন্য এই বইটা সত্যিই দারুণ! যারা দেশের দুঃসময়েও স্পষ্ট ভাষায় দরকারি কথা লিখতে পারছেন না, অবস্থার পরিবর্তন হলে, ভাবগম্ভীর আঁতেলমার্কা কেতাব পাশে সরিয়ে রেখে সবার আগে এই বইটা পড়বেন। কারণ স্পষ্ট কথার অনেক ওজন!
আমাদের বাড়ির পিছনে পাশাপাশি দাঁড়ানো একজোড়া পাড়াতুতো লিচুগাছ ছিল। ছোটবেলার একটা প্রিয় অভ্যাস ছিল জানলা দিয়ে সেই গাছদুটো দেখা। আসলে তো গাছ দেখতাম না। দেখতাম সেই গাছে আশ্রয় নেওয়া কয়েক শ' টিয়াপাখিকে (সংখ্যাটা একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বরং হয়তো কমিয়ে বলে থাকতে পারি)। একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখার জন্যে আমি তাকিয়ে থাকতাম গাছদুটোর দিকে। কী যেন এক সম্মিলিত আবেগের তাড়নায় অতগুলো টিয়াপাখি হঠাৎ একসঙ্গে গাছ থেকে হুউউউশ করে বেরিয়ে আকাশের দিকে সশব্দ উড়াল দিত। সে যে কী এক অপার্থিব সৌন্দর্য! আমার ছোটবেলার অন্যতম প্রিয় স্মৃতিদৃশ্য এটা। গাঢ় সবুজ গাছের পাতা থেকে অকস্মাৎ বেরিয়ে আসছে একঝাঁক ফিকে-সবুজরঙা চিৎকৃত টিয়াপাখি। সেই লিচুগাছদুটো এখন কেটে ফেলা হয়েছে। মানুষ বাড়ি বানিয়েছে সেখানে। সেই অগুনতি টিয়াপাখির দল, তাদের সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব, তাদের সযত্নে সঞ্চিত স্বপ্নগুলো নিয়ে আজ কোথায় চলে গেছে? অত টিয়াপাখি একসঙ্গে দেখেছি বলেই বোধহয় আমি এখন টিয়াপাখি দেখতে পাইনা। কোত্থাও না! কতদিন একটাও টিয়াপাখি দেখিনা আমি। (খাঁচায় যেসব টিয়াপাখি দেখি তারা তো পুরোপুরি পাখি নয়, ঠিক যেমন সেইসব খাঁচার মালিক যারা, তারা পুরোপুরি মানুষ নয়।)
মানুষ এবং প্রকৃতি-লালিত অন্যান্য প্রাণীদের সহাবস্থানের গুরুত্ব নিয়ে এই রিভিউতে কিচ্ছু লিখবো না আমি। পাখি নিয়েও লিখবো না। পাখিদের দুঃখ নিয়ে লিখবো না। হারিয়ে যাওয়া পাখিদের খোঁজে গুডরিডসের দেওয়ালে সাঁটাবো না কোনো নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে ঘোষণা-পোস্টার। লিখবো একটা বইয়ের ব্যাপারে। বইটা আমি উপহার পেয়েছি। গত দুই দশকে ক্যামেরা এবং লেন্সের অভূতপূর্ব সহজলভ্যতা এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে আত্মপ্রকাশের আয়াসহীনতার কারণেই সম্ভবত, আশেপাশে একটা নতুন নেশা তৈরি হয়েছে। পাখি দেখার নেশা। আগেও অবশ্যই ছিল এই নেশা, এখন বহুগুণে বেড়েছে। আমার বেশ কিছু পরিচিত মানুষ পূর্ণ উদ্যমে তাদের এই নেশার আগুনে নিয়মিত ঘি ঢেলে চলেছেন। বিশেষত শীতকালে, কাঁধে একটা ভারী ক্যামেরা আর গলায় বাইনোকুলার ঝুলিয়ে, পিঠে একটা ছোট ব্যাগ নিয়ে তারা ছড়িয়ে পড়েন নগরের বাইরে দূরে দূরান্���রে। নিবিষ্ট চোখে পর্যবেক্ষণ করেন পাখিদের। ছবি তোলেন। (পাখির ছবি তোলা পৃথিবীর কঠিনতম কাজের একটি)। গত তিন বছর ধরে তেমনই একজন পাখিনেশাড়ুর টানাটানিতে কয়েকদিন আমিও সঙ্গী হয়েছি তাদের অভিযানে। আমার শহরের খুব কাছে “কাষ্ঠশালী” নামের একটা জলাভূমিতে। এই জলাভূমিটার আরেকটা সুন্দর নাম আছে— “চুপি”।
সেখানে শয়ে শয়ে নয়, হাজারে হাজারে পাখিদের মুখোমুখি হয়ে চোখে ঝিলমিল লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা। কত প্রজাতির কত ধরনের কত কিসিমের কত চরিত্রের পাখি যে দেখলাম! বিদেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা এসেছে। স্থানীয় দেশি পাখিদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করছে তারা। পাখিপ্রেমীদের কাছে সেই পরিযায়ী পাখিদের খাতির বেশি, কারণ কয়েকদিন পরেই আবার দেশান্তরী হবে তারা। তাদের তুলনায় দেশীয় পাখিদের জামাকাপড় যেন একটু কম স্টাইলিশ। নৌকা থেকে দেখলাম একটা বড় সাইজের “মঙ্গোলিয়ান রেড-ক্রেস্টেড পোচার্ড” জল থেকে ঝপাং করে উড়ে আমার ঘাড়ের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গ্যালো (নামটা বন্ধুর কাছে জেনেছি)। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো : ওরেব্বাস! এই না হলে পাখি! আমার বন্ধুটি বললো, আমাদের দেশেও কিন্তু দারুন দারুন সব পাখি আছে, অরূপদা। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ভাবলাম, বিদেশি পাখির ব্যাপারই আলাদা। আমার এই কলোনিয়াল হ্যাংওভার-সুলভ হাভাতে মনোভাব আন্দাজ করেই কিনা জানিনা, সেই বন্ধুটি উপহার দিয়েছে এই দুর্ধর্ষ বইটা। শুধু দুর্ধর্ষ বললে শুনতে ঠিকঠাক লাগে না।
বলতে হবে : দু র ধ র ষো ও ও...!!
বইটা প্রকাশ করেছে ভারত সরকারের অধীনস্থ “জুলজিক্যাল সার্ভে অভ ইন্ডিয়া” সংস্থা। ছ'শো পৃষ্ঠার বই, পুরোটা রঙিন চকচকে মসৃণ দামি কাগজে মুদ্রিত, অথচ দাম মাত্র ছ'শো টাকা। পঁয়ষট্টিজন “বার্ড-ফটোগ্রাফার” এবং ছয়জন পক্ষীবিশারদ দুই বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে নির্মাণ করেছেন বইটা। বেশি সুন্দর বই দেখলে আমার জ্ঞানগম্যি লোপ পায়, বর্ণনক্ষমতা হাপিস হয়ে যায়। মুখ দিয়ে বারবার শুধু বেরিয়ে আসে : ক্কী সুন্দর মাইরি বইটা! ক্কী দুর্দান্ত বই রে ভাই এটা! সবমিলিয়ে ১৩৩১ রকমের ভারতীয় পাখির সচিত্র পরিচয় রয়েছে এতে। সবক'টি পাখির স্ত্রী এবং পুরুষের আলাদা রঙিন ছবি দেওয়া আছে। সাধারণ পরিচিত নামের পাশাপাশি দেওয়া আছে বৈজ্ঞানিক নাম, বাসস্থান, আকৃতি, বিশেষ দেহবৈশিষ্ট্যের তত্ত্বতালাশ এবং তাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। এবং ছবি। আহা কী দারুন ছবি। এমন মনভোলানো রাশি রাশি পাখির ছবি দেখে আমি বিস্মিত! অভিভূত! “...and what is the use of a book without pictures and conversations?” — “অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড” বইয়ের শুরুতেই অ্যালিস এই কথাটা বলেছিল বটে, কিন্তু কথাটা যে এমন ভয়ংকর সত্যি সেটা আমি এতদিন পরে এসে বুঝলাম!
আমার প্রিয় পাখি কাক। তাদের মতো স্মার্ট, অ্যাটিটিউডওয়ালা এবং চালাকচতুর হতে চাই আমিও (যদিও বেচারাদের বাসায় কোকিল ডিম পেড়ে আসে