জর্জ অরওয়েলের লেখা উপন্যাস পড়লে তাঁকে রূপক কিংবা প্রতীকী-ধাঁচের রচনার একজন ম্যাজিশিয়ান বলে মনে হয়। অ্যানিমেল ফার্মের চরিত্ররা যদি সত্যিকারের মানুষ হতো তাহলে গল্পটা এতটা জমতো না, এটা সব পাঠকই স্বীকার করবেন। অথচ তাঁর প্রবন্ধগুলোতে তিনি একদম উল্টো কায়দা অবলম্বন করেছেন। সেখানে তিনি নিপাট সোজাসাপ্টা। কোনোরকম ধানাইপানাই করেননি। লম্বা কাঠের হাতলওয়ালা একধরণের tool, যার একপ্রান্তে লোহার তৈরি চৌকো চ্যাপ্টা ব্লেড লাগানো থাকে— এরকম ত্যানা না-পেঁচিয়ে সরাসরি যন্ত্রটাকে “কোদাল” নামে ডেকেছেন।
এই ছোট্ট বইটির তিনটি প্রবন্ধেই তিনি “জাতীয়তাবাদ” (nationalism) নামক ধারণাকে অসম্ভব স্পষ্ট ভাষায় বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথম প্রবন্ধটি, “Notes on Nationalism”, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ঠিক মাসখানেক পরে প্রকাশিত হয়েছিলো। এর আগে দুবার পড়েছিলাম এই নাতিদীর্ঘ লেখাটি। প্রতিবারই চমৎকৃত হয়েছি অরওয়েলের পর্যবেক্ষণশক্তি এবং সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা দেখে। প্রতিবারই নিজের দেশ-কালের সঙ্গে মেলাতে পেরেছি তাঁর ৭৭ বছর “পুরোনো” চিন্তাকে। যুদ্ধের সময়ে জাতীয়তাবাদ প্রবল থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার দেশে যুদ্ধ কোথায়? তবু প্রায় হুবহু মিলে যায় অরওয়েলের বিশ্লেষণ!
প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি পাঠককে সাবধান করে দিয়েছেন যে, অনেকসময় সমার্থক অর্থে ব্যবহৃত হলেও, “জাতীয়তাবাদ” এবং “দেশভক্তি” (patriotism)— দুটো আলাদা বস্তু। দেশভক্তি একটি ব্যক্তিগত বিশ্বাস, যা কেউ কারো ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিতে পারেনা। নারী-পুরুষের পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসার মতো। থাকলে থাকবে, না-থাকলে নেই। জাতীয়তাবাদ কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জোর করে (কিংবা চালাকি করে) চাপিয়ে দেওয়া হয়, অথবা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আর, কে না জানে, একমাত্র ভুয়ো মালপত্রই গায়ের জোরে বিক্রি করা হয়। মাল যদি খাঁটি হয়, মানুষ নিজের গরজেই সেটা কিনবে। আমার দেশ যদি সত্যিকারের “মহান” হয়, সেই খবরটা সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়ে জানানোর প্রয়োজন হবে না!
তারপর অসাধারণ বিশ্লেষণের মাধ্যমে অরওয়েল যেন আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে দিয়েছেন। একদম চাঁচাছোলা ভঙ্গিতে জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের উপর তাঁর পর্যবেক্ষণের ঝকঝকে আলো ফেলেছেন। তিনি বলেছেন, একজন জাতীয়তাবাদী কখনই নিজের বিশ্বাস ভুল প্রমাণিত হওয়া সহ্য করতে পারেনা। তার বিশ্বাসকে “সর্বশ্রেষ্ঠ” ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারেনা। এর স্বপক্ষে যদি যথেষ্ট প্রমাণ না-থাকে, তাহলেও কুছ পরোয়া নেহি। এমনকি যদি তার বিশ্বাসের বস্তুটি খেলায় হেরে যায়, তাহলেও সে সেই ফলাফল মেনে নিতে পারেনা। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে ভাবে : “আচ্ছা বেশ, পরের বার দেখে নেবো তোদের!”
কিন্তু জাতীয়তাবাদের ফলাফল কখনই শুভ হয়না। আজ পর্যন্ত কখনও হয়নি। জাতীয়তাবাদ মানে শুধুই যে একটি দেশের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করা, এমনটা নয়। একজন জাতীয়তাবাদী একটি নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি (ধরা যাক হিন্দু ধর্ম) কিংবা একটি রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি (ধরা যাক সেকিউলারিজম) কিংবা সামাজিক অবস্থানের প্রতি (ধরা যাক “শহুরে-শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত”) নিজের চেতনাকে সমর্পণ করতে পারেন। এমনকি তথাকথিত শান্তিবাদী (pacifist) কিংবা নাস্তিক্যবাদীরাও বেশিরভাগ সময়েই খাঁটি জাতীয়তাবাদীদের মতো আচরণ করে। অনেকসময় দেখা যায়, বাংলাভাষাকে “সম্মান” দেখাতে গিয়ে কতিপয় ভাষাপ্রেমিক ইংরিজি ভাষার প্রতি অহেতুক জাতীয়তাবাদী মুখ-ভ্যাংচানি প্রদর্শন করে ফেলছেন।
কিন্তু যেহেতু “জাতীয়তাবাদ” সবসময়ই আমাদের নিজেদের বিশ্বাসের দোষত্রুটিকে উপেক্ষা করতে পরামর্শ দ্যায়, এমনকি অস্বীকার করতে, এমনকি চেপে যেতে পরামর্শ দ্যায়, এমনকি প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে বিকৃত করতে পরামর্শ দ্যায়, মতের অমিল হলে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার পরামর্শ দ্যায়— তাই একজন জাতীয়তাবাদী সারাক্ষণ নেচে নেচে গাইতে থাকে : “আমরা ভাল লক্ষ্মী সবাই, তোমরা ভারি বিশ্রী/ তোমরা খাবে নিমের পাঁচন, আমরা খাব মিশ্রী। আমরা পাব খেলনা পুতুল, আমরা পাব চম্চম্/ তোমরা তো তা পাচ্ছ না কেউ, পেলেও পাবে কম কম।”
তিনটি প্রবন্ধই পাঠকের মনোযোগ এবং কিছুটা পূর্ব-ধারণা দাবি করে। দ্বিতীয় প্রবন্ধটি, “Anti-Semitism in Britain”— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন ইংল্যান্ডের সামাজিক/ রাজনৈতিক পরিবেশের কথা মাথায় রেখে লেখা হয়েছে, কিন্তু প্রবন্ধটি পড়লেই বোঝা যাবে, ব্রিটেনের জায়গায় আমার নিজের দেশের নাম এবং ইহুদিদের জায়গায় মুসলমান শব্দটি বসিয়ে নিলে পড়তে খুব বেশি অসুবিধে হয় না। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায়, ঠিক অরওয়েল যেমন অনেক “ভদ্রলোক”-এর মুখে গোটা ইহুদিজাতির প্রতি অহেতুক গালমন্দ শুনেছেন, আমিও তো এই কয়েকদিন আগেই বাজার করতে গিয়ে শুনেছি, পরিচিত সহ-বাজারকারী একজন কলেজ প্রফেসর (বিষয় অর্থনীতি), যিনি একজন শখের নাট্যকর্মীও বটে, সালমান রুশদির উপর আক্রমণের প্রতিবাদ জানিয়ে আমাকে অবলীলায় বললেন : “শালার মোল্লার জাত!”
“The Sporting Spirit” নামক তৃতীয় প্রবন্ধটিতে তিনি দেখিয়েছেন খেলার মাঠেও কিভাবে জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়ে। আমরা যারা ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ কিংবা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ফুটবল ম্যাচের উত্তেজনার আগুনে নিজেদের সেঁকতে সেঁকতে বড় হয়েছি, তাদের কাছে এই বিষয়টি নিয়ে আলাদা করে কথা বলার প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি প্রবন্ধেই অরওয়েল পাঠককে ভাবতে বাধ্য করেছেন। নিজেকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করেছেন। আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই, অন্ধ এবং অযৌক্তিক জাতীয়তাবাদের কিছু না কিছু বীজ লুকিয়ে আছে। কিংবা লুকোনো নেই, প্রকট হয়ে আছে! এর হাত থেকে নিস্তার নেই। কিন্তু অরওয়েল আমাদের বলেছেন, আমরা যেন নিজেদের কাছেই নিজেরা হার স্বীকার না-করি। নিজের ত্রুটিগুলোকে অন্তত নিজের কাছে যেন ধামাচাপা না-দিই। হাতের ময়লা পুরোপুরি পরিষ্কার করতে না পারলেও, হাতটা যে ময়লা হয়ে আছে, এটুকু দেখতে পারার দৃষ্টি যেন আমাদের থাকে। এই দুঃসময়ে, অন্তত এটুকু যেন থাকে।
It can be argued that no unbiased outlook is possible, that all creeds and causes involve the lies, follies and barbarities. I do not accept this argument.
ইতি ধপাস!
সবদিক থেকেই। বারো বছরের কচি ছেলে গম্ভীর মুখে ভাষণ দিচ্ছে যেন বাষট্টি বছরের খুড়োমশাই। সেই ছেলের সমবয়েসি বান্ধবীর হাবভাব একজন বয়স্ক মহিলার মতো। বাপের বয়েসি ভেটেরান (সুতরাং সবজান্তা) কিছু চরিত্র আছে, তাদের কথাবার্তা যেন শরশয্যায় পিতামহ ভীষ্ম। শুধু বক্তৃতা আর বক্তৃতা। জ্ঞান আর জ্ঞান। বাংলায় যাকে “ডায়লগ মারা” বলে। জীবনের যত দুঃখ কষ্ট দুর্ভোগ শুধু ভাষণ মেরে-মেরেই ঝেঁটিয়ে বিদায় করার মাস্টারপ্ল্যান নিয়েছে সবাই। লেখক এমনিতে বাস্তববাদী হতে বলেছেন আমাদের, কিন্তু নানাবিধ অলৌকিক ঘটনা ঘটে চলেছে চরিত্রদের জীবনে। আর তাছাড়া, তাদের দুঃখেরও সীমা-পরিসীমা নেই রে ব্রাদার! ট্র্যাজেডি আল্ট্রা প্রো ম্যাক্স।
আরো একদিক থেকে ধপাস। পকেট সাইজের ১১৯ পৃষ্ঠার রোগা একটা বইয়ের দাম করেছে ৩৯৫ টাকা! এরা কি আনন্দ পাবলিশার্স? নাকি নিরানন্দ পাষণ্ড?
দক্ষিণ ভারতের একটি ছোটো মফস্বল শহরের নাম মালগুড়ি। ভারতের মানচিত্রে যদিও “মালগুড়ি” নামের কোনো শহরের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। লেখকের মস্তিষ্কপ্রসূত নাম এটি। তাই বলে কি শহরটা মিথ্যা? একেবারেই নয়! এই গল্পসংকলনটি পড়লেই বোঝা যায়, নামটি নিছক কাল্পনিক হলেও, শহরটি মোটেও কাল্পনিক নয়, শহরের মানুষজন কাল্পনিক নয়, এই সংকলনের ৩২টি গল্পে বর্ণিত ঘটনাগুলোও কাল্পনিক নয়।
বস্তুত, ভারতবর্ষের হাজার হাজার অজ্ঞাত অখ্যাত মফস্বল শহরের প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মালগুড়ি নামের এই অস্তিত্বহীন শহরটি। বইয়ের ভূমিকায় লেখক নিজেই বলেছেন : If I explain that Malgudi is a small town in South India I shall only be expressing a half-truth, for the characteristics of Malgudi seem to me universal. আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের দরবারে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি এবং স্বীকৃতি পাওয়া একডজন ভারতীয় (ফিকশন) বইয়ের তালিকায় এই বইটি স্থান করে নেবে, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
আর. কে. নারায়ণের লেখা আগেও পড়েছি আমি। বেশ কিছুকাল আগে যদিও। কিন্তু তাঁর সরস এবং অনায়াস গল্প বলার ভঙ্গিটি ভুলে যাইনি। ভুলে যাইনি তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণক্ষমতা। গল্প বলার এই ছিমছাম নিরিবিলি ধরণটি আমার ভীষণ পছন্দ। কোনো চালাকি কিংবা বাহাদুরি নেই, গদ্যভাষা নিয়ে অহেতুক এক্সপেরিমেন্ট নেই, প্লটের মারপ্যাঁচে পাঠককে চমকে দেওয়ার চেষ্টা নেই, শেষ অনুচ্ছেদে ও-হেনরি মার্কা টুইস্ট নেই। প্রতিটা গল্প ধরে ধরে বিচার করলে সবকটি গল্পের মান সমান নয়। যে-কোনো সংকলনের ক্ষেত্রেই যেমনটা হয়ে থাকে আরকি।
কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। সবকটি গল্পের একত্র সমাহারে “মালগুড়ি ডেইজ” যেন একটি অভিন্ন অভিনব নন্-লিনিয়ার উপন্যাসের রূপ ধারণ করেছে। গল্পগুলোর চরিত্ররা, তাদের নানারঙের সুখ দুঃখ সমস্যা সংশয় আশা আকাঙ্ক্ষা, তাদের জীবনের বৈচিত্র্যময় একঘেঁয়েমি — সবমিলিয়ে, মালগুড়ির বিষয়বস্তু ও প্রাসঙ্গিকতা আমাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত নয়। অপরিচিত নয় বলেই এর আবেদনও চিরন্তন। এবং সর্বজনীন। Universal !
বইটি প্রকাশিত হওয়ার পরে মালগুড়ি শহরের পাশে প্রবহমান সরায়ু নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে (নদীর নামটিও কাল্পনিক!)। জীবন অনেক আধুনিক হয়েছে, জটিল হয়েছে, জীবনের গতিবেগ বেড়ে গেছে। কিন্তু মানুষ এখনও “মানুষ” রয়ে গেছে। ভারতবর্ষ কেমন দেশ? কেমন এই দেশের জনসাধারণ? কেমন তাদের চিন্তাভাবনা? তাদের জীবনযাপন? — ভবিষ্যতে এইসব প্রশ্ন যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি তার হাতে “মালগুড়ি ডেইজ” তুলে দেবো।
আজ বাইশে শ্রাবণ। দুঃখের দিন। রবীন্দ্ররচনাবলী ঢুঁড়ে বিমর্ষ টাইপের কিছু পড়ার দরকার ছিলো। কিছু না হোক, রবীন্দ্রবিরচিত গুটিকয় “স্যাড সং” শুনলেও চলতো। আমি বরং উল্টো কাজটাই করলাম। রবিবার দুপুরে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন ভক্ষণ করার পরে, কিছুতেই মনে দুঃখের আমদানি করতে পারলাম না (ভোজনরসিক হওয়ার উপকারিতা #১৭)। তাই দুঃখের ঘাড়ে রদ্দা মেরে “চিরকুমার সভা” পড়লাম।
চিরকুমার সভাকে নাটক না-বলে প্রহসন বলাই ঠিক হবে (প্রহসন যদিও নাটকেরই একটা সাব-জন্রা)। প্রহসনের মূল উপাদান হলো ছ্যাবলামি এবং অতিরঞ্জন। রবীন্দ্রনাথের দাড়িগোঁফের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফিচেল হাসিটাকে চট্ করে আন্দাজ করা যায় না। তাঁর কবিতা গান গল্প উপন্যাস নাটক প্রবন্ধের বেশিরভাগই সিরিয়াস গোছের। তবু মাঝে মাঝে গুম্ফ-আচ্ছাদিত সেই ফিচেল হাসিটা আলগোছে টের পাওয়া যায়। চিরকুমার সভাতে তিনি, যাকে বলে, হাত খুলে ব্যাটিং করেছেন।
নাটকটা পাঠ করে বেশ নির্মল আনন্দ লাভ করেছি। পাশাপাশি এটা ভেবে আফসোস হয়েছে যে, এর অভিনয়রূপ দেখতে পেলে আরো উপভোগ্য হতো। নাটকের কাহিনিসূত্রটা একেবারেই জটিল নয়। ছেলেমানুষি কাজকর্মে ভরপুর। কিন্তু সংলাপের সরস চাতুর্যে, ঘটনার অভিনবত্বে, ফাঁকে-ফাঁকে টুকরো-টুকরো কাব্যের সংযোজনে, নাটকটার অভিনয় একটা জমজমাট ব্যাপার হবে। বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে এর মধ্যে গাম্ভীর্য একেবারেই নেই। কাহিনির পরিণতির দিক দিয়েও মধুরেণ সমাপয়েৎ ঘটেছে। এরকমই কিছু একটা পড়তে চাইছিলাম আজকে। এবারের বাইশে শ্রাবণের দিন সিরিয়াস কিছু পড়লাম না বলে আশা করি কিছু মনে করেননি ঠাকুরমশাই।
(নিজের মৃত্যুদিবস উপলক্ষ্যে জনসাধারণের ন্যাকামি এবং আদিখ্যেতা দেখে তিতিবিরক্ত হয়ে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ)
খুব পুরোনোপন্থী ভঙ্গিতে লেখা একটা বই। আজকালকার “মনোবিজ্ঞানসম্মত” স্মার্ট সেল্ফ-হেল্প বইয়ের সমুদ্রে এই বইটার তলিয়ে যাবার কথা। কিন্তু আমার কাছে তলিয়ে যায়নি। এই তো কয়েকদিন আগে আমার কোভিড হয়েছিলো। সন্ধ্যেবেলা মাথাব্যথা করছিলো বেশ। একটা মাথাব্যথার ট্যাবলেট খেলে কমে যেতো হয়তো। ট্যাবলেটের বদলে, মা যখন কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, মাথাব্যথা কি উধাও হয়ে গেছিলো? না, যায় নি। কিন্তু একটা মানসিক উপশম হয়েছিলো। মনে হয়েছিলো, ব্যথাটা সহ্য করে নিতে পারি। এই বইটা বহুবার আমাকে সেই মানসিক উপশম দিয়েছে।
জীবনে অবশ্যম্ভাবীভাবে মাঝেমাঝে বেকায়দায় পড়ে যাই আমরা। নিজেকে অসহায় মনে হয়। কিংবা হয়তো, উটকো অতিথির মতো, দুঃখ এসে জাপটে ধরে। বলে, “কী বে? সব খবর ভালো তো? অনেকদিন তোর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ নেই।” আরো কতরকম কতকিছু। আমি তো বইকেই সবসময় বন্ধু হিসেবে মেনে এসেছি। নতুন চাকরি পেয়ে বই কিনেছি। প্রেম ভেঙে যাবার পরে বই কিনেছি। বেড়াতে যাবার ট্রেনের টিকিট কেটে ফেলার আনন্দে বই কিনেছি। ফুটবল খেলতে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙে যাবার কারণে, বেড়াতে যাওয়া ক্যানসেল করতে হয়েছে, তখন পায়ে প্ল্যাস্টার বাঁধা অবস্থায়, আর কী করবো? বাড়ি থেকে অর্ডার দিয়ে সেই বইই কিনেছি!
অনেকবছর আগে, আমার কলেজজীবনে, চেন্নাইয়ের একটা ফুটপাথ থেকে এই বইটা কিনেছিলাম। সন্ধ্যা নামছিলো। জোয়ারের মতো মানুষের ঢল নেমেছিল চারিদিকে। কিন্তু নিজেকে একদম একা মনে হচ্ছিলো। একটা বিশেষ কারণে দুশ্চিন্তা কুরে কুরে খাচ্ছিলো আমাকে। দুশ্চিন্তা আর ভয়। রাস্তার অল্প আলোয় এই বইটার দিকে হঠাৎ নজর যায়। হোস্টেলে ফিরে এসে অনেকক্ষণ বইটা পড়লাম। ব্যাস, পরদিন সকালেই আমার বিপদ কেটে গ্যালো? দুশ্চিন্তা গায়েব হয়ে গ্যালো? আমি মিলখা সিংয়ের মতো দৌড়তে আরম্ভ করলাম? নাহ, এসব কিছুই হয়নি। নিজের সঙ্গে মানসিক যুদ্ধ করে, পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে, অনেক ঝামেলার পরে, সেই বিপদ থেকে মুক্তি পেয়েছিলাম।
এই বইটা, তার অনেক হাস্যকর পরামর্শ দিয়ে, পুরোনো দিনের মানুষদের মতো “সবজান্তা” পরামর্শ দিয়ে, বস্তাপচা পরামর্শ দিয়ে, এবং প্রচুর দরকারি পরামর্শ দিয়ে, তারপর থেকে আমার পাশেপাশে থেকেছে। অনেক মনখারাপের রাতে, দুশ্চিন্তার দুপুরে, একাকী সন্ধ্যেবেলা, নিদ্রাহীন ভোরবেলা, আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, যা ঘটছে তার থেকে বেরিয়ে আসবার উপায় আমার হাতেই রয়েছে। আর কেউ নয়, আমাকেই দাঁড়াতে হবে নিজের পাশে। যদি হাল ভেঙে যায়, আমাকেই মেরামত করতে হবে। ডুবে গেলে ভেসে উঠতে হবে। আমাকেই। কিংবা, কোনো পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে বলতে হবে, আর নয়। অনেক হয়েছে, এবার থেমে যেতে হবে। এবার রাস্তা বদল করতে হবে!
এই বইটার কাছে আমার অনেক ঋণ জমে আছে। অনেকের কাছে বইটা হাসির খোরাক হলেও, যখনই ডেকেছি, আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অনেক বিচ্যুতি সত্ত্বেও কিছু মানুষ যেমন আমাদের ছেড়ে যায়না, এই বইটাও আমাকে ছেড়ে যায়নি।
For every ailment under the sunThere is a remedy, or there is none.If there be one, try to find it,If there is none, never mind it!
[b:লাল নীল দীপাবলি 34329682 লাল নীল দীপাবলি বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী Humayun Azad https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1514169669l/34329682.SY75.jpg 21806666]র মতো অতোটা ভালো লাগেনি। ওই বইতে বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক ইতিহাসকে সুখপাঠ্য ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছিলো। এই বইটিতে বাংলা ভাষার ভাষাতাত্ত্বিক দিকটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলা ভাষার জন্ম, বাংলা অক্ষর-শব্দ-বাক্যগঠনের বিবর্তন, বাংলা গদ্যের জন্ম ও বিবর্তন, ইত্যাদি। নানারকম উদাহরণ সহযোগে এইসব বিবর্তনের একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। আমার কাছে এই উদাহরণের জায়গাগুলো বড্ডো একঘেঁয়ে লেগেছে। মাঝে মাঝে বিরক্তিকর। যদিও আজাদের চাঁছাছোলা আবেগী গদ্য সেই বিরক্তিকে বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে দ্যায়নি।শেষের দিকে বাংলা উপভাষা, বাংলা অভিধান, বাংলা ব্যাকরণ, বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ গোষ্ঠীর ভাষাসংক্রান্ত ভ্রান্তি, এইসব প্রসঙ্গগুলো মোটামুটি ভালোই লেগেছে। অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি। কিছু কিছু ভুলে যাওয়া তথ্য পুনরায় মনে পড়ে গেছে। লাল নীল দীপাবলির মতো এই বইটা পড়লেও বোঝা যায়, জন্মাবধি বাংলাভাষা একটি বিদ্রোহী ভাষা। আগেও, এখনও। বাংলা কখনই রাজভাষা কিংবা বড়লোকদের ভাষার মর্যাদা পায়নি। অতীতে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছে সংস্কৃত, প্রাকৃত, ফারসি, ইংরিজি, কিংবা উর্দু ভাষার সঙ্গে। এখন লড়াই পোস্ট-কলোনিয়াল বিশ্বায়নের ধ্বজাধারী, ইংরিজি-পদলেহী, তাঁর নিজেরই মানসিকভাবে দোআঁশলা হীনমন্য সন্তানদের সঙ্গে। অতীতে সবকটি লড়াইয়ে তাঁর জয় হয়েছে। এবারও হবে।
আঠারো কিলোমিটার লম্বা বি টি রোড (“ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড”— ব্যারাকপুর থেকে কলকাতা যাতায়াতের রাস্তা) ছিলো বাংলার শিল্পউদ্যোগের প্রাণকেন্দ্র। একটা সময়, এই মহাসড়কটির দুধারে ছিলো অজস্র বড় বড় কলকারখানা। কারখানার অদূরেই থাকতো শ্রমিকদের বসবাসের বস্তি। পশুরাও সেইসব অস্বাস্থ্যকর বস্তির চেয়ে উত্তম জায়গায় বাস করে। এমনই একটি শ্রীহীন বস্তি এবং সেই বস্তিবাসী ততোধিক শ্রীহীন মানুষদের ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি।
সমরেশ বসুর লেখকজীবনের শুরুর দিকের রচনা এটি। সম্ভবত এই উপন্যাসটির মাধ্যমেই প্রথম পাঠকপরিচিতি পেয়েছিলেন লেখক। কিন্তু আমার একদম ভালো লাগলো না। সম্ভাবনা ছিলো অনেক। বিষয়বস্তুর ব্যাপারে লেখকের অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট, বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু অতিনাটকীয়তার উপদ্রবে খুব বিরক্ত হয়েছি পড়ার সময়। চরিত্র, ঘটনা, সংলাপ— সবকিছুই চড়াসুরে বাঁধা, যেন সস্তার যাত্রাপালা চলছে। শ্রমিকদের জীবন এবং সংগ্রাম নিয়ে পরবর্তীকালে এর চেয়ে ঢের ভালো উপন্যাস লিখেছেন সমরেশ।
নকশাল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখা আমার পড়া এখনও পর্যন্ত শ্রেষ্ঠ উপন্যাস এটি। যদিও উপন্যাসের কোথাও একবারের জন্যেও “নকশাল” শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে উপন্যাসটিতে অনেক খুঁত খুঁজে পাওয়া যাবে। খাপছাড়া কাহিনি, সাদামাঠা গদ্যশৈলী, মোটাদাগের চরিত্রনির্মাণ। দগদগে ক্রোধের ঘোরগ্রস্ত বহিঃপ্রকাশ কেউ কখনও সাজিয়ে-গুছিয়ে করতে পারে?
আদর্শজনিত আত্মত্যাগের কথাই শুধু নয়, উপন্যাসটিতে বর্ণিত হয়েছে একজন মায়ের সঙ্গে তাঁর ছেলের সম্পর্কের আখ্যানও। গোটা উপন্যাসজুড়ে, সকাল দুপুর বিকেল রাত, মা তাঁর সন্তানকে বোঝার চেষ্টা করছেন। যে সন্তানকে তিনি নিজের হাতে বড় করে তুলেছিলেন, সেই সন্তান এখন তাঁর নিজস্ব চিন্তা-আচরণকে প্রভাবিত করছে। সেই সন্তানের হাত ধরে তিনি সমাজকে চিনতে শিখছেন। মানুষের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুখকে চিহ্নিত করতে শিখছেন। প্রতিবাদ জানাতে শিখছেন!
উপন্যাসের শেষদিকের কিছুটা অংশে ব্ল্যাক-হিউমরের উপাদান রয়েছে। এরকম চাঁচাছোলা ভঙ্গিতে ব্ল্যাক-হিউমরের প্রয়োগ বাংলা সাহিত্যে সচরাচর চোখে পড়ে না। খুব দ্রুত পড়ে শেষ করে ফেলা যায় ছোট আকারের এই উপন্যাসটা। কিন্তু, মাথা থেকে খুব দ্রুত বেরিয়ে যাবার নয় এই উপন্যাসের অভিঘাত। একদমই নয়। লেখক তাঁর আবেগকে পাঠকের মনেও সঞ্চারিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
সবচেয়ে কঠিন নিজের মতো হওয়া।
প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটলো যেদিন, ভারতবর্ষ সেদিন দ্বিধাবিভক্ত। দীর্ঘদিনের অমানুষিক সংগ্রাম শেষ হওয়ার পরে দেখা গ্যালো, সারা দেশে আনন্দের আতশবাজি নয়, সাম্প্রদায়িক ঘৃণার আগুন জ্বলছে। দেশমায়ের কর্তিত শরীর থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব মৌলানা আবুল কালাম আজাদের স্মৃতিচারণামূলক বইটির একদম অন্তিম বাক্যটি হলো : History alone will decide whether we had acted wisely and correctly.
তারপর পঁচাত্তর বছর কেটে গেছে। ইতিহাসের রায় এখন কী বলছে? গান্ধীজির নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সবচেয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন যাঁরা, কতটা সঠিক ছিলো তাঁদের নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত? কতটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন তাঁরা? অকল্পনীয় অত্যাচার ও অপমানের বদলে “স্বাধীনতা” নামের যে-বস্তুটি লাভ করেছিলো দেশের সাধারণ মানুষ, তারা আস্থা রেখেছিলো এই নেতাদের উপর। আস্থার কতটুকু দাম দিতে পেরেছিলেন সেই নেতৃবৃন্দ?
মৌলানা আজাদের বইটি পড়ে মালুম হয়, দূরদৃষ্টি থাকা তো অনেক দূরের কথা, সমসাময়িক দেয়াললিখনটাও তাঁরা ভালোভাবে পড়তে পারেননি। স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতির যেটা সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, আমজনতাকে “মুরগি” বানানো, সাধারণ মানুষের জীবন ও ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার প্রবণতা, এই ট্র্যাডিশনের সূত্রপাত অনেক আগেই ঘটিয়ে ফেলেছিলেন মহান জননায়করা। খুব খুব স্পষ্ট ভাষায় সেই বৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন মৌলানা আজাদ। বইটির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এখানেই।
কাউকে ছেড়ে কথা বলেননি মৌলানা। গান্ধীজি, পণ্ডিত নেহরু, সর্দার পটেল এবং তাঁদের আরো যত কংগ্রেসী সাঙ্গপাঙ্গ, সক্কলের বিচ্যুতিকে, ব্যর্থতাকে, অপদার্থতাকে, সোজাসুজি আঙুল তুলে দেখিয়েছেন। দেশভাগ কিংবা পাকিস্তান-সৃষ্টির ট্র্যাজেডি, যেটা আজকের দিনেও কুরে কুরে খাচ্ছে উপমহাদেশের মানুষকে, তার জন্যে এককভাবে দায়ী করা হয় জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগকে। কিন্তু আরো কয়েকজন মানুষ এর জন্যে দায়ী ছিলেন। পাইকারি হারে স্তব-স্তুতির আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে সেই নামগুলো। এই বই খোঁজ দিয়েছে তাদের।
বইটির তিনটি ত্রুটি চোখে পড়েছে আমার। এক, স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসুর অবদানকে খুব হাস্যকরভাবে এড়িয়ে গেছেন লেখক। দুই, সকলের দোষত্রুটি দেখিয়েছেন, কিন্তু নিজের ব্যাপারে কেবল ভালো ভালো কথা বলেছেন— “সব্বাই ভুল, শুধু আমি ঠিক”। তিন, বইটি আদপে মৌলানা নিজে লেখেননি। মৌলানার সঙ্গে বিস্তারিত কথাবার্তা-সাক্ষাৎকার নেওয়ার পরে বইটি লিখেছিলেন হুমায়ুন কবীর। হুমায়ুনের লেখার ভাষা আমার কাছে বেশ নিরস ও বিরক্তিকর ঠেকেছে। বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ছিলো, তাই পড়ে শেষ করতে পেরেছি। কিন্তু এই ত্রুটিগুলো থাকা সত্ত্বেও বইটির সামগ্রিক মূল্য অপরিসীম।
কংগ্রেসের অন্যান্য নেতাদের বাদ দিয়ে, শুধুমাত্র সর্দার বল্লভভাই পটেলকে কেজি কেজি ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার মোড়কে ক্যানো ঢেকে দিচ্ছে নরেন্দ্র মোদি অ্যান্ড কোম্পানি, বিপুল টাকা খরচ করে পটেলের বৃহদাকার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হলো ক্যানো (পৃথিবীর উচ্চতম স্ট্যাচু), এইসব জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তরও পেয়েছি বইটা থেকে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ বারোটা বছরকে একটা নির্লজ্জ রাজনৈতিক প্রহসন বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না!
দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাস করেছেন এমন কোনো বাঙালি লেখক, নিজের প্রবাসজীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস লিখেছেন, এরকম কোনো উদাহরণ আমার জানা ছিলো না। ভাগ্যের পরিহাসই হবে হয়তো, এমন উপন্যাস সত্যিই একটি আছে, কিন্তু সাধারণ বাঙালি পাঠকের খোঁজখবরের প্রায় বাইরে। ক্যানো যে এই উপন্যাসটির নাম শুনিনি কোনোদিন, কোনো আলোচনা পড়িনি, দেখিনি কোথাও কোনো উল্লেখ, চোখে পড়েনি মুদ্রিত কোনো সংস্করণ, এই ব্যাপারটাকে একটা রহস্যই বলা যায়। ইলেকট্রনিক ভার্শনে বই পড়তে আমি স্বচ্ছন্দ নই। তবু চারশো পৃষ্ঠার উপন্যাসটা মোবাইলের স্ক্রিনে পড়ে ফেলতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। মোবাইলে পড়া ছাড়া আর উপায়ও ছিলো না।
অসুবিধে না-হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ উপন্যাসটির নির্মেদ লিখনশৈলী। কাহিনিবিন্যাস, চরিত্রনির্মাণ কিংবা পটভূমি বর্ণনা— সবদিক দিয়েই লেখক মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। বিশ্বাসই হয়না এটি লেখকের প্রথম এবং একমাত্র উপন্যাস। ইন্টারনেট ও বিশ্বায়নের দৌলতে আমেরিকান জীবন আমাদের কাছে এখন খুবই পরিচিত। কিন্তু ১৯৬৫ সালে, উপন্যাসটা যখন লেখা হয়েছিলো, আমেরিকা তখন ছিলো রূপকথার দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর “বেবি বুম” জমানার, কোল্ড-ওয়ার জমানার, ঘটনাবহুল সেই ষাটের দশক। বিত্ত, বৈভব, ঐশ্বর্য্য এবং রাজনৈতিক মহিমায় এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী ঘোড়ার মতো দৌড়চ্ছে আমেরিকা। ভারতের মতো একটি দরিদ্র দেশের কোনো মানুষের কপালে যদি সেই সময়ে আমেরিকায় বাস করার শিকে ছেঁড়ে, কেমন হবে তার জীবন? তার চিন্তাধারা? তার স্ট্রাগল?
ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, মানুষ যখন ছিন্নমূল হয়, তখন সে যেন একটা দ্বীপের বাসিন্দা হয়ে যায়। মানসিক অস্তিত্বের দিক দিয়ে এমনিতেই প্রত্যেকটি মানুষ একাকী। তার উপর যখন তাকে ছেড়ে যেতে হয় নিজের শহর কিংবা গ্রাম, নিজের দেশ, তখন যেন তার শেকড় উপড়ে যাওয়ার জোগাড় হয়। নতুন দেশের মাটিতে নতুন একটা স্বপ্নকে ধাওয়া করে মানুষ। বেশ কিছুদিন আবিষ্ট থাকে সেই স্বপ্নের কুহকে। কিন্তু একটা সময় সে বুঝতে পারে, আজন্মের পরিচিত ভাষা, মানুষ, দৃশ্য, শব্দ, ঘ্রাণ, স্বাদ, স্পর্শ, সবকিছুই তার হাতের নাগাল থেকে বহুদূরে সরে গেছে। তাকে যেন নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। নির্বাসিত, দ্বীপান্তরিত, সেই মানুষদের জীবনের একটা সার্থক পরিচয় পেয়েছি, খুব সহমর্মিতার সঙ্গে লিখিত এই উপন্যাসটা পড়ে।
প্রায় ষাট বছর আগে লেখা চমৎকার এই বইয়ের গল্পটা আজকের দিনেও একটুও পুরোনো হয়ে যায়নি, প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। শেকড়শুদ্ধু উৎপাটন করে ভিনদেশে পুঁতে দিলেই আমগাছে কমলালেবু ফলতে শুরু করেনা। তৃতীয় বিশ্বের মধ্যবিত্ত জীবনের ভয়, আশঙ্কা, লজ্জা, দ্বিধা, অস্থিরতা, পূর্বজীবনের স্মৃতি— সেই ছিন্নমূল মানুষদের পিছু ধাওয়া করে যায় আজীবন। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে, নতুন দেশের নতুন ছাঁচে নিজেকে গড়ে তুলতে। কিছু কিছু অতিনাটকীয়তা রয়েছে এই উপন্যাসে। গল্পের গতি এবং উপভোগ্যতা সবজায়গায় সমান ছিলো না। তবু বাংলা সাহিত্যে এটি একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। একটি বিশিষ্ট উপন্যাস। এই উপন্যাসটিকে নিয়ে আরো অনেক বেশি আলোচনা হওয়া উচিত। আশ্চর্য! কীভাবে হারিয়ে যায় এমন দারুন একটা লেখা?
অনেকদিন পরে হুমায়ূন আহমেদের কোনো উপন্যাস পড়ে তৃপ্তি পেলাম। এমন নয় যে এই উপন্যাসে উনি নতুন কিছু লিখেছেন। কাহিনি কিংবা চরিত্রনির্মাণ, সবকিছুতেই হুমায়ূনীয় বৈশিষ্ট্যের পরিচিত ছাপ। তবু এই উপন্যাসটা ভালো লাগলো। হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ উপন্যাসের যে-ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়না— “খাপছাড়া সমাপ্তি”— এই বইতে সেই দোষটাও নেই।
এমনটা তো আকছার ঘটছে। সরকারের দুর্নীতিতে শামিল হচ্ছে জনগণ। কিংবা, জনগণের সেন্টিমেন্টকে তুষ্ট রাখতে, অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে সরকার। সরকার এবং জনগণ, ঠিক যেন চোরে চোরে মাসতুতো ভাই।
মনোবিজ্ঞানে “সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্স থিওরি” নামের একটা তত্ত্ব আছে যেখানে দেখানো হয়েছে, একজন মানুষ তার আশেপাশের মানুষের চিন্তাভাবনা এবং কাজকর্মের দ্বারা নিজের অজ্ঞাতেই প্রভাবিত হয়ে যায়। চলতি হাওয়াকে অগ্রাহ্য করার কাজটা মানুষের সহজাত নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। দাঙ্গার সময় মানুষ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী, যার সঙ্গে কোনোদিন কোনও ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিলোনা, তাকেও আক্রমণ করে। আবার সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ, যাকে সে চেনেই না, তাকেও আক্রমণ করে।
ইবসেনের এই নাটকে একটা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে। দেশের গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ (“মেজরিটি”) যদি সরকারের একটা অন্যায় কিংবা ক্ষতিকর কিংবা ভুল নীতিকে সমর্থন করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিবাদ করা সম্ভব?
এমনিতে তো সম্ভব নয়। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে, ভারতের ৫০০ ও ১০০০ টাকার কাগজের মুদ্রা বাতিল করার হঠকারী, অপরিকল্পিত এবং হাস্যকর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই সময় যারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের বলা হয়েছিলো “দেশের শত্রু”।
ঠিক যেমন ইবসেনের এই নাটকেও, একজন চিকিৎসক যখন তাঁর শহরের সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্যে প্রতিবাদ করতে উদ্যত হন, তখন সেই সাধারণ মানুষই তাঁকে “an enemy of the people” আখ্যা দ্যায়। তাঁর জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে।
মানুষের দুটো রূপ। একটা রূপ— মানুষ যখন একলা। আরেকটা রূপ— মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ। একলা মানুষ অনেক অন্যায় কাজ করতে পারেনা যেটা গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ একত্র হয়ে করতে পারে। গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের বিচারবিবেচনাবোধ থাকেনা।
রাজনৈতিক নেতারা এই বিষয়টা কাজে লাগায়। তারা প্রোপাগান্ডা তৈরি করে, শ্লোগান তৈরি করে, ছলে-বলে-কৌশলে “মেজরিটি”কে নিজের আয়ত্বে আনার চেষ্টা করে। একবার যদি সেই চেষ্টা সফল হয়, ব্যাস, তাহলেই বাজিমাত!
তখন, কোনো একক মানুষ যদি ন্যায্য কথা বলে, যদি চোখে আঙুল দিয়ে বলে - “তোমরা ভুল করছো”, কিংবা “ তোমাদের ভুল বোঝানো হয়েছে”, মেজরিটি তাঁর জামার কলার চেপে ধমক দিয়ে বলে : “তুই ব্যাটা চুপ করে থাক! তুই দেশের শত্রু!” রাজনৈতিক নেতারা তখন আড়ালে বসে মিটিমিটি হাসে।
“The majority is never right. Never, I tell you! That's one of these lies in society that no free and intelligent man can help rebelling against. Who are the people that make up the biggest proportion of the population — the intelligent ones or the fools?”
(এই নাটকের কাহিনি অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সিনেমার পোস্টার)
বাংলাভাষায় লেখা নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যের প্রসঙ্গ উঠলে, “তিতাস একটি নদীর নাম” উপন্যাসের কথা সবার আগে মনে পড়ে। তিতাস নদীর চেয়ে খ্যাতনামা নদী বাংলাদেশে আরো অনেক আছে। তবু এই আপাত-অখ্যাত নদীটিকে, অদ্বৈত মল্লবর্মণ চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন আপামর বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে। প্রধানত দুটো কারণে।
এক। প্রান্তিক হতদরিদ্র মৎস্যজীবি সম্প্রদায়ের মধ্যে পড়াশুনার রেওয়াজ, সেই আমলে প্রায় ছিলোনা বললেই চলে। এমন অবস্থায়, নিরক্ষর মালোজাতিদের ঘরের একজন মানুষ, দৈবক্রমে লেখাপড়া শিখে, নিজের জাতির মানুষদের সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার বিবরণ এরকম দরদ দিয়ে লিখবেন, এটা একটা অভাবনীয় ঘটনা। সারা পৃথিবীতে এই বিরল ঘটনা ক'টা ঘটেছে তা আঙুল গুনে বলে দেওয়া যায়।
দুই। সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যাওয়া একটা সময়কাল, সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের মানুষজন, তাদের সমাজ, সামাজিক রীতিনীতি, তাদের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, বেঁচে থাকার অপরিসীম সংগ্রাম, তাদের অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনা, একদরিয়া দুঃখের মাঝে ভাসমান একঘটি সুখ, জীবনের উত্থান-পতন, তাদের প্রেম-ভালোবাসা-বিরহযন্ত্রণা— এই সমস্তকিছু জানতে পেরে পাঠক হিসেবে আমার উপলব্ধি হয়েছে যে, এইসব বৃত্তান্ত যদি লিখে না-রাখা হতো, একটা অপূর্ব ঐশ্বর্য্য তলিয়ে যেতো কালের গর্ভে। এমনও ছিলো আকাশ বাতাস জল মাটি নৌকা বৃক্ষ নদী চোখের জল? আমরা কোনোদিন জানতেই পারতাম না! এখানেই তো সাহিত্যের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।
বইটা পড়ে যে-অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতিকে চিনলাম, সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান ছিলেন গিরীন চক্রবর্তী। তাঁর লেখা এবং আব্বাসউদ্দীন আহমদের গাওয়া ভাওয়াইয়া আঙ্গিকের একটা লোকসংগীত আমার খুব প্রিয়। রিভিউ শেষ করার আগে সেই গানের অন্তিম কয়েকটা লাইন এখানে লিখে রাখি। গানের কথাগুলো শুনলে উপন্যাসের চরিত্রদের অভিব্যক্তি এবং সারল্যের কথা মনে পড়ে যায়।
শালিধানের শ্যামলা বনে হইলদা পঙ্খি ডাকেচিকমিকাইয়া হাসে রে চান্দ সৈর্ষা ক্ষেতের ফাঁকে-ফাঁকে সৈর্ষা ক্ষেতের ফাঁকেসোনালি রূপালি রঙে রাঙা হইলো নদীমিতালী পাতাইতাম মুই মনের মিতা পাইতাম যদি রেআরে ঝিলমিলাইয়া ঝালর পানি নাচে থৈইয়া দিয়া পানি নাচে থৈইয়া দিয়া ...
“ফিরে এসো, চাকা” আমার পাঠকজীবনের একটি মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া বই। প্রতিটি মানুষের চিন্তাভাবনায় কিছু স্ববিরোধ (contradiction) থাকে। পাঠক হিসেবে আমার স্ববিরোধটি হলো, গদ্যের ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা, অস্পষ্টতা কিংবা উদ্দেশ্যহীন অবাস্তবতা আমার সহ্য হয়না ; অথচ আমি কবিতা পড়তে ভালোবাসি! গল্প-উপন্যাস পাঠের ক্ষেত্রে সুসঙ্গত প্লট এবং বক্তব্যের বোধগম্যতা আমার কাছে খুব জরুরি দুটো শর্ত। ফ্রাঞ্জ কাফকার “দ্য মেটামরফোসিস” ভালো লেগেছিলো কারণ, গল্পটির আপাত-absurdity সত্ত্বেও ওই দুটো শর্ত পূরণ হয়েছিলো। হুয়ান রুলফোর “পেড্রো পারামো” ভালো লাগেনি কারণ শর্তদুটো পূরণ হয়নি।
২৮ শে এপ্রিল ১৯৬২ সালে লিখিত নিচের এই লাইনগুলো, আজকে ভোরবেলা আমি যখন পুনরায় পাঠ করলাম, তখন আমি আরো একবার, আবারও একবার, এক রহস্যময় কিন্তু সুস্পষ্ট আচ্ছন্নতার প্রতি নিজেকে সমর্পণ করলাম।
কবে যেন একবার বিদ্ধ হ'য়ে বালুকাবেলায়সাগরের সাহচর্য পেয়েছিলো অলৌকিক পাখি।উদ্যত সংগীতে কবে ভরেছিলো হর্ম্যতল, তবুপেরেক বিফল হ'লো গহ্বরের উদ্ধার পেলো না।
যেমনটা শোনা যায়, হতে পারে এই বইটি একজন কবির ব্যর্থ প্রেমের এবং স্পর্শবঞ্চিত আকাঙ্ক্ষার, সুদীর্ঘ এপিটাফ। কিন্তু যখনই এই কবিতাগুলো পড়ি, কবির মানসিক ইতিবৃত্তান্তের কথা আমার খেয়ালে থাকে না। আমি দেখতে পাই একটা অচেতন টানেলের শেষপ্রান্তে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে একটা হলদে আলোর শিখা। শিখাটার নাম “বোধ”।
আগে এই শিখাটার নাম ছিলো “বিপন্নতা”। ২০০৯ সাল নাগাদ প্রথমবার এই কবিতাগুলো পড়ার আগে, কবিতাকে আমি জানতুম একধরণের অস্পষ্ট আবেশ হিসেবে। কবিতা পড়তে আমার ভালো লাগতো, কিন্তু তারা আমাকে বিপন্ন করতো। যা-কিছুর অর্থ আমার কাছে সম্পূর্ণ ধরা দিতো না, তা-ই আমাকে বিপন্ন করতো।
এমন বিপন্ন আমি, ব্যক্তিগত পবিত্রতাহীন।যেখানে-সেখানে মুগ্ধ মলত্যাগে অথবা অসীমেপ্রস্রাব করার কালে শিশুর গোপন কিছু নেই।ফলে পিপীলিকাশ্রেণী, কুসুমের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
বিনয় মজুমদারের সান্নিধ্যে এসে আমি বুঝেছি, বিপন্নতা থেকে বোধে উত্তরণের নামই কবিতা। কবিতা মানে কেবল বিমূর্ত আবেশ নয়। সুন্দর সুন্দর শব্দ পাশাপাশি সাজিয়ে যাওয়া নয়। কিংবা, পাহাড়ি বালকের বাঁশির মতো সরল আত্মউন্মোচন নয়। ক্রোধজর্জর শ্লোগান তো নয়ই। কবি অবশ্যই নিশ্চিতভাবে কিছু একটা প্রকাশ করতে চাইছেন। হয়তো শুধু আমাকেই বলতে চাইছেন। কবি আর আমি মুখোমুখি। কিন্তু, যেহেতু কবিতার চেয়ে ব্যক্তিগত বিষয় খুব কম আছে পৃথিবীতে, নিজেকে প্রকাশ করার আগে আমার সামর্থ্য যাচাই করে নিচ্ছেন তিনি। টুকরো করে কাছি, আমি কি ডুবতে রাজি আছি?
এসো ক্লান্তি, এসো এসো, বহু পরীক্ষায় ব্যর্থ, হাঁসপুনরায় বলে, তার ওড়ার ক্ষমতাবলি নেই,নির্মিত নীড়ের কথা মনে আনে, বিস্মিত স্মৃতিতে।অজীর্ণ, তোমাকে নিয়ে আর কতো গান গেয়ে যাবো?
বোধের এই যে স্পষ্টতা, অথচ প্রকাশের ভাষাটি যেন এই জগতের নয়। তিনি জানতেন, আমিও ধীরে ধীরে জেনেছি, আমরা দুজনেই আসলে ভিনগ্রহী। অপার্থিব মহাজাগতিক ভিনগ্রহী নয়, আমার মাথার ভেতরেই অনেকগুলো বিকল্প গ্রহ আছে। যদিও কবির সঙ্গে আমার বাক্যবিনিময় পৃথিবীর পরিচিত ভাষায় হয়না, তবু বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই, নিবিড় নিশ্চিত বোধগম্যতার সিঁড়িতে দৃঢ়পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে কবিতা। কবিতা যে ভাসমান বায়বীয় কুয়াশাচ্ছন্ন কোনও হিলস্টেশন নয়, রহস্যময় মানেই যে দুরূহ অস্পষ্টতা নয়, এই জরুরি দর্পণগুলো আমাকে সরবরাহ করেছিলেন কবি বিনয় মজুমদার। কবিতা ছলনা নয়, কবিতারও আছে সুসংগত প্লট, সনির্বন্ধ বোধগম্যতা। ব্যক্তিমানুষ হিসেবে জীবনানন্দ দাশ যা-খুশি হতে পারেন— একজন কমলালেবু কিংবা ভোরের শঙ্খচিল। কিন্তু তাঁর কবিতা মোটেও “বিপন্ন বিস্ময়” নয়। কোনো কবিতা যদি প্রকৃতই কবিতা হয়ে থাকে, তাহলে তা ভীষণভাবে দৃশ্যমান! অবচেতনে নয়, আমার জ্যান্ত চেতনায়! এই উপলব্ধি, “ফিরে এসো, চাকা” পড়ার আগে আমার ছিলো না।
যখন কিছু না থাকে, কিছুই নিমেষলভ্য নয়,তখনো কেবলমাত্র বিরহ সহজে পেতে পারি।তাকেই সম্বল ক'রে বুঝি এই মহাশূন্য শুধুস্বতঃস্ফূর্ত জ্যোৎস্নায় পরিপূর্ণ, মুগ্ধ হতে পারে।
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
নীল ডেগ্র্যাস টাইসনের চমৎকার সরস লেখনীর গুণে প্রায় একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম বইটা। জটিল বিষয়কে সহজ এবং আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনার ব্যাপারে টাইসনের পারদর্শিতার পরিচয়, Cosmos: A Spacetime Odyssey নামের ডকুসিরিজের কল্যাণে, আমরা অনেকেই ইতিমধ্যে পেয়েছি। টাইসনের স্বভাবসম্মত সেই wit এবং স্মার্টনেসের ছাপ এই বইতেও পুরোদস্তুর রয়েছে।
অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের কথা বলতে হলে, প্রায় প্রত্যেকদিন নতুন বিষয় আবিষ্কার হয়ে চলেছে। পুরোনো সিদ্ধান্ত খারিজ হচ্ছে, নতুন ধারণা উঠে আসছে। টেলিস্কোপের আয়নায় রোজ ফুটে উঠছে নতুন নতুন জগৎ। তবুও আশ্চর্যের কথা হলো, প্রকৃতপক্ষে আমরা এখনও প্রায় কিছুই জানিনা! এক বিপুল বিশাল অজ্ঞাত মহাদেশের কিনারে আমরা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
কতটুকু এখনও জানতে বাকি আছে, সেটা জানতে পারাটাও একটা দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা। ছোট্ট একটা বইয়ের ২২০ পৃষ্ঠার মধ্যে টাইসন সেই চেষ্টাই করেছেন। মহাবিশ্বের ব্যাপারে সামান্য যা-কিছু জানতে পেরেছে মানুষ, সেটুকু সংক্ষেপে জানিয়েছেন। এবং একইসঙ্গে, নিঃসীম উত্তেজক রহস্যময়তার দিকে পাঠককে ঠেলে দিয়েছেন।
“And yes, every one of our body's atoms is traceable to the big bang and to the thermonuclear furnaces within high-mass stars that exploded more than five billion years ago.
We are stardust brought to life, then empowered by the universe to figure itself out — and we have only just begun.”
লেখকের মতো আমারও একটা টিশার্ট বানানোর ইচ্ছে আছে যেটাতে লেখা থাকবে : OBEY GRAVITY.
কি লিখবো বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে ঘিলুতে আর্থারাইটিস হয়েছে।
একজন অর্ধোন্মাদ আমেরিকান সিরিয়াল কিলারের গল্প এটা। দুনিয়ার হাজারটা শহর বাদ দিয়ে সে জাপানের টোকিওতে খুন করতে এসেছে। টোকিওতেই ক্যানো এসেছে? মা দুর্গা জানেন! লেখার ধাঁচ দেখে মনে হচ্ছিলো, সদ্য BDSM পর্নোগ্রাফির স্বাদ পেয়েছে এমন কোনো ইশকুল বালকের রচনা এটা। আর কাহিনির যা ছিরি! সেক্সুয়াল থ্রিলার লিখতে গিয়ে সেক্সুয়াল কমেডি লিখে ফেলেছে। গল্পের গরু শুধু গাছে ওঠেনি, মগডালে বসে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে! একই সঙ্গে হাস্যকর এবং বিরক্তিকর জিনিস উৎপাদন করা যেমন-তেমন বাবাজির কম্মো নয়। রামছাগলের ক্যানো দাড়ি থাকে, এই প্রশ্নের যেমন কোনো উত্তর হয় না, এই গল্পের খুনির কাজকারবার এবং অন্যান্য ঘটনার তেমনি কোনো লজিক্যাল উত্তর নেই। এমনকি বইয়ের নামকরণের হেতুটাও উদ্ধার করতে পারলাম না আমি। বইয়ের শেষ অংশ জুড়ে খুনি তার ব্যাকস্টোরি বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেইসব চূড়ান্ত হাবিজাবি কথাবার্তা বিশ্লেষণ করার শক্তি আপাতত হারিয়ে ফেলেছি আমি। লেখক তাঁর চরিত্রদের সঙ্গে গাঁজার নৌকায় চড়ে পাহাড়তলি ছাড়িয়ে আরো বহুদূর চলে গেছেন, কিন্তু বেচারা পাঠক আমি, ফেন্সিডিল ছাড়াই টাশকি খেয়ে বসে আছি!
মানে, পোস্ট-মডার্নিস্ট noir-এর নামে হাতির ডিম, ঘোড়ার ডিম, শুঁয়োপোকার ডিম, যা-খুশি চালিয়ে দিলেই হলো, নাকি? টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্ট আবার এই বইকে “স্মার্ট অ্যান্ড স্ন্যাপি সাইকোসেক্সুয়াল পাল্প থ্রিলার” উপাধি দিয়েছে। “দা টাইমস” ম্যাগাজিন বলেছে, এই বই পড়ে এডগার অ্যালান পো এবং দস্তয়েভস্কির কথা মনে পড়ে গ্যাছে তাদের। বলিহারি মাইরি! বলিহারি! “আপনি থাকচেন স্যার!”
শিগগিরি খানতিনেক শিব্রামের গল্প না-পড়লে এই অখাদ্য রাবিশের প্রভাব শরীর থেকে বেরোবে না!
ভণিতাবিহীন জড়তাবিহীন সাদামাটা ভাষায় লেখা ১৬০টা কবিতার সংকলন। কয়েকটা কবিতা বেশ ভালো লেগেছে। অনেকগুলো কবিতাকে কবিতা বলে মনে হয়নি, প্রলাপ মনে হয়েছে। প্রেমহীন শারীরিক সম্পর্ক, নারীশরীর, একাকীত্ব, বেঁচে থাকার প্রতি ভাবলেশহীন ঔদাসীন্য, অস্থিরতা ... ঘুরেফিরে এগুলোই প্রায় সবকটা কবিতার বিষয়বস্তু। ক্যানো বুঝলাম না, কবিতাগুলোকে স্রেফ অশ্লীল কিংবা খাপছাড়া প্রলাপ বলে খারিজ করে দিতে ইচ্ছে করছে না।
someday they'll
each be dead
someday they'll
each have a
separate coffin
and it will be
quiet.
but right now
it's Bob Dylan
Bob Dylan Bob
Dylan all the
way.
ইবসেনের লেখা নাটকগুলোর মধ্যে তুলনায় কম আলোচিত নাটক এটি। যদিও বিষয়বস্তুর বিচারে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত। ঘৃণিতও বলা চলে। নাটকের কাহিনি-অংশটি আমার কাছে বেশ দুর্বল মনে হয়েছে। একটা চরিত্রও মনে দাগ কাটতে পারেনি। তবে, নাটকের নামকরণের কারণটা উপলব্ধি করে সামান্য চিন্তার পরিসর তৈরি হয়েছিলো, এটুকুই যা প্রাপ্তি।
২০২০ সালের ঘোরতর গৃহবন্দী একটা দিনে সে-বছরের নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি লুইস গ্লুক্-এর নাম কোনোদিন শুনিনি। একজন কবিকে যখন পুরস্কৃত করা হয়, তখন আমার ভালো লাগে। মনে হয় সারাদিনের ঝাঁঝালো নাগরিক শব্দগন্ধতাপশঙ্কা অতিক্রম করে, ক্লৌজ-সার্কিট ক্যামেরা লাগানো গদ্য-সাম্রাজ্যের প্রহরা এড়িয়ে, সবুজ ঘাসভর্তি উন্মুক্তকেশ একটা খোলা ময়দানকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো।
I didn't even know I felt grief
Until that word came, until I felt
Rain streaming from me.
নোবেলজয়ী আজেবাজে অখাদ্য গল্প-উপন্যাস সহজেই পেয়ে যাই (যদিও কিনিনা সেগুলো - পয়সা দিয়ে কাঠালপাতা কেনার মতো মনে হয় - কাঠালপাতা ছাগলের খাদ্য - পয়সা খরচ করে এসব কে কেনে? - এর আগে কিনে ঠকেছি বারদুয়েক)। কিন্তু, এমনকি নোবেল পেলেও, কবিতার বই বাজারে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দীর্ঘদিন হা-হতোস্মি অপেক্ষার পরে হঠাৎ সেদিন অঝোরবৃষ্টি সকালবেলায় আমাজন-বাহক আমাকে দিয়ে গেলেন লুইস গ্লুকের কবিতার বই। কাজের ব্যস্ততা এবং মনের আনন্দ চেপে রেখে বাহককে জিজ্ঞেস করলাম, চা খাবেন? তিনি বললেন, দ্যান অ্যাক্কাপ, খাই, যা বিষ্টি ...
I live essentially
In darkness. You are perhaps training me to be
Responsive to the slightest brightening. Or, like
The poets,
Are you stimulated by despair, does grief
Move you to reveal your nature?
গ্লুকের কবিতা পড়া শুরু করলে যেন অবধারিতভাবে মেরি অলিভারের কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। সেই একই প্রকৃতির সঙ্গে সংলগ্নতা, দুঃখের মাঝেও সঞ্জীবনী অনুভবের সন্ধান (সেটা ঠিক “সুখ” নয়, “সুখ” হেব্বি ফালতু শব্দ), নিবিষ্ট আত্মউন্মোচন, ইত্যাদি। কিন্তু খানিক বাদেই ভুল ভাঙে। প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব খুঁজে পান মেরি অলিভার। গ্লুক্ খুঁজে পান নিজেকে। কিংবা নিজের সঙ্গে নিজের চলতে থাকা সংলাপকে। আমরা নিজেরাও তো, দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা, অনবরত নিজের সঙ্গে নিজে সংলাপ চালিয়ে যাই। ঈশ্বরের মতো একজন গোমড়ামুখো ভদ্দরলোকের সঙ্গে আপনি যেমন, আমি যেমন, গ্লুক্ও তেমনি, বেশিক্ষণ আলাপ চালিয়ে যেতে পারেননি (বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর যেমন আলাপ, তেমন আলাপের কথা বলছি। ইশকুলের ছাত্তরের সঙ্গে হেডমাস্টারের আলাপ নয়)।
Once I believed in you; I planted a fig tree.
Here, in Vermont, country
Of no summer. It was a test: if the tree lived,
It would mean you existed.
By this logic, you do not exist.
গ্লুকের কবিতার ভাষা সহজ, কিন্তু নিহিতার্থ একেবারেই তরল নয়। দ্রুতগামী কিংবা তাকলাগানো কিংবা ওরেব্বাসধর্মী কাব্যভাষা নয় তাঁর। তাঁর নিজের অস্তিত্ব এবং জীবনদর্শনের নিমগ্ন উন্মোচন ঘটেছে কবিতায়। প্রকৃতি তাঁর কাছে বিমূর্ত নয়, দৈনন্দিনতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর ভালোবাসা, দ্বিধা, পিপাসা, স্তব্ধতা, উপলব্ধি, তাঁর উদ্যান, উদ্যানের লাইল্যাক ফুল, লেটুশ পাতা, তাঁর প্রেমিক, আরো যা-কিছু জাগতিক আনন্দবেদনাময় বিষয় আছে, তারা এসেছে এই কবিতাগুলোতে। অভিমানও এসেছে। অভিমান ছাড়া কি কবিতা লেখা যায়?
Even here, even at the beginning of love,
Her hand leaving his face makes
An image of departure
And they think
They are free to overlook
This sadness.
মাঝে মাঝে মনে হয়, পচা ফুল, কেমিক্যাল ধূপকাঠি, স্যাঁতস্যাতে দেয়াল, চ্যাপ্টা আঙুর, পুরোহিতের ঘাম এবং প্রগাঢ় পোড়াতেলের গন্ধে-ভরা কোনো মন্দিরের প্রায়ান্ধকার গর্ভগৃহে নয়— ঈশ্বর আসলে আমার শরীরের ভেতরেই কোথাও গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন। বসে বসে খোলা-ভেঙে চিনেবাদাম খাচ্ছেন আর টাইমপাস করছেন। আপনি আপাতত ওখানেই বসে থাকুন, মেসোমশাই। আরেকটু বুড়ো হই, তখন আপনার খোঁজখবর নেওয়া যাবে, কেমন?
As I get further away from you
I see you more clearly.
This is the earth? Then I don't belong here.
Doesn't joy, like fear, make no sound?
[এই রিভিউটা, একটানা সময়ের অভাবে, বেশ কয়েকদিন ধরে ধীরে ধীরে লেখা। তাই একটু খাপছাড়া হয়ে গেছে।]
ও আমার দরদী, আগে জানলে, আমি জানলে, তোর ভাঙ্গা লৌকায় চড়তাম না ...
(জসীম উদ্দীন)
মাঝে মাঝে মনে হয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিল্পটির নাম “বেঁচে থাকা”। একজন চিত্রশিল্পী যখন ছবি আঁকার কাজ শুরু করেন তখন ক্যানভাসের রং থাকে সাদা। মানুষের জীবনের শুরুতেও তার ক্যানভাসে কোনো দাগ থাকে না। জীবন যত এগিয়ে যায় ক্যানভাসে তত বেশি রং জমতে থাকে। আঁকার কাজ যখন খানিকটা অগ্রসর হয়, তখন হয়তো ধীরে ধীরে চোখে পড়তে থাকে ভুলত্রুটি। সম্ভব হলে ত্রুটিটা সংশোধন করার চেষ্টা করা হয়। কিংবা হয়তো চোখেই পড়ে না। চোখে পড়লেও অনেকসময় ত্রুটিটাকে পাত্তা দেওয়া হয় না। অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে থাকি আমরা। এভাবেই একদিন ছবি আঁকার কাজ সম্পূর্ণ হয়। ছবিটা সফল হলো নাকি ব্যর্থ হলো, সেই বিচার কে করে?
আর্থার মিলারের অতিবিখ্যাত এই নাটকটির শিরোনাম থেকেই বোঝা যায়, কাহিনিতে একজন সেলসম্যানের মৃত্যু ঘটেছে। আমরা প্রত্যেকেই তো একজন সেলসম্যান। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু বিক্রি করি। তাজমহল থেকে শুরু করে নিজের আত্মা— পৃথিবীতে স্থাবর অস্থাবর এমন কোনো পদার্থ নেই মানুষ যেটা বেচতে বাকি রেখেছে। এমনকি ঈশ্বরকেও বাদ দ্যায় নি। এমনকি শয়তানকেও বাদ দ্যায় নি। জীবনের এই বিকিকিনি খেলায় কারো বিক্রিবাট্টা ভালো হয়, কারো মোটামুটি হয়, কারো বাজে হয়। এখন প্রশ্ন হলো, ঠিক কতটুকু বিক্রি করতে পারলে একজন সেলসম্যানকে “সফল” উপাধিতে ভূষিত করা যাবে?
সাফল্যের সংজ্ঞা কী? মানুষ তার নিজের চেহারা আয়নায় দেখে কখন বলতে পারে?— “হ্যাঁ আমি সফল!” কিংবা, “নাহ আমি ব্যর্থ”। কিংবা কিছুই বলতে পারেনা। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আর্থার মিলারের এই অসম্ভব চিন্তাউদ্রেককারী নাটকটা পড়ার শেষে প্রত্যেক পাঠক সেই আয়নাটার সামনে নিজেকে আবিষ্কার করবেন। আমরা কি আমাদের ক্যানভাসে ঠিকঠাক রং লাগাচ্ছি? “বেঁচে থাকা”কে পৃথিবীর শ্রেষ্ট শিল্প বলা উচিত কারণ, প্রত্যেক মানুষের জন্যে বরাদ্দ থাকে মাত্র একটাই ক্যানভাস। ভুল হোক ঠিক হোক ক্যানভাস ওই একটাই। নাটকটা পড়া শেষ করে, রিচার্ড ফাইনম্যানের একটা কথা বিদ্যুৎচমকের মতো মনে পড়ে গ্যালো।
The first principle is that you must not fool yourself and you are the easiest person to fool.
“সর্বকালের শ্রেষ্ঠ লকড-রুম মিস্ট্রি”— এই অভিধায় ভূষিত করা হয়েছে, অত্যন্ত বিরক্তিকর, অহেতুক জটিল, হাস্যকর, এবং হরীতকীর মতো রসকষহীন ভাষায় লেখা এই উপন্যাসটিকে।
দুটো খুন হয়েছে। একটা বদ্ধ ঘরে, একটা উন্মুক্ত রাস্তায়। খুনদুটো দেখলে প্রাথমিকভাবে মনে হয়, খুনি বুঝি হাওয়ায় ভেসে এসে খুন করে পালিয়ে গেছে। খুনির কোনো চিহ্ন নেই, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই, কিচ্ছু নেই! যেন ভোজবাজির খেলা। গোল্ডেন-এইজ ব্রিটিশ গোয়েন্দাসাহিত্যকে নিয়ে এমনিতেই হাসিমস্করা করা হয়। অলস পাঠকরা তাদের গতিহীন জীবনে যাতে একটু কৃত্রিম রোমাঞ্চের স্বাদ পান, তার জন্যে যতসব আজগুবি আর অবাস্তবসম্ভব গাঁজাখুরি গল্প ফেঁদে গেছেন সেই সময়কার রহস্য-সাহিত্যিকরা— এমন অপবাদ দেওয়া হয় (যারা দ্যায়, তারা অবিশ্যি নিরেট বেরসিক মানুষ)। কিন্তু এই বইটা গঞ্জিকাধুম্র উৎপাদনের সমস্ত পূর্বরেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আরেকটা ব্যাপার হলো, এমন ব্যক্তিত্বহীন, boring, ডিটেকটিভমশাইয়ের সঙ্গে বাপের জন্মে মোলাকাত হয়নি আমার। ন্যাতানো-বিস্কুটমার্কা এই গোয়েন্দাবাবাজি যদি তদন্ত করতে আসেন, স্রেফ হাই তুলতে তুলতেই দু-চারজন বেঘোরে পটল তুলে ফেলবে।
এ হলো সেইরকম বই, যেটা পড়তে পড়তে বারবার ঘরের এক কোণে টান মেরে বইটা ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে ; এবং যারা এটাকে বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করে মুগ্ধতা বিতরণ করেছেন (যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বইটা পড়েছি), তাদের উপর ভরসা লুপ্ত হওয়ার জোগাড় হয়।