এই বইটার ব্যাপারে অনেকদিন আগে একবার লিখেছিলাম। আজকে আবার লিখছি। যদিও এরকম বইয়ের ব্যাপারে বারবার লেখা যায়। ফ্রিজ খুলে বারবার আইসক্রিম খাওয়ার মতো।
সংগীত যতটা শুদ্ধভাবে আমাদের চৈতন্যকে ছুঁতে পারে, পৃথিবীতে আর কিছু কি ততটা পারে? প্রেম পারে, বাৎসল্য পারে, প্রকৃতি পারে, অনেকদিন পরে বাড়ি ফিরে মায়ের মুখ দেখার তীব্র আনন্দানুভূতি ঝংকার তুলতে পারে আমাদের হৃদয়ের তারযন্ত্রে। আর শুধু পারে সংগীত।
একটা কথা আছে, কানের কোনো জানলা নেই। সত্যিই তো নেই! আমি প্রায় সবধরণের গানবাজনা উপভোগ করতে পারি। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে, ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত আমার সামনে একটা সম্পূর্ণ অন্যরকম আবেদন নিয়ে হাজির হয়।
এই আবেদনের বর্ণ কেমন, গভীরতা কেমন, চরিত্র কেমন, উত্তাপ কেমন, ছন্দ কেমন, প্রাবল্য কেমন, এসব নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। কিন্তু ভেবে কূল করতে পারিনি আজও। শুধু এক অসীম মগ্নতাকে আঁকড়ে ধরে ভেসে চলেছি জানিনা কোন্ দিকে, কতো দূরে, কতো ভাবে।
ধ্রুপদী সংগীতের ব্যাকরণগত জ্ঞান আমার প্রায় নেই বললেই চলে। নিজেও গাইতে কিংবা বাজাতে তো পারিনা। পৃথিবীতে বোধহয় মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে-কিনা কোনো বিষয়কে বিন্দুমাত্র না বুঝেও সেই বিষয়টির প্রতি নিজেকে নিবেদন করে দিতে পারে। সেই বিষয়টির সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসতে পারে।
আমি যেমন এই রিভিউটা লিখতে লিখতে উস্তাদ বিলায়েত খাঁ সাহেবের সেতার-মন্থিত তিলক-কামোদ রাগ শুনছি। আমি তো কিছুই জানিনা এই রাগের ব্যাপারে। কিচ্ছু না! শুধু এটুকু জানি এই রাগটি শুনতে হয় রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে (রাত ৯টা থেকে ১২টা)। আর শুধু ডুবে যেতে জানি। ডুবে যাওয়ার জন্য কি সাঁতার জানতে হয়?
এই বইটির লেখক কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের পিতৃদেবের নাম ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সংগীত বিষয়ে ধূর্জটিপ্রসাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করতেন এমন বহু বিখ্যাত মানুষের মধ্যে দুজন ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এমন বিশারদ মানুষের পুত্র হওয়ার সুবাদে আশৈশব এক রঙিন বৈচিত্র্যময় সাংগীতিক পরিবেশে জীবন কাটিয়েছেন কুমারপ্রসাদ।
তাঁর সেই জীবনব্যাপী সংগীতময় অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সঞ্চিত ছিলো অনেক আশ্চর্য গল্প, অনেক বিচিত্র কাহিনি। ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত জগতের এমন কোনো দিকপাল মানুষ নেই যাঁর সঙ্গে কুমারপ্রসাদের সাক্ষাৎ হয়নি। তাঁর সেই বর্ণময় ঝুলি হাতড়ে, আমার মতো সংগীত-বোধহীন ভিখারি মানুষের জন্যে তিনি লিখেছেন এই অসামান্য বইটি। পিপাসা তো মিটবে না। সেই যোগ্যতাও নেই। তবু জিভের প্রান্তে অমৃতের সামান্য স্বাদ যদি পাই!
কিছুই হবার নয়। কিছুই আমার পাবার নেই! আমি রাতারাতি বুঝে ফেলবো না রাগসংগীতের মাহাত্ম্য। আমি পারবো না অনুভব করতে একজন সংগীতশিল্পীর সৃষ্টিযন্ত্রণা। আমি তো কিছুতেই দেখতে পারবো না একজন যন্ত্রবাদকের আচ্ছন্ন একাকী অবগাহন।
তবু এই বইটা থেকে সংগীতসাধকদের গল্প শুনে, সংগীতের গল্প শুনে, সামান্য, অতি সামান্য, যৎসামান্য হলেও যদি কোনোদিন বুঝে ফেলতে পারি, জগতের এই বিপুল আনন্দযজ্ঞে আমারও নিমন্ত্রণ আছে, তাহলে এর বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?
এবার শুনবো পণ্ডিত নিখিল ব্যানার্জি আর উস্তাদ আলি আকবর খাঁ সাহেবের যুগলবন্দিতে বাজানো ভৈরবী রাগ। ভৈরবী যদিও ভোরবেলার রাগ। তবু আমার এখনই শুনতে ইচ্ছে করছে!
[একটা কথা উল্লেখ করতে ভুলেই যাচ্ছিলাম। বইটাতে শিল্পী বিমল দাসের আঁকা অজস্র পোর্ট্রেট রয়েছে। বইটির গুণগত মূল্য একলাফে অনেকটা বেড়ে গেছে এই দারুন অলংকরণগুলোর জন্যে!]
মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক চমৎকার একটি বড়গল্প হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। বাস্তবসম্মত পরিবেশ সৃষ্টি, জীবন্ত চরিত্রচিত্রণ, মেদবিহীন গদ্য, আকর্ষণীয় সংলাপ, আবেগের যথাযথ প্রয়োগ। কিন্তু, গল্পের অন্তিম পরিণতি বর্ণনা করবার নির্মোহ সাহস দেখাতে পারেননি লেখক। শুধু দুঃখজনক কিংবা নেতিবাচক নয়, কখনও কখনও ইতিবাচক পরিণতি নির্মাণের জন্যেও সাহসের প্রয়োজন হয়।
১৯১৬ সাল, জাহাজের নাম তোসামারু, গন্তব্য জাপান, যাত্রীর নাম রবীন্দ্রনাথ। জাহাজে বসে চিঠি লিখছেন তিনি। সেই চিঠিগুলোই সংকলিত হয়েছে এই বইতে, ভ্রমণসাহিত্যের ছদ্মবেশে। সচেতন গদ্য নয়, আসলে তো চিঠি, তাই ভাবের প্রকাশে রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি সাবলীল এখানে। লৌকিকতামুক্ত। পথে যেতে যেতে কী কী দৃশ্য দেখেছেন তার বর্ণনার চেয়েও বেশি লিখেছেন, কী কী ভাবনা ভেবেছেন। ভেবেছেন অনেকরকম কথা। তোলপাড় করা সামুদ্রিক ঝড়ের কথা। শান্ত বৈকালিক আকাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার কথা। প্রকৃতির অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করে মানুষের যান্ত্রিক-দানবিক হয়ে উঠবার কথা। জাপানিদের অনুপম সৌন্দর্যবোধের কথা। জাপানিদের সঙ্গে বাঙালিদের মিল ও অমিলের কথা। রাতদুপুরে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অঝোর বৃষ্টিপাতের তালে তাল-মিলিয়ে গেয়ে ওঠা গানের কথা : “শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে”।
হঠাৎ মনে হয়, এ একেবারে অসহ্য। কিন্তু, মানুষের মধ্যে শরীর-মন-প্রাণের চেয়েও বড় একটা সত্তা আছে। ঝড়ের আকাশের উপরেও যেমন শান্ত আকাশ, তুফানের সমুদ্রের নীচে যেমন শান্ত সমুদ্র, সেই আকাশ সেই সমুদ্রই যেমন বড়ো, মানুষের অন্তরের গভীরে এবং সমুচ্চে সেইরকম একটি বিরাট শান্ত পুরুষ আছে— বিপদ এবং দুঃখের ভিতর দিয়ে তাকিয়ে দেখলে তাকে পাওয়া যায়— দুঃখ তার পায়ের তলায়, মৃত্যু তাকে স্পর্শ করতে পারে না।সন্ধ্যার সময় ঝড় থেমে গেল।
তুষার রায় ছিলেন ষাটের দশকের একজন উজ্জ্বল ও সুপরিচিত কবি। মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর। ধীরে ধীরে প্রবেশ করেন বিস্মৃতির অন্তরালে। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটেছিলো তিনলাইনের ফিচেল কিন্তু অর্থবহ একটি ছড়ার মাধ্যমে :
পুলিশ ওরে পুলিশ,কবির কাছে আসার আগেটুপিটা তোর তুলিস।
তারপর আমিও ভুলেছি তাঁকে। তিনিও আমাকে। বছরদেড়েক আগে, কোনো এক পত্রিকার পৃষ্ঠায় হঠাৎ একটি কবিতা পড়ে মনে মনে ভাবি, “আপনাকে তো কালটিভেট কর্ত্তে হচ্চে মোশাই...“। পুরো কবিতাটা তুলে দিই এখানে :
বিদায় বন্ধুগণ, গনগনে আঁচের মধ্যেশুয়ে এই শিখার রুমাল নাড়া নিভে গেলেছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন পাপ ছিল কিনা।এখন আমার কোন কষ্ট নেই, কেননা আমিজেনে গিয়েছি দেহ মানে কিছু অনিবার্য পরম্পরাদেহ কখনো প্রদীপ সলতে ঠাকুর ঘরতবু তোমরা বিশ্বাস করোনিবার বার বুক চিরে দেখিয়েছি প্রেম, বার বারপেশী অ্যানাটমি শিরাতন্তু দেখাতে মশায়আমি গেঞ্জি খোলার মতো খুলেছি চামড়ানিজেই শরীর থেকে টেনেতারপর হার মেনে বিদায় বন্ধুগণ,গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে এই শিখাররুমাল নাড়ছিনিভে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেনপাপ ছিল কিনা।
কবির কোনো বইই খুঁজে পাচ্ছিলাম না কলেজ স্ট্রিটে। একেতেই লকডাউন, তার উপর ঘূর্ণিঝড়। অনেক খোঁজার পরে পেলাম তাঁর কাব্যসংগ্রহ। কবিতাগুলো পড়ে খুব অবাক হলাম। ফস্ করে ভেবে ফেলি, এতটা ব্যতিক্রমী কাব্যভাষা নিয়ে এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলেন? ব্যতিক্রমী এবং বৈপ্লবিক। ব্যর্থ প্রেমের কবিতা তো ঢের পড়েছি। কিন্তু প্রেমহীনতার এরকম অব্যর্থ অভিব্যক্তি আমি আর দেখিনি। এটা কী? ক্রোধ? নাকি ক্রোধের পরের শীতলতা? নাকি অপ্রাপ্তির ধিকিধিকি অভিমান?
তুমি সেই লাল ডিভানেতে শুয়ে বুঝলে নাআমি তো তৃষ্ণার্ত হরিণ হয়ে নামতাম জলেতুমি খেতে চাইলে, নিজের মিটুলি খুবলে—রাখতাম তোমার ঠোঁটের সামনে,তোমার জন্যে রেসের ঘোড়া হয়ে বাজি মারতাম প্রত্যহতোমার একটি চুম্বনের জন্য শাহেন শাহ হয়েপাঁচ লক্ষ দিনার কিংবাউপযুক্ত পাছায় গুনে ঠিক পাঁচ লাথি,তুমি কিছু বুঝলে নাঅর্থহীন হলুদ সাবমেরিন হয়ে চলে গেলেঝোলাগুড় নিয়ে মরিশাসেআমি মরি হতাশ্বাসে, তুমি...তুমি কিছু বুঝলে না— বোবা কালাবেডপ্যান তুমিতুমি ভাঙা বাথরুমে ঝকঝকে মুতের বেসিন।
চমক আমার ভালো লাগেনা এমনিতে। কিন্তু তাঁর কবিতায় এরকম নির্বিকার চমক তিনি বারবার দিয়েছেন। যেটা আমার খুব ভালো লেগেছে। তাঁর অসহনীয় ক্রোধ আমি টের পেয়েছি। কিন্তু তিনি যেন ক্রোধের মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা-বাছা বলে সেই ক্রোধকে শান্ত করেছেন। পরিমিত করেছেন। কীসের ক্রোধ? সবচেয়ে বড় ক্রোধ যা থাকে মানুষের। নিজের উপর ক্রোধ।
তবে কেন লিখেছি কবিতা, গান কেন হয়েছে রচিততারকা খচিত ওই আকাশেতে কেন তবে ওঠে চাঁদবিষাদ দুচোখ ছোঁয় সে কবির অশ্রু ঝরে নিভৃত নয়নেশেষের শয়নে তবে শুতে দাও, আমাকেও লাশ করোফাঁসি দাও গাছের ডালেতে, বুলেটে ঝাঁঝরা করোআমাকেও ওইভাবে, শোনোতারপর কখনো পাতক, তুমি শর্ত করো হবে না ঘাতক।
চপেটাঘাতের মতো ছিটকে আসা অসন্তোষ দেখে মনে হয়েছে, এরকম তো মাইরি আর কাউকে লিখতে দেখিনি :
আপনারা থাকুন এই থকথকে হড়হড়ে জীবনআর কলাবাগানের রাজনীতি নিয়ে,জেনে নিয়ে থোড় মোচা নটে শাক কতোবার মুড়োবে ছাগলেফের গজাবেই জেনে— জেনে নিয়ে আপনারা থাকুন!
ষাটের দশকে বসে, বুদ্ধদেব বসু, কৃত্তিবাস কিংবা আনন্দবাজারের সমস্ত অমোঘ হাতছানি অগ্রাহ্য করে নিজের মতো লিখে গেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা এরকম অভাবনীয় কবিতা। তারপর কি তিনি শীতসন্ধ্যায় কুয়াশাভ্রমিত ময়দানের ভেজা ঘাসে খালিপায়ে দাঁড়িয়ে একলা পড়ে শুনিয়েছেন এইসব কবিতা, নির্বান্ধব কোনো বিষন্ন বাদামওয়ালাকে?
অস্ত বেলায় আকাশ এমন লালদেখছি ধূসর বেলায় দাঁড়িয়ে একা,একাই এসেছি একা চলে যাবো কাল।
কবিতার এমন তছনছ ভাষ্যকারকে নিয়ে ক্যানো শুনিনি কোনো আলোচনা এতদিন? কে লেখে নিজের প্রেমিকার প্রতি এমন দৃপ্ত অঙ্গীকার?
আমি ম্লান মুখ তাড়িখোর জানি আমিরসে তীব্র বিষ আছে,তবু নীল মাছি হয়ে দেখো আমিমরে ভাসবো তোমার সায়রে।
ভাগ্যিস খুব বেশি কবিতা লেখেননি তুষার রায়। নইলে হাড়েমজ্জায় এরকম দৃঘাংচু হয়ে বসে থাকতাম, এখন যেমন বসে আছি, জৈষ্ঠ্যের আধপাগল এই সন্ধ্যাবেলায়। আর মাথার ভেতর গগনচুম্বী চিলের মতো চক্রাকারে ঘুরে যেতো এরকম আরো কতো লাইন :
গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে এই শিখাররুমাল নাড়ছিনিভে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেনপাপ ছিল কিনা।
কালো মেয়ে, তোর জন্য
আজ তুমি হরিণাক্ষী, যেহেতু সৌন্দর্যলোভী গুহামানবেরা
দীঘল হরিণীচোখ খুঁজেছ��ল যুগ যুগ ধরে
ক্ষুদ্রচক্ষু গুহানারীদের
বিমর্ষ ও অভিমানী মুখে।
নারীচোখে পড়েছিল পুরুষের সৌন্দর্যের টান—
সেই টানে জেগেছিল পৃথিবীতে রূপের সন্ত্রাস,
যার থাবা পড়েছিল প্রকৃতির যৌন-নির্বাচনে।
ঈষৎ আয়তচক্ষু যে রমণী, তারই ছিল বিপুল চাহিদা—
পুরুষের ব্যগ্র আলিঙ্গনে।
এভাবে রতির হাটে রূপের শাসনে, বিবর্তনে
হরিণাক্ষী নন্দনের জন্ম হয়েছিল।
তারই চাপে ধীরে ধীরে, বহু বহু প্রজন্ম পেরিয়ে
ক্ষুদ্রচক্ষু নারীগর্ভে
হরিণাক্ষী নন্দিনীর জন্ম হয়েছিল।
রূপের সন্ত্রাস এই— পুরুষ-কামনা
যা চায়, সে তা-ই পাবে—
উর্বশী, মেনকা, তিলোত্তমা।
স্বয়ং প্রকৃতি তার আজ্ঞাদাসী হবে।
তাহলে তোর কী হবে? কালো মেয়ে, বোঁচা মেয়ে,
ক্ষুদ্রচক্ষু মেয়ে?
প্রেমিক পাবি না তুই বসন্ত-উৎসবে?
রূপের বাজারে তোর অন্তহীন অপমান হবে?
মানবো না সৌন্দর্যের এই স্বৈরাচার।
পালটে দেবো কবিতার অলংকার, প্রতীক, উপমা–
ভেঙে দেবো রূপের শাসন।
আমার কবিতা হোক, কালো মেয়ে, তোর জন্য বিদ্রোহী নন্দন।
A strange title for a novel, that's what i thought when i first heard the name of Ghachar Ghochar. Later i found out that it's actually a phrase without any apparent meaning, randomly invented by one of the characters in the story, and loosely translates as : a knot which is tangled up beyond repair. We all have some idea about such annoying knots. (In fact, there is a word we have in Bangla - রামগিট্টু :P) The novella received considerable acclaim post its publication and there are some reason behind that.
Ghachar Ghochar is a subtly-plotted tense story about a lower middle class family which went from rags to riches but couldn't avoid the payoff that comes with wealth and prosperity. I liked the simplicity of the storytelling and the attention that is given to the small details throughout the narration. I liked how deftly the writer explored the themes such as class-morality (or the lack of it) and “wilful-blindness”, which are some inevitable peculiarities of human existence. The narrative flow was superb and there were no unnecessary tinkering with form or prose style.
But i did not like the ending much. I do have some qualms about the term “open-ended/ ambiguous ending”. Writers tend to implement this formula just because they don't have a coherent ending ready, sometimes i suspect. Anyway, Srinath Perur's translation is really impressive. While reading the book i almost forgot that it was originally written in the south Indian language, Kannada. Books like Ghachar Ghochar keep reminding me the fact that, India's regional literature is far ahead of the much-hyped Indian-English literature. Just a few dedicated translators are needed to drive the point home. That's it.
শ্রীজাতর “উড়ন্ত সব জোকার” পড়ে খুব চমকে গেছিলাম। একেবারে আনকোরা কাব্যভাষা! তখন তো খুব বেশি কবিতা পড়তাম না। এখন হয়তো অনেক ত্রুটি চোখে পড়বে, কিন্তু নস্টালজিয়ার কারণে বইটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। “জোকার” পড়ার পরে, কবির পরবর্তী বইয়ের জন্যে অধীর অপেক্ষায় ছিলাম। মনে আছে, “ছোটদের চিড়িয়াখানা” বেরোনোর একদিন পরেই কিনে এনেছিলাম বইটা। এবং গোগ্রাসে গিলেছিলাম।
আমি ওপর-ওপর প্রভুভক্ত, ভেতর-ভেতর হিংস্র !
আমার মতে, এই বইটির মাধ্যমেই শ্রীজাত নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পাকাপাকিভাবে। যাকে বলে, “এর পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি”।
কাল রাতে দৈবাৎ একটা কবিতা দেখে এই বইটার কথা আবার মনে পড়ে গ্যালো অনেকদিন পরে। রিভিউ শেষ করার আগে সেই কবিতা পুরোটাই এখানে তুলে দেওয়া যাক।
সমঝোতা, চাঁদের কুচি, নাকিসুরে রবীন্দ্রসংগীতশীতে পুরী, গ্রীষ্মে দিঘা, অভিমান, পালটা অভিমানভিড় থাকলে প্রোটেকশন, ফাঁকায় জানলার ধারে সিটরাতে তাড়াতাড়ি ফেরা, সকাল দশটার মধ্যে চানঘরে দস্যু, বাইরে গেলে একটা বেশ কবি-কবি ভাবরাতে শ-দেড়েক চুমু, দিনে পঁচিশবার টেলিফোনইমেজ, উল্কার গল্প, জন্মদিনে তন্দুরি-কাবাবঘরদোর গুছিয়ে রাখা, রাত না জাগা, সোজাসাপটা মনসিনেমার মতো দুঃখ, ভোরে ওঠা, মিষ্টিমিষ্টি কথাবিয়েশ্রাদ্ধভোটপৈতেহাসিকান্নামাসতুতোমামাতোনারীপুরুষের খেলা, টাকাপয়সা, খুচরো অমরতা...এসব, আমার কাছে, বলো, তুমি আশা করবে না তো?
বাংলা অ্যাকাডেমির এই লোকসংস্কৃতি সিরিজটা দারুন। আমার মাতামহ নোয়াখালীর মানুষ ছিলেন। ভারতে বসবাস শুরু করার পরেও তিনি ভারতীয় ছিলেন না ; নোয়াখালীর আলো-বাতাস-জল-মাটি পুরোপুরি ঢুকে ছিলো তাঁর বুকের ভিতর। মাথার ভিতর। এবং অবশ্যই মুখের ভাষা। এসব ছিলো আমৃত্যু। স্বাভাবিকভাবেই, আমার ভিতরেও সামান্য নোয়াখালী ঢুকে আছে।
লোকসংস্কৃতির উপাদান দুরকম হতে পারে। বস্তুগত এবং ঐতিহ্যগত। বস্তুগত উপাদানগুলো চোখে দেখা যায়। যেমন নোয়াখালীর হোগলা পাতা দিয়ে তৈরি নানাবিধ লোকসামগ্রী। কিংবা সেখানকার বিশেষ খাবারদাবার। যেমন নোয়াখালীর ঘিগজ ধানের মুড়ি, যার রং হালকা গোলাপি। এছাড়া, গাছপালা-লতাপাতা। শিল্পকলা। যারা বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র। অন্যদিকে, ঐতিহ্যগত উপাদানগুলো চোখে দেখা যায়না ঠিকই, কিন্তু তাদের প্রভাব থাকে অনেক বেশি। কারণ তারা থাকে মানুষের স্মৃতিতে, সত্তায়।
ঐতিহ্যগত উপাদানের একটা বড় অংশ হলো প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা, সংগীত, ইত্যাদি। আমার বেশি উৎসাহ এইসব নিয়ে। এই বইতে খুব যত্ন নিয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে এগুলো। যদিও আরেকটু যত্নবান হলে ভালো হতো। প্রবাদের একটা উদাহরণ দিই। “মায় কয়না পুত, মাসিয়ে কয় আঁর ভোইন হুত, আঁর ভোইন হুত!” এর অর্থ - মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। কিন্তু এই বইতে অর্থ দেওয়া আছে - অন্য আত্মীয়রা যতই আদর যত্ন দেখাক না কেন, তারা মায়ের মতো নয়। একেবারেই ভুল বোঝা হয়েছে প্রবাদটা। নোয়াখালীর ভাষা এতই দুরূহ যে অভিজ্ঞ সংগ্রাহকরাও ঘোল খেয়ে গেছেন। তবুও তাঁদের প্রচেষ্টাকে কোনোভাবেই খাটো করার উপায় নেই।
খুব সামান্যই বললাম। আরো অনেক কিছু রয়েছে এই বইতে। বেশ কিছু লোককবিতা কাহিনি কিসসা রূপকথা ইত্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। “বসন্ত কাল আইছেরে, গাছে ধৈচ্ছে হুল/ হুল নয়রে হুল নয়, গাছের কানের দুল” (হুল মানে ফুল :p)। আধুনিকতার আড়ম্বরে এইসব লোকজ উপাদানগুলো ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। এদের সংরক্ষণ করা ভীষণ জরুরি। বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন আমার খুব প্রিয় প্রচ্ছদশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। রিভিউ শেষ করার আগে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি :
এক থাল সুয়ারি
গইনতে না হারি।
(এক থালা সুপারি, গুনতে না পারি)
কন্ চাই কিয়া?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বলে মনে হয় এই বইটিকে। শক্তির কাব্যভাষার অনন্য চিহ্নগুলোর প্রায় সবক'টা খুঁজে পেয়েছি এতে। বইয়ের একদম প্রথম লাইনেই লেপ্টে আছে শক্তির দুরন্ত উপমাসৃষ্টির নমুনা : আজ আমার সারাদিনই সূর্যাস্ত, লাল টিলা— তার ওপর গড়িয়ে পড়ছে আলখাল্লা পরা স্মৃতির মেঘ। কিছু কিছু পঙক্তি প্রবাদের মতো মনে হয় : বুকের ভিতরে কিছু পাথর থাকা ভালো— ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। বইয়ের চতুর্দশপদী কবিতাগুলোর জন্যে উপায় থাকলে আরো দুটো/একটা তারা বেশি দেওয়া যেতো।
যে হৃদয় থেকে তুমি জেগেছিলে সে হৃদয়ে আর যাবার উপায় নাই, সে হৃদয়ে কোলাহল নাই !
মূলত বইপত্র পড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে পুরোপুরি বুঝতে পারা আমার পক্ষে যেমন কোনোদিনই সম্ভব হবে না, ঠিক তেমনি, মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ ও তিতিক্ষার মহিমাকে বাংলাদেশের জনসাধারণ যদি ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে, কিংবা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গুরুত্ব যদি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে, তাহলে সেই বিস্মৃতি যে আসলে কতটা মর্মান্তিক, সেটাও আমার পক্ষে অনুধাবন করা কোনোদিনই পুরোপুরি সম্ভব হবে না।
ছোট্ট উপন্যাসটা শেষ করে এইসব কথা ভাবছিলাম। আরো ভাবছিলাম যে, শহীদুল জহির নিশ্চয়ই আমার মতো ভিনদেশীদের কথা মাথায় রেখে এই অলৌকিক উপন্যাসটি লেখেননি। ঠিক তারপরেই খুব লজ্জিত হলাম নিজের এই ক্ষুদ্র চিন্তায়। আমরা সবাই আমাদের হতভাগ্য মৃত দিদি মোমেনার নামে নিজের মেয়ের নাম রাখি। এই জন্যে নয় যে মোমেনা নামটা আমরা ভুলে যাচ্ছি। এই জন্যে যে, মোমেনা নামটা কোনোদিন ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। মানুষের— দুর্ভাগ্য, বীরত্ব ও বিস্মৃতি, তিনটেরই কোনো দেশবিভাজন হয় না।
(হারুন তাগাদা না দিলে এই বই পড়তে আমার আরো দেরি হতো।)
একখানা গোটা কবিতাও ভালো লাগেনি। বর্ণনা, উপমা, আবেগ, কাব্যভাষা... কোনোকিছুই আহামরি মনে হয়নি। একদম নিম্নমানের না হলেও... ওই আরকি... চলে যায়। শুধু হাতেগোনা কয়েকটা পঙক্তি ভালো লেগেছে। কিন্তু সেগুলোও বহুব্যবহারে পচে গ্যাছে। এখন সেগুলোও ভালো লাগেনা।
পৃথিবীর কবিতার ইতিহাসে এই বইটাকে নিয়ে ক্যানো অ্যাতো আহ্লাদ করা হয়, এটা আমার কাছে একটা রহস্য!
ঔপন্যাসিক সুবোধ ঘোষ এবং ছোটোগল্পকার সুবোধ ঘোষ দুজন ভিন্ন ব্যক্তি, এটা আমি আগেও টের পেয়েছি। তবুও তিলাঞ্জলি পড়া শুরু করেছিলাম কারণ, পঞ্চাশের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে বলতে গেলে প্রায় কিছুই লেখা হয়নি। বাংলা তেরোশো-পঞ্চাশ (ইংরিজি ১৯৪৩) সালের দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিলেন প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষ। প্রকৃত মৃত্যুসংখ্যা আরো অনেক বেশি ছিল, কারণ এটা সরকারি হিসেব। পঞ্চাশের মন্বন্তরকে শুধু “দুর্ভিক্ষ” বললে মিথ্যা কথা বলা হবে। ঠান্ডা মাথায় ও সুপরিকল্পিতভাবে সংঘটিত গণহত্যা বললে ঠিক বলা হবে। অথচ এই মর্মান্তিক ঘটনাটিকে নিয়ে বাংলাভাষার সাহিত্যিকরা আশ্চর্যরকম নিশ্চুপ। বিভূতিভূষণের “অশনি-সংকেত” ছাড়া বলার মতো কোনো উপন্যাস নেই। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের কয়েকটা ছোটগল্প ছাড়া বলার মতো ছোটগল্প নেই। বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন” ছাড়া নাটক নেই। সুকান্ত ভট্টাচার্য ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা একমুঠো কবিতা ছাড়া কবিতা নেই।
এই উপন্যাসটা পড়ে খুব অবাক হলাম। পঞ্চাশের মন্বন্তরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলো এই যুক্তিতে যে, “মহান” সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ইংরেজরা ফ্যাসিস্টবিরোধী গাঁটছড়া বেঁধেছে। ফলে এমনিতে যারা “দুনিয়ার মজদুর এক হও”, “সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক”, “সাম্রাজ্যবাদীর কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও” এইসব হ্যানাত্যানা বুলি কপচায়, তারা লজ্জার মাথা খেয়ে বাংলার অগণিত সাধারণ মানুষের অভুক্ত থাকার বিষয়টা অগ্রাহ্য করেছিলো। ফ্যাসিস্টবিরোধিতাই ছিলো তাদের মূল অ্যাজেন্ডা। পঞ্চাশের মন্বন্তর এমন একটা ঘটনা, যেখানে খেতে-না-পাওয়া মানুষদের পাশে কেউ ছিলো না। ইংরেজ সরকার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তাদের ভারত ছাড়ো আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। কমিউনিস্ট পার্টি তাদের রাশিয়ান ভেঁপু বাজাতে ব্যস্ত ছিলো। বাংলার প্রাদেশিক সরকার কালোবাজারিদের পায়ে তেলমালিশ করতে ব্যস্ত ছিলো। ব্যবসায়ীরা নিজেদের গুদামে চাল মজুত করতে ব্যস্ত ছিলো। বাংলার স্বচ্ছল মানুষরা কালোবাজার থেকে কয়েকগুণ বেশি দামে সেই চাল কিনতে ব্যস্ত ছিলো।
দুটো ভাতের জন্যে দলে দলে মানুষ গ্রাম-গঞ্জ-মফস্বল থেকে শহরে চলে এসেছিলো। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের গল্পে এইসব ঘটনার কথা আমরা কিছু কিছু পড়েছি। কলকাতার রাস্তায় পোকামাকড়ের মতো বসবাস করছিলো মানুষ। পোকামাকড়ের মতো বেঘোরে মারা যাচ্ছিলো। যদিও তাদের কোনোভাবেই মানুষ বলা যায় না। চেহারায়, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, মানসিকতায়, সেই লক্ষ লক্ষ হাভাতের দল সমবেতভাবে নিজেদের মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছিলো। নাগরিক সমাজ বড় বিব্রত ছিলো এই পোকামাকড়দের নিয়ে। তাদের কর্কশ “ফ্যান দাও ফ্যান দাও” চিৎকারে আকাশবাতাস ভারী হয়ে থাকতো রাত্রিদিন। হ্যাঁ, এটা সত্যি কথা যে, তথাকথিত “সর্বহারাদের পার্টি” মোক্ষম সময়ে সর্বহারাদের পাশে দাঁড়ায়নি। কিন্তু এই উপন্যাসের লেখক কমিউনিস্টদের বিপরীতে জাতীয় কংগ্রেসকে প্রায় ভগবানের আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। উপন্যাসটা লেখা হয়েছিলো ১৯৪৪ সালে, অর্থাৎ দুর্ভিক্ষের কয়েকমাস পরেই। জাতীয় কংগ্রেসের ঢালাও গুণগান পড়তে পড়তে মনে মনে হাসছিলাম আর ভাবছিলাম, আর তিন/চার বছর অপেক্ষা করলেই লেখকমশাই জাতীয় কংগ্রেসের আসল খেল দেখতে পেতেন। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার লাইন মনে পড়ে যাচ্ছিলো বারবার।
আমি কি চেয়েছি এতো রক্তের দামে
এতো কষ্টের, এত মৃত্যুর, এতো জখমের দামে
বিভ্রান্তির অপচয়ে ভরা এই ভাঙা ঘরখানি?
আমি কি চেয়েছি কুমির তাড়ায়ে বাঘের কবলে যেতে?
আজকে সকালে লছমন ফোন করেছিলো। অনেকদিন পরে। আমি তো ওকে প্রায় ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম, কিন্তু ও আমাকে ভোলেনি। আমার নম্বরটাও হারায়নি। খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কী হাল, দাজু?” (কুমায়ুনি ভাষায় দাজু মানে দাদা)। “নেহি জি আনা হ্যায় ইস বার?”
ইস বারের কথা তো এখনও কিছুই ঠিক হয়নি। কিন্তু আমার মনে পড়ে গ্যালো সেই উস বারের কথা। আমার প্রথমবার কুমায়ুন হিমালয় যাওয়ার কথা। মনে পড়ে গ্যালো হাওড়া থেকে রওনা দেওয়ার প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা পরে, ট্রেন যখন কাঠগোদাম স্টেশনে ঢুকছে, সেই সকালবেলাটার কথা। ট্রেন থেকে নেমে টের পেয়েছিলাম, আমার পিঠের ভয়ানক ভারী রুকস্যাকটা হঠাৎ অনেক হালকা মনে হচ্ছে। পিছুটানের ভার কমে গেলে, বারবার দেখেছি, এভাবেই রুকস্যাকের ওজন কমে যায়।
এই কাঠগোদাম স্টেশনে তারপর আরো অন্তত ৪/৫ বার গেছি। নৈনিতাল কিংবা আলমোড়া যেতে হলে। কর্ণপ্রয়াগ কিংবা বাগেশ্বর যেতে হলে (বাগেশ্বরের মহারানির নামেই অবনীন্দ্রনাথের “বাগীশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী”)। কিংবা আরো আরো দূরে। সুন্দরঢুঙ্গা গ্লেসিয়ার। পিন্ডারি গ্লেসিয়ার। আরো অনেক দূরে। মিলাম গ্লেসিয়ার। কুমায়ুনের বেশিরভাগ জায়গায় যেতে হলে কাঠগোদামেই (কিংবা পাশেই হলদোয়ানিতে) নামতে হবে আগে। তারপর স্টেশনের বরফশীতল জলের কলে চোখমুখ ধুতে হবে। মুখ ধুয়ে স্টেশনের দোকান থেকে খেতে হবে এককাপ গরম চা। তারপর আরেক কাপ। তারপর? তারপর আবার কি? চরৈবেতি চরৈবেতি!
লছমনের সঙ্গে কথা শেষ হলে আমি দৌড়ে নিচের ঘরে গিয়ে বের করলাম এই বইটা। প্রতিবার আমাকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে গেছেন ইনি। কবেকার কথা? গতজন্মের? আরেহ ন্না! এই জন্মেরই কথা! আমি যে কেমন ভাগ্যবান সেটা আমার মাঝে মাঝে মনেই থাকেনা। চম্পাবতে বসে জিম করবেটের “ম্যানইটার্স অভ কুমায়ুন” আর ক'জন পড়েছে? (চম্পাবতেই শেষবার ধরা পড়েছিলেন সেই হতভাগ্য শার্দুল শিরোমণি)। কিংবা মাইনাস তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গ্লেসিয়ার পার হতে গিয়ে পা পিছলে আলুর দম হয়েছে ক'জন? কিংবা ফিকে কমলারঙের বিকেলবেলায়, থোকা থোকা নীল রঙের ফল ফুটে থাকা একটা জুনিপার গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, পিথোরাগড় শহর থেকে পঞ্চচুল্লির পর্বতশিখরে সূর্যকে দাউ দাউ আগুন ঢালতে দেখেছে ক'জন? ঘটনাগুলো ঘটবার অনেক আগে, যখন বাড়িতে বসে বেরিয়ে পড়ার চিন্তাভাবনার পালা চলছিল, তখন এই বইটা আমাকে তথ্য জুগিয়েছে, ভরসা দিয়েছে, সাবধান করেছে, মন্ত্রণা দিয়েছে। এই বইটার কাছে আমার অনেক ঋণ।
আবার কবে যাবো এখনও জানিনা। লছমন আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে আছে। বলা হয়নি, লছমনের পুরো নাম লছমনপ্রসাদ কান্ডারি। বারতিনেক আমাদের গাইড ছিলো সে। বাংলায় কান্ডারি মানে নৌকার মাঝি। কেমন সার্থকনামা মানুষ! On the road and hanging by a song! না, কানে হেডফোন গুঁজে শোনা গৃহবন্দী গান নয়। ঘামে ভেজা ক্ষুধার্ত শরীর যখন আর একটা পদক্ষেপ নিতেও আপত্তি জানায়, বোতলের জল যখন তলানিতে এসে ঠেকে, বাঁপাশের গহীন জঙ্গলের ভেতর থেকে তখন যদি হঠাৎ ভেসে আসে অশ্রুতপূর্ব কোনো পাখির অদ্ভুত অপার্থিব সুরেলা ডাক। সেই অবস্থায়, সেই মুহূর্তে, পৃথিবীর আর কোনো গান এত মধুর মনে হয়না। এত শক্তি জোগায় না। আবার কবে শুনবো সেই গান? আবার কবে বলবো, বারবার উচ্চারণ করলেও যে-কথাটা কখনও পুরোনো হবার নয় :
THE MOUNTAINS ARE CALLING. AND I MUST GO!
ভালো লাগছিলো কবিতাগুলো। কিছু কিছু পঙক্তিতে চোখ আটকে যাচ্ছিলো। “মানুষের মাঝে যারা গাছ/ তাদের আপন লাগে”। কিছু কিছু আটপৌরে ভাবনায় সরল গভীরতা উঁকি দিচ্ছিল। “নতুন করে দেখার কিছু নাই/ চাঁদ উঠলে তবু তাকাই কেন?”
খুব একটা ভালো লাগেনি “লেটস গেট পলিটিক্যাল” অংশের কবিতাগুলো। এই অংশের কাব্যভাষায় ক্রোধ এবং দ্রোহের বহিঃপ্রকাশ আমার কাছে পরিমার্জিত মনে হয়নি। কিছু কবিতায় হুমায়ুন আজাদের স্পষ্ট ঝলক। অবশ্য তাতে আপত্তির কিছু নেই।
কবির পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলো পড়তে আগ্রহী হয়েছি। কবে পড়তে পারবো জানিনা। আমাদের এখানে বাংলাদেশের কবিতার বই পাওয়া দুষ্কর। তবু চেষ্টা করবো জোগাড় করার। “তারারা পড়ছে খসে” কবিতাটা সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। “পুনর্জন্মে বিশ্বাস নেই কোনো/ এ জীবন গেলো নদীর কিনারে বসে...“।
রমাপদ চৌধুরী, বিমল কর, মতি নন্দী, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর মতো সাহিত্যিকদের ঘরানায় লেখা উপন্যাস। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের বিপন্নতার আখ্যান। লেখার শৈলী ও গল্প বলার ধরন আমার ভালো লেগেছে। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝে, আর কিছু থাকুক বা না-থাকুক, চিরসঙ্গী হয়ে আমাদের পাশে থাকে কে? সমস্যা আর সংকট! ক্ষয়িষ্ণু আয়ু, ক্ষয়িষ্ণু আশা আর ক্ষয়িষ্ণু সমাজের এই টানটান কাহিনিটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, এরকম গল্প এখন আর কেউ লেখেন না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ (আমি নিজেও যাদের একজন), এবং তাদের যন্ত্রণা ও অসহায়তা, সবকিছুই তো এখনও দিব্যি টিকে আছে। কিন্তু এই শ্রেণিকে কেন্দ্র করে, তাদের সাদামাটা কিন্তু জরুরি বিষয়গুলো নিয়ে লেখার মতো লেখকরা ক্রমশ অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছেন।
যদি লাতিন আমেরিকাকে বলা হয় ম্যাজিক-রিয়ালিজম সাহিত্যধারার আঁতুড়ঘর, শুনেছি এই উপন্যাসকে গণ্য করা হয় এই বিশেষ ধারাটির অগ্রপথিক হিসেবে।
আমার একদম ভালো লাগলো না পড়ে। একরৈখিক ন্যারেশনের বদলে একটা নতুনরকম রচনারীতি প্রয়োগ করেছেন লেখক। অতীত ও বর্তমানের কালসীমাকে ভেঙেচুরে একত্রে মিশিয়ে দিয়েছেন। বিনা-নোটিশে কাহিনির কথক পাল্টে গেছে বারবার। অর্থাৎ, বলা নেই-কওয়া নেই, আচমকা স্থান-কাল-পাত্র বদলে বদলে যাচ্ছিলো। এই বদল এতোটাই আচমকা ঘটছিল যে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা দুষ্কর হয়ে পড়েছিল। এইসবই নতুনত্ব কিংবা অভিনবত্বের প্রয়োজনে, বুঝলাম। কিন্তু পড়ার সময় প্রচণ্ড বিরক্তি লেগেছে আমার।
কাহিনিটি— আক্ষরিক এবং প্রতীকী— দুটো অর্থেই “কিম্ভুত”। কাহিনির গতি অতি ধীর। ন্যারেটিভ টেনশন প্রায় নেই বললেই চলে। গদ্যের গঠনশৈলী অতি কষ্টদায়ক। কিন্তু এগুলো তো কোনো সমস্যা নয়! সমস্যা হলো, কাহিনির মাধ্যমে লেখক যেটা বোঝাতে চেয়েছেন (আদৌ যদি “বিশেষ” কিছু বোঝাতে চেয়ে থাকেন) সেটা আমি ধরতে পারিনি। অলৌকিক বিষয়গুলো বাদ দিলেও, পেড্রো পারেমোর জীবনের মূল গল্পটারও মাথামুন্ডু কিসুই বুঝলাম না। একটা দুর্বোধ্য জটিল আবছায়াময় ঘোলাজলে ডুবে ছিলাম ৯৫-পৃষ্ঠাব্যাপী।
পাঠক হিসেবে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। বোধ-বুদ্ধি-অনুভূতির ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আছে। সবকিছু বিবেচনা করেই বলছি, এত অনর্থক ক্লান্তিকর উপন্যাস আমি জীবনে খুব কম পড়েছি। গুগল সার্চ করে এই উপন্যাসের বিশ্লেষণ এবং সারমর্মে চোখ বুলিয়ে নিলে লেখাটার “প্রকৃত” অর্থ হয়তো আরেকটু ভালো বুঝতে পারতাম। কিন্তু, উপন্যাসের প্রাথমিক মর্মার্থ উদ্ধারের জন্যেও গুগলের সাহায্য নিতে হবে, এটা মাইরি একটা কথা হলো?
সেনর মার্কেজ, আপনার রেকমেন্ডেশন আমার কাছে
একদমই সুবিধের লাগলো না!
রণজিৎ দাশের কবিতা পড়ে আমি আবিষ্কারের আনন্দ লাভ করেছি! বৈশাখদিনের ছুটির দুপুরবেলা অতর্কিত বৃষ্টিপতনের শব্দ ছিল চারিদিকে। ভেজা ঘাসের সবুজ কিন্তু তীক্ষ্ণ উজ্জ্বলতাকে পায়ে মাড়িয়ে কবিতাগুলো হেঁটে যাচ্ছিল পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা অতিক্রম করে।
দুঃখের ভিতরে আমি সুখ খুঁজি, পথ থেকে পথেরাংতা কুড়ানো এক ফুটপাতবালকের মতো...দুঃখকে সুখের মতো ব্যবহারও করতে শিখেছিযেভাবে সাপের বিষ, সূক্ষ্ম মাপে, অসুখ সারায়এভাবেই ঘুরে ঘুরে, আজীবনকেবলই পৌঁছেছি এক পথের জলসায়গভীর শীতের রাতে, যেখানে কাছে ও দূরেঅসংখ্য দুঃখের স্তূপ জ্বলে, আর গরিবেরা আগুন পোহায়যেখানে শ্রোতারা খুব শান্ত, অন্তর্মুখীঘুমচোখে বুঝে নেয়—গানটি দুঃখের, কিন্তু গায়িকাটি সুখী।
শহরে যখন কেউ পাগল হয়, তখন সে ট্রাফিক পুলিশ হয়ে যায়। নিজের খেয়ালে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে, দিনের পর দিন। নিখুঁত তার হাতের মুদ্রা, অটুট তার গাম্ভীর্য। কেবল তার নিয়ন্ত্রিত গাড়ি-ঘোড়াগুলি সম্পূর্ণ অলীক। সেসব গাড়ি-ঘোড়া কাউকে চাপা দেয় না, কোনো প্রিয়জনকে বাসস্টপে নামিয়ে দিয়ে যায় না...
যে বাক্য পেয়েছি স্বপ্নে, তাকে খুব সাবধানেতোমার ঘুমন্ত পিঠে নিঃশব্দ আঙুলে লিখে রাখি।বাক্যটি তোমার মধ্যে মিশে যায়, স্নায়ুকোষে, চুম্বকের টানে।ভোরবেলা জেগে উঠে, আমার ঘুমন্ত পিঠে, বিদ্যুৎ-আঙুলে,তুমি যে বাক্যটি লেখো, সেটিই দ্বিতীয় পঙক্তি, সহস্র জোনাকি !কবিতার জিহ্বা দিয়ে তুমি-আমি চুম্বনে লিপ্ত হয়ে থাকি।
তোমার মনে জমেছে এত বিষ, তুমিআমাকে ছোবল মারোআমিই সেই মহিষ, যার গহনকালো পিঠেমাঠের সকল গোখরো এসে নিশীথবিষ ঢালেতবেই তাদের শঙ্খ লাগে, মাথার মণি জ্বলে...তোমার মনে জমেছে এত বিষ, তুমিআমাকে ছোবল মারোআমিই সেই আকাশ, যার গহনকালো পিঠেতারা ফোটে, রাত্রিভর, একটি ছোবল একটি তারা,এভাবে, হাজারো
তরুণী কেবলই তার প্রেমিক পালটায়, সেমুহূর্তেই বুঝে নেয় পুরুষের ভীরুতা ও ফাঁকিআমি শুধু তরুণীর প্রতিটি মুডের জন্যআবহসংগীত ধরে রাখি।যতদিন সে না খুঁজে পাবে তার প্রকৃত প্রেমিক,ততদিন আমি তার স্বপ্নের ভিতরে অক্লান্ত বাজিয়ে যাব শুদ্ধ ও বিষন্ন মিউজিক।
‘হয়তো আমাদের এই গ্রহ অন্য কোনো গ্রহের নরক।' বলেছিলেন হাক্সলি, শিউরে ওঠার মতন কথা। হয়তো সেজন্যেই এই পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ দুঃখী, অধিকাংশ জন্তু হিংস্র, অধিকাংশ পোকা হিজড়ে, এবং অধিকাংশ জল লোনা। হয়তো সেজন্যেই এই নরক শাসন করে এক উলঙ্গ দানবী, যার নাম ‘অতৃপ্ত বাসনা'। হয়তো এমন আরেকটা গ্রহ আছে, যেটা আমাদের গ্রহের নরক। হয়তো সেই গ্রহের বর্ণনাই লিখিত হয়ে চলেছে আমাদের বেদ-বাইবেল-কোরানে, দান্তে ও মিলটনে, ব্যাংকের পাসবুকে আর রাতের দুঃস্বপ্নে, নিরবচ্ছিন্নভাবে আমাদের ছোট ছোট পদস্খলনে।
কখনও বা কবির পাল্কি থামিয়ে একজন মুসলমান প্রজা কবিকে দুটো টাকা নজর দিলেন। কবি নিতে আপত্তি করলে তিনি বললেন, আমরা না দিলে তোরা খাবি কি করে?
একদম সত্যি কথা! রবীন্দ্রনাথ আশি বছর বেঁচেছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনের চতুর্থ দশকটি সৃষ্টির প্রাচুর্যে, বৈচিত্র্যে এবং স্থায়িত্বের দাবীতে বিশেষভাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এই দশকে তিনি লিখেছিলেন সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালির মতো কবিতার বই, বিদায় অভিশাপ ও কর্ণ-কুন্তী-সংবাদের মতো কাহিনিকাব্য, অসংখ্য ছোটগল্প, এবং সর্বোপরি— ছিন্নপত্রাবলী! এক হিসেবে দেখতে গেলে, জীবনের চতুর্থ দশক থেকেই রবীন্দ্রপ্রতিভার প্রকৃত স্ফূরণ শুরু হয়েছিল। এবং তাঁর এই বিস্ময়কর আত্মবিকাশের প্রেক্ষাপটরূপে ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করছে পূর্ববঙ্গের পল্লীঅঞ্চল। নদ-নদী-খালবিল। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত। মাঠ-প্রান্তর-রাস্তা-কৃষিক্ষেত্র। শুধু পেটের খাদ্য নয়, রবীন্দ্রনাথকে মনের খাদ্য জুগিয়েছিল এই অঞ্চলের প্রকৃতি, পরিবেশ, মানুষ। রবীন্দ্রজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল হিসেবে প্রমথনাথ বিশী এই শিলাইদহ-পর্বটিকেই চিহ্নিত করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলতেন, তাঁর পেশা জমিদারি আর নেশা আশমানদারি। কলকাতার ঘিঞ্জি নাগরিক পরিবেশ থেকে যে তিনি এই আশমানদারি করার প্ররোচনা পাননি, এইকথা তো বলাই বাহুল্য। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে প্রমথনাথ বিশী শুধু বিষয়টিকে বিশ্লেষণই করেননি, আমাদের জানিয়েছেন অনেক জানা-অজানা-অর্ধজানা তথ্য। যেমন, “শিলাইদহ” নামটির উৎস হচ্ছে সেই অঞ্চলের জনৈক নীলকর সাহেব, যার নামের পদবি ছিলো “শেলী”। শেলী থেকে শিলাই। আমি জানতে পেরে আশ্চর্য হয়েছি, স্বাধীনতার আগে শিলাইদহ গ্রামটি ছিল নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত। আমার বাড়ি এই নদীয়া জেলাতেই, যদিও শিলাইদহ আজ চলে গেছে কাঁটাতারের ওপারে। বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে নিজের লেখা ছোটগল্প শোনাবার লোভ দেখিয়ে শিলাইদহ আসার আমন্ত্রণ জানাতেন রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার মানুষরা জেনে খুশি হবেন, কুষ্টিয়াতে প্রথম আলুচাষের প্রবর্তন করেন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তার আগে ওই অঞ্চলের মানুষ আলু খেতে জানতেন না। আমি নিজেও জেনে খুশি হয়েছি যে, রবীন্দ্রনাথ এবং আমি, আমরা দুজনেই মীনরাশির জাতক। হাহা!
রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য রচনায় প্রবিষ্ট হয়ে আছে পূর্ববাংলার চিহ্ন। সমাপ্তি গল্পের মৃন্ময়ী, ছুটি গল্পের ফটিক, অতিথি গল্পের তারাপদ, পুরাতন ভৃত্য ও দুই বিঘা জমি কবিতার কেষ্টা ও উপেন, কিংবা ময়নাপাড়ার মাঠের কালো-হরিণ চোখের সেই বিখ্যাত মেয়েটি, এরা কেউই পুরোপুরি কাল্পনিক নয়। ঠিক যেমন কাল্পনিক নয় “তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা” গানটির বিষাদবিলীন কথা ও সুর। কাল্পনিক নয় আরো অনেক কিছু। চলনবিলে সূর্যাস্তের সময় ঝপাঝপ দাঁড় ফেলতে ফেলতে দাঁড়ের তালে তালে ছোকরা মাঝিদের গেয়ে ওঠা গান—
যোবতী ক্যান্ বা করো মন ভারি? পাবনা থাক্যে আন্যে দেব ট্যাকা দামের মোটরি...
হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি,ছুটি নে কাহারো পিছুতে,মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই কিছুতে।নির্ভয়ে ধাই সুযোগ-কুযোগ বিছুরি,খেয়াল খবর রাখি নে তো কোনো-কিছুরই।উপরে চড়িতে যদি নাই পাই সুবিধাসুখে পড়ি থাকি নিচুতেই, থাকি নিচুতে...
দুপুরবেলা ঝমাঝম বৃষ্টির শেষে বিকেলবেলা বইয়ের দোকান থেকে কিনে এনে ���ন্ধেবেলা উল্টেপাল্টে খানিক নেড়েচেড়ে রাতে খাওয়ার পরে একপাতা দুপাতা করে চোখ বোলাতে বোলাতে রাত বারোটা-কুড়ির সময় চৌষট্টি নাম্বার অর্থাৎ অন্তিম পৃষ্ঠাটা উল্টে ফেলার পরে শেষমেশ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার কথাটা মনে মনে স্বীকার করতেই হলো চিৎপটাং হয়ে শুয়ে শুয়ে সিলিংয়ে ঘুরতে থাকা ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে।
শ্রীজাতর আগের কোনো কবিতার সঙ্গে মেলানো যায়না এই বইয়ের কবিতাগুলোকে যেমন গরমকালে রোদের মধ্যে অনেকক্ষণ মোটরবাইক দাঁড় করানো থাকলে তারপর হঠাৎ তাতে বসতে গেলে ছ্যাঁকা লাগে। প্যান্ট পরে থাকলেও লাগে (অবশ্য প্যান্ট না পরে মোটরবাইকে কেউ বসতে যাবেই বা ক্যানো)। কিংবা শীতকালে যদি একবালতি ঠান্ডা জল... অবশ্য শীতকালের ব্যাপারটা এই বৈশাখ মাসে একটুও আন্দাজ করা যাবে না। কত তাড়াতাড়ি আমরা ভুলে মেরে দিই সবকিছু। প্রায় সবকিছুই। এই বৈশাখ মাসটার কথাও ভুলে যাবো সামনের আশ্বিনে।
যে-কোনও কবিতার একটু নীচ দিয়ে, বয়ে যাচ্ছে একটা চোরা স্রোত। চক্রান্তের। ঠিক যেমন রেড কার্পেটের ধারে ধারে চোখে-না-পড়া পেরেকগুচ্ছ। ঠিক যেমন বাসের ফুরফুরে জানলার কোণে লেগে থাকা টাটকা বমি। হয়তো লেখা হচ্ছে দীঘির কথা, কিন্তু তার অনেক গভীরে, নরম মাটিতে পুঁতে রাখা আছে বাপি মণ্ডলের লাশ, যা জাল ফেলেও পাওয়া যায়নি। হয়তো লেখা আছে ধানক্ষেতের কথা, কিন্তু তার মাঝখানটায় দলাপাকানো রক্তমাখা সায়া। এইরকম। পংক্তির ঠিক মাঝখানে না-দেখতে পাওয়া একটা মিহি ছুরির গুনগুন সুর লুকিয়ে আছে। কমা-র আগে দাঁড়িয়ে দম নিচ্ছে একটা মাছ কাটার লোলুপ বঁটি। স্তবকের ডানদিকের পরদার আড়ালে সায়ানাইড। কবিতা, যা ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, আসলে একটা অজুহাতমাত্র।
শ্রীজাতর কবিতা যাদের ভালো লাগে, এই কবিতাগুলো তাদের ভালো না-ও লাগতে পারে। আবার লাগতেও পারে। আবার না-ও লাগতে পারে। যেমন এই কবিতাটার কথাই ধরা যাক!
হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে যখন পরমাণু বোমা আছড়ে পড়ছিল, আমি তখন কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে একটা গাড়ির তপ্ত বনেটের ওপর বসে এন্তার ড্রাম পেটাচ্ছিলাম। ঘিরে ছিল মাতাল বন্ধুদল, আর হে পিতা, আমি নিজেই কি কম মাতাল ছিলাম সেই রাত্রে? বোতলের পর বোতল বিয়র কিচ্ছুটি না জানিয়ে আমার গলা বেয়ে হুড়মুড় করে নেমে গেছিল পাকস্থলিতে। ঠিক যেমন প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মাবে যোনিপথ বেয়ে। দেদার গানবাজনা হচ্ছিল রাস্তার একটা সস্তা পাবের সামনে। গিটারের তুবড়ির সঙ্গে লয় মেলাতে পারছিল না আমার এলোমেলো মাতাল ড্রাম কিট। কিন্তু, হে পিতা, আমিই কি মেলাতে পারছিলাম? আমি কি জানছিলাম না, আমার ড্রামের এক একটা বিট-এর সঙ্গে কয়েকশো কিলোমিটার পর্যন্ত হিলহিলে সাপের মতোই নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ছে দাঁতক্যালানে তেজস্ক্রিয়তা? একটু একটু উন্মাদনার দুলুনি শরীরে বইয়ে দিতে দিতে আমি কি বুঝতেও পারছিলাম না যে ওরা, আমার এই ড্রামের স্টিকদুটোকে অগুনতি যুদ্ধবিমান বানিয়ে ঢুকিয়ে দেবে আমাদেরই পেছনে? আমি সবটাই বুঝেছিলাম, হে পিতা। কিন্তু আমি, হাড় বিচক্ষণ রিচার্ড ফেইনম্যান, নোবেল পুরস্কারটা আন্দাজ করে উঠতে পারিনি।
সব্বাই ওপেনহাইমারকে গালি দ্যায়। আর একজন ক্রুদ্ধ বাঙালি কবি ফেইনম্যানকে কেমন দিলো! আগে হলে বলতুম, উফ কি দিলো, চারআনা কিলো।
ভালো না-ও লাগতে পারে।
আবার লাগতেও পারে।
কিছুই বলা যায় না।
বইটা উৎসর্গ করা হয়েছে : “প্রিয় চাবুক, পিয়ের পাওলো পাসোলিনি, আপনাকে”। চেনেন নাকি তাঁকে?
(এটা পাসোলিনি নয়। এটা নোবেলজয়ী ড্রামবাদক।)
সুব্রত : ইংরেজিতে একটা কথা আছে... A woman's place... is in the home.আরতি : কথাটা তুমি বিশ্বাস করো?সুব্রত : হুঁউ! আমি ভয়ানক কনজার্ভেটিভ... বাবার মতো। ঘরের বউ... should stay in her ঘর! And not... বিচরণ!
গতকাল বিশ্ব শ্রমদিবস উপলক্ষ্যে বেশ কয়েকজন আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মেসেজ পাঠালো। মেসেজগুলো দেখার পর, কলকারখানা-কৃষিক্ষেত্র কিংবা কাস্তে-হাতুড়ির মতো অমোঘ দৃশ্যের বদলে আমার মনে এসে উদয় হলো সত্যজিৎ রায়ের “মহানগর” সিনেমাটির কথা। দুপুরবেলা ইউটিউবে সিনেমাটা দেখলাম আরেকবার। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের লেখা মূল গল্প “অবতরণিকা”ও পড়লাম আরেকবার। আজকে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন। সুতরাং, সিনেমা আর গল্প, দুটো মিলিয়েমিশিয়ে একটা রিভিউ লেখার চেষ্টা করা যাক!
“অবতরণিকা” শব্দের একটা অর্থ— বইয়ের ভূমিকা অথবা মুখবন্ধ। আরেকটা অর্থ— সিঁড়ি। তবে উপরে ওঠবার নয়, নিচে নামার সিঁড়ি। গল্পটি লেখা হয়েছিল স্বাধীনতার বছর তিনেক পরে (শ্রাবণ ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ)। একটা দেশ যখন নতুনভাবে নিজেকে গড়ে তুলছে। কিন্তু একইসঙ্গে, স্বাধীনতা-পরবর্তী ইউটোপিয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা আপামর দেশবাসীর স্বপ্নভঙ্গেরও সময় ছিলো সেটা। ভারতের অন্যান্য বড় শহরের তুলনায় কলকাতা শহরে স্বপ্নভঙ্গের রূপটা ছিল আরো বেশি মর্মান্তিক। কারণ শহর জুড়ে উপচে পড়েছিলো অসহায় উদ্বাস্তুদের ঢল। কাজের বাজারে ক্রমশ ঘুচে যাচ্ছিলো নারী-পুরুষের বিভেদ। ইতিহাসে প্রথমবার, ঘরের ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন গৃহস্থ বাঙালি মেয়েরা। শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের উদ্দেশ্যে।
রিভিউর শুরুতে উল্লেখ করা কথোপকথনের অংশটা সত্যজিতের “মহানগর” সিনেমার শুরুর দিকের একটা চিত্রমুহূর্ত থেকে নেওয়া। আরতির স্বামী সুব্রত কথাগুলো বলেছিলো নেহাৎ ঠাট্টাচ্ছলে। কিছুটা সাংসারিক অভাবের কারণে, কিছুটা নিজের উদারতা প্রমাণ করতে, সুব্রত নিজেই “অনুমতি” দিয়েছিলো আরতিকে, একটা চাকরি খুঁজে নেওয়ার জন্য। এই ঠাট্টা যদিও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। আমেরিকার বিখ্যাত চিত্রসমালোচক রজার এবার্ট ১৯৬৮ সালে শিকাগো শহরে বসে “মহানগর” দেখার পরে তাঁর রিভিউতে চারের মধ্যে চারতারা রেটিং দিয়েছিলেন। এবং উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছিলেন :
সত্যজিতের সিনেমাকে যদি আমি “বিদেশি” (foreign) সিনেমা হিসেবে গণ্য করে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে আমি মুশকিলে পড়ে যাই। তাঁর সিনেমাগুলোকে কীভাবে “বিদেশি” বলবো আমি? এটা ঠিক কথা যে উনি একজন ভারতীয়, আমি ভারতীয় নই। কিন্তু তাঁর তৈরি সিনেমাগুলোর বিষয়বস্তু এবং চরিত্রদের কথা চিন্তা করলে আমাদের হলিউডের সিনেমাগুলোকে অধিক “বিদেশি” বলে মনে হয় আমার কাছে।
I love to see a young girl go out and grab the world by the lapels. Life's a bitch. You've got to go out and kick ass. (Maya Angelou)