কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসটিকে কাছ থেকে অবলোকন করলে ঝাপসা দেখাবে। দূর থেকে অবলোকন করলে খাপছাড়া দেখাবে। উপন্যাসটি পড়ে খুব ভালো লেগেছে, এই কথা জানানোর পরে একজন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো, উপন্যাসের বিষয়বস্তু কী? কাহিনি কী? কোনো বই পড়ার পরে এমনিতে আমি ভালোলাগা মন্দলাগার কারণগুলো গুছিয়ে বলার চেষ্টা করি। কিন্তু এইক্ষেত্রে, ক্যানো জানি মনে হচ্ছে, ম্যাজিকের রহস্য জানিয়ে দিলে যেমন ম্যাজিকের মজা কমে যায়, কাঁদো নদী কাঁদোকে নিয়ে বেশি বিশ্লেষণ করলে পড়ার আনন্দও কমে যাবে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “বড় সাহিত্যের একটা গুণ হচ্ছে অপূর্বতা— অরিজিন্যালিটি।” এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে এই উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সচেতনভাবে অরিজিন্যাল কিছু সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিলেন। “স্ট্রিম অফ কনসাসনেস”, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছিলেন “সচেতন মনের অবিরাম বকবক”, এই বিষয়টা ওয়ালীউল্লাহর অনেক আগে থেকেই সাহিত্যে বিদ্যমান। ম্যাজিক রিয়েলিজমের ব্যবহারও এই উপন্যাসের মৌলিকতা নয়। তাহলে? আমার মনে হয়েছে, এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় অরিজিন্যালিটি হলো এর বর্ণনাকৌশল। মানুষের শরীরের বর্ণনা হোক কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্যের, অলৌকিকতার বর্ণনা হোক কিংবা প্রখর বাস্তবের, কী যে এক রহস্যময় বাঙ্ময়তা ছড়িয়ে আছে উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়— মুখর হয়েও স্তব্ধ। চঞ্চল হয়েও নিবাতনিষ্কম্প। বাংলা সাহিত্যে এমন জিনিস আমার চোখে পড়েনি কস্মিনকালে। বিশ্বসাহিত্যের কথা জানিনা। কতোটুকুই বা আর পড়েছি!
মানুষের মনকে, মানুষের মনের সিঁড়িভাঙা জটিল অঙ্ককে যেন হাতের মুঠোয় ধরে ফেলেছেন ওয়ালীউল্লাহ। কাহিনির একদম শুরু থেকেই, নিদ্রারসে সিঞ্চিত এক দ্বিপ্রহরে, স্টিমারের একজন যাত্রীর দেহভঙ্গিমা এবং স্বভাবচরিত্রের বর্ণনার মধ্যে দিয়ে পাঠকের চেতনাকে আবিষ্ট করতে শুরু করেন লেখক। সেই বিশেষ যাত্রীটি তাঁর ফেলে আসা জীবনের একটি বিশেষ ঘটনার কথা স্টিমারের সহযাত্রীদের কাছে বলবার উপক্রম করেন। মূল উপন্যাসের যিনি কথক, ঘটনাটি তিনি আগে থেকেই জানতেন। শুরু হয় গল্পের যাত্রা। এইভাবেই ধূপের অদৃশ্য সুগন্ধের মতো, কাহিনির প্লটহীন মন্থর আমেজ আমাকে ঘিরে ফ্যালে। ভাষার অমোঘ অথচ অনায়াস প্রয়োগে, বর্ণনার সূক্ষ্ম কারুকাজে, চিত্রকল্পের মগ্নতায়, আমি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করি, “অরিজিন্যালিটি” শব্দটির দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন।
I am moved by fancies that are curledAround these images, and cling :The notion of some infinitely gentleInfinitely suffering thing.
(টি এস এলিয়ট)
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সবচেয়ে বেশি পঠিত এবং আলোচিত উপন্যাস হলো লালসালু। আমাদের উপমহাদেশীয় সমাজব্যবস্থায়, যেখানে রাজনীতি এবং ধর্ম— এই দুটি বিষয়কে অগ্রাহ্য করে জীবন কাটানো যায়না, সেখানে এইরকম একটি উপন্যাসের গুরুত্ব অপরিসীম। এই উপন্যাসের চরিত্ররা মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলেও, উপন্যাসটির মূল বক্তব্য কোনো নির্দিষ্ট ধর্মকে নিয়ে নয়। চরিত্ররা মুসলমান না-হয়ে হিন্দু হলেও কোনো অসুবিধে ছিলো না। ধর্মকে যারা অসৎ উপায়ে ব্যবহার করে, প্রকৃত “বিধর্মী” আসলে তারাই। আস্তিক-নাস্তিকরা খামোখাই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-মারপিট করে মরে।
ওয়ালীউল্লাহর লেখা প্রথম উপন্যাস এটি। পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে তাঁর যে বিশেষ গদ্যশৈলী প্রত্যক্ষ করি আমরা, এই উপন্যাসে সেটি নেই। খুব আটপৌরে এবং গতানুগতিক ভঙ্গিতে তিনি একজন ভন্ড মানুষের গল্প শুনিয়েছেন। ধর্মকে যারা “ধান্দা” হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের প্রত্যেকের চরিত্রে একটা বিশেষ লক্ষণ দেখা যায়। তারা নিজেরা খুব ভালো করেই জানে যে, তারা মিথ্যেবাদী। একজন হিন্দু বাবাজি খুব ভালো করেই বোঝেন : এই যে তিনি ভক্তদের হাতে মন্ত্রপূত মাদুলি বেঁধে দিচ্ছেন, সেই মাদুলি বস্তুটি একটি খাঁটি ভাঁওতাবাজি। তার মানে, মানুষ যাকে ভগবানের প্রতিনিধি হিসেবে মান্য করছে, সেই লোকটাই ভগবানের সঙ্গে (এবং ভগবানের নামে) সবচেয়ে বড়ো ঠাট্টা-মশকরা করছে। সবচেয়ে নির্ভেজাল খাঁটি নাস্তিক তো তারাই! “জাগো গ্রাহক জাগো!”
ধর্মবিশ্বাস জিনিসটা খারাপ নাকি ভালো সেই আলোচনায় আমি যাবো না। আলোচনাটা এতো সহজও নয়। আমি বরাবর মেনে এসেছি, ঈশ্বরবিশ্বাস একটি ব্যক্তিগত বিষয় (পাহাড় বেশি পছন্দ নাকি সমুদ্র নাকি অরণ্য? —এটা যেমন একটা ব্যক্তিগত বিষয়)। আমি দেখেছি, জাগতিক সিরিয়াস সমস্যাগুলোর প্র্যাক্টিক্যাল সমাধানের উপায় যারা মাথা থেকে বের করতে পারেনা, তারাই ঈশ্বরকে নিয়ে বেশি টানাটানি করে। দুই পক্ষের ক্ষেত্রেই দেখেছি। তুই নাস্তিক না মুই আস্তিক (or vice versa)— এইসব ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপারে তারা খুবই গর্বিত এবং নিজেদের বুক চাপড়ে চাপড়ে বুক ব্যথা করে ফ্যালে। খুব সহজেই তারা একে অপরকে নস্যাৎ করে দ্যায়। “ওহ, তুই ভগবান মানিস (কিংবা মানিস না)? ব্যাস ব্যাস আর কিছু বলতে হবে না, আমি যা বোঝার বুঝে গেছি।” এখন তো আবার ফেসবুক টুইটার আছে— বারোয়ারি মাছের বাজার। যেসব তর্কের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র হলো কে কাকে কতো বেশি হেনস্থা করতে পারে, অপমান করতে পারে, ছোটো করতে পারে— সেগুলো তর্ক নয়, টাইমপাস। ক্ষতিকর টাইমপাস। কাজ নেই খেয়ে দেয়ে, স্ট্যাটাস ছাড়ি ধেয়ে ধেয়ে।
এই টাইমপাসের ফাঁকেই, ফায়দা যাদের লোটার, তারা লুটে নেয়। লালসালু উপন্যাসেও লুটেছে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো নিয়ে যখন সাধারণ মানুষরা ব্যতিব্যস্ত থাকে, সেই সুযোগে তারা চোরের মতো সিঁধ কেটে মানুষের মনের ভিতরে প্রবেশ করে। দেখে মনে হয় এদের অপকর্মের সবচেয়ে বড়ো সহায় হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। আসলে তা নয়। এদের সবচেয়ে বড়ো সহায় হলো মানুষের চেতনার মধ্যে ঢুকে থাকা ভয়, অসহায়তা, ভীরুতা, কাপুরুষতা, লজ্জা। লালসালু উপন্যাসে এই সবকিছুই খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমার আপত্তি শুধু একটা বিষয়ে।
এই উপন্যাসের চরিত্র এবং ঘটনানির্মাণ আমার কাছে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয়নি। গ্রামের মানুষদের এতো বুদ্ধি-বিবেচনাহীন বলে মানতে রাজি নই আমি। গ্রামাঞ্চলের মানুষ শিক্ষায় দীক্ষায় পিছিয়ে আছে, ঠিক কথা। কিন্তু একজন মাত্র মানুষ একটি মাজারকে অবলম্বন করে গোটা গ্রামকে দীর্ঘকাল (১২ বছরেরও বেশি সময়) বোকা বানিয়ে রেখেছে, কেউ কোনো প্রতিবাদ করেনি, রুখে দাঁড়ায়নি, এমনকি তার ভন্ডামি ধরতেও পারেনি। এই বিষয়টা আমার কাছে বেশ আষাঢ়ে কল্পনা বলে মনে হয়েছে। মূল ভন্ড চরিত্রটির মধ্যে আমি এমন সাংঘাতিক কিছু খুঁজে পাইনি যার দ্বারা গোটা গাঁয়ের মানুষের এরকম দীর্ঘকালীন ল্যাজেগোবরে অবস্থা হবে। উপন্যাসের ঘটনাপ্রবাহকে কেমন যেন খাপছাড়া বলেও মনে হয়েছে। বিশেষ করে শেষের দিকের কাণ্ডকারখানার মর্ম আমার বোধগম্য হয়নি।
সুলিখিত এবং সুমার্জিত না হওয়া সত্ত্বেও উপন্যাসটি দীর্ঘকাল যাবৎ পাঠকদের ভাবিয়েছে। তার কারণ, উপন্যাসে বর্ণিত সমস্যার সমাধান আজ পর্যন্ত তো হয়নি বটেই, বরং এখনও বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। আস্তিকরা নাস্তিকদের প্রতি এবং নাস্তিকরা আস্তিকদের প্রতি ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। হেনস্থা করে কাউকে নিজের দলে টানা যায়না। ভয় দেখিয়েও না। আমরা বোধহয় শত্রু নির্বাচনে ভুল করে ফেলছি। পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে সফল নাস্তিক যিনি ছিলেন, তিনি কিন্তু গরম-গরম বিপ্লবী ডায়লগ মেরে, প্রতিপক্ষকে অপমান করে, ফেসবুকে চালাক-চালাক স্ট্যাটাস পোস্ট করে, কিংবা হাতাহাতি করে নিজের কাজ হাসিল করেননি। তিনি নিজের কাজ হাসিল করেছিলেন করুণার দ্বারা, সহমর্মিতার দ্বারা, সমঝোতার দ্বারা, সহানুভূতির দ্বারা। তাঁর নাম সিদ্ধার্থ গৌতম। ওরফে বুদ্ধদেব। এইযুগের ফেসবুক-টুইটারের ভার্চুয়াল মাস্তানদের চেয়ে অনেক কঠিন মাস্তান ছিলেন তিনি।
লালসালু দিয়ে ঢাকা পীরের মাজার হোক কিংবা গেরুয়া নামাবলী দিয়ে ঢাকা “জাগ্রত” দেবতার থান। এইসব জায়গায় যারা ভন্ডামির রাজত্ব চালাচ্ছে, তাদের মুখোশ খুলতে হলে আগে আমাদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক চুলোচুলি বন্ধ করতে হবে। পরস্পরকে বুঝতে হবে। “যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।”
গদ্যশৈলীর মৌলিকতা, কাহিনির ভিতরে সম্পৃক্ত দ্বন্দ্ব, চরিত্র নির্মাণ, পাঠকালীন উপলব্ধি— সব দিক দিয়ে বিচার করে আমার মনে হয়েছে, এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি সম্পদ। এই উপন্যাসটির সঙ্গে লেখকের অন্যান্য জনপ্রিয় উপন্যাসের তুলনা এবং রেটিং-রেটিং খেলায় মত্ত হবো না আমি ; শুধু নিজের ভালোলাগার কারণগুলো খুব সংক্ষেপে লিখে রাখার চেষ্টা করবো এখানে।
উপন্যাসটির একটা মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর নির্লিপ্ততা। আমার কাছে আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম প্রকৃষ্ট লক্ষণ এটা। পাঠকের মতো লেখকও নিজেকে উপন্যাসের চরিত্রদের থেকে আলাদা করে রেখেছেন। নিজের মতামত/দর্শন আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেননি। তিনি স্রষ্টা হয়েও তাঁর হাবভাব স্রষ্টার মতো নয়, পাঠকের মতোই তিনি একজন দর্শক মাত্র। সেই কারণেই, আবু ইব্রাহিম যে মারা যেতে চলেছেন, এই স্পয়লারটা তিনি উপন্যাসের সর্বপ্রথম লাইনেই আমাদের জানিয়ে দিতে কার্পণ্য করেননি। মুখ্য চরিত্রের অন্তিম পরিণতির ব্যাপারটা কাহিনির শুরুতেই বিবৃত করে দেওয়ার পরে, একটি নাতিদীর্ঘ এবং নির্লিপ্ত গল্পকথনের সূচনা করেন লেখক। প্রশ্ন হলো, ক্যানো মারা গেছিলেন আবু ইব্রাহিম?
আবু ইব্রাহিমের জীবনটা আমাদের নিজেদের জীবনের মতোই। তার মতো আমরাও “শর্টকাট” পদ্ধতিতে নিজেদের চারিত্রিক ভীরুতাকে জয় করতে চাই (এবং শেষ পর্যন্ত আরো বেশি ভীরু হয়ে যাই)। তার মতোই আমরা ঘুষ খাবো কি খাবোনা ভেবে রাতের ঘুম নষ্ট করি। খুব ইচ্ছে থাকলেও, স্রেফ সাহসের অভাবে আমরা অসৎ (কিংবা লম্পট) হতে পারিনা। সততার ফালতু মুখোশটা নিজেদের মুখের উপর লেপ্টে রেখে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াই। তার মতোই নিজেদের বউয়ের ব্যাপারে “পৃথুলা”, “স্থূলকায়া”, এইসব শব্দ চিন্তা করি, কিন্তু রাত্রিবেলায় বিছানায় বসে উপলব্ধি করি, এই মেদবহুল দেহটা থেকেই আনন্দ সংগ্রহ করে নিতে হবে, আপাতত হাতের কাছে দ্বিতীয় কোনো অপশন নেই।
যখন “অপশন” এসে হাজির হয়? প্রাক্তন প্রেমিকা কিংবা অফিসের সহকর্মী। চান্স পেলে তখন সেই বিকল্প দেহটাকে আমরা উপভোগ করতে সচেষ্ট হই। ভুল বললাম। আমরা তো ভীরু এবং কাপুরুষ। সচেষ্ট হওয়ার বিষয়টা কেবল মনে মনেই কল্পনা করি। তাকে ডাকবো। বন্ধুর ফাঁকা ফ্ল্যাটে। দুপুরবেলা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি সেই নতুন দেহটাকে কব্জা করতে পারি আমরা? আবু ইব্রাহিম পেরেছিলেন তার “অপশন”কে কব্জা করতে?
জীবনের এইসব হাজাররকম “সম্ভাবনা”কে মগজের মাংসের খাঁজে প্রতিনিয়ত বহন করে চলি আমরা। সফল হওয়ার সম্ভাবনা। দৈহিক সুখলাভের সম্ভাবনা। শহরে নিজস্ব একটি বাড়ির মালিক হওয়ার সম্ভাবনা। পোষা কুকুরের মতো আজীবন পায়ের কাছে লুটোপুটি খাওয়া নিজেদের কাপুরুষতাকে, ভীরুতাকে, জয় করার সম্ভাবনা। বিভ্রান্তিতে ভরা বালের এই বোকাচোখা জীবনটার তেলতেলে ঘৃণ্য খোলস ত্যাগ করে ঝাঁ-চকচকে স্মার্ট জামাকাপড় পিন্দনের সম্ভাবনা। আবু ইব্রাহিম তো আসলে আমরাই। আবু ইব্রাহিমও সম্ভাবনার সুইমিংপুলের সাইডে দাঁড়িয়ে ভেবেছিলেন, জলের মধ্যে লাফ মারবো কি মারবো না? আবু ইব্রাহিম মারা গেছিলেন। তবে জলে ডুবে নয়।
শহীদুল জহিরের এই উপন্যাসটি তিনি বেঁচে থাকতে বই আকারে প্রকাশ করা হয়নি, যদিও পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল অনেক আগেই। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সরকারি উচ্চপদস্থ আমলা। এই উপন্যাসটিতে বেশ খোলামেলাভাবে তিনি আমলাতন্ত্রের ভন্ডামি, দুর্নীতি এবং দ্বিচারিতাকে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটি পড়লে আন্দাজ করা যায়, তাঁর পেশাগত অভিজ্ঞতার কিছু বাস্তব উপাদান তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন কাহিনিতে। এই কারণেই তাঁর জীবিতাবস্থায় বইটি ছাপা হয়নি। কাক যেমন কাকের মাংস খায়না, তেমনি নিজে আমলা হয়ে সহকর্মী-আমলাদের মাংস খাওয়া যায়না।
যাই হোক, আবু ইব্রাহিম ইজ আপাতত ডেড।
কিন্তু তবুও, লং লিভ আবু ইব্রাহিম। এই কথা তো বলাই বাহুল্য।
মহাভারতের অতিপরিচিত কাহিনিগুলো যতবার পড়ি, নব রূপে, নব আঙ্গিকে, ততবার নিত্যনতুন উপলব্ধি জেগে ওঠে মনের মধ্যে। গল্পের আদি-অন্ত জানা থাকলেও মলিন হয়না তাদের আকর্ষণ। পাণ্ডবদের পিতা পাণ্ডু ছিলেন একজন প্রবল প্রতিভাশালী ব্যক্তি। পৌরুষ এবং পাণ্ডিত্যে, শস্ত্র এবং শাস্ত্রে— তাঁর ছিল সমান অধিকার। এত যে পরাক্রমী একজন মানুষ, এত রূপবান এত গুণবান, তবু জন্মগত বিশেষ ত্রুটির কারণে তিনি সন্তানপ্রজননে অক্ষম ছিলেন। কুন্তী এবং মাদ্রী, এই দুই সহানুভূতিশীল স্ত্রীকে পাশে পেয়েও তিনি কাটিয়েছিলেন একটি বিষন্ন এবং বিপন্ন জীবন। এমনিতেই মহাভারতের কাহিনিতে জটিলতার শেষ নেই। পাণ্ডু'র এই শারীরিক ব্যাধি এবং সেই ব্যাধির পরিণাম— মহাভারতের অভিনব এবং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এবং সবচেয়ে রহস্যময়। বলা যেতে পারে, এই বিশেষ ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়েই সমগ্র মহাভারতের সুদূরপ্রসারী ঘূর্ণাবর্তের সূচনা হয়েছিল।
সন্তান উৎপাদনে অক্ষম ছিলেন পাণ্ডু, তবু কীভাবে জন্ম হয়েছিল পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের?
তমাল বন্দোপাধ্যায় মহাভারতের এই কৌতূহলকর অধ্যায়টিকে বেশ সুন্দরভাবে পুনরুজ্জীবিত করেছেন তাঁর কলমে। লেখকের গদ্যভাষা মনোরম, বর্ণনা স্বচ্ছ এবং পরিমিত। পৃথিবীর যেকোনো প্রাচীন মহাকাব্যের বহিরঙ্গের অলৌকিক/অতিলৌকিক খোলসটি অতিক্রম করলে আবিষ্কার করা যায় মানুষের চরিত্র এবং সমাজের চিরকালীন বৈশিষ্ট্যগুলোকে। মহাকালের মন্দিরা সেই একই ছন্দে বেজে যাচ্ছে আজও। আজও মানুষ কায়মনোবাক্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় ; কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কিংবা স্বার্থের তাড়নায়, পরিত্যাগ করে সেই সুচিন্তিত প্রতিজ্ঞা। আজও মানুষ, সভ্যতার দ্বারা অর্জিত শোভন পরিচ্ছদ এবং মার্জিত আচরণের নিচে লুকিয়ে রাখে তার basic instinct-গুলোকে। আসমুদ্রহিমাচল পৃথিবীকে পদানত করার আস্ফালন দেখায় ; কিন্তু মানুষ আজও পোষ মানাতে পারেনি, এমনকি তার নিজের মনকেও!
যদি জিজ্ঞেস করা হয় বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আইকনিক নারী কে ছিলেন? তাহলে প্রায় নির্দ্বিধায় উত্তর দেওয়া যায় : মারি কুরি। ক্যানো? রেডিয়াম এবং পোলোনিয়াম মৌল আবিষ্কার করেছিলেন বলে? রেডিওঅ্যাক্টিভিটি নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণা করেছিলেন বলে? দু'বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বলে?
মারি কুরি'র মেয়ে ইভ কুরি'র লেখা এই অসামান্য জীবনীগ্রন্থটা পড়ার আগে আমিও নিশ্চয়ই এইসব মামুলি উত্তর দিতাম। কিন্তু বইটা পড়ার পরে আমি বিলকুল হতভম্ব হয়ে গেছি। পরাধীন পোল্যান্ডে জন্ম নেওয়া এই নারী, সেই সময় যাঁর নিজের দেশের কোনো ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের অ্যাডমিশন দেওয়া নিষিদ্ধ ছিলো ; পয়সার অভাবে যাঁকে লোকের বাড়িতে গভর্নেসের কাজ করতে হয়েছে দীর্ঘদিন ; প্যারিসের প্রচণ্ড শীতে যাঁর পরিধানের জন্যে না ছিলো ঠিকঠাক শীতবস্ত্র, খাওয়ার জন্যে না ছিলো যথেষ্ট খাদ্য, বসবাসের জন্যে না ছিলো একটা ভদ্রস্থ ঘর ; তবুও যখন বইয়ের শেষের দিকে জানতে পারি : “মাদাম কুরি, বৈজ্ঞানিক, ফ্রান্স”— এইটুকু ঠিকানা লিখে পাঠালেই তাঁর কাছে চিঠি পৌঁছে যেত, তখন মনে হয়, একটা কিংবা দুটো কিংবা তিনটে কিংবা চারটে কিংবা দশটা কিংবা কুড়িটা পয়েন্টের একটা লম্বাচওড়া লিস্ট বানিয়ে মারি কুরি'র সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়।
এত বিচিত্র, বহুমুখী এবং অকল্পনীয় পথে তাঁর চরিত্র এবং জীবন ধাবিত হয়েছিল যে, এই রিভিউটা লিখতে বসে আমি কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবো, কীভাবে অল্প কয়েকটা কথায় এই মানবীর পরিচয় দেবো বুঝতে পারছি না। Superwoman. শুধুমাত্র এই একটা শব্দ লিখেই তাঁর পরিচয় দেবার কাজটা সেরে ফেলা যেত, কিন্তু তিনি তো মোটেও Superwoman ছিলেন না। তাঁর মধ্যে আদপেই তো কোনো সুপারপাওয়ার ছিলো না। কর্তব্যের প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা, কাজ করার প্রচণ্ড স্পৃহা, অদম্য জেদ, অদম্য আত্মসম্মানবোধ— এই গুণগুলোকে তো আর “সুপারপাওয়ার” বলা যায়না, তাইনা? যদি বলা হয়, সাধারণ মানুষের চেয়ে তাঁর বুদ্ধি এবং প্রতিভা ছিলো অনেক বেশি, এই কারণেই তিনি এরকম অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তাহলে যুক্তিটা অনেকটা সেরকম হবে, যদি মাউন্ট এভারেস্টের শিখরে ওঠার পরে কাউকে বলা হয় : ওহ, আপনার তো দুটো পা আছে, সেই কারণেই আপনি শিখরে উঠতে পারলেন!
আমি বোঝাতে পারছি কিনা জানিনা, “বিশেষ” কোনো মহাজাগতিক গুণের অধিকারী ছিলেন না মারি কুরি, তবুও তিনি বিজ্ঞানজগতের শিখরে উঠতে পেরেছিলেন, এই বিষয়টা বুঝতে পেরেই আমার এই হতভম্ব অবস্থা। তাহলে ম্যাজিকটা লুকিয়ে আছে কোথায়? কিছু তো একটা ব্যাপার আছে যে-কারণে তিনি একজন অসামান্য মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আচ্ছা বেশ, কারণগুলো আরেকবার বলি তাহলে? কর্তব্যের প্রতি অপরিসীম নিষ্ঠা, কাজ করার প্রচণ্ড স্পৃহা, অদম্য জেদ, অদম্য আত্মসম্মানবোধ। সত্যি বলছি, তাঁর জীবনী পড়ে অনেক খুঁজেও, অনেক ভেবেও, আমি অন্য কোনও স্পেশাল কারণ আবিষ্কার করতে পারিনি!
আমার মধ্যে যা আছে, আমার মাথায় যতটুকু বুদ্ধি আছে, যতটুকু সুযোগ আমি পেয়েছি, কেবল এইগুলো কাজে লাগিয়েই আমি অনেক কিছু করতে পারি। দরকার নেই প্রচণ্ড বুদ্ধিমান হওয়ার। দরকার নেই প্রভূত সুযোগ পাওয়ার। এই উপলব্ধিটাই মারি কুরি'র জীবন থেকে আমার সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। এই কারণেই তিনি শুধু বিংশ শতাব্দীর নয়, গোটা ইতিহাসের সবচেয়ে আইকনিক নারীদের মধ্যে... না না, ভুল বললাম! জীবনে কখনও, কোনোদিন, নারী হওয়ার জন্যে আফসোস কিংবা উদযাপন করেননি তিনি, তাই তাঁকে শুধু “আইকনিক নারী” বললে তাঁর জীবনদর্শনের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। তিনি ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আইকনিক মানুষদের মধ্যে একজন।
নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্রটার সন্ধানও দিয়েছেন তিনি। মারি কুরি'র সেই অস্ত্রটা তাঁর জীবনের মতোই সাদামাটা, গ্ল্যামারহীন, কিন্তু কার্যকরী। অস্ত্রটার নাম : কাজ (তাঁর ক্ষেত্রে গবেষণার কাজ)। তাঁর যোগ্য সহকর্মী এবং জীবনসঙ্গী, অকালপ্রয়াত পিয়ের কুরি'র একটা কথা তিনি আজীবন মনে রেখেছেন : “যদি প্রাণটাও চলে যাওয়ার উপক্রম হয়, তবুও কাজ বন্ধ করা যাবে না।” শুধু পুরুষতন্ত্র নয়, সামাজিক বাধাবিপত্তি কিংবা অনিবার্য দুর্ভাগ্যের বিরুদ্ধেও মারি কুরি শুধু একটাই অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। কাজ করে যাওয়া। কাজ করে যাওয়া। আর কাজ করে যাওয়া।
আরো একটা অসাধারণ চারিত্রিক গুণ ছিলো তাঁর, যেটার কথা আলাদা করে বলা দরকার। আমি বরং বই থেকে একটা ঘটনার কথা হুবহু লিখে দিই, তাহলে ভালো বোঝা যাবে। রেডিয়াম একটি মহামূল্যবান মৌলপদার্থ। ১৯২০ সালে এক গ্রাম রেডিয়ামের দাম ছিলো এক লক্ষ ডলার। একজন আমেরিকান সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন :
- আপনার কাছে কতোটুকু রেডিয়াম আছে?
- আমার ল্যাবরেটরিতে এক গ্রামের বেশি নেই।
- আপনার কাছে মাত্র এক গ্রাম আছে?
- আমার? ওঃ, আমার তো কিছু নেই। আমার ল্যাবরেটরির জিনিস ওটা।
- আমি স্বত্বাধিকার অনুযায়ী প্রাপ্য অর্থের কথা বললাম। আপনি তো প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে পারতেন।
শান্ত স্বরে তিনি জবাব দিলেন : কারুর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করা রেডিয়ামের কাজ নয়। রেডিয়াম একটা মৌলিক পদার্থ মাত্র। তার উপর সবার সমান অধিকার।
আরো আগে, আরো অনেক আগে এই বইটা পড়লে হয়তো আরেকটু অন্যরকম হতো জীবনটা!
পোল্যান্ডের সাংবাদিক রিশার্দ কাপুশচিনস্কি'র লেখা [b:Shah of Shahs 244617 Shah of Shahs Ryszard Kapuściński https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1348782441l/244617.SY75.jpg 58070] বইটা পড়ে আমি ১৯৭৮/৭৯ সালে ইরানের ইসলামি গণবিপ্লবের ব্যাপারে প্রথমবার বিশদে জানতে পারি। রেজা শাহ পাহ্লাভি নামের একজন ভুয়া সম্রাটকে ইরানের মানুষ দেশ থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে সেই দেশে কায়েম হয়েছিল আয়াতুল্লাহ খোমেইনি নামের একজন গোঁড়া ধর্মগুরুর শাসনব্যবস্থা। ইরানে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল “ইসলামি প্রজাতন্ত্র” নামক একটি কাঁঠালের আমসত্ত্ব। রেজা শাহের আমলে হরেকরকম দুর্ভোগ ছিলো, সত্যি কথা। কিন্তু এই নবগঠিত ইসলামি আমসত্ত্বে ইরানের মানুষকে আধুনিক যুগ থেকে প্রায় মধ্যযুগে ট্রান্সপোর্ট করা হয়েছিল। ধর্মীয় শাসনের নামে নানারকম জোরজুলুমে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলো (এখনও হচ্ছে) সেই দেশের সাধারণ মহিলাদের জীবন। কাপুশচিনস্কি তাঁর বইতে ইরানে ইসলামি প্রজাতন্ত্র গঠিত হওয়া পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন। “পার্সেপোলিস” নামের এই গ্রাফিক বইটি পড়ার পিছনে আমার উদ্দেশ্য ছিলো, ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন পরিস্থিতির ব্যাপারে জানতে পারা।বইটির লেখিকা (এবং একইসঙ্গে অলংকরণ-শিল্পী) মারজান স্যাতরাপি তাঁর বইতে ইরানের সর্বস্তরের মহিলাদের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেননি। এটা এই বইয়ের সবচেয়ে প্রসংশনীয় দিক। পারিবারিকভাবে স্যাতরাপিরা ছিলেন ইরানের প্রকৃত রাজবংশের বংশধর (যে-রাজবংশের রাজাকে উৎখাত করে রেজা শাহ পাহ্লাভির বাবা নিজেকে নতুন রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন)। লেখিকার বাবা-মা দুজনেই ছিলেন শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক এবং মুক্তচেতনার মানুষ। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দমবন্ধ করা পরিবেশেও তাঁরা নিজেদের একমাত্র মেয়েকে যতটা সম্ভব স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র চিন্তাভাবনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। বইটির ভূমিকায় লেখিকা লিখেছেন, ইরানের প্রাচীন এবং মহান সভ্যতার ব্যাপারে আজকাল কেউ আলোচনা করে না। ইরানের প্রসঙ্গ উঠলেই সবার মুখে শুধু ইসলামি মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা এবং সন্ত্রাসবাদের কথা উঠে আসে। ইরানের ব্যাপারে মানুষের এই ত্রুটিপূর্ণ ধারণাগুলোকে সংশোধন করাই হচ্ছে এই বইটা লেখার সবচেয়ে বড়ো প্রেরণা। পুরো বইটা পড়ার পরে আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, আধুনিক ইরানের দেশজ সংস্কৃতি কিংবা ঐতিহ্যের ব্যাপারে এই বইটা থেকে আমি কিচ্ছু জানতে পারিনি। ইরানের একটি উচ্চমধ্যবিত্ত এবং সুরক্ষিত পরিবারের একমাত্র আদরের সন্তানের নিছক ব্যক্তিগত আত্মকথা এটা। একটা মাঝারি মানের “কামিং অফ এইজ” গোত্রের কাহিনি। এর চেয়ে খুব বেশি কিছু নয়।বইটির বিষয়গত ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে যদি ইরানের গোঁড়া ইসলামি পরিবেশ এবং যুদ্ধবিগ্রহকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তাহলে কী পড়ে থাকে? পড়ে থাকে সচ্ছল পরিবারের একটি অল্পবয়েসি মেয়ের কথা, যার জীবনের সবচেয়ে বড় “স্ট্রাগল” ছিলো এটাই যে, বাড়ির বাইরে বেরোলে তাকে মাথায় কাপড় ঢেকে বেরোতে হবে। বইটির ভূমিকাতে তিনি ইরানের সংস্কৃতির ব্যাপারে পাঠককে অবহিত করবেন এমনটা দাবি করলেও, গোটা বই জুড়ে তিনি শুনে গেলেন কিম ওয়াইল্ডের পপ এবং আয়রন মেইডেনের হেভি মেটাল সংগীত। নিজের মাতৃভাষার থেকেও ফরাসি ভাষার চর্চা করেছেন বেশি। দেশের এই শোচনীয় অবস্থাতেও তাঁর বাবা মূল্যবান ক্যাডিল্যাক গাড়ি চালাচ্ছেন, লেখিকা নিজেই স্বীকার করেছেন, এই কথা চিন্তা করে তাঁর লজ্জা লাগতো। গোটা বইতে আমি ইরানের একজনও সাধারণ আমজনতার দেখা পাইনি। কিংবা তাদের গলার আওয়াজ শুনিনি। ইসলামি গণআন্দোলনের সময়, লেখিকা দেখিয়েছেন, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে মূল বিরোধিতার কাজটি করেছিলেন সেই দেশের শিক্ষিত পরিশীলিত কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন মানুষরা। বিক্ষোভ-বিপ্লব করেছেন মূলত তারাই, জেলে বন্দী হয়েছেন তারাই, অত্যাচারিত হয়েছেন তারাই। কথাটা কি সত্যি? না তো! এটা তো সত্যি কথা নয়। কাপুশচিনস্কি'র বইটা পড়লে খুব ভালোভাবেই জানতে পারা যায়, সম্রাটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিলেন সেই দেশের আমজনতা। সাধারণ খেটেখাওয়া ধর্মভীরু মানুষরা। অশিক্ষিত অভুক্ত মানুষরা। রাজতন্ত্র থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে ইরানের সাধারণ মানুষ নিজেদের ইচ্ছায় দেশে ধর্মতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজতন্ত্র থেকে দেশকে মুক্ত করে একজন ধর্মগুরুর হাতে নাকি দেশের শাসনব্যবস্থা অর্পণ করেছেন কমিউনিস্টরা। শুনে হাসবো নাকি কাঁদবো?এই ধর্মতন্ত্রের নিপীড়ন থেকে নিজেদের মেয়েকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে লেখিকাকে ইয়োরোপে (অস্ট্রিয়াতে) পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা, পড়াশুনা করার জন্যে। সেই ইয়োরোপ-অধ্যায়ে লেখিকা যে-জীবনটি যাপন করেছেন, তাকেও কি কেউ “স্ট্রাগল” বলবেন? বাপ-মায়ের টাকায় তিনি উদ্দাম পার্টি করেছেন, নেশাভাং করেছেন, বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ব্রেকআপ হওয়ার পরে তিনমাস ধরে (হ্যাঁ, তিনমাস) মনের দুঃখে রাস্তায় রাস্তায় (আক্ষরিক ভাবেই রাস্তায় রাস্তায়, পার্কের বেঞ্চে, ট্রামের কামরায়) ঘুরে বেড়িয়েছেন। এবং একটা সময়ে, সমস্ত টাকাপয়সা ফুঁকে দেওয়ার পরে, শরীরের অবস্থাও যখন বেহাল, তখন ঘরের মেয়ে আবার ঘরে ফিরে গেছেন। হ্যাঁ, নিজের জীবনের এই অপদার্থতার কথাগুলো খুব সততার সঙ্গে বর্ণনা করেছেন লেখিকা। বইটির কিছু মূল্য যদি থেকে থাকে, তাহলে এটাই। কিন্তু, এটা ছাড়া লেখিকার আর কী-বা করার ছিলো? ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ে ইরানের সাধারণ মানুষ যখন অকল্পনীয় কষ্টের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন, লেখিকা তখন ইয়োরোপের শপিংমলে শপিং করতে করতে হাঁফিয়ে যাচ্ছেন। সেই যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছিল, সেইসব মানুষদের নামে রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে দেখে তিনি বিরক্ত হচ্ছেন। বিদেশে থাকার সময়, যুদ্ধে বিধ্বস্ত স্বদেশের কোনো খবর তিনি রাখেননি। দেশে ফিরে আসার পরে বাবার কাছ থেকে “পোস্ট-ম্যাচ হাইলাইট” শুনেছেন। সুতরাং বইয়ের বিষয়বস্তু হিসেবে যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি নাকি আমাদের ইরানের কথা শোনাবেন, তার বদলে নিজের এই “স্ট্রাগল পরিপূর্ণ” জীবনের সৎ উপাদান ছাড়া সত্যিই তো লেখিকার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আর কিছু ছিলো না!কিন্তু সচ্ছল পরিবারের বখে যাওয়া একটি মেয়ের এই “এগজিস্টেনশিয়াল ক্রাইসিস” (আসলে দায়দায়িত্বহীন অপকর্ম)-এর কাহিনি জানার জন্যে এই বইটা পড়ার কথা ভাবিনি আমি। মেয়েদের এর চেয়েও নিদারুণ দুরবস্থা এবং “সত্যিকারের স্ট্রাগল”-এর দগদগে চিহ্ন ইরানের পথেঘাটে পাড়ায়-মহল্লায় ছড়িয়ে আছে। এই মেয়েরা নিজেদের মানসিক ডিপ্রেশন থেকে একটু হালকা হওয়ার জন্যে শৌখিন স্কি-ভ্যাকেশনে যাওয়ার সুযোগ পায়না। ধর্মীয় অত্যাচার থেকে বাঁচতে বিদেশে পালানোর সুযোগের কথা তো এরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। মস্ত বড়ো আইরনির কথা হলো, এই বইতে লেখিকা নিজেকে একজন “তৃতীয় বিশ্বের মেয়ে” হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। বাপের টাকায় অস্ট্রিয়ার নিষিদ্ধ ক্যাফেতে বসে ফরাসি প্রেমিকের সঙ্গে গাঁজা টানতে টানতে...যে-জিনিসগুলো বইটার থেকে আশা করেছিলাম, এবং লেখিকা নিজেও যে-বিষয়গুলো আমাকে জানাবেন বলে কথা দিয়েছিলেন, দুটোই অপূর্ণ রয়ে গেছে। বইটির অলংকরণ খুবই উচ্চমানের এবং বুদ্ধিদীপ্ত। রেটিংয়ের তিনটে তারার মধ্যে দুটো তারা অলংকরণের কারণেই দিয়েছি। বইয়ের পিছনের মলাটে Sunday Telegraph পত্রিকা সার্টিফিকেট দিয়েছে : “Persepolis is a stylish, clever and moving weapon of mass destruction.” এই সার্টিফিকেটে শুধু “stylish” শব্দটা সত্যি। বাদবাকিটা আসলে বিপদের মুখোমুখি হওয়ার নাম করে বারবার বিপদ থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটা ছাপোষা গল্প। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, সমসাময়িক যেকোনো “সাধারণ” পরিবারের একজন ইরানি মেয়ে, মারজান স্যাতরাপির এই “ট্র্যাজিক” (এই শব্দটাও বইয়ের মলাটে ব্যবহার করা হয়েছে) জীবনকাহিনি শুনে কী মন্তব্য করবেন!“Freedom makes a huge requirement of every human being. With freedom comes responsibility. For the person who is unwilling to grow up, the person who does not want to carry his own weight, this is a frightening prospect.” (Eleanor Roosevelt)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন পুরোদমে চলছে। প্রায় গোটা পৃথিবী মেতে আছে অভূতপূর্ব ধ্বংসলীলায়। অমর্ত্য সেন সেই সময় মাত্র বছর-দশেকের একজন বালক। পুরোনো ঢাকায় নিজের পৈতৃক বাড়ি এবং ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের সেইন্ট গ্রিগোরি স্কুল ত্যাগ করে (মূলত যুদ্ধের কারণেই) শান্তিনিকেতনের স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছেন। বসবাস করছিলেন তাঁর দাদু-দিদিমার সঙ্গে (দাদু ছিলেন প্রবাদপ্রতিম পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সরাসরি কোনো প্রভাব তখনও শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছায়নি।
১৯৪৩ সালের বসন্তকালে, বছরের যে-সময়টাতে সাধারণত শান্তিনিকেতনে উৎসবের মরশুম চলে, হঠাৎ একদিন সেখানে একজন পাগলের উদয় হলো। অপ্রকৃতিস্থ উন্মাদ একজন মানুষ। ছেলেছোকরাদের যেমন কাজ, তারা সেই পাগলকে উত্যক্ত করতে শুরু করলো। খোঁজখবর নিয়ে জানা গ্যালো, মানুষটা আদপে পাগল নন। একমাসেরও বেশি সময় তিনি অভুক্ত অবস্থায় রয়েছেন। দীর্ঘদিন আহারের অভাবে সাময়িক মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে তাঁর। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সঙ্গে এভাবেই প্রথম প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটেছিলো অমর্ত্য সেনের।
এই একটি ঘটনা অমর্ত্যের ভবিষ্যত জীবন এবং চিন্তাভাবনার মূল লক্ষ্যটি নির্ধারণ করে দিয়েছিলো। অমর্ত্য সেনের এই আত্মজীবনী আর-পাঁচটা আত্মজীবনীর চেয়ে অনেকটাই আলাদা। অনেক পাঠক হয়তো একে আত্মজীবনী বলেই মানতে চাইবেন না (কিংবা পড়ার পরে হতাশ হবেন)। এই বইতে, পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের “গোপন” বৃত্তান্ত, অথবা স্বীকারোক্তিমূলক সাহসী আত্মউন্মোচন করার কাজ থেকে বিরত থেকেছেন তিনি। নিজের পরম ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যক্তিগতই রেখেছেন। কোনও চমকপ্রদ এবং উত্তেজক তথ্যই যদি না-পাওয়া গ্যালো তাহলে এই আত্মজীবনী পাঠ করে আমাদের লাভ কী?
১৭৭৬ সালে অ্যাডাম স্মিথের লেখা সুবিখ্যাত “Wealth of Nations” বইটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে, তাত্ত্বিকভাবে “ক্লাসিকাল অর্থনীতি”র ভিত্তি স্থাপন করা হয়। আবহমানকাল ধরে চলে আসতে থাকা রাজতান্ত্রিক এবং জমিদারতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেয়ে ইয়োরোপের মানুষ তখন বাজারতান্ত্রিক পুঁজিবাদী অর্থনীতি বা market capitalism-কে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল।
এই নতুন ধরণের অর্থনীতির প্রাণভোমরা ছিলো “পুঁজি”, অর্থাৎ ক্যাপিটাল। এই অর্থনীতির উদ্দেশ্য ছিলো বাজারের চাহিদা (demand) এবং যোগান (supply)— এই দুই অবস্থার মধ্যে সহাবস্থান বজায় রাখা। মোদ্দা হিসেবে একেই বলে “ক্লাসিকাল অর্থনীতি”। কিন্তু বিংশ শতকের শুরুতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়াবহ একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতির আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়।
আমরা সবাই জানি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯১৯ সালে, “ভার্সাই চুক্তি” নামের একটা বালখিল্য ব্যবস্থার দ্বারা যুদ্ধের সমস্ত দায়ভার জার্মানির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই অপমানজনক চুক্তির পরিণতি ছিলো সুদূরপ্রসারী এবং এই চুক্তি ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে বিধ্বংসী সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন দেখা গ্যালো, অর্থনৈতিক জগৎ দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে।
একটা ভাগে ক্যাপিটালিস্ট বাজারনির্ভর অর্থনীতির মূল তত্ত্বগুলোকে সামান্য পরিবর্তন করে নিয়ে নাম দেওয়া হলো নিও-ক্লাসিকাল বা নব্য-ক্লাসিকাল অর্থনীতি। আরেক ভাগে বলা হলো, “পয়সার জোর যার, বাজার তার”— ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতির এই অবধারিত নিয়মটা সমাজে মারাত্মক অসাম্য তৈরি করেছে। বড়লোক মালিক আর গরীব কর্মচারীর মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং ক্যাপিটালিস্ট অর্থনীতির বিকল্প হিসেবে সমাজতান্ত্রিক (সোশ্যালিস্ট) অর্থনীতিকে মান্যতা দেওয়া হলো।
এই সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়মকানুনের মুখ্য প্রণেতা যে ছিলেন কার্ল হেইনরিখ মার্ক্স নামের একজন লন্ডনপ্রবাসী জার্মান ভদ্রলোক, এই কথাটা আলাদা করে না বললেও চলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, গত শতকের একটা বড়ো সময়জুড়ে বাজারতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি— এই দুই নীতির তাত্ত্বিকরা পরস্পরের মধ্যে হাতাহাতি করে কাটিয়েছেন। হাতাহাতিতে কারও জয়লাভ হয়নি বটে, কিন্তু একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার বোঝা গেছে।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হলো, এই দুই অর্থনীতির কোনোটাই সাধারণ মানুষকে গুরুত্ব দ্যায় না। সাধারণ মানুষ মানে আপনি, আমি, এবং আমাদের মতো গুরুত্বহীন মানুষশাবকের দল। ক্যাপিটালিজম চায় বড়লোকরা আরো বড়লোক হোক। বাজারের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাক। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চায় গভর্নমেন্টের হস্তক্ষেপে দেশের সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন হোক (“উন্নয়ন” শব্দটা শুনলে আমার আজকাল ভয় লাগে)। ধনী-গরীব ভেদাভেদ ঘুচে যাক। কিন্তু সোশ্যালিস্ট অর্থনীতিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বিশেষ মূল্য নেই! এখানেই প্রশ্ন ওঠে, আমি কী চাই? দেশের উন্নতি হলে আমার কী ঘোড়ার ডিম হবে?
এইখানে অনেকে বলবেন, এটা একটা কথা হলো? দেশের উন্নতি হলে তো সেই দেশের মানুষেরও উন্নতি হবে। আচ্ছা সত্যিই কি তাই? উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ভারতের সামগ্রিক GDP বৃদ্ধি পেলে কিংবা সরকারি হিসেব অনুযায়ী মানুষের গড় আয় বৃদ্ধি পেলেই কি ধরে নিতে হবে যে দেশের সকল মানুষের মধ্যে সম্পদের সমান-সমান বণ্টন হয়েছে? দেশের সব মানুষ একইরকম সুবিধে ভোগ করছে? এই বিষয়টা নিয়ে নতুন করে তর্ক করার প্রয়োজন নেই, কারণ রাষ্ট্রের GDP'র হিসেব আর রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের জীবনযাপনের অবস্থার মধ্যে যে অনেক ফারাক আছে, সেটা এখন একটা শিশুও বুঝে গেছে।
এই দুইরকম প্রচলিত অর্থব্যবস্থার পাশাপাশি, ধীরে ধীরে উঠে এসেছে তৃতীয় একটি বিকল্প। অমর্ত্য সেন যখন অর্থনীতি নিয়ে পড়াশুনা করার জন্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে এই তৃতীয় বিকল্পটি নিয়ে তাত্ত্বিক অর্থনীতিবিদরা চিন্তাভাবনা শুরু করেছিলেন। গত শতকের তিরিশের দশকে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সময়ে, জন মেইনার্ড কেইন্স নামের একজন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এই তৃতীয় বিকল্পটির বীজ বপন করেছিলেন।
বিলেত যাওয়ার আগে, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশুনা করার সময় থেকেই অমর্ত্য সেন এই বিকল্প তত্ত্বটির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছিলেন, বইপত্র পড়েছিলেন। আত্মজীবনীতে তিনি নিজেই মন্তব্য করেছেন, কলকাতায় ছাত্রাবস্থায় তাঁর চিন্তাজগতের নায়ক ছিলেন ইতালীয় অর্থনীতিবিদ পিয়েরো স্রাফা (Piero Sraffa)। এই স্রাফা ছিলেন জন মেইনার্ড কেইন্সের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কেমব্রিজে পড়াশুনা করতে গিয়ে অমর্ত্য সেন পিয়েরো স্রাফাকেই নিজের অ্যাকাডেমিক তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পেলেন। কেমন সৌভাগ্যের কথা!
নিজের এই সৌভাগ্যকে অমর্ত্য সেন পুরোদস্তুর কাজে লাগিয়েছিলেন। আমি এর আগেও অমর্ত্য সেনের বিভিন্ন লেখাতে পড়েছি, তিনি বাঙালির আড্ডা-আলোচনা-তর্ক-বিতর্কের জাতিগত স্বভাবটিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে থাকেন। তর্কবিতর্ক বা argument হলো ভারতের চিরাচরিত দার্শনিক বিচার ও শিক্ষাপদ্ধতির একটি সুপ্রাচীন প্রকরণ। বইতে অসংখ্যবার তিনি উল্লেখ করেছেন, জীবনের শুরুতে শান্তিনিকেতনে এবং তারপর কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস এবং অন্যান্য আড্ডার আসরগুলো তাঁর নিজের বুদ্ধিমত্তা এবং চিন্তাক্ষমতার বিকাশে কতটা অবদান রেখেছিল।
কেমব্রিজে পড়াশুনা করতে গিয়েও তিনি সমগোত্রীয় একটি সুস্থ বিতর্কের পরিবেশ লাভ করেছিলেন। যেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত মতবাদের মানুষরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় মগ্ন হন— শুধুই তর্কে জয়লাভ করার উদ্দেশ্যে নয়— বরং তাঁদের নিজস্ব ধারণাকে আরো প্রখর করে তোলার উদ্দেশ্যে। নতুন কিছু শেখার উদ্দেশ্যে। এই আড্ডা-আলোচনার প্রসঙ্গেই অমর্ত্য সেন শুনিয়েছেন তাঁর শিক্ষা এবং কর্মজীবনের অগণিত শিক্ষক, বন্ধু, সহপাঠী এবং ছাত্রদের বৃত্তান্ত। তাঁদের বিচিত্র চিন্তাভাবনার কথা। এটাই অমর্ত্য সেনের এই আত্মজীবনীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
বইটি পড়তে পড়তে আমার বারবার মনে হয়েছে, মুক্ত, উদার এবং গঠনমূলক আলোচনার সেই লোভনীয় জগৎটা আজ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। বদলে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায় troll, meme, status, tweet, post-ভিত্তিক একটা অসুস্থ, অগভীর এবং চটকদার চিন্তাব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় যে যতো বেশি তাৎক্ষণিক চটক বিতরণ করতে পারে, যে যতো বেশি মানুষকে আঘাত দিতে পারে, বাঁকা কথা বলতে পারে, সে তত like কিংবা ফলোয়ার লাভ করে (এবং এতেই তাদের মোক্ষলাভ ঘটে)। আমরা এখন চিন্তার “আদান-প্রদান” করিনা, শুধুই “প্রদান” করি। এবং আমাদের নিজের মতামতের সঙ্গে যাদের মতের মিল হয়না, তৎক্ষণাৎ তাদের গর্দান নিয়ে নিই। I am so cool and the rest is fool. সবকিছুই অবশ্য কম্পিউটার কিংবা মোবাইলের স্ক্রিনের পিছনে মুখ লুকিয়ে করা হয়।
যাই হোক, এই বইটির আরেকটা বড়ো প্রাপ্তি হলো, অর্থনীতির সেই তৃতীয় বিকল্পটি যখন ধীরে ধীরে মূলস্রোতে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করছে, সেই সময়টার এবং সেই পরিবেশটার প্রত্যক্ষ বিবরণ দিয়েছেন অমর্ত্য সেন। তিনি নিজেও সেই তৃতীয় বিকল্পটির সঙ্গে নিজের চিন্তা এবং কর্মজীবনকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন। তৃতীয় বিকল্পটির নাম : “কল্যাণমূলক অর্থনীতি” (welfare economics)। এই অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হলো, এতে পুঁজি, বাজার, উন্নয়ন, রাষ্ট্র, মুনাফা, এইসবকিছুর বাইরেও আরেকটা বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, তার নাম - মানুষ। মানুষ মানে শুধুই গোটা মানবসমাজ নয়, একজন একক ব্যক্তিমানুষকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। “A stupid common man!”
গোটা সমাজ কী চাইছে, ক্যানো চাইছে, কীভাবে আচরণ করছে— তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ একজন একক মানুষ কী চাইছে, ক্যানো চাইছে, কীভাবে আচরণ করছে। কারণ আমাদের প্রত্যেকের অনেকগুলো আলাদা আলাদা পরিচয় আছে। এবং প্রতিটা পরিচয়ের স্বতন্ত্র মূল্য আছে। আপনি একইসঙ্গে একজন বাঙালি, হিন্দু, মেয়ে, গ্র্যাজুয়েট, বেকার, কবি, অমুকের প্রেমিকা, অমুকের ভগিনী, তমুকের কন্যা, সমকামী, ঈশ্বরবিশ্বাসী এবং আর্জেন্টিনা ফুটবল টিমের সমর্থক হতে পারেন (পরিচয়ের সংখ্যা আরো অনেক বাড়তে পারে)। অন্য কেউ না-বুঝুক, আপনি জানেন, আপনার কাছে এই প্রতিটি পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সমগ্র জীবন, আপনার কাজকর্ম, আপনার সিদ্ধান্ত, আপনার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতকে চালনা করছে আপনার এই পরিচয়গুলো। এগুলো একটাও বাদ দেওয়া যাবে না।
অর্থনীতির উপর মানুষের এই স্বতন্ত্র ব্যক্তিপরিচিতি এবং ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ কীভাবে প্রভাব ফ্যালে? খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে, এটাই ছিল অমর্ত্য সেনের মৌলিক গবেষণার বিষয়। যেখানে একটা দেশের মানুষের সামগ্রিক পছন্দ-অপছন্দের হিসেবনিকেশ করাই একটা মুশকিলের ব্যাপার, সেখানে মাত্র একজন মানুষকে ক্যানো গুরুত্ব দেওয়া হবে? কারণ, গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এটাই কল্যাণমূলক অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য।
মানুষের এই ভিন্ন-ভিন্ন পরিচয়গুলোকে যখন আলাদা-আলাদাভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়না, তখনই আমরা কাউকে “সে একজন মুসলমান” কিংবা “সে একজন ভারতীয়” কিংবা “সে একজন নাস্তিক” কিংবা “সে একজন নিরামিষাশী” কিংবা “সে একজন ব্রাজিল ফুটবল দলের সমর্থক”— এইরকম ভাঙাচোরা পরিচয়ে ডাকতে শুরু করি। ডাকলেও অসুবিধে নেই, অসুবিধে হলো, তাদের ভাঙাচোরাভাবে বিচার করতে শুরু করি। তখনই শুরু হয় ঝামেলা। তখনই আমরা আক্রমণাত্মক হয়ে যাই। তখনই আমরা ক্ষুদ্র হয়ে যাই। তখনই আমরা “holier than thou” হয়ে যাই। তখনই আমরা বলি : লোকটা নামাজ পড়ছে, তার মানেই ব্যাটা মুসলমান। আর মুসলমান মানেই... সে শুধুই মুসলমান। তার আর কোনও পরিচয় নেই! আর কোনো সত্তা নেই! কিচ্ছু নেই! গোটা মানুষটার বাকি সব পরিচয় তখন উবে গেছে। রয়ে গেছে শুধু একটা শব্দ। “মুসলমান”।
এই বিচ্ছিরিরকমের বড়ো একটা রিভিউ লিখেও, অত্যন্ত সুলিখিত এই বইটির সম্পূর্ণ পরিচয় দিতে পারলাম না। ব্যক্তিগতভাবে এই বইটি পড়ার পরে আমি ভীষণরকম সমৃদ্ধ হয়েছি। আমার চিন্তা মার্জিত হয়েছে। অর্থনীতি আমার অন্যতম একটি আগ্রহের বিষয়। অমর্ত্য সেনের চিন্তা এবং কাজকেও আমি অনেকদিন যাবৎ জানার চেষ্টা করে আসছি। একটা হারিয়ে যাওয়া সময়, একটা হারিয়ে যাওয়া জগৎ, কয়েকজন হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বল মানুষ এবং তাঁদের চিন্তাভাবনা এবং আজকের এই জটিল উদ্ভট সময়ের মধ্যে একটা মিসিং লিঙ্ক হয়ে থাকবেন অমর্ত্য সেনের মতো ব্যক্তিত্বরা। যাঁদের সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। চারশো পৃষ্ঠার বইতে কারোর প্রতি অসূয়া কিংবা বিদ্বেষ প্রকাশ করেননি তিনি। একবারের জন্যেও “নোবেল পুরস্কার” শব্দটি উচ্চারণ করেননি। পুরো বই জুড়ে ছড়িয়ে ছিলো একটা রসিকতাময় বিদগ্ধ বিনম্র আলো। বইটা শেষ করে খেয়াল হলো, “বিনয়”— এই শব্দটা শুধু বিদ্বান ব্যক্তিদের মানায়। আজকের এই ট্রল, স্ট্যাটাস, রিল, মিম-সংস্কৃতিতে এই গভীর ব্যঞ্জনাময় শব্দটির কোনও জায়গা নেই! জায়গা থাকার কথাও নয়!
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশিবিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথাতুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা—নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।
“যোগাযোগ” পড়া শেষ হলে মনের ভিতর প্রথম যে অনুভূতিটা জেগে উঠেছিল সেটা হলো অতৃপ্তি এবং হতাশা। কাহিনির পরিণতি কেমন হবে তার উপর পাঠকের হাত নেই। পাঠক হলো লেখকের হাতের পুতুল। কিন্তু লেখক নিজেও কি পুরোপুরি স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের জীবন এবং মনের অন্দরমহলে?
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো দ্বিতীয়বার পড়তে গিয়ে (প্রথমবার পড়েছিলাম একেবারে কাঁচা বয়সে) বারবার অনুভব করেছি, সাহিত্যের যে-আঙ্গিকটাতে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাপ্রদীপ সবচেয়ে কম উজ্জ্বল তা হলো উপন্যাস।
এই দ্বিতীয় দফায় তাঁর সবকটা উপন্যাস এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি, তবে অন্তত নৌকাডুবি, শেষের কবিতা এবং চতুরঙ্গ পড়ার পরে মনে মনে নিজেকে নিজে বলেছিলাম : রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস লিখতে পারতেন না। আজকে “যোগাযোগ” শেষ করে, তৃপ্ত হয়েছি বলবো না, তবে চিন্তার খোরাক পেয়েছি অনেক। আমার সব চিন্তাভাবনার কথা এখানে লেখার উপায় নেই। একটা-দুটো লিখি।
তৃতীয় বিশ্বের (বিশেষ করে, ধর্মকণ্টকিত আমাদের এই উপমহাদেশে) মেয়েদের জীবনযন্ত্রণা যে অনেকরকম, এই কথাটা নতুন করে বলার আর কিছু নেই। “যোগাযোগ” উপন্যাসের যিনি নায়িকা, কুমুদিনী (ডাকনাম কুমু)— রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে করলেই তাঁকে দরিদ্র কিংবা নিদেনপক্ষে মধ্যবিত্ত ঘরের “সাধারণ মেয়ে” হিসেবে দেখাতে পারতেন।
সেরকম দেখালেই বরং কুমুর জীবনের প্রতিকূল অবস্থার বর্ণনা দেওয়া সহজ হতো। তাঁর প্রতি ঘটে যাওয়া অবমাননাগুলো “স্বাভাবিক” বলে মনে হতো। গরীব ঘরের মেয়ের আবার মান-অপমান কী? গত শতকের প্রথম দিকে সাধারণ বাঙালি পরিবারের মেয়ে হয়ে জন্মানো ছিলো যেন গতজন্মের মহাপাপের ফল। কিন্তু যোগাযোগের কুমুদিনী “সাধারণ ঘরের সাধারণ মেয়ে” ছিলেন না।
তিনি স্বচ্ছল বনেদি জমিদার পরিবারের (যদিও বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু) ইংরিজি-শিক্ষিত “refined” মানসিকতার মেয়ে। তিনি এসরাজ বাজিয়ে ক্লাসিকাল গান গাইতে পারেন। তিনি ছবি তুলতে পারেন। এমনকি বন্দুক চালাতে পারেন। কুমুর দাদা বিপ্রদাস ছিলেন রবীন্দ্রনাথের জমানার ব্রাহ্মসমাজসুলভ সফিস্টিকেশনের আদর্শ উদাহরণ।
বিপ্রদাস অতীব সুদর্শন এবং অতীব ঈশ্বরবিদ্বেষী। তিনি নারীস্বাধীনতার সমর্থক। তিনি মুক্তচিন্তার অধিকারী। এমন enlightened দাদার আদরের বোন ছিলেন কুমু। কিন্তু সময়ের তুলনায় এতটা প্রাগ্রসর হয়ে থাকা সত্ত্বেও, বাঙালি নারী হয়ে জন্মানোর আবশ্যিক পরিণামগুলো এড়িয়ে যেতে পারেননি তিনি। এই একটা বিশেষ ব্যাপারে, এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ একটা দারুন চালাকি করেছেন!
ইচ্ছা করেই তিনি কুমু চরিত্রটি “অনন্যসাধারণ” রূপে গড়ে তুলেছেন। এই সত্যটা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যে, সমসাময়িক সমাজ এবং আবহমান সংস্কারের কুদৃষ্টি তোমার উপর পড়বেই (কিছু কিছু সংস্কার তো তুমি নিজেই সযত্নে পুষে রেখেছো)। তুমি ফর্সা হও বা কালো (পলিটিক্যাল কারেক্টনেস বজায় রাখার জন্যে যাদের “শ্যামলা”, “চাপা গায়ের রং”, “মাজা গায়ের রং”, “শ্যামবর্ণা”, “উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা” এইসব কাব্যিক নামে ডাকা হয়), তোমার পরিবার ধনী হোক বা হতদরিদ্র, তুমি শিক্ষিত হও বা নিরক্ষর, কুরূপা কিংবা সুরূপা, ছলনাময়ী কিংবা সরলসোজা, বুদ্ধিমতী কিংবা গর্ধব— তুমি যে-ই হও, মেয়ে হয়ে পৃথিবীতে এসেছো মানেই কিছু কিছু আবশ্যিক অপমান এবং অত্যাচার তোমাকে সহ্য করে নিতেই হবে। পালাবার পথ নেই।
কুমুও পালাতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ ইচ্ছে করলেই, পাঠককে খুশি করার জন্যে, তাঁকে পালাতে দিতে পারতেন। “নারীশক্তির জয়”, “নারীচেতনার উদ্বোধন”— এইসব প্রমাণ করে হাততালি কুড়োতে পারতেন। উপন্যাসটা শেষ করে এই কারণেই আমি নিদারুণ হতাশ (এবং কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ) হয়েছিলাম। কিন্তু খানিকক্ষণ চিন্তা করে দেখলাম, পরিবার, পরিবেশ, সময় এবং সমাজের দ্বারা টেনে দেওয়া গণ্ডিকে মেয়েরা আদৌ প্রত্যাখ্যান করতে পারে? কোনোদিন পেরেছে কি?
তখনকার কথা বাদ দিলাম, আজকের দিনেও কি পারে? কেউ কেউ পারে (গণনায় যারা যৎসামান্য), কিন্তু অধিকাংশ মেয়েরা পারে? আজও কি সবাই সাহসী হতে পারে? সবাই কি নিজের ভিতর জাগ্রত করতে পারে তথাকথিত নারীবাদসম্মত মুক্তিচেতনা? রুখে দাঁড়াতে পারে? হতে পারে নির্ভীক? হতে পারে “ব্যতিক্রমী”? হতে পারে “বেপরোয়া বেহায়া অসভ্য নির্লজ্জ মেয়েছেলে”? দৃঢ় কন্ঠে বলতে পারে, “পরোয়া করিনা!”
নাহ, পারে না। যারা পারে, তারা কয়জন? আপনি বলুন দেখি কয়জন? কয়জন “ব্যতিক্রমী” মেয়েকে চেনেন আপনি?
বেশ কিছু গঠনগত ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও “যোগাযোগ” একটি জরুরি উপন্যাস। অনেক বিখ্যাত নারীবাদী উপন্যাসের চেয়ে বেশি বাস্তবসম্মত। কুমুদিনীর অপমান আমার বুকে এসে বেজেছে। সেই অপমানের নিষ্পত্তি করে কুমুদিনী মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেননি, এটা দেখে আমার মাথা নিচু হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কুমুদিনীকে জিতিয়ে দেননি, কারণ কুমুদিনীরা তখনকার দিনেও পরাজিত হতো, আজও পরাজিত হয়। আর পাঠক হিসেবে আমরা অতৃপ্ত কণ্ঠে আফসোস করি : ধুর, গল্পের এন্ডিংটা মনের মতো হলো না!
ছোট হয়ে নেমে পড়ুন মশাইসরু হয়ে নেমে পড়ুন মশাইচোখ নেই ? চোখে দেখতে পান না ?সরু হয়ে যান, ছোট হয়ে যান !আরো কত ছোট হব ঈশ্বর ?ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে !আমি কি নিত্য আমারও সমানসদরে, বাজারে, আড়ালে ?
খুব আশ্চর্যের কথা। হিন্দু ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থগুলো, যেমন রামায়ণ, মহাভারত, প্রাচীনতর পুরাণ গ্রন্থ— কোথাও শ্রীরাধিকার উল্লেখ নেই। রাধার প্রথম দেখা পাওয়া যায় অনেক পরে, দ্বাদশ শতকে, মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি জয়দেবের সংস্কৃত ভাষায় লেখা “গীতগোবিন্দ” কাব্যে। সুতরাং আমরা কল্পনা করে নিতেই পারি, ঐতিহাসিক না-হোক, এমনকি পৌরাণিক সূত্রেও শ্রীরাধিকার অস্তিত্ব ছিল না। তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে অনেক পরে, কোনো এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। কী উদ্দেশ্যে?
হিন্দু দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হলো ভক্তিবাদ। ভক্তিবাদের মতো একটি সুগভীর দর্শনকে সামান্য কয়েকটা কথায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। শুধু এইটুকু বলা যায়, শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর হিসেবে মেনে নেওয়া সত্ত্বেও, তিনি “একাই একশো” নন। তাঁর মতো দিগ্বিজয়ী মানুষেরও একটা দ্বৈত অথচ বিপরীত সত্তা থাকতে হবে। একটা প্রবল পিছুটান থাকতে হবে। শ্রীরাধিকা হলেন কৃষ্ণের সেই পিছুটান। ভক্তিবাদের এই দারুন দুঃসাহসিক তত্ত্বটি সমগ্র ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের প্রাণ স্পর্শ করেছিল একসময়। রাধাই হলেন শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। “হ্লাদিনী” মানে - আনন্দের উৎস। The fountain of bliss!
বৈষ্ণব পদাবলীতে, যেখানে শ্রীরাধিকার প্রাসঙ্গিকতা এমনকি কৃষ্ণেরও উপরে, সেই পদাবলী সাহিত্য পড়লে বোঝা যায়, পুরুষ হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ হতে পারেন সবচেয়ে উত্তম, কিন্তু তাঁর অস্তিত্বের মূলটি গাঁথা রয়েছে রাধার হৃদয়ে। কানু বিনা যেমন রাই নেই, রাই বিনা তেমনি কানুও অসম্পূর্ণ হয়ে আছেন। তাঁরা দুজন সারাজীবন কাছে থাকতে পারেন নি। তাঁদের প্রেম সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ। তবু বৈষ্ণব সাহিত্যে এই প্রেমকেই সবচেয়ে উঁচুতে জায়গা দেওয়া হয়েছে।
অভিমান, বিরহ, বিষাদ এবং দিগন্ত প্রসারিত প্রতীক্ষারই আরেক নাম দেওয়া হয়েছে “প্রেম”। এই যে বুকফাটা অসহায় তৃষ্ণা, এই শূন্যতার অনুভূতিকেই যুগ যুগ ধরে ব্যক্ত করার চেষ্টা করে এসেছে মানুষ। প্রেমিক মানুষ। ভিখারি মানুষ। রাধাকে বলেছিলেন কৃষ্ণ, আলিঙ্গনও যদি না করো, একবার আমার দিকে না-ও যদি তাকাও, একবার স্পর্শ না করো, তোমার ওই খণ্ডিত চন্দ্রকলার মতো পায়ের নখে অন্তত একবার চুম্বন করতে দিও? ভগবানকে এভাবে ভিখারি বানাতে পারা কম সাহসের কথা নয়!
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।এ ভরা বাদর মাহ ভাদরশূন্য মন্দির মোর।
মহাভারতের সফিস্টিকেটেড কৃষ্ণের সঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলীর এই প্রেমিক কৃষ্ণের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আসামের কামরূপী আঙ্গিকের একটা লোকসংগীত আছে। “ও রে কলঙ্কিনী রাধা, কদম ডালে বসিয়া আছে কানু হারামজাদা, মাঈ তুই জলে না যাইও”। যাঁকে দেবতা বলে স্তুতি করা হয়, সেই দেবতাকেই “হারামজাদা” নামে সম্বোধন করা হয়েছে! দেবতার সঙ্গে এই যে বন্ধুর মতো আচরণ, সমগ্র বৈষ্ণব সাহিত্যের এটাই essence! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এই উপন্যাসে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের এই লৌকিক এবং ক্যাজুয়াল বৈশিষ্ট্যকেই ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন।
পুরোপুরি সফল হননি তিনি। আবহমানকাল ধরে চলে আসা রাধাকৃষ্ণের কাহিনিকে তাঁর স্বকীয় পাকা হা���ে effortlessly প্রকাশ করতে পারেননি তিনি। তবু দুইজন নরনারীর পারস্পরিক প্রণয়ের সর্বগ্রাসী আকুতিকে বেশ খানিকটা দেখাতে পেরেছেন। রাধা আর কৃষ্ণের ব্যতিক্রমী প্রেমের গল্পটা জানার জন্যেও খুব সম্ভবত এই বইটির চেয়ে ভালো উপায় আর নেই। অন্তত বাংলায় বোধহয় নেই। আজকে দোল পূর্ণিমার দিন বিকেলবেলা বইটা পড়া শেষ করে, রাধা আর কৃষ্ণের চিরন্তন বেদনাকে উপলব্ধি করতে করতে মাথায় ঘুরছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের লেখা একটা গানের কয়েকটা লাইন।
ধীরে ধীরে পহুঁছত যমুনা কে তীরসুনসান পনঘট মৃদুল সমীরক্ষণ ক্ষণ মাধব বিরহ মদিরউসে কাহে ভুল না পাও ?মথুরা নগরপতী কাহে তুম গোকুল যাও ?
প্রায় একই কথা ভানুসিংহ ঠাকুরও লিখে গেছেন।
বজাও রে মোহন বাঁশিসারা দিবসক বিরহদহনদুখমরমক তিয়াষ নাশি।রিঝ-মন-ভেদন বাঁশরিবাদনকঁহা শিখলি রে কান ?
তিনি কোথায় শিখেছেন এই বাঁশি বাজানোর কায়দা, তা আমি জানিনা। তবু বাঁশির আওয়াজ যে আজও শোনা যায় এই কথাটা কে অস্বীকার করতে পারে? আগুনের শিখার মতো বিরহের এই গল্পটা এভাবেই চলতে থাকবে যুগ যুগ ব্যাপী। যতদিন মানুষ প্রেমিক থাকবে। যতদিন মানুষ প্রতীক্ষারত থাকবে। যতদিন মানুষ ভিখারি থাকবে।
আর কি কখনো কবে এমন সন্ধ্যা হবে ?জনমের মতো হায় হয়ে গেল হারা।
লীলা মজুমদারের জন্মদিন আজকে। সেই কথা ভেবে রচনাসমগ্র বের করে মাকু'র গল্পটা পড়লাম।
মাকু একজন কলের পুতুল, অর্থাৎ রোবট। সে প্রায় সবকিছুই করতে পারে। কথা বলা, গান গাওয়া, নাচা, অঙ্ক কষা, হাতুড়ি পেটানো, দড়ির জট খোলা, পেরেক ঠোকা, ইস্ত্রি করা, রান্না করা, কাপড় কাচা, সেলাই কল চালানো... সবকিছুই করতে পারে। শুধু দুটো কাজ পারেনা।
হাসতে পারেনা আর কাঁদতে পারেনা।
এই দুটো ভীষণ জরুরি কাজ মাকুকে শেখাতে ভুলে গেছে তার মালিক। সোনা আর টিয়া দুই বোন, ঘটনাচক্রে তারা মাকু'র জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তারপর ঘটতে থাকে নানাবিধ অশৈলী কার্যকলাপ।
অল্পবয়েসি পাঠকদের জন্যে গল্প লিখেছেন, তবু তাঁর গল্পে জীবনের জটিল বিষয়গুলো বাদ দিতেন না লীলা মজুমদার। শিশুরা আসলে সবকিছুই বোঝে। মাঝে মাঝে বড়োদের চেয়েও বেশি বোঝে। এই কারণেই, পাঠকের বয়স বেড়ে গেলেও এইসব গল্পের মজা ফুরোয় না।
এই গল্পটা যদিও বেশ ভালোই লাগলো, কিন্তু কেমন যেন খাপছাড়া এলোমেলো মনে হলো। চরিত্রের সংখ্যা আরেকটু কম হলে ভালো হতো। তবু একটা কথা স্বীকার করতেই হয়, লীলা মজুমদারের মাঝারি মানের লেখাতেও ভালোলাগার অনেক রসদ খুঁজে পাওয়া যায়।
শুভ জন্মদিন, লীলাপিসি!
ও হ্যাঁ বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, এই বইয়ের প্রচ্ছদ আর ভিতরের অলংকরণ করেছেন সত্যজিৎ রায়। প্রচ্ছদটা আমার খুব প্রিয়। বাংলা অক্ষর দিয়ে কেমন সুন্দর মুখের অবয়ব ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ। একেবারে লা-জবাব!
“আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি— পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ! কিন্তু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি।”
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ বক্তৃতা, আশি বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রদত্ত। চল্লিশের দশকের শুরুর সেই সময়ে বাতাসে ভাসছে হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় সংঘাতের বিষবাষ্প, দিগন্তে দেখা দিচ্ছে বিশ্বযুদ্ধ এবং ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেত। তবুও তিনি আস্থা রেখেছেন মানুষের শুভবুদ্ধির উপর। “অপরাজিত” মানুষের উপর।
কবিতার পরেই ছোটগল্প আমার প্রিয় সাহিত্য-আঙ্গিক।
প্রখ্যাত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দোপাধ্যায় পাঁচটা আলাদা খণ্ডে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লেখা ছোটগল্প, পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। এই সংকলনটিকে বাংলা অনুবাদ-সাহিত্যের একটি মাইলস্টোন হিসেবে গণ্য করা হয়। মানবেন্দ্রবাবুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু নবনীতা দেবসেনের লেখা একটি প্রবন্ধ থেকে আমি এই সংকলনটির খোঁজ পেয়েছিলাম। আপাতত প্রথম খণ্ডটা পড়লাম। এবং পড়ে তৃপ্ত হলাম।
প্রথম খণ্ডে মোট এগারোটা গল্প আছে। যার মধ্যে দুটো বিখ্যাত বাংলা গল্প ঠাঁই পেয়েছে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের “দেবী” এবং শিবরাম চক্রবর্তীর “দেবতার জন্ম”। এছাড়াও রয়েছে :
প্রেমচন্দের “সদগতি” (হিন্দি)
ভগবতীচরণ পাণিগ্রাহী'র “শিকার” (উড়িয়া)
ভৈকম মুহাম্মদ বশিরের “প্রেমপত্র” (মালায়ালম)
ইসমাত চুঘতাইয়ের “গুডডির নানি” (উর্দু)
পান্নালাল প্যাটেলের “জায়গিরদার আর তাঁর কুকুর” (গুজরাতি)
কৃষণ চন্দরের “পেশোয়ার এক্সপ্রেস” (উর্দু)
ফণীশ্বরনাথ রেণু'র “তিসরি কসম” (হিন্দি)
গোপীনাথ মোহান্তি'র “পিঁপড়ে” (উড়িয়া)
ইউ আর অনন্তমূর্তি'র “ঘটশ্রাদ্ধ” (কন্নড়)
গল্পগুলো পড়ার পরে দুটো বিষয় গভীরভাবে অনুভূত হলো। এক : প্রকরণ হিসেবে ছোটগল্পকে ক্যানো এতো শক্তিশালী বলে মনে করা হয়। দুই : ভাষা, জীবন এবং সংস্কৃতিগত এতো বৈচিত্র্য সত্ত্বেও ভারতবর্ষের অন্তরালে বয়ে যাচ্ছে একটি সার্বজনীন সুরের ফল্গুধারা। বিভেদের হাজারটা কারণ খুঁজে বের করলেও, জাতধর্ম নির্বিশেষে ভারতবর্ষের সব মানুষের দুঃখ, আনন্দ, ভালোবাসা, যন্ত্রণা, অভিশাপ এবং অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার সংগ্রাম— সর্বত্র একই রকম। গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে একটাই ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ।
অনুবাদের মান খুবই চমৎকার, বলাই বাহুল্য।
এবার দ্বিতীয় খণ্ডের দিকে এগোনো যাক।
আহা, কি দারুন এই কবিতাগুলো!
আজকে সকালে দৈবাৎ পড়ে ফেললাম এদের। শীতকালের অন্তিম এই দিনগুলো আমার খুব পছন্দের। ঠিক যেমন পছন্দ আষাঢ়-শুরুর দিনগুলো। আমার জানলার গোটা বাইরেটা জুড়ে ছড়িয়ে আছে অমলিন নীল আকাশ। একফোঁটা বিষাদ নেই তাতে। নিরানন্দ নেই। নারকেল গাছের ডালে একটা পাখি, উচ্চস্বরে ডাকছে। সে যেন আমার শরীরের শীতমগ্ন কোষে কোষে ছড়িয়ে দিচ্ছে বহু দূর থেকে বয়ে নিয়ে আসা নিরাময়ী স্বপ্নের সওগাত! আমার হাতে কফির কাপ থেকে সুগন্ধী ধোঁয়া উঠছে। আমি খুব ধীরে ধীরে, আয়েশ করে কফিতে চুমুক দেওয়ার মতো ধীরে ধীরে, পড়ছি এই কবিতাগুলো। কি ভালো যে লাগছে মাইরি!
তোমার জন্যে কুড়িয়ে এনেছি কাঁঠাল পাতাপকেট ভরে এনেছি কুড়িয়ে ঘুঘুর ডাক...মাথায় করে এসেছি নিয়ে রাতের চাঁদতোমার জন্যে এসেছি আমি অনেক দূর...কাশের বনে ঘুরতে তোমার ইচ্ছে হয় যদিহৃদয় ভরে এনেছি তাই আশ্বিনের নদী!
দা কালার পার্পল পড়তে শুরু করার আগে স্থির করেছিলাম, নারীবাদী সাহিত্য, কিংবা আফ্রিকান-আমেরিকান সাহিত্য, কিংবা সমকামী সাহিত্য— এইরকম কোনো বিশেষ লেবেলের কথা মাথায় রেখে এই উপন্যাসটা পড়বো না আমি। কালার পার্পল একটা অতি বিখ্যাত, বহুপঠিত এবং সম্মানিত উপন্যাস। পাঠক হিসেবে একে আমি “স্বাভাবিক” উপায়ে গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম। আর পাঁচটা মহৎ সাহিত্য যেভাবে গ্রহণ করে থাকি, সেভাবে। কিন্তু পারলাম না। উপন্যাসের লেখিকা অত সহজে আমাকে রেহাই দিলেন না।
নারীবাদী দর্শন, কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনসংগ্রাম এবং যৌনতা সম্পর্কিত যতরকম variation আছে, মাত্র ২৫০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসে লেখিকা প্রায় সবকিছু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কিচ্ছু বাদ দেননি। শুধু আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের জীবন নিয়ে আলোচনা করেই থেমে যাননি, আফ্রিকায় চলে গেছেন! সেখানকার আদিবাসী কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জীবন, তাদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়েও বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। নারীবাদের সঙ্গে ঈশ্বরচেতনার সংযোগ ঘটিয়েছেন। সমকামিতা, বাই-সেক্সুয়ালিটি, ইনসেস্ট, সবকিছু নিয়ে টানাটানি করেছেন। আরো কতো কিছু যে করেছেন!
গোটা উপন্যাসটা অনেকগুলো চিঠির সমাহারে নির্মাণ করা হয়েছে (“epistolary novel”)। বেশিরভাগ চিঠি যিনি লিখেছেন, তিনি আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের জর্জিয়া রাজ্যের একজন গ্রাম্য স্বল্পশিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে। সেই মেয়েটির মুখের আঞ্চলিক ভাষাতেই চিঠিগুলো লেখা হয়েছে। She happy. Don't nobody come see us. Us mama dead. Soon I gitting marry to him. —এইরকম ভাষায়। Authenticity বজায় রাখার জন্যেই নিশ্চয়ই এই রচনাশৈলী গ্রহণ করেছেন লেখিকা? কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এটা শুধুই চমক সৃষ্টি করার একটা উপায়। ঠিক যেমন চমক সৃষ্টি করার জন্যে আরো বত্রিশ রকম কায়দা করেছেন তিনি। এমনকি, ডুবে যাওয়া জাহাজের মানুষদের কোনোরকম explanation ছাড়াই বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছেন! (মিথ্যা বলছি না!)
এই আরোপিত, কৃত্রিম, চমকসর্বস্ব একটা উপন্যাসকে পুলিৎজার পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। স্পিলবার্গ সিনেমা বানিয়েছেন (এটা অবশ্য খুব অবাক হওয়ার মতো ঘটনা নয়)। ব্রডওয়েতে মিউজিক্যাল অভিনীত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত ষাট লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে বইটা। কিন্তু এইরকম অতিনাটকীয়, অস্বাভাবিক, (কিছু ক্ষেত্রে আপত্তিকর) উপায়ে মানুষের জীবনের সমস্যার সমাধান করা হয় বুঝি? মেয়েদের প্রতি সমাজের চিরাচরিত বঞ্চনাকে নিয়ে, সমকাম নিয়ে, বর্ণবাদ নিয়ে, এই ঠাট্টা না করলে হতো না? কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জীবনের, কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের জীবনের, পৃথিবীর যেকোনো মেয়ের জীবনের, সত্যিকারের এবং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোকে নিয়ে এরকম ফাজলামি না করলে হতো না?
ভুয়া উপন্যাসের ভুয়া আশাবাদ!
.
দামু বেজায় বোকা মানুষ। কেমন বোকা? একবার কে যেন তাকে বলেছিল— দেখে এলাম, আমড়াতলায় তোর ডান কানটা পড়ে আছে। তাই শুনে, নিজের কান পরখ না করেই আমড়াতলায় কান খুঁজতে ছুটেছিল সে।
দামুর চেহারাটাও দেখবার মতো। অন্ধকারে তার দিকে তাকালে মানুষের বুকের রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়। ভূতের ভয়ে তারা রামনাম জপ করতে শুরু করে। কিন্তু ���দপে সে বড্ডো ভালমানুষ। সরল সাধাসিধে মনের দামুকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। কেউই তাকে মূল্য দ্যায় না।
একটা বিশেষ কারণে দামুর একটা হাতির প্রয়োজন হয়। হাতি দিয়ে দামু কী করবে? সেটা তো বলা যাবে না, কিন্তু হাতি একটা দামুর চাই-ই চাই! হাতি না পেলে সে সন্ন্যাসী হয়ে যেতেও রাজি। কিন্তু হাতি জোগাড় করা কি এতই সোজা? হাতি তো আর গরু-ছাগল নয়।
সন্ধ্যেবেলা আমার বোনের বাড়িতে এসেছি লুচি-মাংসের নিমন্ত্রণ খেতে। ঘন্টাদুয়েক সময় ছিল হাতে। বোনের বইয়ের আলমারি থেকে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের “সমগ্র কিশোর সাহিত্য” বের করে পড়ে ফেললাম চমৎকার এই হাতি-সন্ধান কাহিনি।
হাতি জোগাড় করা কি দামুর দ্বারা সম্ভব হবে? অবশ্যই হবে! চিরাচরিত ইচ্ছেপূরণের এই গল্পের ভিতরে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন তাঁর অনবদ্য মনভোলানো ম্যাজিক। ছোট্ট উপন্যাসটা শেষ করে মনে পড়ে গ্যালো— আরে! এই গল্পটা নিয়েই তো পরিচালক রাজা সেন একটা সিনেমা বানিয়েছিলেন। খুব সুন্দর সেই সিনেমার নাম “দামু”। উপন্যাসের নামটাও “দামুর হাতি” হলেই যথার্থ হতো। যাক গে, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার আমি যাই, লুচি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!
.
ভগবদগীতাকে কেবলই একটা “পবিত্র ধর্মগ্রন্থ” হিসেবে গণ্য করলে আমার পক্ষে এই বই পড়া সম্ভব ছিল না। আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি, কিংবা না-করি— এইসব কথা আজকের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক নয়। তাছাড়া, ঈশ্বরে বিশ্বাস করা আর ধর্মের আচার-আচরণ পালন করা, দুটো আলাদা জিনিস। আমার মূল আপত্তি আধুনিক হিন্দুধর্মের আনুষ্ঠানিক এবং নির্দেশমূলক বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, এটা করলে পাপ হবে, ওটা খেলে সর্বনাশ হবে, সেটা না-করলে আমাকে এবং আমার চোদ্দোগুষ্টিকে নরকের ননস্টিক কড়াইতে ডিপ-ফ্রাই করা হবে। তারপর শূলে চড়িয়ে হাল্কা আঁচে শিককাবাব বানানো হবে।
ছোটবেলায় যা-কিছু ধর্মপালন করেছি, যা-কিছু “পাপ-পূণ্য” অর্জন করেছি, সেইসব দায় আমার বাপ-মা'র। তাঁরা যেমন বুঝিয়েছেন, তেমন চলেছি। কিন্তু এখন আমার নিজস্ব অল্পস্বল্প জ্ঞানগম্যি হয়েছে। ডিপ-ফ্রাই হওয়ার ভয়টা কেটেছে। আমার যৎসামান্য জ্ঞান দিয়ে আপাতত আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, গেরুয়া রঙের ধুতি পরে এবং সাদা পৈতা গলায় ঝুলিয়ে ব্যাটা পুরোহিত, ভগবানের ভয় (এবং পুণ্যের লোভ) দেখিয়ে, ধান দুব্বো ফুল বেলপাতা গঙ্গাজল ছুঁড়ে, অং বং চং ঘোড়াড্ডিম মন্তর আউড়ে, ঘণ্টা নাড়িয়ে— স্রেফ আমাকে মুরগি মোরগ বানাচ্ছে। ব্যাটাকে আবার দক্ষিণাও দিতে হবে। ১০১ টাকা ওম্ হরিবোলায় নমঃ!
দর্শন আমার খুব পছন্দের বিষয়। কিন্তু তৃতীয়-বিশ্বের বেশিরভাগ উজবুকের মতো আমার মগজের মাইক্রোচিপে একটা বীজমন্ত্র প্রি-ইনস্টল করা আছে— “গান হোক বা গামছা, সিনেমা হোক বা শিঙ্গাড়া, যাহা কিছু পশ্চিম-বিশ্বের তাহাই পরম উপাদেয়”। তাই প্রাচীনকালের সক্রেটিস থেকে শুরু করে আধুনিক কালের ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত পশ্চিমী বিশ্বের যত্তো বিখ্যাত দার্শনিক আছেন, তাঁদের সমস্ত সিদ্ধান্ত, অনুসিদ্ধান্ত, প্রতিপাদ্য, সম্পাদ্য, গোখাদ্য, ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়ে মোটামুটি কাজ-চালানোর মতো (এবং নিজেকে জাহির করার মতো) আইডিয়া জোগাড় করে ফেলিচি আমি।
কিন্তু কেউ যদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে : সাংখ্য দর্শন কাকে বলে? শূন্যবাদ কী জিনিস? কর্মযোগ বিষয়টা কী? শঙ্করাচার্য কে ছিলেন? — আমি তখন ভীষণ নাক কুঁচকে এবং প্রবল দাড়ি চুলকে জবাব দিই : “হামি টো পিওর নাস্টিক আছি, ম্যান। এই সকল রিলিজিয়াস বুলশিট হামি অট্যন্ট ঘৃণা করি। যডিও হামার গায়ের রং ব্রাউন আছে এবং হামার ফাদারের গায়ের রং আরো বেশি ব্রাউন আছে, কিন্টু মনে মনে হামি পারফেক্ট সাহেবের বাচ্চা আছি! রিয়েল সাহেবডের চেয়েও বেশি খাঁটি সাহেব, হুঁ হুঁ বাওয়া!”
তবু মাঝে মাঝে ভিতরে ভিতরে এট্টু লজ্জা লাগে। উপমহাদেশের মানুষ হয়ে উপমহাদেশীয় দর্শনের ব্যাপারে প্রায় কিসুই জানিনা। বাকি বইপত্তর বাদ দিলাম, গীতাটাও ভালো করে পড়িনি। দোষ যদিও সম্পূর্ণ আমার নয়। আবহমানকাল ধরে আমাদের দেশে দর্শনের সঙ্গে ধর্মকে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অথচ আজকের দিনে প্রচলিত হিন্দুধর্মের আচার বিচার সংস্কার বিশ্বাসের সঙ্গে বেদ-উপনিষদের দার্শনিক বিষয়বস্তুর প্রায় কোনো সম্পর্কই নেই। গোটা মহাভারতে একবারের জন্যেও মূর্তিপূজার উল্লেখ নেই। আরো কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো লিখলে কালকে সকালে আমার বাড়িতে উটকো লোকজন ঝামেলা করতে চলে আসবে এবং আমাদের বাড়ির শান্তিপ্রিয় বিড়ালগুলোকে খামোখা হ্যারাস করবে।
টো হামি গীটা ডিয়েই...
ওহ সরি! তো আমি গীতা দিয়েই প্রাচ্য-দর্শনের চর্চা শুরু করবো ঠিক করলাম। কিন্তু গীতার তো হাজার হাজার সংস্করণ বাজারে পাওয়া যায়। আমার নিজের বাড়িতেই ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে ছোট, মেজো, সেজো, দামড়া— এইরকম বিভিন্ন সাইজের হরেক কিসিমের গীতা রাখা আছে (প্রতিটার উপর একটা করে তুলসিপাতা দেওয়া, তুলসিপাতা অ্যান্টিসেপটিক কিনা)। এর মধ্যে কোনটা পড়বো? বাড়ির গীতাগুলো একটাও পছন্দ হলো না। ওগুলো পুজো করার জন্যেই ঠিক আছে।
পড়বো যখন ভালো করেই পড়তে চাই। বঙ্গানুবাদ, বিশদ টীকা, বিশ্লেষণ সহ। বাড়ির কাছে রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়ে দেখলাম স্বামী রঙ্গনাথানন্দের লেখা তিনখণ্ডের গীতা বিক্রি হচ্ছে। বইটা উল্টেপাল্টে দেখে পছন্দ হলো। তিনখণ্ড একসঙ্গে কিনে ফেললাম। কিন্তু বাংলা অনুবাদটা নয়, মূল ইংরিজি সংস্করণটা। এই ঘটনা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের।
অবশেষে আজকে তিনখণ্ডের প্রায় ১৫০০ পৃষ্ঠার এই গীতাপাঠ শেষ করলাম (গীতা “পড়লাম” বলতে নেই, পাপ হয়)। যে-সময়ে এইসব প্রাচীন বইপত্র রচিত হয়েছে তখনও যেহেতু “হিন্দু” শব্দটির কোনো অস্তিত্ব ছিল না, তাই হিন্দু-দর্শনের বদলে “প্রাচীন ভারতীয় দর্শন” বলা উচিত হবে। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের অনেকগুলো শাখা ছিল। এমনকি একাধিক নাস্তিক্য দর্শনের খোঁজও পাওয়া যায় (যেমন - “চার্বাক দর্শন”)। তবে, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মেইনস্ট্রিম ছিল বেদান্ত দর্শন।
বেদান্ত দর্শন আয়তনে বিপুল, বিশাল। বেদ, উপনিষদ— এগুলো সবই বেদান্ত দর্শনের অন্তর্গত। এই বিশাল বেদান্ত দর্শনের অনেক অনেক লিটার দুধ জ্বাল দিয়ে যদি একবাটি ক্ষীর বানানো হয়, তবে সেটা হলো ভগবদগীতা। মাত্র ৭০০টা শ্লোক আছে গীতাতে। গীতা কিন্তু মহাভারতের অন্তর্গত একটা অংশ, আলাদা করে লেখা হয়নি। মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে অর্জুন এবং শ্রীকৃষ্ণের মধ্যে কিছু দার্শনিক আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনার অংশটিকে আমরা আলাদা ভাবে “গীতা” নামে চিনি। কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল দুজনের মধ্যে?
অর্জুন বলেছিলেন, আমি যুদ্ধ করবো না। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো, তারা সবাই আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কেউ কেউ আমার গুরুজন। এদের আমি কীভাবে হত্যা করবো? এদের মেরে যুদ্ধে জেতার চেয়ে ভিক্ষা করে খাওয়া ভালো। ইয়ে লাফড়া আপুন সে নেহিচ হোয়েঙ্গা, বীড়ু! এই বলে তিনি হাতের অস্ত্র ফেলে দিলেন। চোখের জল মুছতে মুছতে শোকে আচ্ছন্ন হয়ে মাটিতে বসে পড়লেন (তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে হতো। বসে পড়ার অর্থ হলো “ওয়াক-ওভার” ঘোষণা করে দেওয়া)। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন অর্জুনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু (“বীড়ু” = “বেস্ট ফ্রেন্ড”)। তিনি ছিলেন গোটা মহাভারতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষও বটে। এই শোচনীয় মানসিক অবস্থা থেকে অর্জুনকে বের করে আনতে হবে তাঁকে।
অর্জুনের মতো নিখুঁত মহাবীর, মহাভারতের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস নায়ক, আজকের দিনের pseudo-psychology'র ভাষায় - “Alpha Male”, তাঁর মতো মানুষও কিনা শোকে-দুঃখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন! নিরাশার সমুদ্রে ডুবে গেছিলেন। নিজেকে চরম অসহায় মনে করছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, এর চেয়ে তো মরে যাওয়া ভালো। নিজেকে কীভাবে সামলাবেন তার কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অর্জুনের মতোই ছন্নছাড়া মানসিক অবস্থা তো আমাদেরও হয়! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ না হোক, আমাদের নিজেদের জীবনটাও একটা যুদ্ধ ছাড়া আর কী? কখনও বাস্তব পরিস্থিতি বাঁশ দ্যায়, আবার কখনও মরীচিকার মতো ভ্রান্ত মোহ এসে চাবুক মারে। আর যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমরা যন্ত্রণায় দগ্ধ হই।
স্বামী বিবেকানন্দ গীতাকে বলেছিলেন “প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত”। মানে গীতার দর্শন স্রেফ যুক্তির মারপ্যাঁচ নয়, আমাদের নিজেদের জীবনে এই দর্শনকে প্রত্যক্ষভাবে কাজে লাগানো সম্ভব। এবং গীতার দর্শন আদ্যোপান্ত একটি পজিটিভ দর্শন। আজকের পৃথিবীতে নায়িলিজম যেন একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদি বলি আমি একজন অপ্টিমিস্ট, ভবিষ্যত নিয়ে আমি আশাবাদী, তার মানে আমি যথার্থ “আধুনিক” মানুষ নই। অথবা আমি একজন সুবিধাবাদী “এলিট”।
দেশদুনিয়ার সমস্যা নিয়ে যিনি যতো বেশি ঘ্যানর-ঘ্যানর প্যানর-প্যানর করবেন, তিনি ততো বেশি “সমাজসচেতন”। দায়দায়িত্বহীন এই ঘ্যানর-ঘ্যানরের দ্বারা মূল সমস্যার কিন্তু দুই ইঞ্চিও সমাধান হয়না। নায়িলিজমগ্রস্ত এই পলায়নী-মনোবৃত্তির বিপরীতে, বিষাদাচ্ছন্ন অর্জুনের উদ্দেশ্যে শ্রীকৃষ্ণ ঠিক সেই কথাটাই বলেছিলেন যেটা একজন প্রকৃত বন্ধুর বলা উচিত : তস্মাৎ উত্তিষ্ঠ কৌন্তেয়! —হে অর্জুন, উঠে দাঁড়াও! আর যাই করো, ভগ্নহৃদয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থেকো না। ব্রো, বসা অবস্থা থেকে আগে উঠে দাঁড়াও! তারপর দেকচি কি করা যায়...
যেভাবেই হোক, অন্তত খাড়া হয়ে একটিবার উঠে দাঁড়ানোটা ক্যানো উচিত, ক্লীব হয়ে বসে থাকার মধ্যে যে কোনো গৌরব নেই, রথের চাকা (আমাদের ক্ষেত্রে কোলবালিশ) জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলে যে সমস্যার সমাধান হয়না, দুর্বলচিত্ত ভীরু দ্বিধাগ্রস্ত মানুষরা যখন ক্ষমা, করুণা, দয়া, অহিংসা, ইত্যাদি সুইট অ্যান্ড বিউটিফুল জিনিসের গুণকীর্তন করে, তখন যে সেটা কতটা হাস্যকর শোনায়, এবং সবচেয়ে বড় কথা, কখনও কখনও যে সত্যিই আমাদের কঠোর হওয়া জরুরি, ভদ্রতার পোশাকটা খুলে আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখা জরুরি, “অভদ্র” হওয়া জরুরি, এই কথাগুলো অর্জুনকে বলেছিলেন তাঁর প্রিয় বন্ধু। ইনি আমাদের পরিচিত সেই বৃন্দাবনের বংশীবাদক লেডিকিলার কেষ্টঠাকুর নন! রাইট নাউ, ড্যাম ইট, হি ইজ অন ফায়ার!
অর্জুনের এই হতবুদ্ধি অবস্থা দেখে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে সান্ত্বনা অফার করেননি। কিংবা, Cheer up, dude! You can do it, man! Oh come on, grow some balls, will ya! এইসব ছাগলের আলাপ করেননি। তিনি বলেছিলেন : শোন ভাই, অহিংসা, ক্ষমা, দয়া— এইসব কাজ দুর্বলদের মানায় না। এগুলো শক্তিশালী মানুষের কাজ। যার নিজেরই হাত পা কাঁপছে, চোখ দিয়ে জল বেরোচ্ছে, সে অন্যকে অহিংসা দেখাবে? হিহি! গান্ধিজির মুখেও আমরা একই কথা শুনতে পাই। নেলসন ম্যান্ডেলার মুখেও। মার্টিন লুথার কিংয়ের মুখেও। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন তথাকথিত অহিংসার পূজারী।
তারপর তিনি অর্জুনের সামনে বেদান্ত দর্শনের যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডারকে উন্মুক্ত করে দিলেন। বুদ্ধি দিয়ে, যুক্তি দিয়ে, বোধ দিয়ে, প্র্যাকটিক্যাল চিন্তা দিয়ে, দীর্ঘদিন ধরে এই দর্শনকে গড়ে তোলা হয়েছে। তিনি বললেন, এই নাও, তোমাকে সবকিছু বললাম। এবার তুমি নিজেই বিচার করে দ্যাখো। বেদান্ত দর্শনের এটা একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য। “বৃহদারণ্যক” নামের একটা বিখ্যাত উপনিষদ আছে। সেখানে একটা বৈপ্লবিক কথা বলা হয়েছে : “বেদো অবেদো ভবতি”। এর মানে হলো, আমার নিজের অনুভূতির, নিজের বিচারবুদ্ধির দাম বেদের চেয়েও বেশি। তুমি আগে তোমার অস্থির মনটা স্থির করো, তারপর সবকিছু শুনে দ্যাখো, তারপর যদি বেদান্তের বিচার পছন্দ হয়, তাহলে রাখো। নইলে ফেলে দাও। কুছ পরোয়া নেহি। আমার মনে হয়েছে, এই বিস্ময়কর ফ্লেক্সিবিলিটি বেদান্ত দর্শনের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য। এর সবচেয়ে বড়ো শক্তি। পৃথিবীর আর কোনো দর্শন নিজের ব্যাপারে এরকম নির্ভীক ঘোষণা করেছে বলে আমার জানা নেই। “বেদো অবেদো ভবতি”। আমার সিদ্ধান্তের সামনে বেদও “অবেদ” হয়ে যায়।
“রোজ সকালবেলা, ভগবদগীতার সুবিশাল এবং মহাজাগতিক দর্শনের গভীরে, আমি আমার বুদ্ধিকে অবগাহন করাই। এই গ্রন্থ পড়ার পরে, আধুনিক পৃথিবী এবং এই পৃথিবীতে রচিত সাহিত্যকে মনে হয় অতি ক্ষুদ্র, অতি নগণ্য।” এই কথা বলেছিলেন হেনরি ডেভিড থোরো, তাঁর বিখ্যাত “ওয়ালডেন” বইতে (বাংলা অনুবাদটা আমার নিজের)। আমি যদিও থোরো-র এই কথাটা মানি না, তবু একটা বিষয় বুঝতে পারি। থোরো-র মতো transcendentalist মানুষ, যিনি নিজের যুগের চিন্তাভাবনার তুলনায় এগিয়ে ছিলেন, তাঁর মননেও গীতার দর্শন এতোটা মৌলিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।
আজকে সকালে গীতা শেষ করে আমারও মনে হয়েছে, যতটুকু ভেবেছিলাম, আমার মনের উপর গীতার “পজিটিভ” দর্শনের প্রভাব তার চেয়ে অনেকটাই বেশি পড়েছে। আমারও মনে হয়েছে, মানুষের জীবনের বোধহয় সবচেয়ে বড়ো কর্তব্য, যতবার বসে পড়ছি, ততবার উঠে দাঁড়ানো। যতবার, ততবার। যতবার, ততবার।
উত্তিষ্ঠত! উত্তিষ্ঠত!
(যদি কেউ নিছক ধর্মীয় অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে গীতা পড়তে চায়, আমি তাকে স্বামী রঙ্গনাথানন্দের লেখা এই সংস্করণটি পড়তে রেকমেন্ড করছি। বইটাকে “লেখা” বললে ভুল হবে। হায়দরাবাদের রামকৃষ্ণ মিশনে দীর্ঘ দুইবছর ধরে প্রতি সপ্তাহে সম্পূর্ণ গীতার বিশ্লেষণ করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তিনি। বইটি সেই বক্তৃতামালার লিখিত রূপ। মৌখিক আলোচনা হওয়ার কারণে এই বিশ্লেষণে দুর্দান্ত একটা গতিশীলতা এসেছে। তাছাড়া, স্বামী রঙ্গনাথানন্দের উদার চিন্তাভাবনা এবং উজ্জ্বল পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়েছি আমি। সবমিলিয়ে, আমার দেখা এটিই শ্রেষ্ঠ গীতা, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই!
বইটার একটা বাংলা অনুবাদ আছে। এমনিতে আমি কোনোকিছুর বাংলা অনুবাদ পাওয়া গেলে সেটা পড়াই পছন্দ করি। কিন্তু এই বইটার ক্ষেত্রে মূল ইংরিজি ভার্শনটা পড়লেই বোধহয় বেশি ভালো হবে। স্বামী রঙ্গনাথানন্দের বক্তব্যের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং ছন্দটা উপভোগ করা যাবে।)
.
পূর্ণেন্দু পত্রীকে যেকোনো একটা পরিচয়ে বেঁধে ফেলা কিংবা আটকে রাখা অসম্ভব। তিনি ছিলেন কলকাতার নাগরিক-ইতিহাসের একজন উৎসাহী গবেষক। একজন মৌলিক সিনেমানির্মাতা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের “তেলেনাপোতা আবিষ্কার”কে তিনি সেলুলয়েডে ধরতে চেয়েছিলেন!! বাংলা প্রকাশনীর ইতিহাসে সম্ভবত সবচাইতে ভার্সাটাইল এবং অভিনব প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন তিনি। চমৎকার গদ্যলেখক এবং ঔপন্যাসিক। এরকম নানাবিধ কাজকর্মে পারদর্শিতা ছাড়াও তিনি এমন কিছু ঘটনার উদ্যোগী ছিলেন, যেগুলো বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। সত্যজিৎ রায় যখন পথের পাঁচালী বানিয়েছিলেন, আপামর বাঙালি দর্শকদের মধ্যে আক্ষরিক-অর্থে তিনি ছিলেন প্রথম মানুষ যিনি নবীন পরিচালকের প্রতি নিজের সমুগ্ধ প্রশস্তি অর্পণ করেছিলেন এবং তাঁকে সম্বর্ধনাজ্ঞাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই পঞ্চাশের দশকে বাংলা সিনেমার অবস্থা ছিল আজকের থেকেও বাহাত্তর-গুণ যাচ্ছেতাই। সমকালীন একজন অখ্যাত অকুলীন বাঙালি সিনেমানির্মাতার প্রতি এইরকম অকপট শ্রদ্ধার প্রকাশ আজকের দিনের ফুটোমস্তান “ফিলিম ক্রিটিক”দের দ্বারা স্বপ্নেও ভাবা যায় না!
কলকাতা শহরের সম্ভবত সবচেয়ে সুদর্শন স্থাপত্য ছিলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের “সেনেট হল”। বারোক এবং নিওক্ল্যাসিক্যাল শৈলীর যুগলবন্দিতে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন এই ভবনটিকে ১৯৬০ সালে “আধুনিকতার প্রয়োজনে” নির্মমভাবে ভেঙে ফেলা হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষের মতো বেশ কয়েকজন সমসাময়িক মানুষের লেখায় দেখতে পাই, সেনেট হলের হত্যাযজ্ঞের সেই ঘটনার ছবি দিনের পর দিন নিজের স্টিল-ক্যামেরায় তুলে রাখছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। ছবি তুলছিলেন এবং অঝোরে কাঁদছিলেন। ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন শিল্পীর অসহায় যন্ত্রণা! পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার আলোচনায় এইসব অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা টেনে আনছি ক্যানো? কারণ একজন কবির প্রকৃত পরিচয় মুদ্রিত থাকে কেবল ফুল পাখি নদী চাঁদ প্রেম বিরহের রমণীয় ক্যানভাসেই নয়, তাঁর সমসাময়িক ক্ষতবিক্ষত পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেও। গভীর রাতে সাদা পৃষ্ঠায় সুচিন্তিত প্রেমের কবিতা লিখবার আগে, কবি নিজের ফুসফুসে ঢুকিয়ে নেন সারাদিনের ধুলো ধোঁয়া নাগরিক-দুর্গন্ধ বিষবাষ্প সূর্যপোড়া ছাই!
নারীরা পুরনো হয়, যুবকেরা বেঁকে যায় দুঃখে দুর্বিপাকেজননীরা তুলে নেয় মৃত্যুর সংসার কোলে-কাঁখেগভীর ফাটল তবু পৃথিবীর মাঠে পড়ে থাকে।
এখনও বিষাদ পাবে বলেপুরুষ নারীর কাছে যায়নারীরা নদীর কাছে যায়নদীরা মাটির কাছে আসেমাটি আকাশের দিকে চায়।তোমার বিষাদগুলি করতলে তুলে নিতে দাওওষ্ঠপুটে রাখি।
ফুলের কাছে নারীর কাছেবুকের বিপুল ব্যথার কাছেবেদনাবহ যে সব কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম।তারাই যখন ফিরে আসেকেউ ললিতে কেউ বিভাসেস্পন্দনে তার বুঝতে পারিবুকের মধ্যে বড়ে গোলাম!
উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি চেয়েছিলেএই যে এঁকেছি।এই তার রক্ত-নাড়ি, এই খুলি,এই তার হাড়।এই দেখ ফুসফুসের চতুর্দিকে পেরেক, আলপিনসরু কাঁটাতার।এইখানে আত্মা ছিলগোল সূর্য, ভারমিলিয়নভাঙা ফুলদানি ছিল এরই মধ্যেছিল পিকদানিপিকদানির মধ্যে ছিলপৃথিবীর কফ, থুতু, শ্লেষ্মা, শ্লেষঅপমান, হত্যা ও মরণ।উৎকৃষ্ট মানুষ তুমি খুঁজেছিলেএই যে এঁকেছি!ক্ষতচিহ্নগুলি গুণে নাও!
My soul softly flaps in the little Pentecost flame with you, like the peace of fucking. We fucked a flame into being. Even the flowers are fucked into being, between sun and earth.
সেরকম ভাবতে গেলে লেডি চ্যাটার্লিজ লাভার একটা সফ্ট-কোর উপন্যাস। যৌন ঘটনার খোলামেলা বর্ণনার অভাব নেই এই বইতে। যৌনতাবাচক বিভিন্ন শব্দ— fuck, cunt, phallus, penis — এসবের উল্লেখ রয়েছে অহরহ। আজ থেকে ৯৫ বছর আগে এরকম কিছু যে লেখা হয়েছে, এবং এইরকম সোজাসাপ্টাভাবে লেখা হয়েছে, সেটা ভাবতে খানিকটা অবাক লাগে বৈকি। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডে নিষিদ্ধ ছিল বইটা। ত্রিশের দশকে এই বইকে নিয়ে সাহিত্যজগৎ যখন তোলপাড়, ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের বউ রানি মেরি বইটা লুকিয়ে পড়ার জোগাড় করলে স্বয়ং রাজা সেটা কেড়ে নিয়ে নেন। সাধারণ ধর-তক্তা-মার-পেরেক জাতীয় পর্নোগ্রাফিক উপন্যাস হলে রাজামশাই বোধহয় কেড়ে নিতেন না। তার মানে, যৌনতার বাইরেও কিছু একটা অন্য ব্যাপার আছে এই উপন্যাসে। কী ব্যাপার সেটা?
মেয়েদের স্রেফ যৌনবস্তু হিসেবে দেখতে নিষেধ করতে-করতে, কিংবা নারীর সম্ভ্রম/ আব্রু/ ইজ্জত ইত্যাদি রক্ষায় সদা তৎপর থাকতে-থাকতে, আমাদের চারপাশের “পলিটিক্যালি কারেক্ট” সমাজ মাঝে মাঝে একটা দরকারি কথা ভুলে মেরে দ্যায়। সেটা হলো, মেয়েরাও যৌনকর্ম ভালোবাসে। পুরুষদের মতোই দিব্যি ভালোবাসে। নারীর যৌনতাবোধের পরিভাষা এবং অভিব্যক্তি হয়তো পুরুষের চেয়ে আলাদা, কিন্তু রানিসাহেবাকে এই বইটা পড়তে দেখে ইংল্যান্ডের রাজার ভয় পাওয়ার কারণ বোধহয় এটাই যে, এই গল্পের নায়িকা নিজের প্রাপ্য যৌন-আনন্দকে হাত পেতে চেয়ে নিয়েছিল। গল্পের শুরুতে, কপালদোষে মেয়েটা মহাবিপাকে পড়েছিল। ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেছে, যুদ্ধ করতে গিয়ে সেই মানুষটা পঙ্গু হয়ে ফেরত এসেছে। প্রথম প্রথম মেয়েটি নিজের দৈহিক চাহিদাকে চেপে রাখার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষমেশ আর পারেনি। বুভুক্ষুর মতো খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়েছে, এবং নিজের খাবার নিজেই খুঁজে নিয়েছে। সে ছিল বিরিয়ানি খাওয়া পরিবারের স্ত্রী। বিরিয়ানি পায়নি, ডালভাত পেয়েছে। সেটাকেই সে পরম যত্ন করে খেয়েছে। বইটিকে নিয়ে গুরুজনদের আপত্তি এখানেই। মেয়েদের যৌনহ্যাংলামি করা একান্তই নিষেধ। এইসব “খাওয়াদাওয়া” তো একান্তই পুরুষালি কর্ম, তাইনা?
উপন্যাসটিতে কিছু ত্রুটি আছে। গল্পের ভাষা এবং গতি অসমান (যদিও বেশিরভাগ জায়গাতেই লরেন্সের গদ্য এবং পরিস্থিতি-বর্ণনা অতি চমৎকার)। গল্পের মধ্যে কিছু আর্থ-সামাজিক জ্ঞান দিয়েছেন লেখক, যেগুলো বিরক্তিকর মনে হয়েছে। উপন্যাসের চরিত্রগঠন ও ঘটনানির্মাণে কিছু কিছু গতানুগতিকতার ছোঁয়া আছে। যৌনতা ক্যানো মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় অংশ, সেই ব্যাপারে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার হালকা চেষ্টা করা হয়েছে, যেটার দরকার ছিল না। বাকি সব জৈবিক কাজের জন্যে যেমন অজুহাত খোঁজার দরকার হয়না, এই কাজেও দরকার নেই। কিন্তু তবু, দোষ ত্রুটি সত্ত্বেও এই উপন্যাসটি অনেক দরকারি কথা বলেছে। পাঠকের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলেছে। শত প্রেমের গান, শত প্রেমের কবিতা, শত গোলাপের গুচ্ছ, হাতে হাত এবং চোখে চোখ রেখে অতিবাহিত করা শত শত ঘন্টা বেকার হয়ে যায়, ফালতু হয়ে যায়, যদি কামনা খুঁজে না পায় তার বাঞ্ছিত সিংহদুয়ার। রম্য, মার্জিত এবং শিল্পসম্মত সফিস্টিকেশন ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়, যদি না আমার তীব্র জলস্রোত আছড়ে গিয়ে না পড়ে তোমার আরণ্যক উপত্যকায়। আর কিছু না হোক, খুব সোচ্চারভাবে এই উপন্যাসে এই জরুরি কথাটা বলা হয়েছে। আর এই জন্যেই, অনেক বদনাম বহন করেও, উপন্যাসটা টিকে গেছে এবং আরো টিকে যাবে, বহুদিন।
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয়।অসংখ্যবন্ধন-মাঝে মহানন্দময়লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধারমৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বারতোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরতনানাবর্ণগন্ধময়। প্রদীপের মতোসমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়তোমার মন্দির-মাঝে।
Amen.
.
চোখের জলের মতো কয়েকফোঁটা আকারের এই কবিতার বইটি চোখের জলের মতোই সরল রহস্যময়। এই কবির কাব্যমননের কেন্দ্রবিন্দুতে, অন্তত এই বইটির ক্ষেত্রে, সেই নারীটি নেই, সাধারণত যেই নারীটি থাকে পৃথিবীর আপামর কবিদের কুঠারের ধারালো কিনারে, কিংবা পালকের নরম ডগায়। অর্থাৎ কবিদের প্রেমিকারা। অথচ এই কবিতাগুলোকে ভালোবাসার কবিতা ছাড়া আর কী-বা বলা যায়? ষোলো পৃষ্ঠার পরিসরে এই বইতে ছড়িয়ে আছে মাত্র তেরোখানি নম্র কবিতা। প্রতিটি কবিতার অনুষঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কবির আম্মার প্রসঙ্গ। অন্ধকারের অন্তর্গত শিমুল যখন টুপটাপ ঝরতে থাকে সারারাত, রোগনিরাময়কারী হাওয়ায় কবির সেই আম্মা, দাঁড়িয়ে থাকেন নিজের ভেতরে, একা—
আমার বাড়ি নবদ্বীপ থেকে চাপড়া নামের জায়গাটিতে যেতে মোটরবাইকে সময় লাগে খুব বেশি হলে এক ঘন্টা। কয়েকদিন আগে পাঠকবন্ধুদের কাছে তাদের বাৎসরিক প্রিয় বইয়ের নাম জানাতে অনুরোধ করেছিলাম। গুডরিডসের অনেক পুরোনো বন্ধু (সম্ভবত সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু) রিফাত, প্রায় কুন্ঠিত হয়ে দুটো বইয়ের নাম জানায় আমাকে। তার মধ্যে এই বিশীর্ণকায় কবিতার বইটি অন্যতম। হারুনের কাছে বইটির খোঁজ নিলে স্বয়ং কবির থেকে বইটির পিডিএফ চেয়ে আনে হারুন (বন্ধুভাগ্য!)। বইটি খুলে দেখি, বাংলাদেশের বগুড়া জেলার কবির এই বইটি প্রকাশিত হয়েছে ভারতের নদীয়া জেলার সেই চাপড়া থেকে! ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া...!
কবি হাসান রোবায়েতের সবচেয়ে বড় শক্তি লুকিয়ে আছে অনুপম দৃশ্য ও চিত্রকল্পময় পরিবেশমাধুর্য সৃষ্টির পারদর্শিতায়। শব্দের উপমাময়, গভীর ইঙ্গিতবাহী, রহস্যময়, ছলনাময় ব্যবহারে, শীতনিশীথে গায়ে জড়িয়ে রাখা পুরাতন চাদরের মতো পাঠকের অনুভবে জড়িয়ে থাকে, জামের নিধু বনে যেসব হাঁসেদের লাল পায়ে পায়ে বাজছে সন্তুর, সেইসব হাঁসেদের বুকের উষ্ণতা। “আনোখা” শব্দটির বাংলা অর্থ হতে পারে - “অনন্য”, কিন্তু ইংরেজি প্রতিশব্দটা বললে অর্থটা আরো পরিষ্কার হবে - “unique”. আমাদের প্রত্যেকের জীবনে এই অনন্য, unique নদী আর কে হতে পারে, আমাদের মা ছাড়া? মোরগ জবাই করা সন্ধ্যায় যখন কবির আম্মা গিঁট মেরে বেঁধে রাখতেন মৌসুমী হাওয়ার দিন... কিংবা, নিমগাছের অমলিন ব্যথায় কবির আম্মা লেপে দিতেন হাতের অন্ধকার... আমিও একটু আগে, কবিতাগুলো পড়ার ফাঁকে দেখে এলাম, আমার আম্মা, আমার মা, নিবিষ্ট মনে বুনছে আমার জন্যে মেরুন রঙের সোয়েটার। আমার চোখে অনর্থক জল এলো। জানিনা ক্যানো মনে পড়ে গ্যালো এই বইয়ের কয়েকটা লাইন—
সিনেমার দিনশেষে সন্ধ্যাতারার নিচেআম্মা চাল ঝাড়তে বসলেগমগমে নিস্তব্ধতার ভেতর একটা বাঁশপাতাক্রমশ পেরিয়ে যায় চিত্রার্পিত হাওয়া......একটা সাইকেলের বেল চিরকাল বেজে যাচ্ছেপত্রছিন্ন সন্ধ্যায়—
মার্সেল প্রুস্ত বলেছিলেন, আমাদের অতীতকে আমরা যেভাবে মনে রাখি, অতীত আসলে তার চেয়ে অনেকটাই অন্যরকম ছিল। প্রুস্তের এই কথার সঙ্গে “বিস্মৃতি”র কোনো সম্পর্ক নেই। বিস্মৃতি মানে ভুলে যাওয়া। এখানে উনি স্মৃতির প্রতারণার কথা বলতে চেয়েছেন। অথবা স্মৃতির বিশ্বাসঘাতকতার কথা। আমরা কতটা ভরসা করতে পারি আমাদের স্মৃতির উপরে?
এই কাহিনিতে নির্দিষ্ট কোনো প্লট নেই। নির্দিষ্ট কোনো শুরু নেই। শেষ নেই। ঠিক যেমন আমাদের অবচেতন এবং অস্তিত্বের মধ্যে সারাক্ষণ নিচুস্বরে কথোপকথন চলতে থাকে, অনেকটা তেমনভাবে বলা হয়েছে এই গল্পটা। সিরিল র্যাডক্লিফ নামের একজন ব্রিটিশ আইনজীবী, যিনি আগে কোনোদিন ভারতবর্ষে পা রাখেননি, তাকে ভারতবর্ষ দেশটাকে ভেঙে দু-টুকরো করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। সময় দেওয়া হয়েছিল ৫ সপ্তাহ।
এই নামমাত্র সময়ের মধ্যে একটা কাল্পনিক সীমারেখা টেনে, পাশাপাশি বসবাস করা অসংখ্য মানুষকে তিনি পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। খণ্ডিত দুই ভূখণ্ড, একে অপরের কাছে পরিণত হয়েছিল স্রেফ স্মৃতিতে। নিমেষের মধ্যে বর্তমান রূপান্তরিত হয়েছিল অতীতে। অতীত মানেই স্মৃতি। কিংবা স্মৃতি এবং বিস্মৃতির মাঝামাঝি কয়েকটা ধূসর সীমারেখা। দ্য শ্যাডো লাইনস।
উপন্যাসটি এমনভাবে লেখা হয়েছে যেন অনেকগুলো টুকরো টুকরো গল্পের মাধ্যমে একটা সম্পূর্ণ গল্পের অবয়ব ফুটে উঠেছে। এই টুকরো গল্পগুলোতে অতীত এবং বর্তমানের সীমারেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বর্তমানের পরের লাইনেই অতীত এবং অতীতের পরের পরিচ্ছেদেই বর্তমানের এই মিশেল পাঠকের মনে একটা ঘোরের সৃষ্টি করে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অমিতাভ ঘোষের চমৎকার মসৃণ গদ্য।
উপন্যাসটি যার জবানিতে লেখা হয়েছে সেই কথকের নামটা একবারও উল্লেখ করা হয়নি। এই নামহীন কথকের মুখে আমরা জানতে পারি তার প্রতিভাবান কাকা ত্রিদিবের কথা। যার ব্যাপারে কথকের ঠাকুমা বলেছিলেন, ত্রিদিব ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই হতে পারতো, কিন্তু ত্রিদিবের নিজের ইচ্ছে ছিলো “কিছুই-না-হওয়া”। জানতে পারি এই কথাটা যিনি বলেছিলেন সেই ঠাকুমার কথা, দেশভাগের অনেক পরে ঢাকায় ঘুরতে যাওয়ার সময় যাঁর মনে হয়েছিল, তিনি সেখানে যাচ্ছেন না, তিনি ঢাকায় “ফিরে আসছেন”। জানতে পারি ইলার কথা। কথক যাকে মনে মনে ভালোবাসতো। ইলা সেই ভালোবাসার কথা জানতো না।
জানতে পারি, আমাদের স্মৃতি প্রায় সবসময়ই অসম্পূর্ণ। Fragmented. Unreliable. কোন্ ঘটনাটা আমরা মনে রেখে দেবো, কোনটা ভুলে যাবো, একটা ঘটনাকে অনেক অনেক বছর পরে কীভাবে পুনর্নির্মাণ করবো, তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। ফুটবল লেগে আমার নাক ভেঙে গেছিলো। সেই দিনটার ব্যাপারে আর কিছুই মনে নেই। শুধু মনে আছে নাক চেপে ধরে মাঠে শুয়ে হঠাৎ আমার চোখে পড়েছিল বিকেলবেলা ঘরে ফিরতে থাকা কয়েকশো পাখির একটা অপূর্ব ঝাঁককে (কয়েক হাজারও হতে পারে)। কুড়ি বছর আগেকার এক শীতের গোধূলিমুহূর্তের এই ঘটনাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে।
এক বন্ধুকে কথাপ্রসঙ্গে এই ঘটনাটা বলার পরে সে হাসতে হাসতে বললো, পাখির ঝাঁক তো সেদিন দেখিসনি তুই। তোর নাক ভেঙেছিল স্কুলের মাঠে দুপুরবেলা। দুপুরবেলায় পাখি কই? পাখির ঝাঁক দেখেছিলি গঙ্গার পাশের মাঠে, যেদিন তোর পা ভেঙেছিলো। মাঠে শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে আমাকেও সেই পাখির ঝাঁক দেখিয়েছিলি তুই। এইরকম আধমাতাল স্মৃতির উপর নির্ভর করেই আমরা সারাজীবন কাটিয়ে দিই! উপন্যাসে এরকম ভঙ্গুর স্মৃতিচারণায় আমরা দেখতে পাই দেশভাগের কথা, দাঙ্গার কথা, দেখতে পাই রাজনীতি কিভাবে প্রভাবিত করে একজন মানুষের জীবনকে, কয়েকজন মানুষের জীবনকে, একটা পরিবারকে, একটা শহরকে, কয়েকটা শহরকে, প্রেমকে, মৃত্যুকে।
“And then I think to myself why don't they draw thousands of little lines through the whole sub-continent and give every little place a new name? What would it change? It's a mirage. The whole thing is a mirage. How can anyone divide a memory?”
চমৎকার একটা উপন্যাস। আমার পড়া হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম সেরা উপন্যাস। ইদানিং তাঁর যেসব লেখাপত্র পড়ছিলাম, বেশিরভাগই ভালো লাগছিলো না। খুব বেশি আশা না-নিয়েই এই উপন্যাসটা শুরু করেছিলাম। একদম ছোটো উপন্যাস। এটা কিন্তু খুব ভালো লেগে গ্যালো।
এই উপন্যাসে হুমায়ূনীয় অনেক কিছুই নেই। “অসম্ভব রূপবতী” এবং “প্রচণ্ড বুদ্ধিমতী” কোনো মেয়ে নেই। সেই বুদ্ধিমতী-রূপবতীকে দূর থেকে ভালোবাসে এমন কোনো নিঃস্বার্থ আলাভোলা প্রেমিক নেই। উপরে ভীষণ কঠিন কিন্তু ভেতরে তুলতুলে নরম হৃদয়ের বাবা নেই। আধপাগল মামা কাকা জ্যাঠা পিসেমশাই মেসোমশাই নেই। অলৌকিক আজগুবি কান্ডকারখানা নেই।
আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার। “যার রাগ বেশি সে নীরবে অনেক ভালোবাসতে জানে, যে নীরবে ভালোবাসতে জানে তার ভালোবাসার গভীরতা অনেক বেশি”, কিংবা “মেয়েদের স্বভাবই হচ্ছে হালকা জিনিস নিয়ে মাতামাতি করা”, কিংবা “যদি আপনি অন্তর থেকে কাউকে চান, জেনে রাখুন সেই মানুষটিও আপনাকে ভেবেই ঘুমাতে যায়”— এই ধরণের হুমায়ূন-সুলভ “উক্তি” এই বইতে একটাও নেই। বিষয়টা আমাকে খুবই অবাক করেছে। উক্তিবিহীন বই তিনি কীভাবে লিখলেন?!
বাবার সঙ্গে মেয়ের, মেয়ের সঙ্গে মায়ের, বোনের সঙ্গে ভাইয়ের, স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রাক্তন স্বামীর, ইত্যাদি যে-সম্পর্কগুলো আমাদের চারপাশে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে, আমরা নিজেরাও যে-সম্পর্কগুলোতে প্রায়শ অংশগ্রহণ করি, মধ্যবিত্ত জীবনের তেমন কিছু সম্পর্ককে দারুন পারদর্শিতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই কাহিনিতে।
পড়তে পড়তে রমাপদ চৌধুরী কিংবা মতি নন্দী কিংবা গৌরকিশোর ঘোষ কিংবা বিমল করের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। হুমায়ূন আহমেদের রচনার এই বাস্তবসম্মত রূপ আমি খুব বেশি দেখিনি। শুধু একটাই আফসোস। হুমায়ূন তাঁর গল্পে মানসিকভাবে শক্তিশালী নারীদের এতো কষ্ট দেন ক্যানো? এই নারীরা নিজেদের শক্তি প্রয়োগ করে যদি জিতে যেত জীবনে, তাহলে আরো ভালো লাগতো আমার।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের আত্মজীবনীর নাম রেখেছিলেন “অর্ধেক জীবন”। তাঁর জীবনের বাকি অর্ধেকটা খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর লেখা কবিতায়। আমরা যারা সুনীলের কবিতার মুগ্ধ পাঠক, সেই আমাদের জীবনেরও বেশ কিছুটা অংশ কি ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেই এইসব কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে? গত প্রায় একমাস ধরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্রের চারটে খণ্ড পড়ে শেষ করার পরে, বাতাসে ভাসমান একাকী তুলোর বীজের মতো আমার মনে ভাসছে প্রথমবার তাঁর কবিতা আবিষ্কার করার স্মৃতি। মফস্বল শহরের বাংলা ইশকুলের অন্ধকার লাইব্রেরির বৃদ্ধ আলমারি থেকে বের করে আনা কীটদষ্ট বইটার নাম ছিলো “জাগরণ হেমবর্ণ”। সেই বইয়ের একটি কবিতার প্রথম লাইন : “যে লেখে, সে আমি নয়/ কেন যে আমায় দোষী করো!” যে-ছেলেটা বইটা পড়ছিলো সেও তো আমি ছিলাম না! “সে কখনো আমার মতন বসে থাকে/ টেবিলে মুখ গুঁজে?”
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৫৮ সালের শীতকালে। পৌষমাসে। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। বইটির নাম ছিলো “একা এবং কয়েকজন”। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছিলো “আমার প্রিয় কবিদের প্রতি”। সবই ঠিক ছিলো, কিন্তু বইয়ের কবিতাগুলো মোটেও সুবিধের ছিলো না। এই বইটিকে নিয়ে সুনীল পরবর্তীকালে নিজের দ্বিধা প্রকাশ করেছিলেন। পাপস্খালনের মতো আফসোস-স্খালনের জন্যে একই নামের একটি বড়ো আকারের উপন্যাস লিখেছিলেন। কবি হিসেবে সুনীলের প্রকৃত আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে, প্রথম বই প্রকাশের আট বছর পরে। বাংলা কবিতার জগতে গুটিকয় অবিস্মরণীয় বইয়ের অন্যতম সেই বইটির নাম— “আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি”। ভাবতে অবাক লাগে, এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতা তিনি আমেরিকায় বসে লিখেছিলেন।
বইটির ভূমিকায় তিরিশ বছর বয়েসি কবি লিপিবদ্ধ করেছেন কিছু অকপট বাক্য : “অসীম ধৈর্যের সঙ্গে ওষ্ঠাধর সঙ্কুচিত করে পড়তে হয় নিজের পুরোনো কবিতা। যেগুলি পছন্দ হয় না এবং শরীর রি-রি করে, সেগুলি মাটিতে ফেলে দিই। ক্রমে আমার ঘরময় বিবর্ণ কাগজ উড়তে থাকে, ঘরের মেঝেতে ও হাওয়ায় ব্যর্থ কবিতা ছড়িয়ে যায়। ...জানি, যে-কবিতা আমি লিখতে চাই, এখনো তার মর্ম স্পর্শ করতে পারিনি।” পরবর্তী অর্ধশতাব্দব্যাপী, ২০১২ সালে তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত, সুনীলের কবিতায় যেন ক্রমাগত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে তাঁর সেই অকপট স্বীকারোক্তিরই নানাবিধ সংস্করণ। নানাবিধ উচ্চারণ। কবিতা লিখে তিনি সমাজ বদলাতে চাননি। প্রতিষ্ঠা পেতে চাননি। ঠাট্টা করে একবার লিখেছিলেন বটে, কিন্তু আদৌ কখনও কবিতা লিখে রাজপ্রাসাদ বানাতে কিংবা পন্টিয়াক গাড়ি কিনতে চাননি। নিজের কবিতায় আজীবন শুধু একটাই কথা বলতে চেয়েছেন : তিনি কী রকম ভাবে বেঁচে আছেন।
আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে পঞ্চাশের দশক ছিলো মোহভঙ্গের দশক। পাটভাঙা ধপধপে পোশাক পরিহিত রাজনৈতিক নেতাদের বচনবলিষ্ঠতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা নির্ভেজাল ধাপ্পাবাজিকে প্রথমবারের জন্যে চিনতে পেরেছিলো দেশের মানুষ। তিরিশের দশকের ব্যাপারে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথের সর্বগ্রাসী প্রভাব থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এই দশকে “বাংলা কাব্যের” মুক্তি ঘটেছিলো। তাহলে বলতে হয় পঞ্চাশের দশক ছিলো “বাংলা কবিতার” মুক্তির দশক! এই মুক্তি এতটাই নির্মম, এতটাই “উন্মার্গগামী” যে, রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা কবিতার ব্যান্ডমাস্টার স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু স্বীকার করে নিয়েছিলেন : আধুনিক কবিতা তিনি ভালো বুঝতে পারছেন না! বন্ধ করে দিয়েছিলেন নিজের সাধের “কবিতা” পত্রিকা। সেই “দুর্বোধ্য” আধুনিকতাকে ট্যাঁকে গুঁজে বাংলা কবিতার নতুন নৌকা তৈরি হলো যার নাম “কৃত্তিবাস” পত্রিকা। সেই নৌকার অবিসংবাদিত মাঝির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
কবি সুনীল যে ভবিষ্যতে গদ্যকার সুনীল হিসেবে অধিক পরিচিত হবেন সেটা তাঁর কবিতা পড়লে আন্দাজ করা যায়। কবিতার নতুন ভাষাকে স্বীকার করে নিয়েও, প্রয়োগসর্বস্ব আঁতেলগন্ধী নিরীক্ষাপ্রবণতাকে শুরু থেকেই তাচ্ছিল্য করেছিলেন তিনি। “আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি”র ঠিক পরের কবিতার বই “বন্দী, জেগে আছো”তে লিখলেন : “কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে/ দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি.../ ...ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করি এবার পৃথিবীটাকে/ মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি/ আমার কিছু ভাল্লাগে না!” এই যে অনুভূতিময় প্রত্যক্ষ প্রকাশভঙ্গিমা, দৃশ্যের পরে দৃশ্যকে সাবলীল বুনে যাওয়া, শব্দ ও বাক্যের সহজিয়া মগ্নতা, এইসমস্ত লক্ষণ তো একজন গদ্যশিল্পীর লক্ষণ। পঞ্চাশের দশকের সবচেয়ে বড় এবং বহুপ্রজ কবির নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ঠিক কথা। কিন্তু সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী কবিতাগুলো লিখেছেন সুনীল। কবিতা সবসময়ই মুষ্টিমেয় পাঠকের জন্যে নির্দিষ্ট ছিলো। আজও আছে। কিন্তু কবিতার লাইনও যে হয়ে উঠতে পারে পপুলার কালচারের অংশ, মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে পারে কবিতার টুকরো, কবিতার এই ক্যাজুয়াল স্বর সুনীলের নিজস্ব অর্জন। এত বেশি উদ্ধৃতিযোগ্য পঙ্ক্তি শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং জীবনানন্দ দাশ ছাড়া অন্য কোনো বাঙালি কবির কাব্যকৃতিতে নেই। এখানে রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লেখ করা উচিত হবে না। উনি তো মানুষ নন, “ঠাকুর”!
একটি প্রার্থনা-সংগীত
গরুদের জন্য দাও ঘাস জমি, খোলামেলা ঘাস জমি,
চিকন সবুজ
ওরা তো চেনে না কোনো রান্নাঘর, ওরা বড় ন্যালাখ্যাপা
অবোধ অবুঝ
কুকুরের জন্য দাও কাঁচা মাংস, লাল মাংস, রক্তমাখা হাড়
ওরা তো খায় না ঘাস, সবুজকে ঘেন্না করে, ওরা চায়
হাড়ের পাহাড়
বাঘেরা বেচারি বড়, দিন দিন কমে যায়, চিড়িয়াখানায় শুধু
বাঘ দেখা হবে?
ওদেরও জন্য দাও নধর হরিণ, দাও খরগোশ
বনের বাঘেরা ফের
মাতুক পুরোনো উৎসবে!
বিড়ালকে মাছ দাও, ব্যাঙেদের সাপ দাও, থুড়ি থুড়ি থুড়ি
সাপদের দাও ব্যাঙ, ছোট-বড় ব্যাঙ
টিকটিকিদের দাও প্রজাপতি, আর কুমিরকে মাঝে মাঝে
ছুঁড়ে দিয়ো
দু-একটা ছাগলের ঠ্যাং!
নদীদের মেঘ দাও, পাহাড়কে দিয়ো গাছ, আর গাছেদের
দিয়ো ঠিকঠাক ফুল ফল
পেঁপে গাছে কোনোদিন ফলে না কখনো যেন হঠাৎ কাঁঠাল
আর নারকোলে ভুল করে
কোকোকোলা দিয়োনাকো
দিয়ো শাঁস জল!
আর মানুষের জন্য দাও...
আর মানুষের জন্য দাও...
কিচ্ছু না, কিচ্ছু না, হা-হা-হা-হা
কিচ্ছু না, কিচ্ছু না, হা-হা-হা-হা
কিচ্ছু না, কিচ্ছু না
কিচ্ছু না, কিচ্ছু না!
বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধগুলোকে তাঁরই লেখা অন্য একটি বইয়ের নাম অনুসরণ করে বলতে ইচ্ছে করে— হঠাৎ আলোর ঝলকানি! কিংবা “অবিরাম আলোর ঝলকানি” বললেও ক্ষতি নেই। একজন কবি যখন গদ্য লেখেন, কবি-মননের স্বভাবসিদ্ধ কাব্যিক ইঙ্গিতময়তা এসে আশ্রয় নেয় সেই গদ্যে। এইরকম কাব্যগন্ধী গদ্যকে প্রায়শই আমি উপভোগ করতে পারিনা। আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হয়েও বুদ্ধদেব বসু এই “দোষে” দুষ্ট নন। তাঁর গদ্য আশ্চর্যরকম সাবলীল। খাঁটি প্রত্যক্ষ গদ্য। শুধুই গদ্য।
আলোচ্য সংকলনটিতে সবমিলিয়ে আটটি প্রবন্ধ রয়েছে। আলোচনায় প্রবেশ করার আগে বলে নিই, বুদ্ধদেবের প্রবন্ধকে “হঠাৎ আলোর ঝলকানি” বললাম ক্যানো। যেকোনো ভালো প্রবন্ধে দুরকম বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। গদ্যভাষার বলিষ্ঠ রম্যময়তা, যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সৈয়দ মুজতবা আলির প্রবন্ধ। আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো, বিষয়বস্তুর বিদগ্ধ উজ্জ্বল বিশ্লেষণ, যার উদাহরণ... ধরা যাক অম্লান দত্ত। (এখানে বারবার “রম্য” শব্দটা ব্যবহার করছি, কিন্তু তাই বলে, ইয়ে, সঞ্জীব চাটুজ্যেমার্কা “কৃত্রিম ছদ্মপ্রাজ্ঞ ছ্যাবলামি” অর্থে ব্যবহার করছি না। এখানে রম্য মানে ভাষা ও ভাবের অকৃত্রিম সাবলীলতা/ সর্বজনীনতা।) একইসঙ্গে রম্য ভাষার ব্যবহার করেছেন এবং উদার বিশ্লেষণ করেছেন এরকম প্রবন্ধলেখকের সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ, আমার মতে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধে অতিরিক্ত যেটা আছে সেটা হলো, ভাষাপ্রয়োগের আশ্চর্য বনেদিয়ানা। বাংলা শব্দের উৎকৃষ্টতম প্রয়োগ। এবং হঠাৎ হঠাৎ আইডিয়ার ঝিলিকে পাঠককে চমৎকৃত করবার পারদর্শিতা। হঠাৎ আলোর ঝলকানি !
প্রতিটি প্রবন্ধ নিয়েই অনেককিছু বলতে ইচ্ছে করছে। সেটা তো সম্ভব নয়। অল্প কিছু বলি। মূল সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণ (কিংবা সেটির বঙ্গানুবাদ) পড়েননি বুদ্ধদেব বসু। আমি যতোটুকু পড়েছি, তিনিও ততোটুকুই পড়েছেন। অর্থাৎ, উপেন্দ্রকিশোরের শিশুতোষ রামায়ণ, কৃত্তিবাসের “বাঙালি” রামায়ণ এবং রাজশেখর বসুর সারানুবাদ। সংকলনের প্রথম প্রবন্ধে (“রামায়ণ”), আরো অনেক প্রসঙ্গের পাশাপাশি, বহুলচর্চিত একটি বিতর্ককে নিজস্ব আঙ্গিকে দেখতে চেয়েছেন বুদ্ধদেব। বিষয়টি হলো, রামায়ণের রামচন্দ্র কি আসলেই একজন আদর্শ মানবচরিত্রের উদাহরণ? “যে-রামের নাম করলে ভূত ভাগে, সেই রাম নিষ্ঠুর অন্যায় করেছেন একাধিকবার।” ক্যানো করেছেন এইসব অন্যায় কাজ? বাজে লোক ছিলেন বলে? নাকি অন্য কোনোভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে রামচন্দ্রের নিষ্ঠুরতাকে? চমৎকার এই প্রবন্ধটি পড়ে খুব খুব আনন্দ লাভ করেছি। রামায়ণ বিষয়ে এমন দারুন প্রবন্ধ বাংলায় খুব বেশি নেই।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি মাইকেল মধুসূদন দত্তের “কীর্তি” বিষয়ক। এই প্রবন্ধেও ঝলসে উঠেছে বুদ্ধদেবের শাণিত যুক্তির তরোয়াল। এখানেও তিনি একটি সুপ্রাচীন ধারণাকে বিকল্প আঙ্গিকে পরখ করে দেখাতে চেয়েছেন। ধারণাটি হলো, মাইকেল তাঁর বিখ্যাত মহাকাব্যে রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাইয়ের চেয়েও রাবণ-মেঘনাদ দুই বাপ-ব্যাটাকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। সত্যিই কি তাঁদের প্রাধান্য দিয়েছেন? সত্যিই মাইকেল বাংলা কাব্যের জগতে বৈপ্লবিক কাজ করেছিলেন? নাকি আমরা তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছি? এই প্রবন্ধে জানতে পারি, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একবার সুস্পষ্টভাবে বলেছিলেন, প্রাচীন বাংলা সাহিত্য সাধারণত অপাঠ্য! (এর চেয়ে সত্যি কথা জগতে আর ক'টা আছে?) বুদ্ধদেবও প্রায় একইরকম সাহসী মন্তব্য করেছেন : “মাইকেল বাংলা জানতেন না”। এইসব কী শুনছি, অ্যাঁ?
“বাংলা শিশুসাহিত্য” প্রবন্ধটি সম্ভবত বাংলা শিশুসাহিত্য বিষয়ক আমার পড়া সবচেয়ে দুর্দান্ত প্রবন্ধ। এই প্রবন্ধেও রয়েছে হঠাৎ হঠাৎ ছিটকে আসা আইডিয়ার আলোর ঝলকানি। দেখতে পাচ্ছি, সে-ই ১৯৫২ সালেই তিনি লীলা মজুমদারকে বাংলাভাষার প্রতিনিধিস্থানীয় শিশুসাহিত্যিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন! একই সঙ্গে স্পষ্ট বুঝিয়ে বলেছেন, বাচ্চাদের জন্যে সাহিত্য রচনা করা যার-তার কাজ নয়। এমনকি রবীন্দ্রনাথও পারেননি (অথচ অবনীন্দ্রনাথ পেরেছেন)। একজায়গায় লিখেছেন : “বাংলা দেশে এত বড়ো দুর্ঘটনাও ঘটেছিলো যে ‘আবোল তাবোল' অনেক বছর ছাপা ছিলো না!” পরপর তিনবার পড়লাম বাক্যটা। খানিক বাদে আবার পৃষ্ঠা উল্টে ফিরে এসে পড়লাম। আরো অনেকবার পড়লাম। বারবার ফিরে ফিরে আসতে হলো এই বাক্যটার কাছে।
এই সেরেচে, রিভিউ তো গড়গড়িয়ে লম্বা হয়ে যাচ্চে! আচ্ছা এবার সংক্ষেপে সারছি। রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী কারা? বিশেষত কবি রবীন্দ্রনাথের? রবীন্দ্রনাথ যখন কবিতা রচনা শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর আশেপাশে বলবার মতো বাঙালি কবির নাম একটাও ছিলো না। নিজে হাতে ইট পুড়িয়ে, বালি-সিমেন্ট মেখে, মজদুরি করে তিনি দাঁড় করিয়েছেন বাংলা কবিতার ভিত্তিমূল। তারপর? “রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক” নামের প্রবন্ধে দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথ নামক একদা আকস্মিক বজ্রপাত কীভাবে আজকে বাংলা কবিতার রক্তমাংসে মিশে গেছেন। তিনি সবকিছুতেই আছেন, থেকেও আছেন, না-থেকেও আছেন। “রবীন্দ্র-জীবনী ও রবীন্দ্র-সমালোচনা” নামের আরেকটি প্রবন্ধ পড়ে বুঝতে পারলাম, আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটাও ভালো জীবনী লেখা সম্ভব হলোনা ক্যানো! রবীন্দ্রনাথ নাকি নিজেই এর জন্যে দায়ী!
যারা ছন্দের ব্যাকরণ বিষয়ে জানেন না, তাদের কাছে “বাংলা ছন্দ” প্রবন্ধটি বিরক্তিকর মনে হতে পারে। সংকলনের এই একটি প্রবন্ধ আমার মতো আমজনতার জন্যে নয়। খুবই টেকনিক্যাল। কিন্তু সংকলনের শেষ দুটি প্রবন্ধ শেষপাতে ক্ষীরের চমচমের মতো (আমার ক্ষীরের চমচম পছন্দ তাই এটার নাম লিখলাম, আপনারা নিজের নিজের পছন্দের নাম বসিয়ে নিতে পারেন)। “সাংবাদিকতা, ইতিহাস, সাহিত্য” নামের প্রবন্ধে বুদ্ধদেব দেখিয়েছেন, ইনফরমেশন-সর্বস্ব আজকের এই জমানায় সাহিত্যের মধ্যেও পাঠক “ইনফরমেশন” খুঁজে চলেছেন। “সংবাদ” খুঁজে চলেছেন। “অমুক রচনাটি আজও প্রাসঙ্গিক”— নিজস্ব দেশকালের সঙ্গে তাৎক্ষণিক প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে চলেছেন। অসামান্য এই প্রবন্ধটির একদম শেষদিকে চোখে পড়লো সুগভীর একটি বাক্য : “ঠিক ততটুকুই আমরা উচ্চারণের অধিকারী, যতটুকু আমাদের উপলব্ধি, আর অধিকার অতিক্রম করবার প্রলোভন ত্যাগ করতে করতেই উপলব্ধির পরিধি বাড়ে।”
বইয়ের অন্তিম প্রবন্ধ “শিল্পীর স্বাধীনতা”-তে বুদ্ধদেব বসু একটি চমৎকার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন আমাদের দিকে। কোনও আদর্শ কিংবা মতবাদের ছাতার তলায় না এসেও, লাল নীল গেরুয়া কিংবা সবুজ রঙের পতাকা দিয়ে নিজের সত্তাকে মুড়ে না-ফেলেও, একজন শিল্পী নিজেকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন? সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ! — সকল পপুলার এবং ফেমাস রং ত্যাগ করে আমার যেটা রং, সেই রঙে নিজেকে রাঙাও। সংস্কৃত শ্লোকটা পড়ে প্রথমে মনে হয়, এই “আমি”টা হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর আমাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাঁকে অনুসরণ করতে। ভুল কথা! এই আমিটা তো আসলে আমি নিজেই। আমার পতাকার রং হবে আমার নিজের পছন্দের। সবচেয়ে ভালো হয়, এইসব পতাকা-ফতাকার ঝামেলাই না থাকলে!
.