রোজ কত মানুষ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। হারিয়ে যায়। রেলস্টেশনের দেয়ালে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবিসহ বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। বালক, যুবক, মাঝবয়েসি, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ, মহিলা, পুরুষ, মানসিক ভারসাম্যহীন। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ওয়েবসাইটের সর্বশেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যান দেখলাম, ২০১৯ সালে বেপাত্তা হয়ে গেছে চার লক্ষেরও বেশি মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আজ আর জীবিত নেই। এদের মধ্যে অনেকেই এখনও নিরুদ্দেশ, কারণ তাদের খুন করে ফেলা হয়েছে।খুন করার পরে কারো দেহ পুঁতে দেওয়া হয়েছে মাটির গভীরে। শহরের ভেতর লাশ পোঁতার উপায় নেই। সেখানে তো জায়গাই নেই। তাই পোঁতা হয়েছে শহরের উপকণ্ঠে। শহরের মানুষ বাড়ছে। জায়গা কমছে। শহরের উপকণ্ঠে গড়ে উঠছে উপনগরী। উপনগরীতে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গগনচুম্বী অট্টালিকা। নতুন অট্টালিকা বানানোর জন্য ভিত খনন করা হচ্ছে। ভিত খুঁড়তে গিয়ে পাওয়া গ্যালো আস্ত নরকঙ্কাল। রেলস্টেশনে নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিজ্ঞাপনে তো মুখের ছবি দেওয়া থাকে। তবুও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। নরকঙ্কালের মুখ কই?হালফিলের পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলা রহস্যকাহিনি/থ্রিলার আমি পড়ি না। পড়লে আমার একইসঙ্গে হাসি পায় এবং বিরক্ত লাগে। একমাত্র ব্যতিক্রম রাজর্ষি দাশ ভৌমিকের গোয়েন্দা কানাইচরণ সিরিজ। এর আগে এই সিরিজের প্রথম বই [b:কলকাতা নুয়া 53295778 কলকাতা নুয়া Rajarshi Das Bhowmik https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1588173875l/53295778.SY75.jpg 81308087] পড়ে আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-সৃষ্ট শবর দাশগুপ্ত চরিত্রটির কথা মাথায় রেখেও বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে যথার্থ পুলিশ-প্রোসিজুরাল গোত্রের রহস্যকাহিনি আজপর্যন্ত একটাও লেখা হয়নি। কানাইচরণ হলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপযুক্ত পুলিশি-গোয়েন্দা। এই সিরিজের নতুন বইটি পড়ে আমার মুগ্ধতা আগের বইটিকেও ছাপিয়ে গেছে।লেখকের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, কানাইচরণ চরিত্রটিকে তিনি বাস্তবসম্মতভাবে সৃষ্টি করেছেন। সকল চরিত্রদের চলাফেরা-কথাবার্তা, কাহিনির পটভূমিকা, অপরাধ ও অপরাধীর গতিপ্রকৃতি, সাসপেক���ট, মোটিভ ও অ্যালিবাইয়ের গোলকধাঁধা, এবং সবশেষে রহস্যসমাধানের প্রক্রিয়া, প্রতিটি ক্ষেত্রে রহস্যগল্পসুলভ টিপিক্যাল অতিনাটকীয়তাকে সচেতনভাবে বর্জন করেছেন লেখক। অথচ তার ফলে কাহিনির বাঁধুনি আলগা, কিংবা রহস্যের উপভোগ্যতায় ঘাটতি হয়নি। পুলিশের প্রকৃত কর্মপদ্ধতি ও তদন্তের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো যেরকম নিখুঁত ডিটেইলে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক, তা এককথায় বিস্ময়কর!উপন্যাসটা পড়া শেষ করে আমার মনে হয়েছে, রহস্যকাহিনির ছদ্মবেশে আসলে লেখক একটি সমসাময়িক বাস্তবসম্মত সামাজিক ভাষ্য রচনা করতে চেয়েছেন। পাঠশেষের মুগ্ধতা একটু ঝিমিয়ে এলে মনে একটা প্রশ্ন জাগে। [b:পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর 54448389 পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর Paiyya Firingi Dor Rajarshi Das Bhowmik https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1594265217l/54448389.SY75.jpg 84969463]-এর মতো ব্যতিক্রমী ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখেন যে-লেখক, সেই একই লেখক, পাশাপাশি অবলীলায়, কানাইচরণের মতো অভিনব গোয়েন্দাচরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন কীভাবে? এমন একটি দুর্দান্ত চরিত্র উপহার দেওয়ার জন্যে লেখককে আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই! অত্যন্ত সুলিখিত এই উপন্যাসটি নিয়ে আরো বেশি আলোচনা হওয়া জরুরি।“আমি ভাবি, ভবিষ্যতে কোনোদিন, আমাদের ধ্বংসও কি আমাদের মতোই ছাপোষা হবে?”
সামান্য কয়েকপৃষ্ঠার এই বইটা পড়ে (বই না বলে পুস্তিকা বলাই ভালো), কত যে ভাবনা আসছে মাথায়!
শ্রীজাত তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন,
“শঙ্খ ঘোষের ‘কবির বর্ম' গায়ে চাপিয়ে ঘুরে মরছি কলকাতায়...“
শঙ্খবাবু নিজেও অন্যত্র লিখেছেন,
“এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে !”
কাকে বলে “কবির বর্ম”?
“অনেকে ভুল বুঝবে, অনেকে ঠিক বুঝেই তাদের ভিন্ন রুচিগত কারণে আমাকে এড়িয়ে যাবে, অনেকে তাচ্ছিল্য ছুঁড়ে মারবে আমার মুখের ওপরে, সমূহ অকৃতজ্ঞতার ঝলক তুলেও চলে যাবে অনেকে...।”
তবুও, “থাকবে না কি এইটুকু বিনয় যে অন্যদের বলতে দাও তাদের নিজের মতো কথা, আমি বলবো শুধু আমারটা, যেটুকু আমি পারি?”
“দেখো, এই হচ্ছি আমি। এইটুকুই, এর চেয়ে বেশি নয়, কমও নয় এর চেয়ে। আর তারপর কে আমার কী বিচার দিল, সে শুধু তার দায়।”
এই বিনীত আত্মপ্রত্যয়কেই “কবির বর্ম” বলে, যা আমরা মাঝেমাঝে গায়ে চাপাতে বিস্মৃত হই।
এই বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধটি পড়ে আরো একবার উপলব্ধি করলাম— তিনি “নির্জনতম কবি” হওয়া সত্ত্বেও, “নিরালম্ব শূন্যতা”কে, শিশিরপতনের মতো অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে, জীবনযাপনের ক্লান্তিকে, নিজের কবিতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে বারবার তুলে ধরলেও, ক্যানো জীবনানন্দ দাশের “অনেক নিঃশব্দের মধ্যে গোপনে গোপনে জড়ো হয়ে আছে বহুতর আর্ত শব্দের উৎক্ষেপ”। এবং ক্যানো, শুধু গলাবাজি করে বিপ্লব বিপ্লব বলে চেঁচামেচি করলেই, গরম গরম ভাষণের আঘাতে চেয়ার-টেবিল-চায়ের গেলাস-বিস্কুটের বয়ম ভেঙে ফেললেই “বিপ্লবী” হওয়া যায় না।
তৃতীয় প্রবন্ধে রাইনার মারিয়া রিলকের “লেটারস টু এ ইয়ং পোয়েট” বইয়ের বক্তব্যের অনুষঙ্গে দেখিয়েছেন, কাউকে কিছু “উপদেশ” দেওয়ার কাজটা আসলে কতটা অবান্তর, অপ্রয়োজনীয়, যান্ত্রিক। কারণ,
“আমার যদি ইচ্ছে হয় প্রেমেরই কথা বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় প্রকৃতিতে যাই ; আমার যদি ইচ্ছে হয় সহজ কথা বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় দুরূহতায় যাই ; আমার যদি ইচ্ছে হয় অলংকারে বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় নিরাভরণ হই ; আমার যদি ইচ্ছে হয় ছন্দ দিয়ে বলি, আমার যদি ইচ্ছে হয় ছন্দ ছেড়ে যাই ; আমার জন্য নির্ধারিত পথ রাখেনি কেউ, আমারও পথে চাই না আমি কাউকে।”
প্রাণিত সুষমাময় গদ্যে এমন স্পষ্ট কথা শঙ্খ ঘোষ ছাড়া আর কে বলতে পারেন?
“মাঝে মাঝে লোকজনকে বেদম গাল দেবার জন্যে ভেতরটা চিড়বিড় করে ওঠে।”
কিন্তু সরাসরি গালিগালাজ করা তো সম্ভব নয়। ভেতরটা চিড়বিড় করে উঠলেও নয়। কারণ, একটা কথা আমরা সব্বাই মেনে নিয়েছি। যে-নর্দমায় আমরা বাস করি তার পোশাকি নাম “সভ্য সমাজ”। সভ্য সমাজে বাস করে একে-অপরকে গালিগালাজ করা যায় না, স্যার। কিন্তু... একটা কাজ করা যায়। একটা আয়না খাড়া করা যায় মানুষের সামনে। মানুষ তো নিজেরাই গালিগালাজ করে চলেছে অহরহ। তাদের সামনে যদি একটা আয়না রাখা যায়, তাহলে মাছও খাওয়া হবে, গলায় কাঁটাও ফুটবে না।
Vox populi, vox Dei. (জনতার কন্ঠ মানেই ঈশ্বরের কন্ঠ)
আহা, এমন একখান খাসা কথা দিয়ে শুরু করলেন তাঁর অভিধান। এমন একটি অভিধান, যেখানে নাকি তিনি সংগ্রহ করেছেন “প্রচলিত ধ্যানধারণা”-কে। “প্রচলিত ধ্যানধারণা” মানে? মানে সেই আয়নাটা, যার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ নিজেই নিজেদের গালি দেয়। জিজ্ঞেস করলে বলে, কেমন চুপ করিয়ে দিলাম বলো আয়নাটাকে? হুঁ হুঁ বাবা, চালাকি নয়, আমার নাম “জনতা”। আমার কন্ঠ মানেই ঈশ্বরের কন্ঠ। (গর্বের হাসি)
পুরোনো জিনিস (অ্যান্টিক) - আরে, ওগুলো সব হালে তৈরি !
শিল্প - কী কাজে লাগে বলুন? আজকাল তো যন্ত্রে ‘আরো ভালো ও দ্রুত' কাজ পাওয়া যায় !
হাই - হাই তুলেই বলতে হবে : ‘ইয়ে, মাপ করবেন, এটা বিরক্তি থেকে নয়, হজমের অসুবিধে থেকে'।
দাড়ি - গায়ের জোরের বাহ্যিক প্রমাণ। যারা দাড়ি রাখে তাদের গায়ের জোর বেশি। এবং তারাই প্রকৃত পুরুষ। বাকিরা সব মেয়েছেলে।
যুদ্ধ - সর্বদাই দুজন বিজয়ী হয় : বিজয়ী ও বিজেতা।
জন্তুজানোয়ার - অনেকেই মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমান !
সোনালি চুলের নারী (ব্লন্ড) - কালো চুলদের চেয়ে ‘উষ্ণ'।
কালো চুলের নারী (ব্রুনেট) - সোনালি চুলদের চেয়ে ‘উষ্ণ'।
ঝি (কাজের লোক) - ঝি মাত্রেই বজ্জাত !
বৌদ্ধধর্ম - ‘ভারতবর্ষের নকল ধর্ম'।
গ্রাম - সেখানে শৌচাগার নেই, সুতরাং কাপড় তুলে—
সারল্য - সব সময়ই ‘মুগ্ধ করে দেওয়ার মতো'।
ডাক্তারির ছাত্র - মড়ার পাশে খায়, মড়ার পাশে শোয়। কেউ কেউ মড়া খায়।
দুঃস্বপ্ন - পেট থেকে উৎপত্তি।
সেলিব্রিটি - এদের সম্পর্কে ঠেস দিয়ে কথা বলতে হবে। এদের ব্যক্তিগত ছিদ্রান্বেষণ করতে হবে।
অকৃতদার - কী দুঃখের জীবন এদের !
শ্যাম্পেন - ওটা তো পান করা হয় না, ‘গেলা' হয়।
চুল - ধুর, পরচুলা !
শল্যচিকিৎসক - এদের ‘কশাই' বলে ডাকতে হবে।
ক্লাসিক - সব্বাই পড়েছে বলে ধরে নিতে হবে।
অসতীর স্বামী - প্রত্যেক স্ত্রীর উচিত স্বামীকে চুতিয়া বানানো।
সংকলন (compilation) - এর চেয়ে সহজ বই লেখা আর হতে পারে না।
আরাম (comfort) - অমূল্য আধুনিক আবিষ্কার।
কোষ্ঠকাঠিন্য - লেখাপড়া জানা লোকমাত্রেরই এটা থাকে।
মিলন - অশ্লীল কথা !
শরীর - আমাদের শরীরের ভেতরটা যে কীভাবে তৈরি, জানা থাকলে নড়াচড়া করতে ভয় পেতাম।
বেশ্যা - আমাদের মেয়ে-বোনেদের রক্ষা করে, যতদিন তারা অবিবাহিত।
সমালোচক - সর্বদাই ‘খ্যাতনামা'।
৭৮ পৃষ্ঠার বই। মাত্র ৩৬ পৃষ্ঠা চলছে। এভাবে চললে রিভিউ অনেক বড় হয়ে যাবে। আচ্ছা, এবার শেষের দিক থেকে কয়েকটা খুঁজে বের করি, কেমন?
ওষুধ - যখন স্বাস্থ্য ভালো থাকবে তখন এটা নিয়ে ঠাট্টা করতে হবে।
বিষণ্নতা - উচ্চ মন আর বিশিষ্ট হৃদয়ের লক্ষণ।
ভোরে ওঠা - কেউ যদি ভোর চারটায় শুয়ে সকাল আটটায় ঘুম থেকে ওঠে তবে সে কুঁড়ে। কিন্তু কেউ যদি রাত নটায় শুয়ে ভোর পাঁচটায় ওঠে, তবে সে খুব কাজের লোক।
লেবেনচুষ - কেউ জানে না কী দিয়ে তৈরি !
জঘন্য - ‘জঘন্য !'
ইঞ্জিনিয়ার - এরা সর্বজ্ঞানের অধিকারী।
গালি দেওয়া - কী মিষ্টি কথা !
সাফল্য - ঘুম ছুটিয়ে দেয়।
রোগী - রোগীর মনোবল বাড়াতে হলে তার অসুখটিকে নিয়ে হাসাহাসি করতে হবে ও তার যন্ত্রণাকে অস্বীকার করতে হবে।
অঙ্ক - হৃদয়ের রস শুষে নেয়।
নিগ্রো - ওদের থুতুর রং সাদা, এটা কী করে সম্ভব হল?!
নিসর্গচিত্র - কয়েক থালা শাকসবজি !
চিন্তা করা - কষ্টসাধ্য ব্যাপার।
প্রগতি - এত দ্রুত হয়েছে যে লোকে ধরতেই পারেনি।
ভগবান - তাঁকে ছাড়া আমাদের চলবে কী করে?
ওহ, হাঁফিয়ে গেছি। আর না।
বলতে ভুলেই যাচ্ছিলাম ! এই অভিধানটি সংকলন করেছেন মাদাম বোভারি-র লেখক গুস্তাভ ফ্লবের। আমার কাছে যেটা আছে সেটা চিন্ময় গুহ-র করা বাংলা অনুবাদ। চমৎকার অনুবাদ করেছেন। বইটা নাড়াচাড়া করতে মাঝেমাঝে কেমন যেন ইয়ে লাগে। “কিছু কিছু বাক্যের সঙ্গে নিজের বক্তব্য হুবহু মিলে যায় !” আমিও তো একজন জনতা।
বলদ - বাছুরের বাপ। ষাঁড় হল গিয়ে তার কাকা।
নজর মেঘে ঢাকা
অঝোর শ্যাম
শ্রাবণ বারিধারা
ট্র্যাফিক জ্যাম।
মেজাজি অটোঅলা
ভেজা জিরাফ
কোথায় ধোঁয়া তোলে
চায়ের কাপ...
পুরো চা খেতে হবে।
কুরোসাওয়ার
বৃষ্টি মনে পড়ে।
থামে না আর।
এগোনো ভালো আজ
যে কোনও দিক—
বাতাসে দোল খায়
জলের চিক...
একা সে ঘুরে মরে
ফ্যাকাশে দিন
পাথরে মাথা রাখে
বোতলে জিন
পেরেকে গাঁথা হাত
ছেড়ে কে যায়
না এলে থাকে রোদ
এলে ভেজায়
শহরে নেমে এসো
বহো রে জল—
মানুষ খুঁজে ফেরে
চায়ের ছল...
আমার সবচেয়ে প্রিয় তিনজন রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পীর মধ্যে একজন হলেন দেবব্রত ওরফে জর্জ বিশ্বাস (অন্য দুজন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সাহানা বাজপেয়ী)। একইসঙ্গে কণ্ঠের দৃপ্ত মাধুর্য এবং আবেগের বিহ্বলতা, দেবব্রত বিশ্বাসের গানে যতটা অনুভব করা যায়, আর কারো গানে আমি অন্তত অনুভব করিনি। তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত গায়কীর অনুকরণ করা সম্ভবত পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটা। দেবব্রত বিশ্বাসের তাই কোনো উত্তরসূরী নেই। তিনি একলা। অদ্বিতীয়। এবং জীবৎকালে ছিলেন ব্রাত্য। ক্যানো ব্রাত্য ছিলেন?
রবীন্দ্রনাথের নিজের খাস-এলাকা শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতীর কতিপয় ইঁচড়ে পাকা এবং হিংসুটে “বিশেষজ্ঞ”, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের গানকে তালাচাবি দিয়ে বাক্সবন্দী করে রাখার সুবন্দোবস্ত করেছিলো। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উদযাপনের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান নতুনভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে। অজস্র গায়ক তাদের অসংখ্য রেকর্ডের মাধ্যমে বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলেছিলেন। ফলে, রবীন্দ্রসংগীতের একটা চওড়া বাজারমূল্য তৈরি হয়েছিল। বেচারা রবীন্দ্রনাথের সামগ্রিক সৃষ্টিসম্ভারের কপিরাইট যেহেতু ছিল তাঁরই নিজের হাতে গড়া বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের হাতে (ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে!), ফলে রবীন্দ্রনাথের লেখা বই হোক কিংবা গান, বিশ্বভারতীর ছাড়পত্র ব্যতীত বাজারে বেরোনো সম্ভব ছিল না।
এরকম অবস্থায় যেটা হওয়ার কথা ছিল, সেটাই হলো। বিশ্বভারতীর ছোট-বড়-মাঝারি ফুটোমস্তানরা দাদাগিরি দেখাতে শুরু করে দিলো। তারা গায়কদের গানের “ভুলত্রুটি” ধরতে শুরু করলো। এবং সেই ভুলত্রুটি সংশোধন না-করা পর্যন্ত সেই গানের রেকর্ড বাজারে ছাড়ার অনুমোদন দেওয়া বন্ধ হলো। কেমন ভুলত্রুটি? শুদ্ধতা বজায় রাখার যুক্তি দেখিয়ে, প্রথাগত স্বরলিপি অনুযায়ী রবীন্দ্রসংগীত না-গাইলে অনুমোদন দেওয়া হবে না, এই বিষয়টা তবু না-হয় মেনে নেওয়া গ্যালো। কিন্তু আরো কিছু “ভুলত্রুটি”-র দু-একটা নমুনা দেওয়া যাক। “গানের সঙ্গে অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, ফলে গানের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে”। “বড্ডো বেশি আবেগ দিয়ে গাওয়া হয়েছে গানটা, ফলে গানের গাম্ভীর্য নষ্ট হয়েছে”। “গানটির যে মূল বক্তব্য এবং দর্শন রয়েছে, গায়ক সেটা বোঝাতে পারেননি”। এছাড়া গানের মধ্যে ছোটবড় উচ্চারণের ত্রুটি তো আছেই। বোঝাই যাচ্ছে, গায়কদের উপর ছড়ি ঘোরানোর পন্থা ছাড়া এসব আর কিছুই নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কস্মিনকালেও এইসব ফালতু বিষয়ে কোনোরকম “নির্দেশ” কিংবা “আদেশ” দিয়ে যাননি। তিনি তো ফুটোমস্তান ছিলেন না।
শুধু নবাগত কিংবা অখ্যাত নয়, এমনকি প্রতিষ্ঠিত এবং স্বনামধন্য সংগীতশিল্পীদের উপর এভাবেই খবরদারি চলছিলো। ঝামেলা এড়ানোর জন্যে বেশিরভাগ শিল্পী এই ব্যবস্থা মেনেও নিয়েছিলেন। বিগ-ব্রাদারদের নেকনজরে থাকার জন্যে রবীন্দ্রসংগীত-শিল্পীদের জগতে একটা অস্বাস্থ্যকর রাজনীতি শুরু হলো। শিল্পীরা একে-অপরকে ল্যাং মারতে শুরু করলেন। দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন কিশোরগঞ্জের খাস-বাঙাল। তাঁর শিরদাঁড়াও ছিলো বাঙালসুলভ সোজা এবং শক্ত। বিশ্বভারতীওয়ালারা যখন তাঁর উপরেও খবরদারি করা শুরু করলো, তিনি রুখে দাঁড়ালেন। রবীন্দ্রসংগীতের শুদ্ধতা বজায় রাখার নামে এই হিটলারি বাঁদরামি তিনি বরদাস্ত করলেন না। ঘোষণা করলেন, তরা বইয়া বইয়া কাইজ্জা কর, গান আর আমি রেকর্ডই করুম না হালা! (ব্যক্তিগত আলাপচারিতা-কথোপকথনের ক্ষেত্রে তিনি “বাঙাল” ভাষা বর্জন করেননি আজীবন।)
তাঁর জনপ্রিয়তায় কিন্তু একচুল ভাঁটা পড়লো না। রেকর্ড না-হয় নাই-বা করলেন, কিন্তু অনুষ্ঠানে-মঞ্চে গাইবার জন্যে তো আর বিশ্বভারতীর লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই। মারাত্মক হাঁপানির রোগে সারাজীবন জর্জরিত ছিলেন। কিন্তু যতদিন বেঁচে ছিলেন, জাগতিক সমস্ত বাধাবিপত্তিকে কাঁচকলা দেখিয়ে রবীন্দ্রসংগীতের জগতে ছিলেন জ্বলন্ত সূর্যের মতো অধিষ্ঠিত। অন্য শিল্পীদের অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে শ্রোতারা রবীন্দ্রসংগীত শুনতে যেতো। কিন্তু দেবব্রত বিশ্বাসের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীত নয়, তারা যেতো “জর্জদার গান” শুনতে। আজকে সকালেও আমি যখন তাঁর কণ্ঠে “যেতে যেতে একলা পথে নিভেছে মোর বাতি” গানটা শুনছিলাম, একজন অভিমানী কিন্তু আপোষহীন মানুষের সংগ্রামের কথা চিন্তা করে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো!
এই বইটিতে তাঁর নিজের জীবনের কথা আছে খুবই কম। সেই অর্থে আত্মজীবনী বলা যায় না বইটিকে। বইয়ের লেখনীও বেশ খাপছাড়া। শুরুর দিকে বেশ একঘেঁয়ে লাগছিলো। রাবীন্দ্রিক-শাখামৃগদের সঙ্গে জর্জ বিশ্বাসের আজীবন সংগ্রামের কিছুটা আভাস পাওয়া যায় বইটা থেকে। এটাই এই বইয়ের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। একইসঙ্গে পাওয়া যায় রবীন্দ্রসংগীত বিষয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনার কথা। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার কথা। তাঁর জীবনদর্শন তাঁর গায়কীর মতোই আবেগদৃপ্ত কিন্তু উচ্চকিত নয়। সর্বার্থেই জর্জ বিশ্বাস একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। আজকে সকালে শোনা গানটির কথা আবারও মনে পড়ে যাচ্ছে। এই গানটি রবীন্দ্রনাথ যেন জর্জ বিশ্বাসের কথা মাথায় রেখেই লিখেছিলেন!
যেতে যেতে একলা পথে
নিবেছে মোর বাতি।
ঝড় এসেছে, ওরে,
এবার ঝড়কে পেলেম সাথি।
আকাশ-কোণে সর্বনেশে
ক্ষণে ক্ষণে উঠছে হেসে,
প্রলয় আমার কেশে বেশে
করছে মাতামাতি।
ইচ্ছে হলে এখানে গানটি শুনে নিতে পারেন। দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে এই গানটি ইউটিউবেও আছে, কিন্তু স্পটিফাই-এর এই ভার্শনটা আমার বেশি ভালো লাগে।
[একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাও এখানে উল্লেখ করে রাখি। কলকাতার “ব্রাত্যজন” নামক নাট্যদল-দ্বারা প্রযোজিত বিখ্যাত “রুদ্ধসংগীত” নাটকটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার (নাট্যকৃতি ও পরিচালনা - ব্রাত্য বসু)। সেই নাটকে দেবব্রত বিশ্বাসের ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদারের অসামান্য অভিনয়কে এই সুযোগে আরো একবার কুর্নিশ জানিয়ে রাখি। নাটকটা আমি দুবার দেখেছি। কেউ যদি কখনও কোনোভাবে “রুদ্ধসংগীত” নাটকটি দেখার সুযোগ পায়, সেই সুযোগ হাতছাড়া করাটা খুব বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ হবে। নাটকটির প্রযোজনা সম্ভবত এখন বন্ধ আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি আবার সুযোগ পাই, আমি আবার দেখবো।]
কোন্ মহান কমরেডের আমলে সোভিয়েত দেশের পতাকার রং বেশি রেড হয়েছিল, এই রিভিউতে সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করা নেহাতই অবান্তর। যেটা বান্তর (অবান্তরের বিপরীতার্থক শব্দ তো এটাই হবার কথা) সেটা হলো, উইকিপিডিয়া এবং আরো কিছু জায়গা থেকে আমি আরো কিছু কৌতুকভ্ খুঁজে পেয়েছি।
১. ক্রেমলিনের ভেতর ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা হয় কীভাবে?
সেখানে একটা সাইনবোর্ডে “যৌথ খামার” লিখে টাঙিয়ে রাখা হয়। ব্যাস, তাইলেই কাজ হাসিল হয়ে যায়। অর্ধেক ইঁদুর খেতে না-পেয়ে মারা যায়। বাকি অর্ধেক নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে পালিয়ে যায়।
২. কেজিবি-র সদর দপ্তর “লুবিয়াঙ্কা” হলো মস্কোর উচ্চতম বাড়ি। এই বাড়ির বেসমেন্ট থেকে সাইবেরিয়া দেখা যায়।
মৃত্যু-আঘাতে মরতে-মরতে
খড়কুটো হয়ে ঝঞ্ঝাবর্তে
ঘূর্ণমান,
তবু-যে খেলছি ভোঁ-ভোঁ কানামাছি,
জেনেও— দাঁড়িয়ে অতি কাছাকাছি,
দিনাবসান,
এত-যে দেখছি চুপিসার ঘুণ,
এখানে-ওখানে দ্রোহের আগুন
বহ্নিমান,
প্রতিটি প্রহারে ক্ষতবিক্ষত
এই-যে আমার ভীষ্মের মতো
শর-শয়ান,
তৃষ্ণার জল, ক্ষুধার অন্ন,
মাথা-উঁচু-করে রাখার জন্য
যে-উপাধান—
সেদিনও যেমন, এখনও সমানে
নিপুণ অমোঘ শরসন্ধানে
যিনি জোগান,
জানি, ভরা তাঁর অশেষ তূণীর,
তাই নিয়ে ফেরে তীর থেকে তীর
দৈবী যান।
কীর্তি বোঝাই সেই-যে নৌকো
আমি শুধু বেছে নিয়েছি চৌকো
সোনার ধান :
প্রতি তারে বাঁধা জীবনের বোধ,
ঘাতে-প্রতিঘাতে বাঁচার রসদ
গীতবিতান।
- কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়
আমি কবিতা লিখতে পারি না। কিন্তু কবিতা পড়তে ভালোবাসি। ইশকুলজীবন থেকে কবিতা পড়ে চলেছি। আজকে বিকালেও পড়লাম।
কবিতা আসলে কী? কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে আমি কোনোদিন ভাবিনি। বরাবর জানি, কবিতা তার শব্দ, অর্থ, ছন্দ, বার্তা, ইঙ্গিত, ইশারা, সবকিছু নিয়ে পাঠকের ব্যক্তিগত বোধের রাজ্যে চুপিসাড়ে প্রবেশ করে। আমি পাঠক, তখন এক অনির্বচনীয় অনুভূতি লাভ করি। কবিতাপাঠের অনুভূতির মতোই, কবিতার সংজ্ঞাও “অনির্বচনীয়”। ভাষায় তাকে বলে বোঝানো যাবে না। কবিতা হচ্ছে, মাকড়সার জটিল নকশায় বোনা তন্তুজালিকা। যাকে এমনিতে খালি চোখে দেখা যায় না। দৈবাৎ আলোর রশ্মি এসে তার উপর পড়লে, তাকে দেখা যায়। ব্যাস এটুকুই।
বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র “প্রতিদিন”-এর সঙ্গে প্রত্যেক রবিবার “রোববার” নামক একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বিনামূল্যে দেওয়া হয়। এখনও হয়। আগে এই ম্যাগাজিনটির সম্পাদক ছিলেন চিত্রপরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। তিনি মারা যাওয়ার পরে এখন সম্পাদনার কাজটি করেন বাংলা-ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দু-র গায়ক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। সত্যি কথা বলতে, এমন অভিনব এবং উপভোগ্য ম্যাগাজিন এই মুহূর্তে বাংলা ভাষায় একটাও নেই। এই ম্যাগাজিনেই ধারাবাহিকভাবে একদা একটি কলাম লিখতেন কবি জয় গোস্বামী। কলামটির নাম ছিল “গোঁসাইবাগান”।
বাংলা কবিতাকে বিশ্লেষণ করার কাজ এর আগে আরো অনেকেই করেছেন। রবীন্দ্রনাথ করেছেন। বুদ্ধদেব বসু করেছেন। জীবনানন্দ দাশ করেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় করেছেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় করেছেন। শঙ্খ ঘোষ করেছেন। এমনকি অমরেন্দ্র চক্রবর্তী (হীরু ডাকাত, শাদা ঘোড়া, আমাজনের জঙ্গলে, ইত্যাদি বইয়ের লেখক) বহুদিন আগে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন যার নাম ছিল “কবিতা-পরিচয়”। এই পত্রিকাটিতে বিভিন্ন বিখ্যাত কবিগণ অন্য কবির কবিতা নিয়ে আলোচনা করতেন। যেমন সুনীল আলোচনা করেছেন শক্তির কবিতা নিয়ে। কিংবা শঙ্খ ঘোষ আলোচনা করেছেন বুদ্ধদেব বসুর কবিতা নিয়ে। বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এই পত্রিকাটি।
ভূতপূর্ব এই সমস্ত কবিতা-আলোচনার সঙ্গে জয় গোস্বামীর গোঁসাইবাগানের একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। সারা পৃথিবীজুড়েই কবিতার পাঠকসংখ্যা সীমিত। বাংলা কবিতার পাঠকসংখ্যা তো আরো সীমিত। প্রায় নগণ্যই বলা চলে। এর আগের যে কবিতা-আলোচনাগুলোর কথা উল্লেখ করলাম, সেগুলো পড়লেই বোঝা যাবে যে, ওগুলো লেখা হয়েছিল কবিতাবোদ্ধাদের কথা মাথায় রেখেই। যেমন, বুদ্ধদেব বসু তাঁর “কালের পুতুল” বইতে জীবনানন্দ দাশ, সমর সেন, সুধীন দত্ত, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কিংবা অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা নিয়ে যে-আলোচনাগুলো করেছেন, সেগুলো “সাধারণ” পাঠকদের উদ্দেশ্যে নয়। তাঁর উদ্দিষ্ট পাঠক হলো, যারা কবিতা বোঝে। জয় গোস্বামীর এই লেখাগুলো কিন্তু শুধুমাত্র “বুঝদার” পাঠকদের জন্যে নয়।
মনে রাখতে হবে, যে-ম্যাগাজিনে জয় গোস্বামী তাঁর কলামটি লিখতেন সেটি একটি পাঁচমেশালি পত্রিকা। রবিবার ছুটির দিন পরিবারের সবাই পড়ে উপভোগ করতে পারে, সেই কথা মাথায় রেখে পত্রিকাটি নির্মাণ করা হতো/এখনও হয়। এমন একটি “সর্বজনভোগ্য” পত্রিকায় কবিতার মতো একটি বিষয়, যেটি সিংহভাগ পাঠকের পছন্দের বিষয় নয়, সেই বিষয়ে নিয়মিত কলাম লেখার কাজটি তো সবিশেষ ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কথা। আদপে কিন্তু এই কলামটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এবং একটানা বহুদিন প্রকাশিত হয়েছিল। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা কীভাবে ঘটলো?
কারণ, বুদ্ধদেব বসু কিংবা শঙ্খ ঘোষের মতো শুধুমাত্র কবিতাপ্রেমী পাঠকদের কথা চিন্তা করে জয় গোস্বামী এই লেখাগুলো লেখেননি। বরং উল্টোটা। লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যাবে, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সকলের মধ্যে কবিতাপাঠের আনন্দকে ছড়িয়ে দেওয়া। যারা জীবনে কোনোদিন স্ব-ইচ্ছায় কবিতা পড়েননি, কবিতায় রস খুঁজে পাননা, কবিতার “মানে” বুঝতে পারেননা, তেমন “বেরসিক” পাঠকের কাছেও পৌঁছে দিতে চেয়েছেন কবিতার সৌন্দর্যপ্রতিমাকে। একেবারে আটপৌরে ভাষায়, পন্ডিতি বর্জন করে, পরম সহানুভূতির সঙ্গে, তিনি বিভিন্ন কবির কবিতাকে বিশ্লেষণ করেছেন। কবিতার লাইন ধরে ধরে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, কবিতা আসলে “বোঝার” বস্তু নয়, উপলব্ধির বস্তু। সাবানের বুদবুদের মতো তাকে ধরতে গেলেই সে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু শান্তভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সেই বুদবুদে দেখা যাবে রামধনুর খেলা।
আর যারা ইতিমধ্যে কবিতা পড়তে ভালোবাসে, অর্থাৎ “অ্যাডভান্সড পাঠক”, তাদেরকেও তিনি নিরাশ করেননি। পরিচিত, সুপরিচিত কবিদের কবিতাকে যেন নতুন আঙ্গিকে চিনতে পারা যায় এই লেখাগুলো পড়লে। এবং কত যে অপরিচিত, স্বল্প-পরিচিত, বিস্মৃত কবির লেখা কবিতার উল্লেখ রয়েছে এতে! এইসব ভুলে-যাওয়া মণিমুক্তোগুলো গোঁসাইবাগানের অন্যতম বড় সম্পদ। এই মুহূর্তে বই ঘেঁটে খুঁজে বের করতে আমার ইচ্ছে করছে না। অনুপ মুখোপাধ্যায় নামের একজন অপরিচিত কবির লেখা অলংকারহীন, সোজা, সাদামাটা, চারটে লাইন খুলে আছে চোখের সামনে। এটুকুই লিখে রাখি আপাতত।
তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে রয়েছিকত ভোরএক ঘন্টা দশ ঘন্টা একশো বছরখুশির এমন চাপ মনে হয় জলে ডুবে আছি ...
অনেক আগের কথা। বাড়িতে “দেশ” পত্রিকা নেওয়া হতো বটে কিন্তু আমি সেটা পড়তাম না। আমি পড়তাম আনন্দমেলা আর কিশোরভারতী। মা “দেশ” পড়তো। খেয়াল করতাম পত্রিকা হাতে নিয়ে মা প্রথমেই পড়ে ফেলতো “বাগর্থকৌতুকী” নামের ছোট একটা ধারাবাহিক কলাম। পড়তে পড়তে মায়ের মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠতো। আমি আড়চোখে মা-কে দেখতাম। কলামটাও নেড়েচেড়ে দেখতাম, কিসুই বুঝতাম না। কী সব হিবিজিবি লেখাপত্তর...
চিরুনি তল্লাশি থেকে ইঁদুর দৌড়
মাল তুলতে প্রেস্টিজে গ্যামাকসিন
ইশে মানে— যে আর কী বুঝলেন না জয়গুরু
গণ্ডেরিরাম বাটপারিয়া হেশোরাম হুঁশিয়ার পাজঞ্জরিতে তিরিতঙ্ক লাগে
‘কোনও ব্যাপার না' ‘ওকে'
দেখো মগর প্যার সে
অবজ ধেচুয়া ঘোঙা
ঢাক ঢাক গুড় গুড়, গুড় গুড় ঢাক ঢাক
এত ভংগ বংগ দেশ তবু রংগে ভরা
চমকানোর কিছু নেই, এগুলো হলো বইটির কতিপয় অধ্যায়ের নাম। সেই হিবিজিবি কলামটি যে এত সুস্বাদু, এবং পড়তে পড়তে আমার মুখেও কখন যেন নিজের অজান্তে মুচকি হাসি চলে আসছে, এইসব অনেক পরের ঘটনা। “বাগর্থ” = বাক্ + অর্থ। বাক্ মানে কথা। অর্থ হচ্ছে সেই কথাটির মানে। একটা ছাড়া অন্যের অস্তিত্ব নেই। আমার নাম অরূপ। শব্দটির আক্ষরিক অর্থ - রূপ নেই যার, কুৎসিৎ (অভিধানে এই মানেটাই প্রথমে উল্লেখ করা আছে)। কিন্তু সত্যিই যদি অরূপ মানে কুৎসিৎ হতো, তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ গান লিখতেন - “অরূপ তোমার বাণী, অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক সে আনি”...?
আক্ষরিক অর্থকে পেরিয়ে গেলে পাওয়া যাবে শব্দটির প্রকৃত অর্থ। অভিধানেই আছে, অরূপ মানে - “নিরাকার”। নিরাকার মানে, যে জিনিসটা আছে ঠিকই, অথচ তাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না (আমাকে যদিও চোখে দেখা যায় বলেই জানি)। ঠিক তেমনি, বাংলা শব্দভাণ্ডারে এমন অসংখ্য শব্দ আছে যাদের বাক্ এবং অর্থ নিয়ে কৌতুক করা শুরু করলে কৌতুকের পাহাড় জমে যাবে। কৌতুক মানে আসলে কিন্তু ফাজলামি কিংবা নিছক ঠাট্টা নয়। কৌতুক শব্দটা এসেছে সংস্কৃত “কুতুক” শব্দ থেকে। কুতুক মানে কৌতূহল। বোঝাই যাচ্ছে, কৌতূহল না থাকলে কোনো কিছু নিয়ে আমোদ কিংবা ঠাট্টা করার অধিকার জন্মায় না।
মানুষের সৃষ্ট সবচেয়ে আশ্চর্য বস্তু হলো ভাষা। “বাগর্থ” হলো ভাষার মাথার মুকুটের সবচেয়ে মূল্যবান মণি। একটা ভাষা তৈরিই হয় শব্দ দিয়ে, আর সেই শব্দের অর্থ দিয়ে। তারপর আসে ব্যাকরণ, হ্যানা ত্যানা। জ্যোতিভূষণ চাকী ছিলেন বহুভাষাবিশারদ। বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত, হিন্দি, পালি, উর্দু, ফারসি, ইত্যাদি ভাষাতেও পারদর্শী। আমাদের বাংলা ভাষার হজমশক্তি তো নেহাত কম নয়। পৃথিবীর নানা ভাষার শব্দভান্ডার থেকে শব্দ গ্রহণ এবং আত্তিকরণ করে বসে আছে আমাদের বাংলা ভাষা। আত্তিকরণ মানে বেমালুম হজম করে ফেলা। এমনকি এই “হজম” আর “বেমালুম” শব্দদুটোও মূলত আরবি ভাষা থেকে এসেছে। তো, ঐশ্বর্যমণ্ডিত এই যে বাংলা শব্দভাণ্ডার, এতে লুকিয়ে আছে কত যে আমোদ, কত মজা, কত কৌতুক, কত মুচকি হাসি, তার কিছুটা উপলব্ধি ঘটে এই বইটা পড়লে।
রোজকার খবরের কাগজ, হরেকরকম বইপত্র, কতরকম অভিধান, দৈনন্দিন মুখের ভাষা, আরো বিবিধ উৎস থেকে লেখক শব্দ (কিংবা শব্দগুচ্ছ) সংগ্রহ করেছেন। তারপর নেড়েচেড়ে দেখেছেন সেইসব শব্দের উৎস, ব্যুৎপত্তি, প্রয়োগ। শব্দের মাঝে ঘাপটি মেরে থাকে শুধু তো সেই শব্দের অর্থ নয়। কতরকম বিপত্তি, কতরকম ত্রুটি, কতরকম ভ্ৰান্তি, কতরকম “হলদে সবুজ ওরাং ওটাং”। ভাষা কিংবা শব্দ নিয়ে এত মজাদার আলোচনা বাংলায় আমার খুব বেশি চোখে পড়েনি। একজন বহুভাষাবিদের পক্ষেই সম্ভব শব্দতত্ত্বের মতো একটা রসকষহীন বিষয়কে এমন মুচকি হাসিতে রূপান্তর করা।
খুব সামান্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন, রোজকার কথায় মুদ্রাদোষ। যেটা আমাদের সব্বার আছে। কথার মাঝে কেউ বারবার বলে, “ইয়ে”— তো যেটা বলছিলাম, ইয়ে, টাকাটা এনেছো? আমার মানে, ইয়ে, পকেট একদম, যাকে বলে, ইয়ে, গড়ের মাঠ। কিংবা বলে, “চিন্তা করুন”— আমি ওকে, চিন্তা করুন, কত বোঝালাম, কিন্তু আমার কথায়, চিন্তা করুন, কানই দিলো না, সংসারের হাল, চিন্তা করুন, ওকেই তো ধরতে হবে, চিন্তা করুন? কিংবা বলে, “তোমার”— আমি তোমার, ক্রিকেটটা তেমন ভালোবাসিনে, ক্রিকেট তোমার, বড্ডো একঘেয়ে, আর ফুটবল তোমার, উত্তেজনায় ভরা! এরকম আরো অনেক আছে। “কী বুঝলেন?”, “ঠিক কিনা?”, “বললে বিশ্বাস করবেন না”, “good”, “very good”, “হলো গিয়ে”...।
- কাল ফিরলাম।
- good
- মা-কে সঙ্গেই এনেছি।
- good
- এখন থেকে আমার সঙ্গেই থাকবেন উনি।
- good
- বাবা হঠাৎ মারা গেলেন কিনা।
- good good.
এক পিশেমশাই এতবার “ইশে” বলতেন যে তার নামই হয়ে গেছিলো ইশেমশাই!
১৯৩৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত, মাত্র বারোবছর-ব্যাপী লেখা সমর সেনের কবিতার পরিচয় দেওয়ার জন্যে খুউব পুরাতন ক্লিশে হয়ে পচে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে এমন একটা শব্দ ব্যবহার করতে ইচ্ছে করছে : “আধুনিক”!
আরো একটা বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে ইচ্ছা করছে, যেটা খুব বেশিদিন হয়নি বাংলা শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করেছে, কিন্তু এখনই বুড়ো হয়ে গেছে : “স্মার্ট”।
সমর সেনের কবিতা শুরু হয়েছে বিষণ্ণ প্রেমিকের ইউনিফর্ম শরীরে চাপিয়ে। তাঁর প্রেম কখনোই বর্তমানের জ্যান্ত নরম স্পর্শে (এমনকি সেই স্পর্শের স্বপ্নেও) পুলকিত নয়। অতীতের ধুলোধূসরিত দ্বিপ্রাহরিক সরু পথরেখার মতো ম্লান।
অন্ধকারের মতো ভারি তোমার দুঃস্বপ্ন,তোমার দুঃস্বপ্ন অন্ধকারের মতো ভারি।
ভুলে-যাওয়া গন্ধের মতোকখনো তোমাকে মনে পড়ে।হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাসআর মেঘের কঠিন রেখায়আকাশের দীর্ঘশ্বাস লাগে।“নগরজীবনের ক্লান্তি”। এই কথাটা বারবার বলা হয়েছে সমর সেনের কবিতার পরিচয় দিতে গিয়ে। এই ক্লান্তি জীবনানন্দের ম্লান-চোখ-তুলে-তাকানো অসহায়তার ক্লান্তি নয়। এই ক্লান্তি আক্রোশে হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যুবক-কবির নতুন নতুন উপলব্ধিজাত নাগরিক ক্লান্তি।বর্তমানে মুক্তকচ্ছ, ভবিষ্যৎ হোঁচটে ভরা,মাঝে মাঝে মনে হয়,দুর্মুখ পৃথিবীকে পিছনে রেখেতোমাকে নিয়ে কোথাও সরে পড়ি।
মৃত্যু শুনেছি শেষ কথা নয়,কালস্রোতে ভেসে আসে নবীন জঞ্জাল,আবার সঙ্গোপনে ঘরে রহস্যভরে বিড়ি ধরেবালক বংশধর,তারো পরে টেরি কেটে কাব্য পড়েজানায় অমর প্রেম বখাটে যুবক।
সংসার খালি;দূর ছাই, কিছু ভালো লাগে না,সঙ্গীহীন বুড়ো ভাবে সন্ধ্যায় :সমাজ বদলেছে অনেক, নিরুপায়,নইলে হে হরি,এ বয়সে মন্দ লাগত না আর একটি কিশোরী।পরবর্তীকালে বামপন্থী “ফ্রন্টিয়ার” ম্যাগাজিনের কিংবদন্তিসম দাপুটে সম্পাদক হতে চলেছেন যিনি, সেই সমর সেনের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটি কিভাবে ধীরে ধীরে রূপধারণ করছে, তার পরিচয়ও পাওয়া যায় এই বইয়ের অনেক কবিতায়। দেশ তখনও পরাধীন। পতপত করে উড়ছে দুর্ভিক্ষের কালো পতাকা। ক্রোধ নয়, প্রতিবাদ নয়, নিপাট তাচ্ছিল্য এসে জমাট বেঁধেছে কবির কলমে।দুকোটি ক্ষুধার অভিশাপসংহত বাঙলা দেশে।চোরে চোরে মাসতুতো ভাই,নিবিড় মিতালি মহাজন ও শকুনে।দুর্দিন রপ্তানি কিছুদিন বন্ধ করএদেশে, হে দেব ! ক্ষান্ত কর দাক্ষিণ্য দারুন।
ভবলীলা সাঙ্গ হলে সবাই সমান—বিহারের হিন্দু আর নোয়াখালির মুসলমাননোয়াখালির হিন্দু আর বিহারের মুসলমান।
বইয়ের একদম অন্তিম কবিতাটি সমর সেনের কাব্যদর্শনের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করে। (কবিতার বইয়ের স্পয়লার হয়? হলে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।)
শুনি না আর সমুদ্রের গান থেমেছে রক্তে ট্রামবাসের বেতাল স্পন্দন। ভুলে গেছি সাঁওতাল পরগনার লাল মাটি একদা দিগন্তে দেখা উদ্যত পাহাড়, বাইজীর আসরে শোনা বসন্তবাহার। ভুলে গেছি বাগবাজারী রকে আড্ডার মৌতাত, বালিগঞ্জের লপেটা চাল, আর ডালহাউসীর আর ক্লাইভ স্ট্রিটের হীরক প্রলাপ,ডকে জাহাজের বিদেশী ডাক। রোমান্টিক ব্যাধি আর রূপান্তরিত হয় না কবিতায়।যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে । বছর দশেক পরে যাব কাশীধামে ।।
এর পরে আর কোনোদিন কবিতা লেখেন নি তিনি।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম-সার্ধশতবার্ষিকী চলছে। তাই স্থির করেছি এবছর তাঁর সমস্ত লেখা আবার পড়ে ফেলবো একটু একটু করে। এটা তাঁর প্রথম বই। আয়তনে সবচেয়ে ছোট বইও বটে। বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা - পনেরো মিনিট।
গল্পটা খুবই পরিচিত। মহাভারতের থেকে নেওয়া গল্প। একই গল্প নিয়ে কালিদাস নাটক লিখেছিলেন - অভিজ্ঞানশকুন্তলম্। কালিদাসের ভার্শনে প্রাপ্তবয়সোচিত উপাদান আছে প্রচুর। খোকাখুকুরা পড়বে বলে অবন ঠাকুরের বইতে সেসব নেই। গল্পটা হলো, একজন মানুষের দ্বারা আরেকজন মানুষ কিভাবে অহেতুক উপেক্ষিত হচ্ছে।
“অবন ঠাকুর ছবি লেখেন”, অর্থাৎ কেবলমাত্র শাব্দিক বর্ণনার মাধুর্যেই যেন চোখের সামনে একটা চিত্রশিল্প দেখতে পাওয়া যাচ্ছে - অবনীন্দ্রনাথের এই ট্রেডমার্ক বৈশিষ্ট্যটা তাঁর প্রথম বইতেই চিনে নেওয়া যায়। কিন্তু উপভোগ্য হয়ে ওঠেনা। কেমন যেন বিরক্ত লাগে এত এত বর্ণনার সমাহার। যদিও শুধু এই বইটার ক্ষেত্রেই এই বিরক্তির কথাটা প্রযোজ্য। তাঁর পরের বইগুলো তো দারুন দুর্দান্ত!
#অবনঠাকুর_১৫০
জাপানি সংস্কৃতির মতো অভিনব সংস্কৃতি এই দুনিয়ায় আর একটা নেই। চারুশিল্প কিংবা সৃজনশিল্পের হরেক নমুনা তো পৃথিবীতে রয়েছে। অঙ্কন, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, আরো কত কি। কিন্তু, ফুল সাজানোর শিল্প “ইকেবানা”, কিংবা বড় গাছকে উদ্ভিদবিদ্যাগত উপায়ে ছোট সাইজের বানিয়ে ফেলার শিল্প “বনসাই”, কিংবা ভাঁজ-করা পাতলা কাগজের হাতপাখার উপর সূক্ষ্ম উডব্লক-প্রিন্ট ও ক্যালিগ্রাফি করার শিল্প “সেনসু”, এসব জিনিস জাপানিরা ছাড়া আর কেউ ভাবতে পারেনি। সামান্য চা খাওয়াকেও তারা একটা সৃজনশিল্প বানিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে তাদের যে-শিল্পটা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে তার নাম “অরিগামি”।
ছোটবেলায় ইশকুলে পড়ার সময় কাগজের নৌকা কিংবা কাগজের এইরোপ্লেইন কে না বানিয়েছে? কিন্তু তবু, কাগজ ভাঁজ করে যে আরো কত কত জিনিস বানানো যায়, এই বিষয়টার ব্যাপ্তির আন্দাজ আজকের দিনেও খুব বেশি মানুষের নেই। ১৯৮০ সালে (বইটা যখন প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল) তো আরো ছিলো না। নারায়ণ সান্যাল একজন আশ্চর্য মানুষ ছিলেন। কতো ভিন্ন ভিন্ন বিচিত্র বিষয়ে যে তিনি কেতাব লিখেছেন! (আচ্ছা, তাঁর ব্যাপারে আরেকদিন বলা যাবে)। তাই বলে “অরিগামি” বিষয়েও বই লিখেছেন তিনি, ভাবা যায়? এলেবেলে বই নয়, রীতিমত বিস্তারিত গবেষণাসমৃদ্ধ বই। যেখানে নিজের হাতে ছবি এঁকে এঁকে তিনি শিখিয়েছেন অরিগামি মডেল বানাবার উপায়। আজকের দিনে ইউটিউবের কল্যাণে এই বইটির মূল্য হয়তো আর কিছুই নেই। কিন্তু আজ থেকে অনেক বছর আগে (ভুলে গেছি কত বছর আগে) আমি যখন প্রথম এই বইটির সংস্পর্শে এসেছিলাম, একটা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত আনন্দময় জগতের দরজা খুলে গেছিলো আমার সামনে!
শুধুমাত্র একটুকরো কাগজ দিয়ে কি কি জিনিস বানানো সম্ভব? মাছ, উড়ন্ত ঈগল, শুকরছানা, উড়ন্ত সারস পাখি, টিয়াপাখি, পেলিক্যান, রাজহংস, বাইসন, মোরগ, কুকুর, সিংহ, অক্টোপাস, ব্যাঙ (যেটা আবার নাচেও), ঘোড়ায় চড়া বেদুইন, ময়ূর (যার পুচ্ছটি গুটিয়েও রাখা যায়), দাড়িয়ালা রামছাগল, আরো অনেক অনেক অনেক কিছু। এমনকি, পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অরিগামি-মাস্টার বলা হয় যাঁকে, সেই আকিরা যোশিযাওয়া, কাগজ ভাঁজ করে নিজের সেল্ফ-পোর্ট্রেট বানিয়েছিলেন! এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখা আবশ্যক। অরিগামি মানে কিন্তু শুধুই কাগজ-ভাঁজ-করা। কোনো আঠার ব্যবহার নয়, কাঁচির ব্যবহার নয়। শুধু একটুকরো কাগজ, দুটো হাত, আর উৎসাহ। এর বাইরে কিছু ব্যবহার করলে সেটাকে অরিগামি বলা যাবে না।
একসময় খুবই উৎসাহিত ছিলাম অরিগামি নিয়ে। ইশকুলের বার্ষিক প্রদর্শনীতে সবাই যখন সেই একঘেঁয়ে থোড়-বড়ি-খাড়া সায়েন্স-মডেল, ইলেকট্রনিক্স মডেল, থার্মোকলের মডেল, কিংবা দেশলাই কাঠি দিয়ে আল্পনার মডেল বানাতো, তখন, বলতে একটু লজ্জাই লাগছে, রঙিন কাগজ দিয়ে বানানো আমার অরিগামি মডেলগুলো দেখতে সবচেয়ে বেশি মানুষ ভিড় করতো। এখন আর ততটা উৎসাহ নেই। কিন্তু পুরোনো বই গোছাতে গিয়ে আজকে সকালে যখন এই বইটা হাতে পড়লো, দমকা হাওয়ার মতো চোখের সামনে ভেসে এলো : ঘরময় লাল-নীল-হলুদ-সবুজ কাগজের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে, সারাটা দুপুরবেলা আমি মগ্ন হয়ে ভাঁজ করে বানাবার চেষ্টা করছি একটা কাগজের কাঠবেড়ালি। বিকেলবেলা মা আমার ঘরে ঢুকে কাঠবেড়ালিটা দেখে বেশি খুশি হলো নাকি আমার খুশিতে উজ্জ্বল মুখটা দেখে, বলা মুশকিল।
সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের বিষয় সেটা হলো, বাইরের দুনিয়ায় রাজশেখর বসুর ইমেজ ছিলো তাঁর লেখা গল্পের একদম উল্টো। তিনি নাকি ছিলেন ভয়ানক গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। তাঁর মুখে হাসি দেখতে পাওয়া ছিলো বেগতিক বিরল ঘটনা। তিনি কথা বলতেন কম। যেটুকু বলতেন তাতে রসিকতার বাষ্পটুকুও থাকতো না। এমন একজন গেরামভারি মানুষের কলম দিয়ে, রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদ কিংবা বিখ্যাত বাংলা অভিধানের জন্ম হলো, আচ্ছা তা নাহয় বোঝা গ্যালো, কিন্তু এতগুলো উপভোগ্য সরস গল্প কিভাবে বেরোলো?
বাংলা সাহিত্যে রাজশেখর বসু ওরফে পরশুরামের আগেও সরস সাহিত্য রচিত হয়েছিলো অনেক। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কিংবা প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় কিংবা সুকুমার রায় ততদিনে রসসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। কিন্তু তবুও, ১৯২৪ সালে রাজশেখর বসুর প্রথম হাসির গল্পের বই “গড্ডলিকা” প্রকাশ হওয়ার ঘটনাটিকে গোটা বাংলা সাহিত্যের নিরিখে একটা ‘ওয়াটারশেড মোমেন্ট' বলা যেতে পারে। কারণ, স্বয়ং চলন্তিকা অভিধানের স্রষ্টা যদি সবকিছু বাদ দিয়ে হাসির গল্প লেখেন, তাহলে রসসাহিত্য যে জাতে উঠে যাবে তা তো বলাই বাহুল্য।
জাতে উঠেও গ্যালো। রাজশেখরের কর্মস্থল বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিমোহিত হয়ে লেখককে পত্র দিলেন : “তোমার বই খুলিয়া পড়িতে পড়িতে আমি এই বৃদ্ধ বয়সে হাসিতে হাসিতে choked হইতেছি”। রবীন্দ্রনাথ পত্র দিলেন : “লেখার দিক হইতে বইখানি আমার কাছে বিস্ময়কর”। এই বিস্ময়ের স্রোত কিন্তু থেমে যায়নি। একের পর এক অনবদ্য হাসির গল্প উপহার দিয়ে গেছেন গোমড়ামুখো রাজশেখর। একটা কথা আছে, যে হাসতে জানেনা সে বাঁচতেও জানেনা। তাহলে বলতে হয়, রাজশেখর বসুর হাসির গল্পের ভাণ্ডার বাঙালিকে বাঁচতে সাহায্য করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ।
রাজশেখর বসুর হাসির গল্পের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলতে হলে প্রথমেই বলতে হয় এর ভাষার কথা। রাজশেখরের গল্পের ভাষা নির্মেদ, ভাবাবেগবিহীন। পাঠককে জোর করে হাসানোর জন্যে তাঁকে কাতুকুতু দিতে হয়নি। স্রেফ চরিত্রনির্মাণ এবং ঘটনাবর্ণনার সাহায্যেই তিনি হাসিয়ে গেছেন। হাসির গল্পের একটা অন্যতম উপাদান হলো, মানবজীবনের অসঙ্গতি কিংবা খাপছাড়া ঘটনাগুলো। কিন্তু খাপছাড়া বিষয় দেখানোর জন্য রাজশেখর কাউকে খোঁচা কিংবা গুঁতো দেননি। তাঁর হাস্যরসকে এই কারণেই প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন “ইন্টেলেকচুয়াল লাফটার”।
প্রায় শ-খানেক হাসির গল্প লিখেছিলেন পরশুরাম। বেশিরভাগ গল্পেই দেখা যায় শহুরে প্রেক্ষাপটে শহুরে মানুষদের কীর্তিকলাপ। কখনও মারোয়াড়ি ব্যবসায়ী রবীন্দ্রনাথের উক্তি আওড়ান : “বৈরাগ সাধন মুক্তি সো হমার নহি”। কখনও রোগীর জিজ্ঞাসায় বিরক্ত ডাক্তার জবাব দেন : “যদি বলি তোমার পেটে ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলস হয়েছে, কিছু বুঝবে?” কখনও “এক্সকিউজ মি প্রভু, আপনি কি জিসস ক্রাইস্টকে জানতেন?” এই প্রশ্নের উত্তরে ত্রিকালদর্শী মহাত্মা সাধু বলেন : “হাঃ হাঃ যিশু তো সেদিনকার ছেলে!” আবার এই কথা শুনে আরেকজন অবাক হয়ে মন্তব্য করেন : “ইনি তাহলে গৌটামা বুডঢাকেও জানতেন?”
যাই হোক, পরশুরামের হাসির গল্পের বিশ্লেষণ এই সীমিত পরিসরে করা যাবে না, আমার দ্বারা সম্ভবও নয়। সবচেয়ে ভালো হয় তাঁর গল্পসমগ্র জোগাড় করে ফেলা। তারপর একটার পর একটা গল্প তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। তবে, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বলি। আগাগোড়া সমস্ত গল্প পরপর পড়ে যাওয়া উচিত হবে না। যেহেতু পরশুরামের গল্পের প্রেক্ষাপট এবং চরিত্রদের মধ্যে খুব বেশি বৈচিত্র্য নেই, তাই একাদিক্রমে পড়তে গেলে একঘেঁয়ে লাগতে পারে। মাঝেমাঝে একটা-দুটো গল্প চেখে দেখাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
বুজেচ?আজ্ঞে হাঁ।ছাই বুজেচ।
বিশাল ভরদ্বাজ পরিচালিত “ওমকারা” ছবিটি দেখার সুবাদে “ওথেলো”-র কাহিনি আগে থেকেই জানা ছিলো। কিন্তু শেক্সপিয়ারের সৃষ্টি তো শুধু কাহিনির ঘেরাটোপেই আটকে থাকে না। দুটো লাইনের ফাঁকে গুঁজে দেওয়া থাকে চিন্তার অদৃশ্য খোরাক। শুধু কাহিনি জানলেই ভদ্রলোককে পুরোপুরি চেনা যাবে না, তাঁর নাটক পড়াও একটা বিশেষ অভিজ্ঞতা।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন :
“ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।”
এই অসুখটার নাম ঈর্ষা। ভুল হোক ঠিক হোক উচিৎ হোক অনুচিৎ হোক বোকামি হোক গাধামি হোক, অসুখ তো বটে। (ঈর্ষা তো অনেকরকম হতে পারে। ঈর্ষা বলতে এই রিভিউতে আমি যৌন-ঈর্ষা বুঝিয়েছি। শেক্সপিয়ারও তা-ই বুঝিয়েছেন)। এমন সময় আসে যখন ভালোবাসার দহন আর ঈর্ষার দহন একসঙ্গে জ্বলতে থাকে। দুটো শিখা আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। ঈর্ষার রং দেওয়া হয়েছে সবুজ, যেটা বোধহয় ঠিক নয়। ঈর্ষার রং গনগনে লাল।
ওথেলো নাটকটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে এই ঈর্ষাকেই তুলে ধরা হয়েছে আবহমানকাল যাবৎ। আরো একটা বিষয় আছে এই নাটকে, যেটা প্রায় সমান গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কম আলোচিত। বেশি আলোচিত বিষয়টা নিয়ে আগে দু-চারটে কথা বলে নেওয়া যাক।
নাটকে ইয়াগো নামক একটি চরিত্র আছে যাকে খলনায়ক উপাধিতে ভূষিত করা হয়ে থাকে। আমার যদিও মনে হয়েছে, ইয়াগো আমাদের মনেরই একটা রূপক অংশ। আমরা নিজেদের যতই সাধুপুরুষ ভেবে, মুচকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে, নিশ্চিন্তে বসে থাকার ভান করি না ক্যানো, আমাদের ভেতরের প্রত্যেকজন খলনায়ককে আমরা খুব ভালোভাবেই চিনি। চিনেও মুখ ঘুরিয়ে থাকি। পাখি, প্রজাপতি, ফুল, আকাশ... উদাসনয়নে এইসব দেখি। যতক্ষণ না সেই আকাশ আমাদের মাথায় ভেঙে পড়ে, ততক্ষণ পর্যন্ত।
ইয়াগো তার মনিব ওথেলোর হৃদয়ে ছলে-বলে-কৌশলে ঈর্ষার বীজ বুনে দেয়। ওথেলো কি জানতো না তার বিবেচনায় ভুল হচ্ছে? সে যে ঈর্ষার দংশনে বুদ্ধিভ্রষ্ট হতে চলেছে, জানতো না? অবশ্যই জানতো। কিন্তু ঈর্ষা একটা অদ্ভুত বস্তু। সে আগেই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। তারপর কারণ খোঁজা শুরু করে। শেষমেশ সে “কারণ” খুঁজে বার করবেই করবে। দরকার হলে কারণ ম্যানুফ্যাকচার করবে। তবু কারণ তার চাই-ই চাই! মনের ভেতর ঈর্ষা তার আগুন জ্বালিয়ে অপেক্ষা করে, আর মানুষ সেই অগ্নিতে নিজেই নিজেকে আহুতি দেয়।
Othello : Think on thy sins.(Think of your sins.)
Desdemona : They are loves I bear to you.(My only sin was loving you too much.)
আচ্ছা বেশ, এবার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাতে আসা যাক। তা হলো বর্ণবাদ (Racism)। নাটকের নায়ক ওথেলো একজন কৃষ্ণাঙ্গ। তাকে “moor” নামে অভিহিত করা হয়েছে নাটকে। তখনকার দিনে moor শব্দের অর্থ আজকের “আফ্রিকান” শব্দের প্রায় সমান। ওথেলো যদিও সমাজে একজন সম্মাননীয় পুরুষ, তবু তার উদ্দেশ্যে কালা আদমি (black man), কালা মূর (black moor), কালো ভেড়া (black ram), পুরু-ঠোঁট (thick-lips), এইসকল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
ওথেলো-র স্ত্রী ডেসডেমোনা কিন্তু সম্ভ্রান্ত পরিবারের শ্বেতাঙ্গিনী কন্যা। বর্ণবাদের একটা অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মানসিক-শিরদাঁড়াটি বাঁকিয়ে দেওয়া। যাদের বর্ণবাদের শিকার হতে হয়, একটা সময় তারা সত্যিই নিজেদের হীন ভাবতে শুরু করে। অযোগ্য ভাবতে শুরু করে। এমনকি আজকের দিনেও বর্ণমিশ্রিত (interracial) বৈবাহিক সম্পর্ককে taboo হিসেবে ধরা হয়। (আমি এখন ভোরবেলা ছাদে বসে এই রিভিউটা লিখছি। হঠাৎ কানে আসছে একটা ছোট্ট টুনটুনি পাখি তারস্বরে ডাকছে। রবার্ট স্যাপোলস্কি-র লেখায় পড়েছিলাম, পাখিদের ডাক আমাদের কানে যতই মধুর শোনাক না ক্যানো, আসলে সেটা তাদের ঈর্ষাজনিত চিৎকার।) যাই হোক, যেটা বলছিলাম...। আজকের দিনেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে চারশো-কুড়ি বছর আগেকার সমাজে (“ওথেলো” লেখা হয়েছিল ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দে) এই নাটকের সামাজিক অভিঘাত ক্যামোন হতে পারে?
ক্যামোন হতে পারে সেটা আন্দাজ করার জন্যে তখনকার নয়, বরং এখনকার সমাজ থেকে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন আপার্টহাইট জমানা চলছিলো, তখন সেখানে “ব্যাভিচার আইন” (Immorality act) নামের একটা কানুনি ব্যবস্থা ছিলো। কোনো কালো মানুষ যদি সাদা মানুষের সঙ্গে প্রেমজ-মেলামেশা করার সাহস দেখাতো, তখন সেই কালো মানুষটিকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হতো এই আইন মোতাবেক। এবার ঘটনা হলো, ১৯৮৭ সালে (এই তো, মাত্র ৩৫ বছর আগে!) দক্ষিণ আফ্রিকায় যখন আপার্টহাইট ব্যবস্থা মধ্যগগনে, তখন জোহানেসবার্গ শহরের বিখ্যাত “মার্কেট থিয়েটারে” ওথেলো নাটকের একটি প্রযোজনা অভিনীত হয়।
জনৈক জন কানি, যিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ, তিনি ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ডেসডেমোনার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জোয়ানা উইনবার্গ, যিনি একজন শ্বেতাঙ্গিনী। নাটকের অভিনয় শেষে ওথেলোর ভূমিকায় অভিনয়কারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের কারণ? “অ্যাতোজন সম্ভ্রান্ত শ্বেতাঙ্গ দর্শকের সামনে তুই মঞ্চে ডেসডিমোনাকে চুম্বন করেছিস! তাকে আলিঙ্গন করেছিস! দর্শকদের মুখ বিরক্তি আর ঘেন্নায় কুঁচকে গ্যাছে! এতবড় সাহস তোর হয় কীভাবে?? চল ব্যাটা তোকে মজা দেখাচ্ছি!”
এবার দুটো প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে যাদের উত্তর আমি এখনও খুঁজছি। এক, তখনকার চরম বর্ণবাদগ্রস্ত সমাজে ওথেলো নাটকের অভিনয় কীভাবে সম্ভব হতো? ওথেলো নাটক লেখার পশ্চাতে শেক্সপিয়ারের প্রকৃত ভাবনাটি কী ছিলো? শুধুই ঈর্ষা নামক গরলের প্রদর্শন? নাকি অন্য কিছু? দুই, শেক্সপিয়ার কি এটা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে ওথেলো যেহেতু হীন-মনোবৃত্তিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন, তার আত্মমর্যাদার অভাবই কি তার ঈর্ষার পিছনে আসল কারণ? ডেসডেমোনা যে তার কপালে জুটেছিলো, এটা কি সে হজম করতে পারেনি? মানুষ কি সেটাই হজম করতে পারে যেটা সে হজম করার যোগ্য? যোগ্যতার বাইরে কিছু প্রাপ্তি ঘটলেই কি তার হজমের গোলমাল দেখা দ্যায়?
Othello : Her name, that was as fresh as Dian's visage, is now begrimed and black as mine own face.(Her reputation was as pure as the snow, but now it's as dirty and black as my own face.)
আমার কথাটি ফুরলো (আরো অনেক কথা ছিলো, কিন্তু জায়গা কোথায়?), এবার নটে গাছটা মুড়িয়ে দেবার আগে আমি যে সংস্করণটি পড়েছি তার ব্যাপারে সামান্য কিছু কথা বলা জরুরি। আমি “No Fear Shakespeare” সংস্করণ থেকে এই নাটকটা পড়েছি। এই সংস্করণগুলোর বিশেষত্ব হলো, বাঁ-দিকের পৃষ্ঠায় মূল নাট্যাংশ দেওয়া থাকে, ডানদিকের পৃষ্ঠায় থাকে সেই নাট্যাংশের আধুনিক ইংরিজি “অনুবাদ”। এলিজাবেথীয় যুগের ইংরিজি ভাষা এবং প্রাক-আধুনিক ইংরিজি সাহিত্য বিষয়ে যারা আমার মতো “বিশেষ-অজ্ঞ”, তাদের কাছে এই সংস্করণগুলো একটা আশীর্বাদ-স্বরূপ, এই কথা তো বলাই বাহুল্য। তাছাড়া, একইসঙ্গে দুবার পড়া হয়ে যায় নাটকটা। এই কারণে এটা শেষ করতে সময়ও বেশি লেগে গ্যালো আমার।
দু'হাত দিয়ে আড়াল করা আলোর শিখাটুকুযখন তখন কাঁপার মতন তুমি আমার গোপন,তার ভেতরেও ঈর্ষা আছে, রেফের মতনতীক্ষ্ম ফলাছেলেবেলার মতন জেদীএদিক ওদিক তাকাই তবু মন তো মানে নাভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।
খেতে ভালোবাসতেন সুকুমার রায়। খেতে যারা ভালোবাসে তারা খাওয়াতেও ভালোবাসে। প্রতি সোমবার সুকুমারের গড়পারের বাড়িতে গুণীজনের সাহিত্য-আড্ডা বসতো। আড্ডার নাম ছিল “Monday Club”, যেহেতু সোমবারের আড্ডা। কিন্তু আড্ডার পাশাপাশি খাওয়াদাওয়ার বহর এতোই প্রবল হয়ে ওঠে যে সেই ক্লাবের নাম পাল্টে হয়ে যায় “মন্ডা ক্লাব”। সেই সুকুমার যে একদিন “খাই খাই” লিখবেন তাতে আর আশ্চর্যি কিসের?
যারা সুকুমারকে শুধুই “ননসেন্স” পদ্যের লেখক হিসেবে গণ্য করেন, এই বইটা পড়লে তাদের ভুল ভাঙবে। এই বইয়ের ছড়াগুলোতে ননসেন্স নয়, বরং সেন্সের ছড়াছড়ি রয়েছে (আরে! শিবরামের মতো কথা বলে ফেললাম যে!)। প্রথম যে ছড়াটি, “খাই খাই”, এটি বাংলা ভাষার ব্যবহারযোগ্যতার অনবদ্য পরিচয় দেয়। কিভাবে? শুধুমাত্র “খাওয়া”— এই ক্রিয়াপদটা ব্যবহার করে আটান্ন লাইনের একটা আস্ত ছড়া লিখেছেন সুকুমার। খাওয়া মানে কি শুধুই ভোজন? আরো কত কি যে খায় মানুষ। মহাজন সুদ খায়। দারোগা ঘুষ খায়। পালোয়ান ডিগবাজি খায়। তেলে জলে মিশ খায়। “ভয় খেয়ে খাবি খায় পাঠশালে ছেলেরা”। কেউ বেত খায়, কেউ গালি খায়। খোকা কাঁদলে মা চুমু খায়। আরো কত কত কত খাওয়ার ফিরিস্তি আছে এই পদ্যে। কিন্তু সুকুমারের ম্যাজিক শুধু ফিরিস্তি দিয়েই থেমে যায়নি। তাঁর অসম্ভব উচ্চমার্গীয় কল্পনাশক্তি এবং ছন্দসৃষ্টির পারদর্শিতা একে অপরের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। দুনিয়ার সকল মহার্ঘ্য বস্তুর মতো এই ছড়াটার মর্মও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু কখনও অবকাশমতো তলিয়ে ভাবলে অবাক হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কত শক্তিশালী আমাদের এই বাংলাভাষা, কত শক্তিশালী এই ভাষার কারিগররা। কত ভাগ্যবান আমরা।
আরো অনেকগুলো ছড়া আছে এই বইতে। প্রতিটা ছড়াই সরস মাধুর্যে টলমল করছে। আর, ছন্দের সে কি বাহার! জলের মতো সহজ কিন্তু সন্দেশের মতো উপাদেয়। অথচ গভীরতায় অনন্য। অনেকেই বলেন সুকুমার শুধুই ছেলেভোলানো হাসির ছড়া লিখেছেন (সেদিন একজায়গায় দেখলাম অক্ষয় মালবেরির লেখক মণীন্দ্র গুপ্তও এই কথা বলছেন। অন্য কেউ হলে ব্যাটা আহাম্মক বলে গালি দিতাম। শুধু অক্ষয় মালবেরি লিখেছেন বলে গুপ্তমশাইকে ছাড় দিলাম)। যারা এমন কথা বলেন, তারা কি “জীবনের হিসাব” (যেখানে বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই এবং নিরক্ষর বৃদ্ধ মাঝির কথোপকথন রয়েছে), কিংবা “নিঃস্বার্থ” (যেখানে মানবচরিত্রের নির্লজ্জ হিপোক্রিসির বিষয়টি হাস্যরসের মোড়কে পরিবেশন করা হয়েছে), কিংবা “হিংসুটিদের গান” (সুকুমারের লেখা শ্রেষ্ঠ ছড়াগুলোর অন্যতম, ছড়ার বিষয়বস্তুটি ছড়ার নামকরণেই প্রকাশিত)— এই ছড়াগুলো কি তারা পড়েন নি?
যাই হোক, অনেক কথাই তো বলে ফেললাম। আবোল তাবোল কিংবা হযবরল-র পাশাপাশি এই বইটা নিয়েও আরো বেশি বেশি আলোচনা হওয়া উচিত। আমার মতো জানলা খুলে বাইরে তাকিয়ে পাড়াপ্রতিবেশীর সুখশান্তিকে নিছক অগ্রাহ্য করে সন্ধেবেলা গলা ছেড়ে আবৃত্তি করা উচিত :
ভাবলে গাধা—এই তো মনিব জল হয়েছেন হেসে এইবারে যাই আদর নিতে কোলের কাছে ঘেঁষে। এই না ভেবে এক্কেবারে আহ্লাদেতে ক্ষেপে চড়ল সে তার হাঁটুর উপর দুই পা তুলে চেপে। সাহেব ডাকেন ‘ত্রাহি ত্রাহি' গাধাও ডাকে ‘ঘ্যাঁকো' (অর্থাৎ কিনা ‘কোলে চড়েছি, এখন আমায় দ্যাখো!')
তারপর? তারপর কী হলো?
আধ্যাত্মিকতা, ঈশ্বরচিন্তা (কিংবা নিরীশ্বরচিন্তা), নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের বিশ্বাস ও চেতনার বিবর্তন বিষয়ক এই একটা “দার্শনিক উপন্যাস” লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্করহিত এই উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে কী যে বিরক্ত লেগেছে!
মানুষের চরিত্র এবং জীবনের পরিস্থিতি ও মূল্যবোধকে বিষয়বস্তু করে লিখিত রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলো যখন পড়ি, তাদের প্রাঞ্জল, পরিমিত এবং realistic প্রকাশশৈলীর জাদুতে মুগ্ধ হই। গল্পগুলো পড়লে বোঝা যায়, তাদের নির্মাণের পশ্চাতে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার একটি জোরালো প্রেক্ষাপট আছে। চরিত্রগুলো জ্যান্ত।
অথচ, দু-তিনটে বাদ দিয়ে তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাস পড়তে গিয়ে ঠিক উল্টোটা ঘটে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের পটভূমি, চরিত্র, ঘটনানির্মাণ, সবকিছুই কেমন যেন কষ্টকল্পিত, কৃত্রিম। আইডিয়ার গভীরতা আছে, কিন্তু কাহিনি এবং চরিত্রনির্মাণে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতার ছোঁয়া পাইনা। দার্শনিক আইডিয়া বিতরণ করা আর উপন্যাস রচনায় তো পার্থক্য আছে।
Verbosity'র দ্বারা জর্জরিত ন্যারেটিভ এবং মেকি কথোপকথনের মারপ্যাঁচে সাজানো এইরকম খান-চারেক “অন্য ধারার” উপন্যাস লিখেছিলেন গুরুদেব— কী যে লিখেছেন, কী যে বোঝাতে চেয়েছেন, উপন্যাসের অন্তিমে কী যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, অবাস্তব উদ্ভট এই চরিত্রদের জোগাড়ই বা করেছেন কোথা থেকে... ভগাই জানে!
একটা বিশেষ দরকারে এই বইটা খুঁটিয়ে পড়তে হয়েছ��ল। সেই কাজ মিটেছে, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জীবনে বইটার প্রয়োজন খারিজ হয়ে যায়নি। শুধু আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে নয়, বোধহয় পৃথিবীর কোনো দেশেই ইশকুলের পড়াশুনায় মনোবিদ্যা সংক্রান্ত কিছুই শেখানো হয়না। অথচ শেখানো উচিত। ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, বিজ্ঞানের মতোই বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই ছেলেমেয়েদের মনোবিদ্যার পাঠ দেওয়াটা যত দিন যাচ্ছে তত বেশি জরুরি হয়ে উঠছে। “নিউট্রন বোমা বোঝ, মানুষ বোঝ না!”
মানুষের মন তো ব্রহ্মাণ্ডের মতো রহস্যময়। বিষয় হিসেবে বিজ্ঞানের অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত শাখার তুলনায় সাইকোলজি এখনও বেশ পিছিয়ে রয়েছে। বিভিন্ন তত্ত্ব এবং মতামতের পারস্পরিক বাদানুবাদের এখনও মীমাংসা হয়নি। কিন্তু মনোবিদ্যা যে আসলে আজগুবি ভেল্কিবাজির চর্চা নয় (যেমনটা আজ থেকে শ'খানেক বছর আগেও মনে করা হতো), বাকি সব বিজ্ঞান-বিষয়ের মতোই এই বিষয়ের সিদ্ধান্তগুলোকে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, এই ব্যাপারটা আজকের দিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বিষয় হিসেবে মনোবিদ্যা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। কতো কিসিমের মানুষই না আছে এই পৃথিবীতে। আর তাদের কতো কিসিমের মন। অন্য মানুষের কথা বাদ দিলাম, আমার নিজের মনের ভিতরেই কতোরকমের টানাপোড়েন, বৈসাদৃশ্য, বৈপরীত্য, পাগলামি, দুর্বোধ্যতা, দ্বিচারিতা। মাঝে মাঝে মনে হয়, অন্যকে চিনবো কীভাবে, নিজেকেই তো ভালোভাবে চিনতে পারলাম না এখনও। আমি নিজেই নিজের কাছে সবচেয়ে বেশি অচেনা। মানুষের মনের পাকদন্ডীর এই জটিল রুটম্যাপকে মনোবিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে কব্জা করার চেষ্টা করছেন। খুব সামান্যই পেরেছেন, কিন্তু যতটুকু পেরেছেন, তাতেই আশ্চর্য হতে হয়!
কেউ যদি আধুনিক মনোবিদ্যার প্রাথমিক ধারণা এবং সমকালীন অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চায়, চমৎকার প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা এই বইটা তাদের খুব কাজে লাগবে। এই বই পড়ার পরে সত্যি সত্যি আমার মনে হয়েছে, ইশ আগে যদি টের পেতাম, দরকার হলে বাড়িতে ঝগড়া করে হলেও এই বিষয়টা নিয়েই পড়াশুনা করতাম। অবশ্য ঝগড়া করেও কোনো লাভ হতো না। চিৎকার চ্যাঁচামেচি তো করেছিলাম যথেষ্ট
আমি প্রথম শার্লক হোমস পড়েছিলাম চুরি করা টাকায়, ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়। কার পকেট মেরেছিলাম, কীভাবে মেরেছিলাম, এইসব বৃত্তান্ত আপাতত “ক্লাসিফায়েড” থাকুক। কিন্তু একটা বিষয় অনুধাবন করতে পেরেছিলাম— বই কেনার জন্যে হাতসাফাই খুবই তৃপ্তিদায়ক একটি কাজ। চুরির টাকায় কেনা বইটিতে শার্লকের ছোটগল্প এবং উপন্যাস সমস্তকিছু একটা খণ্ডেই আঁটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। অনুবাদক ছিলেন নচিকেতা ঘোষ (কামিনী প্রকাশনী)। অনুবাদটা ভালো ছিল না।
তারপর পড়েছিলাম “তুলি-কলম” থেকে প্রকাশিত শার্লকের সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলা অনুবাদ। অনুবাদকের নাম মণীন্দ্র দত্ত। অনুবাদের মান আগেরটার চাইতে ভালো ছিল। ততদিনে শার্লক হোমসের মহিমা আমি বেশ ভালোমতোই ধরে ফেলতে পেরেছি। একই কাহিনি একাধিকবার পড়লেও আশ মিটছে না। দ্য হাউন্ড অভ দা বাস্কারভিলস উপন্যাসটা সারাজীবনে আমি বোধহয় দশবার পড়েছি।
মূল ইংরিজি লেখাগুলো পড়েছিলাম কলেজে পড়ার সময়। প্রায় সবক'টা গল্পই আগে থেকে পরিচিত থাকায় ইংরিজি রচনাশৈলী উপভোগ করতে আরেকটু বেশি সুবিধে হয়েছিল। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সেই প্রথম আমি বুঝতে পারি, বাঙালি অনুবাদকরা তাঁদের অনুবাদে বেশ খানিকটা জল মিশিয়ে রেখেছেন। কোনো লাইনকে আক্ষরিকভাবে বঙ্গায়িত করার প্রচেষ্টায়, কিংবা আপন মনের মাধুরী মেশানোর চক্করে, শার্লক হোমসের প্রকৃত চেহারা পুরোপুরি সফলভাবে ফুটে ওঠেনি। অনুবাদে অনুবাদ-অনুবাদ গন্ধ রয়ে গেছে।
শার্লকের যে-বাংলা অনুবাদটা পড়ে প্রথম পুরোপুরি তৃপ্তি পেয়েছিলাম সেটা হলো মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা “বাস্কারভিলস”-এর অনুবাদ। তারপরে পড়লাম মানবেন্দ্রবাবুরই “দ্য সাইন অভ ফোর”-এর অনুবাদ। দুঃখের বিষয় তিনি শার্লকের আর কোনো অনুবাদ করেননি। বাঙালি শার্লকপ্রেমীদের জন্যে সেই অভাব পূরণ করে দিয়েছেন দ্য গ্রেট অদ্রীশ বর্ধন মশাই।
বেঙ্গল পাবলিশার্স নামে অধুনা-বিলুপ্ত একটি প্রকাশন সংস্থা ছিল। অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদে শার্লকের সমস্ত রচনা পাঁচটা আলাদা খণ্ডে পাওয়া যেত। আমার কাছে প্রথম চারটে ছিল। সে-ই পুরোনো লেটারপ্রেসে ছাপা বই। কিন্তু পঞ্চম খণ্ডটা বহু খুঁজেও জোগাড় করতে পারিনি। অসম্পূর্ণ সেই সেটটা আলমারিতে মাঝে মাঝে দেখতাম আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়তাম। আমার বোন আমার এই ফোঁস ফোঁস শব্দে হতাশ দীর্ঘশ্বাসের কারণটা জানতো।
বছর সাতেক আগে এক ভাইফোঁটায় আমার বোন কাগজে মোড়ানো বেশ ভারী একটা উপহার দিলো আমাকে। হাতে নিয়েই বুঝেছিলাম বই, কিন্তু মোড়ক খুলে আমার খাদের ধারে দাঁড়ানো প্রফেসর মরিয়ার্টির মতো হতভম্ব অবস্থা। লালমাটি প্রকাশন থেকে সদ্য প্রকাশিত খুব চমৎকার দুই খণ্ডে অদ্রীশ বর্ধনের অনুবাদ করা শার্লক হোমস সমগ্র! ভাইফোঁটার অনুষ্ঠান, খাওয়া দাওয়া, সবকিছু মাথায় উঠলো।
অদ্রীশ বর্ধনের কাজটাই আমার পড়া শার্লকের সবচে ভালো বাংলা অনুবাদ। বাংলা রহস্য এবং সায়েন্স ফিকশন সাহিত্যের জগতে অদ্রীশবাবু নিজেই এক একক প্রতিষ্ঠান। শার্লক ছাড়াও তিনি জুল ভার্নের সব রচনা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। এডগার অ্যালান পো-র সমস্ত কাহিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। ফাদার ব্রাউনের গল্পের অনুকরণে তৈরি করেছেন ফাদার ঘনশ্যাম নামের একটি চরিত্র। বিশাল আয়তনের “কথাসরিৎসাগর” বইয়ের পুরোটা অনুবাদ করেছেন (তাঁর এই কাজটি খুব বেশি পরিচিতি পায়নি)। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায় হোমসের অনুবাদই তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ। এই দুর্দান্ত কাজটিকে লালমাটি প্রকাশন যথাযোগ্য সম্মান দিয়ে প্রকাশ করেছে।
প্রত্যেক শার্লকপ্রেমীই সিডনি প্যাজেট-এর অলংকরণের কথা জানেন। এছাড়া বিলিতি দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছেন। লালমাটি প্রকাশনের এই বইটিতে পুরোনো সেইসব অলংকরণ এবং আনুষঙ্গিক আরো অনেক কিছু পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। ফলে বইটির নান্দনিক মূল্য এক লাফে অনেকটা বেড়ে গেছে। এছাড়া নতুন এই সংস্করণের আরো একটি আকর্ষণ আছে।
এমনিতে কোনো বইতে খুব বেশি টীকাটিপ্পনী আমার ভালো লাগেনা। শার্লক এবং অদ্রীশ বর্ধন যুগলবন্দীর এই নতুন সংকলনে প্রচুর প্রচুর প্রচুর টীকা সংযোজিত হয়েছে। টীকাগুলো আমার খুব কাজে লেগেছে। শার্লক-সমকালীন পুরোনো ইংল্যান্ডকে জানতে (ইতিহাস এবং ভূগোল— দুই দিক দিয়েই) ; তৎকালীন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, যেগুলোর সঙ্গে গল্পের যোগসাজশ রয়েছে ; কিংবা একটি গল্পকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে সাহায্য করা, ইত্যাদি সবকিছু বিবেচনা করলে এই টীকাগুলো খুবই উপাদেয় বস্তু। প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত এবং সৌম্যেন পাল প্রশংসনীয় এবং পরিশ্রমী কাজ করেছেন।
যদি কেউ বাংলা ভাষায় তৃপ্তিসহকারে শার্লক হোমসের গল্প-উপন্যাস উপভোগ করতে চান, চোখ বন্ধ করে এই সংস্করণটি বেছে নিতে পারেন। অনুবাদের মুনশিয়ানা, অলংকরণের প্রাচুর্য, দৃষ্টিনন্দন গ্রন্থনির্মাণ— সব দিক দিয়ে এই সংস্করণটি দুর্দান্ত। সবার শার্লক-পাঠ আনন্দময় হোক!
(“শার্লক হোমসের মৃত্যু”, সিডনি প্যাজেটের অলংকরণ)
পড়েছিনু বহুদিন তরে
সবুজ মলাট দেওয়া কেতাবখানি খুলে,
হয়েছি সওয়ার যে কতো, গল্পের তরীটি বাহিয়া—
আজি তাহা গিয়াছিনু ভুলে।
গ্রীষ্মের দাবদাহে চিত্ত মোর যবে
ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে দিবানিশিভরি,
পরশে হরষ জাগে যেই ক্ষণে উল্টাইয়া পৃষ্ঠা
খান-তিনেক গল্প আমি পড়ি।
কিংবা যদি গগনে-গগনে ডাকে দেয়া
অপরাহ্নে গুরু গুরু রবে,
হাম্বাগণ ধায় নিজ গৃহপানে দৌড়াদৌড়ি করি ;
বাতায়নে বসি আমি, এই গ্রন্থ পাঠ করি নীরবে।
উতলা পরাণ মম, সোয়েটার অঙ্গে জড়াইনু
শীতে যবে ঠকাঠক দন্তপাটি কাঁপি কাঁপি উঠে,
পারদের চিহ্ন যায় রসাতলে নামি, সেই দিনে—
এই বই ঠাঁই লয় মম দুই শীর্ণ করপুটে।
উৎসবে, আনন্দে, ঝগড়া-হাঙ্গামায়, কিংবা
বারো মাসে পার্বণ যে আছে চোদ্দোখানি,
অথবা যেদিন ঘোর স্যাডনেস ঘাড়ে চাপি ব'সে,
শেলফ হইতে স্যাট্ করে এই গ্রন্থ নিয়েছিনু টানি।
দিবস বহিয়া যায়, মাস যায়, বৎসরও ঘোরে—
পিছে পিছে খুব সন্তর্পনে ;
দাড়ি মোর পাকে, হেয়ারলাইন প্রশস্ত হয় নিশ্চুপে,
এ বই পড়িলে তবু নিজেরে ছোকরা লাগে দর্পণে!
কত শত অদ্ভুত চরিত্ররা আনাগোনা করে, আর
প্লটের বাহার হেরি হিয়া মম উল্লাসে মারে লম্ফ,
কিবা গল্প রচি গেলে সুকুমারপুত্র তুমি, আহা
তব পার্শ্বে বাকি সব লাগে যেন কর্কশ জগঝম্প!
আজি এই শুভদিনে পিতার ভবনে বসি
কায়মন সমর্পিয়া তব লাগি পরম যতনে,
তোমারে সেলাম করি মহারাজ, এই রিভিউটি—
রবীন্দ্রের নকল মারি লিখিয়াছে অরূপরতনে।
নোবেল পুরস্কারের যে-দুটো ক্যাটেগরির দিকে প্রতিবছর আমার বেশি নজর থাকে তা হলো সাহিত্য এবং অর্থনীতি। এই বছর দুটো বিভাগের পুরস্কারই আমাকে হতাশ করেছে (যদিও, সাহিত্য বিভাগে হতাশার ব্যাপারটা আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে)। সাহিত্যে যিনি পুরস্কার পেয়েছেন, সেই হান কাং-এর মাত্র একটাই বই পড়েছি (“The Vegetarian”) এবং সেই বইটি ছিল গতবছর আমার পড়া সবচেয়ে ফালতু বই। কিন্তু অর্থনীতির পুরস্কারের খবরটা শুনে ঠিক হতাশ নই, হতভম্ব হয়েছি। মূলত দুটো কারণে।
প্রথম কারণটা সংক্ষেপে বলে দেওয়া যাবে। অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় নতুন আবিষ্কৃত কিংবা আলোচিত কিংবা দিকনির্দেশিত কোনো তত্ত্বের জন্য। এই বছরের পুরস্কৃত তত্ত্বটির মূল বিষয়বস্তুকে বাংলায় একটা লাইনে লিখে ফেলা যায় : একটা দেশ কতটা উন্নতি করবে সেটা নির্ভর করে সেই দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি কতোটা স্বাধীনভাবে, সক্রিয়ভাবে ও মানবকল্যাণমূলকভাবে কাজ করতে সমর্থ হয়, তার উপরে। খুবই অভিনব এবং এক্কেবারে নতুন আবিষ্কৃত একটি তত্ত্ব, তাই না?
বইটা যখন পড়েছিলাম তখন এই তত্ত্বটিকে শুধু বস্তাপচা বলেই মনে হয়নি, মনে হয়েছিল তত্ত্বটি পুরোপুরি ঠিকও নয়। রাষ্ট্রের উন্নয়নের কারণ খোঁজার কাজটা বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। আধুনিক অর্থনীতি বলবে, এই অনুসন্ধানের সূচনা হয়েছিল অ্যাডাম স্মিথের জমানা থেকে। কিন্তু কারো যদি কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ব্যাপারে মোটামুটি ধারণা থাকে, তিনি সময়টা আরো এক-হাজার বছর পিছিয়ে দিতে দ্বিধা করবেন না। একটু কমন সেন্স থাকলেই বোঝা যায়, রাষ্ট্রের উন্নয়নের পিছনে একটা-দুটো নয়, অনেকগুলো কারণ কাজ করে। এবং সবকটা কারণকেই যে অর্থনৈতিক হতে হবে এমনটা মোটেই নয়।
এই বইটিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটার নাম extractive, যারা রাষ্ট্রের অল্পকিছু ধান্দাবাজ মানুষের জন্য কাজ করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে শোষণ করে। আরেকটার নাম inclusive, যারা গণতান্ত্রিকভাবে কাজ করে এবং হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থের উদ্দেশ্যে নয়, বরং আমজনতার কথা ভেবে কাজ করে। এই একটিমাত্র অতিসরলীকৃত তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বইয়ের লেখকরা সাড়ে-চারশো-পৃষ্ঠাব্যাপী ক্রমাগত বকবক করে গেছেন (এবং অজস্র তথ্যকে “চেরি-পিকিং” করে গেছেন)। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্য থেকে আধুনিক উত্তর-আমেরিকার অর্থনৈতিক উন্নতির অজস্র উদাহরণ দেখিয়েছেন। এবং বলতে চেয়েছেন, নৃতাত্ত্বিক কিংবা ভৌগোলিক কিংবা ঐতিহাসিক কোনো কারণ নয়, একটি দেশের উন্নতির পিছনে তাঁদের এই extractive-inclusive তত্ত্বটিই প্রকৃত চালিকাশক্তি।
এই তত্ত্বের অন্যতম বড় ত্রুটি হিসেবে যেটা আমার মনে হয়েছে তা হলো, তত্ত্বটি আধুনিক “গ্লোবালাইজেশন” ধারণাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছে। এই তত্ত্বটি রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলির কার্যকারিতার কথাই শুধু বলেছে। কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে কোনো দেশের অস্তিত্ব কি স্বতন্ত্র থাকতে পারে? পৃথিবীকে এখন বলা হয় “গ্লোবাল ভিলেজ”। রাজনীতি, কূটনীতি, অর্থনীতি, টেকনোলজি— এরকম বেশ কিছু জাল দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি কয়েকটি জনগোষ্ঠীর উন্নতি কিংবা অবনতির পিছনে কিছু ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টরটির নাম— “ইতিহাস” (কাশ্মীর কিংবা প্যালেস্টাইন কিংবা বসনিয়ার জনগণের কথা চিন্তা করুন)।
এবার এই বইটি থেকে একটি হাস্যকর উদ্ধৃতির উল্লেখ করি (যেরকম হাস্যকর উদ্ধৃতির অভাব নেই এই বইতে)। আমেরিকা ক্যানো মেক্সিকোর চেয়ে বড়লোক তার কারণ দর্শাতে গিয়ে লেখা হয়েছে :
“Unlike in Mexico, in the United States the citizens could keep politicians in check and get rid of ones who would use their offices to enrich themselves or create monopolies for their cronies.”
লেখকরা সম্ভবত হিরোশিমা-নাগাসাকি, ভিয়েতনাম, কিউবা, ইরাক, লেবানন, আফগানিস্তান, গুয়ান্তানামো বে, গাজা-ওয়েস্ট ব্যাংক— এই অঞ্চলগুলির নাম শোনেননি। আমেরিকার ডিফেন্স মিনিস্ট্রি, ওয়েপন অ্যান্ড অ্যামিউনিশন ইন্ডাস্ট্রি কিংবা মর্গেজ ইন্ডাস্ট্রির কর্মপদ্ধতির ব্যাপারেও বোধহয় তাঁরা একেবারেই অজ্ঞ। পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশের আভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে যে অনেক গরীব দেশের মানুষ পরোক্ষভাবে অত্যাচারিত এবং বঞ্চিত হয় (ঊনবিংশ শতকের ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের আখ চাষী কিংবা বর্তমান শতকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কর্মীদের কথা চিন্তা করুন)— এই বহুল-আলোচিত বিষয়টিও তাঁরা বেমালুম চেপে গেছেন। তাঁরা উন্নত দেশগুলির উন্নয়নকামী বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেছেন, কিন্তু প্রদীপের নিচে অন্ধকার অঞ্চলগুলিকে মনে রাখেননি (অথবা রাখতে চাননি, নিজেদের “অভিনব” তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে)।
সবচেয়ে আশ্চর্য কথা হলো, তাঁরা ভারত এবং চিন নামক দুটি বৃহৎ দেশের জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নিজেদের তত্ত্বের ভিতর ঢোকাতে ভুলে গেছেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি মানেই যে মানবিক সমৃদ্ধি নয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকতে পারে, এমনকি একটি তথাকথিত উন্নত দেশের অগণিত মানুষ যে অভুক্ত কিংবা বাসস্থানহীন থাকতে পারে (ভারত কিংবা চিনের মতো উন্নয়নশীল দেশের কথা বাদ দিই, জার্মানির মতো উন্নত রাষ্ট্রেও ২০২৪ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রায় বাইশ হাজার শিশু সরাসরি রাস্তায় বসবাস করে), এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে এবারের নোবেল লরিয়েটরা আলোচনার উপযুক্ত বলেই মনে করেননি! বর্তমান পৃথিবীতে ভারতীয় কিংবা চৈনিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতিকে অগ্রাহ্য করে অর্থনীতির কোনো আলোচনা কি চলতে পারে? এরকম সুবৃহৎ অর্থনীতি যে extractive-inclusive তত্ত্বের সরল রাস্তায় চলতে পারে না (উদাহরণ : ভারত), কিংবা এই রাস্তায় না-চলেও হাতেকলমে প্রভূত রাষ্ট্রীয় সম্পদ সৃষ্টি হতে পারে (উদাহরণ : চিন কিংবা সৌদি আরব), কিংবা একটি রাষ্ট্রের inclusive-পৌষমাস যে অন্য রাষ্ট্রের extractive-সর্বনাশের কারণ হতে পারে (উদাহরণ : আমেরিকা-আফগানিস্তান), এইসব আলোচনা এই বইতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এই তো গ্যালো অর্থনীতির দিক দিয়ে এই তত্ত্বের কয়েকটি খামতি (আরো আছে, কিন্তু এখানে লেখার জায়গা নেই)। কিন্তু এই তত্ত্বের সবচেয়ে উন্নাসিক ত্রুটিটি কিন্তু অর্থনীতি-সম্পর্কিত নয়। একটি রাষ্ট্রের উন্নতির পিছনে রাষ্ট্রটির ভৌগোলিক অবস্থান, পররাষ্ট্রগত জটিলতা, ঐতিহাসিক বাধা-বিপত্তি, কিংবা পরিবেশ/জলবায়ুগত ভূমিকা থাকতে পারে— এই বিষয়গুলো সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। ১৪৯৮ সালে মশলার লোভে ভারতে এসেছিল ইয়োরোপীয় লুটেরা বণিকরা, তাদের সঙ্গে প্রবেশ করেছিল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদ। দুশো বছর ধরে সেই ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্পদকে যথেচ্ছ লুণ্ঠন করেছিল। বিদায় নেওয়ার আগে সেই সাম্রাজ্যবাদীদের দুষ্টচক্রান্তে ভেঙে দুই টুকরো (পরবর্তীকালে তিন টুকরো) হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশ। টুকরো হওয়া তিনটে দেশের অর্থনীতি আজও বহন করছে সাম্রাজ্যবাদী অভিঘাতের ক্ষতচিহ্ন (২০২৩ সালে ভারতের প্রতিরক্ষা বাবদ খরচ হয়েছিল প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা, অথচ স্বাস্থ্য বাবদ খরচ করা হয়েছিল মাত্র ৯০ হাজার কোটি টাকা— ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য কোনটা বেশি প্রয়োজন? দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নাকি গোলাবারুদ?) বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের পিছনে রয়েছে ভারতের বেশ কিছু পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ। আবার ভারতের হস্তক্ষেপের পিছনে খুঁজলে পাওয়া যাবে পাকিস্তানের সঙ্গে (সুতরাং চিনের সঙ্গেও) তাদের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বের যোগসূত্র।
উপরে উল্লিখিত উপমহাদেশীয় ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের নোবেল লরিয়েটদের কাছে এবারে কয়েকটা প্রশ্ন করি : সাম্প্রতিক জুলাই আন্দোলনে শারীরিক আঘাতজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত একজন বাংলাদেশি ছাত্রের অন্ধকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতকে তাঁরা নিজেদের extractive-inclusive তত্ত্ব দিয়ে কীভাবে বিশ্লেষণ এবং সমাধান করবেন? প্যালেস্টাইনের মতো একটি অত্যাচারিত রাষ্ট্র আপনাদের এই তত্ত্বটি প্রয়োগ করে কীভাবে সুষমভাবে পরিচালনা করবে তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে? ভারতের মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানা রাজ্যের দুজন ছাত্রী— যাদের একজন ব্রাহ্মণ (যিনি মহারাষ্ট্রের) এবং আরেকজন দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত (যিনি হরিয়ানার)— বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দুজনের অ্যাকাডেমিক রেকর্ড যদি হুবহু একই হয়, ওহে নোবেল লরিয়েটগণ, আপনারা কি জানেন, তবুও তাদের একজনের ভবিষ্যত হতে পারে উজ্জ্বল এবং আরেকজনের নিকষ অন্ধকার? (যদি ভারতীয় উদাহরণ পছন্দ না হয় তাহলে আপনাদের উন্নত দেশ আমেরিকা থেকেও উদাহরণ দিতে পারি)। এবং এই অন্ধকার কিংবা উজ্জ্বল হওয়ার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কোনো সম্পর্ক নেই!
রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন নামক মারাত্মক জটিল সমীকরণটির একটি জলমেশানো ইউটোপিয়ান বিশ্লেষণকে এবারের নোবেল পদক দ্বারা পুরস্কৃত করা হয়েছে। ব্রাভো!
এই অ-পূ-উ-উ-র-বো বইটিকে নিয়ে আগের প্রোফাইলে একটা রিভিউ লিখেছিলাম। বন্ধু মুহাম্মদ গতকাল মেসেজ করে বললো : “আবার লেখোনা ক্যান?”। কিন্তু এই বই নিয়ে আরেকবার গুছিয়ে লেখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু সামান্য কয়েকটা কথা :
“আত্মজীবনী” লেখার নাম করে এইরকম এক্সপোর্ট কোয়ালিটির গাঁজাখুরি কাহিনি রচনা করবার মতো সাহস, কল্পনাশক্তি এবং আত্মবিশ্বাস— পৃথিবীতে ভীষণ অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে দেখা যায়। ইনি সেই ভীষণ অল্পসংখ্যক মানুষদের একজন। গাঁজাগল্প লেখার সময় অন্যরা গরুকে গাছে ওঠায়, নিজেরা নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। এই ভদ্রলোক গরুর জন্যে অপেক্ষা করেননি, নিজেই গাছে উঠে পড়েছেন।
গরু ল্যাজ তুলে পালিয়েছে!
.
যে-কোনো বড়ো শহরের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সেই শহরের একাকীত্ব। শহরের একাকীত্ব মানে সেই শহরের মানুষের একাকীত্ব। যে শহরে যত বেশি মানুষ, সেই শহর তত বেশি একলা। সেইসব গণনাতীত মানুষের পরিত্যাগ করা কার্বন ডাইঅক্সাইডে ভরে ওঠে শহরের ছালওঠা ময়দান, ত্বকচর্চাহীন পিচের রাস্তা, প্লাস্টিক আলো আর আসবাবের কিউবিজমে ডুবে থাকা শহরের কাফে রেস্টুরেন্ট শুঁড়িখানা সিনেমাঘর, এবং চৌকো আয়ত ত্রিকোণ গোল লম্বা বেঁটে হাজার হাজার হাজার হাজার হাজার হাজার বাসাবাড়ি। মানুষের ফেলে দেওয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস উড়ে আসে মানুষেরই ঘরের ভিতরে।বড়ো শহরের এই চরিত্র আমি প্রথম চিনতে পেরেছিলাম কলেজজীবনে হোস্টেলে থাকার সময়। হোস্টেলও একরকম সরাইখানা বটে। পার্থক্য শুধু, সরাইখানার মতো রোজ রোজ মানুষের মুখ পাল্টে যায় না হোস্টেলে। কিন্তু সেই একইরকম চিৎকার হুজ্জতি লৌন্ডা বদনাম হুয়া লৌন্ডিয়া তেরে লিয়ে জন বন জোভি ব্রায়ান অ্যাডামস খেউড় খিস্তি আব্বে চুতিয়া বেটিচোদ হাহাহাহাহাহা হাসির দমক সিগারেটের ধোঁয়া মৃত বিয়ারের বোতল বিকল হয়ে যাওয়া বেসিনের জলে ভেসে যাচ্ছে বারোয়ারি বাথরুমের নোংরা মেঝে ঘরের দেয়ালে টাঙানো স্বামী বিবেকানন্দ এবং ভগবান তিরুপতির পরিপাটি বাঁধানো ছবির ঠিক পাশেই পোস্টারে ঝুলে আছে প্যামেলা অ্যান্ডারসনের সাহসী পশ্চাৎদেশ।একটা বইয়ের দোকানে নিয়মিত যেতাম, সেখানেই পৃষ্ঠা উল্টে প্রথম দেখেছিলাম এডোয়ার্ড হপার-এর আঁকা ছবি (যে বইটার রিভিউ লিখছি, এটাই সেই বইটা, অনেকদিন পরে কিনেছিলাম)। মূল্যবান বইয়ের মসৃণ পৃষ্ঠাগুলো ভিজে আছে একাকীত্বের আর্দ্রতায়। বড়ো শহরের জ্যামিতিক একাকীত্ব। শিল্পী হিসেবে হপারকে “reverse-প্রথাভঙ্গকারী” বলা যেতে পারে। শিল্পীসুলভ উচ্ছৃঙ্খল ছিলেন না তিনি। বোহেমিয়ান ছিলেন না। যাঁকে বিয়ে করেছিলেন তাঁর সঙ্গেই সারাজীবন কাটিয়েছেন, একটাও গুপ্ত প্রেমিকার অস্তিত্ব নেই তাঁর জীবনে। কথাবার্তায় ছিলেন অশিল্পীসুলভ মৃদুভাষী। তাঁর জীবন নিয়ে বায়োপিক তৈরি করলে সেই সিনেমা অবধারিত ফ্লপ হবে। সমকালীন সকল শিল্পতত্ত্ব, অমুক ইজম তমুক ইজম, সবরকম প্রাসঙ্গিক ইজমকে এড়িয়ে গেছেন তিনি। কোনো বিদ্রোহ নেই, কোনো তত্ত্বের প্রচার নেই, কিংবা সমাজকে তাচ্ছিল্য কিংবা আঘাত করার প্রবণতা নেই। শিল্পী ছিলেন? নাকি শিল্পীবেশী অহিংস কেরানি ছিলেন তিনি?তিরিশ/চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দুর্দশাগ্রস্ত বিশ্বে, পিকাসো যখন আঁকছেন “গের্নিকা”, সালভাদর দালি আঁকছেন “দা পার্সিস্টেন্স অফ মেমোরি”, পল ক্লি আঁকছেন “অ্যাড পারনাসাম”, মার্ক শাগাল আঁকছেন “দা চেলিস্ট “, ফ্রিদা কাহলো আঁকছেন জাদুবাস্তবিক আত্মপ্রতিকৃতি, সেই সময় এডোয়ার্ড হপার তেলরঙের বাটিতে প্রশান্ত তুলি ডুবিয়ে নিশ্চুপে ফুটিয়ে তুলছেন একাকীত্বের বাস্তবসম্মত চিত্রভাষ্য। তাঁর ছবির ভাষায়, রঙে, রেখায়, সমসাময়িক শৈল্পিক ভাঙাগড়া, উন্মত্ততার ছিঁটেফোঁটা নেই। (বোধহয় সেই কারণেই ই. এইচ. গমব্রিচের বিখ্যাত The Story of Art বইতে একবারের জন্যেও হপারের নামের উল্লেখ নেই!) আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনের টুকরো টুকরো মুহূর্তকে, প্রতিবিম্বের মতো, নির্বিকার রিয়ালিস্ট ভঙ্গিমায় এঁকেছেন একটার পর একটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব (এবং তার পরেরও) আমেরিকান জীবনের একাকীত্বের সেই শুকনো ফুলের গন্ধ আমি আজকে ২০২৩ সালের জানুয়ারির দু-তারিখ সোমবার সকালবেলাতেও পাচ্ছি।তাঁর ছবির মেলানকলিক চরিত্ররা কেউ গাড়িতে গ্যাস ভরছে ফাঁকা গ্যাসস্টেশনে, কেউ একলা বসে আছে মোটেলের বিছানায়, অফিসে একা বসে কাজ করছে, সেলাই করছে একা, থিয়েটার দেখছে একা, রেস্টুরেন্টে কফি খাচ্ছে একা, বই পড়ছে একা। এমনকি চরিত্র যখন একাধিক, তখনও তারা চুপচাপ। নিজেদের মধ্যে একা। হপারের এই অদ্ভুত একলা বিশ্বে ছবির দর্শক হিসেবে আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি নিজেদের একলা আত্মাকে। তাঁর ছবিকে নিখুঁত আয়না হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আমার খুব প্রিয় একটা ছোটোগল্পের সংকলন, [b:The Oxford Book of American Short Stories 13689875 The Oxford Book of American Short Stories Joyce Carol Oates https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1346004335l/13689875.SY75.jpg 1270467], যেটি সম্পাদনা করেছেন আরেকজন বিখ্যাত গল্পলেখক জয়েস ক্যারল ওটস, সেই বইটা যখন কিনলাম, দেখলাম প্রচ্ছদে ব্যবহার করা হয়েছে হপারেরই আঁকা একটা ছবি। হঠাৎ অনুভব করলাম, এডোয়ার্ড হপার তাঁর প্রত্যেক ছবিতে, ছবির দৃশ্যবস্তুর পাশাপাশি, খুব সন্তর্পণে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন নিশ্চুপ নিরিবিলি একেকটা গল্প। খুব মৃদু গলায় কথা বলছে তাঁর সেইসব গল্পের চরিত্ররা? কী কথা বলছে? কে জানে!(“সামার ইভনিং”, ১৯৪৭, ক্যানভাসে তেলরং)