ক্যানো এই উপন্যাসের চরিত্রেরা বইটির কালো অক্ষর-খোদিত পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসে আমার চারপাশে তাদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে গ্যালো; শহুরে মানুষ আমি ক্যানো স্পষ্ট চাক্ষুষ করি আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত অদেখা ভাটি অঞ্চলের জল থৈ থৈ পরিপার্শ্ব আর ভেজা শোঁ-শোঁ বাতাসমাখা দিনগুলি আর রাতগুলি; ক্যানো এই বইটির নাম গ্রামকেন্দ্রিক/ নদীকেন্দ্রিক বাংলা ক্লাসিক উপন্যাসের তালিকায় খুঁজে পাইনি একবারও; এইসব হরেক ক্যানোর উত্তর ধীরেসুস্থে খোঁজার চেষ্টা করবো পরে কখনও। কোন্ লেখা যে পাঠকসাধারণের নেকনজর লাভ করে (মাঝে মাঝে অহেতুকভাবে), আর কোন্ লেখা আত্মগোপন করে থাকে কোনো এক মধ্যরাতে অকস্মাৎ আবিষ্কৃত হওয়ার অপেক্ষায়, পাঠকজীবনের এই এক আনন্দময় রহস্য।
এমনিতে দেড় তারা রেটিং হয়। জানলা দিয়ে ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া আর চাঁদের আলো আসছে (তাছাড়া কালকে রবিবার ছুটির দিন), এইসব ছোটোখাটো আনন্দে হাফ তারা বাড়িয়ে দিলাম।
এতো সুন্দর গদ্যশৈলী, এতো সাবলীল চরিত্রনির্মাণ, এতো ঝকঝকে বাস্তবসম্মত সংলাপ। অথচ হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ উপন্যাসের এন্ডিং এরকম ঝুপুশ করে, মাঝিকে অবাক করে দিয়ে, মাঝদরিয়ায় ডুবে যায় ক্যানো বারবার? বলি কেসটা কী ভাই??
পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল,কার্নিশে কার্নিশ,ফুটপাত বদল হয় মধ্যরাতে।
(শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
মধ্যরাতে কলকাতা শহর শাসন করতেন যে-চারজন যুবক, কিংবদন্তি সেই অশ্বারোহী চতুষ্টয়ের একজন ছিলেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়। পেশা ছিলো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টগিরি। কিন্তু বাংলা কবিতার বিশিষ্ট মাইলফলক “কৃত্তিবাস” কবিতাপত্রিকার প্রত্যক্ষ উদ্যোগীদের একজন ছিলেন। পঞ্চাশের দশকের মুখ্য কবিদের মধ্যেও তিনি একজন। তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়। অথচ শরৎকুমারের কবিতায় তিলপরিমাণ নেই তাঁর সেইসব শালপ্রাংশু বন্ধুকবিদের প্রভাব। নির্ভার নিজস্বতার এ এক আশ্চর্য উদাহরণ।
বিখ্যাত বন্ধুদের সঙ্গে তুলনা করলে তাঁর কবিতার সংখ্যা যৎসামান্য। তাঁর কাব্যভাষাতেও নেই সুনীল কিংবা শক্তির কবিতার মতো শব্দ কিংবা উপমা কিংবা বর্ণনার বর্ণময় সমারোহ। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে একটা নিবিষ্ট বার্তা আছে, যেটা আমার ভালো লেগেছে। অনুচ্চস্বরে প্রায় মন্ত্রের মতো তিনি লিখেছেন একটি পাখি এবং একটি ছাতিমগাছের কথা।
একটি পাখিসারা সকাল উড়ে বেরিয়েছেকাড়াকাড়ি, মারামারি, চুরি, ছিনতাইছোটোখাটো লুঠতরাজ সেরে, দ্যাখোনির্জন দুপুরে ছাতিমডালে ঠোঁট ঘষছে,আপন মনে গুমরোচ্ছে অনুশোচনায়।আর ছাতিম গাছতার সহজ বাহু তুলে, দুলে দুলে, দ্যাখোফিশফিশ করে বলছেক্ষমা, ক্ষমা। ক্ষমা।
তোমার প্রপিতামহ, শাকাহারী, জাদুঘরে আমি তার কংকাল দেখেছি,তিনঘর জোড়া এক সরীসৃপ।বহুকাল অবলুপ্ত। দলত্যাগী তুমিছোট হতে-হতে টিকে গেলে। ধূর্ততুমি, গৃহস্থ বাড়িতে ঢুকে আত্মরক্ষা করো, যেন কিছুই ঘটেনি। ...
যে মুহূর্তে পরিত্যক্ত দেহ থেকে, তুমি আবর্জনা—কেন লিপ্ত হতে আসো, কেবল উত্যক্ত করতে আসো?
স্বনির্ভর হতে হবে। ওপরে আকাশস্নিগ্ধ প্লাইকাঠে মোড়া, অন্নময়আবদ্ধ জীবন নিচে, মাঝখানেকাকধর্মে নিয়তই সংগ্রাম রয়েছে।
ধুৎ! এই সূর্যোদয়!এর জন্যে এতো কষ্ট এতো হুটোপাটিছেঁদো প্লাস্টিকের বলের মতো ঠান্ডা বিবর্ণ একটা জিনিশময়লা মেঘের স্তূপ থেকে কষ্টেসৃষ্টে উঠে এলো...
আমারও গোপন কথা কিছু ছিল, তুমি জেনে যাও।দেখা হলে যে-কথা লজ্জায়বলিনি, চিঠিতে লিখতে পারিনি যে-কথাআমাকে দেখেই তুমি বুঝে নাও।
ভালোবাসা, একদিন তোমাকেও আবার দ্বারস্থ হতে হবেআমি ঘর অন্ধকার করে বসে আছি।এবার এসো না যেন ভিক্ষুকের মতো, তুমি রাজার দুলালকরাঘাত কোরো বন্ধ দরজায়— একবার দুবার তিনবার।আমি সাড়া দেবো না প্রথমে হয়তো, হয়তো অভিমানকণ্ঠরোধ করে থাকবে, দেহমন উচাটন, তুমিজানো না বন্ধুরা ফেলে পালিয়েছে। আমিসঙ্গহীন লোকেদের ভিড়েবসে আছি, ভাবছি—
শুধুমাত্র চেহারা এবং সংস্কৃতির ভিন্নতার জন্যে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভুত মানুষদের আমরা অন্যচোখে দেখি। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে হাসিতামাশা কিংবা বাঁকা কথা কিংবা তাঁদের প্রতি অপমানজনক আচরণ দেখা কিংবা শোনার অভিজ্ঞতা আমাদের, অর্থাৎ তথাকথিত ভূমিপুত্রকন্যাদের সবারই কমবেশি আছে। নিজদেশে তাঁরা পরদেশি হয়ে আছেন। বাংলাদেশের বান্দরবান অঞ্চলের নামডাক অনেক শুনেছি, মূলত বেড়াবার জায়গা হিসেবে। কিন্তু এই অঞ্চলের “পাহাড়ি” মানুষদের সঙ্গে বাঙালি “ভূমিসন্তান”দের সংঘর্ষের বিষয়টা আমি জানতাম না। এই বইটাকে দুই তারা দিলাম শুধু এই বিষয়টা এবং “মারমা” জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে আমাকে অবগত করবার জন্যে।
গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়কে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাসটির শুরু হয়েছিলো বেশ আশা জাগিয়ে। গদ্য বেশ ঝরঝরে লাগছিলো। লেখকের রসবোধটাও বেশ উপভোগ্য মনে হচ্ছিলো। তারপরেই শুরু হলো তামিল ব্লকবাস্টার সিনেমা। গল্পের স্বাদ আরো ঝাঁঝালো করতে অবধারিতভাবে ঢোকানো হয়েছে সকল মশলার শ্রেষ্ঠ মশলা— মুক্তিযুদ্ধের আবেগ। তাও আবার চড়া মাত্রায়। গল্পের যিনি নায়ক, তাঁর মধ্যে নায়কোচিত সমস্ত উত্তম গুণ প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন লেখক। ভাগ্যাহত অনাথ, কিন্তু লেখাপড়ায় মেধাবী। এমনিতে তাঁর কুসুমকোমল হৃদয়, কিন্তু যখন দরকার হয় তখন সংকল্পে ইস্পাতদৃঢ়। মারাত্মক সৎ। নিশ্চুপ প্রেমিক। পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থার সাহায্য ছাড়াই রাতারাতি তিনি সুস্থ করে তুলতে পারেন মৃতপ্রায় একজন সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ার রোগিকে। নায়কের অনাথ হওয়ার কাহিনিটিও (এবং সেই কাহিনির পরিণতি) এতোটাই নাটকীয় যে, এরকম কাহিনি আজকাল বাজারি বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্টলেখকরাও লেখা ছেড়ে দিয়েছেন।
মেলোড্রামার রসে জবজবে করে চোবানো অবিশ্বাস্য ঘটনাসমৃদ্ধ এই উপন্যাসটা পড়তে পড়তে খুব আফসোস হচ্ছিলো আমার। শুধুমাত্র পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার লোভে এমন একটি সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কেমন ছেলেখেলা করলেন লেখক। উপন্যাসটা পড়া শেষ করে অনুভব করলাম, বান্দরবান পার্বত্য অঞ্চলের অশান্তির কার্যকারণ বিষয়ে খুব কম তথ্যই জানতে পেরেছি আমি। লাভের মধ্যে এটুকুই, মাথার মধ্যে ঢুকে রইলো একটা উদ্ভট আজগুবি আরব্যরজনীর গল্প।
অন্নদাশঙ্কর রায় ছিলেন ইংরেজ আমলের সিভিল সার্ভেন্ট। অবিভক্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সরকারি প্রশাসনের দন্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে কর্মজীবন কাটিয়েছেন। কাজের সূত্রে মিশেছেন ধনী দরিদ্র সাধারণ অসাধারণ নানারকম মানুষের সঙ্গে। কিন্তু সেই মেলামেশা “সমানে সমানে” মেলামেশা নয়। উত্তমর্ণের সঙ্গে অধমর্ণের মেলামেশা। অন্নদাশঙ্কর সাহিত্যচর্চা করতেন। তাই প্রশাসনিক কর্তব্যের বাইরেও নিজের লেখালিখির জন্যে উপাদান খুঁজতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর ছোটোগল্পগুলোকে ঠিক “গল্প” বলতে পারছি না। কর্মজীবনের বিবিধ অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প নামে চালিয়েছেন। শুধু পাত্রপাত্রীর নামধাম পাল্টে নিয়েছেন।
গল্পগুলো আমার ভালো লাগেনি। নিজের অভিজ্ঞতাকে সরাসরি আশ্রয় করে গল্পরচনা দোষের নয়। কিন্তু গল্প শোনাবার অছিলায় নিজস্ব রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বিশ্বাস পাঠকের হৃদয়ে ট্রান্সফার করতে চাইলে বিরক্তি লাগে। গল্পের ভেতরে কিছু-একটা “বার্তা” কিংবা “দর্শন” কিংবা “শিক্ষা” ঢুকিয়ে দিলেও বিরক্তি লাগে। গল্পের প্লট আগে, নাকি “বার্তা” আগে? আমার কাছে সবসময়ই প্লট আগে। প্রতিষ্ঠিত ছোটোগল্পকার বনফুলও তাঁর নিজের ছোটোগল্পের ভেতরে “শিক্ষা” ঢুকিয়েছেন, কিন্তু সেইজন্যে প্লটকে তিনি হেলাফেলা করেন নি। অন্নদাশঙ্করের গল্পে বাঁধুনি নেই, বৈচিত্র্য নেই, কাঠামো নেই। তাছাড়া, “বাংলাদেশটাকে থালায় করে তুলে দেওয়া হলো মুসলমানদের হাতে“— একজন প্রাক্তন প্রশাসক, যিনি দীর্ঘদিন পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কাজ করেছেন, তাঁর মুখে যদি এমন কথা শুনতে হয়, তাইলে কেমন লাগে?
চোন্দিল ভড়চাজের লেখাপত্তর সেই হাপ-প্যান্টুলুন বয়েস থেকেই আমার বেশ ভালো লাগে মাইরি। ভাষা নিয়ে ক্কি সুন্দর নিজস্ব একটা হুড়ুম দুড়ুম স্টাইল বার করেছে এই ম্যানটা। পোথোম যখন লেখালিখি শুরু করেছিলেন, তখন আমি কোয়াইট ইয়াং। লেখাগুলোর পোচুর ইনার মিনিং আউটার মিনিং আমার হেডের সাড়ে-বাইশ ইঞ্চি উপর দিয়ে বেরিয়ে যেতো। কিন্তু তবুও পড়তাম নিয়মিত। আশেপাশের সবাই তখন হাঁদাভোঁদা নন্টেফন্টে আর খুব বেশি হলে ফেলুদা শঙ্কু পড়তো। আমিও ওসব পড়তাম। চোন্দিলও পড়তাম। ল্যাটিন আমেরিকার হাপবয়েল গাঁজামার্কা উপন্যাসগুলোর সুনাম করলে ইদানিং যেমন, সবার মাঝে নিজেকে বেশ ইয়ে মনে হয়। আমাদের মফস্বল শহরে চোন্দিলের লেখার সুনাম করলে তখন সেইম ফিলিং হতো, চাদ্দিক কেমন “ওয়াও” লাগতো।
একজন গেল মাঠতার মাথায় আঁতেল ছাঁটকুকুর মেকুর রামের ঢেঁকুর পেরোচ্ছে সম্রাট।
চলে যাচ্ছে দিন, ঠিক পাঁচটা তিন, প্রায় অন্ধকার।বাসস্টপে কেউ নেই কোথাও...
এই শালা গোটা সভ্যতাটা উন্নতির নাম করে স্রেফ আলসেমির দিকে ঢলছে! যত পারে শালারা মেশিন বানায়। মশলা বাটবে কে? মেশিন। মুসুম্বির রস বের করবে কে? মেশিন। জাঙিয়া কাচবে কে? মেশিন। খবর নেবে কে? টেলিফোন। ফাইল গুছিয়ে রাখবে কে? কম্পিউটার। টাকা গুনবে কে? এটিএম। মড়া পোড়াবে কে? ইলেকট্রিক চুল্লি। আর তুমি শালা ঈশ্বরের দেওয়া ননীর তনুখানি নিয়ে কী করবে? আধশোয়া হয়ে চিপস খাবে আর সিরিয়াল গিলবে।
মেয়েদের ব্যাপারটা ঠিক জানি না, ছেলেদের অন্তত, হস্তমৈথুনের চেয়ে বড় বন্ধু এ পৃথিবীতে নেই। কেউ নেই, যে নিঃশর্ত আনন্দময় এক সম্ভাবনা নিয়ে সর্বক্ষণ সঙ্গে-সঙ্গে থাকে ও তুরীয় সুখ ডেলি প্রদান করে। সান্ত্বনা ও শুশ্রূষাও কিছু কম বিলোয় না। মা-বাবার চেয়ে অনেক নিশ্চিত আশ্রয় সন্তান নিজশিশ্নের কাছে পায়। যদিও, মা-বাপ তাকে ডেকে প্রবল কড়কাবার পর এবং “এসব করলে তুমি উইক হয়ে পড়বে, কোনো কাজ করতে পারবে না, ডাক্তারকাকুও বাঁচাতে পারবে না”, কিংবা “নোংরাস্য নোংরারাই এইসব করে ছি ছি ছি আমাদের ছেলে হয়ে তুমি ছিঃ চ্ছি ছিইইহ” ধমকি শোনার পর সে প্রতিজ্ঞা করে “আর নয় জীবনে নয় কক্ষনো এই পাপ নেহি!!”
পড়লে বগা ফান্দেহাত-পা ছুঁড়ে কান্দে,আরে বৌ চাই, মৌ চাই, ম্যাও চাই, ঘৌ চাই,খ্যামটায় ঘোমটায়, ঝিংচ্যাক ছৌ চাই,Sunday হো ইয়া Monday!কিনছে পালং শাকতাতে মাছের মাথা ঢাক,আরে ঢাকঢাক, গুড়গুড়তিন তাল, সাত সুরLove scene, obsceneদিনকাল কদ্দুরআয়নায় ঠকঠকখুললেই রোদ্দুরগোবরজলে ধুই!একের পিঠে দুইকাঁদিস কেন তুই?অরুণ বরুণ কিরণমালাচৌকি চেপে শুই।এসো চৌকি চেপে শুই!এসো চৌকি চেপে শুই?
পৃথিবীতে কি আর কোনো প্রাথমিক ভাষাশিক্ষার বই আছে, যে বইয়ের শুরু হয়েছে এই কথাগুলো দিয়ে?
ছোটো খোকা বলে অ আশেখে নি সে কথা কওয়া।
ঋ
ঘন মেঘ বলে ঋদিন বড়ো বিশ্রী।
ন
রেগে বলে দন্ত্য নযাবো না তো কক্ষনো।
কাল ছিল ডাল খালি,আজ ফুলে যায় ভ'রে।বল দেখি তুই মালী,হয় সে কেমন ক'রে?
ওরে কৈলাস, দৈ চাই। ভালো ভৈষা দৈ আর কৈ মাছ। শৈল আজ খৈ দিয়ে দৈ মেখে খাবে।
বাঁশ গাছে বাঁদর। যত ঝাঁকা দেয়, ডাল তত কাঁপে। ওকে দেখে পাঁচু ভয় পায়, পাছে আঁচড় দেয়।
আজ খুব শীত। কচু পাতা থেকে টুপ টুপ করে হিম পড়ে। ঘাস ভিজে। পা ভিজে যায়। দুখী বুড়ি উনুন-ধারে উবু হয়ে বসে আগুন পোহায় আর গুন গুন গান গায়। বেলা হল। মাঠ ধূ ধূ করে। থেকে থেকে হূ হূ হাওয়া বয়। দূরে ধুলো ওড়ে। চুনি মালী কুয়ো থেকে জল তোলে...আর ঘুঘু ডাকে ঘূ ঘূ।
প্রথমেই স্বীকার্য, গত কুড়ি বছরে প্রকাশিত বাংলা সাহিত্য আমি খুব বেশি পড়িনি। তাই সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের হালচাল আমি খুব ভালো জানিনা। পূজাবার্ষিকীর কল্যাণে আগে নিয়মিত সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসু কিংবা সুনীল-শীর্ষেন্দু পড়তাম। কে জানতো, এইসকল আনন্দবাজারীয় ধনুর্ধরদের পাশাপাশি, আমার মতো অনেক বে-খবর পাঠকের অগোচরে, অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন দু-একজন প্রতিভাবান সাহিত্যিক। এদের মধ্যে স্বপ্নময় চক্রবর্তী, খুব সম্ভবত, সৃষ্টির উৎকর্ষতার দিক দিয়ে এই মুহূর্তে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন।
স্বপ্নময়কে আমি চিনতাম মূলত ছোটোগল্পের লেখক হিসেবে। একটাই উপন্যাস পড়েছিলাম, “চতুষ্পাঠী”— এবং পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সাপ্তাহিক “রোববার” পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার সময়ে “হলদে গোলাপ” উপন্যাসটি বিচ্ছিন্নভাবে পড়তে গিয়ে বুঝেছি, বৃহৎ আকারের উপন্যাস রচনাতেও স্বপ্নময়ের কব্জি যথেষ্ট চওড়া। বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে “হলদে গোলাপ” একটি মাইলস্টোন। কিন্তু স্বপ্নময়ের ম্যাগনাম ওপাস যদি বলতে হয়, আমার মতে “হলদে গোলাপ” নয়, সেটা অবশ্যই “জলের উপর পানি”।
আমরা যখন কোনো মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশি, সেই মানুষটার একটা মানসিক অবয়ব তৈরি হয় আমাদের মনে। সেই মানুষটার ব্যাপারে একটা ধারণা তৈরি করি আমরা। তার সঙ্গে নিজের পছন্দ-অপছন্দ সম্পৃক্ত করতে চেষ্টা করি। দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের জায়গা তৈরি হয়। ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনার আদানপ্রদান করার পরিসর তৈরি হয়। কিন্তু একদিন যদি হঠাৎ বুঝতে পারি, মানুষটিকে যেমনটা চিনতাম সে আদৌ সেরকম নয়। একদিন যদি মনে হয়, কে এই মানুষটা? এর সঙ্গেই কি মিশেছি এতদিন! আয়না ভেঙে গিয়ে প্রতিচ্ছবি টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের চেতনার উতরাই সিঁড়িতে।
ছিন্নমূল উদ্বাস্তু মানুষরা যখন তাদের আজন্মের বাসভূমি ত্যাগ করে নতুন দেশে পদার্পণ করে, তাদের মনে অনেকটা একইরকম চিন্তার উদয় হয়। বহুদিনের পরিচিত ভূখণ্ডের যে-প্রতিচ্ছবি তারা হৃদয়ে লালন করে এসেছে জন্মাবধি, সেটা ভেঙে ছত্রখান হয়ে যায়। নিজের পুরাতন জগৎকে মনে হয় স্বপ্ন। নিজের সত্তাকে মনে হয় অচেনা। অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকা একটা সাঁকোর উপর দাঁড়িয়ে সে ভাবতে থাকে, যা চিনেছি যা বুঝেছি যা দেখেছি যা মেনে এসেছি এতদিন, সবই কি তবে ভ্রম? সবই কি ভুল? সাঁকোর দুলুনি ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
দেশভাগ এবং উদ্বাস্তুজীবন নিয়ে কথকতা বাংলা সাহিত্যে অসংখ্যবার করা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের অতি সমৃদ্ধ একটা অংশ জুড়ে রয়েছে অগণিত ছিন্নমূল মানুষের অশ্রুবাষ্প, বিষাদকুয়াশা। পঁচাত্তর বছর পূর্বের দেশভাগের ক্ষতচিহ্ন আজও রয়ে গেছে বাঙালিজাতির সম্মিলিত মননে। তাই সমাজসচেতন কথাসাহিত্যিক এতযুগ পরেও দেশভাগের বিপন্নতার মধ্যে থেকে খুঁজে নেন তাঁর উপন্যাসের রসদ, তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা। এই উপন্যাসটি লেখার জন্যে যে-বিশদ গবেষণা করেছেন স্বপ্নময়, দুই বাংলা ব্যাপী যে-বর্ণময় পটভূমির বিস্তার করেছেন, তা আমাকে বিস্মিত করেছে। “মুগ্ধ করেছে” বলতে পারতাম, কিন্তু যন্ত্রণার কোরাকাগজে মুগ্ধতার জলছাপ ফুটে ওঠেনা।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা অদৃষ্টের হস্তক্ষেপে দেশভাগ হয়নি। দেশভাগ হয়েছিলো মুষ্টিমেয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সীমাহীন অপদার্থতার কারণে। দেশভাগ বিষয়ক কিছু পড়তে গেলে আমি খুব অবাক হই। ঈশ্বর নাকি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। ঈশ্বরের ক্ষমতা কি মানুষের চেয়েও বেশি? ঈশ্বর কি পারেন নিজের অহংকে তৃপ্ত করার উদ্দেশ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে? ঈশ্বর কি পারেন ধর্মের নামে মানুষের পশুপ্রবৃত্তির বগলে সুড়সুড়ি দিতে? আমার মস্তিষ্কে দামামার মতো বাজতে থাকে— এই দেশভাগ হওয়ার কথা ছিলো না। এই দেশভাগ আটকানো সম্ভব ছিলো। খুব নিশ্চিতভাবে সম্ভব ছিলো। সত্যিই কি সম্ভব ছিলো?
হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং একাত্মবোধ নিয়ে কতো ভাবনা ছড়িয়ে আছে। মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তাহার প্রাণ। স্বাধীনতাপূর্ব অবিভক্ত বাংলাদেশের আর্থসমাজব্যবস্থায় হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সম্পর্কের যা-কিছু বিবরণ আমি শুনেছি/ পড়েছি, তার পরে এই ধরণের ছড়াকে ছেলেভুলানো ছড়া বলে মনে হয়। যদি একই বৃন্তে দুটি কুসুম হতো, তবে মুসলমানদের খেতে দেওয়ার জন্যে আলাদা থালা-বাটি-গ্লাসের ব্যবস্থা রাখতে হতো না। আলাদা হুঁকো-তামাকের ব্যবস্থা রাখতে হতো না। একে অপরের অন্দরমহলে অবাধ প্রবেশ করার “অধিকার” থাকতো। উঠোনে দাঁড়ালে সেই মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে ফেলে দেওয়া হতো না। এই চূড়ান্ত অপমানজনক সহাবস্থান যখন দীর্ঘদিন যাবৎ চলতে থাকে, এবং সেই সঞ্চিত অপমানরাশি যদি একদিন ভিসুভিয়াসের মতো লাভা উদগীরণ করে, তবে কাকে দায়ী করবো? মানুষকে? রাজনীতিবিশারদকে? নাকি স্বয়ং ঈশ্বরকে?
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর এই উপন্যাসের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি অনেক অপ্রিয় সত্যিকথাকে পরিত্যক্ত কুয়োর গভীর থেকে উঠিয়ে এনেছেন। দেশভাগ-বিষয়ক সাহিত্যের স্বাভাবিক রোমান্টিসিজমকে বজায় রেখেও তিনি উপন্যাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বুনে দিয়েছেন তিক্ত প্রশ্নের বীজ। মানুষ মানুষের সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করেনি। মানুষই তৈরি করেছে মানুষের নিয়তি। সেই নিয়তির কুঠারের আঘাতে মানুষ হারিয়েছে নিজের প্রাণ, নিজের প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মসম্মান, মনুষ্যত্ব, মান ইজ্জত, ভিটে মাটি, পুকুর দীঘি, দীঘির জলে প্রতিবিম্বিত আকাশের চাঁদ, ভোরের পাখির কূজন, বিকেলের চন্দনচর্চিত হাওয়া, সন্ধ্যার নিবিড় কুহেলিকা, একত্রে মিশে যাওয়া শঙ্খের ধ্বনি আর আজানের আহ্বান। নির্নিমেষ স্তব্ধতা।
লাল জামা গায়ে নীল জামা গায়ে
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রঙ বদলায়
দিন বদলায় না।
মুন্সি প্রেমচন্দ, সাদত হাসান মান্টো, কৃশন চন্দর, রাজেন্দ্র সিং বেদি, ইসমত চুগতাই। উর্দু কথাসাহিত্যের পঞ্চপাণ্ডব। এঁদের মধ্যে শেষ তিনজনের প্রত্যেকের পাঁচটি করে, মোট পনেরোটি গল্প নিয়ে এই সংকলনটি তৈরি করা হয়েছে। “এক গধে কি আত্মকথা” বাদ দিয়ে কৃশন চন্দরের কিছুই পড়া ছিলো না আমার। বেদি এবং চুগতাইয়ের বিশিষ্ট কয়েকটা ছোটোগল্প ইংরিজি অনুবাদে এখানে-ওখানে পড়েছিলাম। গল্পগুলো পুনরায় বাংলা অনুবাদে পড়ার ইচ্ছে ছিলো। উর্দু গল্পভাণ্ডারকে ভালো করে পড়বার একটা ব্যক্তিগত প্রকল্প শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি সম্প্রতি। এই সংকলনটা দিয়ে সেই প্রকল্পের সূচনা করেছিলাম। কিন্তু কপাল মন্দ, পড়ে শেষ করতে পারলাম না (তিরিশ পৃষ্ঠা বাকি রইলো)।
জঘন্য যাচ্ছেতাই অনুবাদ! ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এরকম উন্মাদের মতো অনুবাদকে ছাড়পত্র দিলো কীভাবে? বইটা এতগুলো মুদ্রণসৌভাগ্য (আমারটা ২০০৯ সালে প্রকাশিত। ২০০৯ সালেই সপ্তম মুদ্রণ। এখন তো আরো বেশি হওয়ার কথা!) অর্জন করলো কীভাবে? মা দুর্গা জানেন!
এবার স্থির করেছি, উর্দু লেখকদের আলাদা আলাদা গল্পসংকলন পড়বো। প্রেমচন্দের আলাদা, মান্টোর আলাদা, চুগতাইয়ের আলাদা, এরকম। ভবিষ্যতে ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের বাংলা অনুবাদ পড়ার আগে ভালো করে (১০৮ বার) রামনাম জপ করে নেবো। এরকম অশৈলী অনুবাদ পড়লে মাঝরাত্তিরে হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার জোগাড় হয়!
এই বইটার কথা বাদ দেওয়া যাক। উর্দু সাহিত্যের এই বিখ্যাত গল্পগুলো অন্য কোনো বই থেকে আরেকবার পড়ার পরে, ভবিষ্যতে বিশদে আলোচনা করার ইচ্ছে রইলো।
হ্যাডলি চেইজ পড়িনি কখনও। এই বইটার নাম শুনেছিলাম কোথাও। রেলস্টেশনে দেখতে পেয়ে কিনলাম। কিন্তু খুব বেশি পড়ার সুযোগ পাইনি সেদিন। একটা গুরুগম্ভীর বই নিয়ে বসেছিলাম আজকে দুপুরবেলা। কিন্তু পাড়ার দুর্গাপূজার মণ্ডপ থেকে ভেসে আসা বাজনার আওয়াজে সেই বই পড়া ভন্ডুল হয়ে গ্যালো। গুরুগম্ভীর বই বন্ধ রেখে এটা পড়লাম।
প্রবল ঢাকের আওয়াজ, মাইকে লতা মঙ্গেশকরের আওয়াজ সত্ত্বেও বইটা দিব্যি শেষ করতে পারলাম। এই জন্যে একটা তারা। শেষ দশ পৃষ্ঠার আগে পর্যন্ত রীতিমত টেনে ধরে রেখেছিলো গল্পের রহস্য। সেই জন্যে আরেকটা তারা। আর কোনোদিন পড়বো হ্যাডলি চেইজ? না। এটা উপলব্ধি করানোর জন্যে বাকি তিনটে তারা কেটে নিলাম।
সবাইকে শুভ শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা!
বিক্রম শেঠ একজন প্রতিষ্ঠিত ঔপন্যাসিক হওয়ার পাশাপাশি একজন উঁচুদরের কবিও বটে। পুশকিনের “Eugene Onegin” বইয়ের বিশিষ্ট ছন্দকে অনুসরণ করে তাঁর লেখা কাব্য-উপন্যাস “The Golden Gate” পাঠকদের তরফ থেকে প্রভূত প্রশংসা এবং বিস্ময় অর্জন করেছে। “দ্য গোল্ডেন গেট”কে যদিও সেই অর্থে “কবিতার বই” বলা যাবে না। “All You Who Sleep Tonight” কিন্তু পুরোদস্তুর কবিতার বই।
শীর্ণ চেহারার এই বইতে স্থান পাওয়া নাতিদীর্ঘ আকারের কবিতাগুলো পড়লে, একটা বৈশিষ্ট্য খুব সহজেই খেয়াল করা যায়। তা হলো— গভীর অনুভূতি ও গহন চিন্তাকে সহজ ভাষায় প্রকাশ করার প্রবণতা। ভাষা সহজ, প্রকাশভঙ্গি সহজ, কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে, ছন্দকে যথাযথভাবে সাজিয়ে এভাবে কবিতা লেখা মোটেই সহজ কাজ নয়। ভালো কবিতার বোধহয় এটাও একটা অন্যতম লক্ষণ। তাতে বাহাদুরি কম থাকে। কিন্তু পাঠকের চেতনাকে স্পর্শ করে যায়।
All you who sleep tonightFar from the ones you love,No hand to left or right,And emptiness above—Know that you aren't alone.The whole world shares your tears,Some for two nights or one,And some for all their years.
এগুলো কবিতা নয়।
মিছিলের স্লোগান, নির্বাচনী দেয়াল-লিখন, কিংবা ইস্তাহারে ছাপার উদ্দেশ্যে দ্রুতহাতে, নড়বড়ে ছন্দে লেখা কাব্যিক আস্ফালনকে কবিতা হিসেবে চালানো হয়েছে। সাম্যবাদী কিংবা সমাজবাদী ভোকাবুলারির সার্থক প্রয়োগ সুভাষ মুখোপাধ্যায় পরবর্তীকালে অনেকবার অনেক কবিতায় করেছেন। কিন্তু কবিজীবনের একদম শুরুর দিকে প্রকাশিত এই বইয়ের কবিতাগুলো পড়ে খুব হতাশ হলাম।
“সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুটি কারণে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, তিনি বোধহয় প্রথম বাঙালি কবি যিনি প্রেমের কবিতা লিখে কাব্যজীবন আরম্ভ করলেন না! এমনকি, প্রকৃতিবিষয়ক কবিতাও তিনি লিখলেন না। কোনো অস্পষ্ট, মধুর সৌরভ তাঁর রচনায় নেই, যা সমর সেনের প্রথম কবিতাগুলিতে লক্ষণীয় ছিলো। দ্বিতীয়ত, কলাকৌশলে তাঁর দখল এতই অসামান্য যে কাব্য রচনায় তাঁর চেয়ে ঢের বেশি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদেরও এই ক্ষুদ্র বইখানায় শিক্ষণীয় বস্তু আছে বলে মনে করি।”
(বুদ্ধদেব বসু। পৌষ সংখ্যা, ১৩৪৭। “কবিতা” পত্রিকায় প্রকাশিত)
“আমাদের দেশে যাঁরা সাম্যবাদী কবিতা লিখতে শুরু করেছেন তাঁদের মধ্যে এক দল হচ্ছেন যাঁরা ভাব কিংবা ভঙ্গি কোনো দিক থেকে কবি নন। এঁরা যে-কর্তব্যবোধের প্রবর্তনায় গোলদীঘি থেকে সুদূর পল্লীগ্রাম পর্যন্ত সভাসমিতি করে বেড়ান, দৈনিক সাপ্তাহিক কাগজে প্রবন্ধ লেখেন, জেল খাটেন, সেই প্রবর্তনার বশেই কবিতা লিখছেন। এতে তাঁদের প্রপাগ্যান্ডার কাজ কতখানি হাসিল হয় বলা শক্ত, তবে বিশুদ্ধ সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তি তাঁদের সাহিত্য-প্রচেষ্টাকে সন্দেহের চোখে না-দেখে পারেনা।”
(আবু সয়ীদ আইয়ুব। “আধুনিক বাংলা কবিতা” বইয়ের ভূমিকায় লিখিত বক্তব্য)
যারা গপগপ করে বই ভক্ষণ করতে ভালোবাসে, তাদের কাছে আরো আরো আরো নতুন নতুন বইয়ের সন্ধান পাওয়ার চেয়ে তৃপ্তিদায়ক বিষয় আর কিছু নেই। যদিও, Goodreads-এর পাবলিকদের কাছে এইসব কথা বলার অর্থ, মায়ের কাছে মাসির গল্প ফাঁদা। তারচে সরাসরি এই বইটার ব্যাপারে কিছু কথা বলে ফেলা যাক!
ধরাধাম থেকে বিদায় নেবার আগে অবশ্যপাঠ্য ১০০টি বই।
পটল তুলবার পূর্বে যে ১০০টি ক্লাসিক আপনাকে পড়তেই হবে।
অক্কা পাওয়ার আগে এই ১০০টা বই পড়ে ফেলুন।
যদি আপনার ডাক শুনে কেউ না আসে তবে এই ১০০টি উপন্যাস পড়ুন।
চমকে চৌত্রিশ হতে চাইলে যে ১০০টি বই আপনাকে পড়তে হবে।
জিভে জল আনা ১০০টি বইয়ের ফর্দ।
মানুষ নামক জন্তুর লেখা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ১০০টি কেতাব।
ইন্টারনেটের অলিতে গলিতে এরকম লিস্ট দেখে দেখে চোখ ব্যথা হয়ে গেছে। মোটামুটি সব লিস্টেই ১৫০টা বইকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। নামিদামি পত্রপত্রিকারাও এরোম লিস্টি বের করে মাঝেমধ্যে। সেখানেও সেই একই মাল। যারা নিজেদের একটু “অন্যরকম” দেখাতে চায়, তারা লিস্টের পয়লা র্যাঙ্কিং বইটার নাম লেখে প্রুস্তের “হারিয়ে যাওয়া সময়ের খোঁজে”। যারা নিজেদের আরো বেশি অন্যরকম দেখাতে চায় তারা লেখে জোসেফ হেলারের “ক্যাচ-বাইশ”। এই যেমন আমি নিজেকে অন্যরকম বোঝানোর জন্যে বইগুলোর নাম বাংলায় লিখলাম। ব্যাস, ক্যারদানি এটুকুই। বইক্ষুধার্তরা অ্যাদ্দিনে ভালো করেই বুঝে ফেলেছেন, এইসব থোড়-বড়ি-খারা লিস্ট ঘেঁটে বিশেষ লাভ নেই। এই বইটার নাম দেখে প্রথমে আমিও ভেবেছিলাম, হায় রামচন্দ্র, এরা ইন্টারনেট থেকে বাইরে বেরিয়ে লিস্টি-বিষয়ক গোটা বই লিখে ফেলেছে রে!
তারপর দেখলাম ১০০০টা বইয়ের লিস্ট বানিয়েছে এই বইতে। এট্টু লোভ হলো। বইটা হাতে নিয়ে দেখলাম ক্কি সোন্দর পৃষ্ঠা! ক্কি সোন্দর বাইন্ডিং! কত্তো চ্ছবি! আরো এট্টু বেশি লোভ হলো। কিনেই ফেললাম।
আশি, নব্বই এবং শূন্য দশকে “আ কমন রিডার” নামক বই-বিষয়ক একটা মেইল-অর্ডার ক্যাটালগ খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো আমেরিকায়। এই ক্যাটালগের সাবস্ক্রিপশন নিলে, বাড়িতে বসে প্রতিমাসে প্রচুর নতুন এবং পুরোনো বইয়ের খবর পাওয়া যেত। ইন্টারনেটের (এবং Goodreads-এর) আগেকার যুগে, বলাই বাহুল্য, এমন ক্যাটালগের চাহিদা থাকাই স্বাভাবিক। প্রায় তিন লক্ষ ক্যাটালগ বিক্রি হতো প্রতি বছর। এই বইটি যিনি লিখেছেন, সেই জনপ্রিয় ক্যাটালগটার সম্পাদক ছিলেন তিনি। বই বিক্রির ব্যবসাও করেছেন দীর্ঘসময়। সবচেয়ে বড় কথা, ইনি নিজেই একজন বইবুভুক্ষু বইউন্মাদ মানুষ। সুতরাং লেখকের বায়োডেটা দেখে বেশ ভরসা হলো।
বইটা খুলে তো আমি একদম ঝুপ্পুশ ডুবে গেলাম! দিনচারেক পরে বই থেকে মুখ তুলে, বেশ জোরেই বললাম, হেব্বি লিস্ট বানিয়েছে মাইরি! মা আমার গলা শুনে বললো, কীসের লিস্ট বানিয়েছে মাইরি? গত কয়েকদিন তোর কোনো খোঁজখবর নেই ক্যানো মাইরি?
একহাজারটা বইয়ের মধ্যে অনেকগুলোই আমার পড়া... ইয়ে মানে, অনেকগুলোরই নাম শুনেছি আগে। বিষয় সেটা নয়। লিস্টে থাকা প্রতিটা বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে একটা করে নাতিদীর্ঘ রচনা লিখেছেন লেখক। সেই রচনাগুলো অতি উপাদেয়। আর একটা ব্যাপার হলো— বৈচিত্র্য। বাচ্চাদের বই, উপন্যাস, ছোটোগল্প, নাটক, কবিতা, ভ্রমণকাহিনি, রহস্যরোমাঞ্চ, ফ্যান্টাসি, সাইফাই, প্রবন্ধ। কোনো গোত্রই বাদ দেননি। কত নতুন বইয়ের নাম যে জানতে পেরেছি! নামের পাশাপাশি সেইসব বইয়ের ইতিহাস-ভূগোল-জীবনবিজ্ঞান-ভৌতবিজ্ঞানও জানতে পেরেছি। সঙ্গে আছে অজস্র ছবি। তাছাড়া, শুধু ১০০০টা বইতেই শেষ নয়। প্রতিটা বইয়ের ব্যাপারে আলাপ করার সময় একই ধাঁচের আরো চারপাঁচছয়সাতটা বইয়ের খবর দিয়েছেন। কোনো বইয়ের ভালো অডিওবুক থাকলে, সেটাও জানিয়েছেন। সিনেমা থাকলে, খোঁজ দিয়েছেন। সবমিলিয়ে, চমৎকার একটা বই! এরকম বই তো আগা থেকে গোড়া একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা সম্ভব নয় (বইটার পৃষ্ঠাসংখ্যাও প্রায় ১০০০)। মাঝেমাঝে উল্টেপাল্টে দেখি। প্রতিবারই নতুন কিছুর খবর পাই। প্রতিবারই পুলকিত হই।
শুধু পুলক নয়, একটু আফসোসও হয়। ইশ, বাংলা বইয়ের ব্যাপারে এমন একটা বই যদি কেউ লিখতো!
“তমস” শব্দের অর্থ হলো নিকষ অন্ধকার। মানুষের মনের অন্ধকার। যে-সমাজে মানুষ বসবাস করে সেই সমাজের অন্ধকার।
এমনিতে বলা হয়, মানুষ নাকি সামাজিক প্রাণী। সৌভাতৃত্ব, সামাজিকতা, সহানুভূতি, সাম্য, সহযোগিতা, সম্প্রীতি— এরকম অনেক শব্দ তুলসীপাতার মতো ধুয়ে ধুয়ে রাখা হয়। কিন্তু এই শব্দগুলো এতোটাই ঠুনকো যে সামান্য অভিঘাতেই এরা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এই শব্দগুলো নিয়ে মানুষ যখন বড় বড় বাতচিত করে, আড়ালে দাঁড়িয়ে ইতিহাস মুচকি মুচকি হাসে।
উপমহাদেশের ইতিহাসে দেশভাগ শুধু যে একটা দুঃখজনক ঘটনা ছিলো তা-ই নয়, এটা ছিলো একটা হতবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা। দীর্ঘদিন-যাবৎ পাশাপাশি বসবাস করা শান্তিপ্রিয় প্রতিবেশীরা যখন পরস্পরকে বুভুক্ষু শেয়াল-কুকুরের মতো আক্রমণ করে, শুধুমাত্র আরেকটা ঠুনকো শব্দের দোহাই দিয়ে, যে-শব্দটার নাম “ধর্ম”, তখন হতবাক হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না।
এমনিতে তো ধর্মের উপকারিতা, ধর্মের শক্তি, ধর্মের কল্যাণ, ধর্মের উপযোগিতার খুব একটা প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু দেশভাগের মতো ঘটনায় বেশ বুঝতে পারা গেছিলো, হ্যাঁ... হেব্বি পাওয়ারফুল জিনিস বটে ধর্ম!
ভীষ্ম সাহনির এই আইকনিক হিন্দি উপন্যাসটি খুব সোজাসাপটা ভঙ্গিতে রচিত। ঘটনাস্থল : অবিভক্ত পাঞ্জাব প্রদেশের একটি ছোটো শহর। আসন্ন দেশভাগের প্রেক্ষাপটে ঘটমান সাম্প্রদায়িক-দাঙ্গার বিভৎসতায়, মানুষের পাশবিকতায়, তিনি দার্শনিকতা কিংবা কার্যকারণসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেননি। শুধুই নির্বিকার বর্ণনা দিয়ে গেছেন। এই নিস্পৃহ শৈলীই বোধহয় এই উপন্যাসটি জনপ্রিয় হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ। এই উপন্যাসের আরো একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, লেখক কোনো একটি বিশেষ পক্ষ অবলম্বন করেননি।
নিকষ অন্ধকারে সব পক্ষের মুখই তমসাবৃত হয়ে যায়। যাদের নিয়ে কাহিনি রচিত হয় তাদের মুখ। যিনি সেই কাহিনি রচনা করেন তাঁর মুখ। যারা সেই কাহিনি পাঠ করেন, সেই পাঠকদের মুখও। সব্বার মুখ। দেশভাগ বিষয়ে যেকোনো ভাষায় লেখা বইয়ের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পঠিত এবং আলোচিত উপন্যাস এটি। পরিচালক গোবিন্দ নিহালানি একটি চমৎকার টেলিফিল্মও তৈরি করেছিলেন এই উপন্যাসের গল্পকে অবলম্বন করে। মূল হিন্দি থেকে উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অবশ্যপাঠ্য একটি উপন্যাসের সাবলীল অনুবাদ!
অনুবাদক দুজনের একজন কবি, আরেকজন পুলিশ। মদ খেতে খেতে এবং পুকুরে মাছ ধরতে ধরতে তাঁরা অনুবাদের কাজ করেছেন। যুগলবন্দির এই খবর শুনে মনে হয় না গালিব খুব খুশি হতেন। অনুবাদের ছিরি দেখে তো নিশ্চয়ই আরো না-খুশ হতেন।
সম্মুখে রাখো মদের পাত্র এবং মদিরা যতনভরেতারপর দেখো, কেমন মুখর আমার মুখের বাক্যি ঝরে।
হুয়ি তমন্না বেতাব জব সাকি ভাগ গ্যয়ি ম্যায়খানা ছোড়কে ইয়া রব, ইয়ে দোনো মিলকে ক্যায়সা হাল কিয়া তেরা, গালিব।
অদ্ভুত সুন্দর উপন্যাস লিখেছেন বিমল কর। শেষ হওয়ার পরেও অনুভূতির রেশ এতটাই রয়ে গেছে, খুঁটিয়ে বিশেষ কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। তবু সামান্য কিছু লিখে রাখা দরকার।
বিমল করের গদ্যভাষা, বরাবরের মতোই, ব্যতিক্রমী। অনুপম। মানুষের মন যদি একটা জটিল বিষয় হয়ে থাকে, তবে তো এই উপন্যাসের বিষয়বস্তুকে জটিল বলতে হয়। পূর্ণতার সন্ধানে মানুষ তার জীবন অতিবাহিত করে। জীবনকে সম্পূর্ণরূপে পেতে চায়। উপভোগ করতে চায়। কিন্তু হিসেব মেলাতে বসলে দেখা যায়, অপ্রাপ্তি, অতৃপ্তি আর রিক্ততায় ভরে থাকে মানুষের জীবন। অপূর্ণতায় ভরে থাকে।
নিরাসক্ত, আত্মগত ভঙ্গিতে এই কাহিনি আমাদের শুনিয়েছেন বিমল কর। গভীর এবং শান্ত তাঁর পর্যবেক্ষণ। প্রকৃতির বর্ণনা এত সুন্দর, যেন হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যায়। উপন্যাসটির পটভূমি - বিহারের হাজারিবাগ অঞ্চল। এই অঞ্চলে যারা গিয়েছেন, তারা আরো ভালো বুঝবেন এই ব্যাপারটা। যদিও এই গল্প প্রকৃতির নয়। মানুষের। তিনজন নরনারীর প্রেম এবং প্রেমহীনতার গল্প। প্রেমের মধ্যে দিয়েও তো আমরা সেই পূর্ণতাকেই অন্বেষণ করি, তাইনা?
Though nothing can bring back the hour
Of splendour in the grass, of glory in the flower,
We will grieve not, rather find
Strength in what remains behind.
(Wordsworth)
“গোলকধাম রহস্য” গল্পের শুরুতে মহাভারত প্রসঙ্গে তপেশরঞ্জন মিত্তির বলেছিলো, “এ হলো একধার থেকে ননস্টপ ভূরিভোজ। গল্পের পর গল্পের পর গল্প।” তপেশরঞ্জন ওরফে তোপসের এই কথা শুনে তার কাজিন-ব্রাদার ফেলু মিত্তির উল্লসিত হয়ে এই বইকে “আনপুটডাউনেবল” আখ্যা দিয়েছিলেন। “যে বই একবার পড়ব বলে পিকআপ করলে আর পুট-ডাউন করবার জো নেই!” যদিও তিনি যেটা পড়ছিলেন, সেটা ছিলো থানইঁট সাইজের কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত। কালীসিঙ্গির মহাভারত আমি একবার ট্রাই করেছিলাম। সামলাতে তো পারিই নি, উল্টে ল্যাজে-গোবরে হয়ে গেসলুম।
কালীপ্রসন্ন সিংহের দুই-খণ্ডের মহাভারত এমনিতেই সেই ঊনবিংশ-শতক স্টাইলের তৎসমবহুল পুরোনো বাংলায় লেখা। রেলগাড়ির মতো ইয়া লম্বা লম্বা বাক্য। তার উপর মহাভারতের কিসসার তো কোনো অন্ত নেই। একই কাহিনি চোদ্দোবার বলা হয়েছে। বেশিরভাগ কাহিনির সঙ্গে মূল গল্পের কোনো সংস্পর্শ নেই। সংস্পর্শ থাকলেও সেই সংস্পর্শের বিষয়টা আবিষ্কৃত হয়েছে চারশো-বত্তিরিশ পৃষ্ঠা পরে গিয়ে। চরিত্রদের সংখ্যারও কোনো গোনাগুন্তি নেই। গল্প ছাড়াও আরো অনেক কিছু আছে। দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি, কূটনীতি, রাজনৈতিক তত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, আরো গুচ্ছের সব কঠিন কঠিন ব্যাপার-স্যাপার। প্রথমখণ্ডের ২৬.৩২% এগিয়েই মুন্ডু খামচে বসে থাকার মতো অবস্থা। সেল্ফ-কনফিডেন্সের সোয়া-বারোটা বেজে গেছিলো।
সেই কবে ছোটোবেলায় উপেন্দ্রকিশোরের মহাভারত পড়েছিলাম। রামায়ণ আর মহাভারত যদিও আলাদা করে পড়তে হয়না ভারতীয়দের। বিশেষ করে রামায়ণ। প্রি-ইনস্টলড সফটওয়ারের মতো, জন্মের সময় থেকেই এই গল্প আমাদের মগজের মাদারবোর্ডে চিপকানো থাকে। পৌনে-দুই বছরের পুঁচকে নাকেশিকনি ছোঁড়াকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, রামচন্দ্রের শত্তুর কে? সেও আধো উচ্চারণে ঠিক ঠিক জবাব দেবে : রাবণ। রামচন্দ্রের বউ? - হিহি, সীতা।
কিন্তু উপেন্দ্রকিশোর তো অল্পবয়েসিদের কথা চিন্তা করে মহাভারত লিখেছিলেন। খোকাখুকুদের মন যাতে দূষিত না-হয় সেকথা ভেবে সমস্ত “অ্যাডাল” প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছেন। অনেক গুরুগম্ভীর বিষয় ছেঁটে দিয়েছেন। শরশয্যায় শুয়ে পিতামহ ভীষ্ম কাকে কাকে কী কী পরামর্শ দিয়েছেন সেই জটিল কথাবার্তা শুনলে শিশুরা তো মনে মনে বলবে, অ্যাম্মা ক্বী বোরিং গল্প মাইরি ধুস্ আমি খেলতে গেলাম ঝন্টু তোর ব্যাট বের কর। তাই ওই বইতে ওইসব কিছুই নেই। কিন্তু আমি তো এখন বড় হয়ে গেছি! কালীপ্রসন্নও মুখ বাঁকাচ্ছেন আমার বুদ্ধিশুদ্ধির অভাব দেখে। তাইলে কি মহাভারতটা ভালো করে পড়াই হবে না আমার?
ঠিক এমনি সময়ে, এন্টার দ্য রাজশেখর দ্য বসু! এর আগে তাঁর হাসির গপ্পো পড়ে আঁকুপাঁকু হেসেছি অনেক। হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ হ্যাহ হাসতে হাসতে হঠাৎ চোখে পড়লো : আরে! ভদ্রলোক তো বিখ্যাত অভিধানও সংকলন করেছেন। “চলন্তিকা”। অলরাউন্ডার নাকি? তারও পরে একদা হাতে এলো তাঁর লেখা মহাভারত। আমার সব ছ্যাবলামি ফুলস্টপ হয়ে গ্যালো। আমি মহাভারত পড়লাম। কালীপ্রসন্নের দুইখণ্ডের দুটো থানইঁটকে উনি ওস্তাদের মতো পালিশ করে একখণ্ডের সুদৃশ্য শিল্পবস্তুতে পরিণত করেছেন। আমি তখনও বুদ্ধদেব বসু পড়িনি। মুজতবা আলি পড়িনি। শঙ্খ ঘোষ পড়িনি। বাংলা গদ্যের বলিষ্ঠ সৌকর্যে আমার প্রাণ যেন ভরে গ্যালো। প্রথমবারের জন্যে।
মহাভারতকে বলা হয় পৃথিবীর দীর্ঘতম মহাকাব্য। পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোর অন্যতমও বটে। হিন্দুধর্মের একটা প্রধান আকরগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হলেও আমি মহাভারতকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করিনা। একটা কথা সত্যি, মহাভারতের ভেতরেই আছে “শ্রীমদ্ভগবতগীতা”, যে-বইটি হিন্দু বেদান্ত-দর্শনের সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎস হিসেবে মান্যতা পেয়ে এসেছে বরাবর। কিন্তু মহাভারতের বিশালতাকে শুধুমাত্র একটি ধর্মের চৌহদ্দিতে আটকে রাখার চেষ্টা করা উচিত হবে না, চেষ্টা করে লাভও হবে না। মহাভারতের আবেদন সর্বজনীন। কোনো বিশেষ ধর্ম নয়, একটি বৃহৎ অঞ্চলের সম্মিলিত সংস্কৃতি ও সভ্যতার দীর্ঘকালীন লৌকিক ইতিহাস এটি। অধুনা-প্রচলিত আনুষ্ঠানিক পৌত্তলিক ধর্মের সংগঠন হয়েছে আরো অনেক পরে।
মূল মহাভারতের বিস্তারিত আলোচনা করার পরিসর এটা নয়। (আমার পক্ষে সম্ভবও নয়!) আমি বরং রাজশেখর বসুর ভার্শনটার ব্যাপারে আর মাত্তর চাট্টি কথা বলে আজকের বক্তিমে শেষ করবো আজ্ঞে। রাজশেখর বসুর মহাভারতের সবচেয়ে বড় প্লাসপয়েন্ট হলো, মূল মহাভারতের একটা উপাখ্যানও উনি বাদ দেননি। একটা প্রসঙ্গও হাপিস করেননি। এমনকি প্রচলিত দার্শনিক অংশগুলোও দিব্যি রেখে দিয়েছেন (যেমন “গীতা”)। উনি শুধু মূল সংস্কৃত মহাভারতের অতিরিক্ত কোলেস্টরল এবং ফ্যাটকে ট্রেডমিল-দ্বারা বর্জন করিয়ে সিক্স-প্যাক সারবস্তুটুকু পরিবেশন করেছেন। যাতে আমার মতো ধৈর্যহীন, বুদ্ধিশুদ্ধিহীন ব্যক্তিরাও মহাভারত-পাঠের অভিজ্ঞতা এবং আনন্দ লাভ করতে পারে।
ভাগ্যিস রাজশেখর বসু ছিলেন। তাই আমিও এখন গুরুগম্ভীর আলোচনায়, বিজ্ঞবাগীশ কলার তুলে, স্লো-মোশনে জামার হাতা গোটাতে গোটাতে উদাস কিন্তু হেব্বিজ্ঞানী নয়ন মেলে বলতে পারি : তো ইয়ে যেটা বলছিলাম আরকি... গরুড় যদিও সেই বিশাল গাছটার মগডালে বসে আরাম করে গজকচ্ছপ ভোজন করছিলো, কিন্তু গাছের ডাল তো গ্যালো ভেঙে... শেষ পর্যন্ত গন্ধমাদন পর্বতের শৃঙ্গে বসেই ভোজন করতে হলো তাকে, আর কোনো উপায়ও তো ছিলো না বেচারার, তাইনা?
আপনারা যারা রাজশেখর পড়েননি তারা তো আমার কথা কিসুই বুঝবেন না। শুধু বলবেন, হেঁ হেঁ তা তো বটেই, তা তো বটেই...
আর. কে. নারায়ণের লেখা গল্প-উপন্যাস নয়, তাঁর এই আত্মজীবনীটাই প্রথম পড়েছিলাম আমি। চেন্নাই, আগে যে-শহরের নাম ছিলো মাদ্রাজ, যে-শহরে তাঁর ছোটোবেলার অনেকটা অংশ কেটেছিলো, সেই শহরে বসেই পড়েছিলাম বইটা। এমন কাণ্ড ক্যানো করেছিলাম জানিনা। অন্য সব লেখা বাদ দিয়ে সবার আগে লেখকের আত্মজীবনী কে পড়ে?
এইজন্যে যদিও আফসোস হয়নি কখনও। তাঁর উপন্যাস কিংবা গল্প পড়ার সময় মিলিয়ে মিলিয়ে দেখেছি, অনেক উপাদানই নিজের জীবন থেকে নিয়েছেন তিনি। মনে হয়েছে, একজন লেখকের মূল অস্ত্র কল্পনাশক্তি নয়, তাঁর অভিজ্ঞতা। নারায়ণ নিজের জীবনের কাহিনিও শুনিয়েছেন স্বকীয় উপন্যাসের আদলেই। নিচু তারে বাঁধা সরস স্বর। চমক দেওয়ার প্রবণতা নেই একটুও। জীবনের অবশ্যম্ভাবী বিষাদ-বেদনা সেই স্বরের তাল কাটতে পারেনি পুরোপুরি।
প্রিয় মানুষদের আত্মজীবনী পড়তে ভালো লাগে। তাঁদের মতো হতে হবে, তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা নিতে হবে, এইসব আদর্শ-ফাদর্শগত কারণে নয়। এমনিই। কেমন ছিলো সময়টা। কেমন ছিলো পারিপার্শ্বিক সমাজ। মানুষ। বন্ধুবান্ধব। আলো জল বাতাস। বই পড়তে ভালোবাসতেন? কী কী বই তাঁর জীবন পাল্টে দিয়েছে? অন্তর্মুখী ছিলেন? নারায়ণের সহোদর আর. কে. লক্ষ্মণ আমার খুব প্রিয় কার্টুনিস্ট। দুই ভাইই নিজ নিজ সৃষ্টিক্ষেত্রে একইরকম খ্যাতি অর্জন করেছেন। কীভাবে গড়ে উঠেছিলো তাঁর সাহিত্যচেতনা? সাহিত্যসৃষ্টির উদ্দীপনা? কীভাবে তৈরি হয় একটা উপন্যাস? কীভাবে সামলেছেন খ্যাতিকে? স্ত্রীর মৃত্যুর পরে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা থেকে মাথা তুলে কীভাবে আবার শুরু করেছিলেন লেখালিখি?
ভেবে দেখলে একটা কথা সত্যি। যে-লেখাগুলোর জন্যে সত্যজিৎ পরবর্তীকালে লেখক হিসেবে খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তালাভ করেছিলেন, ফেলুদা কিংবা প্রোফেসর শঙ্কু কিংবা তাঁর ছোটোগল্পগুলো, এই সবকিছুই তিনি লিখেছিলেন প্রয়োজনের খাতিরে। পারিবারিক পত্রিকা “সন্দেশ” যখন পুনরায় বের হওয়া শুরু হয়, সেই পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরাবার উদ্দেশ্যে রায়পরিবারের অনেক সদস্যকেই দুহাত খুলে লিখতে হয়েছিলো। প্রধান-সম্পাদক সত্যজিৎকে একটু বেশিই লিখতে হয়েছিলো। আরো পরে, তাঁর স্ত্রীর আত্মজীবনী “আমাদের কথা”-তে দেখতে পাই সত্যজিতের অকপট স্বীকারোক্তি : সিনেমা থেকে উপার্জন নয়, তাঁদের সংসার চলতো সত্যজিতের লেখা বইগুলোর রয়ালটির টাকায়। ভেবে দেখলে, তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলো কিন্তু পুরোপুরি এই গোত্রের নয়। অর্থাৎ গল্প-উপন্যাসের মতো ফরমায়েশি নয়। সিনেমা (এবং পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত) ছিলো সত্যজিতের সবচেয়ে আগ্রহের বিষয়। অথচ সিনেমা বিষয়ে খুব বেশি লেখার সুযোগ তিনি পাননি। সিনেমা নির্মাণ করতেন সৃজনশীল সৃষ্টির উদ্দীপনায়। গল্প লিখতেন কিছুটা কর্তব্যের ডাকে, কিছুটা জীবিকার প্রয়োজনে। গুরুগম্ভীর সিরিয়াস প্রবন্ধ লেখার সময় কই? কিন্তু সত্যজিতের সৃষ্টিভাণ্ডারের দিকে চোখ বোলালে আমরা টের পাবো, খুব সামান্য কোনো কাজে হাত দিলেও তিনি সেই কাজটা দায়সারাভাবে করতেন না। “দায়সারা” শব্দটা তাঁর অভিধানে ছিলোই না। উদাহরণস্বরূপ, অনামা অখ্যাত “শারদীয় সোভিয়েত বিপ্লব পরিচয়” নামের পত্রিকাতে তিনি যখন “সোভিয়েত চলচ্চিত্র” নামের প্রবন্ধটি লিখেছেন, নিজের অভিজ্ঞানের পুরোটা ঢেলে দিয়েছেন। অথচ এই প্রবন্ধটি তাঁকে পরিচিতি দ্যায়নি, পয়সা দ্যায়নি, কিছুই দ্যায়নি।ঠিক এই কারণেই সত্যজিতের প্রবন্ধগুলো আমার কাছে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। অল্পবয়েসে “বিষয় চলচ্চিত্র” পড়েছিলাম। সিনেমার তখন কিছুই বুঝতাম না (এখনও বুঝিনা যদিও)। কিন্তু জটিল বিষয় নিয়ে যিনি ইচ্ছে করলেই পাণ্ডিত্য ফলাতে পারতেন, লম্বা লম্বা তত্ত্বকথা লিখতে পারতেন সহজেই, সেই মানুষটা সযত্নে পরিহার করেছেন পণ্ডিতি করার লোভ। সারাজীবন। আজীবন। তাই “চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে” নামক মাত্র দুইপৃষ্ঠার রচনাতে তিনি আমার মতো গণ্ডমূর্খকে এমন অনেককিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন যেটা হয়তো এই বিষয়ের একটা গোটা বই পড়লেও আমি বুঝতে পারতাম না। “সংলাপ যদি স্বাভাবিক না হয় তাহলে অভিনয় স্বাভাবিক হওয়া মুশকিল”— হঠাৎ শুনতে খুব সামান্য মনে হলেও, সিনেমার নির্মাণগত দিকটা নিয়ে যারা বিন্দুমাত্রও আগ্রহী, তারা এই কথাটার মূল্য বুঝতে পারবেন! এরকম মূল্যবান উদাহরণ আমি ভুরি ভুরি দিয়ে যেতে পারি।অথচ মানুষটা একটু সময় নিয়ে, একটু যত্ন নিয়ে, একটু আরাম করে, প্রবন্ধ লেখার সুযোগ পেলেন না। এটা একটা বড় আফসোস। তাঁর প্রবন্ধগুলো পড়লেই বোঝা যায়, হাজাররকম কাজের ফাঁকে চটজলদি সময় বের করে নিয়ে লেখা হয়েছে সেগুলো। তাই সিংহভাগ প্রবন্ধই দৈর্ঘ্যে যৎসামান্য। প্রবন্ধের ভাষাতে যদিও সত্যজিতের ট্রেডমার্ক সহজতা এবং মিতবাচনের চিহ্ন আছে। প্রতিটা রচনাতেই কিছু-না-কিছু নতুন অন্তর্দৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়। এমনকি তাঁর নিজের তৈরি সিনেমাগুলো নিয়ে ছোটো ছোটো যে লেখাগুলো লিখেছেন, সেখানেও তিনি পাঠকের সময় ফালতু নষ্ট করেননি। নতুন কোনো আঙ্গিকে চিনিয়েছেন তাঁর চিরচেনা ছবিকে। “অপুর সংসার” তৈরির সময় অপু চরিত্র এবং অপু-অপর্ণার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে দেড়পৃষ্ঠার একটা নোট লিখে দিয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। এই নোটটি যেন সত্যজিতের পুরো জীবনকে, পুরো প্রতিভাকে, পুরো মানুষটাকে, এক লহমায় চিনিয়ে দ্যায়। সহজ, মিতবাক, স্পষ্ট, প্রাঞ্জল, কিন্তু চিন্তার গভীরতায় ও বক্তব্যের বিশ্লেষণে ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত। অনন্য!তাঁর প্রবন্ধ নিয়ে আরো অনেক কথা বলে ফেলা যায়। আমার বিশেষভাবে ভালোলাগা প্রবন্ধগুলো নিয়ে আরো কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে। তাঁকে নিয়ে আমার কথার শেষ নেই। চারশোর কিছু বেশি পৃষ্ঠার এই বইটিতে তাঁর লেখা শুধু বাংলা প্রবন্ধগুলোই স্থান পেয়েছে। তাঁর ইংরিজি মৌলিক প্রবন্ধগুলো, যা আপাতত দুটো আলাদা আলাদা বইতে সংকলিত হয়েছে, [b:Our Films, Their Films 670580 Our Films, Their Films Satyajit Ray https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1363702482l/670580.SY75.jpg 656613] এবং [b:Deep Focus 13385130 Deep Focus Reflections On Cinema Satyajit Ray https://i.gr-assets.com/images/S/compressed.photo.goodreads.com/books/1337760534l/13385130.SX50.jpg 18615535]— সেগুলোও অসামান্য, অসাধারণ— বলাই বাহুল্য! ইংরিজি এবং বাংলা এই প্রবন্ধগুলোর মধ্যে দিয়ে সত্যজিতের একটা ভিন্ন, অপরিচিত রূপ আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়। একজন চিন্তাশীল সত্যজিৎ। ভাবুক সত্যজিৎ। যে-বিষয়টা আমরা সবচেয়ে ভালোবাসি, আমাদের প্রাণের সবচেয়ে কাছাকাছি, সেই বিষয়ে কথা বললেই তো সবচেয়ে ভালো চিনতে পারা যায় আমাদের, তাইনা?একেক সময় মনে হয় যদি সময় পাই, অবকাশ আসে, তখন শুধু বাখ মোৎজার্ট বেটোফেন শুনবো!
(সাড়ে-তিন তারা)
এই ক্ষুদ্রকায় উপন্যাসটা যখন লেখা হচ্ছিলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তখনও শেষ হয়নি। উপন্যাসটির বিষয়বস্তুর সঙ্গে যুদ্ধের যোগসূত্র আছে বটে, কিন্তু এই কাহিনি আদৌ যুদ্ধকেন্দ্রিক নয়। প্রথমেই যে-বিষয়টা জানতে পেরে অবাক লেগেছে, বইটি লেখার সময় লেখিকার বয়স ছিলো মাত্র ২৪ বছর। এই বয়সে এত পরিণত উপন্যাস লেখা কীভাবে সম্ভব? এবং এত গভীর বিষয়বস্তুকে নিরীক্ষা করাও কীভাবে সম্ভব? লেখিকার প্রথম উপন্যাস এটি।
ক্রমাগত বোমাবর্ষণের অভিঘাতে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন একজন সৈনিক। সেই সময়কার ভাষায় যাকে বলে shell-shocked হওয়া। তিনি বাড়ি ফিরে এসেছেন, কিন্তু বিগত পনেরো বছরের ঘটনাক্রমের ব্যাপারে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন। ভুলে গেছেন দীর্ঘদিনের বিবাহিত স্ত্রীর কথা। মৃত পুত্রসন্তানের কথা। তাঁর শুধু মনে আছে পনেরো বছর আগেকার এক হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার স্মৃতি। সেই “কিশোরী” প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। প্রেমিকা যদিও এখন বিবাহিত এবং বিগতযৌবনা।
একজন স্মৃতিভ্রষ্ট পুরুষ এবং তাঁকে ঘিরে তিনজন নারীর মানসিক পরিস্থিতির গল্প এটি। ইংল্যান্ডের অপরূপ গ্রাম্য পরিবেশের পটভূমিকায় আর্থসামাজিক শ্রেণিব্যবস্থা, ভালোবাসা এবং বিষাদের গল্প এটি। অদ্ভুত লিরিক্যাল ভাষায় লেখা এই উপন্যাসটি পড়বার সময় অখণ্ড মনোযোগের প্রয়োজন হয়। কিছু কিছু অনুচ্ছেদ দুবার পড়ে দেখতে হয়। তাড়াহুড়ো করলে অসুবিধে হয়। শেষ পৃষ্ঠা উল্টে ফেলার পরে পাঠকের মনে কিছু প্রশ্ন দেখা দ্যায়। আমরা সবাই কিছু-না-কিছু ভুলে যেতে চাই।
One forgets only those things that one wants to forget.
ক্যানো ভুলে যেতে চাই আমরা জীবনের সেই ঘটনাগুলো?
সাড়ে-তিন তারা।
এই উপন্যাসটা দিয়েই এবছরের “পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা” পড়া শুরু করলাম। অনেকদিন পরে স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর লেখা পড়লাম। বেশ ভালো লাগলো।
সময় ষোড়শ শতক। পর্তুগিজ জলদস্যুরা দক্ষিণবঙ্গের ভাটি অঞ্চলের ত্রাস ছিলো তখন। বিখ্যাত বারো-ভুঁইয়াদের অন্যতম, রাজা প্রতাপাদিত্য ছিলেন যশোরের তৎকালীন শাসক। তাঁর রাজ্য দখল করতে ক্রমশ এগিয়ে আসছেন বাদশাহ আকবরের সেনাপতি মানসিংহ। ঐতিহাসিক পটভূমিতে লেখা গল্পটা শুরু থেকেই টানটানভাবে জমে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা, জলদস্যুদের নৃশংসতা, বাহুবলের বিরুদ্ধে মস্তিষ্কের লড়াই, সবশেষে অশুভের পরাজয়। বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবে এবং দ্রুতগতিতে পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে কাহিনি। ক্লাইম্যাক্সটাও বেশ জমজমাট। সবমিলিয়ে উপভোগ করেছি স্মরণজিতের এই কিশোর-উপন্যাসটি।
এরপর কোনটা পড়া যায়?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে?
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনের কতটুকু মিথ, আর কতটুকু সত্যি, কতটুকু কুয়াশা, আর কতটুকু দ্বিপ্রহরের প্রখর সূর্যালোক— এইসব জটিল ধাঁধার কিছুটা সমাধান হয়েছে, কিছুটা আজও হয়নি, কিছুটা হয়তো কোনোদিন হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে তাঁর মতো বৈচিত্র্যময় এবং ঘটনাবহুল জীবনের উদাহরণ আর একটিও নেই।
সুভাষচন্দ্র ছিলেন আজন্ম-বিপ্লবী। পারিবারিক স্বচ্ছলতা এবং নিজস্ব প্রতিভার স্পর্ধায় তিনি অতি অনায়াসে একটি আরামের জীবন বেছে নিতে পারতেন। ইংরেজ রাজত্বের সবচেয়ে উঁচুপদের চাকরি পাওয়ার জন্যে যে ICS পরীক্ষা দিতে হতো, সেই পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন। অতি দুর্লভ এবং আপাত-লোভনীয় সেই চাকরিতে তিনি যোগদান করেননি, পরাধীন দেশের প্রতি কর্তব্যের আহ্বান তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে অন্য ভবিতব্যের দিকে।
কর্মজীবনের শুরুই হয়েছে যাঁর এরকম অবিশ্বাস্য ত্যাগের মধ্যে দিয়ে, সেই মানুষটার বাকি জীবনের রূপরেখা আমরা সহজেই আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে দুরন্ত কল্পনাও তাঁর জীবনের বাস্তব কাহিনিকে স্পর্শ করতে পারেনা। অতিমানবিক অকল্পনীয় এক নাটকীয় জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
যখন মূলধারার রাজনীতি করেছেন, তখন স্বয়ং গান্ধীজির নির্দেশ অমান্য করেছেন বারবার। কংগ্রেসের রাজনৈতিক দর্শন যখন ডুবে আছে অহিংসার কোমল নরম এঁটেল মাটির কাদার গভীরে, সেই সময় তিনি বারবার বলেছেন, হাত পেতে ভিক্ষা চাইলে স্বাধীনতা লাভ করা যাবেনা। প্রয়োজন সার্বিক সংগ্রামের। তাঁর নিজের কথায় : “No real change in history has ever been achieved by discussions.”
এই বিকল্প “উগ্র” মনোভাবের কারণে প্রায় প্রত্যেক প্রথমসারির কংগ্রেস নেতার বিরাগভাজন হয়েছিলেন তিনি। শুধু ব্রিটিশরাই তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেনি, নিজের দলেও তাঁকে ব্রাত্য করে রাখার, তাঁকে মাথা তুলতে না-দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিলো। ব্রাত্য হয়েছেন তিনি মৃত্যুর পরেও। রিচার্ড অ্যাটেনবরো পরিচালিত বিশ্ববিখ্যাত “গান্ধী” ছবির একটা ফ্রেমেও সুভাষচন্দ্রকে দেখা যায়নি। গান্ধীর জীবনে সুভাষচন্দ্র নেই, ভাবা যায়!
অজস্র বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও একটা অবিশ্বাস্য জীবন যাপন করেছিলেন তিনি, সেই জীবনের তুলনা সমগ্র পৃথিবীর মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাঁর জীবনের ভরকেন্দ্র ছিল নিজের দেশমাতৃকার প্রতি অকপট শ্রদ্ধা। আর কিচ্ছু না! আর কোনোকিছু কিংবা কোনো মানুষের প্রতি তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন না। কাউকে পরোয়া করেননি। কোনো বাধাবন্ধন সহ্য করেননি। ভেতো, ভীরু, ক্ষমতার-পদলেহনকারী বাঙালির ঘরে তাঁর মতো সিংহের জন্মগ্রহণ একটা অকল্পনীয় ঘটনা!
বাঙালি তাঁকে সম্মান জানিয়েছে, মাথায় তুলে নেচেছে। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কাউকে বাঙালি এতটা উঁচু বেদীতে প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু তাঁর জীবন নিয়ে আজ পর্যন্ত একটাও পরিপূর্ণ উপন্যাস লেখা হয়নি বাংলাভাষায় (রবীন্দ্রনাথের জীবন নিয়েও নয়)। এই উপন্যাসটা মারাঠি ভাষায় রচিত। আমি পড়েছি বাংলা অনুবাদে। যেরকম নিষ্ঠার সঙ্গে, গবেষণার পরিশ্রমে, সাবলীল সজীব গদ্যে, এই উপন্যাসটা লেখা হয়েছে, তার জন্যে লেখকের প্রতি শুধু আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানানো যায়! বইয়ের শেষে “তথ্যসূত্র” ও “গ্রন্থপঞ্জী” অংশদুটিতে চোখ বোলালে তাজ্জব হতে হয়।
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে কেউ কেউ উল্কার সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু তিনি উল্কা ছিলেন না মোটেও। একটি প্রজ্জ্বলন্ত মশাল ছিলেন। পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে মশালটা আজীবন দাউ দাউ করে জ্বলেছে। কেউ তাঁকে নেভাতে পারেনি! তাঁর জীবনের কথা জানতে পেরে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ হয়। আবার পাশাপাশি এটাও মনে হয় যে, সেই মশালের একটা ছোট্ট স্ফুলিঙ্গের অস্তিত্বও কি আজকের বৃহত্তর বাঙালি সমাজে খুঁজে পাওয়া যাবে?
এই বইটাকে দুভাবে বিচার করা যেতে পারে। লেখক ওয়াল্টার আইজাকসন কীভাবে লিখলেন বইটা। এবং, যাঁর ব্যাপারে লিখলেন তাঁকে কতটা চিনতে পারলাম। আমি যখন বইটা পড়েছিলাম... ভুলে গেছি কবে পড়েছিলাম! (খুব বেশিদিন আগে নয়) ...যাই হোক, যখন পড়েছিলাম তখনও আমার কাছে অ্যাপেলের তৈরি কোনো বস্তু ছিলো না, এখনও নেই। স্টিভ জবস মানুষটিকে জানবার আগ্রহ থেকে বইটা পড়েছিলাম। স্রেফ একজন “অন্যরকম” মানুষকে জানবার আগ্রহ থেকে।
For the loser now
Will be later to win
For the times they are a-changin'.
(বব ডিলান)
অনেকে ভাববে আদিখ্যেতা। একজন আপাদমস্তক ধান্দাবাজ লোক, প্রায় অসৎ বলা যেতে পারে, টাকা রোজগার করাই যাঁর মূল উদ্দেশ্য (এই ধারণাগুলো পুরোপুরি ঠিক নয় যদিও), তাঁকে জেনে কী লাভ? এইসব কথা মাথায় রেখে এই দারুন বইটা আমিও প্রায় স্কিপ করে যাচ্ছিলাম। ভাগ্যিস করিনি। যারা হন্যে হয়ে “দ্য গ্রেট আমেরিকান বুক”-এর খোঁজ করছেন, তারা এই বইটা পড়ুন। কল্পিত উপন্যাসের চেয়ে বেশি উত্তেজক উপাদান আছে এই লোকটার জীবনে। বইটা পড়লে আরো দুটো জিনিস জানা যায়। এক। ক্যাপিটালিস্ট মার্কেট-ইকোনমি কীভাবে কাজ করে সেটা হাতেকলমে, প্রায় ল্যাবরেটরির ভেতরে বসে, জানতে পারা যায়। দুই। আমরা সবাই, নিজেদের অজান্তে, কনজিউমারিজমের সঙ্গে কীভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে আছি/ আরো জড়িয়ে যাচ্ছি, এবং ক্যানো জড়িত হয়ে আছি/ যাচ্ছি, একটু চোখকান খোলা রেখে বইটা পড়লে তার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
মানুষ হিসেবে স্টিভ জবস খুব একটা সুবিধের লোক ছিলেন না। অনেক জঘন্য কাজ করেছেন। জঘন্য বললে বাড়াবাড়ি হবে হয়তো। “অমানবিক” বলা যেতে পারে। (না না, কিছু কাজ তো জঘন্যই বলতে হবে!)। খুব দয়ামায়াহীন লোক ছিলেন। সাংঘাতিক স্বার্থপর ছিলেন। একগুঁয়ে ছিলেন। কাজ হাসিলের জন্যে নিচে নামতে দ্বিধা করতেন না। বাড়াবাড়িরকম পারফেকশনিস্ট ছিলেন (প্রায় প্যাথোলজিক্যাল লেভেলের)। এত খারাপ লোক হওয়া সত্ত্বেও এত বিখ্যাত, এত সফল, এত বড়লোক হলেন কীভাবে? (ভালো গুণ কিছুই ছিলো না?) বইটা যিনি লিখেছেন, তিনি আরো অনেক বিখ্যাত মানুষদের বায়োগ্রাফি লিখেছেন। বেন ফ্র্যাঙ্কলিনের জীবনী লিখেছেন (পড়িনি)। আইনস্টাইনের সম্ভবত সবচেয়ে ভালো জীবনীটা লিখেছেন (আইনস্টাইনের শুধু এই একটাই জীবনী পড়েছি, তবু এই কথাটা ক্যানো বললাম কে জানে)। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সম্ভবত সবচেয়ে ভালো জীবনীটা লিখেছেন (এটা কিন্তু সত্যি বলছি!)।
খুব যত্ন নিয়ে, প্রচুর গবেষণা করে, বিষয়ের গভীরে ঢুকে, বই লেখেন ইনি। বাকি যাঁদের জীবনী লিখেছেন তাঁরা সবাই মৃত মানুষ। স্টিভ জবসের বইটা যখন লিখতে শুরু করেছিলেন, উনি তখনও বেঁচে ছিলেন। মৃত মানুষের জীবনী লেখা সহজ। জ্যান্ত মানুষের জীবনী লিখতে হলে প্রচুর লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে হয়, সাক্ষাৎকার নিতে হয়, ইত্যাদি। এই লেখক এইসব কাজ করেছেন। অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছেন। স্বয়ং স্টিভের সঙ্গেও প্রচুর ঘন্টা বকবক করেছেন। স্টিভের স্ত্রী, ছেলেপিলে... তাদের সঙ্গেও। এরকম একজন জটিল মানুষের জীবনী লেখার কাজটা একেবারেই সহজ ছিল না। বইটা পুরোপুরি নিরপেক্ষ কিংবা পক্ষপাতিত্বহীন নয় যদিও। একটু ইয়ে আছে। কিন্তু স্টিভ জবসের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র বেশ স্পষ্ট বোঝা গেছে বইটা পড়ে। স্টিভ জবসকে নিয়ে, অ্যাপেলের বিজনেস মডেল নিয়ে, প্রোডাক্ট ডেভলপমেন্ট নিয়ে, পরে আরো কিছু বই পড়েছি, কিন্তু এটাই সবচে ভালো বই।